আত্-তারগীব ওয়াত্-তারহীব- ইমাম মুনযিরী রহঃ

১৯. অধ্যায়ঃ বিচার ব্যবস্থা

হাদীস নং: ৩৩১৯
অধ্যায়ঃ বিচার ব্যবস্থা
মুসলমানের কোন কাজে ন্যায়পরায়ণতার সাথে শাসনভার গ্রহণ করা ইত্যাদির প্রতি অনুপ্রেরণা এবং প্রজাদের প্রতি কঠোরতা আরোপ করা, অত্যাচার করা, প্রতারণা করা, তাদের সাক্ষাৎ না দেওয়া, তাদের প্রয়োজনের সময় দরজা বন্ধ রাখার প্রতি ভীতি প্রদর্শন
৩৩১৯. হযরত ইয়ায ইবনে হিমার (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ (ﷺ) কে বলতে শুনেছি। তিন প্রকার লোক জান্নাতী। তারা হলঃ ১. ন্যায়পরায়ণ সামর্থ্যবান শাসক, ২. নিকট আত্মীয়, যে প্রত্যেক মুসলমানের জন্য দয়ালু ও কোমল অন্তরের অধিকারী এবং ৩. ঐ ব্যক্তি, যার অধিক সন্তান-সন্ততি থাকা সত্ত্বেও পরমুখাপেক্ষীহীন।
(মুসলিম বর্ণিত।
المقسط- ন্যায়পরায়ণ।)
كتاب القضاء
ترغيب من ولي شَيْئا من أُمُور الْمُسلمين فِي الْعدْل إِمَامًا كَانَ أَو غَيره وترهيبه أَن يشق على رَعيته أَو يجور أَو يغشهم أَو يحتجب عَنْهُم أَو يغلق بَابه دون حوائجهم
3319- وَعَن عِيَاض بن حمَار رَضِي الله عَنهُ قَالَ سَمِعت رَسُول الله صلى الله عَلَيْهِ وَسلم يَقُول أهل الْجنَّة ثَلَاثَة ذُو سُلْطَان مقسط موفق وَرجل رَحِيم رَقِيق الْقلب لكل ذِي قربى مُسلم وعفيف متعفف ذُو عِيَال

رَوَاهُ مُسلم
المقسط الْعَادِل

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এ হাদীছটিতে তিন শ্রেণির লোক সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, তারা জান্নাতবাসী হবে। তাদের মধ্যে প্রথম হল- ذُوْ سُلْطَانٍ مُقْسِطٌ مُوَفَّقٌ (তাওফীকপ্রাপ্ত ন্যায়পরায়ণ শাসক)। তাওফীকপ্রাপ্ত মানে আল্লাহ তা'আলার পক্ষ থেকে তাঁর পসন্দনীয় কাজ করার সাহায্য ও আনুকূল্য লাভ করা। আল্লাহ তা'আলার পসন্দ এটাই যে, তিনি যা-কিছু করতে আদেশ করেছেন, বান্দা তা পালন করবে এবং তিনি যা-কিছু করতে নিষেধ করেছেন, বান্দা তা থেকে বিরত থাকবে। এককথায় এর দ্বারা শরী'আত মোতাবেক জীবনযাপন করা বোঝানো হয়। ন্যায়পরায়ণ শাসকের ক্ষেত্রে এর দ্বারা এটাও বোঝানো উদ্দেশ্য যে, সে রাষ্ট্রীয়ভাবে শরী'আহ আইন প্রতিষ্ঠা করবে। সে যদি সত্যিই তা করতে চায়, তবে আল্লাহ তা'আলার সাহায্যও পেয়ে যায়। আল্লাহ তা'আলার ওয়াদা রয়েছে-
وَلَيَنصُرَنَّ اللَّهُ مَن يَنصُرُهُ ۗ إِنَّ اللَّهَ لَقَوِيٌّ عَزِيزٌ
আল্লাহ অবশ্যই তাদের সাহায্য করবেন, যারা তার (দীনের) সাহায্য করবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বশক্তিমান, পরাক্রমশালী। (সূরা হজ্জ (২২), আয়াত ৪০)

জান্নাতবাসী দ্বিতীয় শ্রেণির লোক হল- ورجل رحيم رقيق القلب لكل ذي قرب ومسلم (প্রত্যেক আত্মীয় এবং মুসলিমের জন্য নরম মনের দয়ালু ব্যক্তি)। অর্থাৎ যেসকল কোমলমনা ব্যক্তি আত্মীয়-স্বজনের প্রতি দয়ার আচরণ করে, তাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক রক্ষা করে, তাদের হক আদায়ে যত্নবান থাকে এবং তারা সম্পর্ক ছিন্ন করলেও সে তাদের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা করে চলে, তারা জান্নাত লাভ করবে। তবে সেইসঙ্গে এটাও জরুরী যে, দুনিয়ার প্রত্যেক মুসলিমের প্রতিই সে দয়া ও মায়া-মমতা লালন করবে। একজন মুসলিমের কর্তব্য দুনিয়ার সকল মুসলিমকে ভাইয়ের দৃষ্টিতে দেখা; বরং নিজ দেহের অঙ্গের মতো গণ্য করা। সুতরাং সে সকলকেই ভালোবাসবে এবং আপন সাধ্যমতে সকলেরই কল্যাণ করার চেষ্টা করবে। হাঁ, আত্মীয়ের অধিকার যেহেতু অনাত্মীয়ের তুলনায় বেশি, তাই তুলনামূলক বেশি সদাচরণ তাদেরই প্রাপ্য। এ কারণেই আত্মীয়ের কথা আগে বলা হয়েছে। কিছু আছে সাধারণ হক। যেমন জান, মাল ও ইজ্জতের নিরাপত্তা। এ ক্ষেত্রে সকলেই সমান। আত্মীয় হোক বা অনাত্মীয়, কারওই জান, মাল ও ইজ্জতের ক্ষতি করা কোনওক্রমেই জায়েয নয়। কিন্তু আত্মীয়তার সুবাদে আত্মীয়ের বাড়তি হক রয়েছে আর তা হচ্ছে তাদের খোঁজখবর নেওয়া এবং তাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলা। তবে এ হাদীছে কেবল হক আদায় করে সন্তুষ্ট থাকার কথা বলা হয়নি; বরং তারও অধিক কোমল আচরণ ও দয়ালু মনের পরিচয় দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। এটা হকের অতিরিক্ত বিষয়, যাকে পরিভাষায় ইহসান বলা হয়। জান্নাতবাসীগণ ইহসানের অধিকারী হয়ে থাকে।

