মুসনাদে আহমদ- ইমাম আহমদ রহঃ (আল-ফাতহুর রব্বানী)

প্রশংসা ও ভর্ৎসনা সম্পর্কে অধ্যায়

হাদীস নং: ৫৭
প্রশংসা ও ভর্ৎসনা সম্পর্কে অধ্যায়
পরিচ্ছেদ: অট্টালিকা নির্মাণ করার নিন্দা সম্পর্কে
৫৭. কায়স (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমরা অসুস্থ খাব্বাব ইব্‌ন আরাত্তের নিকট প্রবেশ করলাম। তখন তিনি তার দেয়াল তৈরী করছিলেন। তিনি বললেন, এ মাটিতে যা কিছু নির্মাণ করে, তা ছাড়া সকল বিষয়ে মুসলমানকে প্রতিদান দেয়া হয়। তখন তিনি তার পেটে (গরম কিছু দিয়ে) সেঁক দিচ্ছিলেন। তিনি বলেন, যদি রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আমাদেরকে মৃত্যু কামনা করতে নিষেধ না করতেন, তাহলে আমি অবশ্যই মৃত্যু কামনা করতাম। (অন্য বর্ণনায় অতিরিক্ত এসেছে:) আমাদের যেসব সাথীরা বিদায় নিয়েছেন, দুনিয়া তাদেরকে আকৃষ্ট করেনি এবং তাদের অবস্থারও কোন পরিবর্তন হয়নি। তাদের মৃত্যুর পর আমরা দুনিয়া উপার্জন করেছি যার শেষ পরিণতি হবে মাটি।
كتاب المدح والذم
باب ما جاء في ذم البنيان
عن قيس (6) قال دخلنا على خباب (بن الأرت) نعوده وهو يبني حائطا له فقال المسلم يؤجر في كل شيء خلا ما يجعل في هذا التراب (7) وقد اكتوى سبعا في بطنه وقال لولا ان رسول الله صلى الله عليه وسلم نهانا ان ندعو بالموت لدعوت به (8) (زاد في رواية) ثم قال أن أصحابنا الذين مضوا لم تنقصهم (1) الدنيا شيئا وانا أصبنا بعدهم ما لا نجد له موضعا إلا التراب

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এ হাদীছটির বর্ণনাকারী বিখ্যাত তাবি'ঈ কায়স ইবন আবূ হাযিম রহ.। তাঁর পিতা আবূ হাযিম রাযি. একজন সাহাবী ছিলেন। তিনি নিজেও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাল পেয়েছিলেন। এমনকি তিনি তাঁর হাতে বায়'আত গ্রহণের জন্য মদীনা মুনাউওয়ারার দিকে যাত্রাও করেছিলেন। কিন্তু পথিমধ্যেই সংবাদ পান যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওফাত হয়ে গেছে। তিনি আশারায়ে মুবাশশারাসহ বহু সাহাবীর সাক্ষাৎ ও সাহচর্য লাভ করেছেন। হযরত খাব্বাব ইবনুল আরাত রাযি.-ও তাদের একজন। তিনি একাধিকবার হযরত খাব্বাব রাযি.-এর খেদমতে হাজির হয়েছেন এবং তাঁর নিকট থেকে হাদীছ শুনেছেন। একবার হযরত খাব্বাব রাযি. অসুস্থ হলে তিনি তাঁকে দেখতে আসেন। তাঁর এ সময়কার অবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি বলেন-
وَقَدِ اكْتَوَى سَبْعَ كَياتٍ (তখন তিনি শরীরের সাতটি স্থান দাগিয়েছেন)। اكْتَوَى শব্দটির উৎপত্তি كي থেকে।كي -এর অর্থ উত্তপ্ত লোহা দ্বারা শরীর দাগানো। এটা এক প্রকার চিকিৎসা। বিভিন্ন রোগ-ব্যাধিতে চিকিৎসার এ পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়। এতে উপকারও পাওয়া যায়। প্রাচীনকালে এ পদ্ধতির বহুল ব্যবহার ছিল। আধুনিককালে এটা বৈদ্যুতিকভাবে করা হয়ে থাকে। সরাসরি উত্তপ্ত লোহা দ্বারা শরীর দাগালে অসহনীয় কষ্ট হয়। তাই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ পদ্ধতির চিকিৎসা পসন্দ করেননি, যদিও নিরুপায় অবস্থায় তিনি এটা অনুমোদনও করেছেন। তো হযরত খাব্বাব রাযি.-ও বিশেষ কোনও রোগের কারণে তাঁর শরীরের সাতটি স্থানে গরম লোহা দ্বারা দাগিয়েছিলেন।

হযরত খাব্বাব রাযি, হিজরী ৩৭ সনে ইন্তিকাল করেছেন। তাঁর আগে বহু সাহাবী দুনিয়া থেকে গত হয়েছেন। কোনও কোনও সাহাবীর ওফাত তো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবদ্দশায়ই হয়েছে, যাদের বেশিরভাগই শহীদ হয়েছিলেন। তখন তাদের ছিল কঠিন দারিদ্র্য। খাওয়া-পরার অবর্ণনীয় কষ্টের মধ্যে তাদের দিন কাটাতে হয়েছে। সে অবস্থায় যেসকল সাহাবী দুনিয়া ছেড়ে চলে গেছেন, তাদের স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে হযরত খাব্বাব রাযি. বলেন-
مَضَوْا، وَلَمْ تَنْقُصْهُمُ الدُّنْيَا (তারা চলে গেছেন এ অবস্থায় যে, দুনিয়া তাদের কিছুই ক্ষতি করতে পারেনি)। অর্থাৎ আল্লাহ তা'আলার কাছে তাদের যে উচ্চমর্যাদা নির্ধারিত ছিল, জান্নাতের যে অকল্পনীয় নি'আমত তাদের জন্য বরাদ্দ ছিল, তা থেকে দুনিয়া কিছুই কমাতে পারেনি। কমাতে পারেনি এ কারণে যে, তারা তো দুনিয়ার আরাম-আয়েশ ও আনন্দ-সুখের কিছুই ভোগ করে যাননি। তা ভোগ করলে হয়তো আখিরাতের প্রাপ্তি থেকে কিছু কমে যেত। কিন্তু তারা চলে গেছেন নিতান্তই গরীবী হালে। ফলে তাদের পরকালীন প্রতিদান সম্পূর্ণ অক্ষত ও পরিপূর্ণ রয়ে গেছে।

লক্ষণীয়, হযরত খাব্বাব রাযি. কীভাবে তাঁর গত হয়ে যাওয়া সঙ্গীদের প্রশংসা করেছেন! সাহাবায়ে কেরাম এরকমই উদারপ্রাণ ছিলেন। তাদের পরস্পরের মধ্যে কোনও হিংসা-বিদ্বেষ ছিল না। একে অন্যকে আন্তরিকভাবে ভালোবাসতেন। একে অন্যের গুণগ্রাহী ছিলেন। একে অন্যের মধ্যে যে গুণ দেখতে পেতেন, খোলামনে তা স্বীকার করতেন ও তার প্রশংসা করতেন। তাদের কাছ থেকে এটাও আমাদের শেখার বিষয়।

তারপর হযরত খাব্বাব রাযি. নিজের অবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন- وإنَّا أصَبْنَا ما لا نَجِدُ له مَوْضِعًا إلَّا التُّرَابَ (আর আমরা এমনসব বস্তু অর্জন করেছি, মাটি ছাড়া যা রাখার কোনও স্থান দেখি না)। অর্থাৎ আমরা দুনিয়ার প্রচুর অর্থ-সম্পদের মালিক হয়েছি। বিভিন্ন যুদ্ধে আমরা গনীমতের মাল পেয়েছি। রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে আমাদের ভাতা দেওয়া হচ্ছে। এভাবে আমাদের মালিকানায় বিপুল সম্পদ জমা হয়ে গেছে। অপর এক বর্ণনায় আছে-
لَقَدْ رَأَيْتُنِي مَعَ رَسُوْلِ اللهِ ﷺ لَا أَمْلِكُ دِرْهَما وَإِنَّ فِي جَانِبِ بَيْتِي الْيَوْمَ لَأَرْبَعِينَ أَلْفَ دِرْهَم
‘আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে আমাকে এমন অবস্থায়ও দেখেছি, যখন আমি একটা দিরহামেরও মালিক ছিলাম না। আর আজ আমার ঘরের কোণে চল্লিশ হাজার দিরহাম পড়ে রয়েছে।(তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর: ৩৬৭৪; মুসনাদে আহমাদ: ২১০৭২: জামে তিরমিযী: ৯৭০)

মোটকথা, পরবর্তী জীবনে হযরত খাব্বাব রাযি. আরও অনেক সাহাবীর মতো প্রচুর অর্থ-সম্পদের মালিক হয়েছিলেন। সে সম্পদ ছিল তাঁর প্রয়োজনের অনেক বেশি। তা গরীবদের মধ্যে বিতরণ করবেন সে সুযোগও নেই। কারণ হযরত উমর রাযি.-এর যুগে ইসলামের দিগ্বিজয়ের ফলে উম্মতের প্রাচুর্য যেন উপচে পড়ছিল। দান-খয়রাত গ্রহণ করার মতো লোক প্রায় পাওয়াই যাচ্ছিল না। এ অবস্থায় সেই উদ্বৃত্ত সম্পদ কী করা হবে, কোথায় রাখা হবে, সে এক বাড়তি চিন্তা। কারণ সম্পদের হেফাজত করাও জরুরি। অবহেলায় নষ্ট করা জায়েয নয়। তখন তো আর আধুনিক কালের মতো সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণের বিশেষ ব্যবস্থা ছিল না। উপায় ছিল একটাই- মাটির ভেতর পুঁতে রাখা। সেদিকে ইঙ্গিত করেই হয়তো তিনি বলছেন, মাটি ছাড়া যা রাখার কোনও স্থান দেখি না। অথবা এর দ্বারা মাটির ঘর বানানোর কথাও বোঝানো হতে পারে। অর্থাৎ হযরত খাব্বাব রাযি. যেন বলছেন, উদ্বৃত্ত সম্পদ ঘর-বাড়ি নির্মাণের পেছনে খরচ করা ছাড়া কোনও বিকল্প দেখছি না। এ ব্যাখ্যা সঠিক হওয়া সম্ভব। হাদীছটির পরবর্তী অংশ এর সমর্থন করে। কেননা কায়স ইবন আবূ হাযিম রহ. বলছেন যে, পরে আরেকবার এসে আমি দেখতে পাই তিনি তাঁর একটি প্রাচীর নির্মাণ করছেন।

বলাবাহুল্য প্রাচীর নির্মাণ বা ঘরবাড়ি তৈরি করার প্রতি হযরত খাব্বাব রাযি.-এর কোনও আসক্তি ছিল না। কোনওরকম বিলাসিতা তাঁকে স্পর্শ করতে পারেনি। সম্পদের কোনও মায়া তাঁর মনে স্থান পায়নি। সেরকম হলে মৃত্যুর প্রতি তাঁর কোনও আগ্রহ থাকত না। কিন্তু তিনি তো বলছেন-
وَلَوْلَا أَنَّ النَّبِيَّ ﷺ نَهَانَا أَنْ نَدْعُوَ بِالْمَوْتِ لَدَعَوْتُ بِهِ (নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যদি না আমাদেরকে মৃত্যু কামনা করতে নিষেধ করতেন, তবে আমি অবশ্যই তা কামনা করতাম)। তিনি এ কথা বলছেন ওই আশঙ্কা থেকে যে, না জানি এতসব প্রাচুর্যের কারণে আখিরাতের প্রতিদান কমে যায়! কিংবা এমন আশঙ্কাও হতে পারে যে, এরূপ প্রাচুর্যের মধ্যে থাকলে না জানি অন্তর এর আসক্তিতে জড়িয়ে পড়ে! আর সেরকম হলে তা দীনের জন্য অনেক বড় ক্ষতির কারণ হবে। তারচে' বরং ঈমান-আমল নিয়ে দুনিয়া থেকে বিদায় নেওয়াই ভালো। কিন্তু এ শুভ চিন্তা সত্ত্বেও তিনি মৃত্যুকামনা থেকে বিরত থেকেছেন। কেননা প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিষেধ করেছেন যে! সাহাবায়ে কেরামের কাছে সর্বাবস্থায় নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদেশ-নিষেধই ছিল সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ, নিজেদের বুঝ-সমঝ, রুচি-অভিরুচি ও যুক্তি-বুদ্ধি নয়।

কায়স ইবন আবূ হাযিম রহ. পরেরবার এসে হযরত খাব্বাব রাযি.-কে প্রাচীর নির্মাণরত অবস্থায় দেখতে পান। তখন হযরত খাব্বাব রাযি. বলেন-
إِنَّ الْمُسْلِمَ لَيُؤْجَرُ فِي كُلِّ شَيْءٍ يُنْفِقُهُ إِلَّا فِي شَيْءٍ يَجْعَلُهُ فِي هَذَا التّرَابِ ‘মুসলিম ব্যক্তি যা-কিছুই খরচ করে, তাতেই তাকে ছাওয়াব দেওয়া হয়, তবে এ মাটিতে সে যা-কিছু রাখে (অর্থাৎ খরচ করে) তা ছাড়া'। অর্থাৎ মুসলিম ব্যক্তি আল্লাহ তা'আলার সন্তুষ্টিলাভের উদ্দেশ্যে যে খাতেই অর্থব্যয় করে তাতেই সে ছাওয়াব পায়। কিন্তু এই মাটির পেছনে যা খরচ করে (অর্থাৎ ঘরবাড়ি বানানোর পেছনে), তাতে কোনও ছাওয়াব নেই। অবশ্য এ কথাটি অতিরিক্ত ঘরবাড়ি বানানোর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। ইজ্জতের সঙ্গে নিজের ও নিজ পরিবারবর্গের বসবাসের জন্য যতটুকু প্রয়োজন, ততটুকু নির্মাণে যা খরচ হয় তাতে দোষ নেই। দোষ তো নেই-ই; বরং এ পরিমাণ খরচ করা শরী'আতের হুকুমও বটে। এটা নিজ ও নিজ পরিবারবর্গের হক। এ হক আদায় করার দ্বারা ছাওয়াব পাওয়া যায়।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. উত্তপ্ত লোহা দ্বারা দাগিয়ে কিংবা বৈদ্যুতিক শক দিয়ে চিকিৎসা করা জায়েয।

খ. অসুস্থ ব্যক্তিকে দেখতে যাওয়া সুন্নত। বিশিষ্ট দীনদার ব্যক্তি হলে এর গুরুত্ব আরও বেড়ে যায়।

গ. পার্থিব সুখভোগের দ্বারা আখিরাতের প্রতিদান কমে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে।

ঘ. অর্থ-সম্পদ আল্লাহ তা'আলার নি'আমত। তার রক্ষণাবেক্ষণ জরুরি।

ঙ. পার্থিব কষ্ট-ক্লেশের কারণে মৃত্যু কামনা করতে নেই।

চ. উপযুক্ত খাতে অর্থ-সম্পদ ব্যয় করা ছাওয়াব অর্জনের একটি শ্রেষ্ঠ উপায়।

ছ. প্রয়োজনের অতিরিক্ত ঘর-বাড়ি নির্মাণে অর্থব্যয় সমীচীন নয়।

জ. গুণগ্রাহিতা একটি উত্তম স্বভাব।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান