আত্-তারগীব ওয়াত্-তারহীব- ইমাম মুনযিরী রহঃ
২. কুরআন-সুন্নাহর অনুসরণ
হাদীস নং: ৯৫
কুরআন-সুন্নাহর অনুসরণ
অনুকরণ করা হবে সে উদ্দেশ্যে উত্তম কাজের সূচনা করার প্রতি অনুপ্রেরণা এবং বিভ্রান্তির অনুকরণ করা হতে পারে সে আশংকায় মন্দ নীতি উদ্ভাবনের প্রতি ভীতি প্রদর্শন
৯৫. হযরত জারীর (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা পূর্বাহ্নে আমরা রাসূলুল্লাহ্ (সা) -এর নিকট ছিলাম। ইতিমধ্যে গলায় তরবারি ঝুলিয়ে নগ্নদেহে একদল লোক (নবী (সা) এর নিকট) এলো। তারা ছিল কালো ডোরা চাদর ও আবা পরিহিত অবস্থায়। তাদের সবাই ছিল মুযার গোত্রের লোক। তাদেরকে অনাহারক্লিষ্ট দেখে রাসূলুল্লাহ্ (সা) এর চেহারা বিবর্ণ হয়ে গেল এবং তিনি (ঘরে) প্রবেশ করলেন। তারপর বেরিয়ে আসলেন এবং বিলাল (রা)-কে আযান ও ইকামত দিতে নির্দেশ দিলেন। সে মতে তিনি আযান ও ইকামত দিলেন এবং তিনি নবী (সা) সবাইকে নিয়ে সালাত আদায় করলেন। তারপর তিনি ভাষণ দিলেন। তাতে তিনি বললেনঃ "হে মানব মণ্ডলী! তোমরা তোমাদের প্রতিপালককে ভয় কর! যিনি তোমাদের একব্যক্তি হতে সৃষ্টি করেছেন ও যিনি তা হতে তার সংগিণী সৃষ্টি করেছেন, যিনি তাদের দু'জন হতে বহু নর-নারী ছড়িয়ে দিয়েছেন এবং আল্লাহকে ভয় কর যাঁর নামে তোমরা একে অপরের নিকট যাঞ্চা কর এবং সতর্ক থাক জ্ঞাতি-বন্ধন সম্পর্কে। আল্লাহ্ তোমাদের উপর তীক্ষ্ণদৃষ্টি রাখেন।" (সূরা নিসা, ৪ঃ ১)
অতঃপর তিনি সূরা হাশরের এই আয়াত তিলাওয়াত করেন:
اتَّقوا الله ولتنظر نفس مَا قدمت لغد
তোমরা আল্লাহ্কে ভয় কর; প্রত্যেকেই ভেবে দেখুক আগামীকালের জন্যে সে কী অগ্রিম পাঠিয়েছে।
" অতঃপর তিনি বললেনঃ তোমাদের প্রত্যেকেরই তার দীনার, তার দিরহাম, তার কাপড়, তার গমের পাত্র ও খেজুর পাত্র হতে দান করা উচিত। এমন কি তিনি বললেন, যদিও এক চিলতে খেজুরও হয়। তিনি (জারীর) বললেন, এক আনসারী তখন এক ঝুড়ি খেজুর নিয়ে এলো- যা বহন করে নিয়ে আসতে সে প্রায় অসমর্থ হয়ে পড়েছিল। তিনি বললেন, অতঃপর লোকেরা একে অন্যের অনুসরণ করতে লাগল। এমনকি আমি দেখলাম, অন্ন ও বস্ত্রের দুটি স্তূপ জমে গেছে এবং দেখলাম (আনন্দে) রাসূলুল্লাহ্ (সা) এর চেহারা ঝলক মেরে উঠল, মনে হচ্ছিল তা যেন স্বর্ণে মোড়ানো। অতঃপর রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন: যে ব্যক্তি ইসলামে কোন উত্তম নীতি প্রবর্তন করবে, তার জন্য রয়েছে তার আমলের সওয়াব এবং তার পর যারা সে আমল করবে, তাদেরও সওয়াব। অথচ এতে তাদের সওয়াব হ্রাস করা হবে না। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি ইসলামে কোন মন্দকাজ প্রবর্তন করবে, তার জন্য রয়েছে তার কাজের গুনাহ এবং পরে যারা একাজ করবে, তাদের গুনাহও। অথচ এতে তাদের গুনাহ কিছুমাত্র হ্রাস করা হবে না।
(ইমাম মুসলিম, নাসাঈ, ইব্ন মাজাহ এবং তিরমিযী সংক্ষিপ্ত কাহিনী সহকারে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।)
অতঃপর তিনি সূরা হাশরের এই আয়াত তিলাওয়াত করেন:
اتَّقوا الله ولتنظر نفس مَا قدمت لغد
তোমরা আল্লাহ্কে ভয় কর; প্রত্যেকেই ভেবে দেখুক আগামীকালের জন্যে সে কী অগ্রিম পাঠিয়েছে।
" অতঃপর তিনি বললেনঃ তোমাদের প্রত্যেকেরই তার দীনার, তার দিরহাম, তার কাপড়, তার গমের পাত্র ও খেজুর পাত্র হতে দান করা উচিত। এমন কি তিনি বললেন, যদিও এক চিলতে খেজুরও হয়। তিনি (জারীর) বললেন, এক আনসারী তখন এক ঝুড়ি খেজুর নিয়ে এলো- যা বহন করে নিয়ে আসতে সে প্রায় অসমর্থ হয়ে পড়েছিল। তিনি বললেন, অতঃপর লোকেরা একে অন্যের অনুসরণ করতে লাগল। এমনকি আমি দেখলাম, অন্ন ও বস্ত্রের দুটি স্তূপ জমে গেছে এবং দেখলাম (আনন্দে) রাসূলুল্লাহ্ (সা) এর চেহারা ঝলক মেরে উঠল, মনে হচ্ছিল তা যেন স্বর্ণে মোড়ানো। অতঃপর রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন: যে ব্যক্তি ইসলামে কোন উত্তম নীতি প্রবর্তন করবে, তার জন্য রয়েছে তার আমলের সওয়াব এবং তার পর যারা সে আমল করবে, তাদেরও সওয়াব। অথচ এতে তাদের সওয়াব হ্রাস করা হবে না। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি ইসলামে কোন মন্দকাজ প্রবর্তন করবে, তার জন্য রয়েছে তার কাজের গুনাহ এবং পরে যারা একাজ করবে, তাদের গুনাহও। অথচ এতে তাদের গুনাহ কিছুমাত্র হ্রাস করা হবে না।
