মুসনাদে আহমদ- ইমাম আহমদ রহঃ (আল-ফাতহুর রব্বানী)
স্বপ্নের ব্যাখ্যা অধ্যায়
হাদীস নং: ১৪
স্বপ্নের ব্যাখ্যা অধ্যায়
পরিচ্ছেদ : স্বপ্নের প্রকারভেদ এবং খারাপ স্বপ্ন দেখলে কী করবে?
১৪। আবূ হুরায়রা (রা) সূত্রে নবী (ﷺ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, শেষ যামানায় মু'মিন ব্যক্তির স্বপ্ন প্রায়ই মিথ্যা হবে না। তোমাদের মধ্যে সর্বাধিক বাস্তব স্বপ্নদ্রষ্টা সে, যে সর্বাধিক সত্যবাদী। স্বপ্ন তিন প্রকার। (এক) 'ভাল স্বপ্ন' আল্লাহর পক্ষ হতে সুসংবাদবাহক। (দুই) এমন বিষয়ের স্বপ্ন যা মানুষ কল্পনা করে। (তিন) এমন স্বপ্ন যা শয়তানের পক্ষ হতে দুর্ভাবনার সৃষ্টি করে। যদি তোমাদের মধ্যে কেউ এমন স্বপ্ন দেখে, যা সে অপসন্দ করে, তা হলে সে যেন স্বপ্নের কথা কারো নিকট প্রকাশ না করে এবং (ঘুম হতে) উঠে সালাত আদায় করে। আবূ হুরায়রা (রা) বলেন, আমি (স্বপ্নে) হাতকড়া দেখা পসন্দ করি এবং গলায় বেড়ি দেখা অপসন্দ করি। কেননা, হাতকড়া ধর্মের ওপর অবিচলতা প্রকাশ করে। নবী (ﷺ) বলেছেন, মু'মিন ব্যক্তির স্বপ্ন নবুওয়াতের ছেচল্লিশ ভাগের একভাগ।
(বুখারী, মুসলিম, তিরমিযী, ইবন মাজাহ)
(বুখারী, মুসলিম, তিরমিযী, ইবন মাজাহ)
كتاب تعبير الرؤيا
باب أنواع الرؤيا وما يفعل من رأى ما يكره
عن أبي هريرة (4) عن النبي صلى الله عليه وسلم قال في آخر الزمان (5) لا تكاد رؤيا المؤمن تكذب وأصدقكم رؤيا أصدقكم حديثًا (6) والرؤيا ثلاثة، الرؤيا الحسنة بشرى من الله عز وجل (7) والرؤيا يحدث بها الرجل نفسه (8) والرؤيا تحزين من الشيطان (9) فإذا رأى أحدكم رؤيا يكرهها فلا يحدث بها أحدًا وليقم فليصل (10) قال أبو هريرة يعجبني، القيد (11) وأكره الغل، القيد ثبات في الدين، وقال النبي صلى الله عليه وسلم رؤيا المؤمن جزء من ستة وأربعين جزءًا من النبوة
হাদীসের ব্যাখ্যা:
এতে মোট তিনটি বিষয় বর্ণিত হয়েছে। (ক) কোন সময়ের স্বপ্ন সাধারণত সত্য হয়, মিথ্যা প্রায় হয়ই না। (খ) কার দেখা স্বপ্ন বেশি সত্য হয়। (গ) সত্যস্বপ্ন নবুওয়াতের এক ভগ্নাংশ।
কোন সময়কার স্বপ্ন সত্য
কোন সময়কার স্বপ্ন সাধারণত সত্য হয়, সে সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে- إذا اقترب الزمان 'যখন কাল কাছাকাছি হবে (বা কাছাকাছি হয়)। ব্যাখ্যাদাতাগণ এর বিভিন্ন ব্যাখ্যা করেছেন। যেমন কারও মতে এর অর্থ হল দিন ও রাতের সময় কাছাকাছি হওয়া। অর্থাৎ দিন অপেক্ষা রাত বা রাত অপেক্ষা দিন বেশি বড় না হওয়া। এটা একেক অঞ্চলে একেক ঋতুতে হয়। তা যে ঋতুতেই হোক না কেন, দিন ও রাতের সময় যখন কাছাকাছি হয়, উভয়ের মধ্যে বিশেষ পার্থক্য হয় না, তখন মানুষের স্বভাব-প্রকৃতি ভারসাম্যপূর্ণ থাকে। ফলে তখন যে স্বপ্ন দেখে তা সাধারণত সঠিকই হয়।
কারও মতে সময় কাছাকাছি হওয়ার অর্থ কিয়ামত কাছাকাছি হওয়া। খুবসম্ভব এটা ওই সময়, যখন হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের হাতে দাজ্জালের ধ্বংস সাধিত হবে। তারপর দুনিয়ায় যত মানুষ অবশিষ্ট থাকবে, তারা সকলেই হবে মুসলিম। এটাই সেই সময় সারা বিশ্বে দীন বলতে কেবল ইসলামই অবশিষ্ট থাকবে, অন্য কোনও দীন ও ধর্মের অস্তিত্ব থাকবে না। এ সময়ে মুসলিম ব্যক্তির দেখা প্রতিটি স্বপ্ন সত্যই হবে। যেমন সেই সময়কার বিবরণ সম্বলিত দীর্ঘ এক হাদীছে আছে-
فيبعث الله عِيسَى بن مَرْيَمَ فَيَمْكُثُ فِي النَّاسِ سَبْعَ سِنِينَ لَيْسَ بَيْنَ اثْنَيْنِ عَدَاوَةٌ ثُمَّ يُرْسِلُ اللَّهُ رِيحًا بَارِدَةً مِنْ قِبَلِ الشَّامِ فَلَا يَبْقَى عَلَى وَجْهِ الْأَرْضِ أَحَدٌ فِي قَلْبِهِ مِثْقَالُ ذَرَّةٍ مِنْ خَيْرٍ أَوْ إِيمَانٍ إِلَّا قَبَضَهُ الْحَدِيثَ قَالَ فَكَانَ أَهْلُ هَذَا الزَّمَانِ أَحْسَنَ هَذِهِ الْأُمَّةِ حَالًا بَعْدَ الصَّدْرِ الْأَوَّلِ وَأَصْدَقَهُمْ أَقْوَالًا فَكَانَتْ رُؤْيَاهُمْ لَا تَكْذِبُ
'তারপর আল্লাহ তা'আলা ঈসা ইবন মারয়ামকে পাঠাবেন। তিনি মানুষের মধ্যে সাত বছর অবস্থান করবেন। তখন কোনও দুই ব্যক্তির মধ্যে শত্রুতা থাকবে না। ইসলামের প্রথম যুগের পর এ যুগের মানুষই হবে এ উম্মতের সর্বোত্তম মানুষ। তাদের অবস্থা হবে সবচে' ভালো। তারা কথায় হবে সর্বাপেক্ষা বেশি সত্যবাদী। তাদের স্বপ্ন মিথ্যা হবে না। (ফাতহুল বারী, ১২ খণ্ড, ৪০৬ পৃষ্ঠা (মাকতাবায়ে শামেলা)।)
অবশ্য সময় নিকটবর্তী হওয়ার দ্বারা কিয়ামতের কাছাকাছি ওই সময়কেও বোঝানো হতে পারে, যখন আল্লাহ তা'আলা অধিকাংশ আলেমকে তুলে নেবেন। চারদিকে দীন সম্পর্কে ব্যাপক অজ্ঞতা ছড়িয়ে পড়বে। মানুষ নানারকম ফিতনা-ফাসাদের শিকার হবে। এরূপ অবস্থায় দীনী দৃষ্টিকোণ থেকে দিকনির্দেশনা লাভ করা মানুষের জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। এক তো ধারেকাছে আলেম-উলামা থাকবে না; আলেমদের অস্তিত্বই প্রায় বিলুপ্ত হয়ে যাবে। অন্যদিকে নতুন নবী আসারও কোনও সম্ভাবনা নেই, যেহেতু মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামই সর্বশেষ নবী। তাহলে মানুষ তখন কী করবে? কোথা থেকে সে নির্দেশনা পাবে? মানুষের এ প্রয়োজন মেটানোর জন্যই আল্লাহ তা'আলা তখন সত্যস্বপ্ন দ্বারা তাদের সাহায্য করবেন। মুসলিম ব্যক্তি স্বপ্নযোগে কল্যাণজনক বিষয়ে আগাম সুসংবাদ লাভ করবে। এমনিভাবে যে বিষয়ে তার সতর্ক হওয়া প্রয়োজন, সে বিষয়েও সে স্বপ্নযোগে ইশারা-ইঙ্গিত পাবে।
উল্লেখ্য, প্রত্যেকের জন্য তার মৃত্যুও এক রকম কিয়ামত। কাজেই তার ক্ষেত্রে এ কথা বলা যেতে পারে যে, মৃত্যু নিকটবর্তী হলে তার দেখা স্বপ্ন অন্য সময়ের স্বপ্ন অপেক্ষা বেশি সঠিক হয়, বিশেষত সে যদি বয়স্ক হয়। বয়স্ক ব্যক্তি বেশি সহনশীল, ও অভিজ্ঞতাসমৃদ্ধ হওয়ায় যেমন তার তুলনায় বেশি সঠিক হয়, তেমনি ঘুমন্ত অবস্থায় সে যা দেখে তাও তুলনামূলক বেশি সঠিক হয়।
কারও কারও মতে সময় কাছাকাছি হওয়ার অর্থ সময় খুব দ্রুত চলে যাওয়া। ঘণ্টা, দিন, সপ্তাহ এবং মাস ও বছর কীভাবে যে চলে যাবে তা টের পাওয়া যাবে না। চব্বিশ ঘন্টার দিবারাত্র মনে হবে কয়েক ঘণ্টাতেই ফুরিয়ে গেল। মাস শুরু হওয়ার পর দেখতে না দেখতে ফুরিয়ে যাবে এবং নতুন মাস শুরু হয়ে যাবে। এমনিভাবে বছরকে মনে হবে মাসের মতো অল্প দিনের। বলা হয়ে থাকে, এরূপ মনে হবে ইমাম মাহদীর সময়ে। তিনি যখন বিশ্ব শাসন করবেন, তখন চারদিকে ন্যায় ও ইনসাফ ছড়িয়ে পড়বে। সর্বত্র মানুষ জান, মাল ও ইজ্জতের নিরাপত্তা পাবে। মানুষ সুখে-শান্তিতে জীবন কাটাবে। কারও কোনও কষ্ট থাকবে না। সুখে-শান্তিতে দিন কাটতে থাকায় মনে হবে সময় খুব দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে। সুখের সময়টা খুব দ্রুত ফুরায় বলেই মনে হয়, যেমন কষ্টের কালকে খুব দীর্ঘ মনে হয়। স্বভাবতই এরূপ অবস্থায় মানুষের মন থাকবে সবরকম উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা থেকে মুক্ত। ফলে এ সময়ে যে স্বপ্ন তারা দেখবে, তা শান্ত ও সুস্থ মনে দেখবে এবং দেখবে সঠিক ও বাস্তবসম্মত।
শেষরাতের স্বপ্ন
প্রচলিত আছে, শেষরাতে দেখা স্বপ্ন সত্য হয়ে থাকে। এ ধারণা অমূলক নয়। এ সম্পর্কে একটি হাদীছও পাওয়া যায়। হযরত আবূ সা'ঈদ খুদরী রাযি. থেকে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-
أَصْدَقُ الرُّؤْيَا بِالْأَسْحَارِ
'শেষরাতের স্বপ্ন বেশি সত্য হয়’।
(জামে' তিরমিযী: ২২৭৪; সুনানে দারিমী: ২১৯২; মুসনাদে আবু ইয়া'লা: ১৩৫৭; সহীহ ইবনে হিব্বান : ৬০৪১; হাকিম, আল মুস্তাদরাক;৮১৮৩;বায়হাকী,শু'আবুলঈমান:৪৪৩৬;বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ: ৩২৭৯,)
শেষরাতের সময়টা অনেক বরকতপূর্ণ। এ সময়ে আল্লাহ তা'আলার বিশেষ রহমত নাযিল হয়। এটা দু'আ কবুলেরও একটা সময়। এ সময় স্বাস্থ্য ও মন-মস্তিষ্ক স্বাভাবিক থাকে। ফলে স্বপ্নেও এর প্রভাব পড়ে। তবে এর মানে এ নয় যে, এ সময়কার সব স্বপ্নই সঠিক হবে। স্বপ্নে যেমন সময়ের প্রভাব থাকে, তেমনি প্রভাব থাকে পাক, পবিত্রতার এবং ব্যক্তির আখলাক-চরিত্রেরও। তাই স্বপ্ন দেখার সময় লোকটির শরীর, পোশাক, বিছানা ইত্যাদি পবিত্র ছিল কি না তাও বিবেচনার বিষয়। তাছাড়া লোকটি সত্যবাদী কি না, হালাল খাওয়ায় অভ্যস্ত কি না, এসবও গুরুত্বপূর্ণ। তাই একটা দিক লক্ষ করে স্বপ্নের সত্যতা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার সুযোগ নেই। এর জন্য অনেক কিছুই লক্ষণীয়। স্বপ্নের তা'বীর করার যোগ্যতা ও দক্ষতা যার আছে, সে সবকিছু সামনে রেখে একটা ধারণায় পৌঁছতে সক্ষম হয়। এটা সবার কাজ নয়। মোটকথা স্বপ্নের সত্যতা ও অসত্যতার সঙ্গে অনেক কিছুরই সম্পর্ক আছে। সেসব বিবেচনায় কেবল শেষরাতের নয়; অন্য সময়ের স্বপ্নও সত্য হতে পারে। এমনকি সত্য হতে পারে দিনের বেলায় দেখা স্বপ্নও। আবার অসত্য হতে পারে শেষরাতের স্বপ্নও। একাধিক হাদীছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দিনের বেলায় দেখা স্বপ্নের কথা বর্ণিত আছে। বলাবাহুল্য তাঁর এবং অন্যসব নবীর স্বপ্ন সত্যই হত এবং তা ওহীর মর্যাদা রাখত। ইবনে সীরীন রহ. থেকে বর্ণিত আছে যে, দিনের স্বপ্ন ও রাতের স্বপ্ন একইরকম। হাঁ, এতটুকু বলা যেতে পারে যে, শেষরাতের স্বপ্ন অন্য সময়কার স্বপ্ন অপেক্ষা সঠিক হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। এরচে'ও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হল ব্যক্তির সত্যবাদিতা ও তাকওয়া-পরহেযগারী। এরূপ ব্যক্তির স্বপ্ন অন্যদের তুলনায় অনেক বেশি সঠিক হয়। তার সাধুতা ও সত্যবাদিতার প্রভাব তার স্বপ্নেও থাকে। তাই যারা স্বপ্নকে খুব বেশি গুরুত্ব দেয়, স্বপ্নের পেছনে না পড়ে তাদের নিজ আখলাক-চরিত্রের সংশোধনে বেশি মনোযোগী হওয়া দরকার।
যাহোক সময় যখন হবে কাছাকাছি, তখন যে স্বপ্ন দেখা হবে সে সম্পর্কে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- لَمْ تَكَدْ رُؤيَا الْمُؤْمِنِ تَكْذِبُ (তখন মুমিনের স্বপ্ন মিথ্যা প্রায় হবেই না)। বাহ্যত এর দ্বারা মনে হয় তখন কোনও কোনও স্বপ্ন মিথ্যাও হতে পারে, যদিও অধিকাংশই হবে সত্য। কিন্তু গভীরভাবে লক্ষ করলে বোঝা যায় তখন মুসলিম ব্যক্তির দেখা কোনও স্বপ্নই মিথ্যা হবে না; সবই সত্য হবে। কেননা لَمْ تَكَدْ এর দ্বারা নৈকট্যকে অস্বীকার করা হয়েছে। کاد، یکاد নৈকট্যের অর্থ দেয়। হাদীছটিতে অস্বীকার করা হয়েছে মিথ্যার নৈকট্যকে। অর্থাৎ মুমিন ব্যক্তির স্বপ্ন মিথ্যার নিকটবর্তী হবে না। কোনও বস্তু বা কোনও বিষয় নিকটবর্তী না হওয়ার অর্থ তো সেই বস্তু বা বিষয়ের অস্তিত্বই লাভ না হওয়া। কাজেই মুমিন ব্যক্তির স্বপ্ন মিথ্যার নিকটবর্তী না হওয়ার অর্থ দাঁড়ায় তার দেখা সব স্বপ্ন সত্যই হবে।
কার স্বপ্ন বেশি সত্য হয়
আলোচ্য হাদীছে দ্বিতীয় যে বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে তা হল কাদের স্বপ্ন বেশি সত্য হয়। ইরশাদ হয়েছে- أصدقكمْ رُؤيًا أصدقكُمْ حَدِيثًا (তোমাদের মধ্যে সে ব্যক্তির স্বপ্ন বেশি সত্য হবে,যে কথায় বেশি সত্যবাদী)। যে ব্যক্তি সত্যকথা বেশি বলে তার অন্তর থাকে আলোকিত। তার অনুভবশক্তি থাকে শক্তিশালী। ফলে তার অন্তরে সত্য-সঠিক ভাব যথাযথভাবে অঙ্কিত হয়। জাগ্রত অবস্থায় যে ব্যক্তি সত্য বলে অভ্যস্ত, ঘুমন্ত অবস্থায়ও তার অন্তরে সত্যেরই উদ্ভাস ঘটে। ফলে সে যা দেখে তা সত্যই হয়ে থাকে। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি মিথ্যা বলে অভ্যস্ত, তার অন্তর নষ্ট হয়ে যায়। তা অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। সে অন্তরে সত্য রেখাপাত করে না। তাই তার স্বপ্ন হয় উদ্ভট কিসিমের। তা হয় নানা গোজামিলের সমষ্টি। এককথায় মিথ্যাস্বপ্ন। হাঁ, ব্যতিক্রম উভয় ক্ষেত্রেই হতে পারে। কখনও সত্যবাদীর স্বপ্নও মিথ্যা হতে পারে, আবার মিথ্যাবাদীর স্বপ্নও সত্য হতে পারে। কিন্তু এটা ব্যতিক্রমই। সাধারণত ব্যক্তির স্বপ্ন তার চারিত্রিক অবস্থার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণই হয়ে থাকে।
স্বপ্নের গুরুত্ব
স্বপ্নের গুরুত্ব সম্পর্কে কোন কোন বর্ণনায় বলা হয়েছে- وَرُؤْيَا الْمُؤْمِنِ جُزْءٌ مِنْ خَمْسٍ وَأَرْبَعِينَ جُزْءًا مِنَ النُّبُوَّةِ (মুমিনের স্বপ্ন নবুওয়াতের পঁয়তাল্লিশ ভাগের এক ভাগ)। তবে অধিকাংশ বর্ণনায় ছেচল্লিশ ভাগের এক ভাগ বলা হয়েছে। সুতরাং এটাই অগ্রগণ্য।
বোঝা গেল সত্যস্বপ্ন নবুওয়াতের একটা ভগ্নাংশ। তা স্বপ্ন যে নবুওয়াতের একটা ভগ্নাংশ এ কথার অর্থ কী? এর অর্থ হল নবুওয়াত দ্বারা যে জ্ঞান লাভ হয় তা বিভিন্ন রকম। যেমন অতীতে ঘটে যাওয়া কোনও ঘটনার সংবাদ, ভবিষ্যতে ঘটবে এমন কোনও ঘটনার ভবিষ্যদ্বাণী, বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কিত বিধান, বিভিন্ন গায়েবী বিষয়ের পরিচয় ইত্যাদি। তো নবুওয়াত দ্বারা যেমন বিশেষ বিশেষ ভবিষ্যৎ-ঘটনা সম্পর্কে জ্ঞান লাভ হয়, তেমনি এরূপ জ্ঞান সত্যস্বপ্নের দ্বারাও লাভ হয়ে থাকে। এ হিসেবেই একে নবুওয়াতের একটা ভগ্নাংশ বলা হয়েছে।
প্রকাশ থাকে যে, কোনও একটা বিষয়ের একটা অংশমাত্র অর্জিত হওয়ার দ্বারা পূর্ণ সে বিষয়টাই অর্জিত হয়ে যায় না। কাজেই সত্যস্বপ্নকে 'নবুওয়াত' নামে অভিহিত করার কোনও অবকাশ নেই। নবুওয়াত তো এক ব্যাপক বিষয়। বিশেষত তা দ্বারা আল্লাহপ্রদত্ত বিধান অর্জিত হয়ে থাকে। স্বপ্ন দ্বারা তা আদৌ অর্জিত হয় না। তা দ্বারা কেবলই ভবিষ্যতের কোনও কোনও ঘটনা জানা যায় মাত্র। আবার সেই জানাটাও ঠিক নবুওয়াত দ্বারা যেভাবে জানা যায় সেরকমের নয়। মিলটা কেবল 'জানা' শব্দের। কিন্তু দুই 'জানা'-এর ভেতর বিস্তর ব্যবধান। এক ব্যবধান তো বলা হল- নবুওয়াত দ্বারা যা জানা যায় তা অনেক ব্যাপক আর স্বপ্ন দ্বারা যা জানা যায় তা বিশেষ একটা বিষয় মাত্র। তাছাড়া নবুওয়াত দ্বারা যে জ্ঞান অর্জিত হয় তা সন্দেহাতীত। তাতে সন্দেহের লেশমাত্র থাকে না। পক্ষান্তরে মুমিন ব্যক্তি স্বপ্নযোগে যা জানে তা অকাট্য ও নিশ্চিত নয়। তাতে সন্দেহের অবকাশ থাকে। এ কারণেই তা কোনওভাবেই শরী'আতের দলীল হতে পারে না। এমনিভাবে নবুওয়াতের দ্বারা যে সংবাদ লাভ হয় তা নবীর তো বটেই, অন্যদেরও বিশ্বাস করা জরুরি। যে ব্যক্তি তা বিশ্বাস করবে না, সে ঈমানদার হতে পারবে না। পক্ষান্তরে মুমিন ব্যক্তির স্বপ্নে কারও বিশ্বাস রাখা জরুরি নয় ঈমানদার হলে তো ঘটনা না ঘটা পর্যন্ত স্বপ্ন সত্য না মিথ্যা তা নিশ্চিত করে বলা সম্ভবও নয়। একটা ধারণা মাত্র লাভ হয়। হয়তো সে ধারণা সত্য হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। কিন্তু নিশ্চিত নয় কিছুতেই। এটা অনেকটা জাগ্রত অবস্থার ধারণার মতো। ধারণা শক্তিশালী নিশ্চিত সত্য হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। কিন্তু তা হওয়াটা নিশ্চিত নয়। অনেক সময় শক্তিশালী ধারণাও ভুল প্রমাণিত হয়।
স্বপ্নকে নবুওয়াতের ছেচল্লিশ ভাগের এক ভাগ বলার ব্যাখ্যা
উলামায়ে কেরামের মধ্যে অনেকেই এর ব্যাখ্যা করতে রাজি নন। তাদের মতে এ বিষয়ে নীরবতাই শ্রেয়। কেননা প্রত্যেক বিষয়েই আমাদের পুরোপুরি জানতে হবে এটা জরুরি নয়। আলেমদের ইলমের একটা সীমানা আছে। সে সীমানায় তারা থেমে যেতে বাধ্য। ওহীর মাধ্যমে আমাদেরকে যা জানানো হয়েছে তার সবটাই যে আমাদের বিস্তারিত বলেও দেওয়া হয়েছে এমন নয়। তার মধ্যে কোনও কোনওটি এমনও আছে, যা আমাদেরকে কেবল সংক্ষিপ্তভাবেই বলা হয়েছে। তার বিস্তারিত ব্যাখ্যা কেবল আল্লাহ তা'আলা ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামই জানেন। সত্যস্বপ্ন যে নবুওয়াতের ছেচল্লিশ ভাগের এক ভাগ, এটাও সেরকমই। কাজেই আমরা কেবল এতটুকুই জানলাম যে, তা নবুওয়াতের ছেচল্লিশ ভাগের এক ভাগ। কিন্তু তা কীভাবে সেটা আমরা জানি না, যেহেতু আমাদের বলে দেওয়া হয়নি।
তবে উলামায়ে কেরামের অনেকে এর ব্যাখ্যাও করেছেন। তারা বলেন, জাগ্রত অবস্থায় ওহী নাযিলের আগে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি ছয় মাস যাবৎ স্বপ্নযোগে ওহী নাযিল করা হয়েছিল। জাগ্রত অবস্থায় তাঁর প্রতি ওহী নাযিল করা হয়েছে ২৩ বছর। তাঁর জীবনে এ ২৩ বছর ছিল তাঁর নবুওয়াতী কাল। স্বপ্নকালীন ৬ মাস দ্বারা নবুওয়াতের সেই ২৩ বছরকে ভাগ করলে তা ছেচল্লিশ ভাগের এক ভাগই হয়। এ হিসেবেই স্বপ্নকে ছেচল্লিশ ভাগের এক ভাগ বলা হয়েছে।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. স্বপ্নেরও একটা বাস্তবতা আছে। কাজেই একে নিছক কল্পনা বলে উড়িয়ে দেওয়া ঠিক নয়।
খ. সত্য-সঠিক স্বপ্ন দ্বারা ভবিষ্যতের কল্যাণকর বিষয়ে সুসংবাদ এবং অনাকাঙ্ক্ষিত বিষয়ে সতর্ক সংকেত পাওয়া যায়।
গ. স্বপ্ন সুসংবাদ ও সতর্ক সংকেত মাত্র, এর বেশি কিছু নয়। কাজেই একে বাড়তি গুরুত্ব দিয়ে শরী'আতের কোনও বিধানে অবহেলা করার সুযোগ নেই।
ঘ. সত্যস্বপ্ন নবুওয়াতী জ্ঞানের এক ভগ্নাংশ মাত্র। তা নবুওয়াত নয় কিছুতেই।
ঙ. সত্যবাদিতা এক মহৎ গুণ। এমনকি স্বপ্নেও তার প্রভাব থাকে।
চ. স্বপ্নের সত্যতায় সময়কালেরও প্রভাব থাকতে পারে।
কোন সময়কার স্বপ্ন সত্য
কোন সময়কার স্বপ্ন সাধারণত সত্য হয়, সে সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে- إذا اقترب الزمان 'যখন কাল কাছাকাছি হবে (বা কাছাকাছি হয়)। ব্যাখ্যাদাতাগণ এর বিভিন্ন ব্যাখ্যা করেছেন। যেমন কারও মতে এর অর্থ হল দিন ও রাতের সময় কাছাকাছি হওয়া। অর্থাৎ দিন অপেক্ষা রাত বা রাত অপেক্ষা দিন বেশি বড় না হওয়া। এটা একেক অঞ্চলে একেক ঋতুতে হয়। তা যে ঋতুতেই হোক না কেন, দিন ও রাতের সময় যখন কাছাকাছি হয়, উভয়ের মধ্যে বিশেষ পার্থক্য হয় না, তখন মানুষের স্বভাব-প্রকৃতি ভারসাম্যপূর্ণ থাকে। ফলে তখন যে স্বপ্ন দেখে তা সাধারণত সঠিকই হয়।
কারও মতে সময় কাছাকাছি হওয়ার অর্থ কিয়ামত কাছাকাছি হওয়া। খুবসম্ভব এটা ওই সময়, যখন হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের হাতে দাজ্জালের ধ্বংস সাধিত হবে। তারপর দুনিয়ায় যত মানুষ অবশিষ্ট থাকবে, তারা সকলেই হবে মুসলিম। এটাই সেই সময় সারা বিশ্বে দীন বলতে কেবল ইসলামই অবশিষ্ট থাকবে, অন্য কোনও দীন ও ধর্মের অস্তিত্ব থাকবে না। এ সময়ে মুসলিম ব্যক্তির দেখা প্রতিটি স্বপ্ন সত্যই হবে। যেমন সেই সময়কার বিবরণ সম্বলিত দীর্ঘ এক হাদীছে আছে-
فيبعث الله عِيسَى بن مَرْيَمَ فَيَمْكُثُ فِي النَّاسِ سَبْعَ سِنِينَ لَيْسَ بَيْنَ اثْنَيْنِ عَدَاوَةٌ ثُمَّ يُرْسِلُ اللَّهُ رِيحًا بَارِدَةً مِنْ قِبَلِ الشَّامِ فَلَا يَبْقَى عَلَى وَجْهِ الْأَرْضِ أَحَدٌ فِي قَلْبِهِ مِثْقَالُ ذَرَّةٍ مِنْ خَيْرٍ أَوْ إِيمَانٍ إِلَّا قَبَضَهُ الْحَدِيثَ قَالَ فَكَانَ أَهْلُ هَذَا الزَّمَانِ أَحْسَنَ هَذِهِ الْأُمَّةِ حَالًا بَعْدَ الصَّدْرِ الْأَوَّلِ وَأَصْدَقَهُمْ أَقْوَالًا فَكَانَتْ رُؤْيَاهُمْ لَا تَكْذِبُ
'তারপর আল্লাহ তা'আলা ঈসা ইবন মারয়ামকে পাঠাবেন। তিনি মানুষের মধ্যে সাত বছর অবস্থান করবেন। তখন কোনও দুই ব্যক্তির মধ্যে শত্রুতা থাকবে না। ইসলামের প্রথম যুগের পর এ যুগের মানুষই হবে এ উম্মতের সর্বোত্তম মানুষ। তাদের অবস্থা হবে সবচে' ভালো। তারা কথায় হবে সর্বাপেক্ষা বেশি সত্যবাদী। তাদের স্বপ্ন মিথ্যা হবে না। (ফাতহুল বারী, ১২ খণ্ড, ৪০৬ পৃষ্ঠা (মাকতাবায়ে শামেলা)।)
অবশ্য সময় নিকটবর্তী হওয়ার দ্বারা কিয়ামতের কাছাকাছি ওই সময়কেও বোঝানো হতে পারে, যখন আল্লাহ তা'আলা অধিকাংশ আলেমকে তুলে নেবেন। চারদিকে দীন সম্পর্কে ব্যাপক অজ্ঞতা ছড়িয়ে পড়বে। মানুষ নানারকম ফিতনা-ফাসাদের শিকার হবে। এরূপ অবস্থায় দীনী দৃষ্টিকোণ থেকে দিকনির্দেশনা লাভ করা মানুষের জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। এক তো ধারেকাছে আলেম-উলামা থাকবে না; আলেমদের অস্তিত্বই প্রায় বিলুপ্ত হয়ে যাবে। অন্যদিকে নতুন নবী আসারও কোনও সম্ভাবনা নেই, যেহেতু মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামই সর্বশেষ নবী। তাহলে মানুষ তখন কী করবে? কোথা থেকে সে নির্দেশনা পাবে? মানুষের এ প্রয়োজন মেটানোর জন্যই আল্লাহ তা'আলা তখন সত্যস্বপ্ন দ্বারা তাদের সাহায্য করবেন। মুসলিম ব্যক্তি স্বপ্নযোগে কল্যাণজনক বিষয়ে আগাম সুসংবাদ লাভ করবে। এমনিভাবে যে বিষয়ে তার সতর্ক হওয়া প্রয়োজন, সে বিষয়েও সে স্বপ্নযোগে ইশারা-ইঙ্গিত পাবে।
উল্লেখ্য, প্রত্যেকের জন্য তার মৃত্যুও এক রকম কিয়ামত। কাজেই তার ক্ষেত্রে এ কথা বলা যেতে পারে যে, মৃত্যু নিকটবর্তী হলে তার দেখা স্বপ্ন অন্য সময়ের স্বপ্ন অপেক্ষা বেশি সঠিক হয়, বিশেষত সে যদি বয়স্ক হয়। বয়স্ক ব্যক্তি বেশি সহনশীল, ও অভিজ্ঞতাসমৃদ্ধ হওয়ায় যেমন তার তুলনায় বেশি সঠিক হয়, তেমনি ঘুমন্ত অবস্থায় সে যা দেখে তাও তুলনামূলক বেশি সঠিক হয়।
কারও কারও মতে সময় কাছাকাছি হওয়ার অর্থ সময় খুব দ্রুত চলে যাওয়া। ঘণ্টা, দিন, সপ্তাহ এবং মাস ও বছর কীভাবে যে চলে যাবে তা টের পাওয়া যাবে না। চব্বিশ ঘন্টার দিবারাত্র মনে হবে কয়েক ঘণ্টাতেই ফুরিয়ে গেল। মাস শুরু হওয়ার পর দেখতে না দেখতে ফুরিয়ে যাবে এবং নতুন মাস শুরু হয়ে যাবে। এমনিভাবে বছরকে মনে হবে মাসের মতো অল্প দিনের। বলা হয়ে থাকে, এরূপ মনে হবে ইমাম মাহদীর সময়ে। তিনি যখন বিশ্ব শাসন করবেন, তখন চারদিকে ন্যায় ও ইনসাফ ছড়িয়ে পড়বে। সর্বত্র মানুষ জান, মাল ও ইজ্জতের নিরাপত্তা পাবে। মানুষ সুখে-শান্তিতে জীবন কাটাবে। কারও কোনও কষ্ট থাকবে না। সুখে-শান্তিতে দিন কাটতে থাকায় মনে হবে সময় খুব দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে। সুখের সময়টা খুব দ্রুত ফুরায় বলেই মনে হয়, যেমন কষ্টের কালকে খুব দীর্ঘ মনে হয়। স্বভাবতই এরূপ অবস্থায় মানুষের মন থাকবে সবরকম উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা থেকে মুক্ত। ফলে এ সময়ে যে স্বপ্ন তারা দেখবে, তা শান্ত ও সুস্থ মনে দেখবে এবং দেখবে সঠিক ও বাস্তবসম্মত।
শেষরাতের স্বপ্ন
প্রচলিত আছে, শেষরাতে দেখা স্বপ্ন সত্য হয়ে থাকে। এ ধারণা অমূলক নয়। এ সম্পর্কে একটি হাদীছও পাওয়া যায়। হযরত আবূ সা'ঈদ খুদরী রাযি. থেকে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-
أَصْدَقُ الرُّؤْيَا بِالْأَسْحَارِ
'শেষরাতের স্বপ্ন বেশি সত্য হয়’।
(জামে' তিরমিযী: ২২৭৪; সুনানে দারিমী: ২১৯২; মুসনাদে আবু ইয়া'লা: ১৩৫৭; সহীহ ইবনে হিব্বান : ৬০৪১; হাকিম, আল মুস্তাদরাক;৮১৮৩;বায়হাকী,শু'আবুলঈমান:৪৪৩৬;বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ: ৩২৭৯,)
শেষরাতের সময়টা অনেক বরকতপূর্ণ। এ সময়ে আল্লাহ তা'আলার বিশেষ রহমত নাযিল হয়। এটা দু'আ কবুলেরও একটা সময়। এ সময় স্বাস্থ্য ও মন-মস্তিষ্ক স্বাভাবিক থাকে। ফলে স্বপ্নেও এর প্রভাব পড়ে। তবে এর মানে এ নয় যে, এ সময়কার সব স্বপ্নই সঠিক হবে। স্বপ্নে যেমন সময়ের প্রভাব থাকে, তেমনি প্রভাব থাকে পাক, পবিত্রতার এবং ব্যক্তির আখলাক-চরিত্রেরও। তাই স্বপ্ন দেখার সময় লোকটির শরীর, পোশাক, বিছানা ইত্যাদি পবিত্র ছিল কি না তাও বিবেচনার বিষয়। তাছাড়া লোকটি সত্যবাদী কি না, হালাল খাওয়ায় অভ্যস্ত কি না, এসবও গুরুত্বপূর্ণ। তাই একটা দিক লক্ষ করে স্বপ্নের সত্যতা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার সুযোগ নেই। এর জন্য অনেক কিছুই লক্ষণীয়। স্বপ্নের তা'বীর করার যোগ্যতা ও দক্ষতা যার আছে, সে সবকিছু সামনে রেখে একটা ধারণায় পৌঁছতে সক্ষম হয়। এটা সবার কাজ নয়। মোটকথা স্বপ্নের সত্যতা ও অসত্যতার সঙ্গে অনেক কিছুরই সম্পর্ক আছে। সেসব বিবেচনায় কেবল শেষরাতের নয়; অন্য সময়ের স্বপ্নও সত্য হতে পারে। এমনকি সত্য হতে পারে দিনের বেলায় দেখা স্বপ্নও। আবার অসত্য হতে পারে শেষরাতের স্বপ্নও। একাধিক হাদীছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দিনের বেলায় দেখা স্বপ্নের কথা বর্ণিত আছে। বলাবাহুল্য তাঁর এবং অন্যসব নবীর স্বপ্ন সত্যই হত এবং তা ওহীর মর্যাদা রাখত। ইবনে সীরীন রহ. থেকে বর্ণিত আছে যে, দিনের স্বপ্ন ও রাতের স্বপ্ন একইরকম। হাঁ, এতটুকু বলা যেতে পারে যে, শেষরাতের স্বপ্ন অন্য সময়কার স্বপ্ন অপেক্ষা সঠিক হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। এরচে'ও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হল ব্যক্তির সত্যবাদিতা ও তাকওয়া-পরহেযগারী। এরূপ ব্যক্তির স্বপ্ন অন্যদের তুলনায় অনেক বেশি সঠিক হয়। তার সাধুতা ও সত্যবাদিতার প্রভাব তার স্বপ্নেও থাকে। তাই যারা স্বপ্নকে খুব বেশি গুরুত্ব দেয়, স্বপ্নের পেছনে না পড়ে তাদের নিজ আখলাক-চরিত্রের সংশোধনে বেশি মনোযোগী হওয়া দরকার।
যাহোক সময় যখন হবে কাছাকাছি, তখন যে স্বপ্ন দেখা হবে সে সম্পর্কে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- لَمْ تَكَدْ رُؤيَا الْمُؤْمِنِ تَكْذِبُ (তখন মুমিনের স্বপ্ন মিথ্যা প্রায় হবেই না)। বাহ্যত এর দ্বারা মনে হয় তখন কোনও কোনও স্বপ্ন মিথ্যাও হতে পারে, যদিও অধিকাংশই হবে সত্য। কিন্তু গভীরভাবে লক্ষ করলে বোঝা যায় তখন মুসলিম ব্যক্তির দেখা কোনও স্বপ্নই মিথ্যা হবে না; সবই সত্য হবে। কেননা لَمْ تَكَدْ এর দ্বারা নৈকট্যকে অস্বীকার করা হয়েছে। کاد، یکاد নৈকট্যের অর্থ দেয়। হাদীছটিতে অস্বীকার করা হয়েছে মিথ্যার নৈকট্যকে। অর্থাৎ মুমিন ব্যক্তির স্বপ্ন মিথ্যার নিকটবর্তী হবে না। কোনও বস্তু বা কোনও বিষয় নিকটবর্তী না হওয়ার অর্থ তো সেই বস্তু বা বিষয়ের অস্তিত্বই লাভ না হওয়া। কাজেই মুমিন ব্যক্তির স্বপ্ন মিথ্যার নিকটবর্তী না হওয়ার অর্থ দাঁড়ায় তার দেখা সব স্বপ্ন সত্যই হবে।
কার স্বপ্ন বেশি সত্য হয়
আলোচ্য হাদীছে দ্বিতীয় যে বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে তা হল কাদের স্বপ্ন বেশি সত্য হয়। ইরশাদ হয়েছে- أصدقكمْ رُؤيًا أصدقكُمْ حَدِيثًا (তোমাদের মধ্যে সে ব্যক্তির স্বপ্ন বেশি সত্য হবে,যে কথায় বেশি সত্যবাদী)। যে ব্যক্তি সত্যকথা বেশি বলে তার অন্তর থাকে আলোকিত। তার অনুভবশক্তি থাকে শক্তিশালী। ফলে তার অন্তরে সত্য-সঠিক ভাব যথাযথভাবে অঙ্কিত হয়। জাগ্রত অবস্থায় যে ব্যক্তি সত্য বলে অভ্যস্ত, ঘুমন্ত অবস্থায়ও তার অন্তরে সত্যেরই উদ্ভাস ঘটে। ফলে সে যা দেখে তা সত্যই হয়ে থাকে। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি মিথ্যা বলে অভ্যস্ত, তার অন্তর নষ্ট হয়ে যায়। তা অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। সে অন্তরে সত্য রেখাপাত করে না। তাই তার স্বপ্ন হয় উদ্ভট কিসিমের। তা হয় নানা গোজামিলের সমষ্টি। এককথায় মিথ্যাস্বপ্ন। হাঁ, ব্যতিক্রম উভয় ক্ষেত্রেই হতে পারে। কখনও সত্যবাদীর স্বপ্নও মিথ্যা হতে পারে, আবার মিথ্যাবাদীর স্বপ্নও সত্য হতে পারে। কিন্তু এটা ব্যতিক্রমই। সাধারণত ব্যক্তির স্বপ্ন তার চারিত্রিক অবস্থার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণই হয়ে থাকে।
স্বপ্নের গুরুত্ব
স্বপ্নের গুরুত্ব সম্পর্কে কোন কোন বর্ণনায় বলা হয়েছে- وَرُؤْيَا الْمُؤْمِنِ جُزْءٌ مِنْ خَمْسٍ وَأَرْبَعِينَ جُزْءًا مِنَ النُّبُوَّةِ (মুমিনের স্বপ্ন নবুওয়াতের পঁয়তাল্লিশ ভাগের এক ভাগ)। তবে অধিকাংশ বর্ণনায় ছেচল্লিশ ভাগের এক ভাগ বলা হয়েছে। সুতরাং এটাই অগ্রগণ্য।
বোঝা গেল সত্যস্বপ্ন নবুওয়াতের একটা ভগ্নাংশ। তা স্বপ্ন যে নবুওয়াতের একটা ভগ্নাংশ এ কথার অর্থ কী? এর অর্থ হল নবুওয়াত দ্বারা যে জ্ঞান লাভ হয় তা বিভিন্ন রকম। যেমন অতীতে ঘটে যাওয়া কোনও ঘটনার সংবাদ, ভবিষ্যতে ঘটবে এমন কোনও ঘটনার ভবিষ্যদ্বাণী, বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কিত বিধান, বিভিন্ন গায়েবী বিষয়ের পরিচয় ইত্যাদি। তো নবুওয়াত দ্বারা যেমন বিশেষ বিশেষ ভবিষ্যৎ-ঘটনা সম্পর্কে জ্ঞান লাভ হয়, তেমনি এরূপ জ্ঞান সত্যস্বপ্নের দ্বারাও লাভ হয়ে থাকে। এ হিসেবেই একে নবুওয়াতের একটা ভগ্নাংশ বলা হয়েছে।
প্রকাশ থাকে যে, কোনও একটা বিষয়ের একটা অংশমাত্র অর্জিত হওয়ার দ্বারা পূর্ণ সে বিষয়টাই অর্জিত হয়ে যায় না। কাজেই সত্যস্বপ্নকে 'নবুওয়াত' নামে অভিহিত করার কোনও অবকাশ নেই। নবুওয়াত তো এক ব্যাপক বিষয়। বিশেষত তা দ্বারা আল্লাহপ্রদত্ত বিধান অর্জিত হয়ে থাকে। স্বপ্ন দ্বারা তা আদৌ অর্জিত হয় না। তা দ্বারা কেবলই ভবিষ্যতের কোনও কোনও ঘটনা জানা যায় মাত্র। আবার সেই জানাটাও ঠিক নবুওয়াত দ্বারা যেভাবে জানা যায় সেরকমের নয়। মিলটা কেবল 'জানা' শব্দের। কিন্তু দুই 'জানা'-এর ভেতর বিস্তর ব্যবধান। এক ব্যবধান তো বলা হল- নবুওয়াত দ্বারা যা জানা যায় তা অনেক ব্যাপক আর স্বপ্ন দ্বারা যা জানা যায় তা বিশেষ একটা বিষয় মাত্র। তাছাড়া নবুওয়াত দ্বারা যে জ্ঞান অর্জিত হয় তা সন্দেহাতীত। তাতে সন্দেহের লেশমাত্র থাকে না। পক্ষান্তরে মুমিন ব্যক্তি স্বপ্নযোগে যা জানে তা অকাট্য ও নিশ্চিত নয়। তাতে সন্দেহের অবকাশ থাকে। এ কারণেই তা কোনওভাবেই শরী'আতের দলীল হতে পারে না। এমনিভাবে নবুওয়াতের দ্বারা যে সংবাদ লাভ হয় তা নবীর তো বটেই, অন্যদেরও বিশ্বাস করা জরুরি। যে ব্যক্তি তা বিশ্বাস করবে না, সে ঈমানদার হতে পারবে না। পক্ষান্তরে মুমিন ব্যক্তির স্বপ্নে কারও বিশ্বাস রাখা জরুরি নয় ঈমানদার হলে তো ঘটনা না ঘটা পর্যন্ত স্বপ্ন সত্য না মিথ্যা তা নিশ্চিত করে বলা সম্ভবও নয়। একটা ধারণা মাত্র লাভ হয়। হয়তো সে ধারণা সত্য হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। কিন্তু নিশ্চিত নয় কিছুতেই। এটা অনেকটা জাগ্রত অবস্থার ধারণার মতো। ধারণা শক্তিশালী নিশ্চিত সত্য হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। কিন্তু তা হওয়াটা নিশ্চিত নয়। অনেক সময় শক্তিশালী ধারণাও ভুল প্রমাণিত হয়।
স্বপ্নকে নবুওয়াতের ছেচল্লিশ ভাগের এক ভাগ বলার ব্যাখ্যা
উলামায়ে কেরামের মধ্যে অনেকেই এর ব্যাখ্যা করতে রাজি নন। তাদের মতে এ বিষয়ে নীরবতাই শ্রেয়। কেননা প্রত্যেক বিষয়েই আমাদের পুরোপুরি জানতে হবে এটা জরুরি নয়। আলেমদের ইলমের একটা সীমানা আছে। সে সীমানায় তারা থেমে যেতে বাধ্য। ওহীর মাধ্যমে আমাদেরকে যা জানানো হয়েছে তার সবটাই যে আমাদের বিস্তারিত বলেও দেওয়া হয়েছে এমন নয়। তার মধ্যে কোনও কোনওটি এমনও আছে, যা আমাদেরকে কেবল সংক্ষিপ্তভাবেই বলা হয়েছে। তার বিস্তারিত ব্যাখ্যা কেবল আল্লাহ তা'আলা ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামই জানেন। সত্যস্বপ্ন যে নবুওয়াতের ছেচল্লিশ ভাগের এক ভাগ, এটাও সেরকমই। কাজেই আমরা কেবল এতটুকুই জানলাম যে, তা নবুওয়াতের ছেচল্লিশ ভাগের এক ভাগ। কিন্তু তা কীভাবে সেটা আমরা জানি না, যেহেতু আমাদের বলে দেওয়া হয়নি।
তবে উলামায়ে কেরামের অনেকে এর ব্যাখ্যাও করেছেন। তারা বলেন, জাগ্রত অবস্থায় ওহী নাযিলের আগে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি ছয় মাস যাবৎ স্বপ্নযোগে ওহী নাযিল করা হয়েছিল। জাগ্রত অবস্থায় তাঁর প্রতি ওহী নাযিল করা হয়েছে ২৩ বছর। তাঁর জীবনে এ ২৩ বছর ছিল তাঁর নবুওয়াতী কাল। স্বপ্নকালীন ৬ মাস দ্বারা নবুওয়াতের সেই ২৩ বছরকে ভাগ করলে তা ছেচল্লিশ ভাগের এক ভাগই হয়। এ হিসেবেই স্বপ্নকে ছেচল্লিশ ভাগের এক ভাগ বলা হয়েছে।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. স্বপ্নেরও একটা বাস্তবতা আছে। কাজেই একে নিছক কল্পনা বলে উড়িয়ে দেওয়া ঠিক নয়।
খ. সত্য-সঠিক স্বপ্ন দ্বারা ভবিষ্যতের কল্যাণকর বিষয়ে সুসংবাদ এবং অনাকাঙ্ক্ষিত বিষয়ে সতর্ক সংকেত পাওয়া যায়।
গ. স্বপ্ন সুসংবাদ ও সতর্ক সংকেত মাত্র, এর বেশি কিছু নয়। কাজেই একে বাড়তি গুরুত্ব দিয়ে শরী'আতের কোনও বিধানে অবহেলা করার সুযোগ নেই।
ঘ. সত্যস্বপ্ন নবুওয়াতী জ্ঞানের এক ভগ্নাংশ মাত্র। তা নবুওয়াত নয় কিছুতেই।
ঙ. সত্যবাদিতা এক মহৎ গুণ। এমনকি স্বপ্নেও তার প্রভাব থাকে।
চ. স্বপ্নের সত্যতায় সময়কালেরও প্রভাব থাকতে পারে।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)