শরহু মাআ’নিল আছার- ইমাম ত্বহাবী রহঃ
২. নামাযের অধ্যায়
হাদীস নং: ২৩৫৬
নামাযের অধ্যায়
রুগ্ন ব্যক্তির পিছনে সুস্থ ব্যক্তির সালাত।
২৩৫৬। ফাহাদ (রাহঃ).... আয়েশা (রাযিঃ) থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেছেন: যখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ভারী (অসুস্থ) হয়ে পড়লেন তখন বিলাল (রাযিঃ) তাঁর নিকট এসে সালাতের ঘােষণা দিলেন। তিনি বললেন, তােমরা আবু বকর (রাযিঃ) এর নিকট যাও, তিনি যেন লােকদেরকে সালাত পড়ান। তিনি বলেন, আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল, যদি উমর (রাযিঃ)-কে নির্দেশ দিতেন তাদেরকে সালাত পড়াবার (তাহলে ভাল হতাে) যেহেতু আবু বকর (রাযিঃ) কোমল হৃদয়ের কারণে অধিক ক্রন্দনকারী ব্যক্তি এবং তিনি আপনার স্থানে দাঁড়ালে অধিক ক্রন্দনের কারণে লােকদেরকে আওয়ায পৌছাতে সক্ষম হবেন না। তিনি বললেন, তােমরা আবু বকর (রাযিঃ)-কে নির্দেশ দাও তিনি যেন লোকদেরকে সালাত পড়ান। তারা আবু বকর (রাযিঃ)-কে এ নির্দেশের কথা অবহিত করলেন। তিনি লােকদের সালাত পড়ানাের জন্য দাঁড়ালেন। যখন তিনি সালাত শুরু করলেন তখন
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) (কিছুটা) আরামবোধ করলেন এবং উঠে দু'ব্যক্তির উপর ভর করে চললেন; অথচ তার দু'পা যমীনে হেঁচড়ে হেঁচড়ে চলছিলো, আবু বকর (রাযিঃ) তাঁর আগমনের আওয়ায শুনে পিছনে সরে যেতে লাগলেন। তিনি তাকে ইংগিতে বললেন, তােমার অবস্থায় থেকে সালাত পড়। পরে রাসূলুল্লাহর (ﷺ) এসে আবু বকর (রাযিঃ) এর বাম পার্শ্বে বসে পড়লেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-লােকদেরকে নিয়ে সালাত পড়ছিলেন আর আবু বকর (রাযিঃ) সঁড়িয়ে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) -এর ইকতিদা করছিলেন এবং লােকেরা আবু বকর (রাযিঃ) এর সালাতের সাথে ইকতিদা করছিলাে।
একদল প্রশ্নকারী প্রশ্ন করে বলেছে যে, এ হাদীসে তােমাদের পক্ষে কোন প্রমাণ নেই। যেহেতু রাসূলুল্লাহ (ﷺ) উক্ত সালাতে মুকতাদী রূপে ছিলেন। আর এ বিষয়ে তারা নিম্নোক্ত হাদীস দলীল হিসাবে পেশ করেনঃ
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) (কিছুটা) আরামবোধ করলেন এবং উঠে দু'ব্যক্তির উপর ভর করে চললেন; অথচ তার দু'পা যমীনে হেঁচড়ে হেঁচড়ে চলছিলো, আবু বকর (রাযিঃ) তাঁর আগমনের আওয়ায শুনে পিছনে সরে যেতে লাগলেন। তিনি তাকে ইংগিতে বললেন, তােমার অবস্থায় থেকে সালাত পড়। পরে রাসূলুল্লাহর (ﷺ) এসে আবু বকর (রাযিঃ) এর বাম পার্শ্বে বসে পড়লেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-লােকদেরকে নিয়ে সালাত পড়ছিলেন আর আবু বকর (রাযিঃ) সঁড়িয়ে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) -এর ইকতিদা করছিলেন এবং লােকেরা আবু বকর (রাযিঃ) এর সালাতের সাথে ইকতিদা করছিলাে।
একদল প্রশ্নকারী প্রশ্ন করে বলেছে যে, এ হাদীসে তােমাদের পক্ষে কোন প্রমাণ নেই। যেহেতু রাসূলুল্লাহ (ﷺ) উক্ত সালাতে মুকতাদী রূপে ছিলেন। আর এ বিষয়ে তারা নিম্নোক্ত হাদীস দলীল হিসাবে পেশ করেনঃ
كتاب الصلاة
2356 - حَدَّثَنَا فَهْدٌ، قَالَ: ثنا أَحْمَدُ بْنُ يُونُسَ، قَالَ: ثنا أَبُو مُعَاوِيَةَ، قَالَ: ثنا الْأَعْمَشُ، عَنْ إِبْرَاهِيمَ، عَنِ الْأَسْوَدِ، عَنْ عَائِشَةَ، رَضِيَ اللهُ عَنْهَا قَالَتْ: " لَمَّا ثَقُلَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ جَاءَهُ بِلَالٌ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ يُؤْذِنُهُ بِالصَّلَاةِ فَقَالَ: «ائْتُوا أَبَا بَكْرٍ فَلْيُصَلِّ بِالنَّاسِ» قَالَتْ فَقُلْتُ: يَا رَسُولَ اللهِ , لَوْ أَمَرْتَ عُمَرَ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ يُصَلِّي بِهِمْ , فَإِنَّ أَبَا بَكْرٍ رَجُلٌ أَسِيفٌ وَمَتَى يَقُومُ مَقَامَكَ لَمْ يَسْمَعِ النَّاسُ قَالَ: «مُرُوا أَبَا بَكْرٍ فَلْيُصَلِّ بِالنَّاسِ» فَأَمَرُوا أَبَا بَكْرٍ , فَصَلَّى بِالنَّاسِ. فَلَمَّا دَخَلَ فِي الصَّلَاةِ وَجَدَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ خِفَّةً , فَقَامَ يُهَادَى بَيْنَ رَجُلَيْنِ , وَرِجْلَاهُ تَخُطَّانِ فِي الْأَرْضِ , فَلَمَّا سَمِعَ أَبُو بَكْرٍ حِسَّهُ ذَهَبَ لِيَتَأَخَّرَ , فَأَوْمَى إِلَيْهِ أَنْ صَلِّ كَمَا أَنْتَ فَجَاءَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ حَتَّى جَلَسَ عَنْ يَسَارِ أَبِي بَكْرٍ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ. فَكَانَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يُصَلِّي بِالنَّاسِ , وَأَبُو بَكْرٍ يَقْتَدِي بِالنَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَهُوَ قَائِمٌ , وَالنَّاسُ يَقْتَدُونَ بِصَلَاةِ أَبِي بَكْرٍ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ " فَقَالَ قَائِلُونَ: لَا حُجَّةَ لَكُمْ فِي هَذَا الْحَدِيثِ لِأَنَّ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَانَ فِي تِلْكَ الصَّلَاةِ مَأْمُومًا
হাদীসের ব্যাখ্যা:
১. এ হাদীস থেকে প্রমাণিত হয় অসুস্থতার কারণে ইমাম বসে নামায পড়ালেও পেছনের সুস্থ মুক্তাদীগণ দাঁড়িয়ে ইক্তিদা করবে। এটাই হানাফী মাযহাবের মত। (শামী: ১/৫৮৮)
এর বিপরীতে বুখারী-মুসলিমের বেশ কিছু হাদীসে বর্ণিত আছে যে, وَإِذَا صَلَّى قَائِمًا فَصَلُّوا قِيَامًا وَإِذَا صَلَّى قَاعِدًا فَصَلُّوا قُعُودًا أَجْمَعُونَ ইমাম দাঁড়িয়ে নামায পড়লে তোমরাও দাঁড়িয়ে নামায পড়বে। আর ইমাম বসে নামায পড়লে তোমরাও সকলে বসে নামায পড়বে। (বুখারী-৬৫৫, মুসলিম-৮০৬) ইমাম বুখারী রহ. হযরত আনাস রা. থেকে এ হাদীসটি বর্ণনা করার পরে বলেন, قَالَ الْحُمَيْدِيُّ قَوْلُهُ إِذَا صَلَّى جَالِسًا فَصَلُّوا جُلُوسًا هُوَ فِي مَرَضِهِ الْقَدِيمِ ثُمَّ صَلَّى بَعْدَ ذَلِكَ النَّبِيُّ صَلَّى الله عَلَيْهِ وَسَلَّمَ جَالِسًا وَالنَّاسُ خَلْفَهُ قِيَامًا لَمْ يَأْمُرْهُمْ بِالْقُعُودِ وَإِنَّمَا يُؤْخَذُ بِالْآخِرِ فَالْآخِرِ مِنْ فِعْلِ النَّبِيِّ صَلَّى الله عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ‘আল্লামা হুমাইদী বলেন, ইমাম বসে নামায পড়লে তোমরাও বসে নামায পড়বে’ এটা নবী কারীম স.-এর পূর্বেকার অসুস্থতার সময়ের কথা। পরবর্তীতে নবী কারীম স. নামায পড়েছেন বসে আর তাঁর পেছনের মুক্তাদীগণ পড়েছেন দাঁড়িয়ে। রসূল স. তাদেরকে বসতে বলেননি। আর রাসূল সা. এর সর্বশেষ আমলই গ্রহণীয়। (বুখারী-৬৫৫) এ থেকে প্রমাণিত হয় যে, ইমাম বসে নামায পড়ালে তাঁর পেছনের সুস্থ মুক্তাদীগণ দাঁড়িয়ে ইক্তিদা করবে। এ আমলটি রসূল স.-এর শেষ আমল এবং এটাই বহাল। আর বসে ইক্তিদা করার আমলটি পূর্বের যা রহিত হয়ে গেছে।
২. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ওফাতের আগের বৃহস্পতিবার ইশার সময় খুব বেশি অসুস্থ হয়ে পড়েন। ফলে তাঁর পক্ষে মসজিদে গিয়ে ইমামত করা সম্ভব হচ্ছিল না। তাই তিনি ঘরের লোকদের হুকুম দিলেন, যেন তারা হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি.-কে ইমামত করতে বলেন। হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি.-এর মন ছিল অত্যন্ত নরম। কুরআন মাজীদ তিলাওয়াতকালে তাঁর কান্না চলে আসত। কান্নার বেগ বেশি হলে স্বাভাবিক গতিতে তিলাওয়াত করা সম্ভব হয় না। ইমামত করার সময় এরূপ অবস্থা হলে সাবলীলভাবে কুরআন পাঠ করা কঠিন হয়ে যায়। আবার সময়টা ছিল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অসুস্থতাকালীন। এ কারণে হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি, এমনিতেও উদ্বিগ্ন ছিলেন। এ অবস্থায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্থানে দাঁড়িয়ে ইমামত করতে তাঁর অনেক বেশি চাপবোধ হওয়ার কথা। সেদিকে ইঙ্গিত করে উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা রাযি. বলেন যে, আপনার স্থানে দাঁড়িয়ে তিনি নামায পড়লে কান্নার কারণে মানুষকে কিরাআত, তাকবীর ইত্যাদি শোনাতে পারবেন না। অর্থাৎ কান্না অবস্থায় তাঁর উচ্চারণ জড়িয়ে যাবে। আওয়াজও উঁচু হবে না। ফলে মুক্তাদীগণ তা শুনতে পাবে না।
কিন্তু নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এসব ওজর গ্রাহ্য করলেন না। হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি. তাঁর সবচে' বেশি প্রিয় মানুষ। বিভিন্ন আলামত-ইঙ্গিত দ্বারা বোঝা যায়, তাঁর একান্ত কামনা ছিল তাঁর ওফাতের পর হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি.-ই যেন প্রথম খলীফা হিসেবে মনোনীত হন। জীবনের শেষ দিনগুলোতে নামাযের ইমামরূপে তাঁর স্থলাভিষিক্ত হিসেবে দায়িত্ব পালন করাটা এ কামনা পূরণে সহায়ক ছিল। অন্য কেউ এ দায়িত্ব পালন করলে তার দিকে কিছু লোকের ঝুঁকে পড়ার আশঙ্কা ছিল। হয়তো এটাকে তারা তার খলীফারূপে মনোনয়নের প্রতি ইঙ্গিত মনে করত। সে আশঙ্কার পথ বন্ধ করার জন্য হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি.-কে দিয়েই ইমামত করানোর প্রয়োজন ছিল। তাই সব ওজর প্রত্যাখ্যান করে তিনি বারবার হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি.-কেই ইমামত করার হুকুম দিতে বললেন।
সেমতে হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্থলাভিষিক্তরূপে নামাযের ইমামত করলেন। এটা ছিল বৃহস্পতিবার ইশার নামায। এরপর থেকে সোমবার ফজর পর্যন্ত টানা ১৭ ওয়াক্ত নামাযে তিনি ইমামত করেন। ওফাতের পর যখন খলীফা নিয়োগের পালা আসে, তখন হযরত উমর ফারূক রাযি, হযরত আলী রাযি. প্রমুখ শীর্ষস্থানীয় সাহাবীগণ নামাযের এই ইমামতকে তাঁর বৃহত্তর ইমামত অর্থাৎ খেলাফতের পদমর্যাদায় অভিষিক্ত হওয়ার পক্ষে একটি বড় শক্তিরূপে অবলম্বন করে নিয়েছিলেন।
যাহোক, এস্থলে এ হাদীছের মূল বিষয় হল কুরআন তিলাওয়াতকালে ক্রন্দন করা। হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি. তিলাওয়াতকালে খুব কাঁদতেন। এটা প্রকৃত মুমিনদের শান। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে
إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ الَّذِينَ إِذَا ذُكِرَ اللَّهُ وَجِلَتْ قُلُوبُهُمْ وَإِذَا تُلِيَتْ عَلَيْهِمْ آيَاتُهُ زَادَتْهُمْ إِيمَانًا وَعَلَى رَبِّهِمْ يَتَوَكَّلُونَ
মুমিন তো তারাই, (যাদের সামনে) আল্লাহকে স্মরণ করা হলে তাদের হৃদয় ভীত হয়, যখন তাদের সামনে তাঁর আয়াতসমূহ পড়া হয়, তখন তা তাদের ঈমানের উন্নতি সাধন করে এবং তারা তাদের প্রতিপালকের উপর ভরসা করে।
অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে
اللَّهُ نَزَّلَ أَحْسَنَ الْحَدِيثِ كِتَابًا مُتَشَابِهًا مَثَانِيَ تَقْشَعِرُّ مِنْهُ جُلُودُ الَّذِينَ يَخْشَوْنَ رَبَّهُمْ ثُمَّ تَلِينُ جُلُودُهُمْ وَقُلُوبُهُمْ إِلَى ذِكْرِ اللَّهِ ذَلِكَ هُدَى اللَّهِ يَهْدِي بِهِ مَنْ يَشَاءُ وَمَنْ يُضْلِلِ اللَّهُ فَمَا لَهُ مِنْ هَادٍ
"আল্লাহ নাযিল করেছেন উত্তম বাণী- এমন এক কিতাব যার বিষয়বস্তুসমূহ পরস্পর সুসামঞ্জস্য, (যার বক্তব্যসমূহ) পুনরাবৃত্তিকৃত, যারা তাদের প্রতিপালককে ভয় করে এর দ্বারা তাদের শরীর রোমাঞ্চিত হয়। তারপর তাদের দেহমন বিগলিত হয়ে আল্লাহর স্মরণে ঝুঁকে পড়ে। এটা আল্লাহর হিদায়াত, যার মাধ্যমে তিনি যাকে চান সঠিক পথে নিয়ে আসেন আর আল্লাহ যাকে বিপথগামী করেন, তাকে সঠিক পথে আনার কেউ নেই।
কুরআন পড়ে দেহমন বিগলিত হওয়া মহান লোকদের মধ্যে হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি. ছিলেন শ্রেষ্ঠতম। মদীনা মুনাউওয়ারায় হিজরতের আগে তিনি মক্কা ছেড়ে পরিব্রাজকরূপে ভূপৃষ্ঠে ঘুরে বেড়ানো ও আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগীতে জীবন কাটিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে বের হয়ে পড়লে ইবনুদ্দাগিনাহ নামক মক্কার এক সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি তাঁকে নিরাপত্তা দিয়ে ফিরিয়ে নিয়ে এসেছিলেন। এ সময় তিনি বাড়ির আঙিনায় একটি ইবাদতখানা বানিয়ে সেখানে ইবাদত-বন্দেগী ও যিকর-তিলাওয়াতে মশগুল থাকেন। তিনি যখন বিগলিত মনে কুরআন তিলাওয়াত করতেন আর অঝোর ধারায় কাঁদতে থাকতেন, তখন আশপাশের নারী-পুরুষ সকলে ঘর থেকে বের হয়ে আসত এবং তাঁর নিকট জড়ো হয়ে কুরআন শ্রবণে মগ্ন হয়ে পড়ত। কুরায়শ নেতৃবর্গ এটাকে অনেক বড় ঝুঁকিরূপে দেখছিল। তারা ভাবছিল, এভাবে চলতে থাকলে মক্কার সকল নারী-পুরুষ নিজ ধর্ম ছেড়ে ইসলাম কবুল করে নেবে। সুতরাং তাদের চাপে পড়ে ইবনুদ্দাগিনাহ তার দেওয়া নিরাপত্তা প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হয়। পরিশেষে হিজরতের পালা আসে। হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি. নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে মক্কা থেকে হিজরত করে মদীনা মুনাওয়ারায় চলে আসেন।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. এ হাদীছ প্রমাণ করে হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি.-ই ছিলেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সর্বাপেক্ষা বেশি প্রিয় সাহাবী।
খ. প্রথম খলীফা হিসেবে হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি.-ই ছিলেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সর্বাপেক্ষা পসন্দের ব্যক্তি।
গ. ‘ইলম ও আমলে শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিকেই ইমামরূপে মনোনীত করা উচিত।
ঘ. কুরআন পাঠকালে সম্ভব হলে ক্রন্দন করা উচিত। অন্ততপক্ষে ক্রন্দনের ভাব তো অবলম্বন করা চাই-ই।
এর বিপরীতে বুখারী-মুসলিমের বেশ কিছু হাদীসে বর্ণিত আছে যে, وَإِذَا صَلَّى قَائِمًا فَصَلُّوا قِيَامًا وَإِذَا صَلَّى قَاعِدًا فَصَلُّوا قُعُودًا أَجْمَعُونَ ইমাম দাঁড়িয়ে নামায পড়লে তোমরাও দাঁড়িয়ে নামায পড়বে। আর ইমাম বসে নামায পড়লে তোমরাও সকলে বসে নামায পড়বে। (বুখারী-৬৫৫, মুসলিম-৮০৬) ইমাম বুখারী রহ. হযরত আনাস রা. থেকে এ হাদীসটি বর্ণনা করার পরে বলেন, قَالَ الْحُمَيْدِيُّ قَوْلُهُ إِذَا صَلَّى جَالِسًا فَصَلُّوا جُلُوسًا هُوَ فِي مَرَضِهِ الْقَدِيمِ ثُمَّ صَلَّى بَعْدَ ذَلِكَ النَّبِيُّ صَلَّى الله عَلَيْهِ وَسَلَّمَ جَالِسًا وَالنَّاسُ خَلْفَهُ قِيَامًا لَمْ يَأْمُرْهُمْ بِالْقُعُودِ وَإِنَّمَا يُؤْخَذُ بِالْآخِرِ فَالْآخِرِ مِنْ فِعْلِ النَّبِيِّ صَلَّى الله عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ‘আল্লামা হুমাইদী বলেন, ইমাম বসে নামায পড়লে তোমরাও বসে নামায পড়বে’ এটা নবী কারীম স.-এর পূর্বেকার অসুস্থতার সময়ের কথা। পরবর্তীতে নবী কারীম স. নামায পড়েছেন বসে আর তাঁর পেছনের মুক্তাদীগণ পড়েছেন দাঁড়িয়ে। রসূল স. তাদেরকে বসতে বলেননি। আর রাসূল সা. এর সর্বশেষ আমলই গ্রহণীয়। (বুখারী-৬৫৫) এ থেকে প্রমাণিত হয় যে, ইমাম বসে নামায পড়ালে তাঁর পেছনের সুস্থ মুক্তাদীগণ দাঁড়িয়ে ইক্তিদা করবে। এ আমলটি রসূল স.-এর শেষ আমল এবং এটাই বহাল। আর বসে ইক্তিদা করার আমলটি পূর্বের যা রহিত হয়ে গেছে।
২. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ওফাতের আগের বৃহস্পতিবার ইশার সময় খুব বেশি অসুস্থ হয়ে পড়েন। ফলে তাঁর পক্ষে মসজিদে গিয়ে ইমামত করা সম্ভব হচ্ছিল না। তাই তিনি ঘরের লোকদের হুকুম দিলেন, যেন তারা হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি.-কে ইমামত করতে বলেন। হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি.-এর মন ছিল অত্যন্ত নরম। কুরআন মাজীদ তিলাওয়াতকালে তাঁর কান্না চলে আসত। কান্নার বেগ বেশি হলে স্বাভাবিক গতিতে তিলাওয়াত করা সম্ভব হয় না। ইমামত করার সময় এরূপ অবস্থা হলে সাবলীলভাবে কুরআন পাঠ করা কঠিন হয়ে যায়। আবার সময়টা ছিল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অসুস্থতাকালীন। এ কারণে হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি, এমনিতেও উদ্বিগ্ন ছিলেন। এ অবস্থায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্থানে দাঁড়িয়ে ইমামত করতে তাঁর অনেক বেশি চাপবোধ হওয়ার কথা। সেদিকে ইঙ্গিত করে উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা রাযি. বলেন যে, আপনার স্থানে দাঁড়িয়ে তিনি নামায পড়লে কান্নার কারণে মানুষকে কিরাআত, তাকবীর ইত্যাদি শোনাতে পারবেন না। অর্থাৎ কান্না অবস্থায় তাঁর উচ্চারণ জড়িয়ে যাবে। আওয়াজও উঁচু হবে না। ফলে মুক্তাদীগণ তা শুনতে পাবে না।
কিন্তু নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এসব ওজর গ্রাহ্য করলেন না। হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি. তাঁর সবচে' বেশি প্রিয় মানুষ। বিভিন্ন আলামত-ইঙ্গিত দ্বারা বোঝা যায়, তাঁর একান্ত কামনা ছিল তাঁর ওফাতের পর হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি.-ই যেন প্রথম খলীফা হিসেবে মনোনীত হন। জীবনের শেষ দিনগুলোতে নামাযের ইমামরূপে তাঁর স্থলাভিষিক্ত হিসেবে দায়িত্ব পালন করাটা এ কামনা পূরণে সহায়ক ছিল। অন্য কেউ এ দায়িত্ব পালন করলে তার দিকে কিছু লোকের ঝুঁকে পড়ার আশঙ্কা ছিল। হয়তো এটাকে তারা তার খলীফারূপে মনোনয়নের প্রতি ইঙ্গিত মনে করত। সে আশঙ্কার পথ বন্ধ করার জন্য হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি.-কে দিয়েই ইমামত করানোর প্রয়োজন ছিল। তাই সব ওজর প্রত্যাখ্যান করে তিনি বারবার হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি.-কেই ইমামত করার হুকুম দিতে বললেন।
সেমতে হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্থলাভিষিক্তরূপে নামাযের ইমামত করলেন। এটা ছিল বৃহস্পতিবার ইশার নামায। এরপর থেকে সোমবার ফজর পর্যন্ত টানা ১৭ ওয়াক্ত নামাযে তিনি ইমামত করেন। ওফাতের পর যখন খলীফা নিয়োগের পালা আসে, তখন হযরত উমর ফারূক রাযি, হযরত আলী রাযি. প্রমুখ শীর্ষস্থানীয় সাহাবীগণ নামাযের এই ইমামতকে তাঁর বৃহত্তর ইমামত অর্থাৎ খেলাফতের পদমর্যাদায় অভিষিক্ত হওয়ার পক্ষে একটি বড় শক্তিরূপে অবলম্বন করে নিয়েছিলেন।
যাহোক, এস্থলে এ হাদীছের মূল বিষয় হল কুরআন তিলাওয়াতকালে ক্রন্দন করা। হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি. তিলাওয়াতকালে খুব কাঁদতেন। এটা প্রকৃত মুমিনদের শান। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে
إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ الَّذِينَ إِذَا ذُكِرَ اللَّهُ وَجِلَتْ قُلُوبُهُمْ وَإِذَا تُلِيَتْ عَلَيْهِمْ آيَاتُهُ زَادَتْهُمْ إِيمَانًا وَعَلَى رَبِّهِمْ يَتَوَكَّلُونَ
মুমিন তো তারাই, (যাদের সামনে) আল্লাহকে স্মরণ করা হলে তাদের হৃদয় ভীত হয়, যখন তাদের সামনে তাঁর আয়াতসমূহ পড়া হয়, তখন তা তাদের ঈমানের উন্নতি সাধন করে এবং তারা তাদের প্রতিপালকের উপর ভরসা করে।
অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে
اللَّهُ نَزَّلَ أَحْسَنَ الْحَدِيثِ كِتَابًا مُتَشَابِهًا مَثَانِيَ تَقْشَعِرُّ مِنْهُ جُلُودُ الَّذِينَ يَخْشَوْنَ رَبَّهُمْ ثُمَّ تَلِينُ جُلُودُهُمْ وَقُلُوبُهُمْ إِلَى ذِكْرِ اللَّهِ ذَلِكَ هُدَى اللَّهِ يَهْدِي بِهِ مَنْ يَشَاءُ وَمَنْ يُضْلِلِ اللَّهُ فَمَا لَهُ مِنْ هَادٍ
"আল্লাহ নাযিল করেছেন উত্তম বাণী- এমন এক কিতাব যার বিষয়বস্তুসমূহ পরস্পর সুসামঞ্জস্য, (যার বক্তব্যসমূহ) পুনরাবৃত্তিকৃত, যারা তাদের প্রতিপালককে ভয় করে এর দ্বারা তাদের শরীর রোমাঞ্চিত হয়। তারপর তাদের দেহমন বিগলিত হয়ে আল্লাহর স্মরণে ঝুঁকে পড়ে। এটা আল্লাহর হিদায়াত, যার মাধ্যমে তিনি যাকে চান সঠিক পথে নিয়ে আসেন আর আল্লাহ যাকে বিপথগামী করেন, তাকে সঠিক পথে আনার কেউ নেই।
কুরআন পড়ে দেহমন বিগলিত হওয়া মহান লোকদের মধ্যে হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি. ছিলেন শ্রেষ্ঠতম। মদীনা মুনাউওয়ারায় হিজরতের আগে তিনি মক্কা ছেড়ে পরিব্রাজকরূপে ভূপৃষ্ঠে ঘুরে বেড়ানো ও আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগীতে জীবন কাটিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে বের হয়ে পড়লে ইবনুদ্দাগিনাহ নামক মক্কার এক সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি তাঁকে নিরাপত্তা দিয়ে ফিরিয়ে নিয়ে এসেছিলেন। এ সময় তিনি বাড়ির আঙিনায় একটি ইবাদতখানা বানিয়ে সেখানে ইবাদত-বন্দেগী ও যিকর-তিলাওয়াতে মশগুল থাকেন। তিনি যখন বিগলিত মনে কুরআন তিলাওয়াত করতেন আর অঝোর ধারায় কাঁদতে থাকতেন, তখন আশপাশের নারী-পুরুষ সকলে ঘর থেকে বের হয়ে আসত এবং তাঁর নিকট জড়ো হয়ে কুরআন শ্রবণে মগ্ন হয়ে পড়ত। কুরায়শ নেতৃবর্গ এটাকে অনেক বড় ঝুঁকিরূপে দেখছিল। তারা ভাবছিল, এভাবে চলতে থাকলে মক্কার সকল নারী-পুরুষ নিজ ধর্ম ছেড়ে ইসলাম কবুল করে নেবে। সুতরাং তাদের চাপে পড়ে ইবনুদ্দাগিনাহ তার দেওয়া নিরাপত্তা প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হয়। পরিশেষে হিজরতের পালা আসে। হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি. নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে মক্কা থেকে হিজরত করে মদীনা মুনাওয়ারায় চলে আসেন।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. এ হাদীছ প্রমাণ করে হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি.-ই ছিলেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সর্বাপেক্ষা বেশি প্রিয় সাহাবী।
খ. প্রথম খলীফা হিসেবে হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি.-ই ছিলেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সর্বাপেক্ষা পসন্দের ব্যক্তি।
গ. ‘ইলম ও আমলে শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিকেই ইমামরূপে মনোনীত করা উচিত।
ঘ. কুরআন পাঠকালে সম্ভব হলে ক্রন্দন করা উচিত। অন্ততপক্ষে ক্রন্দনের ভাব তো অবলম্বন করা চাই-ই।
২. ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)