(ইমাম মুসলিম, নাসাঈ, ইব্ন মাজাহ এবং তিরমিযী সংক্ষিপ্ত কাহিনী সহকারে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।)
كتاب السنة
التَّرْغِيب فِي الْبدَاءَة بِالْخَيرِ ليستن بِهِ والترهيب من الْبدَاءَة بِالشَّرِّ خوف أَن يستن بِهِ
95 - عَن جرير رَضِي الله عَنهُ قَالَ كُنَّا فِي صدر النَّهَار عِنْد رَسُول الله صلى الله عَلَيْهِ وَسلم فَجَاءَهُ قوم غزَاة مجتابي النمار والعباء متقلدي السيوف عامتهم من مُضر بل كلهم من مُضر فتمعر وَجه رَسُول الله صلى الله عَلَيْهِ وَسلم لما رأى مَا بهم من الْفَاقَة فَدخل ثمَّ خرج فَأمر بِلَالًا فَأذن وَأقَام فصلى ثمَّ خطب فَقَالَ {يَا أَيهَا النَّاس اتَّقوا ربكُم الَّذِي خَلقكُم من نفس وَاحِدَة} إِلَى آخر الْآيَة {إِن الله كَانَ عَلَيْكُم رقيبا} النِّسَاء 1
وَالْآيَة الَّتِي فِي الْحَشْر
{اتَّقوا الله ولتنظر نفس مَا قدمت لغد} الْحَشْر 81
تصدق رجل من ديناره من درهمه من ثَوْبه من صَاع بره من صَاع تمره حَتَّى قَالَ وَلَو بشق تَمْرَة
قَالَ فجَاء رجل من الْأَنْصَار بصرة كَادَت كَفه تعجز عَنْهَا بل قد عجزت قَالَ ثمَّ تتَابع النَّاس حَتَّى رَأَيْت كومين من طَعَام وَثيَاب حَتَّى رَأَيْت وَجه رَسُول الله صلى الله عَلَيْهِ وَسلم يَتَهَلَّل كَأَنَّهُ مذهبَة فَقَالَ رَسُول الله صلى الله عَلَيْهِ وَسلم من سنّ فِي الْإِسْلَام سنة حَسَنَة فَلهُ أجرهَا وَأجر من عمل بهَا من بعده من غير أَن ينقص من أُجُورهم شَيْء وَمن سنّ فِي الْإِسْلَام سنة سَيِّئَة كَانَ عَلَيْهِ وزرها ووزر من عمل بهَا من غير أَن ينقص من أوزارهم شَيْء
رَوَاهُ مُسلم وَالنَّسَائِيّ وَابْن مَاجَه وَالتِّرْمِذِيّ بِاخْتِصَار الْقِصَّة
وَالْآيَة الَّتِي فِي الْحَشْر
{اتَّقوا الله ولتنظر نفس مَا قدمت لغد} الْحَشْر 81
تصدق رجل من ديناره من درهمه من ثَوْبه من صَاع بره من صَاع تمره حَتَّى قَالَ وَلَو بشق تَمْرَة
قَالَ فجَاء رجل من الْأَنْصَار بصرة كَادَت كَفه تعجز عَنْهَا بل قد عجزت قَالَ ثمَّ تتَابع النَّاس حَتَّى رَأَيْت كومين من طَعَام وَثيَاب حَتَّى رَأَيْت وَجه رَسُول الله صلى الله عَلَيْهِ وَسلم يَتَهَلَّل كَأَنَّهُ مذهبَة فَقَالَ رَسُول الله صلى الله عَلَيْهِ وَسلم من سنّ فِي الْإِسْلَام سنة حَسَنَة فَلهُ أجرهَا وَأجر من عمل بهَا من بعده من غير أَن ينقص من أُجُورهم شَيْء وَمن سنّ فِي الْإِسْلَام سنة سَيِّئَة كَانَ عَلَيْهِ وزرها ووزر من عمل بهَا من غير أَن ينقص من أوزارهم شَيْء
رَوَاهُ مُسلم وَالنَّسَائِيّ وَابْن مَاجَه وَالتِّرْمِذِيّ بِاخْتِصَار الْقِصَّة
হাদীসের ব্যাখ্যা:
এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও শিক্ষামূলক এক হাদীছ। এর দ্বারা উম্মতের প্রতি নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের দরদ ও মমত্ববোধের পরিচয় পাওয়া যায়। আরও জানা যায় যে, তিনি নিজ অনুসারীদের অন্তরে এ গুণ ছড়িয়ে দেওয়া এবং অভাবগ্রস্ত মুসলিমদের অভাব-অনটনে সাহায্য-সহযোগিতা করার প্রতি উদ্বুদ্ধ ও উৎসাহী করে তোলার প্রতি কেমন যত্নবান ছিলেন।
বনু মুদার আরবের একটি প্রসিদ্ধ গোত্র। তাদের একটি দল তরবারিসজ্জিত অবস্থায় নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট উপস্থিত হয়। সম্ভবত সেটা কোনও যুদ্ধের সময় ছিল। কিন্তু তাদের গায়ের কাপড় ছিল নিতান্তই সংক্ষিপ্ত ও অতি সাধারণ। একটা মাত্র কাপড়ে শরীরের নিম্নাংশ কোনওরকমে ঢেকে নিয়েছিল। উপরের অংশ ছিল খোলা। অনাহারে-অর্ধাহারে শরীর ছিল ক্লান্ত-ক্লিষ্ট। তাদের এ অবস্থা দেখে নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের চেহারা বিবর্ণ হয়ে গেল। তিনি ছিলেন দয়ার সাগর। উম্মতের কষ্ট-ক্লেশ দেখলে তাঁর মন ব্যথিত হত। সে বেদনার ছাপ তাঁর চেহারায় ফুটে উঠেছিল। তাদের খাদ্য ও বস্ত্রের অভাব মেটানোর জন্য প্রথমে তিনি নিজের ঘরে গেলেন। এই আশায় যে কিছু পাওয়া যায় কিনা। কিন্তু কিছুই পেলেন না। খালি হাতে ফিরে আসলেন।
ইতোমধ্যে নামাযের সময় হয়ে গেল। হযরত বিলাল রাযি. আযান দিলেন। তারপর ইকামত দিলেন। তিনি সকলকে নিয়ে নামায আদায় করলেন। তারপর এই হতদরিদ্র আগন্তুকদের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য উপস্থিত লোকদের সামনে একটি ভাষণ দিলেন।
তিনি প্রথমে আল্লাহ তা'আলার হামদ ও ছানা পড়লেন। এটাই ছিল তাঁর সাধারণ নিয়ম। ভাষণের আগে আল্লাহ তা'আলার প্রশংসা করে নিতেন। তারপর সূরা নিসার প্রথম আয়াত এবং সূরা হাশরের ১৮ নং আয়াত তিলাওয়াত করলেন।
এ আয়াতদু'টিতে মানুষের প্রতি মমত্ববোধ, আল্লাহর পথে অর্থব্যয় এবং আখিরাতের জন্য প্রস্তুতিগ্রহণের শিক্ষা রয়েছে। সূরা নিসার আয়াতে আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেন-
يَاأَيُّهَا النَّاسُ اتَّقُوا رَبَّكُمُ الَّذِي خَلَقَكُمْ مِنْ نَفْسٍ وَاحِدَةٍ وَخَلَقَ مِنْهَا زَوْجَهَا وَبَثَّ مِنْهُمَا رِجَالًا كَثِيرًا وَنِسَاءً وَاتَّقُوا اللَّهَ الَّذِي تَسَاءَلُونَ بِهِ وَالْأَرْحَامَ إِنَّ اللَّهَ كَانَ عَلَيْكُمْ رَقِيبًا (1)
'হে লোক সকল! নিজ প্রতিপালককে ভয় কর, যিনি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন এক ব্যক্তি হতে এবং তারই থেকে তার স্ত্রীকে সৃষ্টি করেছেন। আর তাদের উভয় থেকে বহু নর-নারী (পৃথিবীতে) ছড়িয়ে দিয়েছেন এবং আল্লাহকে ভয় কর, যার অছিলা দিয়ে তোমরা একে অন্যের কাছে (নিজেদের হক) চেয়ে থাক। এবং আত্মীয়দের (অধিকার খর্ব করা)-কে ভয় কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রাখেন। (সূরা নিসা (৪), আয়াত ১)
মানুষের প্রতি মানুষের কর্তব্য
এর সারমর্ম হচ্ছে সমস্ত মানুষ এক আদি পিতামাতার সন্তান। সে হিসেবে তারা সকলে ভাই-ভাই ও ভাই-বোন। এ ভ্রাতৃত্বের কারণে তাদের একের ওপর অন্যের হক আছে। প্রত্যেকের উচিত অন্যের দুঃখ-কষ্টে তার পাশে দাঁড়ানো। পরস্পরে সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি করে নেওয়াতেই ভ্রাতৃত্বের সার্থকতা। তারপর যদি আবার পরস্পরের মধ্যে আরও বেশি কাছের আত্মীয়তা থাকে, তখন পারস্পরিক দায়িত্ব-কর্তব্য অনেক বেড়ে যায়।
তো এক আদমসন্তান হিসেবে সমস্ত মানুষের প্রতি রয়েছে সাধারণ দায়িত্ব-কর্তব্য এবং নিকটাত্মীয়দের প্রতি রয়েছে বিশেষ দায়িত্ব-কর্তব্য। এ দায়িত্ব-কর্তব্য পালন করা আল্লাহ তা'আলারই হুকুম। তাঁর এ হুকুম কে কতটুকু গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করছে, আল্লাহ তা'আলা তা লক্ষ রাখছেন। আখিরাতে এ সম্পর্কে তিনি জিজ্ঞাসাবাদ করবেন। কাজেই প্রত্যেকের উচিত অন্তরে সে জিজ্ঞাসাবাদের ভয় রাখা। কেননা উত্তর সঠিক না হলে তার পরিণাম বড় ভয়াবহ। তাই প্রথমেই আল্লাহ তা'আলা সতর্ক করেছেন যে, তোমরা তোমাদের প্রতিপালককে ভয় কর। এ ভয়ের দাবি হচ্ছে প্রত্যেকে তুলনামূলকভাবে তারচে' যে বেশি দুঃখ-কষ্টের মধ্যে আছে তার পাশে দাঁড়াবে এবং যতটুকু সম্ভব তার দুঃখ-কষ্ট লাঘবের চেষ্টা করবে।
দ্বিতীয় আয়াতে আল্লাহ তা'আলা প্রত্যেককে হুকুম করেছেন যে, সে যেন আখিরাতের জন্য কতটুকু কী করেছে – সেদিকে লক্ষ রাখে। এ হুকুমের শুরুতেও তাঁকে ভয় করার নির্দেশ দিয়েছেন এবং পরেও এ নির্দেশের পুনরাবৃত্তি করেছেন। এর দ্বারা আখিরাতের লক্ষ্যে কাজ করা যে কত গুরুত্বপূর্ণ সেদিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন।
আখিরাতের জীবনই আসল জীবন। ইহজগত সেই জীবনের শস্যক্ষেত্র মাত্র। এখানে যেমন কর্ম হবে, সেখানে তেমনি ফল পাওয়া যাবে। কর্ম ভালো হলে ভালো ফল এবং মন্দ হলে মন্দ ফল। ভালো ফল ভোগের জায়গা জান্নাত আর মন্দ ফলের জন্য আছে জাহান্নাম। সে বড় কঠিন জায়গা। আল্লাহ তা'আলা ন্যায়বিচারক। সেখানে ফাঁকি দেওয়ার কোনও সুযোগ নেই। প্রত্যেকের কর্ম সম্পর্কে আল্লাহ তা'আলা পূর্ণ অবগত। কাজেই মুক্তি পেতে চাইলে এখনই সতর্কতা দরকার। প্রতিটি কাজ যেন এমনভাবে হয়, যাতে তা দ্বারা আখিরাতের সঞ্চয় হয় এবং সেখানে মুক্তির অছিলা হিসেবে গণ্য হয়। আল্লাহর পথে দান-খয়রাতও সেরকমই এক অছিলা। আল্লাহর বান্দাদের দুঃখ-কষ্ট লাঘবে যা-কিছু ব্যয় করা হবে তা নেকীরূপে সঞ্চিত হতে থাকবে, যে নেকী সঞ্চয়ের প্রতি এ আয়াতে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে।
এ উভয় আয়াতই মুদার গোত্রের তখনকার অবস্থার প্রেক্ষাপটে খুবই প্রাসঙ্গিক। প্রথম আয়াত দ্বারা তাদের প্রতি ভ্রাতৃত্ববোধ জাগ্রত করা হয়েছে, আর দ্বিতীয় আয়াত দ্বারা তাদের প্রতি প্রত্যেকের সামর্থ্য অনুযায়ী দান-সদাকার উৎসাহ দেওয়া হয়েছে।
ভূমিকাস্বরূপ আয়াতদু'টি তিলাওয়াত করার পর নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম উপস্থিত সাহাবীদেরকে সরাসরি দান-খয়রাত করার হুকুম দেন। প্রত্যেককে তার সামর্থ্য অনুযায়ী দান করতে বলেন। একটি দীনার, একটি দিরহাম, একটা কাপড়, এক সা' গম বা খেজুর, যে যা পারে। এমনকি কেউ যদি একটা খেজুরের অর্ধেকও দিতে পারে, তাও যেন দেয়।
বলাবাহুল্য, এত অল্প পরিমাণ দান কেবল তখনই হয়, যখন বাড়তি কিছু না থাকে। যতটুকু থাকে তাতে নিজ প্রয়োজনও পুরোপুরি মেটে না। এরূপ অবস্থায় দান করতে গেলে দরকার হয় নিজের ওপর অন্যকে প্রাধান্য দেওয়া, নিজে অভুক্ত থেকে অন্যকে খাওয়ানো বা নিজে সর্বনিম্ন পর্যায়ে খেয়ে অন্যের ক্ষুধা মেটানো। একে “ঈছার' বলে। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম মহান সাহাবীদেরকে ঈছার গুণের ওপর গড়ে তুলেছিলেন। সুতরাং কুরআন মাজীদে এই বলে তাদের প্রশংসা করা হয়েছে যে-
وَيُؤْثِرُونَ عَلَى أَنْفُسِهِمْ وَلَوْ كَانَ بِهِمْ خَصَاصَةٌ وَمَنْ يُوقَ شُحَّ نَفْسِهِ فَأُولَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ (9)
এবং তাদেরকে তারা নিজেদের ওপর প্রাধান্য দেয়, যদিও তাদের অভাব-অনটন থাকে। যারা স্বভাবগত কার্পণ্য হতে মুক্তি লাভ করে, তারাই তো সফলকাম।" সূরা হাশর (৫৯), আয়াত ৯
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম আদেশ দেওয়ামাত্র সাহাবায়ে কিরামের মধ্যে প্রতিযোগিতা লেগে গেল। প্রত্যেকে আপন আপন সামর্থ্য অনুযায়ী দান করতে থাকলেন। তাতে খাদ্য ও কাপড়ের দু'টি স্তুপ হয়ে গেল। তা দেখে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রাণ জুড়িয়ে গেল। এতক্ষণ তাঁর চেহারা বেদনায় মলিন ছিল। এবার আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে গেল। সুন্দর ও মুবারক চেহারাখানি খুশিতে এমন ঝলমল করছিল, মনে হচ্ছিল যেন তাতে স্বর্ণের প্রলেপ দেওয়া হয়েছে।
তাঁর এ আনন্দ ও সন্তুষ্টি ছিল এক তো এই কারণে যে, জীর্ণশীর্ণ আগন্তুকদের উপস্থিত অভাব মোচনের একটা ব্যবস্থা হয়ে গেল। দ্বিতীয় কারণ তাঁর হুকুম পালনে মহান সাহাবীদের তৎপরতা। এমনই ছিলেন সাহাবায়ে কিরামের জামাত। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু "আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন যে হুকুম করতেন তা বিনাবাক্যে পালন করতে ব্যস্ত হয়ে যেতেন। কারণ তাদের বিশ্বাস ছিল এতেই তাদের দুনিয়া ও আখিরাতের সফলতা।
অতঃপর নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম একটি সাধারণ নীতি ঘোষণা করে দেন। সে নীতি ভালো ও মন্দ তরিকা চালু করা সম্পর্কে। কেউ কোনও ভালো তরিকা চালু করলে সে নিজ আমলের ছাওয়াব তো পাবেই, সেইসঙ্গে তার দেখাদেখি আরও যারা সে কাজ করবে তাদের সকলের সমপরিমাণ ছাওয়াব তার আমলনামায় লেখা হতে থাকবে। এতে তাদের ছাওয়াব কোনও অংশে কমবে না। পক্ষান্তরে কেউ কোনও মন্দ নিয়ম চালু করলে সে নিজ কর্মের জন্য গুনাহগার তো হবেই, সেইসঙ্গে তার দেখাদেখি যত লোক সেই মন্দ কাজটি করবে তাদের সকলের সমপরিমাণ গুনাহ তার আমলনামায় লেখা হতে থাকবে। এতে তাদের গুনাহ কোনও অংশে কমবে না।
সাহাবায়ে কিরামের শ্রেষ্ঠত্ব : ছাওয়াবের বিপুলতায়
এর দ্বারা সাহাবায়ে কিরামের শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে কিছুটা ধারণা পাওয়া যায়। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের শিক্ষানুযায়ী দীনের যাবতীয় ভালো কাজের তারাই ছিলেন প্রথম কর্মী। তাঁর শিক্ষানুযায়ী তারা আমলের ধারা চালু করেছেন। তারপর তাদের পরবর্তীকালের মানুষ তাদের দেখানো পথে আমল করতে থেকেছে। প্রতি যুগে আমলকারীর সংখ্যা বাড়তে থেকেছে বিপুলহারে। মুষ্টিমেয় সাহাবীর দেখানো পথে আজকের পৃথিবীতে আমল করছে কোটি কোটি মানুষ। যুগপরম্পরায় এ পর্যন্ত কত শতকোটি মানুষ তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে আসছে। এতে তাদের একেকজনের আমলনামায় কত ছাওয়াব লেখা হয়েছে ও লেখা হচ্ছে তা কি কল্পনা করা সম্ভব? ঈমান ও বিশ্বাসের গভীরতার কারণে তাদের নিজ আমলের যে আলাদা মান ও বৈশিষ্ট্য— সে তো স্বতন্ত্র রয়েছেই, সেইসঙ্গে দীনের যাত্রাপথে প্রথম পথিক হওয়ার সুবাদে তাদের ছাওয়াবে যে বিপুল বিস্তার তাতেও তাঁরা অনন্য। এদিক থেকেও তাদের সঙ্গে কারও তুলনার কোনও অবকাশ নেই। রাদিয়াল্লাহু তা'আলা 'আলাইহিম ওয়া রাদূ 'আনহু।
মৃত্যুর পরও এভাবে নেকীর ধারা চালু থাকাকে 'সাদাকায়ে জারিয়া' বলা হয়। মৃত্যুর পরও এভাবে নেকী হাসিলের সুযোগ সবকালেই আছে। এখনও যে ব্যক্তি কোনও ভালো কাজ শুরু করবে আর তার দেখাদেখি অন্যরাও তা করবে এবং পরবর্তীদের মধ্যে তার ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকবে, সে ব্যক্তি তাদের সকলের ছাওয়াবের সমান ছাওয়াব নিজ আমলনামায় পেয়ে যাবে।
এই নিরবচ্ছিন্ন ছাওয়াব পাওয়ার জন্য এটা শর্ত নয় যে, কোনও আমল সম্পূর্ণ নতুনভাবে নিজের থেকে শুরু করতে হবে এবং পূর্বে তার কোনও অস্তিত্ব না থাকতে হবে। বরং প্রচলিত আমল দ্বারাও এ ছাওয়াব পাওয়া সম্ভব। যেমন নামাযের কথাই ধরা হোক। দীনের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ এ আমল সমাজে চালু আছে। তা সত্ত্বেও যে ব্যক্তি নিজে নামায পড়ার পাশাপাশি তার সন্তান-সন্ততিকে নামাযীরূপে গড়ে তুলবে, অন্য বেনামাযীকেও নামাযী বানানোর চেষ্টা করবে, অতঃপর তাদের ধারায় পরবর্তী প্রজন্মদের মধ্যে নামাযের আমল অব্যাহত থাকবে, সে ব্যক্তির আমলনামায় এদের সকলের নামাযের সমান ছাওয়াব লেখা হতে থাকবে।
একইভাবে বিচার করা যায় বিদ'আতের বিষয়টাও। যে ব্যক্তি কোনও বিদ'আত চালু করে, তার নিজ আমলের গুনাহ তো তার আছেই। তারপর যত লোক সে বিদ'আতের অনুসরণ করবে, তাদের সকলের গুনাহর সমপরিমাণ যদি তার আমলনামায় লেখা হতে থাকে, তবে সে গুনাহর পরিমাণ কত হয় ভাবা যায় কি? আজ যে সকল বিদ'আতী কর্ম সমাজে চালু আছে, এর প্রথম প্রবক্তা যারা ছিল, কী অবস্থা তাদের আমলনামার? এর থেকে আমাদের সবক নেওয়া দরকার।
খুব সতর্ক থাকা দরকার যাতে আমাদের এমন কোনও মন্দ কাজ না হয়ে যায়, যা আমার দেখাদেখি অন্যরাও করতে শুরু করে। নিজ সন্তান-সন্ততি ও পরিবারের সদস্যবর্গ থেকে শুরু করে পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, ভক্ত-অনুরক্ত ও এদের সকলের পরবর্তী প্রজন্মের ভেতর যাতে আমার চালু করা কোনও মন্দ কাজের প্রচলন না হয়ে যায়—সেদিকে লক্ষ রাখা খুব জরুরি। সেরকম কিছু হলে আমি মরে যাব বটে, কিন্তু আমার আমলনামায় পাপ লেখা বন্ধ হবে না। কিয়ামত পর্যন্ত তা চলতেই থাকবে। আখিরাতে ধ্বংস হওয়ার জন্য এই-ই তো যথেষ্ট। আল্লাহ তা'আলা এই ধ্বংসাত্মক কর্ম থেকে আমাদের হেফাজত করুন- আমীন।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. এ হাদীছ শিক্ষা দেয় মানুষ হিসেবে মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে প্রত্যেকেরই কিছু না কিছু হক আমাদের ওপর আছে। তাই যে-কারও দুঃখ-কষ্টে সহমর্মী হওয়া অবশ্যকর্তব্য।
খ. আত্মীয়-স্বজনের বিশেষ হক রয়েছে। সে হক আদায়ে যত্নবান থাকা উচিত।
গ. এ হাদীছ দ্বারা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের মমত্ববোধের পরিচয় পাওয়া যায়। তাঁর একজন উম্মত হিসেবে আমার মধ্যেও এ গুণ অবশ্যই থাকা চাই।
ঘ. দীনী কাজে চাঁদা দেওয়া সাহাবায়ে কিরামের সুন্নত। এর অনুসরণ বাঞ্ছনীয়।
ঙ পিতামাতা, উস্তায, শায়খ বা এরকম মুরব্বীস্থানীয় কারও চেহারায় কোনও কারণে বেদনার ছাপ পরিলক্ষিত হলে যথাসাধ্য তা দূর করার চেষ্টা করা উচিত, যাতে যথাশীঘ্র সে চেহারায় আনন্দের উদ্ভাস ফুটে ওঠে।
চ. নিজ ক্ষমতার পরিমণ্ডলে নেক আমলের রেওয়াজ দেওয়া চাই, যাতে আমলনামায় স্থায়ীভাবে ছাওয়াব লেখা হতে থাকে।
ছ. প্রত্যেকের সতর্ক থাকা উচিত যাতে তার দ্বারা কোনওক্রমেই বিদ'আতের প্রচলন না ঘটে।
বনু মুদার আরবের একটি প্রসিদ্ধ গোত্র। তাদের একটি দল তরবারিসজ্জিত অবস্থায় নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট উপস্থিত হয়। সম্ভবত সেটা কোনও যুদ্ধের সময় ছিল। কিন্তু তাদের গায়ের কাপড় ছিল নিতান্তই সংক্ষিপ্ত ও অতি সাধারণ। একটা মাত্র কাপড়ে শরীরের নিম্নাংশ কোনওরকমে ঢেকে নিয়েছিল। উপরের অংশ ছিল খোলা। অনাহারে-অর্ধাহারে শরীর ছিল ক্লান্ত-ক্লিষ্ট। তাদের এ অবস্থা দেখে নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের চেহারা বিবর্ণ হয়ে গেল। তিনি ছিলেন দয়ার সাগর। উম্মতের কষ্ট-ক্লেশ দেখলে তাঁর মন ব্যথিত হত। সে বেদনার ছাপ তাঁর চেহারায় ফুটে উঠেছিল। তাদের খাদ্য ও বস্ত্রের অভাব মেটানোর জন্য প্রথমে তিনি নিজের ঘরে গেলেন। এই আশায় যে কিছু পাওয়া যায় কিনা। কিন্তু কিছুই পেলেন না। খালি হাতে ফিরে আসলেন।
ইতোমধ্যে নামাযের সময় হয়ে গেল। হযরত বিলাল রাযি. আযান দিলেন। তারপর ইকামত দিলেন। তিনি সকলকে নিয়ে নামায আদায় করলেন। তারপর এই হতদরিদ্র আগন্তুকদের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য উপস্থিত লোকদের সামনে একটি ভাষণ দিলেন।
তিনি প্রথমে আল্লাহ তা'আলার হামদ ও ছানা পড়লেন। এটাই ছিল তাঁর সাধারণ নিয়ম। ভাষণের আগে আল্লাহ তা'আলার প্রশংসা করে নিতেন। তারপর সূরা নিসার প্রথম আয়াত এবং সূরা হাশরের ১৮ নং আয়াত তিলাওয়াত করলেন।
এ আয়াতদু'টিতে মানুষের প্রতি মমত্ববোধ, আল্লাহর পথে অর্থব্যয় এবং আখিরাতের জন্য প্রস্তুতিগ্রহণের শিক্ষা রয়েছে। সূরা নিসার আয়াতে আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেন-
يَاأَيُّهَا النَّاسُ اتَّقُوا رَبَّكُمُ الَّذِي خَلَقَكُمْ مِنْ نَفْسٍ وَاحِدَةٍ وَخَلَقَ مِنْهَا زَوْجَهَا وَبَثَّ مِنْهُمَا رِجَالًا كَثِيرًا وَنِسَاءً وَاتَّقُوا اللَّهَ الَّذِي تَسَاءَلُونَ بِهِ وَالْأَرْحَامَ إِنَّ اللَّهَ كَانَ عَلَيْكُمْ رَقِيبًا (1)
'হে লোক সকল! নিজ প্রতিপালককে ভয় কর, যিনি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন এক ব্যক্তি হতে এবং তারই থেকে তার স্ত্রীকে সৃষ্টি করেছেন। আর তাদের উভয় থেকে বহু নর-নারী (পৃথিবীতে) ছড়িয়ে দিয়েছেন এবং আল্লাহকে ভয় কর, যার অছিলা দিয়ে তোমরা একে অন্যের কাছে (নিজেদের হক) চেয়ে থাক। এবং আত্মীয়দের (অধিকার খর্ব করা)-কে ভয় কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রাখেন। (সূরা নিসা (৪), আয়াত ১)
মানুষের প্রতি মানুষের কর্তব্য
এর সারমর্ম হচ্ছে সমস্ত মানুষ এক আদি পিতামাতার সন্তান। সে হিসেবে তারা সকলে ভাই-ভাই ও ভাই-বোন। এ ভ্রাতৃত্বের কারণে তাদের একের ওপর অন্যের হক আছে। প্রত্যেকের উচিত অন্যের দুঃখ-কষ্টে তার পাশে দাঁড়ানো। পরস্পরে সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি করে নেওয়াতেই ভ্রাতৃত্বের সার্থকতা। তারপর যদি আবার পরস্পরের মধ্যে আরও বেশি কাছের আত্মীয়তা থাকে, তখন পারস্পরিক দায়িত্ব-কর্তব্য অনেক বেড়ে যায়।
তো এক আদমসন্তান হিসেবে সমস্ত মানুষের প্রতি রয়েছে সাধারণ দায়িত্ব-কর্তব্য এবং নিকটাত্মীয়দের প্রতি রয়েছে বিশেষ দায়িত্ব-কর্তব্য। এ দায়িত্ব-কর্তব্য পালন করা আল্লাহ তা'আলারই হুকুম। তাঁর এ হুকুম কে কতটুকু গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করছে, আল্লাহ তা'আলা তা লক্ষ রাখছেন। আখিরাতে এ সম্পর্কে তিনি জিজ্ঞাসাবাদ করবেন। কাজেই প্রত্যেকের উচিত অন্তরে সে জিজ্ঞাসাবাদের ভয় রাখা। কেননা উত্তর সঠিক না হলে তার পরিণাম বড় ভয়াবহ। তাই প্রথমেই আল্লাহ তা'আলা সতর্ক করেছেন যে, তোমরা তোমাদের প্রতিপালককে ভয় কর। এ ভয়ের দাবি হচ্ছে প্রত্যেকে তুলনামূলকভাবে তারচে' যে বেশি দুঃখ-কষ্টের মধ্যে আছে তার পাশে দাঁড়াবে এবং যতটুকু সম্ভব তার দুঃখ-কষ্ট লাঘবের চেষ্টা করবে।
দ্বিতীয় আয়াতে আল্লাহ তা'আলা প্রত্যেককে হুকুম করেছেন যে, সে যেন আখিরাতের জন্য কতটুকু কী করেছে – সেদিকে লক্ষ রাখে। এ হুকুমের শুরুতেও তাঁকে ভয় করার নির্দেশ দিয়েছেন এবং পরেও এ নির্দেশের পুনরাবৃত্তি করেছেন। এর দ্বারা আখিরাতের লক্ষ্যে কাজ করা যে কত গুরুত্বপূর্ণ সেদিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন।
আখিরাতের জীবনই আসল জীবন। ইহজগত সেই জীবনের শস্যক্ষেত্র মাত্র। এখানে যেমন কর্ম হবে, সেখানে তেমনি ফল পাওয়া যাবে। কর্ম ভালো হলে ভালো ফল এবং মন্দ হলে মন্দ ফল। ভালো ফল ভোগের জায়গা জান্নাত আর মন্দ ফলের জন্য আছে জাহান্নাম। সে বড় কঠিন জায়গা। আল্লাহ তা'আলা ন্যায়বিচারক। সেখানে ফাঁকি দেওয়ার কোনও সুযোগ নেই। প্রত্যেকের কর্ম সম্পর্কে আল্লাহ তা'আলা পূর্ণ অবগত। কাজেই মুক্তি পেতে চাইলে এখনই সতর্কতা দরকার। প্রতিটি কাজ যেন এমনভাবে হয়, যাতে তা দ্বারা আখিরাতের সঞ্চয় হয় এবং সেখানে মুক্তির অছিলা হিসেবে গণ্য হয়। আল্লাহর পথে দান-খয়রাতও সেরকমই এক অছিলা। আল্লাহর বান্দাদের দুঃখ-কষ্ট লাঘবে যা-কিছু ব্যয় করা হবে তা নেকীরূপে সঞ্চিত হতে থাকবে, যে নেকী সঞ্চয়ের প্রতি এ আয়াতে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে।
এ উভয় আয়াতই মুদার গোত্রের তখনকার অবস্থার প্রেক্ষাপটে খুবই প্রাসঙ্গিক। প্রথম আয়াত দ্বারা তাদের প্রতি ভ্রাতৃত্ববোধ জাগ্রত করা হয়েছে, আর দ্বিতীয় আয়াত দ্বারা তাদের প্রতি প্রত্যেকের সামর্থ্য অনুযায়ী দান-সদাকার উৎসাহ দেওয়া হয়েছে।
ভূমিকাস্বরূপ আয়াতদু'টি তিলাওয়াত করার পর নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম উপস্থিত সাহাবীদেরকে সরাসরি দান-খয়রাত করার হুকুম দেন। প্রত্যেককে তার সামর্থ্য অনুযায়ী দান করতে বলেন। একটি দীনার, একটি দিরহাম, একটা কাপড়, এক সা' গম বা খেজুর, যে যা পারে। এমনকি কেউ যদি একটা খেজুরের অর্ধেকও দিতে পারে, তাও যেন দেয়।
বলাবাহুল্য, এত অল্প পরিমাণ দান কেবল তখনই হয়, যখন বাড়তি কিছু না থাকে। যতটুকু থাকে তাতে নিজ প্রয়োজনও পুরোপুরি মেটে না। এরূপ অবস্থায় দান করতে গেলে দরকার হয় নিজের ওপর অন্যকে প্রাধান্য দেওয়া, নিজে অভুক্ত থেকে অন্যকে খাওয়ানো বা নিজে সর্বনিম্ন পর্যায়ে খেয়ে অন্যের ক্ষুধা মেটানো। একে “ঈছার' বলে। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম মহান সাহাবীদেরকে ঈছার গুণের ওপর গড়ে তুলেছিলেন। সুতরাং কুরআন মাজীদে এই বলে তাদের প্রশংসা করা হয়েছে যে-
وَيُؤْثِرُونَ عَلَى أَنْفُسِهِمْ وَلَوْ كَانَ بِهِمْ خَصَاصَةٌ وَمَنْ يُوقَ شُحَّ نَفْسِهِ فَأُولَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ (9)
এবং তাদেরকে তারা নিজেদের ওপর প্রাধান্য দেয়, যদিও তাদের অভাব-অনটন থাকে। যারা স্বভাবগত কার্পণ্য হতে মুক্তি লাভ করে, তারাই তো সফলকাম।" সূরা হাশর (৫৯), আয়াত ৯
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম আদেশ দেওয়ামাত্র সাহাবায়ে কিরামের মধ্যে প্রতিযোগিতা লেগে গেল। প্রত্যেকে আপন আপন সামর্থ্য অনুযায়ী দান করতে থাকলেন। তাতে খাদ্য ও কাপড়ের দু'টি স্তুপ হয়ে গেল। তা দেখে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রাণ জুড়িয়ে গেল। এতক্ষণ তাঁর চেহারা বেদনায় মলিন ছিল। এবার আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে গেল। সুন্দর ও মুবারক চেহারাখানি খুশিতে এমন ঝলমল করছিল, মনে হচ্ছিল যেন তাতে স্বর্ণের প্রলেপ দেওয়া হয়েছে।
তাঁর এ আনন্দ ও সন্তুষ্টি ছিল এক তো এই কারণে যে, জীর্ণশীর্ণ আগন্তুকদের উপস্থিত অভাব মোচনের একটা ব্যবস্থা হয়ে গেল। দ্বিতীয় কারণ তাঁর হুকুম পালনে মহান সাহাবীদের তৎপরতা। এমনই ছিলেন সাহাবায়ে কিরামের জামাত। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু "আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন যে হুকুম করতেন তা বিনাবাক্যে পালন করতে ব্যস্ত হয়ে যেতেন। কারণ তাদের বিশ্বাস ছিল এতেই তাদের দুনিয়া ও আখিরাতের সফলতা।
অতঃপর নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম একটি সাধারণ নীতি ঘোষণা করে দেন। সে নীতি ভালো ও মন্দ তরিকা চালু করা সম্পর্কে। কেউ কোনও ভালো তরিকা চালু করলে সে নিজ আমলের ছাওয়াব তো পাবেই, সেইসঙ্গে তার দেখাদেখি আরও যারা সে কাজ করবে তাদের সকলের সমপরিমাণ ছাওয়াব তার আমলনামায় লেখা হতে থাকবে। এতে তাদের ছাওয়াব কোনও অংশে কমবে না। পক্ষান্তরে কেউ কোনও মন্দ নিয়ম চালু করলে সে নিজ কর্মের জন্য গুনাহগার তো হবেই, সেইসঙ্গে তার দেখাদেখি যত লোক সেই মন্দ কাজটি করবে তাদের সকলের সমপরিমাণ গুনাহ তার আমলনামায় লেখা হতে থাকবে। এতে তাদের গুনাহ কোনও অংশে কমবে না।
সাহাবায়ে কিরামের শ্রেষ্ঠত্ব : ছাওয়াবের বিপুলতায়
এর দ্বারা সাহাবায়ে কিরামের শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে কিছুটা ধারণা পাওয়া যায়। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের শিক্ষানুযায়ী দীনের যাবতীয় ভালো কাজের তারাই ছিলেন প্রথম কর্মী। তাঁর শিক্ষানুযায়ী তারা আমলের ধারা চালু করেছেন। তারপর তাদের পরবর্তীকালের মানুষ তাদের দেখানো পথে আমল করতে থেকেছে। প্রতি যুগে আমলকারীর সংখ্যা বাড়তে থেকেছে বিপুলহারে। মুষ্টিমেয় সাহাবীর দেখানো পথে আজকের পৃথিবীতে আমল করছে কোটি কোটি মানুষ। যুগপরম্পরায় এ পর্যন্ত কত শতকোটি মানুষ তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে আসছে। এতে তাদের একেকজনের আমলনামায় কত ছাওয়াব লেখা হয়েছে ও লেখা হচ্ছে তা কি কল্পনা করা সম্ভব? ঈমান ও বিশ্বাসের গভীরতার কারণে তাদের নিজ আমলের যে আলাদা মান ও বৈশিষ্ট্য— সে তো স্বতন্ত্র রয়েছেই, সেইসঙ্গে দীনের যাত্রাপথে প্রথম পথিক হওয়ার সুবাদে তাদের ছাওয়াবে যে বিপুল বিস্তার তাতেও তাঁরা অনন্য। এদিক থেকেও তাদের সঙ্গে কারও তুলনার কোনও অবকাশ নেই। রাদিয়াল্লাহু তা'আলা 'আলাইহিম ওয়া রাদূ 'আনহু।
মৃত্যুর পরও এভাবে নেকীর ধারা চালু থাকাকে 'সাদাকায়ে জারিয়া' বলা হয়। মৃত্যুর পরও এভাবে নেকী হাসিলের সুযোগ সবকালেই আছে। এখনও যে ব্যক্তি কোনও ভালো কাজ শুরু করবে আর তার দেখাদেখি অন্যরাও তা করবে এবং পরবর্তীদের মধ্যে তার ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকবে, সে ব্যক্তি তাদের সকলের ছাওয়াবের সমান ছাওয়াব নিজ আমলনামায় পেয়ে যাবে।
এই নিরবচ্ছিন্ন ছাওয়াব পাওয়ার জন্য এটা শর্ত নয় যে, কোনও আমল সম্পূর্ণ নতুনভাবে নিজের থেকে শুরু করতে হবে এবং পূর্বে তার কোনও অস্তিত্ব না থাকতে হবে। বরং প্রচলিত আমল দ্বারাও এ ছাওয়াব পাওয়া সম্ভব। যেমন নামাযের কথাই ধরা হোক। দীনের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ এ আমল সমাজে চালু আছে। তা সত্ত্বেও যে ব্যক্তি নিজে নামায পড়ার পাশাপাশি তার সন্তান-সন্ততিকে নামাযীরূপে গড়ে তুলবে, অন্য বেনামাযীকেও নামাযী বানানোর চেষ্টা করবে, অতঃপর তাদের ধারায় পরবর্তী প্রজন্মদের মধ্যে নামাযের আমল অব্যাহত থাকবে, সে ব্যক্তির আমলনামায় এদের সকলের নামাযের সমান ছাওয়াব লেখা হতে থাকবে।
একইভাবে বিচার করা যায় বিদ'আতের বিষয়টাও। যে ব্যক্তি কোনও বিদ'আত চালু করে, তার নিজ আমলের গুনাহ তো তার আছেই। তারপর যত লোক সে বিদ'আতের অনুসরণ করবে, তাদের সকলের গুনাহর সমপরিমাণ যদি তার আমলনামায় লেখা হতে থাকে, তবে সে গুনাহর পরিমাণ কত হয় ভাবা যায় কি? আজ যে সকল বিদ'আতী কর্ম সমাজে চালু আছে, এর প্রথম প্রবক্তা যারা ছিল, কী অবস্থা তাদের আমলনামার? এর থেকে আমাদের সবক নেওয়া দরকার।
খুব সতর্ক থাকা দরকার যাতে আমাদের এমন কোনও মন্দ কাজ না হয়ে যায়, যা আমার দেখাদেখি অন্যরাও করতে শুরু করে। নিজ সন্তান-সন্ততি ও পরিবারের সদস্যবর্গ থেকে শুরু করে পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, ভক্ত-অনুরক্ত ও এদের সকলের পরবর্তী প্রজন্মের ভেতর যাতে আমার চালু করা কোনও মন্দ কাজের প্রচলন না হয়ে যায়—সেদিকে লক্ষ রাখা খুব জরুরি। সেরকম কিছু হলে আমি মরে যাব বটে, কিন্তু আমার আমলনামায় পাপ লেখা বন্ধ হবে না। কিয়ামত পর্যন্ত তা চলতেই থাকবে। আখিরাতে ধ্বংস হওয়ার জন্য এই-ই তো যথেষ্ট। আল্লাহ তা'আলা এই ধ্বংসাত্মক কর্ম থেকে আমাদের হেফাজত করুন- আমীন।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. এ হাদীছ শিক্ষা দেয় মানুষ হিসেবে মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে প্রত্যেকেরই কিছু না কিছু হক আমাদের ওপর আছে। তাই যে-কারও দুঃখ-কষ্টে সহমর্মী হওয়া অবশ্যকর্তব্য।
খ. আত্মীয়-স্বজনের বিশেষ হক রয়েছে। সে হক আদায়ে যত্নবান থাকা উচিত।
গ. এ হাদীছ দ্বারা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের মমত্ববোধের পরিচয় পাওয়া যায়। তাঁর একজন উম্মত হিসেবে আমার মধ্যেও এ গুণ অবশ্যই থাকা চাই।
ঘ. দীনী কাজে চাঁদা দেওয়া সাহাবায়ে কিরামের সুন্নত। এর অনুসরণ বাঞ্ছনীয়।
ঙ পিতামাতা, উস্তায, শায়খ বা এরকম মুরব্বীস্থানীয় কারও চেহারায় কোনও কারণে বেদনার ছাপ পরিলক্ষিত হলে যথাসাধ্য তা দূর করার চেষ্টা করা উচিত, যাতে যথাশীঘ্র সে চেহারায় আনন্দের উদ্ভাস ফুটে ওঠে।
চ. নিজ ক্ষমতার পরিমণ্ডলে নেক আমলের রেওয়াজ দেওয়া চাই, যাতে আমলনামায় স্থায়ীভাবে ছাওয়াব লেখা হতে থাকে।
ছ. প্রত্যেকের সতর্ক থাকা উচিত যাতে তার দ্বারা কোনওক্রমেই বিদ'আতের প্রচলন না ঘটে।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)