রিয়াযুস সালিহীন-ইমাম নববী রহঃ

ভূমিকা অধ্যায়

হাদীস নং:
ভূমিকা অধ্যায়
ইমাম নববী রাহঃ-এর ভূমিকাঃ

সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর। তিনি এক, মহা শক্তিশালী, প্রবল পরাক্রান্ত, মহা ক্ষমাশীল। তিনি হৃদয়বান ও চিন্তাশীল লোকদের উপদেশদান এবং জ্ঞানী ও শিক্ষাগ্রহণকারী লোকদের অন্তর্দৃষ্টি উন্মোচনের জন্য রাত ও দিনের আবর্তন ঘটান। তিনি তাঁর সৃষ্টিকুলের মধ্যে যাকে চান সজাগ করেন। তিনি তাদেরকে ইহজগতের ব্যাপারে নির্মোহ করে। তোলেন এবং তাদেরকে মশগুল করে দেন তাঁর ধ্যানে, সার্বক্ষণিক ফিকিরে এবং উপদেশ ও শিক্ষাগ্রহণে। তিনি তাদেরকে তাঁর আনুগত্যে অভ্যস্ত হওয়ার তাওফীক দান করেন এবং অনন্ত নিবাসের জান্নাতলাভের জন্য প্রস্তুতিগ্রহণে সাহায্য করেন। তিনি তাদেরকে সতর্ক রাখেন যাতে এমন কোনও কাজ না করে, যা তাঁর অসন্তুষ্টির কারণ হয় এবং তাদের জন্য ধ্বংসের নিবাস জাহান্নাম অবধারিত করে। সেইসংগে অবস্থা ও পরিবেশ- পরিস্থিতির আবর্তন-বিবর্তনে তাদেরকে সঠিক পথে অবিচল থাকারও তাওফীক দেন।
আমি তাঁর প্রশংসা করছি চূড়ান্ত প্রশংসা। আমি তাঁর প্রশংসা করছি বিশুদ্ধতম ও পরিপূর্ণ প্রশংসা। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি আল্লাহ ছাড়া কোনও মা'বূদ নেই। তিনি পুণ্যময় ও মহানুভব। তিনি দয়ার্দ্র, পরমদয়ালু। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি মুহাম্মাদ তাঁর বান্দা ও রাসূল। তাঁর হাবীব ও খলীল। তিনি সরল সঠিক পথের দিশারী এবং সুপ্রতিষ্ঠিত দীনের আহ্বায়ক। আল্লাহর রহমত ও তাঁর শান্তি বর্ষিত হোক তাঁর প্রতি ও সমস্ত নবী-রাসূলগনের প্রতি এবং প্রত্যেক নবীর পরিবারবর্গ ও সমস্ত নেককার বান্দার প্রতি।
তারপর বক্তব্য এই যে, আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেছেন-
وَمَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالْإِنْسَ إِلَّا لِيَعْبُدُونِ مَا أُرِيدُ مِنْهُمْ مِنْ رِزْقٍ وَمَا أُرِيدُ أَنْ يُطْعِمُونِ

"আমি জিন্ন ও ইনসানকে কেবল এজন্যই সৃষ্টি করেছি যে, তারা আমার ইবাদত করবে। আমি তাদের কাছে রিযক চাই না এবং এটাও চাই না যে, তারা আমাকে খাবার দিক।"
এর দ্বারা সুস্পষ্টভাবে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, তাদেরকে কেবল ইবাদতের জন্যই সৃষ্টি করা হয়েছে। সুতরাং যে উদ্দেশ্যে তাদের সৃষ্টি করা হয়েছে, তাদের অবশ্যকর্তব্য তার প্রতি মনোযোগী হওয়া এবং নির্মোহ জীবনযাপনের মাধ্যমে দুনিয়ার ভোগবিলাস পরিহার করে চলা। কেননা এটা নশ্বর জগত। চিরদিন থাকার জায়গা নয়। এটা (পরকালীন গন্তব্যস্থলে) পৌঁছার বাহন, ফুর্তির জায়গা নয়। এবং এটা বিচ্ছিন্নতার ঘাঁটি, স্থায়ী ঠিকানা নয়। সুতরাং ইবাদতকারী বান্দাগণই এর সচেতন বাসিন্দা এবং নির্মোহ জীবন-যাপনকারীগণই এর সর্বাপেক্ষা বুদ্ধিমান লোক।
আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেন-
إِنَّمَا مَثَلُ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا كَمَاءٍ أَنْزَلْنَاهُ مِنَ السَّمَاءِ فَاخْتَلَطَ بِهِ نَبَاتُ الْأَرْضِ مِمَّا يَأْكُلُ النَّاسُ وَالْأَنْعَامُ حَتَّى إِذَا أَخَذَتِ الْأَرْضُ زُخْرُفَهَا وَازَّيَّنَتْ وَظَنَّ أَهْلُهَا أَنَّهُمْ قَادِرُونَ عَلَيْهَا أَتَاهَا أَمْرُنَا لَيْلًا أَوْ نَهَارًا فَجَعَلْنَاهَا حَصِيدًا كَأَنْ لَمْ تَغْنَ بِالْأَمْسِ كَذَلِكَ نُفَصِّلُ الْآيَاتِ لِقَوْمٍ يَتَفَكَّرُونَ

“পার্থিব জীবনের দৃষ্টান্ত তো কিছুটা এ রকম, যেমন আমি আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করলাম, যদ্দরুন ভূমিজ সেইসব উদ্ভিদ নিবিড় ঘন হয়ে জন্মাল, যা মানুষ ও গবাদি পশু খেয়ে থাকে । অবশেষে ভূমি যখন নিজ শোভা ধারণ করে ও নয়নাভিরাম হয়ে ওঠে এবং তার মালিকগণ মনে করে এখন তা সম্পূর্ণরূপে তাদের আয়ত্তাধীন, তখন কোনও এক দিনে বা রাতে তাতে আমার নির্দেশ এসে পড়ে (এই মর্মে যে, তার উপর কোনও দুর্যোগ আপতিত হোক) এবং আমি তাকে কর্তিত ফসলের এমন শূন্য ভূমিতে পরিণত করি, যেন গতকাল তার অস্তিত্বই ছিল না। যে সকল লোক চিন্তা করে তাদের জন্য এভাবেই নিদর্শনাবলি সুস্পষ্টরূপে বর্ণনা করি।”

এ বিষয়ে বহু আয়াত আছে। জনৈক কবি বড় সুন্দর বলেছেন-

إِنَّ لِلَّهِ عِبَادًا فطنا + طلقوا الدنيا وخافوا الفتنا

نظروا فيها فلما علموا + انها ليست لحي وطنا

جعلواها لجة واتخذوا + صالِحَ الْأَعْمَالِ فِيهَا سُفنا

“আল্লাহর কিছু বান্দা আছে, যারা ত্যাগ করেছে দুনিয়া, ভয় করেছে ফিতনার।

তারা দৃষ্টি দিল দুনিয়ার প্রতি। যখন জানতে পারল, নয় এটা কোনও জীবিতের স্থায়ী ঠিকানা,

তখন একে গণ্য করেছে সাগর, আর করেছে অবলম্বন নেক আমলসমূহকে এ সাগর উতরানোর জাহাজরূপে।'

তো এই যে বললাম দুনিয়া ক্ষণস্থায়ী আর আমাদেরকে এখানে সৃষ্টি করা হয়েছে আল্লাহ তা'আলার ইবাদত করার জন্য, তখন আমাদের কর্তব্য নেককারদের পথ অবলম্বন করা এবং বুদ্ধিমান ও জ্ঞানীজনদের পথে চলা। ইঙ্গিত করে এসেছি যে, প্রকৃত বুদ্ধিমানেরা দুনিয়ার প্রতি নির্মোহ থেকে ইবাদত-বন্দেগীতে মগ্ন থাকতেন। আমাদের কর্তব্য তাদের অনুরূপ কাজের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করা ও তাদের পদাঙ্ক অনুসরণের প্রতি যত্নবান হওয়া। এ ব্যাপারে সর্বাপেক্ষা বিশুদ্ধ পন্থা ও সরল সঠিক তরীকা হল নবী কারীম (ﷺ) থেকে বিশুদ্ধভাবে প্রমাণিত শিক্ষামালা ও আদব-শিষ্টাচার অবলম্বন করা। তিনি পূর্বাপর সমস্ত মানুষের নেতা। আগের ও পরের সকল মানুষের মধ্যে সর্বাপেক্ষা বেশী মর্যাদাবান। তাঁর ও সমস্ত নবীর প্রতি বর্ষিত হোক আল্লাহর রহমত ও শান্তি।
আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেন-
وَتَعَاوَنُوا عَلَى الْبِرِّ وَالتَّقْوَى
'তোমরা নেককাজ ও তাকওয়ায় একে অন্যকে সাহায্য কর।'
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) থেকে বিশুদ্ধসূত্রে বর্ণিত আছে যে, তিনি ইরশাদ করেন-
والله في عون العبد ما كان العبد في عون أخيه
“বান্দা যতক্ষণ তার ভাইয়ের সাহায্যে লেগে থাকে, ততক্ষণ আল্লাহ তা'আলাও তার সাহায্য করতে থাকেন।”
তিনি আরও ইরশাদ করেন-
منْ دَلَّ عَلَى خَيْرٍ فَلَهُ مِثْلُ أَجْرٍ فَاعِلِهِ.
“যে ব্যক্তি কোনও নেক কাজের পথ দেখায়, তার জন্য রয়েছে ওই নেক কাজের কর্তার অনুরূপ ছওয়াব।"
তিনি আরও ইরশাদ করেন-
من دعا إلى هدى كان له من الأجر مثل أجور من تبعده لا ينقص ذلك من أجورهم شيئا
যে ব্যক্তি কোনও সৎকর্মের দিকে ডাকে, তার জন্য রয়েছে ওই সৎকর্মের অনুসরণকারীদের সমান ছওয়ার। তাতে তাদের ছওয়াব একটুও কমে না।”
নবী কারীম (ﷺ) হযরত আলী রাযিঃ-কে উপদেশ দেন-
فو الله لأن يَهْدِي الله بك رَجُلًا واحدًا خير لك من حمر النعم.
"আল্লাহর কসম! যদি আল্লাহ তা'আলা তোমার দ্বারা একজন লোককেও হিদায়াত দান করেন, তবে তা তোমার জন্য একপাল লাল উট অপেক্ষাও উত্তম। (লাল উটের কথা বলা হয়েছে সেকালের দিকে লক্ষ করে। সেকালে এটাই ছিল সর্বাপেক্ষা দামী সম্পদ। এর দ্বারা বোঝানো উদ্দেশ্য- কারও হিদায়াতের জন্য মেহনত করা আল্লাহর কাছে দুনিয়ার সর্বাপেক্ষা দামী সম্পদ অপেক্ষাও মূল্যবান।)
সুতরাং আমি চিন্তা করলাম সহীহ হাদীছের একটি সংক্ষিপ্ত সংকলন তৈরী করব। তাতে এমনসব হাদীছ থাকবে, যা হবে এর পাঠকের জন্য আখিরাতের দিকে চলার পথস্বরূপ। পাঠক তা দ্বারা জাহেরী ও বাতেনী আদব-কায়দা শিখতে পারবে। তাতে প্রেরণাদায়ী ও সতর্ককারী- এ উভয়রকম হাদীছ থাকবে। এমনিভাবে তাতে থাকবে আল্লাহর পথের পথিকদের প্রয়োজনীয় যাবতীয় শিক্ষাসংক্রান্ত হাদীছ। যথা- যুহদ (দুনিয়ার প্রতি নিরাসক্তি) সম্পর্কিত হাদীছ, আত্মশুদ্ধি ও চরিত্র গঠনমূলক হাদীছ, কলবের পবিত্রতা ও আত্মিক রোগ নিরাময় সংক্রান্ত হাদীছ এবং অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের হেফাজত ও তার বক্রতা নিরসনমূলক হাদীছ। এমনিভাবে আল্লাহর মা'রিফাত ও তত্ত্বজ্ঞানসম্পন্ন লোকদের কাঙ্ক্ষিত অন্যান্য বিষয় সম্বলিত হাদীছসমূহও তাতে থাকবে।
এ সংকলনে আমার নীতি হবে কেবল বিশুদ্ধ ও স্পষ্ট অর্থবোধক হাদীছসমূহই উল্লেখ করা। প্রসিদ্ধ ও বিশুদ্ধ হাদীছ গ্রন্থসমূহের বরাতও উল্লেখ করে দেব। প্রতিটি অধ্যায় শুরু করব কুরআন মাজীদের আয়াত দ্বারা। কোনও শব্দের উচ্চারণ নিরূপণ করে দেওয়ার প্রয়োজন হলে তাও করে দেব। অস্পষ্ট অর্থেরও ব্যাখ্যা করে দেব। সেইসংগে উৎকৃষ্ট কোনও জ্ঞাতব্য বিষয় থাকলে তা উল্লেখ করব। কোনও হাদীছের শেষে যদি লিখি, متفق عليه তবে তার অর্থ এ হাদীছটি ইমাম বুখারী ও ইমাম মুসলিম উভয়ই উল্লেখ করেছেন।
যদি এ গ্রন্থখানি সংকলনের কাজ শেষ হতে পারে, তবে আমি আশা করি এটি মনোযোগী পাঠককে কল্যাণের পথে টেনে নেবে এবং তাকে সবরকম মন্দ ও ধ্বংসাত্মক কাজ থেকে বিরত রাখবে।
যে-কোনও ভাই এর দ্বারা কিছুমাত্র উপকৃত হবেন তার কাছে আমার নিবেদন- তিনি যেন আমার জন্য, আমার মা-বাবার জন্য, আমার উস্তাযগণের জন্য, আমার সকল বন্ধু-বান্ধবের জন্য এবং সমস্ত মুসলিম নর-নারীর জন্য দু'আ করেন।
মহান আল্লাহর প্রতি আমার ভরসা। তাঁর উপরই আমি নিজেকে ও আমার যাবতীয় বিষয় ন্যস্ত করি । আল্লাহই আমার জন্য যথেষ্ট এবং তিনিই উত্তম কর্মবিধায়ক। পরাক্রান্ত প্রজ্ঞাময় আল্লাহ ছাড়া কারও কোনও ভালো কাজ করার শক্তি নেই এবং নেই কোনও মন্দ কাজ থেকে বেঁচে থাকার ক্ষমতা।

বিসমিল্লাহির রাহ্‌মানির রাহীমঃ

অধ্যায়: ১

সমস্ত কাজ ও কথায় এবং প্রকাশ্য ও গুপ্ত যাবতীয় অবস্থায় ইখলাস ও সহীহ নিয়তের গুরুত্ব।

এ অধ্যায়ে ইখলাস ও সহীহ নিয়ত সম্পর্কিত আয়াত ও হাদীছ উল্লেখ করা হয়েছে।

নিয়ত : নিয়ত অর্থ কোনও কাজে মনের ইচ্ছা যোগ করা। এই ইচ্ছা দু'রকম হতে পারে-
এক. এমন ইচ্ছা, যা দ্বারা কাজ নির্দিষ্ট করা হয়। অর্থাৎ বিভিন্ন রকম কাজ ও ইবাদতের ভেতর আমি কোনটা করতে চাই, মনে মনে তা নির্দিষ্ট করে নেওয়া। নামায ফরয, ওয়াজিব, সুন্নত, নফল বিভিন্ন রকম হতে পারে। তাছাড়া আছে ওয়াক্তিয়া নামায ও কাযা নামায। কাযাও বিভিন্ন ওয়াক্তের হতে পারে। অনুরূপ রোযাও বিভিন্ন রকম আছে। রমযানের কাযা রোযা, মানতের রোযা, কাফফারার রোযা, নফল রোযা ইত্যাদি। তো আমি যখন নামায পড়ব বা রোযা রাখব, তখন এই বিভিন্ন রকম নামায ও রোযার ভেতর কোনটা আদায় করতে যাচ্ছি মনে মনে তা ঠিক করে নেওয়া, যেমন আমি ফজরের দু' রাক'আত সুন্নত পড়ছি বা দু' রাকাআত ফরয পড়ছি, আমি রমযানের ছুটে যাওয়া রোযার কাযা করছি, মানতের রোযা রাখছি কিংবা নফল রোযা রাখছি ইত্যাদি। যেকোনও ইবাদত শুরুর আগে তা নির্দিষ্ট করার জন্য এরূপ নিয়ত করা জরুরী, অন্যথায় সে ইবাদত সহীহ হয় না।

দুই. এমন ইচ্ছা, যা দ্বারা কাজের উদ্দেশ্য নির্দিষ্ট করা হয়। অর্থাৎ আমি যে কাজটি করছি তা কী উদ্দেশ্যে করছি? আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি লাভের জন্য, না পার্থিব কোনও স্বার্থ হাসিলের জন্য? আল্লাহ তা'আলার সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে করে থাকলে তাকে বলা হবে সহীহ নিয়ত। আর যদি মানুষকে খুশি করার জন্য করা হয় বা সুনাম-সুখ্যাতি লাভের উদ্দেশ্য থাকে, তবে তা হবে ফাসিদ নিয়ত। ফাসিদ নিয়তে ইবাদত-বন্দেগী করলে তা আল্লাহ তাআলার কাছে কবুল হয় না, বাহ্যদৃষ্টিতে তা যতই সুন্দর ও বিশুদ্ধ মনে হোক না কেন। আল্লাহ তা'আলার কাছে ইবাদত কবুল হওয়ার জন্য নিয়ত সহীহ থাকা শর্ত। সহীহ নিয়তেরই অপর নাম ইখলাস।

ইখলাস : ইখলাস মানে খালেস ও মুক্ত করা। ইবাদত-বন্দেগীতে ইখলাস হল- তাকে ভ্রান্ত উদ্দেশ্য থেকে মুক্ত রেখে কেবল আল্লাহ তা'আলার সন্তুষ্টি লাভের জন্য সম্পন্ন করা। অর্থাৎ নামায, রোযা ইত্যাদি আদায় করা হবে কেবলই আল্লাহ তা'আলাকে খুশি করার জন্য, দুনিয়ার কোনও কিছু পাওয়ার জন্য নয়। যেমন কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে-

إِنَّمَا نُطْعِمُكُمْ لِوَجْهِ اللَّهِ لَا نُرِيدُ مِنْكُمْ جَزَاء وَلَا شُكُورا-

অর্থ : (এবং তাদেরকে বলে,) আমরা তো তোমাদেরকে খাওয়াই কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে। আমরা তোমাদের কাছে কোনও প্রতিদান চাই না এবং কৃতজ্ঞতাও না।

প্রকাশ থাকে যে, ইসলামে ইখলাস ও সহীহ নিয়তের গুরুত্ব অপরিসীম। বলা যায় এটা গোটা দীনের অর্ধাংশ। কেননা যেকোনও কাজ আল্লাহর কাছে গৃহীত হওয়ার জন্য বা দীনী কাজ সাব্যস্ত হওয়ার জন্য দু'টি শর্ত। (ক) কাজটি সঠিক হওয়া এবং (খ) তা খালেস হওয়া। যদি কোনও কাজ সঠিক হয় কিন্তু খালেস না হয়, তা আল্লাহ কাছে গ্রহণযোগ্য হয় না। অনুরূপ যদি খালেস হয় কিন্তু সঠিক না হয়, তাও গৃহীত হয় না। গৃহীত হওয়ার জন্য সঠিক হওয়া ও খালেস হওয়া উভয়ই জরুরি। বলা বাহুল্য, কাজ সঠিক হয় সুন্নত মোতাবেক হওয়ার দ্বারা অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে পদ্ধতি শিক্ষা দিয়েছেন, সেই মোতাবেক হওয়ার দ্বারা। এককথায় শরীআতসম্মত কাজই সঠিক কাজ। শরী'আতে যে কাজের অনুমোদন নেই তা ভ্রান্ত কাজ। এরূপ কাজে সহীহ নিয়তের প্রশ্নই আসে না। এরূপ কাজ আল্লাহর উদ্দেশ্যে করলে ছওয়াব তো পাওয়াই যাবে না; বরং দ্বিগুণ গুনাহ হবে। যেমন কেউ চুরি-ডাকাতি করে বা সুদ-ঘুষ খেয়ে সেই অর্থ গরীব-দুঃখীদের মধ্যে বিতরণ করল এবং আশা রাখল যে, এটা অনেক বড় দীনী কাজ হল আর আল্লাহ তা'আলা এতে খুশি হবেন। তার আশা দুরাশা মাত্র, বরং এটা আল্লাহ তা'আলার সংগে একরকম পরিহাস। না'উযুবিল্লাহি মিন যালিক।
সমস্ত বিদআতী কাজও এর পর্যায়ভুক্ত। নিজের পক্ষ থেকে কোনও কাজকে দ্বীনের অংশ সাব্যস্ত করাকে বিদআত বলে। এটা শরীআতে সংযোজন করার নামান্তর, যেমন চল্লিশা করা, শবে বরাতে হালুয়া-রুটি বিতরণ করা, মাজারে শিরনী দেওয়া, মৃত ব্যক্তির ঘরে তিন দিন চুলা জ্বালানো দুষনীয় মনে করা ইত্যাদি। বিদআত করা কঠিন গুনাহ।
সুতরাং কেউ যদি ইখলাসের সাথে এরূপ কাজ করে অর্থাৎ এরূপ কাজের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তষ্টি লাভের আশা রাখে, তবে তাতে সন্তুষ্টিলাভ তো হাসিল হবেই না, উল্টো গুনাহ হবে। কেননা আল্লাহর সন্তুষ্টিলাভ কেবল শরী'আতসম্মত কাজের দ্বারাই সম্ভব।
আর কাজ খালেস হয় সহীহ নিয়ত ও ইখলাসের দ্বারা। অর্থাৎ শরীআতসম্মত কাজটি যদি আল্লাহ তা'আলার সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে করা হয়, তবেই সে কাজ আল্লাহ তা'আলার কাছে গ্রহণযোগ্য হয়। এরূপ কাজে যদি ইখলাস না থাকে, তবে তাতে কোনও ছওয়াব লাভ হয় না, উল্টো গুনাহ হয়। যেমন কেউ যদি 'লোকে হাজী সাহেব বলবে' এই উদ্দেশ্যে হজ্জ করে, তবে সেই হজ্জ দ্বারা আখিরাতে তার কোনও কিছুই লাভ হবে না। ইবাদতে এরূপ উদ্দেশ্য থাকলে তাকে "রিয়া" বলে। রিয়াকে বলে গুপ্ত শিরক, যেহেতু আল্লাহর জন্য ইবাদত করার পাশাপাশি গায়রুল্লাহকে খুশি করা ও গায়রুল্লাহর কাছে সুনাম ও সুখ্যাতি লাভেরও ইচ্ছা থাকে। এরূপ শিরকের নিষেধাজ্ঞায় কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে-

فمن كان يَرْجُوا لِقَاء رَبِّهِ فَلْيَعْمَلْ عَمَلًا صَالِحًا وَ لَا يُشْرِكْ بِعِبَادَةِ رَبَّه أَحَدا-

অর্থ : সুতরাং যে-কেউ নিজ মালিকের সাথে মিলিত হওয়ার আশা রাখে, সে যেন সৎকর্ম করে এবং নিজ মালিকের ইবাদতে অন্য কাউকে শরীক না করে।
অর্থাৎ তাঁর যেহেতু কোনও শরীক নেই, তাই ইবাদত করতে হবে ইখলাসের সাথে। তাতে স্থূল তো নয়ই, সূক্ষ্ম শিরকও পরিত্যাজ্য। অর্থাৎ নিয়ত থাকবে কেবল আল্লাহ তাআলাকে খুশি করা। রিয়া বা মানুষকে দেখানোর জন্য ইবাদত করলে তাও এক ধরনের শিরক, তাতে ইবাদতের ভেতর সূক্ষ্মভাবে মানুষকে শরীক করা হয়।
এক হাদীছ দ্বারা জানা যায়, সুনাম-সুখ্যাতি লাভের উদ্দেশ্যে যারা ইবাদত-বন্দেগী করে, তারা জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে। উদাহরণস্বরূপ এক হাদীছে একজন শহীদ, একজন আলেম ও একজন দানশীল লোকের কথা বলা হয়েছে, যাদের উদ্দেশ্য আল্লাহ তা'আলার সন্তুষ্টি অর্জন ছিল না, বরং উদ্দেশ্য ছিল কেবলই মানুষের মাঝে সুনাম অর্জন করা, আপন-আপন স্থানে অনেক বড় ত্যাগ স্বীকার করা সত্ত্বেও আল্লাহ তা'আলার পক্ষ থেকে হুকুম হবে- এদেরকে জাহান্নামে নিক্ষেপ কর। এর কারণ কেবল এই যে, তাদের অন্তরে ইখলাস ছিল না।
এর দ্বারা ইখলাস যে কত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তা সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। ইখলাসের এ গুরুত্ব কুরআন মাজীদের বিভিন্ন আয়াতে স্পষ্ট করা হয়েছে। এ সম্পর্কে আছে বহু হাদীছও। ইমাম নববী রহ. এ অধ্যায়ে প্রথমে এ রকম কিছু আয়াত, তারপর কয়েকটি হাদীছ উল্লেখ করেছেন। নিচে আমরা এসব আয়াত ও হাদীছের অর্থ ও ব্যাখ্যা পেশ করছি। আল্লাহ তাআলাই তাওফীকদাতা।


ইখলাস সম্পর্কে কতিপয় আয়াত:

এক নং আয়াত -

قَالَ اللهُ تَعَالَى: {وَمَا أُمِرُوا إِلاَّ لِيَعْبُدُوا اللَّهَ مُخْلِصِينَ لَهُ الدِّينَ حُنَفَاءَ وَيُقِيمُوا الصَّلاةَ وَيُؤْتُوا الزَّكَاةَ وَذَلِكَ دِينُ الْقَيِّمَةِ} [البينة: 5]

অর্থঃ তাদেরকে কেবল এই আদেশই করা হয়েছিল যে, তারা আল্লাহর ইবাদত করবে, আনুগত্যকে একনিষ্ঠভাবে তাঁরই জন্য খালেস রেখে এবং নামায কায়েম করবে ও যাকাত দেবে আর এটাই সরল সঠিক উম্মতের দ্বীন।

ব্যাখ্যা:
এ আয়াতে আল্লাহ তা'আলা জানাচ্ছেন, আহলে কিতাব তথা ইহুদি ও খ্রিস্টান জাতির প্রতি নির্দেশ ছিল, তারা যেন ইখলাস ও বিশুদ্ধ নিয়তের সাথে আল্লাহ তাআলার ইবাদত করে। অর্থাৎ ইবাদতের উদ্দেশ্য যেন আল্লাহ তা'আলার সন্তুষ্টি লাভই হয়, অন্য কোনও উদ্দেশ্য না থাকে। নামায, রোযা ইত্যাদি যাবতীয় ইবাদতে লক্ষ থাকবে কেবলই তাঁর সন্তুষ্টি। বলাবাহুল্য, এ আদেশ তাদেরকে তাদের আসমানী কিতাবেই দেয়া হয়েছিল; তাওরাত ও ইনজীলে। সেই নির্দেশ কুরআন মাজীদে উল্লেখ দ্বারা প্রমাণ হয়, এটা সমস্ত জাতির প্রতি আল্লাহ তা'আলার এক সাধারণ হুকুম। আগের জাতিসমূহকে যেমন ইখলাসের সাথে ইবাদত-বন্দেগীর হুকুম দেওয়া হয়েছিল, তেমনি এ জাতির প্রতিও সেই হুকুম বলবৎ আছে। ইখলাসবিহীন ইবাদত যেমন পূর্বকালে গ্রহণযোগ্য ছিল না, তেমনি একালেও তা গ্রহণযোগ্য নয় ।
আয়াতে ইখলাসের সংগে ইবাদত-বন্দেগী করাকে সরল সঠিক দ্বীন সাব্যস্ত করা হয়েছে। তার মানে বান্দার কর্তব্য নিয়মিত ইবাদত-বন্দেগী করা এবং আল্লাহর যাবতীয় হুকুম মেনে চলা, সেইসংগে ইবাদত-বন্দেগী ও আল্লাহর হুকুম পালনে ইখলাসের পরিচয় দেওয়া। ইখলাসের সংগে আল্লাহর হুকুম পালন করা না হলে বান্দা যা কিছুই করুক না কেন, তা দ্বীনরূপে গণ্য হবে না। এর দ্বারা ইখলাসের গুরুত্ব পরিস্ফুট। সুতরাং আমাদের কর্তব্য এ গুরুত্ব উপলব্ধি করা এবং সমস্ত আমলে ইখলাস ও বিশুদ্ধ নিয়তের প্রতি যত্নবান থাকা ।

দুই নং আয়াত:

وَقالَ تَعَالَى: {لَنْ يَنَالَ اللَّهَ لُحُومُهَا وَلاَ دِمَاؤُهَا وَلَكِنْ يَنَالُهُ التَّقْوَى مِنْكُمْ} [الحج: 37]

অর্থ : আল্লাহর কাছে তাদের গোশত (অর্থাৎ কুরবানীর পশু) পৌঁছে না আর তাদের রক্তও না, বরং তাঁর কাছে তো তোমাদের তাকওয়াই পৌঁছে।

ব্যাখ্যা:
এ আয়াতের শানে নুযুল সম্পর্কে হযরত আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাযি. থেকে বর্ণিত আছে যে, জাহিলী যুগের মানুষ কুরবানীর পশুর রক্ত বায়তুল্লাহ শরীফে মাখিয়ে দিত। তার অনুকরণে মুসলিমগণও চাইল তাদের কুরবানীর পশুর রক্ত কাবা ঘরে মাখিয়ে দেবে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহ তাআলা এ আয়াত নাযিল করেন। এর দ্বারা জানানো হয়, কাবা ঘরে রক্ত মাখানো একটি অহেতুক কাজ। কুরবানীর পশুর রক্ত ও তার গোশত কোনোকিছুই তো আল্লাহর কাছে পৌঁছে না। রক্ত মাটিতে মিশে যায় আর গোশত কুরবানীদাতা নিজেই খেয়ে থাকে। পশুর অন্যান্য অংশও তার উপকারে আসে। এর কোনোকিছুই আল্লাহর কোনও কাজে আসে না। তিনি কেবল দেখেন তোমাদের মনের অবস্থা। অর্থাৎ তোমরা কুরবানী করছ তাঁর সন্তষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে, না সুনাম- সুখ্যাতি লাভ বা অন্য কোনও দুনিয়াবী লক্ষ্যে। যদি আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য কুরবানী করে থাক, তবে তোমাদের এই ইখলাস ও সদিচ্ছার বিষয়টা তাঁর কাছে পৌঁছে। অর্থাৎ এরকম কুরবানী তিনি কবুল করে নেন এবং এর বিনিময়ে বান্দাকে প্রভূত ছওয়াব দান করেন। এ আয়াত দ্বারাও সহীহ নিয়ত ও ইখলাসের গুরুত্ব বোঝা গেল।

তিন নং আয়াত:

وَقالَ تَعَالَى: {قُلْ إِنْ تُخْفُوا مَا فِي صُدُورِكُمْ أَوْ تُبْدُوهُ يَعْلَمْهُ اللَّهُ} [آل عمران: 29]

অর্থ: (হে রাসূল! মানুষকে বলে দাও, তোমাদের অন্তরে যা-কিছু আছে, তোমরা তা গোপন রাখ বা প্রকাশ কর, আল্লাহ তা অবগত আছেন ।

ব্যাখ্যা:
অর্থাৎ তোমরা এ কথা মনে করো না যে, ইখলাস তো মনের বিষয়। আমি কোন কাজ কী নিয়তে করছি তা তো কেউ জানে না। বাহ্যিকভাবে কাজ সঠিক হলেই হল। মনে কি আছে না আছে, তা কে দেখে? এরূপ মনে করা নিতান্তই ভুল। কেননা আল্লাহ তাআলা প্রকাশ্য ও গুপ্ত সবকিছুই দেখেন ও জানেন। কার মনে কি আছে তারও খবর তিনি রাখেন। তিনি অন্তর্জামী। তিনি মনের অবস্থা অনুযায়ী কাজের ফলাফল দান করবেন। তিনি যেমন তোমাদের দেহের স্রষ্টা, তেমনি মনেরও। ফলে দেহ ও মনের কোনোকিছুই তাঁর অগোচরে থাকতে পারে না। তিনি ইরশাদ করেন-

الا يعلم من خلق وَهُوَ اللطيف الخبير -

"যিনি সৃষ্টি করেছেন তিনি জানবেন না? অথচ তিনি সূক্ষদর্শী, সম্যক জ্ঞাত।”
১। ইখলাস সম্পর্কিত হাদীছ—
সমস্ত আমল নিয়তের উপর নির্ভরশীল:
হাদীছ নং : ১

অর্থ : আমীরুল মুমিনীন হযরত উমর ইবনে খাত্তাব (ইবন নুফায়ল ইবন আব্দুল উযযা ইবন রিয়াহ ইবন আব্দুল্লাহ ইবন কুরত ইবন রাযাহ ইবন 'আদী ইবন কা'ব ইবন লুআঈ ইবন গালিব কুরাশী আদাভী) রাযি. বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি যে, সমস্ত আমল নিয়তের সংগে সম্পর্কযুক্ত। প্রত্যেক ব্যক্তি তাই পাবে, যা সে নিয়ত করে। সুতরাং যার হিজরত হয় আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের দিকে (অর্থাৎ তাঁর সন্তুষ্টিলাভের উদ্দেশ্যে), তার হিজরত (বাস্তবিকই) আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের দিকেই হয়। আর যার হিজরত হয় দুনিয়ার দিকে (অর্থাৎ দুনিয়ার কোনও ভোগ্যবস্তু লাভের উদ্দেশ্যে) বা কোনও মহিলার দিকে, যাকে সে বিবাহ করতে চায়, তার হিজরত (প্রকৃতপক্ষে) সে দিকেই হয়, যেদিকে (অর্থাৎ যা লাভের উদ্দেশ্যে) সে হিজরত করেছে।
বুখারী ও মুসলিম।
(বুখারী হাদীস নং ১,মুসলিম হাদীস নং ১৯০৭)
উক্ত হাদীসটি আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মাদ ইবনে ইসমাঈল আল-বুখারী এবং আবুল-হুসাইন মুসলিম ইবনে হাজ্জাজ আল কুশাইরী তাদের কিতাবদ্বয়ে (সহীহাইন) বর্ণনা করেছেন।
مقدمة الامام النووي
مقدمة المؤَلف الإمَام النوَوي
بسم الله الرحمن الرحيم

الحمْدُ للهِ الواحدِ القَهَّارِ، العَزيزِ الغَفَّارِ، مُكَوِّرِ اللَّيْلِ على النَّهَارِ، تَذْكِرَةً لأُولي القُلُوبِ والأَبصَارِ، وتَبْصرَةً لِذَوي الأَلبَابِ واَلاعتِبَارِ، الَّذي أَيقَظَ مِنْ خَلْقهِ مَنِ اصطَفاهُ فَزَهَّدَهُمْ في هذهِ الدَّارِ، وشَغَلهُمْ بمُراقبَتِهِ وَإِدَامَةِ الأَفكارِ، ومُلازَمَةِ الاتِّعَاظِ والادِّكَارِ، ووَفَّقَهُمْ للدَّأْبِ في طاعَتِهِ، والتّأهُّبِ لِدَارِ القَرارِ، والْحَذَرِ مِمّا يُسْخِطُهُ ويُوجِبُ دَارَ البَوَارِ، والمُحافَظَةِ على ذلِكَ مَعَ تَغَايُرِ الأَحْوَالِ والأَطْوَارِ، أَحْمَدُهُ أَبلَغَ حمْدٍ وأَزكَاهُ، وَأَشمَلَهُ وأَنْمَاهُ، وأَشْهَدُ أَنْ لا إِلَهَ إِلا اللهُ البَرُّ الكَرِيمُ، الرؤُوفُ الرَّحيمُ، وأشهَدُ أَنَّ سَيَّدَنا مُحمّدًا عَبدُهُ ورَسُولُهُ، وحبِيبُهُ وخلِيلُهُ، الهَادِي إلى صِرَاطٍ مُسْتَقيمٍ، والدَّاعِي إِلَى دِينٍ قَويمٍ، صَلَوَاتُ اللهِ وسَلامُهُ عَليهِ، وَعَلَى سَائِرِ النَّبيِّينَ، وَآلِ كُلٍّ، وسَائِرِ الصَّالِحينَ.
أَما بعد، فقد قال اللهُ تعالى: {وَمَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالإنْسَ إِلاَّ لِيَعْبُدُونِ مَا أُرِيدُ مِنْهُمْ مِنْ رِزْقٍ وَمَا أُرِيدُ أَنْ يُطْعِمُونِ} [الذاريات: 56 - 57] وَهَذا تَصْريحٌ بِأَنَّهُمْ خُلِقوا لِلعِبَادَةِ، فَحَقَّ عَلَيْهِمُ الاعْتِنَاءُ بِمَا خُلِقُوا لَهُ وَالإعْرَاضُ عَنْ حُظُوظِ الدُّنْيَا بالزَّهَادَةِ، فَإِنَّهَا دَارُ نَفَادٍ لاَ مَحَلُّ إخْلاَدٍ، وَمَرْكَبُ عُبُورٍ لاَ مَنْزِلُ حُبُورٍ، ومَشْرَعُ انْفصَامٍ لاَ مَوْطِنُ دَوَامٍ، فلِهذا كَانَ الأَيْقَاظُ مِنْ أَهْلِهَا هُمُ الْعُبَّادُ، وَأعْقَلُ النَّاسِ فيهَا هُمُ الزُّهّادُ. قالَ اللهُ تعالى: {إِنَّمَا مَثَلُ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا كَمَاءٍ أَنْزَلْنَاهُ مِنَ السَّمَاءِ فَاخْتَلَطَ بِهِ نَبَاتُ الأَرْضِ مِمَّا يَأْكُلُ النَّاسُ وَالأَنْعَامُ حَتَّى إِذَا أَخَذَتِ الأَرْضُ زُخْرُفَهَا وَازَّيَّنَتْ وَظَنَّ أَهْلُهَا أَنَّهُمْ قَادِرُونَ عَلَيْهَا أَتَاهَا أَمْرُنَا لَيْلًا أَوْ نَهَارًا فَجَعَلْنَاهَا حَصِيدًا كَأَنْ لَمْ تَغْنَ بِالأَمْسِ كَذَلِكَ نُفَصِّلُ الآياتِ لِقَوْمٍ يَتَفَكَّرُونَ} [يونس: 24]. والآيات في هذا المعنى كثيرةٌ.
ولقد أَحْسَنَ القَائِلُ:
إِنَّ للهِ عِبَادًا فُطَنَا ... طَلَّقُوا الدُّنْيَا وخَافُوا الفِتَنَا
نَظَروا فيهَا فَلَمَّا عَلِمُوا ... أَنَّهَا لَيْسَتْ لِحَيٍّ وَطَنَا
جَعَلُوها لُجَّةً واتَّخَذُوا ... صَالِحَ الأَعمالِ فيها سُفُنا
فإذا كَانَ حالُها ما وصَفْتُهُ، وحالُنَا وَمَا خُلِقْنَا لَهُ مَا قَدَّمْتُهُ؛ فَحَقٌّ عَلَى الْمُكلَّفِ أَنْ يَذْهَبَ بنفسِهِ مَذْهَبَ الأَخْيارِ، وَيَسلُكَ مَسْلَكَ أُولي النُّهَى وَالأَبْصَارِ، وَيَتَأهَّبَ لِمَا أشَرْتُ إليهِ، وَيَهْتَمَّ لِمَا نَبَّهتُ عليهِ. وأَصْوَبُ طريقٍ لهُ في ذَلِكَ، وَأَرشَدُ مَا يَسْلُكُهُ مِنَ المسَالِكِ، التَّأَدُّبُ بمَا صَحَّ عَنْ نَبِيِّنَا سَيِّدِ الأَوَّلينَ والآخرينَ، وَأَكْرَمِ السَّابقينَ والَّلاحِقينَ، صَلَواتُ اللهِ وسَلامُهُ عَلَيهِ وَعَلى سَائِرِ النَّبيِّينَ. وقدْ قالَ اللهُ تعالى: {وَتَعَاوَنُوا عَلَى الْبِرِّ وَالتَّقْوَى} [المائدة:2] وقد صَحَّ عَنْ رسولِ الله - صلى الله عليه وسلم - أَنَّهُ قالَ: «واللهُ في عَوْنِ العَبْدِ مَا كَانَ العَبْدُ في عَوْنِ أَخِيهِ» ، وَأَنَّهُ قالَ: «مَنْ دَلَّ عَلَى خَيْرٍ فَلَهُ مِثْلُ أجْرِ فَاعِلِهِ» وأَنَّهُ قالَ: «مَنْ دَعَا إِلى هُدىً كَانَ لَهُ مِنَ الأَجرِ مِثْلُ أُجُورِ مَنْ تَبِعَهُ لاَ يَنْقُصُ ذلِكَ مِنْ أُجُورِهِمْ شَيئًا» وأَنَّهُ قالَ لِعَليٍّ - رضي الله عنه: «فَوَاللهِ لأَنْ يَهْدِي اللهُ بِكَ رَجُلًا وَاحِدًا خَيْرٌ لَكَ مِنْ حُمْرِ النَّعَمِ» فَرَأَيتُ أَنْ أَجْمَعَ مُخْتَصَرًا منَ الأحاديثِ الصَّحيحَةِ، مشْتَمِلًا عَلَى مَا يكُونُ طَرِيقًا لِصَاحبهِ إِلى الآخِرَةِ، ومُحَصِّلًا لآدَابِهِ البَاطِنَةِ وَالظَاهِرَةِ. جَامِعًا للترغيب والترهيب وسائر أنواع آداب السالكين: من أحاديث الزهد ورياضات النُّفُوسِ، وتَهْذِيبِ الأَخْلاقِ، وطَهَارَاتِ القُلوبِ وَعِلاجِهَا، وصِيانَةِ الجَوَارحِ وَإِزَالَةِ
اعْوِجَاجِهَا، وغَيرِ ذلِكَ مِنْ مَقَاصِدِ الْعارفِينَ.
وَأَلتَزِمُ فيهِ أَنْ لا أَذْكُرَ إلاّ حَدِيثًا صَحِيحًا مِنَ الْوَاضِحَاتِ، مُضَافًا إِلى الْكُتُبِ الصَّحِيحَةِ الْمَشْهُوراتِ. وأُصَدِّر الأَبْوَابَ مِنَ الْقُرْآنِ الْعَزِيزِ بِآياتٍ كَرِيماتٍ، وَأَوشِّحَ مَا يَحْتَاجُ إِلى ضَبْطٍ أَوْ شَرْحِ مَعْنىً خَفِيٍّ بِنَفَائِسَ مِنَ التَّنْبِيهاتِ. وإِذا قُلْتُ في آخِرِ حَدِيث: مُتَّفَقٌ عَلَيهِ فمعناه: رواه البخاريُّ ومسلمٌ.
وَأَرجُو إنْ تَمَّ هذَا الْكِتَابُ أَنْ يَكُونَ سَائِقًا للمُعْتَنِي بِهِ إِلى الْخَيْرَاتِ حَاجزًا لَهُ عَنْ أنْواعِ الْقَبَائِحِ والْمُهْلِكَاتِ. وأَنَا سَائِلٌ أخًا انْتَفعَ بِشيءٍ مِنْهُ أَنْ يَدْعُوَ لِي ، وَلِوَالِدَيَّ، وَمَشَايخي، وَسَائِرِ أَحْبَابِنَا، وَالمُسْلِمِينَ أجْمَعِينَ. وعَلَى اللهِ الكَريمِ اعْتِمادي، وَإِلَيْهِ تَفْويضي وَاسْتِنَادي، وَحَسبِيَ اللهُ وَنِعْمَ الوَكِيلُ، وَلاَ حَوْلَ وَلاَ قُوَّةَ إِلاَّ بِاللهِ الْعَزِيزِ الْحَكِيمِ.

بسم الله الرحمن الرحيم

1 - باب الإخلاص وإحضار النية في جميع الأعمال والأقوال والأحوال البارزة والخفية
قَالَ اللهُ تَعَالَى: {وَمَا أُمِرُوا إِلاَّ لِيَعْبُدُوا اللَّهَ مُخْلِصِينَ لَهُ الدِّينَ حُنَفَاءَ وَيُقِيمُوا الصَّلاةَ وَيُؤْتُوا الزَّكَاةَ وَذَلِكَ دِينُ الْقَيِّمَةِ} [البينة: 5]، وَقالَ تَعَالَى: {لَنْ يَنَالَ اللَّهَ لُحُومُهَا وَلاَ دِمَاؤُهَا وَلَكِنْ يَنَالُهُ التَّقْوَى مِنْكُمْ} [الحج: 37]، وَقالَ تَعَالَى: {قُلْ إِنْ تُخْفُوا مَا فِي صُدُورِكُمْ أَوْ تُبْدُوهُ يَعْلَمْهُ اللَّهُ} [آل عمران: 29].
1 - وعن أمير المؤمِنين أبي حَفْصٍ عمرَ بنِ الخطابِ بنِ نُفَيْلِ بنِ عبدِ العُزّى بن رياحِ بنِ عبدِ اللهِ بن قُرْطِ بن رَزاحِ بنِ عدِي بنِ كعب (1) بنِ لُؤَيِّ بنِ غالبٍ القُرشِيِّ العَدويِّ - رضي الله عنه - قالَ: سَمِعتُ رَسُولَ اللهِ - صلى الله عليه وسلم - يقُولُ: «إنّمَا الأَعْمَالُ بالنِّيّاتِ، وَإِنَّمَا لِكُلِّ امرِىءٍ مَا نَوَى، فَمَنْ كَانَتْ هجرته إلى الله ورسوله، فهجرته إلى الله ورسوله، ومن كانت هِجْرَتُهُ لِدُنْيَا يُصيبُهَا، أَوْ امْرَأَةٍ يَنْكَحُهَا، فَهِجْرَتُهُ إِلى مَا هَاجَرَ إِلَيْه». مُتَّفَقٌ عَلَى صِحَّتِهِ. رَوَاهُ إمَامَا الْمُحَدّثِينَ، أبُو عَبْدِ الله مُحَمَّدُ بْنُ إسْمَاعيلَ بْن إبراهِيمَ بْن المُغيرَةِ بنِ بَرْدِزْبهْ الجُعْفِيُّ البُخَارِيُّ، وَأَبُو الحُسَيْنِ مُسْلمُ بْنُ الحَجَّاجِ بْنِ مُسْلمٍ الْقُشَيريُّ النَّيْسَابُورِيُّ رضي اللهُ عنهما فِي صحيحيهما اللَّذَيْنِ هما أَصَحُّ الكُتبِ المصنفةِ. (2)

হাদীসের ব্যাখ্যা:

পবিত্র এ হাদীছে চারটি বাক্য আছে। প্রথম বাক্য إِنَّمَا الأَعْمَالُ بِالنِّيَّات (সমস্ত আমল নিয়তের সাথে সম্পর্কযুক্ত)। এ বাক্যটি একটি মূলনীতিস্বরূপ। এতে বলা হয়েছে- প্রতিটি আমলের ভালোমন্দ নিয়তের উপর নির্ভরশীল। নিয়ত ভালো হলে আমলটি ভালো আর নিয়ত মন্দ হলে আমলটি মন্দরূপে গণ্য হবে। কেবল বাহ্যিক রূপ ভালো হওয়াই আমল ভালো হওয়ার জন্য যথেষ্ট নয়। বাহ্যিক রূপ ভালো হওয়া সত্ত্বেও নিয়ত যদি মন্দ হয়, তবে সে আমল ভালো বলে গণ্য হবে না। বরং নিয়ত মন্দ হওয়ার কারণে সেই বাহ্যিক ভালো আমলটিও মন্দ সাব্যস্ত হবে। কথাটি এভাবেও বলা যায় যে, আল্লাহর কাছে কোনও কাজ গ্রহণযোগ্য হওয়া বা না হওয়া ইখলাস ও নিয়তের উপর নির্ভরশীল। কাজটি যদি ইখলাসের সাথে অর্থাৎ আল্লাহ তা'আলার সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে হয়, তবে তা আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য হয়। পক্ষান্তরে উদ্দেশ্য যদি আল্লাহর সন্তুষ্টিলাভ না হয়ে অন্যকিছু হয়, তবে সে আমল আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য হয় না। সুতরাং প্রত্যেকের কর্তব্য সমস্ত আমলেই বিশুদ্ধ নিয়ত ও ইখলাসের প্রতি যত্নবান থাকা।

দ্বিতীয় বাক্য وَإِنَّمَا لِكُلِّ امْرِئٍ مَا نَوَى (প্রত্যেক ব্যক্তি তাই পাবে, যা সে নিয়ত করে) এ বাক্যটি ওই মূলনীতির ফলাফল। বলা হয়েছে- প্রত্যেকে তাই পাবে, যা সে নিয়ত করে। অর্থাৎ কোনও আমল দ্বারা যদি আল্লাহ তা'আলার সন্তুষ্টি কামনা করে, তবে সেই আমল দ্বারা সে আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি লাভ করবে। পক্ষান্তরে যদি উদ্দেশ্য থাকে সুনাম-সুখ্যাতি লাভ করা বা মানুষের সন্তুষ্টি অর্জন করা কিংবা টাকা-পয়সা ও ধন-দৌলত হাসিল করা, তবে ওই আমল দ্বারা সে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করবে না। বাহ্যদৃষ্টিতে সে আমল যতই সুন্দর হোক না কেন, তাতে সে কোনও ছওয়াব পাবে না। এবং আখিরাতে তার বিনিময়ে তার কিছুই অর্জিত হবে না।
অতঃপর হিজরত দ্বারা ভালোমন্দ নিয়তের দৃষ্টান্ত দেওয়া হয়েছে। হিজরত মানে পরিত্যাগ করা। পরিভাষায় দীন ও ঈমান হেফাজতের উদ্দেশ্যে কুফরের দেশ পরিত্যাগ করে ইসলামী দেশে গমন করাকে হিজরত বলা হয়। যে-কোনও মন্দ কাজ পরিত্যাগকেও হিজরত বলে। যে ব্যক্তি হিজরত করে, তাকে বলা হয় মুহাজির। এক হাদীছে আছে- প্রকৃত মুহাজির সেই; যে আল্লাহর নিষিদ্ধ বিষয়াবলী পরিত্যাগ করে চলে। এর মধ্যে শরীআতের সমস্ত আদেশ-নিষেধ এসে যায়। কেননা শরীআতের আদিষ্ট বিষয়াবলী পালন করতে হলে মনের খেয়াল-খুশি পরিত্যাগ করতে হয়। অনুরূপ নিষিদ্ধ বিষয়াবলী থেকে দূরে থাকার জন্যও মনের বিরোধিতা করা অপরিহার্য হয়। সুতরাং ব্যাপক অর্থে হিজরত এমন এক আমল, গোটা শরীআতই যার অন্তর্ভুক্ত। তবে এ হাদীছে হিজরত দ্বারা বিশেষভাবে দেশত্যাগকেই বোঝানো হয়েছে।
তো এই হিজরত এমন এক আমল, নিয়তের ভালোমন্দ দ্বারা যার ভালোমন্দ সাব্যস্ত হয়। উভয় অবস্থায় এর বাহ্যিক রূপ একই থাকে। ফলে বাহ্যিক রূপ দ্বারা এর ভালোমন্দ ও শুদ্ধাশুদ্ধ নির্ণয় করা যায় না।

তৃতীয় বাক্যে বলা হয়েছে فَمَنْ كَانَتْ هِجْرَتُهُ إِلَى اللَّهِ وَرَسُولِهِ فَهِجْرَتُهُ إِلَى اللَّهِ وَرَسُولِهِ "যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের দিকে (অর্থাৎ আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সন্তষ্টির উদ্দেশ্যে) হিজরত করে, (বাস্তবিকপক্ষে) তার হিজরত আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের দিকেই হয়'। অর্থাৎ এ হিজরত দ্বারা সে কেবল এক স্থান থেকে অন্য স্থানে বা মক্কা থেকে মদীনার দিকেই যায় না। সে প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সন্তুষ্টি ও নৈকট্যের দিকেই গমন করে। ফলে তার হিজরত আল্লাহর কাছে কবুল হয় এবং সে এর বিনিময়ে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করে ও আখিরাতে প্রভূত ছওয়াবের অধিকারী হবে। এটা ভালো নিয়তের উদাহরণ।

চতুর্থ বাক্যে বলা হয়েছে- وَمَنْ كَانَتْ هِجْرَتُهُ لِدُنْيَا يُصِيبُهَا أَوِ امْرَأَةٍ يَتَزَوَّجُهَا فَهِجْرَتُهُ إِلَى مَا هَاجَرَ إِلَيْهِ 'যে ব্যক্তি দুনিয়াপ্রাপ্তির জন্য অথবা কোনও নারীকে বিবাহ করার জন্য হিজরত করে, (বাস্তবিকপক্ষে) তার হিজরত সে যার নিয়ত করেছে তার দিকেই (অর্থাৎ দুনিয়া বা নারীকে পাওয়ার জন্যই) হয়েছে বলে গণ্য হবে। এ হিজরত দ্বারা তার স্থান বদল হয় মাত্র, তার অবস্থার কোনও বদল হয় না। সে তুচ্ছ দুনিয়ার ভোগ-আসক্তির মধ্যেই ঘুরপাক খেতে থাকে। আল্লাহর সন্তুষ্টি ও নৈকট্যের দিকে অগ্রসর হতে পারে না। বাহ্যদৃষ্টিতে তাকে মুহাজির বলা হয় বটে, কিন্তু এর বিনিময়ে আল্লাহর কাছে সে কিছুই পাবে না। এটা মন্দ নিয়তের উদাহরণ।
দুনিয়া বলতে ইহজগতের যাবতীয় বিষয়কেই বোঝায়, যেমন অর্থ-সম্পদ, সুনাম- সুখ্যাতি, পদমর্যাদা ইত্যাদি। পুরুষের জন্য নারী এবং নারীর জন্য পুরুষও এর অন্তর্ভুক্ত। এর সবকিছুই ক্ষণস্থায়ী ও ধ্বংসশীল। এর বিপরীতে আখিরাত স্থায়ী ও অনিঃশেষ। কোনও আমল দ্বারা দুনিয়ার কোনও কিছু পাওয়ার কামনা করা একজন ঈমানদারের পক্ষে শোভা পায় না। ঈমানদার ব্যক্তি আখিরাতে বিশ্বাস রাখে। সেই বিশ্বাসের ভিত্তিতেই তার যাবতীয় কাজ সম্পন্ন হওয়া উচিত। পার্থিব উদ্দেশ্যে আমল করলে একে তো আখিরাতের জীবনে কিছুই পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে না, সেই সংগে দুনিয়ার যেই উদ্দেশ্যে করা হয় তা পাওয়ারও কোনো নিশ্চয়তা থাকে না। কেননা প্রকৃত দাতা তো আল্লাহ তাআলাই । দুনিয়াতেও যা-কিছু দেওয়ার তিনিই দিতে পারেন।। কোনও মানুষের কিছু দেওয়ার ক্ষমতা নেই। ফলে যেই আশায় কাজ করা হয়ে থাকে, তা না পাওয়ার সম্ভাবনা যথেষ্ট। বাস্তবে মানুষের কত আশাই না বৃথা চলে যায়। কত প্রচেষ্টা হয় পণ্ডশ্রমে পর্যবসিত। আল্লাহ তাআলা এ সম্পর্কে ইরশাদ করেন-

{مَنْ كَانَ يُرِيدُ الْعَاجِلَةَ عَجَّلْنَا لَهُ فِيهَا مَا نَشَاءُ لِمَنْ نُرِيدُ ثُمَّ جَعَلْنَا لَهُ جَهَنَّمَ يَصْلَاهَا مَذْمُومًا مَدْحُورًا (18) وَمَنْ أَرَادَ الْآخِرَةَ وَسَعَى لَهَا سَعْيَهَا وَهُوَ مُؤْمِنٌ فَأُولَئِكَ كَانَ سَعْيُهُمْ مَشْكُورًا (19)} [الإسراء: 18، 19]

অর্থ : কেউ দুনিয়ার নগদ লাভ কামনা করলে আমি যাকে ইচ্ছা, যতটুকু ইচ্ছা, এখানেই তাকে তা নগদ দিয়ে দেই। তারপর আমি তার জন্য জাহান্নাম রেখে দিয়েছি, যাতে সে লাঞ্ছিত ও বিতাড়িতরূপে প্রবেশ করবে। আর যে ব্যক্তি আখিরাত (-এর লাভ) চায় এবং সেজন্য যথোচিতভাবে চেষ্টা করে, সে যদি মু'মিন হয়, তবে এরূপ লোকের চেষ্টার পরিপূর্ণ মর্যাদা দেওয়া হবে।'
আয়াতের সারকথা, আখিরাতের উদ্দেশ্যে আমল করলে তা পাওয়ার নিশ্চয়তা শতভাগ, কিন্তু দুনিয়ার উদ্দেশ্যে আমল করলে তা পাওয়ার কোনও নিশ্চয়তা নেই। পাওয়া যেতেও পারে, নাও পাওয়া যেতে পারে। পাওয়া গেলেও তা কেবল ততটুকুই, যতটুকু আল্লাহ ইচ্ছা করেন, তার বেশি নয়। সুতরাং এহেন অনিশ্চিত বিষয়ের আশা একজন ঈমানদার ব্যক্তি কেন করবে?
হাদীছের এই চতুর্থ বাক্যে দুনিয়ার বিভিন্ন বিষয়ের মধ্য থেকে বিশেষভাবে নারীর কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এর একটা প্রেক্ষাপট আছে। জনৈক ব্যক্তি উম্মে কায়ছ নামী এক মহিলাকে বিবাহ করার আশায় মদীনায় হিজরত করেছিল। ওই মহিলা শর্ত দিয়েছিল যে, হিজরত করলে তাকে বিবাহ করবে। তো তার এই হিজরত আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে ছিল না, ছিল একজন নারীকে বিবাহ করার উদ্দেশ্যে। তাই তাকে উম্মে কায়ছের মুহাজির বলা হত। এদিকে ইশারা করে বলা হয়েছে, কেউ কোনও মহিলাকে বিবাহ করার উদ্দেশ্যে হিজরত করলে সে প্রকৃত মুহাজির হবে না এবং এর দ্বারা আখিরাতে সে কোনও প্রতিদান পাবে না। ঘটনা যদি এর বিপরীত হয়, অর্থাৎ কোনও পুরুষকে বিবাহ করার জন্য কোনও নারী হিজরত করে, তবে তার ক্ষেত্রেও একই কথা।
হাদীছে বিশেষভাবে নারীপ্রসঙ্গ উত্থাপনের একটা কারণ এও হতে পারে যে, যদিও দুনিয়ার যাবতীয় বিষয়ের প্রতি মানুষের স্বভাবগত আকর্ষণ আছে, কিন্তু তার মধ্যে নারীর প্রতি আকর্ষণ সর্বাপেক্ষা তীব্র, যেমন কুরআন মাজীদে ইরশাদ-

{زُيِّنَ لِلنَّاسِ حُبُّ الشَّهَوَاتِ مِنَ النِّسَاءِ وَالْبَنِينَ وَالْقَنَاطِيرِ الْمُقَنْطَرَةِ مِنَ الذَّهَبِ وَالْفِضَّةِ وَالْخَيْلِ الْمُسَوَّمَةِ وَالْأَنْعَامِ وَالْحَرْثِ ذَلِكَ مَتَاعُ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَاللَّهُ عِنْدَهُ حُسْنُ الْمَآبِ (14)} [آل عمران: 14]

অর্থ : মানুষের জন্য ওই সকল বস্তুর আসক্তিকে মনোরম করা হয়েছে, যা তার প্রবৃত্তির চাহিদা মোতাবেক অর্থাৎ নারী, সন্তান, রাশিকৃত সোনা-রূপা, চিহ্নিত অশ্বরাজি, চতুষ্পদ জন্তু ও ক্ষেত-খামার। এসব ইহজীবনের ভোগ-সামগ্রী। (কিন্তু) স্থায়ী পরিণামের সৌন্দর্য কেবল আল্লাহরই কাছে।
এ আকর্ষণ যেহেতু স্বভাবগত, তাই স্বভাবধর্ম ইসলাম একে নির্মূল করার হুকুম দেয়নি। তা করা মানুষের পক্ষে সম্ভবও নয়। বরং একে নিয়ন্ত্রণ করতে বলা হয়েছে এবং বৈধ পন্থায় এ চাহিদা পূরণ করার ব্যবস্থা দেওয়া হয়েছে। সুতরাং বিবাহের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে-

صحيح البخاري (7/ 3)
قال النبي صلى الله عليه وسلم: «يا معشر الشباب من استطاع منكم الباءة فليتزوج، ومن لم يستطع فعليه بالصوم فإنه له وجاء»

'হে যুব সম্প্রদায়! তোমাদের মধ্যে যার বিবাহ করার সামর্থ্য আছে, সে যেন বিবাহ করে। কেননা এটা চক্ষু সংযত করা ও চরিত্র রক্ষা করার পক্ষে বেশি সহায়ক। আর যার সে সামর্থ্য নেই, সে যেন রোযা রাখে। কেননা রোযা যৌনচাহিদা দমন করে।
তো নারীর প্রতি মানুষের যেহেতু স্বভাবজাত আকর্ষণ রয়েছে, তাই সে আকর্ষণ ব্যক্তির ইবাদত-বন্দেগী ও আমলের নিয়তকে প্রভাবিত করতে পারে। নিয়ত যদি তা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে যায়, তবে আমল মূল্যহীন হয়ে পড়ে। তাই এ হাদীছে এ সম্পর্কে সাবধান করা হয়েছে যে, তোমার হিজরত এবং দীনী কোনও কাজই যেন কোনও নারীর আকর্ষণে অর্থাৎ কোনও নারীকে খুশি করা ও তাকে পাওয়ার জন্য না হয়। সেজন্য হলে তোমার সেই হিজরত ও দীনী কাজ আল্লাহর কাছে গৃহীত হবে না এবং তার বিনিময়ে আল্লাহর কাছে কোনও বদলা পাবে না।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. মানুষের উচিত দীনী কাজ দ্বারা দুনিয়া নয়; বরং আখিরাত ও আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা করা।

খ. হাদীছে যেহেতু আমলকে নিয়তের উপর নির্ভরশীল বলা হয়েছে, সেহেতু কেউ যদি দীনি কাজ দুনিয়ার উদ্দেশ্যে করে, তবে তা প্রকৃতপক্ষে দীনী কাজ থাকে না; দুনিয়াবী কাজ হয়ে যায়, বাহ্যদৃষ্টিতে তাকে যতই দীনী কাজ মনে হোক না কেন।

গ. দুনিয়াবী জায়েয কাজ যেমন পানাহার করা, বেচাকেনা করা, ঘর-সংসার করা ইত্যাদি যদি কেউ আল্লাহ তা'আলার সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে করে, তবে তা নিছক দুনিয়াবী কাজ থাকে না, তা ইবাদতেরও মর্যাদা লাভ করে।

ঘ. বর্জন করাটাও যেহেতু কাজ, যেমন চুরি না করা, মদপান না করা, দর্প না করা, ঝগড়া না করা, কারও মনে আঘাত না দেওয়া ইত্যাদি, সেহেতু এগুলো না করার ক্ষেত্রে যদি আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টির নিয়ত থাকে, তবে এর দ্বারাও ছওয়াব পাওয়া যাবে।

ঙ. নিয়ত দ্বারা ছোট ও তুচ্ছ কাজও বড় ও মহৎ কাজে পরিণত হয়ে যায়। যেমন কারও সংগে হাসি দিয়ে কথা বলা, রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক জিনিস সরিয়ে দেওয়া, আপাতদৃষ্টিতে এগুলো বিশেষ বড় কোনও কাজ নয়, কিন্তু আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টির নিয়তে করলে তাঁর কাছে এসব অনেক মর্যাদাপূর্ণ কাজে পরিণত হয়ে যায়। বিভিন্ন হাদীছ দ্বারা আখিরাতে এসব আমলের অভাবনীয় পুরস্কার লাভের কথা জানা যায়।

চ. নিয়ত দ্বারা একই আমল বহু আমলে পরিণত হতে পারে। যেমন কেউ যদি মসজিদে গমন করে আর জামাতে নামায পড়ার সাথে সাথে এই নিয়তও রাখে যে, সে রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক জিনিস সরিয়ে দেবে, মু'মিনদের দেখা পেলে সালাম দেবে, মু'মিনদের খোঁজখবর নেবে, রুগ্ন ব্যক্তির দেখা পেলে তার সেবা করবে ইত্যাদি, তবে বাস্তবে এসব কাজের অবকাশ না আসলেও কেবল নিয়তের কারণেও সে তার ছওয়াব পাবে। কাজ তো হয়েছে একটি অর্থাৎ মসজিদে গমন, কিন্তু নিয়ত যেহেতু ছিল বহুবিধ, তাই সে বহুবিধ আমলেরই ছওয়াবের অধিকারী হয়ে যাবে।

ছ. নিয়ত একান্তই মনের বিষয়। প্রত্যেকে কেবল তার নিজ মনের অবস্থাই জানে, অন্যের মনে কি আছে তা কেউ জানে না। সুতরাং আমলের ক্ষেত্রে কর্তব্য নিজ নিয়তের তদারকি করা, অন্যের নিয়ত নিয়ে কথা না বলা। অন্যের নিয়ত নিয়ে কুধারণা করা গুনাহ'র কাজ। এর থেকে বিরত থাকা জরুরি।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:বিশুদ্ধ (পারিভাষিক সহীহ)