আত্-তারগীব ওয়াত্-তারহীব- ইমাম মুনযিরী রহঃ

১৪. অধ্যায়ঃ যিকির ও দু‘আ

হাদীস নং: ২৩৪৪
অধ্যায়ঃ যিকির ও দু‘আ
কোন মজলিসে অহেতুক কথাবার্তার কাফফারা হয়, এমন বাক্যসমূহের প্রতি উৎসাহ দান
২৩৪৪. হযরত আবু বারযা আসলামী (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) যখন কোন মজলিসে বসতেন তখন মজলিস থেকে উঠে যাবার সময় বলতেনঃ
سُبْحَانَكَ اللَّهُمَّ وَبِحَمْدِكَ أَشْهَدُ أَنْ لَا إِلَهَ إِلَّا أَنْتَ أَسْتَغْفِرُكَ وَأَتُوبُ إِلَيْكَ
"হে আল্লাহ্! তুমি পবিত্র, আমি তোমার প্রশংসাসহ পবিত্রতা বর্ণনা করছি। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, তুমি ছাড়া কোন ইলাহ নেই। আমি তোমার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করছি এবং তোমার দিকেই ফিরে আসছি।" জনৈক ব্যক্তি বলে উঠল, ইয়া রাসূলাল্লাহ্। আপনি আজ এমন কথা বলছেন, যা পূর্বে বলতেন না। তিনি উত্তরে বললেন, এটি হল মজলিসে যা সংঘটিত হয়, সে বিষয়ের কাফফারা।
(হাদীসটি আবু দাউদ বর্ণনা করেছেন।)
كتاب الذّكر وَالدُّعَاء
التَّرْغِيب فِي كَلِمَات يكفرن لغط الْمجْلس
2344- وَعَن أبي بَرزَة الْأَسْلَمِيّ رَضِي الله عَنهُ قَالَ كَانَ رَسُول الله صلى الله عَلَيْهِ وَسلم إِذا جلس مَجْلِسا يَقُول بِآخِرهِ إِذا أَرَادَ أَن يقوم من الْمجْلس سُبْحَانَكَ اللَّهُمَّ وَبِحَمْدِك أشهد أَن لَا إِلَه إِلَّا أَنْت أستغفرك وَأَتُوب إِلَيْك فَقَالَ رجل يَا رَسُول الله إِنَّك لتقول قولا مَا كنت تَقوله فِيمَا مضى فَقَالَ كَفَّارَة لما يكون فِي الْمجْلس

رَوَاهُ أَبُو دَاوُد

হাদীসের ব্যাখ্যা:

মজলিসে সাধারণত প্রয়োজনীয়-অপ্রয়োজনীয় নানারকম কথা হয়ে যায়। লোক যত বেশি হয়, কথাও ততো বেশি হয়। অনেক সময় এমন এমন কথাও হয়ে যায়, যা মোটেই শরী'আতসম্মত নয়। অথচ আমরা যা-কিছুই কথা বলি তা আমলনামায় লেখা হয়ে যায়। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে-
مَا يَلْفِظُ مِنْ قَوْلٍ إِلَّا لَدَيْهِ رَقِيبٌ عَتِيدٌ
মানুষ যে কথাই উচ্চারণ করে, তার জন্য একজন প্রহরী নিযুক্ত আছে, যে (লেখার জন্য) সদা প্রস্তুত। (সূরা কাফ, আয়াত ১৮)

মজলিস-বৈঠকে যেহেতু নানারকম কথা বলা হয়, যার মধ্যে থাকে অপ্রয়োজনীয় কথাও, হয়তো গুনাহের কথাও, আর তা সবই আমলনামায় লেখা হয়ে যায়, তাই এমন কোনও ব্যবস্থা থাকা দরকার, যা দ্বারা সেসব অপ্রয়োজনীয় ও গুনাহের কথাবার্তার প্রতিকার হয়ে যাবে এবং আমলনামা থেকে তা মুছে দেওয়া হবে। কেননা আমলনামায় যদি তা অবশিষ্ট থেকে যায়, তবে কিয়ামতের দিন সেজন্য কঠিন দুর্ভোগ পোহানোর আশঙ্কা রয়েছে। সরাসরিভাবে যে কথায় পাপ হয় তা তো দুর্ভোগের কারণ বটেই; যে কথায় সরাসরি পাপ বা পুণ্য কিছুই নেই, কেবলই বেহুদা কথা, তাও আখিরাতে দুর্ভোগ বয়ে আনতে পারে। একবার এক সাহাবীর মৃত্যু হলে অপর এক সাহাবী তাঁকে লক্ষ্য করে জান্নাতের সুসংবাদ দিচ্ছিলেন। তখন নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন-
أَوَلَا تَدْرِي فَلَعَلَّهُ تَكَلَّمَ فِيمَا لَا يَعْنِيهِ أَوْ بَخِلَ بِمَا لَا يَنْقُصُهُ
'(তুমি তাকে জান্নাতের সুসংবাদ দিচ্ছা!) অথচ তোমার জানা নেই হয়তো সে কখনও অনর্থক কোনও কথা বলেছে অথবা এমন বিষয়ে কার্পণ্য করেছে, যা তার কিছু হ্রাস করত না।’ (জামে' তিরমিযী: ২৩১৬)

সুতরাং মজলিস-বৈঠকে হয়ে যাওয়া অনুচিত বা অহেতুক কথাবার্তার দায় থেকে মুক্তিলাভ করা একান্ত প্রয়োজন। আলোচ্য হাদীছে সেই ব্যবস্থাই আমাদেরকে দেওয়া হয়েছে। আর তা হল মজলিস থেকে ওঠার সময় হাদীছে বর্ণিত দু'আটি পাঠ করা। দু'আটি হল-
سُبْحَانَكَ اللَّهُمَّ وَبِحَمْدِكَ، أَشْهَدُ أَنْ لَا إِلَهَ إِلَّا أَنْتَ أَسْتَغْفِرُكَ وَأَتُوْبُ إِلَيْكَ
'হে আল্লাহ! তুমি মহান, পবিত্র। তোমারই সমস্ত প্রশংসা। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি তুমি ছাড়া কোনও মা'বুদ নেই। আমি তোমার কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করছি ও তাওবা করছি।’

হাদীছটির বক্তব্যমতে যে ব্যক্তি এ দু'আ পাঠ করবে, মজলিসে তার দ্বারা যা-কিছু অনুচিত ও অহেতুক কথা হবে তা সব মাফ হয়ে যাবে। দু'আটির প্রথমে আছে আল্লাহ তা'আলার গুণগান। তারপর আছে আল্লাহ তা'আলার একত্ববাদের সাক্ষ্য। তারপর আছে ইস্তিগফার ও তাওবা। খুবই সারগর্ভ ও পূর্ণাঙ্গ দু'আ। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেও এ দু'আ পড়তেন, আমাদেরকেও এটি পড়তে উৎসাহ দিয়েছেন।

দু'আটির সুফল পাওয়ার জন্য জরুরি হল আল্লাহ তা'আলার দিকে রুজু' হয়ে অত্যন্ত বিনয় ও মনোযোগের সঙ্গে এটি পাঠ করা। মুখস্থ কথা অবহেলার সঙ্গে পড়ে দেওয়া যথেষ্ট নয়। অবহেলার সঙ্গে পড়া উচিতও নয়, যেহেতু এর ভেতর আল্লাহ তা'আলার মহিমা ও গৌরবের বর্ণনা ও কালেমার সাক্ষ্য আছে। আছে আল্লাহ তা'আলার কাছে তাওবা করা ও ক্ষমাপ্রার্থনার বিষয়টিও।

যেহেতু এর মধ্যে তাওবা-ইস্তিগফারের বিষয়টিও আছে, তাই ভীতি ও আন্তরিকতার সঙ্গে পড়লে এর দ্বারা কেবল সগীরা নয়; কবীরা গুনাহও মাফ হয়ে যাওয়ার আশা রাখা যায়।

বিভিন্ন হাদীছ থেকে জানা যায়, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ দু'আটি পড়া শুরু করেছেন জীবনের শেষদিকে। আগে এটি পড়তেন না। তার মানে আল্লাহ তা'আলার পক্ষ থেকে তাঁকে এটি শেখানোই হয়েছে শেষদিকে। ইসলাম পরিপূর্ণতা লাভ করেছে এভাবেই। ইসলামের যাবতীয় বিধি-বিধান শুরুতে একসঙ্গে দেওয়া হয়নি; পর্যায়ক্রমে দেওয়া হয়েছে। ফরয ও সুন্নত সর্বস্তরের বিধানের ক্ষেত্রেই এমন হয়েছে। কাজেই এমন অনেক বিধান রয়েছে, যা শুরুতে ছিল না, পরে এসেছে। মজলিসের এ দু'আটিও সেরকমই।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. মজলিস ও বৈঠকে কথাবার্তা বলতে সাবধান থাকা উচিত যাতে কোনও অনুচিত ও অহেতুক কথা না হয়ে যায়।

খ. অনর্থক কথাও পরকালীন ক্ষতির কারণ। তাই এর থেকেও বিরত থাকতে হবে।

গ. আমরা অবশ্যই এ দু'আটি মুখস্থ করব এবং প্রত্যেক বৈঠক ও মজলিস শেষে এটি পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলব।

ঘ. ইসলামের বিধানাবলি পর্যায়ক্রমিকভাবে দেওয়া হয়েছে। তাই দাওয়াতের ক্ষেত্রে পর্যায়ক্রমের প্রতি লক্ষ রাখা বাঞ্ছনীয়।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান