মুসনাদে আহমদ- ইমাম আহমদ রহঃ (আল-ফাতহুর রব্বানী)
খোরপোষ অধ্যায়
হাদীস নং: ২৪
খোরপোষ অধ্যায়
অধ্যায়: খোরপোষ
পরিচ্ছেদ : স্বামীর অবস্থা অনুযায়ী স্ত্রীর খোরপোষ আবশ্যিক হবে এবং এটা অন্যান্য আত্মীয়-স্বজন অপেক্ষা বেশি অগ্রাধিকার পাবে। এবং এ কাজে স্বামীর সওয়াব প্রসঙ্গ।
পরিচ্ছেদ : স্বামীর অবস্থা অনুযায়ী স্ত্রীর খোরপোষ আবশ্যিক হবে এবং এটা অন্যান্য আত্মীয়-স্বজন অপেক্ষা বেশি অগ্রাধিকার পাবে। এবং এ কাজে স্বামীর সওয়াব প্রসঙ্গ।
২৪। আবূ হুরায়রা (রা) সূত্রে নবী (ﷺ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, একটি দীনার তুমি আল্লাহর পথে ব্যয় করেছ, একটি দীনার তুমি দরিদ্রকে দান করেছ, একটি দীনার তুমি গোলাম আযাদ করায় ব্যয় করেছ, একটি দীনার তুমি তোমার পরিজনের জন্য ব্যয় করেছ, এসবের মধ্যে যে দীনার তুমি তোমার পরিজনের জন্য ব্যয় করেছ তার পুরস্কার সর্বাপেক্ষা বেশি। 
(মুসলিম ও অন্যান্য)
(মুসলিম ও অন্যান্য)
كتاب النفقات
كتاب النفقات
باب وجوب نفقة الزوجة باعتبار حال الزوج وأنها مقدمة على الأقارب وثواب الزوج عليها
باب وجوب نفقة الزوجة باعتبار حال الزوج وأنها مقدمة على الأقارب وثواب الزوج عليها
عن أبي هريرة عن النبي صلى الله عليه وسلم قال دينار أنفقته في سبيل الله عز وجل ودينار في المساكين ودينار في رقبة ودينار في أهلك أعظمها أجرا الدينار الذي أنفقته على أهلك
হাদীসের ব্যাখ্যা:
এ হাদীছটিতে চার রকম অর্থব্যয়ের কথা বলা হয়েছে। তার মধ্যে এক হচ্ছে আল্লাহর পথে ব্যয়। আল্লাহর পথে ব্যয়ের অর্থ জিহাদে ব্যয় করা। জিহাদে ব্যয় করার প্রধান দু'টি খাত হচ্ছে জিহাদের জন্য বাহন কেনা এবং সহযোদ্ধাদের পেছনে খরচ করা। নিজে জিহাদে যাওয়ার জন্য আসবাবপত্র কেনা কিংবা নিজে যেতে না পারলে খরচা দিয়ে অন্যদের পাঠানোও জিহাদে ব্যয় করার অন্তর্ভুক্ত। এর সবটাই অত্যন্ত ফযীলতপূর্ণ আমল।
আল্লাহর পথে খরচ দ্বারা ব্যাপক অর্থে দীনের প্রচার ও প্রতিষ্ঠামূলক যে-কোনও কাজে অর্থ ব্যয় করা এবং আল্লাহর বান্দাদের সাহায্য-সহযোগিতায় টাকা-পয়সা খরচ করাও বোঝানো হতে পারে। এরকম অর্থব্যয়ও অনেক ছাওয়াবের কাজ। আল্লাহর পথে অর্থব্যয়ের ফযীলত সম্পর্কে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
مَنْ أَنْفَقَ نَفَقَة فِي سَبِيْلِ اللَّهِ كُتِبَتْ لَهُ بِسَبْعِ مِائَةِ ضِعْف
“কেউ আল্লাহর পথে কিছু খরচ করলে তার বিনিময়ে তার জন্য সাতশ গুণ বেশি খরচের নেকী লেখা হয় (অর্থাৎ এক টাকা খরচ করলে সাতশ' টাকা খরচের ছাওয়াব পাওয়া যায়)।৩৭৪
     
আরেকটি হচ্ছে দাসমুক্তিতে অর্থ ব্যয় করা, যেমন কোনও গোলাম কিনে তাকে আযাদ করে দেওয়া, অর্থের বিনিময়ে মনীবের সঙ্গে যে গোলামের মুক্তিচুক্তি (মুকাতাবা) সম্পন্ন হয়েছে তাকে টাকা-পয়সা দিয়ে তার চুক্তির অর্থ পরিশোধে সাহায্য করা ইত্যাদি। এটা বিপুল ছাওয়াবের কাজ। এক হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
مَنْ أَعْتَقَ رَقَبَةً مُسْلِمَةً ، أَعْتَقَ اللهُ بِكُلِّ عُصْرٍ مِنْهُ عُضَوا مِنَ النَّارِ
'যে ব্যক্তি কোনও মুসলিম গোলামকে মুক্তিদান করে, আল্লাহ তাআলা সে গোলামের প্রতি অঙ্গের বিনিময়ে তার প্রতি অঙ্গ জাহান্নাম থেকে মুক্ত রাখেন।৩৭৫
    
আরেকটি হচ্ছে গরীব-মিসকীনের উপর অর্থব্যয় করা। এটাও অনেক বড় নেকীর কাজ। যেমন হাদীছে ইরশাদ হয়েছে-
السَّاعِي عَلَى الْأَرْمَلَةِ وَالْمِسْكِيْنِ كَالْمُجَاهِدِ فِي سَبِيلِ اللَّهِ وَأَحْسَبُهُ قَالَ: وَكَالْقَائِم الَّذِي لا يَفْتُرُ، وَكَالصَّائِمِ الَّذِي لَا يُفْطِرُ
‘হযরত আবু হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, বিধবা ও মিসকীনদের সহায়তাকারী আল্লাহর পথে জিহাদকারীর মত । (রাবী বলেন) আমার ধারণা তিনি আরও বলেছেন, এবং সে অবিশ্রান্ত নামায আদায়কারীর মত বা ওই রোযাদারের মত, যে কখনও রোযা ছাড়া থাকে না।৩৭৬
পরিবারবর্গের পেছনে অর্থব্যয় যে কারণে শ্রেষ্ঠ
আরেকটি হচ্ছে পরিবার-পরিজনের পেছনে অর্থব্যয় করা। এ চার প্রকার ব্যয়ের মধ্যে ছাওয়াবের দিক থেকে শ্রেষ্ঠতম হচ্ছে পরিবার-পরিজনের পেছনে অর্থ ব্যয় করা।
পরিবারবর্গের পেছনে ব্যয় করা সর্বোত্তম এ কারণে যে, এছাড়া বাকিগুলো সাধারণভাবে ওয়াজিব নয়, নফল ও মুস্তাহাব পর্যায়ের। তা করার দ্বারা ছাওয়াব পাওয়া যায়, না করলে স্বাভাবিক অবস্থায় কোনও গুনাহ নেই। পক্ষান্তরে পরিবার-পরিজনের পেছনে ব্যয় করা ফরয। তাদের অন্ন, বস্ত্র ও বাসস্থানের ব্যবস্থা করা পরিবারের কর্তার জন্য অবশ্যকর্তব্য। এ ব্যাপারে অবহেলা করলে গুনাহ হয়। যেমন এক হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
كَفَى بِالْمَرْءِ إِثْمًا أَنْ يُضَيَّعَ مَنْ يَقُوْتُ
‘নিজ পোষ্যদের ধ্বংসের মুখে ফেলে দেওয়া কোনও ব্যক্তির গুনাহগার হওয়ার জন্য যথেষ্ট।৩৭৭
বলাবাহুল্য, যে-কোনও নফল আমলের চেয়ে ফরয আমলের ছাওয়ার অনেক অনেক বেশি হয়ে থাকে। পরিবারবর্গের পেছনে অর্থ ব্যয় করা যখন ফরয আর বাকিগুলো নফল, তখন সেগুলো অপেক্ষা পরিবারবর্গের পেছনে ব্যয় করার ফযীলত বেশিই হবে বৈকি। সে কারণেই এ হাদীছে পরিবার-পরিজনের পেছনে ব্যয় করাকে উত্তম বলা হয়েছে।
একশ্রেণীর লোক কেবল জযবা দিয়ে চলে। তারা আবেগের তাড়নায় বিভিন্ন দীনী কাজে অকাতরে অর্থ ব্যয় করে। কিন্তু স্ত্রী ও ছেলেমেয়ের প্রতি লক্ষ রাখে না। কেউ তো বিভিন্ন দীনী কাজে এমন মশগুল হয়ে থাকে যে, বউ-বাচ্চার দিকে খেয়াল রাখারই অবকাশ হয় না। তারা খেয়ে থাকল না না খেয়ে, তাদের চিকিৎসাহ হচ্ছে না বিনা চিকিৎসায় কষ্ট পাচ্ছে, এ নিয়ে কোনও চিন্তা নেই। এটা একরকম বৈরাগ্য। ইসলামে এর অনুমোদন নেই। এ শ্রেণীর লোককে আখেরাতে কঠিন জবাবদিহিতার সম্মুখীন হতে হবে। কেননা পরিবার-পরিজন আমানতস্বরূপ। গৃহকর্তা তাদের দায়িত্বশীল। তাদের যথাযথ তত্ত্বাবধান না করা আমানতের খেয়ানত করার শামিল। যে-কোনও দায়িত্বশীল ব্যক্তি আমানতদারির সঙ্গে দায়িত্ব আদায় করেছে কি না সে ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা হবে বলে হাদীছ মারফত আমাদের জানানো হয়েছে। অতএব কেবল জযবা দ্বারা নয়; বরং শরীআতের নির্দেশনা মোতাবেকই চলা উচিত। তাতেই দুনিয়ার শান্তি ও আখেরাতের মুক্তি।
উল্লেখ্য, পরিবার-পরিজনের পেছনে ব্যয় করার দ্বারা তাদের জরুরি ও প্রয়োজনীয় ব্যয়ের কথাই বোঝানো উদ্দেশ্য। তাদের খেয়াল-খুশি ও অন্যায় আবদার মেটানোর ব্যয় এর মধ্যে পড়ে না। সেরকম ব্যয় ছাওয়াবের কাজ তো নয়ই; বরং কঠিন গুনাহ। এ ব্যাপারে প্রত্যেক গৃহকর্তার সতর্ক থাকা প্রয়োজন।
পরিবারবর্গের প্রতি দু'রকম দায়িত্ব
প্রকাশ থাকে যে, পরিবার-পরিজনের প্রতি গৃহকর্তার দায়িত্ব-কর্তব্য দুইরকম। এক হচ্ছে দুনিয়াবী দায়িত্ব, আরেক দীনী দায়িত্ব। দুনিয়াবী দায়িত্ব পালন করা অর্থাৎ তাদের অন্ন, বস্ত্র ও বাসস্থান ইত্যাদি মৌলিক চাহিদা পূরণ করা যেমন ফরয, তেমনি দীনী দায়িত্ব পালনও ফরয বৈকি। দীনী দায়িত্ব হচ্ছে তাদেরকে দীনের মৌলিক বিষয়াবলী শেখানো, যেমন তাওহীদ, রিসালাত, আখেরাতসহ অন্যান্য বিশ্বাসের সঙ্গে তাদেরকে পরিচিত করা: নামায, রোযা, যাকাত ও হজ্জের মাসাইল শিক্ষা দেওয়া; ওযূ-গোসল, পাক-পবিত্রতা, হালাল-হারাম ইত্যাদি সম্পর্কে অবগত করা; পিতামাতা, আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশীসহ আত্মীয়-অনাত্মীয় নির্বিশেষে সমস্ত মানুষের হুকুক সম্পর্কে তালীম দেওয়া এবং ইসলামী আখলাক-চরিত্র সম্পর্কে তাদেরকে ওয়াকিফহাল করা। এসব শেখানোর পাশাপাশি তারা যাতে এর উপর আমলে অভ্যস্ত হয় সেদিকে লক্ষ রাখাও জরুরি।
এ দায়িত্ব পালন করার জরুরত দুনিয়াবী দায়িত্ব পালন অপেক্ষাও অনেক বেশি। পরিবার-পরিজনের দুনিয়াবী চাহিদা পূরণ না করলে তাতে তাদের ইহজীবনের ক্ষতি। এ ক্ষতি অনেক সীমিত। পক্ষান্তরে তাদের দীনী জরুরত পূরণ না করলে তাদের আখেরাতের ক্ষতি হয়। সে ক্ষতি অসীম। তাদের দুনিয়াবী ক্ষতি থেকে বাঁচানোর জন্য যে টাকা-পয়সা খরচ করা হয়, তা যদি জিহাদ ও গরীব-মিসকীনদের মধ্যে দান-খয়রাত করার চে'ও উত্তম হয়, তবে তাদের দীনী প্রয়োজন পূরণে যে টাকা-পয়সা খরচ করা হবে তার ফযীলত কত উচ্চ হবে? এ ক্ষেত্রে আমাদের অনেকের মধ্যেই গাফলাতী লক্ষ করা যায়। এ গাফলাতী কিছুতেই কাম্য নয়।
হাদীছ থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. এ হাদীছটি দ্বারা জানা গেল আল্লাহর পথে অর্থ ব্যয় করা, দাসমুক্তিতে অর্থ ব্যয় করা এবং গরীব-মিসকীনদের সাহায্য-সহযোগিতা করা অনেক বড় ছাওয়াবের কাজ। আপন আপন সামর্থ্য অনুযায়ী আমাদের এ জাতীয় অর্থব্যয়ে শরীক থাকা চাই।
খ. নিজ পরিবারবর্গের মৌলিক চাহিদা পূরণের জন্য অর্থ ব্যয় করা ফরয এবং এর ছাওয়াব অন্যসব অর্থব্যয় অপেক্ষা অনেক বেশি। এ ক্ষেত্রে অবহেলা করা কিছুতেই বাঞ্ছনীয় নয়।
৩৭৪. জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ১৬২৫; সুনানে নাসাঈ, হাদীছ নং ৩১৮৬; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ১৯০৩৬; মুসান্নাফে ইবন আবী শাইবা, হাদীছ নং ১৯৪২৪; সহীহ ইবন হিব্বান হাদীছ নং ৪৬৪৭; তাবারানী, আল মুজামুল কাবীর, হাদীছ নং ৪১৫৩; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ৬৫৪২; শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ৩৯৬৩
৩৭৫, সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৬৭১৫; সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ১৫০৯; সুনানে আবূ দাউদ, হাদীছ নং ৩৯৬৬; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ১৫৪১; সুনানে নাসাঈ, হাদীছ নং ৩১৪৫; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ৯৭৭৩; মুসান্নাফে ইবন আবী শাইবা, হাদীছ নং ১২৬৩৩: সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ৪৩০৮; তাবারানী, আল মুজামুল কাবীর, হাদীছ নং ৫৮৩৯
৩৭৬. সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৬০০৬; সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ২৯৮২; সুনানে নাসাঈ, হাদীছ নং ২৫৭৭; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ২৩৬৯; সুনানে ইবন মাজাহ, হাদীছ নং ২১৪০; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ৮৭৩২; সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ৪২৪৫; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ১২৬৬৪; শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ১০৫৮
৩৭৭, সুনানে আবূ দাউদ, হাদীছ নং ১৬৯২; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ৬৪৯৫; সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ৪২৪০; তাবারানী, আল মুজামুল কাবীর, হাদীছ নং ১৩৪১৪; বায়হাকী, আস্ সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ১৫৬৯৪; শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ৮৩৩৬; নাসাঈ, আস্ সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ৯১৩২
আল্লাহর পথে খরচ দ্বারা ব্যাপক অর্থে দীনের প্রচার ও প্রতিষ্ঠামূলক যে-কোনও কাজে অর্থ ব্যয় করা এবং আল্লাহর বান্দাদের সাহায্য-সহযোগিতায় টাকা-পয়সা খরচ করাও বোঝানো হতে পারে। এরকম অর্থব্যয়ও অনেক ছাওয়াবের কাজ। আল্লাহর পথে অর্থব্যয়ের ফযীলত সম্পর্কে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
مَنْ أَنْفَقَ نَفَقَة فِي سَبِيْلِ اللَّهِ كُتِبَتْ لَهُ بِسَبْعِ مِائَةِ ضِعْف
“কেউ আল্লাহর পথে কিছু খরচ করলে তার বিনিময়ে তার জন্য সাতশ গুণ বেশি খরচের নেকী লেখা হয় (অর্থাৎ এক টাকা খরচ করলে সাতশ' টাকা খরচের ছাওয়াব পাওয়া যায়)।৩৭৪
আরেকটি হচ্ছে দাসমুক্তিতে অর্থ ব্যয় করা, যেমন কোনও গোলাম কিনে তাকে আযাদ করে দেওয়া, অর্থের বিনিময়ে মনীবের সঙ্গে যে গোলামের মুক্তিচুক্তি (মুকাতাবা) সম্পন্ন হয়েছে তাকে টাকা-পয়সা দিয়ে তার চুক্তির অর্থ পরিশোধে সাহায্য করা ইত্যাদি। এটা বিপুল ছাওয়াবের কাজ। এক হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
مَنْ أَعْتَقَ رَقَبَةً مُسْلِمَةً ، أَعْتَقَ اللهُ بِكُلِّ عُصْرٍ مِنْهُ عُضَوا مِنَ النَّارِ
'যে ব্যক্তি কোনও মুসলিম গোলামকে মুক্তিদান করে, আল্লাহ তাআলা সে গোলামের প্রতি অঙ্গের বিনিময়ে তার প্রতি অঙ্গ জাহান্নাম থেকে মুক্ত রাখেন।৩৭৫
আরেকটি হচ্ছে গরীব-মিসকীনের উপর অর্থব্যয় করা। এটাও অনেক বড় নেকীর কাজ। যেমন হাদীছে ইরশাদ হয়েছে-
السَّاعِي عَلَى الْأَرْمَلَةِ وَالْمِسْكِيْنِ كَالْمُجَاهِدِ فِي سَبِيلِ اللَّهِ وَأَحْسَبُهُ قَالَ: وَكَالْقَائِم الَّذِي لا يَفْتُرُ، وَكَالصَّائِمِ الَّذِي لَا يُفْطِرُ
‘হযরত আবু হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, বিধবা ও মিসকীনদের সহায়তাকারী আল্লাহর পথে জিহাদকারীর মত । (রাবী বলেন) আমার ধারণা তিনি আরও বলেছেন, এবং সে অবিশ্রান্ত নামায আদায়কারীর মত বা ওই রোযাদারের মত, যে কখনও রোযা ছাড়া থাকে না।৩৭৬
পরিবারবর্গের পেছনে অর্থব্যয় যে কারণে শ্রেষ্ঠ
আরেকটি হচ্ছে পরিবার-পরিজনের পেছনে অর্থব্যয় করা। এ চার প্রকার ব্যয়ের মধ্যে ছাওয়াবের দিক থেকে শ্রেষ্ঠতম হচ্ছে পরিবার-পরিজনের পেছনে অর্থ ব্যয় করা।
পরিবারবর্গের পেছনে ব্যয় করা সর্বোত্তম এ কারণে যে, এছাড়া বাকিগুলো সাধারণভাবে ওয়াজিব নয়, নফল ও মুস্তাহাব পর্যায়ের। তা করার দ্বারা ছাওয়াব পাওয়া যায়, না করলে স্বাভাবিক অবস্থায় কোনও গুনাহ নেই। পক্ষান্তরে পরিবার-পরিজনের পেছনে ব্যয় করা ফরয। তাদের অন্ন, বস্ত্র ও বাসস্থানের ব্যবস্থা করা পরিবারের কর্তার জন্য অবশ্যকর্তব্য। এ ব্যাপারে অবহেলা করলে গুনাহ হয়। যেমন এক হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
كَفَى بِالْمَرْءِ إِثْمًا أَنْ يُضَيَّعَ مَنْ يَقُوْتُ
‘নিজ পোষ্যদের ধ্বংসের মুখে ফেলে দেওয়া কোনও ব্যক্তির গুনাহগার হওয়ার জন্য যথেষ্ট।৩৭৭
বলাবাহুল্য, যে-কোনও নফল আমলের চেয়ে ফরয আমলের ছাওয়ার অনেক অনেক বেশি হয়ে থাকে। পরিবারবর্গের পেছনে অর্থ ব্যয় করা যখন ফরয আর বাকিগুলো নফল, তখন সেগুলো অপেক্ষা পরিবারবর্গের পেছনে ব্যয় করার ফযীলত বেশিই হবে বৈকি। সে কারণেই এ হাদীছে পরিবার-পরিজনের পেছনে ব্যয় করাকে উত্তম বলা হয়েছে।
একশ্রেণীর লোক কেবল জযবা দিয়ে চলে। তারা আবেগের তাড়নায় বিভিন্ন দীনী কাজে অকাতরে অর্থ ব্যয় করে। কিন্তু স্ত্রী ও ছেলেমেয়ের প্রতি লক্ষ রাখে না। কেউ তো বিভিন্ন দীনী কাজে এমন মশগুল হয়ে থাকে যে, বউ-বাচ্চার দিকে খেয়াল রাখারই অবকাশ হয় না। তারা খেয়ে থাকল না না খেয়ে, তাদের চিকিৎসাহ হচ্ছে না বিনা চিকিৎসায় কষ্ট পাচ্ছে, এ নিয়ে কোনও চিন্তা নেই। এটা একরকম বৈরাগ্য। ইসলামে এর অনুমোদন নেই। এ শ্রেণীর লোককে আখেরাতে কঠিন জবাবদিহিতার সম্মুখীন হতে হবে। কেননা পরিবার-পরিজন আমানতস্বরূপ। গৃহকর্তা তাদের দায়িত্বশীল। তাদের যথাযথ তত্ত্বাবধান না করা আমানতের খেয়ানত করার শামিল। যে-কোনও দায়িত্বশীল ব্যক্তি আমানতদারির সঙ্গে দায়িত্ব আদায় করেছে কি না সে ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা হবে বলে হাদীছ মারফত আমাদের জানানো হয়েছে। অতএব কেবল জযবা দ্বারা নয়; বরং শরীআতের নির্দেশনা মোতাবেকই চলা উচিত। তাতেই দুনিয়ার শান্তি ও আখেরাতের মুক্তি।
উল্লেখ্য, পরিবার-পরিজনের পেছনে ব্যয় করার দ্বারা তাদের জরুরি ও প্রয়োজনীয় ব্যয়ের কথাই বোঝানো উদ্দেশ্য। তাদের খেয়াল-খুশি ও অন্যায় আবদার মেটানোর ব্যয় এর মধ্যে পড়ে না। সেরকম ব্যয় ছাওয়াবের কাজ তো নয়ই; বরং কঠিন গুনাহ। এ ব্যাপারে প্রত্যেক গৃহকর্তার সতর্ক থাকা প্রয়োজন।
পরিবারবর্গের প্রতি দু'রকম দায়িত্ব
প্রকাশ থাকে যে, পরিবার-পরিজনের প্রতি গৃহকর্তার দায়িত্ব-কর্তব্য দুইরকম। এক হচ্ছে দুনিয়াবী দায়িত্ব, আরেক দীনী দায়িত্ব। দুনিয়াবী দায়িত্ব পালন করা অর্থাৎ তাদের অন্ন, বস্ত্র ও বাসস্থান ইত্যাদি মৌলিক চাহিদা পূরণ করা যেমন ফরয, তেমনি দীনী দায়িত্ব পালনও ফরয বৈকি। দীনী দায়িত্ব হচ্ছে তাদেরকে দীনের মৌলিক বিষয়াবলী শেখানো, যেমন তাওহীদ, রিসালাত, আখেরাতসহ অন্যান্য বিশ্বাসের সঙ্গে তাদেরকে পরিচিত করা: নামায, রোযা, যাকাত ও হজ্জের মাসাইল শিক্ষা দেওয়া; ওযূ-গোসল, পাক-পবিত্রতা, হালাল-হারাম ইত্যাদি সম্পর্কে অবগত করা; পিতামাতা, আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশীসহ আত্মীয়-অনাত্মীয় নির্বিশেষে সমস্ত মানুষের হুকুক সম্পর্কে তালীম দেওয়া এবং ইসলামী আখলাক-চরিত্র সম্পর্কে তাদেরকে ওয়াকিফহাল করা। এসব শেখানোর পাশাপাশি তারা যাতে এর উপর আমলে অভ্যস্ত হয় সেদিকে লক্ষ রাখাও জরুরি।
এ দায়িত্ব পালন করার জরুরত দুনিয়াবী দায়িত্ব পালন অপেক্ষাও অনেক বেশি। পরিবার-পরিজনের দুনিয়াবী চাহিদা পূরণ না করলে তাতে তাদের ইহজীবনের ক্ষতি। এ ক্ষতি অনেক সীমিত। পক্ষান্তরে তাদের দীনী জরুরত পূরণ না করলে তাদের আখেরাতের ক্ষতি হয়। সে ক্ষতি অসীম। তাদের দুনিয়াবী ক্ষতি থেকে বাঁচানোর জন্য যে টাকা-পয়সা খরচ করা হয়, তা যদি জিহাদ ও গরীব-মিসকীনদের মধ্যে দান-খয়রাত করার চে'ও উত্তম হয়, তবে তাদের দীনী প্রয়োজন পূরণে যে টাকা-পয়সা খরচ করা হবে তার ফযীলত কত উচ্চ হবে? এ ক্ষেত্রে আমাদের অনেকের মধ্যেই গাফলাতী লক্ষ করা যায়। এ গাফলাতী কিছুতেই কাম্য নয়।
হাদীছ থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. এ হাদীছটি দ্বারা জানা গেল আল্লাহর পথে অর্থ ব্যয় করা, দাসমুক্তিতে অর্থ ব্যয় করা এবং গরীব-মিসকীনদের সাহায্য-সহযোগিতা করা অনেক বড় ছাওয়াবের কাজ। আপন আপন সামর্থ্য অনুযায়ী আমাদের এ জাতীয় অর্থব্যয়ে শরীক থাকা চাই।
খ. নিজ পরিবারবর্গের মৌলিক চাহিদা পূরণের জন্য অর্থ ব্যয় করা ফরয এবং এর ছাওয়াব অন্যসব অর্থব্যয় অপেক্ষা অনেক বেশি। এ ক্ষেত্রে অবহেলা করা কিছুতেই বাঞ্ছনীয় নয়।
৩৭৪. জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ১৬২৫; সুনানে নাসাঈ, হাদীছ নং ৩১৮৬; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ১৯০৩৬; মুসান্নাফে ইবন আবী শাইবা, হাদীছ নং ১৯৪২৪; সহীহ ইবন হিব্বান হাদীছ নং ৪৬৪৭; তাবারানী, আল মুজামুল কাবীর, হাদীছ নং ৪১৫৩; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ৬৫৪২; শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ৩৯৬৩
৩৭৫, সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৬৭১৫; সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ১৫০৯; সুনানে আবূ দাউদ, হাদীছ নং ৩৯৬৬; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ১৫৪১; সুনানে নাসাঈ, হাদীছ নং ৩১৪৫; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ৯৭৭৩; মুসান্নাফে ইবন আবী শাইবা, হাদীছ নং ১২৬৩৩: সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ৪৩০৮; তাবারানী, আল মুজামুল কাবীর, হাদীছ নং ৫৮৩৯
৩৭৬. সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৬০০৬; সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ২৯৮২; সুনানে নাসাঈ, হাদীছ নং ২৫৭৭; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ২৩৬৯; সুনানে ইবন মাজাহ, হাদীছ নং ২১৪০; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ৮৭৩২; সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ৪২৪৫; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ১২৬৬৪; শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ১০৫৮
৩৭৭, সুনানে আবূ দাউদ, হাদীছ নং ১৬৯২; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ৬৪৯৫; সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ৪২৪০; তাবারানী, আল মুজামুল কাবীর, হাদীছ নং ১৩৪১৪; বায়হাকী, আস্ সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ১৫৬৯৪; শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ৮৩৩৬; নাসাঈ, আস্ সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ৯১৩২
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
 তাহকীক:তাহকীক চলমান
তাহকীক:তাহকীক চলমান