বলাবাহুল্য, যারা অন্যের সঙ্গে ইহসানের আচরণ করে, অর্থাৎ আইনের ঊর্ধ্বে উঠে বাড়তি দয়া ও মায়া-মমতার আচরণ করে, তারা অন্যের হক তো অবশ্যই আদায় করে থাকে। তাদের দ্বারা কখনও কারও অধিকার খর্ব হয় না। অধিকার খর্ব করাটা জান্নাতে যাওয়ার জন্য বাধা। যারা ইহসানের আচরণ করে, স্বাভাবিকভাবেই তারা যেহেতু অন্যের হকসমূহ আদায়ে যত্নবান থাকে, তাই এদিক থেকে জান্নাতে যাওয়ার জন্য তাদের কোনও বাধা থাকে না। সুতরাং তারা জান্নাতবাসী হবে এবং দয়ামায়ার আচরণ করার কারণে জান্নাতে উচ্চতর মর্যাদার অধিকারী হবে।

জান্নাতবাসী তৃতীয় শ্রেণির লোক হল- وَعَفِيفٌ مُتَعَفِّفٌ ذُو عِيَالٍ (এবং পরিবার-পরিজনওয়ালা এমন চরিত্রবান ব্যক্তি, যে অন্যের কাছে চাওয়া হতে নিজ সম্মান রক্ষা করে)। عَفِيفٌ অর্থ চরিত্রবান। যে ব্যক্তি যাবতীয় হারাম ও অবৈধ বিষয় থেকে নিজেকে রক্ষা করে, যেমন সুদ ও ঘুষ খাওয়া, চুরি-ডাকাতি করা বা অন্য কোনওভাবে অন্যের সম্পদ আত্মসাৎ করা, ব্যভিচার করা, হারাম পশু আহার করা, মদপান করা ইত্যাদি, তাকে عفيف বলা হয়।

مُتَعَفِّفٌ বলা হয় ওই ব্যক্তিকে, যে অন্যের কাছে হাত পাতা হতে বিরত থাকে।

যার পরিবার-পরিজন আছে আবার আর্থিকভাবেও অসচ্ছল, সে যদি সর্বপ্রকার হারাম খাওয়া হতে বিরত থাকে, সেইসঙ্গে কারও কাছে হাতও না পাতে, তবে তা তার অতি উচ্চস্তরের তাওয়াক্কুল ও আল্লাহনির্ভরতা এবং অতি উন্নত চরিত্র ও ধৈর্য-সহিষ্ণুতার পরিচয় বহন করে। উন্নত চরিত্র জান্নাতলাভের পক্ষে অনেক বড় সহায়ক। এ কারণেই এ হাদীছে এরূপ ব্যক্তিদের সম্পর্কে জানানো হয়েছে যে, তারা জান্নাতবাসী হবে।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. ন্যায়পরায়ণ শাসক জান্নাতবাসী হবে। কাজেই আল্লাহ তা'আলা যাকে রাষ্ট্রক্ষমতা দান করেন, তার একান্ত কর্তব্য ন্যায়-ইনসাফের সঙ্গে রাষ্ট্র পরিচালনা করা।

খ. যে শাসক রাষ্ট্রীয়ভাবে শরী'আহ আইন প্রতিষ্ঠা করতে চায়, আল্লাহ তা'আলা তাকে সাহায্য করে থাকেন।

গ. আত্মীয়-অনাত্মীয় সকলের প্রতি দয়ামায়ার আচরণ করা উচিত।

ঘ. অন্যদের তুলনায় আত্মীয়দের অধিকার বেশি। আচার-ব্যবহারে সে কথা স্মরণ রাখা উচিত।

ঙ. জান্নাতলাভের আশাবাদীকে অবশ্যই আপন চরিত্রের হেফাজত করতে হবে।

চ. অর্থসংকট যত বেশিই হোক, অন্যের কাছে হাত পাততে নেই।

ছ. যে গরীবের পরিবার-পরিজন আছে, তা সত্ত্বেও অন্যের কাছে হাত পাতে না, আল্লাহর কাছে তার অনেক মর্যাদা। কারও তার সে মর্যাদা উপেক্ষা করা উচিত নয়।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান