আল জামিউল কাবীর- ইমাম তিরমিযী রহঃ
২৭. সুন্দর ব্যবহার ও আত্নীয়তার সম্পর্ক রক্ষার অধ্যায়
হাদীস নং: ১৯২৮
আন্তর্জাতিক নং: ১৯২৮
সুন্দর ব্যবহার ও আত্নীয়তার সম্পর্ক রক্ষার অধ্যায়
এক মুসলিমের জন্য আরেক মুসলিমের সহমর্মিতা।
১৯৩৪। হাসান ইবনে আলী খাল্লাল প্রমুখ (রাহঃ) ......... আবু মুসা আশআরী (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, এক মু’মিন আরেক মু’মিনের জন্য ‘ইমারতের ন্যায়, যার একটি অংশ আপর অংশকে শক্তিশালী করে।
أبواب البر والصلة عن رسول الله صلى الله عليه وسلم
باب مَا جَاءَ فِي شَفَقَةِ الْمُسْلِمِ عَلَى الْمُسْلِمِ
حَدَّثَنَا الْحَسَنُ بْنُ عَلِيٍّ الْخَلاَّلُ، وَغَيْرُ، وَاحِدٍ، قَالُوا حَدَّثَنَا أَبُو أُسَامَةَ، عَنْ بُرَيْدِ بْنِ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ أَبِي بُرْدَةَ، عَنْ جَدِّهِ أَبِي بُرْدَةَ، عَنْ أَبِي مُوسَى الأَشْعَرِيِّ، قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم " الْمُؤْمِنُ لِلْمُؤْمِنِ كَالْبُنْيَانِ يَشُدُّ بَعْضُهُ بَعْضًا " . قَالَ أَبُو عِيسَى هَذَا حَدِيثٌ حَسَنٌ صَحِيحٌ .
হাদীসের ব্যাখ্যা:
ঈমান ও ইসলামের বদৌলতে আল্লাহ তা'আলার কাছে একজন লোক অনেক মর্যাদাবান হয়ে যায়। তাঁর কাছে এরকম লোকের জান-মাল-ইজ্জত সবকিছুরই মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয়। তিনি চান মানুষ এই মর্যাদা অনুভব করুক ও তা রক্ষায় যত্নবান থাকুক। তাই কুরআন-সুন্নাহর মাধ্যমে ঈমানদারদের এ তিন বস্তুর মর্যাদার প্রতি মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। তাদের হুকুম দেওয়া হয়েছে যেন প্রত্যেকে অন্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকে। যেন প্রত্যেকে অন্যের জান-মাল-ইজ্জতের মর্যাদা রক্ষায় আন্তরিক থাকে। এর জন্যে তাদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ জাগানোরও ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। বারবার ঘোষণা করা হয়েছে এক মুসলিম অপর মুসলিমের ভাই।
কাজেই তারা যেন ভ্রাতৃত্ববোধে উজ্জীবিত থাকে এবং কেউ কারও জান-মাল ইজ্জতের মর্যাদাক্ষুণ্নকারী কোনও কাজে লিপ্ত না হয়। সেরকম কাজে লিপ্ত হওয়ার দ্বারা অন্যের প্রতি জুলুম করা হয়। তাতে জুলুম হয় নিজের প্রতিও। জুলুম করা মহাপাপ। কাজেই একজন অন্যের প্রতি কোনওভাবেই জুলুম করবে না। নিজে জুলুম তো করবেই না। অন্যেও জুলুম করলে সেই ক্ষেত্রে সে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবে। অর্থাৎ মজলুমকে জুলুম থেকে রক্ষা করবে এবং জালেমকেও জুলুম করা হতে বাঁচাবে।
যেহেতু এক মুসলিম অপর মুসলিমের ভাই, তাই কেবল জুলুম থেকে নিবৃত্ত থাকাই যথেষ্ট নয়; বরং একজন আরেকজনের প্রতি স্নেহ-মমতার আচরণ করবে। স্নেহ-মমতার দাবি অন্যের সুখে সুখী হওয়া ও অন্যের দুঃখে দুঃখবোধ করা। অন্যের বিপদে সাহায্য করা এবং তার যে-কোনও অভাব ও প্রয়োজন মেটানোর চেষ্টা করা।অন্যের মান-সম্ভ্রম রক্ষায় ভূমিকা রাখা এবং যে-কোনও অনিষ্ট ও ক্ষতি থেকে তার হেফাজত করা।
এভাবে চলার দ্বারা পরস্পরের মধ্যে ঐক্য-সংহতি প্রতিষ্ঠিত হয়। গড়ে উঠে নিরাপত্তা ও শান্তিপূর্ণ সমাজ। ফলে প্রত্যেকের পক্ষে আল্লাহ তাআলার মর্জি মোতাবেক জীবন যাপন করা সহজ হয়। সুগম হয়—অন্তর্নিহিত প্রতিভা, সম্ভাবনা ও মুনষ্যত্বের বিকাশ ঘটিয়ে আখেরাতের মুক্তি ও আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের পথ।
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ হাদীছে মুমিনদের পারস্পরিক সাহায্য-সহযোগিতার গুরুত্ব তুলে ধরেছেন। তিনি মুমিনদের সমাজকে প্রাচীরের সঙ্গে তুলনা করে বোঝাচ্ছেন যে, মুমিনগণ তাদের দীন ও দুনিয়া কোনও ক্ষেত্রেই পারস্পরিক সাহায্য-সহযোগিতা ছাড়া সুপ্রতিষ্ঠিত ও শক্তিশালী থাকতে পারে না।
তিনি বিষয়টাকে চাক্ষুষভাবে বোঝানোর জন্য প্রাচীরের উদাহরণ দিয়েছেন। কোনও প্রাচীর নির্মাণের জন্য প্রথমে তার ভিত্তি স্থাপন করা হয়, তুলনামূলকভাবে উপর অংশের তুলনায় ভিত্তিকে বেশি মজবুতরূপে গড়ে তোলা হয়। তারপর সে ভিত্তির উপর এক-একটি করে ইট গেঁথে প্রাচীরের নির্মাণকার্য সম্পন্ন করা হয়। প্রাচীরে সবগুলো ইট পরস্পর সন্নিবিষ্ট হয়ে থাকে আর তার একটি দ্বারা অন্যটি এমন সুদৃঢ় হয় যে, সহজে সে প্রাচীর থেকে কোনও একটি ইট পৃথক করা যায় না। কিন্তু ইটগুলো যদি পরস্পর সংযুক্ত না থেকে বরং ফাঁকা ফাঁকা থাকে, তবে প্রাচীর তো নির্মিত হতেই পারে না এবং পৃথকভাবে সেগুলোর কোনও শক্তিও থাকে না, যার যেমনি ইচ্ছা তা সরিয়ে ফেলতে বা নিয়ে যেতে পারে। মুসলিম সমাজের অবস্থাও তদ্রূপ। তাদের মধ্যে কেউ থাকে শক্তিশালী, কেউ দুর্বল। দুর্বলের কর্তব্য শক্তিশালীর সাথে মিশে থাকা আর শক্তিশালীর কর্তব্য দুর্বলকে নিজ পাশে রাখা। এতে করে শক্তিশালীর শক্তি বৃদ্ধি পায় ও দীর্ঘস্থায়ী হয় এবং তার শক্তিতে দুর্বলও শক্তিশালী হয়ে ওঠে। আর এভাবে গোটা সমাজ সুগঠিত ও সুসংহত হয়। তখন কোনও শত্রুর পক্ষে সে সমাজের ক্ষতিসাধন করা সহজ হয় না। এমনকি শত্রুপক্ষ তাদের কোনও দুর্বল ব্যক্তির সঙ্গেও লাগার সাহস করে না। কেননা সংঘবদ্ধ হয়ে থাকার কারণে গোটা সমাজের শক্তি তার সঙ্গে।
অপরদিকে সকল মুসলিম একতাবদ্ধ না থাকলে কেবল দুর্বল ব্যক্তিই দুর্বল হয়ে থাকে না, শত্রুর চোখে সবল ব্যক্তিও দুর্বল হয়ে থাকে। কেননা একা এক ব্যক্তির শক্তি যতই বেশি হোক-না কেন, সংঘবদ্ধ শত্রুর বিরুদ্ধে তা কোনও কাজের নয়। এ কারণেই কুরআন মাজীদ মুমিনদেরকে পরস্পর দ্বন্দ্ব-কলহে লিপ্ত না হয়ে সংঘবদ্ধ হয়ে থাকতে জোর তাগিদ করেছে। ইরশাদ হয়েছেঃ- وَاعْتَصِمُوا بِحَبْلِ اللَّهِ جَمِيعًا وَلَا تَفَرَّقُوا তোমরা সকলে মিলে আল্লাহর রশিকে (অর্থাৎ তাঁর দ্বীন ও কিতাবকে) দৃঢ়ভাবে ধরে রাখ এবং পরস্পরে বিভেদ করো না।
আরও ইরশাদঃ- وَلَا تَنَازَعُوا فَتَفْشَلُوا وَتَذْهَبَ رِيحُكُمْ ‘এবং পরস্পরে কলহ করবে না, অন্যথায় তোমরা দুর্বল হয়ে পড়বে এবং তোমাদের হাওয়া (প্রভাব) বিলুপ্ত হবে।
এসব আয়াতের দাবি হচ্ছে সকল মুসলিম সর্বদা একতাবদ্ধ থাকবে। আত্মকলহেও লিপ্ত হবে না এবং কেউ বিচ্ছিন্ন হয়েও থাকবে না; বরং প্রত্যেকে অন্যের শক্তি যোগাবে ও নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী অন্যের সাহায্য-সহযোগিতা করবে।
পূর্ণাঙ্গ সমাজের জন্য সর্বস্তরের লোকের প্রয়োজনীয়তা
এ হাদীছে প্রাচীরের সঙ্গে তুলনা করে বোঝানো হচ্ছে যে, প্রাচীরের প্রত্যেক অংশ যেমন অন্য অংশকে শক্তি যোগায়, তেমনি প্রত্যেক মুসলিমেরই কর্তব্য অপর মুসলিমকে শক্তি যোগানো। কেউ প্রশ্ন করতে পারে, অন্যকে শক্তি যোগানো তো কেবল শক্তিমানের পক্ষেই সম্ভব; যে ব্যক্তি নিজেই দুর্বল সে কিভাবে অন্যের উপকারে আসবে?
প্রকৃতপক্ষে অন্যের কোনও না কোনও উপকার করা প্রত্যেকের পক্ষেই সম্ভব। কেননা শক্তি-সামর্থ্য বলতে কেবল পেশীশক্তি বা অর্থবলকেই বোঝায় না; বরং এর মধ্যে অনেক ব্যাপকতা রয়েছে। একেকজন মানুষ একেকরকম যোগ্যতা ও একেকরকম ক্ষমতা রাখে। কারও আছে বুদ্ধিবল, কারও বিদ্যাবল, কারও লোকবল, কারও অর্থবল। এমনিভাবে বিভিন্ন রকম কারিগরি-ক্ষমতা, বিচিত্র অভিজ্ঞতা, নানারকম বৃত্তি ও বিবিধ প্রতিভা, এর প্রত্যেকটিই মানুষের জন্য উপকারী ও কল্যাণকর। এমন কোনও ব্যক্তি নেই, যার মধ্যে এই বিবিধপ্রকার কল্যাণকর গুণের কোনও একটিও বিদ্যমান নেই। প্রত্যেকেই নিজের মধ্যে দৃষ্টিপাত করলে অন্যের উপকারে আসে এমন কোনও না কোনও যোগ্যতা ও ক্ষমতা পাবেই এবং সে ক্ষমতাটি এমন যে, একটি পূর্ণাঙ্গ সমাজের জন্য তা অতীব প্রয়োজন। একজন কামার তার পেশাজনিত যোগ্যতা ব্যবহার না করলে অন্যসব লোকের যে বহু প্রয়োজনীয় কাজ আটকে যাবে এবং তাদেরকে কঠিন জটিলতার সম্মুখীন হতে হবে– এ কথা প্রত্যেকেই স্বীকার করতে বাধ্য। কাজেই এ পেশার লোক সমাজের অবশিষ্ট লোকদের পক্ষে পরম উপকারী বৈকি। বাহ্যদৃষ্টিতে তাদেরকে যতই দুর্বল ভাবা হোক-না কেন, বাস্তবিকপক্ষে সামাজিক সচলতায় তারাও বিশেষ ধরনের শক্তি যুগিয়ে থাকে। সুতরাং এ হাদীছের মর্মার্থ তাদেরকেও শামিল করে।
ইমাম রাগিব রহ. বলেন, পৃথিবীতে জীবনধারণের জন্য কোনও ব্যক্তির যা-কিছু প্রয়োজন, তার সবটা তার নিজের একার পক্ষে যোগানো সম্ভব নয়। সেজন্য অন্যদের সহযোগিতা তার লাগবেই। এক লোকমা খাবার সংগ্রহ করতে প্রথমে জমি চাষাবাদ করতে হয়, সেখানে ফসল বুনতে হয়, তারপর ফসল কাটা, তা মাড়াই করা, তা পেষাই করা, তারপর রুটি তৈরি করা, এর জন্য যেসকল আসবাব-উপকরণ ও সরঞ্জামাদি
দরকার তা তৈরি করা ইত্যাদি যত কাজের প্রয়োজন তা হিসাব করে শেষ করাও তো কঠিন। কোন ব্যক্তির পক্ষে একা তা সব আঞ্জাম দেওয়া সম্ভব? এজন্যই বলা হয়, মানুষ স্বভাবগতভাবেই সামাজিক জীব। সমষ্টি থেকে পৃথক হয়ে একা জীবনযাপন কারও পক্ষেই সম্ভব নয়। দুনিয়া ও আখেরাত উভয় জগতের প্রয়োজন ও চাহিদা পূরণে প্রত্যেকেই অন্যের মুখাপেক্ষী। এ হাদীছ সেদিকে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
ইমাম নববী রহ. এ হাদীছটি মুসলমানদের পারস্পরিক মান-সম্ভ্রমের প্রতি মর্যাদা প্রদর্শন সম্পর্কিত অধ্যায়ে উল্লেখ করেছেন। এ হাদীছ দ্বারা পরোক্ষভাবে তা প্রমাণিত হয়। কেননা মুমিনগণ যখন পরস্পর প্রাচীরস্বরূপ, যাদের কর্তব্য একে অন্যকে শক্তিশালী করা ও একে অন্যের সাহায্য-সহযোগিতায় লিপ্ত থাকা, তখন তাদের একজন দ্বারা অন্যের জান-মাল ও ইজ্জতের ক্ষয়ক্ষতি করার তো প্রশ্নই আসে না; বরং প্রত্যেকে অন্যের জান-মাল ও ইজ্জতের হেফাজতে যত্নবান থাকবে। কেউ কারও কোনও প্রকার হক নষ্ট করবে না; বরং সর্বপ্রকার হক আদায়ে সদা সচেষ্ট থাকবে। অন্য কারও পক্ষ থেকে কোনও মুসলিমের প্রতি বিদ্বেষমূলক আচরণ করা হলে সকল মুসলিম তার পাশে দাঁড়াবে। যে-কোনও মুসলিমের জান-মাল বা ইজ্জতের উপর শত্রুর আক্রমণকে সকলে মিলে প্রতিহত করবে।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. এ হাদীছ মুমিনদেরকে সর্বাবস্থায় একতাবদ্ধ হয়ে থাকার জোর তাকিদ দেয়।
খ. এর দ্বারা শিক্ষা পাওয়া যায় যে, একতাবদ্ধ হয়ে থাকার দ্বারা সামাজিক শক্তি অর্জিত হয় আর এতে করে সমাজের প্রত্যেকের পক্ষে তার জান, মাল ও ইজ্জতের হেফাজত করা সহজ হয়।
গ. এ হাদীছ যেহেতু সকলকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে থাকতে তাকিদ করেছে, তাই এর দ্বারা এ শিক্ষাও লাভ হয় যে, সকলকে ঐক্য পরিপন্থী যে-কোনও কাজ থেকে দূরে থাকতে হবে।
ঘ. জান, মাল ও ইজ্জতের নিরাপত্তা লাভ করা প্রত্যেকের সামাজিক অধিকার। এতে অন্যায় হস্তক্ষেপ সম্পূর্ণ হারাম। এর দ্বারা ঐক্য ও সংহতি বিনষ্ট হয়। তাই প্রত্যেকের এর থেকে বিরত থাকা অবশ্যকর্তব্য।
ঙ. ঐক্যবদ্ধ হয়ে থাকার এক দাবি এটাও যে, প্রত্যেকে তার সাধ্যমত অপরের সাহায্য-সহযোগিতা করে যাবে এবং একজনের দুঃখ-কষ্ট সকলে ভাগাভাগি করে নেবে।
চ. এ হাদীছ দ্বারা এ শিক্ষাও পাওয়া যায় যে, উপযুক্ত উদাহরণ বা দৃষ্টান্ত কোনও বিষয়বস্তু সহজে বোঝার পক্ষে সহায়ক হয়ে থাকে। কাজেই শিক্ষক বা উপদেশদাতা প্রয়োজনে এ নীতি অবলম্বন করতে পারে।
কাজেই তারা যেন ভ্রাতৃত্ববোধে উজ্জীবিত থাকে এবং কেউ কারও জান-মাল ইজ্জতের মর্যাদাক্ষুণ্নকারী কোনও কাজে লিপ্ত না হয়। সেরকম কাজে লিপ্ত হওয়ার দ্বারা অন্যের প্রতি জুলুম করা হয়। তাতে জুলুম হয় নিজের প্রতিও। জুলুম করা মহাপাপ। কাজেই একজন অন্যের প্রতি কোনওভাবেই জুলুম করবে না। নিজে জুলুম তো করবেই না। অন্যেও জুলুম করলে সেই ক্ষেত্রে সে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবে। অর্থাৎ মজলুমকে জুলুম থেকে রক্ষা করবে এবং জালেমকেও জুলুম করা হতে বাঁচাবে।
যেহেতু এক মুসলিম অপর মুসলিমের ভাই, তাই কেবল জুলুম থেকে নিবৃত্ত থাকাই যথেষ্ট নয়; বরং একজন আরেকজনের প্রতি স্নেহ-মমতার আচরণ করবে। স্নেহ-মমতার দাবি অন্যের সুখে সুখী হওয়া ও অন্যের দুঃখে দুঃখবোধ করা। অন্যের বিপদে সাহায্য করা এবং তার যে-কোনও অভাব ও প্রয়োজন মেটানোর চেষ্টা করা।অন্যের মান-সম্ভ্রম রক্ষায় ভূমিকা রাখা এবং যে-কোনও অনিষ্ট ও ক্ষতি থেকে তার হেফাজত করা।
এভাবে চলার দ্বারা পরস্পরের মধ্যে ঐক্য-সংহতি প্রতিষ্ঠিত হয়। গড়ে উঠে নিরাপত্তা ও শান্তিপূর্ণ সমাজ। ফলে প্রত্যেকের পক্ষে আল্লাহ তাআলার মর্জি মোতাবেক জীবন যাপন করা সহজ হয়। সুগম হয়—অন্তর্নিহিত প্রতিভা, সম্ভাবনা ও মুনষ্যত্বের বিকাশ ঘটিয়ে আখেরাতের মুক্তি ও আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের পথ।
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ হাদীছে মুমিনদের পারস্পরিক সাহায্য-সহযোগিতার গুরুত্ব তুলে ধরেছেন। তিনি মুমিনদের সমাজকে প্রাচীরের সঙ্গে তুলনা করে বোঝাচ্ছেন যে, মুমিনগণ তাদের দীন ও দুনিয়া কোনও ক্ষেত্রেই পারস্পরিক সাহায্য-সহযোগিতা ছাড়া সুপ্রতিষ্ঠিত ও শক্তিশালী থাকতে পারে না।
তিনি বিষয়টাকে চাক্ষুষভাবে বোঝানোর জন্য প্রাচীরের উদাহরণ দিয়েছেন। কোনও প্রাচীর নির্মাণের জন্য প্রথমে তার ভিত্তি স্থাপন করা হয়, তুলনামূলকভাবে উপর অংশের তুলনায় ভিত্তিকে বেশি মজবুতরূপে গড়ে তোলা হয়। তারপর সে ভিত্তির উপর এক-একটি করে ইট গেঁথে প্রাচীরের নির্মাণকার্য সম্পন্ন করা হয়। প্রাচীরে সবগুলো ইট পরস্পর সন্নিবিষ্ট হয়ে থাকে আর তার একটি দ্বারা অন্যটি এমন সুদৃঢ় হয় যে, সহজে সে প্রাচীর থেকে কোনও একটি ইট পৃথক করা যায় না। কিন্তু ইটগুলো যদি পরস্পর সংযুক্ত না থেকে বরং ফাঁকা ফাঁকা থাকে, তবে প্রাচীর তো নির্মিত হতেই পারে না এবং পৃথকভাবে সেগুলোর কোনও শক্তিও থাকে না, যার যেমনি ইচ্ছা তা সরিয়ে ফেলতে বা নিয়ে যেতে পারে। মুসলিম সমাজের অবস্থাও তদ্রূপ। তাদের মধ্যে কেউ থাকে শক্তিশালী, কেউ দুর্বল। দুর্বলের কর্তব্য শক্তিশালীর সাথে মিশে থাকা আর শক্তিশালীর কর্তব্য দুর্বলকে নিজ পাশে রাখা। এতে করে শক্তিশালীর শক্তি বৃদ্ধি পায় ও দীর্ঘস্থায়ী হয় এবং তার শক্তিতে দুর্বলও শক্তিশালী হয়ে ওঠে। আর এভাবে গোটা সমাজ সুগঠিত ও সুসংহত হয়। তখন কোনও শত্রুর পক্ষে সে সমাজের ক্ষতিসাধন করা সহজ হয় না। এমনকি শত্রুপক্ষ তাদের কোনও দুর্বল ব্যক্তির সঙ্গেও লাগার সাহস করে না। কেননা সংঘবদ্ধ হয়ে থাকার কারণে গোটা সমাজের শক্তি তার সঙ্গে।
অপরদিকে সকল মুসলিম একতাবদ্ধ না থাকলে কেবল দুর্বল ব্যক্তিই দুর্বল হয়ে থাকে না, শত্রুর চোখে সবল ব্যক্তিও দুর্বল হয়ে থাকে। কেননা একা এক ব্যক্তির শক্তি যতই বেশি হোক-না কেন, সংঘবদ্ধ শত্রুর বিরুদ্ধে তা কোনও কাজের নয়। এ কারণেই কুরআন মাজীদ মুমিনদেরকে পরস্পর দ্বন্দ্ব-কলহে লিপ্ত না হয়ে সংঘবদ্ধ হয়ে থাকতে জোর তাগিদ করেছে। ইরশাদ হয়েছেঃ- وَاعْتَصِمُوا بِحَبْلِ اللَّهِ جَمِيعًا وَلَا تَفَرَّقُوا তোমরা সকলে মিলে আল্লাহর রশিকে (অর্থাৎ তাঁর দ্বীন ও কিতাবকে) দৃঢ়ভাবে ধরে রাখ এবং পরস্পরে বিভেদ করো না।
আরও ইরশাদঃ- وَلَا تَنَازَعُوا فَتَفْشَلُوا وَتَذْهَبَ رِيحُكُمْ ‘এবং পরস্পরে কলহ করবে না, অন্যথায় তোমরা দুর্বল হয়ে পড়বে এবং তোমাদের হাওয়া (প্রভাব) বিলুপ্ত হবে।
এসব আয়াতের দাবি হচ্ছে সকল মুসলিম সর্বদা একতাবদ্ধ থাকবে। আত্মকলহেও লিপ্ত হবে না এবং কেউ বিচ্ছিন্ন হয়েও থাকবে না; বরং প্রত্যেকে অন্যের শক্তি যোগাবে ও নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী অন্যের সাহায্য-সহযোগিতা করবে।
পূর্ণাঙ্গ সমাজের জন্য সর্বস্তরের লোকের প্রয়োজনীয়তা
এ হাদীছে প্রাচীরের সঙ্গে তুলনা করে বোঝানো হচ্ছে যে, প্রাচীরের প্রত্যেক অংশ যেমন অন্য অংশকে শক্তি যোগায়, তেমনি প্রত্যেক মুসলিমেরই কর্তব্য অপর মুসলিমকে শক্তি যোগানো। কেউ প্রশ্ন করতে পারে, অন্যকে শক্তি যোগানো তো কেবল শক্তিমানের পক্ষেই সম্ভব; যে ব্যক্তি নিজেই দুর্বল সে কিভাবে অন্যের উপকারে আসবে?
প্রকৃতপক্ষে অন্যের কোনও না কোনও উপকার করা প্রত্যেকের পক্ষেই সম্ভব। কেননা শক্তি-সামর্থ্য বলতে কেবল পেশীশক্তি বা অর্থবলকেই বোঝায় না; বরং এর মধ্যে অনেক ব্যাপকতা রয়েছে। একেকজন মানুষ একেকরকম যোগ্যতা ও একেকরকম ক্ষমতা রাখে। কারও আছে বুদ্ধিবল, কারও বিদ্যাবল, কারও লোকবল, কারও অর্থবল। এমনিভাবে বিভিন্ন রকম কারিগরি-ক্ষমতা, বিচিত্র অভিজ্ঞতা, নানারকম বৃত্তি ও বিবিধ প্রতিভা, এর প্রত্যেকটিই মানুষের জন্য উপকারী ও কল্যাণকর। এমন কোনও ব্যক্তি নেই, যার মধ্যে এই বিবিধপ্রকার কল্যাণকর গুণের কোনও একটিও বিদ্যমান নেই। প্রত্যেকেই নিজের মধ্যে দৃষ্টিপাত করলে অন্যের উপকারে আসে এমন কোনও না কোনও যোগ্যতা ও ক্ষমতা পাবেই এবং সে ক্ষমতাটি এমন যে, একটি পূর্ণাঙ্গ সমাজের জন্য তা অতীব প্রয়োজন। একজন কামার তার পেশাজনিত যোগ্যতা ব্যবহার না করলে অন্যসব লোকের যে বহু প্রয়োজনীয় কাজ আটকে যাবে এবং তাদেরকে কঠিন জটিলতার সম্মুখীন হতে হবে– এ কথা প্রত্যেকেই স্বীকার করতে বাধ্য। কাজেই এ পেশার লোক সমাজের অবশিষ্ট লোকদের পক্ষে পরম উপকারী বৈকি। বাহ্যদৃষ্টিতে তাদেরকে যতই দুর্বল ভাবা হোক-না কেন, বাস্তবিকপক্ষে সামাজিক সচলতায় তারাও বিশেষ ধরনের শক্তি যুগিয়ে থাকে। সুতরাং এ হাদীছের মর্মার্থ তাদেরকেও শামিল করে।
ইমাম রাগিব রহ. বলেন, পৃথিবীতে জীবনধারণের জন্য কোনও ব্যক্তির যা-কিছু প্রয়োজন, তার সবটা তার নিজের একার পক্ষে যোগানো সম্ভব নয়। সেজন্য অন্যদের সহযোগিতা তার লাগবেই। এক লোকমা খাবার সংগ্রহ করতে প্রথমে জমি চাষাবাদ করতে হয়, সেখানে ফসল বুনতে হয়, তারপর ফসল কাটা, তা মাড়াই করা, তা পেষাই করা, তারপর রুটি তৈরি করা, এর জন্য যেসকল আসবাব-উপকরণ ও সরঞ্জামাদি
দরকার তা তৈরি করা ইত্যাদি যত কাজের প্রয়োজন তা হিসাব করে শেষ করাও তো কঠিন। কোন ব্যক্তির পক্ষে একা তা সব আঞ্জাম দেওয়া সম্ভব? এজন্যই বলা হয়, মানুষ স্বভাবগতভাবেই সামাজিক জীব। সমষ্টি থেকে পৃথক হয়ে একা জীবনযাপন কারও পক্ষেই সম্ভব নয়। দুনিয়া ও আখেরাত উভয় জগতের প্রয়োজন ও চাহিদা পূরণে প্রত্যেকেই অন্যের মুখাপেক্ষী। এ হাদীছ সেদিকে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
ইমাম নববী রহ. এ হাদীছটি মুসলমানদের পারস্পরিক মান-সম্ভ্রমের প্রতি মর্যাদা প্রদর্শন সম্পর্কিত অধ্যায়ে উল্লেখ করেছেন। এ হাদীছ দ্বারা পরোক্ষভাবে তা প্রমাণিত হয়। কেননা মুমিনগণ যখন পরস্পর প্রাচীরস্বরূপ, যাদের কর্তব্য একে অন্যকে শক্তিশালী করা ও একে অন্যের সাহায্য-সহযোগিতায় লিপ্ত থাকা, তখন তাদের একজন দ্বারা অন্যের জান-মাল ও ইজ্জতের ক্ষয়ক্ষতি করার তো প্রশ্নই আসে না; বরং প্রত্যেকে অন্যের জান-মাল ও ইজ্জতের হেফাজতে যত্নবান থাকবে। কেউ কারও কোনও প্রকার হক নষ্ট করবে না; বরং সর্বপ্রকার হক আদায়ে সদা সচেষ্ট থাকবে। অন্য কারও পক্ষ থেকে কোনও মুসলিমের প্রতি বিদ্বেষমূলক আচরণ করা হলে সকল মুসলিম তার পাশে দাঁড়াবে। যে-কোনও মুসলিমের জান-মাল বা ইজ্জতের উপর শত্রুর আক্রমণকে সকলে মিলে প্রতিহত করবে।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. এ হাদীছ মুমিনদেরকে সর্বাবস্থায় একতাবদ্ধ হয়ে থাকার জোর তাকিদ দেয়।
খ. এর দ্বারা শিক্ষা পাওয়া যায় যে, একতাবদ্ধ হয়ে থাকার দ্বারা সামাজিক শক্তি অর্জিত হয় আর এতে করে সমাজের প্রত্যেকের পক্ষে তার জান, মাল ও ইজ্জতের হেফাজত করা সহজ হয়।
গ. এ হাদীছ যেহেতু সকলকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে থাকতে তাকিদ করেছে, তাই এর দ্বারা এ শিক্ষাও লাভ হয় যে, সকলকে ঐক্য পরিপন্থী যে-কোনও কাজ থেকে দূরে থাকতে হবে।
ঘ. জান, মাল ও ইজ্জতের নিরাপত্তা লাভ করা প্রত্যেকের সামাজিক অধিকার। এতে অন্যায় হস্তক্ষেপ সম্পূর্ণ হারাম। এর দ্বারা ঐক্য ও সংহতি বিনষ্ট হয়। তাই প্রত্যেকের এর থেকে বিরত থাকা অবশ্যকর্তব্য।
ঙ. ঐক্যবদ্ধ হয়ে থাকার এক দাবি এটাও যে, প্রত্যেকে তার সাধ্যমত অপরের সাহায্য-সহযোগিতা করে যাবে এবং একজনের দুঃখ-কষ্ট সকলে ভাগাভাগি করে নেবে।
চ. এ হাদীছ দ্বারা এ শিক্ষাও পাওয়া যায় যে, উপযুক্ত উদাহরণ বা দৃষ্টান্ত কোনও বিষয়বস্তু সহজে বোঝার পক্ষে সহায়ক হয়ে থাকে। কাজেই শিক্ষক বা উপদেশদাতা প্রয়োজনে এ নীতি অবলম্বন করতে পারে।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
বর্ণনাকারী: