আত্-তারগীব ওয়াত্-তারহীব- ইমাম মুনযিরী রহঃ

৫. অধ্যায়ঃ নামাজ

হাদীস নং: ৪৭৪
অধ্যায়ঃ নামাজ
অন্ধকারে মসজিদের দিকে পদচারণার প্রতি অনুপ্রেরণা এবং তার ফযীলত
৪৭৪. হযরত উবাই ইবন কা'ব (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমার জানামতে এক আনসারীর বাড়ি মসজিদ (মসজিদে নববী) থেকে সব চেয়ে দূরে ছিল, তথাপিও তার সালাতের জামা'আত ছুটত না। তাকে বলা হলঃ তুমি যদি একটি গাধা কিনে নিতে, তাহলে তা তোমাকে তাপ এবং কীট থেকে রক্ষা করত। সে বলল: আমার বাড়ি মসজিদের কাছাকাছি হোক, এতে আমি সন্তুষ্ট নই। আমি চাই যে, মসজিদে হেঁটে যাওয়া এবং আমার ঘরে ফিরে আসা আমার আমলনামায় লেখা হোক। রাসূলুল্লাহ বলেছেন: আল্লাহ তা'আলা তা তোমার জন্য পুরোপুরি জমা করছেন।
অন্য বর্ণনায় আছে, আমি তার জন্য দুঃখিত হলাম এবং আমি তাকে বললামঃ হে অমুক! তুমি যদি একটি গাধা কিনে নিতে, তাহলে তা তোমাকে তাপ এবং মাটির কীট ও হিংস্র জন্তু থেকে রক্ষা করত। লোকটি বললঃ আল্লাহর কসম, আমার বাড়ি মুহাম্মাদ (সা) এর কাছাকাছি হোক, আমি তা পসন্দ করি না। বর্ণনাকারী বলেন, কথাটি আমার মনে বাধলো। অবশেষে আমি নবী (সা) এর কাছে এসে তাঁকে তা অবহিত করলাম তিনি তাকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন। তাঁর কাছেও সে অনুরূপ কথা বলল এবং জানাল যে, সে তার পদক্ষেপের সওয়াব কামনা করে। তখন নবী তাকে বললেন: তুমি যা আশা করছ, তা তুমি পাবে।
(হাদীসটি মুসলিম এবং অপরাপর হাদীস গ্রন্থে বর্ণিত। আর ইবন মাজাহ শরীফে দ্বিতীয় বর্ণনার অনুরূপ এসেছে।)
كتاب الصَّلَاة
التَّرْغِيب فِي الْمَشْي إِلَى الْمَسَاجِد سِيمَا فِي الظُّلم وَمَا جَاءَ فِي فَضلهَا
474 - وَعَن أبي بن كَعْب رَضِي الله عَنهُ قَالَ كَانَ رجل من الْأَنْصَار لَا أعلم أحدا أبعد من الْمَسْجِد مِنْهُ كَانَت لَا تخطئه صَلَاة فَقيل لَهُ لَو اشْتريت حمارا تركبه فِي الظلماء وَفِي الرمضاء فَقَالَ مَا يسرني أَن منزلي إِلَى جنب الْمَسْجِد إِنِّي أُرِيد أَن يكْتب لي ممشاي إِلَى الْمَسْجِد ورجوعي إِذا رجعت إِلَى أَهلِي فَقَالَ رَسُول الله صلى الله عَلَيْهِ وَسلم قد جمع الله لَك ذَلِك كُله
وَفِي رِوَايَة فتوجعت لَهُ فَقلت لَهُ يَا فلَان لَو أَنَّك اشْتريت حمارا يقيك الرمضاء وهوام الأَرْض قَالَ أما وَالله مَا أحب أَن بَيْتِي مطنب بِبَيْت مُحَمَّد صلى الله عَلَيْهِ وَسلم قَالَ فَحملت بِهِ حملا حَتَّى أتيت نَبِي الله صلى الله عَلَيْهِ وَسلم فَأَخْبَرته فَدَعَاهُ فَقَالَ لَهُ مثل ذَلِك وَذكر أَنه يَرْجُو أجر الْأَثر فَقَالَ النَّبِي صلى الله عَلَيْهِ وَسلم لَك مَا احتسبت
رَوَاهُ مُسلم وَغَيره وَرَوَاهُ ابْن مَاجَه بِنَحْوِ الثَّانِيَة

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এ হাদীছে যে সাহাবীর কথা বলা হয়েছে যে, তাঁর বাড়ি মসজিদে নববী থেকে অনেক দূরে ছিল এবং অতদূর থেকে তিনি হেঁটে হেঁটে মসজিদে যাতায়াত করতেন, তার পরিচয় জানা যায় না। তবে তাঁর যে জযবার কথা এখানে উল্লেখ করা হয়েছে তা ছিল সাহাবায়ে কিরামের সাধারণ বৈশিষ্ট্য। তাঁরা সকলেই ছিলেন আখিরাতমুখী এবং দুনিয়ার প্রতি নির্মোহ। কিভাবে কত বেশি ছাওয়াব অর্জন করা যায় তা-ই ছিল তাঁদের ধ্যানজ্ঞান।

তাঁরা জানতেন নামায সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদত। মসজিদ পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ স্থান। যে নামায মসজিদে জামাতের সাথে আদায় করা হয় তার ফযীলত অনেক বেশি। এত বড় ফযীলতের কাজে আসা-যাওয়া করাও অনেক বড় নেক কাজ। সে আসা-যাওয়া যত বেশি আদবের সঙ্গে করা যায় ততই ভালো। বলাবাহুল্য, কোনও কিছুতে সওয়ার হয়ে যাতায়াত করা অপেক্ষা হেঁটে হেঁটে আসা-যাওয়া করাতেই আদব বেশি। তাই এ সাহাবী পাঁচ ওয়াক্ত নামায অতদূর থেকে মসজিদে নববীতে এসেই পড়তেন এবং হেঁটে হেঁটেই আসা-যাওয়া করতেন। তাঁর এ কষ্ট দেখে অপর এক সাহাবীর, হয়তো উবাঈ ইবন কা'ব নিজেরই, মায়া লাগল। কেননা রাতের অন্ধকারে অতদূর থেকে পায়ে হেঁটে আসা- যাওয়া করা তো অত্যন্ত কঠিন ব্যাপার। এমনিভাবে দিনের বেলা রোদের খরতাপে যখন মরুভূমির বালু উত্তপ্ত হয়ে যায়, তখন তার উপর দিয়ে হাঁটা তো আরও কঠিন। তাই তিনি পরামর্শ দিলেন যে, ভাই তুমি তো একটা গাধা কিনে নিলে পার। গাধায় চড়ে আসা-যাওয়া করলে এ কষ্ট তোমার হয় না।

কিন্তু এ সাহাবীর মনে তো অন্য জোশ। মনের সে জোশের সামনে শরীরের কষ্ট কিছুই নয়। আখিরাতের সফলতা নির্ভর করে বেশি নেকীর উপর। যত বেশি হাঁটা যাবে, সে নেকী তত বেশি কামাই হবে। সওয়ারীর পিঠে চড়ে আসলে তো তা হবে না। শরীরের আরাম হবে বটে, তবে সে আরাম আরও বেশি হয় মসজিদের পাশে বাড়ি হলে। কিন্তু তিনি শরীরের আরাম চান না, চান রূহের শান্তি। তা হয় বেশি পুণ্য দিয়ে। তাই বললেন, আমি তো এটাও পসন্দ করি না যে, আমার বাড়ি মসজিদের পাশে হোক। মসজিদে হেঁটে আসতে যে ছাওয়াব হবে এবং হেঁটে হেঁটে বাড়ি ফিরলে যে ছাওয়াব হবে, আমি চাই তা আমার আমলনামায় লেখা হোক।

তাঁর এ কথা কোনওভাবে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের কানে পৌঁছে গেল। তাঁর প্রথম কথাটি আপাতদৃষ্টিতে আপত্তিকর মনে হয়। কেননা মসজিদের পাশে বাড়ি হওয়া তো অনেক ভালো। এর দ্বারা মসজিদের কল্যাণ অনেক বেশি অর্জন করা যায়। কিন্তু তিনি তা পসন্দ করছেন না। পসন্দ না করাটা কি সঠিক হয়েছে? এ ব্যাপারে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম কী বলেন? তাঁর মতামত জানার কৌতূহলেই হয়তো কেউ এ খবর তাঁকে জানিয়েছিল। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার আবেগের মূল্য দিলেন এবং যে উদ্দেশ্যে মসজিদের কাছে বাড়ি না হওয়া পসন্দ করেছেন তাকে প্রশংসার চোখে দেখলেন। সুতরাং তাকে আশ্বাসবাণী শোনালেন যে, তুমি আসা-যাওয়ার পথে কদমে কদমে যে নেকীর আশা করেছ, আল্লাহ তা'আলা তোমার সে আশা পূরণ করেছেন। তোমার আমলনামায় সে নেকী লেখা হচ্ছে।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. এ হাদীছ দ্বারা ছাওয়াব অর্জনের প্রতি সাহাবায়ে কিরামের কেমন জযবা ছিল তা জানা যায়। আমাদের উচিত তাঁদের দ্বারা অনুপ্রাণিত হওয়া।

খ. মসজিদের কাছে বাড়ি হওয়া যেমন বরকতের, তেমনি দূরে হওয়াও ছাওয়াব অর্জনে সহায়ক। কাজেই প্রত্যেকের কর্তব্য আপন আপন বাড়ির অবস্থানকে কল্যাণকর মনে করা এবং অবস্থান অনুযায়ী তা থেকে কল্যাণ হাসিল করে নেওয়া।

গ. অন্যের কষ্ট দেখে সহানুভূতিশীল হওয়া সাহাবায়ে কিরামের আদর্শ।

ঘ. শারীরিক কষ্টের উপর রূহের শান্তি তথা ছাওয়াব হাসিল করাকে প্রাধান্য দেওয়া সাহাবায়ে কিরামের নীতি।

ঙ. অন্যের দীনী ভাবাবেগকে অবজ্ঞা করতে নেই; বরং তার মূল্যায়ন করা উচিত।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান
আত্-তারগীব ওয়াত্-তারহীব - হাদীস নং ৪৭৪ | মুসলিম বাংলা