রিয়াযুস সালিহীন-ইমাম নববী রহঃ
ভূমিকা অধ্যায়
হাদীস নং: ৬৯
ভূমিকা অধ্যায়
তাকওয়ার ব্যাখ্যা, গুরুত্ব ও ফযীলত
তাকওয়া (تقوى) শব্দটির উৎপত্তি وقاية থেকে। وقاية অর্থ: কষ্টদায়ক ও ক্ষতিকর জিনিস হতে কোনও কিছু রক্ষা করা।
তাকওয়া অর্থ কষ্টদায়ক ও ক্ষতিকর জিনিস হতে নিজেকে রক্ষা করা। ক্ষতিকর জিনিস থেকে আত্মরক্ষা করা হয় সে জিনিসের প্রতি ভীতির কারণে। তাই রূপকার্থে ভীতিকেও তাকওয়া বলে, বিশেষত আল্লাহভীতিকে। কেননা আল্লাহর ভয় থাকলেই তাঁর আদেশ-নিষেধ অমান্য করা হতে নিজেকে রক্ষা করা হয়। শরীআতের পরিভাষায় তাকওয়া বলা হয় গুনাহের কাজ থেকে বেঁচে থাকাকে। গুনাহ হয় আল্লাহ যা আদেশ করেছেন তা পালন না করলে এবং যা নিষেধ করেছেন তাতে লিপ্ত হলে। গুনাহ ও পাপাচারে লিপ্ত হলে আল্লাহ তাআলা নারাজ হন। কিয়ামতে তিনি গুনাহগার ব্যক্তিকে জাহান্নামের কঠিন শাস্তি দিবেন। কাজেই গুনাহ ও পাপকর্ম মানুষের পক্ষে সর্বাপেক্ষা ক্ষতিকর বিষয়। এর থেকে বেঁচে থাকা সর্বাপেক্ষা বেশি জরুরি। গুনাহ থেকে বেঁচে থাকা হয় শরীআতের আদেশ-নিষেধ মানার দ্বারা। সুতরাং শরীআতের আদেশ-নিষেধ অনুসরণের মাধ্যমে গুনাহ থেকে বেঁচে থাকারই নাম তাকওয়া। আবু ইয়াযীদ বিসতামী [বায়েজিদ বোস্তামী] রহ. বলেন, যখন কোনও কথা বলা হবে, আল্লাহরই জন্য বলা হবে এবং যখন কোনও কাজ করা হবে, আল্লাহরই জন্য করা হবে- এরই নাম তাকওয়া।
অন্তরে আল্লাহর ভয় থাকলে তাকওয়ার উপর চলা সহজ। নয়তো ব্যাপারটা অত্যন্ত কঠিন। কেননা মানুষের আছে নফস ও কুপ্রবৃত্তি। বাইরে আছে শয়তানের ছলনা। চতুর্দিকে পাপের প্রলোভন। মন তাতে খুব আকৃষ্ট হয়। গুনাহমাত্রই আনন্দদায়ী। তাতে ক্ষণিকের আনন্দ পাওয়া যায়। আল্লাহভীতি ছাড়া তা থেকে বাঁচা খুব কঠিন। তাই ইহজীবনের পদে পদে দরকার অন্তরে আল্লাহভীতি জাগ্রত করা ও সতর্ক হয়ে চলা। একদিন হযরত উমর রাযি. হযরত উবাঈ ইবন কা'ব রাযি.-কে জিজ্ঞেস করেছিলেন, তাকওয়া কী? তিনি বললেন, আপনি কি কখনও এমন পথ দিয়ে চলেছেন, যে পথে শুধু কাঁটা আর কাঁটা? হযরত উমর রাযি. বললেন, হাঁ চলেছি। হযরত উবাঈ রাঃ বললেন, তখন কী করেছেন? তিনি বললেন, কাপড়চোপড় গুটিয়ে ধরেছি এবং খুব সতর্ক হয়ে চলেছি। হযরত উবাঈ রাঃ বললেন, এটাই তাকওয়া।
তাকওয়া অতিবড় এক গুণ। যাবতীয় কল্যাণ এর মধ্যে নিহিত। আগের পরের সকল জাতিকে আল্লাহ তাআলা তাকওয়া অবলম্বনের আদেশ দিয়েছেন। মানুষ যত ভালো গুণ অর্জন করতে পারে, তাকওয়া তার মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ। হযরত আবু উমামা রাঃ বর্ণিত এক হাদীছে আছে, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন- মু'মিন ব্যক্তি তাকওয়া ও আল্লাহভীতির পর নেক স্ত্রীর চেয়ে উত্তম কিছু লাভ করতে পারে না। এর দ্বারা বোঝা যায় মানুষের সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন হল তাকওয়া।
তাকওয়া অবলম্বনের ফল হচ্ছে আল্লাহ তাআলার অসন্তুষ্টি এবং তাঁর আযাব ও গযব থেকে রক্ষা পাওয়া। যে সকল বৈধ কাজ করলে ক্রমান্বয়ে গুনাহে লিপ্ত হয়ে পড়ার আশংকা থাকে, তা থেকে দূরে থাকাও তাকওয়ার অন্তর্ভুক্ত। যে ব্যক্তি তাকওয়া অবলম্বন করে চলে, তাকে মুত্তাকী বলা হয়ে থাকে।
যেহেতু তাকওয়ার মাধ্যমেই গুনাহ থেকে বেঁচে থাকা ও শরীআত অনুযায়ী চলা সম্ভব হয়, তাই ইসলামে এর গুরুত্ব অপরীসীম। কুরআন মাজীদের বহু আয়াতে তাকওয়া অবলম্বন ও আল্লাহভীতির আদেশ দেওয়া হয়েছে। এ সম্পর্কে আছে বহু হাদীছ। ইমাম নববী রহ. এ অধ্যায়ে কয়েকটি আয়াত ও কিছু হাদীছ উল্লেখ করেছেন। নিচে তার অর্থ ও ব্যাখ্যা পেশ করা হচ্ছে।
তাকওয়া সম্পর্কিত আয়াত
এক নং আয়াত
يَأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ حَقَّ تُقَتِهِ
অর্থ : হে মু'মিনগণ! অন্তরে আল্লাহকে সেইভাবে ভয় কর, যেভাবে তাকে ভয় করা উচিত।
ব্যাখ্যা
আল্লাহ তা'আলাকে কেমন ভয় করা উচিত, তার ব্যাখ্যা এক হাদীছে এভাবে বর্ণিত হয়েছে যে, তাঁর আনুগত্য করা হবে, কখনও অবাধ্যতা করা হবে না; তাঁকে স্মরণ করা হবে, কখনও ভোলা হবে না এবং তাঁর কৃতজ্ঞতা আদায় করা হবে, কখনও অকৃতজ্ঞতা করা হবে না।
মুজাহিদ রহ.-এর মতে এর অর্থ আল্লাহর পথে যথার্থভাবে জিহাদ করা এবং এ পথে এমন অবিচলতা ও স্থিতিশীলতা প্রদর্শন করা, যাতে নিন্দুকের নিন্দার কোনও পরওয়া করা না হয়। সেইসংগে সত্য ও ন্যায়ের উপর এমনভাবে প্রতিষ্ঠিত থাকা যে, নিজের পিতামাতা ও সন্তান-সন্তুতির বিপক্ষে গেলেও তা থেকে বিচ্যুত হবে না।
হযরত আনাস রাযি. বলেন, বান্দা যতক্ষণ পর্যন্ত নিজ জিহ্বার পুরোপুরি হেফাজত না করবে, ততক্ষণ পর্যন্ত তাকওয়ার হক আদায় করতে পারবে না।
কেউ বলেন, এ আয়াতে সর্বোচ্চ স্তরের তাকওয়া অবলম্বনের হুকুম দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ বান্দা সমস্ত মাখলুকের মহব্বত থেকে নিজ অন্তকরণকে মুক্ত ও ছিন্ন করে আল্লাহর স্মরণ ও ভালোবাসায় এমনভাবে নিমজ্জিত থাকবে যে, মুহূর্তের জন্যও তা থেকে গাফেল হবে না।
কোনও কোনও বর্ণনা দ্বারা জানা যায়, এ আয়াত নাযিল হলে সাহাবায়ে কিরামের কাছে বিষয়টা একটু কঠিন মনে হয়েছিল। তাই তাঁরা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে আরয করেছিলেন- ইয়া রাসূলাল্লাহ! এটা কার পক্ষে সম্ভব? তখন এই আয়াত নাযিল হয়-
فَاتَّقُوا اللهَ مَا اسْتَطَعْتُمْ
"সুতরাং তোমরা যথাসাধ্য আল্লাহকে ভয় করে চলো।'
তখন তাঁদের অন্তরের ভার লাঘব হয় এবং ব্যাপারটা তাঁদের কাছে সহজসাধ্য মনে হয়।
দুই নং আয়াত
فَاتَّقُوا اللهَ مَا اسْتَطَعْتُمْ
অর্থ : সুতরাং তোমরা যথাসাধ্য আল্লাহকে ভয় করে চলো।
ব্যাখ্যা
এ আয়াত দ্বারা উপরের আয়াতের ব্যাখ্যা করা হয়েছে। বোঝানো হচ্ছে যে, আল্লাহকে যথার্থ ভয় করার এক অর্থ তো মহামহিম আল্লাহর শান মোতাবেক ভয় করা। সেরকম ভয় করা কোনও মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। প্রথম আয়াত দ্বারা সে অর্থ বোঝার অবকাশ ছিল। সেজন্যই সাহাবায়ে কিরাম প্রশ্ন করেছিলেন। এ আয়াতে বলে দেওয়া হয়েছে, আল্লাহকে যেভাবে ভয় করা উচিত সেভাবে ভয় করার মানে আল্লাহর শান মোতাবেক ভয় করা নয়; বরং তোমাদের সাধ্য অনুযায়ী ভয় করা। অর্থাৎ বান্দার পক্ষে আল্লাহকে যতটুকু ভয় করা সম্ভব ততটুকু ভয় করে চলাই যথার্থ তাকওয়া। তার মানে বান্দা নিজসাধ্য মোতাবেক আল্লাহকে ভয় করলে ধরে নেওয়া হবে সে আল্লাহর শান মোতাবেক তাকে ভয় করেছে। এটা বান্দার প্রতি আল্লাহ তাআলার কত বড়ই না মেহেরবানী যে, তিনি দুর্বল বান্দার সীমিত শক্তির তাকওয়াকে তাঁর নিজ শান মোতাবেক তাকওয়া হিসেবে গ্রহণ করে নেন। এজন্য বান্দার উচিত মনেপ্রাণে শোকর আদায় করা। সে শোকর তখনই আদায় হবে, যখন বান্দা আল্লাহ তাআলা যা-কিছু আদেশ করেছেন, নিজ শক্তি-সামর্থ্য অনুযায়ী তা পালন করবে এবং তিনি যা-কিছু নিষেধ করেছেন, নিজ সাধ্য অনুযায়ী তা থেকে বিরত থাকবে। প্রকৃতপক্ষে শরীআতের কোনও হুকুমই সাধ্যের অতীত নয়। বান্দার পক্ষে পালন করা সম্ভব নয় এমন কোনও আদেশ বা নিষেধ তাকে করা হয়নি। ইরশাদ হয়েছে-
لَا يُكَلِّفُ اللَّهُ نَفْسًا إِلَّا وُسْعَهَا
"আল্লাহ কাউকে তার ক্ষমতার বাইরে কোনও হুকুম দেন না।"
অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে-
وَمَا جَعَلَ عَلَيْكُمْ فِي الدِّينِ مِنْ حَرَجٍ
“তিনি দ্বীনের ব্যাপারে তোমাদের প্রতি কোনও সংকীর্ণতা আরোপ করেননি।”
আরও ইরশাদ হয়েছে-
يُرِيدُ اللهُ بِكُمُ الْيُسْرَ وَلَا يُرِيدُ بِكُمُ الْعُسْرَ
"আল্লাহ তোমাদের পক্ষে যা সহজ সেটাই চান, তোমাদের জন্য জটিলতা চান না।"
মোটকথা, শরীআতের প্রতিটি বিধানই এমন, যা বান্দার পক্ষে পালন করা সম্ভব। তা পালন করার ক্ষমতা বান্দার আছে। এবং সহজও বটে। অর্থাৎ তা পালনে বান্দার সর্বশক্তি নিয়োগের দরকার হয় না। স্বাভাবিক শক্তি-ক্ষমতা ব্যবহার দ্বারাই তা পালন করা যায়। নামায, রোযাসহ যে কোনও বিধানের প্রতি দৃষ্টি দিলে বিষয়টা সহজেই বুঝে আসে। তারপর আবার ওযর অজুহাতের প্রতিও লক্ষ রাখা হয়েছে। অর্থাৎ সুস্থকালে কোনও বিধান যেভাবে পালন করতে হয়, ওযর অবস্থায় যে ঠিক সেভাবেই তা পালন করতে হবে এমন বাধ্যবাধকতা ইসলামে নেই। বরং তখন যেভাবে পালন করা সম্ভব সেভাবেই পালন করবে। তাতেই সে সুস্থতাকালে বিধানটি যেভাবে পরিপূর্ণরূপে আদায় করতে পারত, সেভাবে আদায় করার ছওয়াব পেয়ে যাবে। যেমন নামাযের বিষয়টা মনে করুন। ওযরের কারণে যে ব্যক্তি দাড়িয়ে পড়তে পারে না, সে বসে পড়লেও নামাযের বিধান পালনকারীরূপে গণ্য হবে এবং দাঁড়িয়ে পড়ার সমান ছওয়াব পাবে। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত ইমরান ইবনে হুসাইন রাযি.-কে লক্ষ্য করে বলেন, দাঁড়িয়ে নামায পড়বে। যদি তা না পার, বসে পড়বে। আর যদি তাও না পার, তবে শুয়ে পড়বে।
অন্যান্য বিধানসমূহের ব্যাপারও এরকমই। ওযর অবস্থায় যেভাবে পালন করা সম্ভব সেভাবে পালনের সুযোগ রাখা হয়েছে। যদি সেভাবেও পালন করা না হয়, তবে বিধান অমান্যকারী সাব্যস্ত হবে। এ আয়াতে সে কথাই বলা হয়েছে যে, আল্লাহকে ভয় কর তোমাদের পক্ষে যতটুকু সম্ভব। অর্থাৎ শরীআতের যে হুকুম তোমাদের পক্ষে যেভাবে পালন করা সম্ভব, সেভাবে পালন করতে অবহেলা করো না। সেভাবে পালন করলেই ধরে নেওয়া হবে তোমরা আল্লাহকে যথার্থ ভয় করেছ।
তিন নং আয়াত
يأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ وَقُولُوا قَوْلًا سَدِيدًا
অর্থ : 'হে মুমিনগণ! আল্লাহকে ভয় কর এবং সত্য-সঠিক কথা বল।'
ব্যাখ্যা
এ আয়াতে আল্লাহ তাআলা মু'মিনদেরকে দু'টি বিষয়ের আদেশ দিয়েছেন। (ক) তাকওয়া অবলম্বন করা ও (খ) সত্য-সঠিক কথা বলা।
সত্য-সঠিক কথার অর্থ
সত্য-সঠিক কথা বলতে এমন কথাকে বোঝায়, যা বাস্তবসম্মত হয় এবং স্থান-কাল-পাত্র অনুযায়ী হয়। কথা বাস্তবসম্মত না হলে তা মিথ্যা হয়। আর স্থান-কাল-পাত্র অনুযায়ী না হলে তা বাস্তবিকপক্ষে সত্য হলেও ভুল প্রয়োগের ফলে বেঠিক হয়ে যায়। তাই কথা বলার সময় দু'টি বিষয়ই লক্ষণীয়। সতর্ক থাকতে হবে যাতে তা অসত্য ও অবাস্তব কথা না হয় এবং লক্ষ রাখতে হবে যাতে স্থান-কাল-পাত্র মোতাবেক হয়। কুরআন ও হাদীছে স্থান-কাল-পাত্র লক্ষ করে কথা বলার বিশেষ তাকীদ করা হয়েছে। কেননা সেদিকে লক্ষ না রাখলে সত্য কথাও নিষ্ফল হয়ে যায়। বস্তুত প্রত্যেক কথারই একটা উপযুক্ত স্থান থাকে। থাকে উপযুক্ত কাল ও উপযুক্ত পাত্র। সেদিকে লক্ষ না রাখলে কথা কেবল নিষ্ফলই হয় না, অনেক সময় উল্টো ফলও হয়। তাই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিশেষ বিশেষ কথা সাধারণভাবে সকলের সামনে না বলে বিশিষ্ট সাহাবীদেরকেই বলতেন, যাতে তা দ্বারা ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি না হয়। হযরত আলী রাযি. বলেন, মানুষের সাথে কথা বল তাদের আকল-বুদ্ধি অনুপাতে। তোমরা কি চাও আল্লাহ ও তার রাসূলকে অবিশ্বাস করা হোক? অর্থাৎ হাদীছের যে বিষয়টা কোনও ব্যক্তির বোধবুদ্ধির অতীত হয়, তবে সে বিষয়টা তার সামনে না বলাই বাঞ্ছনীয়। কেননা বুঝতে না পারার দরুন সে তা অস্বীকার করে বসবে। তাতে অস্বীকার করা হবে কুরআন ও হাদীছ। এ অস্বীকৃতির দরুন তার যে গুনাহ হবে, তার জন্য বক্তাকেই দায়ী থাকতে হবে। কারণ সে কথাটি বিবেচনাবোধের সাথে বলেনি।
সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ এবং উপদেশ-নসীহত করার ক্ষেত্রে এ বিষয়টা বিশেষভাবে লক্ষ রাখা উচিত। কারও দ্বারা গোপনে একাকী ত্রুটি-বিচ্যুতি হয়ে গেলে তাকে জনসম্মুখে তিরষ্কার করা সমীচীন নয়। কেউ গাড়ি ধরার জন্য ছুটছে, রোগী নিয়ে হাসপাতালে যাচ্ছে বা এরকম অন্য কোনও ব্যস্ততার ভেতর আছে, এ অবস্থায় তাকে উপদেশ দান করা নিতান্তই ভুল। পিতামাতা, গুরুজন ও বিশেষ মর্যাদাপূর্ণ ব্যক্তির দ্বারা ভুল-ত্রুটি হয়ে গেলে সেজন্য তাঁকে শক্ত ভাষায় সতর্ক করা যায় না। বিশেষত পিতামাতার ক্ষেত্রে তো শক্ত ভাষার ব্যবহার কঠিন অপরাধ। তাদের উপদেশদান করতে হয় তাদের মর্যাদা রক্ষা করে এবং তা করতে হয় নম্র-কোমল ভাষায়।
মোটকথা নিজ কথাকে যেমন অশ্লীলতা, পরনিন্দা, গালমন্দ, শিরক, বিদআত, মিথ্যাচার প্রভৃতি থেকে হেফাজত করা জরুরি, তেমনি জরুরি শরীআতসম্মত কথাকে স্থান-কাল-পাত্রের বিবেচনাবোধ ছাড়া যত্রতত্র বলা হতেও বিরত থাকা। এ উভয় শর্ত রক্ষার সাথে যে কথা বলা হবে, সেটাই সত্য-সঠিক কথা এবং এ আয়াতে তাকওয়ার হুকুম দানের পর এরূপ কথা বলারই আদেশ করা হয়েছে।
তাকওয়ার সাথে সত্য-সঠিক কথার সম্পর্ক
প্রশ্ন হতে পারে, তাকওয়ার হুকুম দানের পর বিশেষভাবে সত্য সঠিক কথা বলার হুকুম দেওয়ার কারণ কী? কারণ এই যে, মানুষ তাকওয়া পরিপন্থী কাজ বেশির ভাগ মুখের দ্বারাই করে থাকে। বলা হয়ে থাকে, জিহ্বা আকারে অনেক ছোট কিন্তু সে অপরাধ করে অনেক বড় বড়। এক হাদীছে আছে- "প্রতিদিন মানুষের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ জিহ্বাকে লক্ষ্য করে বলে, তুমি আমাদের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় কর। তুমি সোজা থাকলে আমরাও সোজা থাকব, আর তুমি বেঁকে গেলে আমরাও বেঁকে যাব"। অনেক সময় মুখ কোনও বেফাঁস কথা বলে বসে। আর তার অশুভ পরিণাম থেকে বাঁচার জন্য অন্যসব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকেও ব্যবহার করা হতে থাকে। কিন্তু শেষরক্ষা হয় না। কথাটির জন্য ধরা পড়তে হয় এবং কঠিন শাস্তি ভোগ করতে হয়। কথা বলে কেবল মুখ, কিন্তু তার দায় ভোগ করতে হয় গোটা শরীরকে। এজন্যই কথা বলার ক্ষেত্রে বাড়তি সতর্কতা প্রয়োজন। এজন্যই নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাদীছে বলেন-
مَنْ كَانَ يُؤْمِنُ بِاللهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ فَلْيَقُلْ خَيْرًا أَوْ لِيَصْمُتْ
"যে ব্যক্তি আল্লাহ ও আখিরাতে বিশ্বাস রাখে, সে যেন ভালো কথা বলে, নয়তো চুপ থাকে।”
আরও ইরশাদ হয়েছে-
إنَّ الصَّدَقَ يَهْدِي إلى البروإن البر يَهْدِي إلى الجنة، وإنَّ الرَّجُلَ لَيَصْدُقُ حَتَّى يُكتب عِنْدَ اللهِ صِدِّيقًا، وَإِنَّ الْكَذِبَ يَهْدِي إلى الفُجُوْرِ وَ إِنَّ الْفُجُورَ يَهْدِي إِلَى النَّارِ، وَ إِنَّ الرَّجُل ليكذب حتى يُكتب عِندَ اللهِ كَذَابًا.
"সত্যবাদিতা নেককাজের পথ দেখায়। আর নেককাজ জান্নাতে পৌঁছায়। ব্যক্তি সত্যকথা বলতে থাকে। এমনকি একসময় সে আল্লাহর কাছে 'সিদ্দীক' নামে লিখিত (অভিহিত) হয়। অন্যদিকে মিথ্যাবাদিতা পাপাচারের পথ দেখায়। আর পাপাচার জাহান্নামে পৌঁছায়। ব্যক্তি মিথ্যাচার করতে থাকে। অবশেষে আল্লাহর কাছে সে 'কায্যাব' (মহামিথ্যুক) নামে লিখিত (অভিহিত) হয়।
এ হাদীছ জানাচ্ছে সততা ও সত্যবাদিতা অবলম্বন করে চললে সবরকম নেককাজ করার তাওফীক লাভ হয়। আর মিথ্যাচারে লিপ্ত থাকার পরিণাম হয় যাবতীয় পাপকর্মে জড়িয়ে পড়া। আর তাকওয়া বলা হয় শরীআত মোতাবেক চলা তথা সর্বপ্রকার পাপকর্ম থেকে বিরত থেকে সৎকর্মে মশগুল থাকাকে। তো যে ব্যক্তি তাকওয়ার সাথে জীবনযাপন করতে চাবে, তার কর্তব্য হবে মুখের হেফাজত করা তথা সত্য-সঠিক কথা বলতে সচেষ্ট থাকা। এ কারণেই আয়াতে তাকওয়া অবলম্বনের হুকুম দেওয়ার পর সত্য-সঠিক কথা বলতে আদেশ করা হয়েছে। যেন বলা হয়েছে, তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, বিশেষত কথা বলার ক্ষেত্রে। যখনই কোনও কথা বলবে, আল্লাহর দিকে তাকিয়ে বলবে, যাতে জবানের পুরোপুরি হেফাজত করতে সক্ষম হও এবং সত্য সঠিক কথা বলতে পার।
যে ব্যক্তি তাকওয়া অবলম্বন করবে এবং সত্য সঠিক কথা বলতে সচেষ্ট থাকবে, আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে তার জন্য দু'টি পুরস্কার ঘোষিত হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে—
يُصْلِحْ لَكُمْ أَعْمَالَكُمْ وَيَغْفِرْ لَكُمْ
“তাহলে আল্লাহ তোমাদের কার্যাবলী শুধরে দেবেন এবং তোমাদের পাপরাশি ক্ষমা করবেন।” আহযাব: ৭১
সুবহানাল্লাহ! কত বড় পুরস্কার। আল্লাহ তাআলা কার্যাবলী শুধরে দেবেন অর্থাৎ এতদিন যে সমস্ত ভুল-ত্রুটি করা হত, সেগুলো শোধরানোর তাওফীক দান করবেন। ফলে আর ভুল-ত্রুটি হবে না। যাবতীয় কাজ শরীআত মোতাবেক সম্পন্ন করা যাবে। আর তিনি পাপরাশি মাফ করবেন। অর্থাৎ অতীতে তাকওয়ার পথে না চলার কারণে এবং জবানের হেফাজত না করার কারণে যেসব গুনাহ হয়ে গেছে, তিনি তা মাফ করে দেবেন। সেইসংগে এখনও কোনো পাপকর্ম হয়ে গেলে সে ব্যাপারেও তাওবার তাওফীক দান করবেন। বস্তুত বান্দার পক্ষে আল্লাহর কাছে ক্ষমা পাওয়ার চেয়ে বড় কোনও পুরস্কার হতে পারে না। আল্লাহ তাআলা আমাদের সকলের জীবনের যাবতীয় পাপ ক্ষমা করে দিন - আমীন। -
চার নং আয়াত
وَمَن يَتَّقِ اللَّهَ يَجْعَل لَّهُ مَخْرَجَانَ وَيَرْزُقْهُ مِنْ حَيْثُ لَا يَحْتَسِبُ
অর্থ : যে-কেউ আল্লাহকে ভয় করবে, আল্লাহ তার জন্য সংকট থেকে উত্তরণের কোনও পথ তৈরি করে দেবেন। এবং তাকে এমন স্থান থেকে রিযিক দান করবেন, যা তার ধারণার বাইরে। তালাক ২-৩
ব্যাখ্যা
অর্থাৎ যে ব্যক্তি আল্লাহ তাআলাকে ভয় করে চলে ও জীবনের সব ক্ষেত্রে শরীআতের আদেশ-নিষেধ অনুসরণ করে, আল্লাহ তাআলা তার জীবনযাপন সহজ করে দেন এবং তাকে সকল সংকট থেকে মুক্তি দান করেন। আল্লাহ তাআলা তাঁর মুত্তাকী বান্দাকে বিপদের মধ্যে ফেলে রাখেন না। জীবনের যে ক্ষেত্রেই তার সংকট দেখা দেয়, তাকওয়ার বদৌলতে তা থেকে তাকে মুক্তি দিয়ে দেন। আল্লাহভীরু বান্দার পক্ষে এটা কতই না আশ্বাসবাণী! সে যদি কখনও কোনও বিপদে পড়ে, তবে অস্থির হওয়ার কোনও কারণ নেই। তার কর্তব্য নিজ তাকওয়া ও আল্লাহভীরুতা বজায় রাখা। তাহলে আল্লাহ তা'আলা তাকে সে বিপদ থেকে উদ্ধার করবেনই। হয় বাহ্যিকভাবেই আশুমুক্তি দান করবেন। নয়তো তার অন্তরে হিম্মত ও অবিচলতা দান করবেন। ফলে আখিরাতের ছওয়াবের আশায় সে বিপদে ধৈর্যধারণ করবে এবং অন্তরে স্বস্তিবোধ করবে। এটাও এক প্রকার মুক্তিলাভ। আত্মিক মুক্তিলাভ।
তাকওয়া অবলম্বনের ফায়দা
যারা তাকওয়া অবলম্বন করে তারা যে বিপদ-আপদে আল্লাহ তাআলার সাহায্য পায়, হাদীছ গ্রন্থসমূহে এর বহু উদাহরণ আছে। তাছাড়া বুযুর্গানে দীনের জীবনেও এর বহু নজির আছে। হাদীছ গ্রন্থসমূহে ওই ঘটনা তো প্রসিদ্ধ, যাতে তিন ব্যক্তি একটি পাহাড়ের গুহায় আটকা পড়েছিল। সে অবস্থায় তাদের প্রত্যেকে তাকওয়াভিত্তিক যে আমল করেছিল, তার অছিলায় আল্লাহ তাআলার কাছে দু'আয় লিপ্ত হয়। ফলে আল্লাহ তা'আলা তাদেরকে সে সংকট থেকে মুক্তিদান করেন। অনুরূপ আমরাও যদি আল্লাহ তা'আলাকে ভয় করে চলি, তবে অবশ্যই ভরসা রাখতে পারি যে, তিনি যে-কোনও সংকটে আমাদের সাহায্য করবেন এবং যে-কোনও বিপদে মুক্তিদান করবেন।
এখানে দ্বিতীয় আশ্বাসবাণী শোনানো হয়েছে যে, তাকওয়া অবলম্বন করলে আল্লাহ তাআলা বান্দাকে অকল্পনীয়ভাবে রিযিক দান করবেন। সাধারণত মানুষ জীবিকার ক্ষেত্রে খুবই ত্বরাপ্রবণ। একটু অর্থসংকট হলেই সে সত্য-সঠিক পথ থেকে টলে যায়। সামান্য কষ্টেই হারাম উপার্জনের দিকে ঝুঁকে পড়ে। এমনিভাবে কেউ যদি হারাম উপার্জনে লিপ্ত থাকে, তবে সহজে তা ছাড়তে পারে না। তার ভয় এটা ছেড়ে দিলে উপার্জনের উপায় কী হবে? অপেক্ষায় থাকে, যদি কখনও হালাল উপার্জনের সুযোগ হয় তবে এ হারাম পন্থা ছেড়ে দেবে। এভাবে বছরের পর বছর গড়াতে থাকে। হারাম পন্থা আর পরিত্যাগ করা হয় না। এ আয়াত বলছে, যে ব্যক্তি আল্লাহকে ভয় করে চলবে, আল্লাহ তাআলা তাকে তার ধারণার বাইরে জীবিকা দান করবেন।
সুতরাং ওহে মু'মিন মুত্তাকী! তুমি নিশ্চিত ভরসা রাখতে পার যে, অবৈধ উপার্জন ছেড়ে দিলে তিনি কোনও না কোনও বৈধ উপার্জনের ব্যবস্থা তোমাকে করেই দেবেন। তিনি রায্যাক। সকল সৃষ্টির জীবিকা তিনিই দান করে থাকেন। তুমি তাঁকে ভয় করে অবৈধ পন্থা পরিত্যাগ করবে আর তিনি তোমাকে অনাহারে রাখবেন? কিংবা আল্লাহর ভয়ে তুমি অল্প আয়-রোজগারে ধৈর্যধারণ করবে আর তিনি তোমাকে কষ্টে ফেলে রাখবেন? না, কখনোই নয়। তুমি ধৈর্যধারণ করতে পারলে তিনি তোমার রোজগারে বরকত দান করবেন। তোমার জন্য প্রাচুর্যের দুয়ার খুলে দেবেন। তুমি তাঁর উপর ভরসা রেখে হারাম উপার্জন ছেড়ে দিলে অবশ্যই তোমাকে বৈধ জীবিকা দান করবেন। সুতরাং তাকওয়া অবলম্বন কর। তাঁকে ভয় করে চল। তুমি তোমার কল্পনার বাইরে রিযিক পেয়ে যাবে। তা শীঘ্র হোক বা একটু দেরিতে। তাড়াহুড়া করা চলবে না। বিলম্ব দেখা গেলে তাকে পরীক্ষা মনে করবে। আল্লাহর কাছ থেকে পেতে চাইলে একটু পরীক্ষা তো তিনি করতেই পারেন। সুতরাং আল্লাহর ওয়াদার উপর ভরসা রাখ ও সবর অবলম্বন কর। সবর করলে সে পরীক্ষায়ও তিনি সাহায্য করবেন। অতঃপর দুনিয়ায়ও তোমার অর্থসংকট মোচন হবে এবং আখিরাতেও পাবে মহাপুরস্কার।
পাঁচ নং আয়াত
يَأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِن تَتَّقُوا اللهَ يَجْعَل لَّكُمْ فُرْقَانَا يُكَفِر عَنكُمْ سَيَأْتِكُمْ وَيَغْفِرُ لَكُمْ وَالله لو
الْفَضْلِ الْعَظِيمِ
অর্থ : হে মুমিনগণ! তোমরা যদি আল্লাহর সঙ্গে তাকওয়ার নীতি অবলম্বন কর, তবে তিনি তোমাদেরকে (সত্য ও মিথ্যার মধ্যে) পার্থক্য করার শক্তি দেবেন, তোমাদের পাপ মোচন করবেন এবং তোমাদেরকে ক্ষমা করবেন। আল্লাহ মহা অনুগ্রহের মালিক। আনফাল ২৯
ব্যাখ্যা
তাকওয়া অবলম্বনের তিনটি পুরস্কার
এ আয়াতে তাকওয়ার তিনটি পুরস্কার ঘোষিত হয়েছে।
প্রথম পুরস্কার : তাকওয়া অবলম্বন করলে আল্লাহ তা'আলা সত্য-মিথ্যার মধ্যে পার্থক্য করার শক্তি দান করবেন। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। শয়তানের কুমন্ত্রণা ও নফসের ওয়াসওয়াসার কারণে অনেক সময় মনে সন্দেহ দেখা দেয়। ফলে কোনও কোনও বিষয়ে অন্তরে বিভ্রম সৃষ্টি হয়। বিষয়টা ন্যায় না অন্যায়, বৈধ না অবৈধ এবং হক না বাতিল, তা বুঝতে কষ্ট হয়। ইদানীং সমাজে নানারকমের ফিতনা বিরাজ করছে। একেকজন দীনের একেকরকম ব্যাখ্যা নিয়ে হাজির হচ্ছে। প্রতিষ্ঠিত সত্য সম্পর্কেও বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা হচ্ছে। অনেক লোক তাতে খেই হারিয়ে ফেলে। কী করবে বুঝে উঠতে পারে না। কিন্তু যারা মু'মিন মুত্তাকী, তারা দিশা হারায় না। আল্লাহ তা'আলা তাদের সাহায্য করেন। তিনি তাদের অন্তর্দৃষ্টি খুলে দেন। মনের ওয়াসওয়াসা দূর করে দেন। ফলে কোনটা হক ও কোনটা বাতিল তা সহজেই নির্ণয় করতে সক্ষম হয়।
তাকওয়া অবলম্বন ও আল্লাহভীতি দ্বারা দীনী জ্ঞান বৃদ্ধি পায় ও দীনের বুঝ-সমঝে গভীরতা আসে। যে ব্যক্তি আল্লাহকে ভয় করে না, সে অহরহ পাপকাজে লিপ্ত হয়। পাপকাজ করলে অন্তরে কালো দাগ পড়ে যায়। একপর্যায়ে সম্পূর্ণ অন্তর অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে যায়। সে অন্তরে দীনের বুঝ থাকে না। সে বিচারবুদ্ধি হারিয়ে ফেলে। এরূপ লোক নেককাজ ও বদকাজের পার্থক্য বুঝতে পারে না। তার কাছে হক-নাহক সমান মনে হয়। ফলে নির্বিচারে যে-কোনও কাজে লিপ্ত হয়ে পড়ে। পক্ষান্তরে আল্লাহভীরু লোক পাপকাজ থেকে দূরে থাকে। সে শরীআত মোতাবেক চলার চেষ্টা করে। যতবেশি নেককাজ করে, ততই তার অন্তর আলোকিত হয়। আল্লাহ তা'আলা তার জ্ঞানচক্ষু খুলে দেন। তার দীনের বুঝ বাড়তে থাকে। ফলে তার সামনে হক-বাতিল সুস্পষ্ট হয়ে যায়। এক বর্ণনায় আছে— “যে ব্যক্তি তার জানা বিষয়ে আমল করে, আল্লাহ তা'আলা তাকে ওই সকল বিষয়ের জ্ঞান দান করেন, যা সে জানত না”। এটাও প্রমাণ করে যে, নেক আমল দ্বারা দীনের জ্ঞান বৃদ্ধি পায়। সুতরাং যে ব্যক্তি দীন সম্পর্কে নিজের জ্ঞান ও বুঝ-সমঝ বাড়াতে চায় এবং সকল বিভ্রান্তি থেকে মুক্ত থেকে সহীহ শুদ্ধভাবে দীনের উপর চলার সংকল্প রাখে, তার উচিত তাকওয়া অবলম্বন করা ও সকল ক্ষেত্রে আল্লাহকে ভয় করা।
দ্বিতীয় পুরস্কার : পাপমোচন হওয়া। আগেই বলা হয়েছে তাকওয়া মানে শরীআতের বিধি-নিষেধ মেনে চলা। তো যে ব্যক্তি শরীআতের বিধি-নিষেধ মেনে চলবে, আল্লাহ তাআলা তার গুনাহসমূহ মিটিয়ে দেবেন। যেমন বিভিন্ন হাদীছে আছে, আল্লাহ তাআলা নামায, রোযা প্রভৃতি ইবাদতের দ্বারা বান্দার পাপরাশি মিটিয়ে দেন। কুরআন মাজীদের অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে-
إِنَّ الْحَسَنتِ يُذْهِبْنَ السَّيَاتِ
“নিশ্চয়ই পুণ্যরাজি পাপরাশিকে মিটিয়ে দেয়।”
নেক আমল দ্বারা যেহেতু পাপ মোচন হয়, তাই এ আয়াত দ্বারা বোঝা যায় তাকওয়া অবলম্বন করলে আল্লাহ তা'আলা বেশি বেশি নেক আমলেরও তাওফীক দান করেন। নেক আমলের তাওফীক লাভ করাটা অনেক বড় নিআমত। এর দ্বারা দুনিয়ায় শান্তি ও আখিরাতে মুক্তিলাভ হয়। সুতরাং এ নিআমত লাভের আশায় আমাদের প্রত্যেকের উচিত বেশি পরিমাণে তাকওয়ার গুণ অর্জন করা।
তৃতীয় পুরস্কার : আল্লাহর কাছে ক্ষমা লাভ। অর্থাৎ দুনিয়ায় যে ব্যক্তি তাকওয়া অবলম্বন করবে ও আল্লাহকে ভয় করে চলবে, আখিরাতে আল্লাহ তা'আলা তাকে তার পাপরাশির জন্য পাকড়াও করবেন না। বরং সমুদয় পাপ ক্ষমা করে দিয়ে তাকে জাহান্নাম থেকে রক্ষা করবেন ও জান্নাতে দাখিল করবেন।
আয়াতের শেষে বলা হয়েছে আল্লাহ মহা অনুগ্রহের মালিক। অর্থাৎ তাকওয়া অবলম্বন করলে যে আল্লাহ তা'আলা এ তিনটি পুরস্কার দান করেন, এটা তাঁর পক্ষে কঠিন কিছু নয়। বরং তিনি এত অনুগ্রহশীল যে, চাইলে বান্দাকে দীন-দুনিয়ার অপরিমিত নিআমতে ভরে দিতে পারেন। তাঁর ভাণ্ডারে কোনও কিছুর কমতি নেই। এর দ্বারা বান্দার অন্তরে আশা জাগানো উদ্দেশ্য যে, ওহে বান্দা! তুমি আল্লাহকে ভয় করে চল। তাহলে দীন-দুনিয়ার কোনও সংকট, কোনও অভাব ও কোনও দুঃখ-কষ্ট তোমার থাকবে না। তিনি তাঁর অফুরন্ত ভাণ্ডার থেকে অপরিমিত কল্যাণ তোমাকে দান করবেন।
তাকওয়া (تقوى) শব্দটির উৎপত্তি وقاية থেকে। وقاية অর্থ: কষ্টদায়ক ও ক্ষতিকর জিনিস হতে কোনও কিছু রক্ষা করা।
তাকওয়া অর্থ কষ্টদায়ক ও ক্ষতিকর জিনিস হতে নিজেকে রক্ষা করা। ক্ষতিকর জিনিস থেকে আত্মরক্ষা করা হয় সে জিনিসের প্রতি ভীতির কারণে। তাই রূপকার্থে ভীতিকেও তাকওয়া বলে, বিশেষত আল্লাহভীতিকে। কেননা আল্লাহর ভয় থাকলেই তাঁর আদেশ-নিষেধ অমান্য করা হতে নিজেকে রক্ষা করা হয়। শরীআতের পরিভাষায় তাকওয়া বলা হয় গুনাহের কাজ থেকে বেঁচে থাকাকে। গুনাহ হয় আল্লাহ যা আদেশ করেছেন তা পালন না করলে এবং যা নিষেধ করেছেন তাতে লিপ্ত হলে। গুনাহ ও পাপাচারে লিপ্ত হলে আল্লাহ তাআলা নারাজ হন। কিয়ামতে তিনি গুনাহগার ব্যক্তিকে জাহান্নামের কঠিন শাস্তি দিবেন। কাজেই গুনাহ ও পাপকর্ম মানুষের পক্ষে সর্বাপেক্ষা ক্ষতিকর বিষয়। এর থেকে বেঁচে থাকা সর্বাপেক্ষা বেশি জরুরি। গুনাহ থেকে বেঁচে থাকা হয় শরীআতের আদেশ-নিষেধ মানার দ্বারা। সুতরাং শরীআতের আদেশ-নিষেধ অনুসরণের মাধ্যমে গুনাহ থেকে বেঁচে থাকারই নাম তাকওয়া। আবু ইয়াযীদ বিসতামী [বায়েজিদ বোস্তামী] রহ. বলেন, যখন কোনও কথা বলা হবে, আল্লাহরই জন্য বলা হবে এবং যখন কোনও কাজ করা হবে, আল্লাহরই জন্য করা হবে- এরই নাম তাকওয়া।
অন্তরে আল্লাহর ভয় থাকলে তাকওয়ার উপর চলা সহজ। নয়তো ব্যাপারটা অত্যন্ত কঠিন। কেননা মানুষের আছে নফস ও কুপ্রবৃত্তি। বাইরে আছে শয়তানের ছলনা। চতুর্দিকে পাপের প্রলোভন। মন তাতে খুব আকৃষ্ট হয়। গুনাহমাত্রই আনন্দদায়ী। তাতে ক্ষণিকের আনন্দ পাওয়া যায়। আল্লাহভীতি ছাড়া তা থেকে বাঁচা খুব কঠিন। তাই ইহজীবনের পদে পদে দরকার অন্তরে আল্লাহভীতি জাগ্রত করা ও সতর্ক হয়ে চলা। একদিন হযরত উমর রাযি. হযরত উবাঈ ইবন কা'ব রাযি.-কে জিজ্ঞেস করেছিলেন, তাকওয়া কী? তিনি বললেন, আপনি কি কখনও এমন পথ দিয়ে চলেছেন, যে পথে শুধু কাঁটা আর কাঁটা? হযরত উমর রাযি. বললেন, হাঁ চলেছি। হযরত উবাঈ রাঃ বললেন, তখন কী করেছেন? তিনি বললেন, কাপড়চোপড় গুটিয়ে ধরেছি এবং খুব সতর্ক হয়ে চলেছি। হযরত উবাঈ রাঃ বললেন, এটাই তাকওয়া।
তাকওয়া অতিবড় এক গুণ। যাবতীয় কল্যাণ এর মধ্যে নিহিত। আগের পরের সকল জাতিকে আল্লাহ তাআলা তাকওয়া অবলম্বনের আদেশ দিয়েছেন। মানুষ যত ভালো গুণ অর্জন করতে পারে, তাকওয়া তার মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ। হযরত আবু উমামা রাঃ বর্ণিত এক হাদীছে আছে, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন- মু'মিন ব্যক্তি তাকওয়া ও আল্লাহভীতির পর নেক স্ত্রীর চেয়ে উত্তম কিছু লাভ করতে পারে না। এর দ্বারা বোঝা যায় মানুষের সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন হল তাকওয়া।
তাকওয়া অবলম্বনের ফল হচ্ছে আল্লাহ তাআলার অসন্তুষ্টি এবং তাঁর আযাব ও গযব থেকে রক্ষা পাওয়া। যে সকল বৈধ কাজ করলে ক্রমান্বয়ে গুনাহে লিপ্ত হয়ে পড়ার আশংকা থাকে, তা থেকে দূরে থাকাও তাকওয়ার অন্তর্ভুক্ত। যে ব্যক্তি তাকওয়া অবলম্বন করে চলে, তাকে মুত্তাকী বলা হয়ে থাকে।
যেহেতু তাকওয়ার মাধ্যমেই গুনাহ থেকে বেঁচে থাকা ও শরীআত অনুযায়ী চলা সম্ভব হয়, তাই ইসলামে এর গুরুত্ব অপরীসীম। কুরআন মাজীদের বহু আয়াতে তাকওয়া অবলম্বন ও আল্লাহভীতির আদেশ দেওয়া হয়েছে। এ সম্পর্কে আছে বহু হাদীছ। ইমাম নববী রহ. এ অধ্যায়ে কয়েকটি আয়াত ও কিছু হাদীছ উল্লেখ করেছেন। নিচে তার অর্থ ও ব্যাখ্যা পেশ করা হচ্ছে।
তাকওয়া সম্পর্কিত আয়াত
এক নং আয়াত
يَأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ حَقَّ تُقَتِهِ
অর্থ : হে মু'মিনগণ! অন্তরে আল্লাহকে সেইভাবে ভয় কর, যেভাবে তাকে ভয় করা উচিত।
ব্যাখ্যা
আল্লাহ তা'আলাকে কেমন ভয় করা উচিত, তার ব্যাখ্যা এক হাদীছে এভাবে বর্ণিত হয়েছে যে, তাঁর আনুগত্য করা হবে, কখনও অবাধ্যতা করা হবে না; তাঁকে স্মরণ করা হবে, কখনও ভোলা হবে না এবং তাঁর কৃতজ্ঞতা আদায় করা হবে, কখনও অকৃতজ্ঞতা করা হবে না।
মুজাহিদ রহ.-এর মতে এর অর্থ আল্লাহর পথে যথার্থভাবে জিহাদ করা এবং এ পথে এমন অবিচলতা ও স্থিতিশীলতা প্রদর্শন করা, যাতে নিন্দুকের নিন্দার কোনও পরওয়া করা না হয়। সেইসংগে সত্য ও ন্যায়ের উপর এমনভাবে প্রতিষ্ঠিত থাকা যে, নিজের পিতামাতা ও সন্তান-সন্তুতির বিপক্ষে গেলেও তা থেকে বিচ্যুত হবে না।
হযরত আনাস রাযি. বলেন, বান্দা যতক্ষণ পর্যন্ত নিজ জিহ্বার পুরোপুরি হেফাজত না করবে, ততক্ষণ পর্যন্ত তাকওয়ার হক আদায় করতে পারবে না।
কেউ বলেন, এ আয়াতে সর্বোচ্চ স্তরের তাকওয়া অবলম্বনের হুকুম দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ বান্দা সমস্ত মাখলুকের মহব্বত থেকে নিজ অন্তকরণকে মুক্ত ও ছিন্ন করে আল্লাহর স্মরণ ও ভালোবাসায় এমনভাবে নিমজ্জিত থাকবে যে, মুহূর্তের জন্যও তা থেকে গাফেল হবে না।
কোনও কোনও বর্ণনা দ্বারা জানা যায়, এ আয়াত নাযিল হলে সাহাবায়ে কিরামের কাছে বিষয়টা একটু কঠিন মনে হয়েছিল। তাই তাঁরা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে আরয করেছিলেন- ইয়া রাসূলাল্লাহ! এটা কার পক্ষে সম্ভব? তখন এই আয়াত নাযিল হয়-
فَاتَّقُوا اللهَ مَا اسْتَطَعْتُمْ
"সুতরাং তোমরা যথাসাধ্য আল্লাহকে ভয় করে চলো।'
তখন তাঁদের অন্তরের ভার লাঘব হয় এবং ব্যাপারটা তাঁদের কাছে সহজসাধ্য মনে হয়।
দুই নং আয়াত
فَاتَّقُوا اللهَ مَا اسْتَطَعْتُمْ
অর্থ : সুতরাং তোমরা যথাসাধ্য আল্লাহকে ভয় করে চলো।
ব্যাখ্যা
এ আয়াত দ্বারা উপরের আয়াতের ব্যাখ্যা করা হয়েছে। বোঝানো হচ্ছে যে, আল্লাহকে যথার্থ ভয় করার এক অর্থ তো মহামহিম আল্লাহর শান মোতাবেক ভয় করা। সেরকম ভয় করা কোনও মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। প্রথম আয়াত দ্বারা সে অর্থ বোঝার অবকাশ ছিল। সেজন্যই সাহাবায়ে কিরাম প্রশ্ন করেছিলেন। এ আয়াতে বলে দেওয়া হয়েছে, আল্লাহকে যেভাবে ভয় করা উচিত সেভাবে ভয় করার মানে আল্লাহর শান মোতাবেক ভয় করা নয়; বরং তোমাদের সাধ্য অনুযায়ী ভয় করা। অর্থাৎ বান্দার পক্ষে আল্লাহকে যতটুকু ভয় করা সম্ভব ততটুকু ভয় করে চলাই যথার্থ তাকওয়া। তার মানে বান্দা নিজসাধ্য মোতাবেক আল্লাহকে ভয় করলে ধরে নেওয়া হবে সে আল্লাহর শান মোতাবেক তাকে ভয় করেছে। এটা বান্দার প্রতি আল্লাহ তাআলার কত বড়ই না মেহেরবানী যে, তিনি দুর্বল বান্দার সীমিত শক্তির তাকওয়াকে তাঁর নিজ শান মোতাবেক তাকওয়া হিসেবে গ্রহণ করে নেন। এজন্য বান্দার উচিত মনেপ্রাণে শোকর আদায় করা। সে শোকর তখনই আদায় হবে, যখন বান্দা আল্লাহ তাআলা যা-কিছু আদেশ করেছেন, নিজ শক্তি-সামর্থ্য অনুযায়ী তা পালন করবে এবং তিনি যা-কিছু নিষেধ করেছেন, নিজ সাধ্য অনুযায়ী তা থেকে বিরত থাকবে। প্রকৃতপক্ষে শরীআতের কোনও হুকুমই সাধ্যের অতীত নয়। বান্দার পক্ষে পালন করা সম্ভব নয় এমন কোনও আদেশ বা নিষেধ তাকে করা হয়নি। ইরশাদ হয়েছে-
لَا يُكَلِّفُ اللَّهُ نَفْسًا إِلَّا وُسْعَهَا
"আল্লাহ কাউকে তার ক্ষমতার বাইরে কোনও হুকুম দেন না।"
অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে-
وَمَا جَعَلَ عَلَيْكُمْ فِي الدِّينِ مِنْ حَرَجٍ
“তিনি দ্বীনের ব্যাপারে তোমাদের প্রতি কোনও সংকীর্ণতা আরোপ করেননি।”
আরও ইরশাদ হয়েছে-
يُرِيدُ اللهُ بِكُمُ الْيُسْرَ وَلَا يُرِيدُ بِكُمُ الْعُسْرَ
"আল্লাহ তোমাদের পক্ষে যা সহজ সেটাই চান, তোমাদের জন্য জটিলতা চান না।"
মোটকথা, শরীআতের প্রতিটি বিধানই এমন, যা বান্দার পক্ষে পালন করা সম্ভব। তা পালন করার ক্ষমতা বান্দার আছে। এবং সহজও বটে। অর্থাৎ তা পালনে বান্দার সর্বশক্তি নিয়োগের দরকার হয় না। স্বাভাবিক শক্তি-ক্ষমতা ব্যবহার দ্বারাই তা পালন করা যায়। নামায, রোযাসহ যে কোনও বিধানের প্রতি দৃষ্টি দিলে বিষয়টা সহজেই বুঝে আসে। তারপর আবার ওযর অজুহাতের প্রতিও লক্ষ রাখা হয়েছে। অর্থাৎ সুস্থকালে কোনও বিধান যেভাবে পালন করতে হয়, ওযর অবস্থায় যে ঠিক সেভাবেই তা পালন করতে হবে এমন বাধ্যবাধকতা ইসলামে নেই। বরং তখন যেভাবে পালন করা সম্ভব সেভাবেই পালন করবে। তাতেই সে সুস্থতাকালে বিধানটি যেভাবে পরিপূর্ণরূপে আদায় করতে পারত, সেভাবে আদায় করার ছওয়াব পেয়ে যাবে। যেমন নামাযের বিষয়টা মনে করুন। ওযরের কারণে যে ব্যক্তি দাড়িয়ে পড়তে পারে না, সে বসে পড়লেও নামাযের বিধান পালনকারীরূপে গণ্য হবে এবং দাঁড়িয়ে পড়ার সমান ছওয়াব পাবে। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত ইমরান ইবনে হুসাইন রাযি.-কে লক্ষ্য করে বলেন, দাঁড়িয়ে নামায পড়বে। যদি তা না পার, বসে পড়বে। আর যদি তাও না পার, তবে শুয়ে পড়বে।
অন্যান্য বিধানসমূহের ব্যাপারও এরকমই। ওযর অবস্থায় যেভাবে পালন করা সম্ভব সেভাবে পালনের সুযোগ রাখা হয়েছে। যদি সেভাবেও পালন করা না হয়, তবে বিধান অমান্যকারী সাব্যস্ত হবে। এ আয়াতে সে কথাই বলা হয়েছে যে, আল্লাহকে ভয় কর তোমাদের পক্ষে যতটুকু সম্ভব। অর্থাৎ শরীআতের যে হুকুম তোমাদের পক্ষে যেভাবে পালন করা সম্ভব, সেভাবে পালন করতে অবহেলা করো না। সেভাবে পালন করলেই ধরে নেওয়া হবে তোমরা আল্লাহকে যথার্থ ভয় করেছ।
তিন নং আয়াত
يأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ وَقُولُوا قَوْلًا سَدِيدًا
অর্থ : 'হে মুমিনগণ! আল্লাহকে ভয় কর এবং সত্য-সঠিক কথা বল।'
ব্যাখ্যা
এ আয়াতে আল্লাহ তাআলা মু'মিনদেরকে দু'টি বিষয়ের আদেশ দিয়েছেন। (ক) তাকওয়া অবলম্বন করা ও (খ) সত্য-সঠিক কথা বলা।
সত্য-সঠিক কথার অর্থ
সত্য-সঠিক কথা বলতে এমন কথাকে বোঝায়, যা বাস্তবসম্মত হয় এবং স্থান-কাল-পাত্র অনুযায়ী হয়। কথা বাস্তবসম্মত না হলে তা মিথ্যা হয়। আর স্থান-কাল-পাত্র অনুযায়ী না হলে তা বাস্তবিকপক্ষে সত্য হলেও ভুল প্রয়োগের ফলে বেঠিক হয়ে যায়। তাই কথা বলার সময় দু'টি বিষয়ই লক্ষণীয়। সতর্ক থাকতে হবে যাতে তা অসত্য ও অবাস্তব কথা না হয় এবং লক্ষ রাখতে হবে যাতে স্থান-কাল-পাত্র মোতাবেক হয়। কুরআন ও হাদীছে স্থান-কাল-পাত্র লক্ষ করে কথা বলার বিশেষ তাকীদ করা হয়েছে। কেননা সেদিকে লক্ষ না রাখলে সত্য কথাও নিষ্ফল হয়ে যায়। বস্তুত প্রত্যেক কথারই একটা উপযুক্ত স্থান থাকে। থাকে উপযুক্ত কাল ও উপযুক্ত পাত্র। সেদিকে লক্ষ না রাখলে কথা কেবল নিষ্ফলই হয় না, অনেক সময় উল্টো ফলও হয়। তাই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিশেষ বিশেষ কথা সাধারণভাবে সকলের সামনে না বলে বিশিষ্ট সাহাবীদেরকেই বলতেন, যাতে তা দ্বারা ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি না হয়। হযরত আলী রাযি. বলেন, মানুষের সাথে কথা বল তাদের আকল-বুদ্ধি অনুপাতে। তোমরা কি চাও আল্লাহ ও তার রাসূলকে অবিশ্বাস করা হোক? অর্থাৎ হাদীছের যে বিষয়টা কোনও ব্যক্তির বোধবুদ্ধির অতীত হয়, তবে সে বিষয়টা তার সামনে না বলাই বাঞ্ছনীয়। কেননা বুঝতে না পারার দরুন সে তা অস্বীকার করে বসবে। তাতে অস্বীকার করা হবে কুরআন ও হাদীছ। এ অস্বীকৃতির দরুন তার যে গুনাহ হবে, তার জন্য বক্তাকেই দায়ী থাকতে হবে। কারণ সে কথাটি বিবেচনাবোধের সাথে বলেনি।
সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ এবং উপদেশ-নসীহত করার ক্ষেত্রে এ বিষয়টা বিশেষভাবে লক্ষ রাখা উচিত। কারও দ্বারা গোপনে একাকী ত্রুটি-বিচ্যুতি হয়ে গেলে তাকে জনসম্মুখে তিরষ্কার করা সমীচীন নয়। কেউ গাড়ি ধরার জন্য ছুটছে, রোগী নিয়ে হাসপাতালে যাচ্ছে বা এরকম অন্য কোনও ব্যস্ততার ভেতর আছে, এ অবস্থায় তাকে উপদেশ দান করা নিতান্তই ভুল। পিতামাতা, গুরুজন ও বিশেষ মর্যাদাপূর্ণ ব্যক্তির দ্বারা ভুল-ত্রুটি হয়ে গেলে সেজন্য তাঁকে শক্ত ভাষায় সতর্ক করা যায় না। বিশেষত পিতামাতার ক্ষেত্রে তো শক্ত ভাষার ব্যবহার কঠিন অপরাধ। তাদের উপদেশদান করতে হয় তাদের মর্যাদা রক্ষা করে এবং তা করতে হয় নম্র-কোমল ভাষায়।
মোটকথা নিজ কথাকে যেমন অশ্লীলতা, পরনিন্দা, গালমন্দ, শিরক, বিদআত, মিথ্যাচার প্রভৃতি থেকে হেফাজত করা জরুরি, তেমনি জরুরি শরীআতসম্মত কথাকে স্থান-কাল-পাত্রের বিবেচনাবোধ ছাড়া যত্রতত্র বলা হতেও বিরত থাকা। এ উভয় শর্ত রক্ষার সাথে যে কথা বলা হবে, সেটাই সত্য-সঠিক কথা এবং এ আয়াতে তাকওয়ার হুকুম দানের পর এরূপ কথা বলারই আদেশ করা হয়েছে।
তাকওয়ার সাথে সত্য-সঠিক কথার সম্পর্ক
প্রশ্ন হতে পারে, তাকওয়ার হুকুম দানের পর বিশেষভাবে সত্য সঠিক কথা বলার হুকুম দেওয়ার কারণ কী? কারণ এই যে, মানুষ তাকওয়া পরিপন্থী কাজ বেশির ভাগ মুখের দ্বারাই করে থাকে। বলা হয়ে থাকে, জিহ্বা আকারে অনেক ছোট কিন্তু সে অপরাধ করে অনেক বড় বড়। এক হাদীছে আছে- "প্রতিদিন মানুষের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ জিহ্বাকে লক্ষ্য করে বলে, তুমি আমাদের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় কর। তুমি সোজা থাকলে আমরাও সোজা থাকব, আর তুমি বেঁকে গেলে আমরাও বেঁকে যাব"। অনেক সময় মুখ কোনও বেফাঁস কথা বলে বসে। আর তার অশুভ পরিণাম থেকে বাঁচার জন্য অন্যসব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকেও ব্যবহার করা হতে থাকে। কিন্তু শেষরক্ষা হয় না। কথাটির জন্য ধরা পড়তে হয় এবং কঠিন শাস্তি ভোগ করতে হয়। কথা বলে কেবল মুখ, কিন্তু তার দায় ভোগ করতে হয় গোটা শরীরকে। এজন্যই কথা বলার ক্ষেত্রে বাড়তি সতর্কতা প্রয়োজন। এজন্যই নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাদীছে বলেন-
مَنْ كَانَ يُؤْمِنُ بِاللهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ فَلْيَقُلْ خَيْرًا أَوْ لِيَصْمُتْ
"যে ব্যক্তি আল্লাহ ও আখিরাতে বিশ্বাস রাখে, সে যেন ভালো কথা বলে, নয়তো চুপ থাকে।”
আরও ইরশাদ হয়েছে-
إنَّ الصَّدَقَ يَهْدِي إلى البروإن البر يَهْدِي إلى الجنة، وإنَّ الرَّجُلَ لَيَصْدُقُ حَتَّى يُكتب عِنْدَ اللهِ صِدِّيقًا، وَإِنَّ الْكَذِبَ يَهْدِي إلى الفُجُوْرِ وَ إِنَّ الْفُجُورَ يَهْدِي إِلَى النَّارِ، وَ إِنَّ الرَّجُل ليكذب حتى يُكتب عِندَ اللهِ كَذَابًا.
"সত্যবাদিতা নেককাজের পথ দেখায়। আর নেককাজ জান্নাতে পৌঁছায়। ব্যক্তি সত্যকথা বলতে থাকে। এমনকি একসময় সে আল্লাহর কাছে 'সিদ্দীক' নামে লিখিত (অভিহিত) হয়। অন্যদিকে মিথ্যাবাদিতা পাপাচারের পথ দেখায়। আর পাপাচার জাহান্নামে পৌঁছায়। ব্যক্তি মিথ্যাচার করতে থাকে। অবশেষে আল্লাহর কাছে সে 'কায্যাব' (মহামিথ্যুক) নামে লিখিত (অভিহিত) হয়।
এ হাদীছ জানাচ্ছে সততা ও সত্যবাদিতা অবলম্বন করে চললে সবরকম নেককাজ করার তাওফীক লাভ হয়। আর মিথ্যাচারে লিপ্ত থাকার পরিণাম হয় যাবতীয় পাপকর্মে জড়িয়ে পড়া। আর তাকওয়া বলা হয় শরীআত মোতাবেক চলা তথা সর্বপ্রকার পাপকর্ম থেকে বিরত থেকে সৎকর্মে মশগুল থাকাকে। তো যে ব্যক্তি তাকওয়ার সাথে জীবনযাপন করতে চাবে, তার কর্তব্য হবে মুখের হেফাজত করা তথা সত্য-সঠিক কথা বলতে সচেষ্ট থাকা। এ কারণেই আয়াতে তাকওয়া অবলম্বনের হুকুম দেওয়ার পর সত্য-সঠিক কথা বলতে আদেশ করা হয়েছে। যেন বলা হয়েছে, তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, বিশেষত কথা বলার ক্ষেত্রে। যখনই কোনও কথা বলবে, আল্লাহর দিকে তাকিয়ে বলবে, যাতে জবানের পুরোপুরি হেফাজত করতে সক্ষম হও এবং সত্য সঠিক কথা বলতে পার।
যে ব্যক্তি তাকওয়া অবলম্বন করবে এবং সত্য সঠিক কথা বলতে সচেষ্ট থাকবে, আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে তার জন্য দু'টি পুরস্কার ঘোষিত হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে—
يُصْلِحْ لَكُمْ أَعْمَالَكُمْ وَيَغْفِرْ لَكُمْ
“তাহলে আল্লাহ তোমাদের কার্যাবলী শুধরে দেবেন এবং তোমাদের পাপরাশি ক্ষমা করবেন।” আহযাব: ৭১
সুবহানাল্লাহ! কত বড় পুরস্কার। আল্লাহ তাআলা কার্যাবলী শুধরে দেবেন অর্থাৎ এতদিন যে সমস্ত ভুল-ত্রুটি করা হত, সেগুলো শোধরানোর তাওফীক দান করবেন। ফলে আর ভুল-ত্রুটি হবে না। যাবতীয় কাজ শরীআত মোতাবেক সম্পন্ন করা যাবে। আর তিনি পাপরাশি মাফ করবেন। অর্থাৎ অতীতে তাকওয়ার পথে না চলার কারণে এবং জবানের হেফাজত না করার কারণে যেসব গুনাহ হয়ে গেছে, তিনি তা মাফ করে দেবেন। সেইসংগে এখনও কোনো পাপকর্ম হয়ে গেলে সে ব্যাপারেও তাওবার তাওফীক দান করবেন। বস্তুত বান্দার পক্ষে আল্লাহর কাছে ক্ষমা পাওয়ার চেয়ে বড় কোনও পুরস্কার হতে পারে না। আল্লাহ তাআলা আমাদের সকলের জীবনের যাবতীয় পাপ ক্ষমা করে দিন - আমীন। -
চার নং আয়াত
وَمَن يَتَّقِ اللَّهَ يَجْعَل لَّهُ مَخْرَجَانَ وَيَرْزُقْهُ مِنْ حَيْثُ لَا يَحْتَسِبُ
অর্থ : যে-কেউ আল্লাহকে ভয় করবে, আল্লাহ তার জন্য সংকট থেকে উত্তরণের কোনও পথ তৈরি করে দেবেন। এবং তাকে এমন স্থান থেকে রিযিক দান করবেন, যা তার ধারণার বাইরে। তালাক ২-৩
ব্যাখ্যা
অর্থাৎ যে ব্যক্তি আল্লাহ তাআলাকে ভয় করে চলে ও জীবনের সব ক্ষেত্রে শরীআতের আদেশ-নিষেধ অনুসরণ করে, আল্লাহ তাআলা তার জীবনযাপন সহজ করে দেন এবং তাকে সকল সংকট থেকে মুক্তি দান করেন। আল্লাহ তাআলা তাঁর মুত্তাকী বান্দাকে বিপদের মধ্যে ফেলে রাখেন না। জীবনের যে ক্ষেত্রেই তার সংকট দেখা দেয়, তাকওয়ার বদৌলতে তা থেকে তাকে মুক্তি দিয়ে দেন। আল্লাহভীরু বান্দার পক্ষে এটা কতই না আশ্বাসবাণী! সে যদি কখনও কোনও বিপদে পড়ে, তবে অস্থির হওয়ার কোনও কারণ নেই। তার কর্তব্য নিজ তাকওয়া ও আল্লাহভীরুতা বজায় রাখা। তাহলে আল্লাহ তা'আলা তাকে সে বিপদ থেকে উদ্ধার করবেনই। হয় বাহ্যিকভাবেই আশুমুক্তি দান করবেন। নয়তো তার অন্তরে হিম্মত ও অবিচলতা দান করবেন। ফলে আখিরাতের ছওয়াবের আশায় সে বিপদে ধৈর্যধারণ করবে এবং অন্তরে স্বস্তিবোধ করবে। এটাও এক প্রকার মুক্তিলাভ। আত্মিক মুক্তিলাভ।
তাকওয়া অবলম্বনের ফায়দা
যারা তাকওয়া অবলম্বন করে তারা যে বিপদ-আপদে আল্লাহ তাআলার সাহায্য পায়, হাদীছ গ্রন্থসমূহে এর বহু উদাহরণ আছে। তাছাড়া বুযুর্গানে দীনের জীবনেও এর বহু নজির আছে। হাদীছ গ্রন্থসমূহে ওই ঘটনা তো প্রসিদ্ধ, যাতে তিন ব্যক্তি একটি পাহাড়ের গুহায় আটকা পড়েছিল। সে অবস্থায় তাদের প্রত্যেকে তাকওয়াভিত্তিক যে আমল করেছিল, তার অছিলায় আল্লাহ তাআলার কাছে দু'আয় লিপ্ত হয়। ফলে আল্লাহ তা'আলা তাদেরকে সে সংকট থেকে মুক্তিদান করেন। অনুরূপ আমরাও যদি আল্লাহ তা'আলাকে ভয় করে চলি, তবে অবশ্যই ভরসা রাখতে পারি যে, তিনি যে-কোনও সংকটে আমাদের সাহায্য করবেন এবং যে-কোনও বিপদে মুক্তিদান করবেন।
এখানে দ্বিতীয় আশ্বাসবাণী শোনানো হয়েছে যে, তাকওয়া অবলম্বন করলে আল্লাহ তাআলা বান্দাকে অকল্পনীয়ভাবে রিযিক দান করবেন। সাধারণত মানুষ জীবিকার ক্ষেত্রে খুবই ত্বরাপ্রবণ। একটু অর্থসংকট হলেই সে সত্য-সঠিক পথ থেকে টলে যায়। সামান্য কষ্টেই হারাম উপার্জনের দিকে ঝুঁকে পড়ে। এমনিভাবে কেউ যদি হারাম উপার্জনে লিপ্ত থাকে, তবে সহজে তা ছাড়তে পারে না। তার ভয় এটা ছেড়ে দিলে উপার্জনের উপায় কী হবে? অপেক্ষায় থাকে, যদি কখনও হালাল উপার্জনের সুযোগ হয় তবে এ হারাম পন্থা ছেড়ে দেবে। এভাবে বছরের পর বছর গড়াতে থাকে। হারাম পন্থা আর পরিত্যাগ করা হয় না। এ আয়াত বলছে, যে ব্যক্তি আল্লাহকে ভয় করে চলবে, আল্লাহ তাআলা তাকে তার ধারণার বাইরে জীবিকা দান করবেন।
সুতরাং ওহে মু'মিন মুত্তাকী! তুমি নিশ্চিত ভরসা রাখতে পার যে, অবৈধ উপার্জন ছেড়ে দিলে তিনি কোনও না কোনও বৈধ উপার্জনের ব্যবস্থা তোমাকে করেই দেবেন। তিনি রায্যাক। সকল সৃষ্টির জীবিকা তিনিই দান করে থাকেন। তুমি তাঁকে ভয় করে অবৈধ পন্থা পরিত্যাগ করবে আর তিনি তোমাকে অনাহারে রাখবেন? কিংবা আল্লাহর ভয়ে তুমি অল্প আয়-রোজগারে ধৈর্যধারণ করবে আর তিনি তোমাকে কষ্টে ফেলে রাখবেন? না, কখনোই নয়। তুমি ধৈর্যধারণ করতে পারলে তিনি তোমার রোজগারে বরকত দান করবেন। তোমার জন্য প্রাচুর্যের দুয়ার খুলে দেবেন। তুমি তাঁর উপর ভরসা রেখে হারাম উপার্জন ছেড়ে দিলে অবশ্যই তোমাকে বৈধ জীবিকা দান করবেন। সুতরাং তাকওয়া অবলম্বন কর। তাঁকে ভয় করে চল। তুমি তোমার কল্পনার বাইরে রিযিক পেয়ে যাবে। তা শীঘ্র হোক বা একটু দেরিতে। তাড়াহুড়া করা চলবে না। বিলম্ব দেখা গেলে তাকে পরীক্ষা মনে করবে। আল্লাহর কাছ থেকে পেতে চাইলে একটু পরীক্ষা তো তিনি করতেই পারেন। সুতরাং আল্লাহর ওয়াদার উপর ভরসা রাখ ও সবর অবলম্বন কর। সবর করলে সে পরীক্ষায়ও তিনি সাহায্য করবেন। অতঃপর দুনিয়ায়ও তোমার অর্থসংকট মোচন হবে এবং আখিরাতেও পাবে মহাপুরস্কার।
পাঁচ নং আয়াত
يَأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِن تَتَّقُوا اللهَ يَجْعَل لَّكُمْ فُرْقَانَا يُكَفِر عَنكُمْ سَيَأْتِكُمْ وَيَغْفِرُ لَكُمْ وَالله لو
الْفَضْلِ الْعَظِيمِ
অর্থ : হে মুমিনগণ! তোমরা যদি আল্লাহর সঙ্গে তাকওয়ার নীতি অবলম্বন কর, তবে তিনি তোমাদেরকে (সত্য ও মিথ্যার মধ্যে) পার্থক্য করার শক্তি দেবেন, তোমাদের পাপ মোচন করবেন এবং তোমাদেরকে ক্ষমা করবেন। আল্লাহ মহা অনুগ্রহের মালিক। আনফাল ২৯
ব্যাখ্যা
তাকওয়া অবলম্বনের তিনটি পুরস্কার
এ আয়াতে তাকওয়ার তিনটি পুরস্কার ঘোষিত হয়েছে।
প্রথম পুরস্কার : তাকওয়া অবলম্বন করলে আল্লাহ তা'আলা সত্য-মিথ্যার মধ্যে পার্থক্য করার শক্তি দান করবেন। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। শয়তানের কুমন্ত্রণা ও নফসের ওয়াসওয়াসার কারণে অনেক সময় মনে সন্দেহ দেখা দেয়। ফলে কোনও কোনও বিষয়ে অন্তরে বিভ্রম সৃষ্টি হয়। বিষয়টা ন্যায় না অন্যায়, বৈধ না অবৈধ এবং হক না বাতিল, তা বুঝতে কষ্ট হয়। ইদানীং সমাজে নানারকমের ফিতনা বিরাজ করছে। একেকজন দীনের একেকরকম ব্যাখ্যা নিয়ে হাজির হচ্ছে। প্রতিষ্ঠিত সত্য সম্পর্কেও বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা হচ্ছে। অনেক লোক তাতে খেই হারিয়ে ফেলে। কী করবে বুঝে উঠতে পারে না। কিন্তু যারা মু'মিন মুত্তাকী, তারা দিশা হারায় না। আল্লাহ তা'আলা তাদের সাহায্য করেন। তিনি তাদের অন্তর্দৃষ্টি খুলে দেন। মনের ওয়াসওয়াসা দূর করে দেন। ফলে কোনটা হক ও কোনটা বাতিল তা সহজেই নির্ণয় করতে সক্ষম হয়।
তাকওয়া অবলম্বন ও আল্লাহভীতি দ্বারা দীনী জ্ঞান বৃদ্ধি পায় ও দীনের বুঝ-সমঝে গভীরতা আসে। যে ব্যক্তি আল্লাহকে ভয় করে না, সে অহরহ পাপকাজে লিপ্ত হয়। পাপকাজ করলে অন্তরে কালো দাগ পড়ে যায়। একপর্যায়ে সম্পূর্ণ অন্তর অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে যায়। সে অন্তরে দীনের বুঝ থাকে না। সে বিচারবুদ্ধি হারিয়ে ফেলে। এরূপ লোক নেককাজ ও বদকাজের পার্থক্য বুঝতে পারে না। তার কাছে হক-নাহক সমান মনে হয়। ফলে নির্বিচারে যে-কোনও কাজে লিপ্ত হয়ে পড়ে। পক্ষান্তরে আল্লাহভীরু লোক পাপকাজ থেকে দূরে থাকে। সে শরীআত মোতাবেক চলার চেষ্টা করে। যতবেশি নেককাজ করে, ততই তার অন্তর আলোকিত হয়। আল্লাহ তা'আলা তার জ্ঞানচক্ষু খুলে দেন। তার দীনের বুঝ বাড়তে থাকে। ফলে তার সামনে হক-বাতিল সুস্পষ্ট হয়ে যায়। এক বর্ণনায় আছে— “যে ব্যক্তি তার জানা বিষয়ে আমল করে, আল্লাহ তা'আলা তাকে ওই সকল বিষয়ের জ্ঞান দান করেন, যা সে জানত না”। এটাও প্রমাণ করে যে, নেক আমল দ্বারা দীনের জ্ঞান বৃদ্ধি পায়। সুতরাং যে ব্যক্তি দীন সম্পর্কে নিজের জ্ঞান ও বুঝ-সমঝ বাড়াতে চায় এবং সকল বিভ্রান্তি থেকে মুক্ত থেকে সহীহ শুদ্ধভাবে দীনের উপর চলার সংকল্প রাখে, তার উচিত তাকওয়া অবলম্বন করা ও সকল ক্ষেত্রে আল্লাহকে ভয় করা।
দ্বিতীয় পুরস্কার : পাপমোচন হওয়া। আগেই বলা হয়েছে তাকওয়া মানে শরীআতের বিধি-নিষেধ মেনে চলা। তো যে ব্যক্তি শরীআতের বিধি-নিষেধ মেনে চলবে, আল্লাহ তাআলা তার গুনাহসমূহ মিটিয়ে দেবেন। যেমন বিভিন্ন হাদীছে আছে, আল্লাহ তাআলা নামায, রোযা প্রভৃতি ইবাদতের দ্বারা বান্দার পাপরাশি মিটিয়ে দেন। কুরআন মাজীদের অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে-
إِنَّ الْحَسَنتِ يُذْهِبْنَ السَّيَاتِ
“নিশ্চয়ই পুণ্যরাজি পাপরাশিকে মিটিয়ে দেয়।”
নেক আমল দ্বারা যেহেতু পাপ মোচন হয়, তাই এ আয়াত দ্বারা বোঝা যায় তাকওয়া অবলম্বন করলে আল্লাহ তা'আলা বেশি বেশি নেক আমলেরও তাওফীক দান করেন। নেক আমলের তাওফীক লাভ করাটা অনেক বড় নিআমত। এর দ্বারা দুনিয়ায় শান্তি ও আখিরাতে মুক্তিলাভ হয়। সুতরাং এ নিআমত লাভের আশায় আমাদের প্রত্যেকের উচিত বেশি পরিমাণে তাকওয়ার গুণ অর্জন করা।
তৃতীয় পুরস্কার : আল্লাহর কাছে ক্ষমা লাভ। অর্থাৎ দুনিয়ায় যে ব্যক্তি তাকওয়া অবলম্বন করবে ও আল্লাহকে ভয় করে চলবে, আখিরাতে আল্লাহ তা'আলা তাকে তার পাপরাশির জন্য পাকড়াও করবেন না। বরং সমুদয় পাপ ক্ষমা করে দিয়ে তাকে জাহান্নাম থেকে রক্ষা করবেন ও জান্নাতে দাখিল করবেন।
আয়াতের শেষে বলা হয়েছে আল্লাহ মহা অনুগ্রহের মালিক। অর্থাৎ তাকওয়া অবলম্বন করলে যে আল্লাহ তা'আলা এ তিনটি পুরস্কার দান করেন, এটা তাঁর পক্ষে কঠিন কিছু নয়। বরং তিনি এত অনুগ্রহশীল যে, চাইলে বান্দাকে দীন-দুনিয়ার অপরিমিত নিআমতে ভরে দিতে পারেন। তাঁর ভাণ্ডারে কোনও কিছুর কমতি নেই। এর দ্বারা বান্দার অন্তরে আশা জাগানো উদ্দেশ্য যে, ওহে বান্দা! তুমি আল্লাহকে ভয় করে চল। তাহলে দীন-দুনিয়ার কোনও সংকট, কোনও অভাব ও কোনও দুঃখ-কষ্ট তোমার থাকবে না। তিনি তাঁর অফুরন্ত ভাণ্ডার থেকে অপরিমিত কল্যাণ তোমাকে দান করবেন।
৬৯। তাকওয়া সম্পর্কিত হাদীছসমূহ;
কে সর্বাপেক্ষা বেশি মর্যাদাবান:
হযরত আবু হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করা হল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! মানুষের মধ্যে সর্বাপেক্ষা বেশি মর্যাদাবান কে? তিনি বললেন, তাদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা মর্যাদাবান সে ব্যক্তি, যে বেশি মুত্তাকী। সাহাবীগণ বললেন, আমরা আপনাকে এ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করিনি। তিনি বললেন, তবে আল্লাহর নবী ইউসুফ, যিনি আল্লাহর নবী (হযরত ইয়াকুব আলাইহিস সালাম)-এর পুত্র, তিনি আল্লাহর নবী (হযরত ইসহাক আলাইহিস সালাম)- এর পুত্র এবং তিনি খলীলুল্লাহ (হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম)-এর পুত্র। তারা বললেন, আমরা আপনাকে এ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করিনি। তিনি বললেন, তবে কি তোমরা আমাকে আরব গোত্রসমূহ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করছ? তাদের মধ্যে যারা জাহিলী যুগে শ্রেষ্ঠ ছিল ইসলামেও তারাই শ্রেষ্ঠ, যদি দীনের জ্ঞান-সমঝ হাসিল করে - বুখারী ও মুসলিম । (বুখারী শরীফ হাদীস নং ৩৩৫৩, মুসলিম শরীফ হাদীস নং ২৩৭৮)
কে সর্বাপেক্ষা বেশি মর্যাদাবান:
হযরত আবু হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করা হল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! মানুষের মধ্যে সর্বাপেক্ষা বেশি মর্যাদাবান কে? তিনি বললেন, তাদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা মর্যাদাবান সে ব্যক্তি, যে বেশি মুত্তাকী। সাহাবীগণ বললেন, আমরা আপনাকে এ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করিনি। তিনি বললেন, তবে আল্লাহর নবী ইউসুফ, যিনি আল্লাহর নবী (হযরত ইয়াকুব আলাইহিস সালাম)-এর পুত্র, তিনি আল্লাহর নবী (হযরত ইসহাক আলাইহিস সালাম)- এর পুত্র এবং তিনি খলীলুল্লাহ (হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম)-এর পুত্র। তারা বললেন, আমরা আপনাকে এ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করিনি। তিনি বললেন, তবে কি তোমরা আমাকে আরব গোত্রসমূহ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করছ? তাদের মধ্যে যারা জাহিলী যুগে শ্রেষ্ঠ ছিল ইসলামেও তারাই শ্রেষ্ঠ, যদি দীনের জ্ঞান-সমঝ হাসিল করে - বুখারী ও মুসলিম । (বুখারী শরীফ হাদীস নং ৩৩৫৩, মুসলিম শরীফ হাদীস নং ২৩৭৮)
مقدمة الامام النووي
6 - باب في التقوى
69 - فالأول: عن أبي هريرةَ - رضي الله عنه - قَالَ: قِيلَ: يَا رسولَ الله، مَنْ أكرمُ النَّاس؟ قَالَ: «أَتْقَاهُمْ (1)». فقالوا: لَيْسَ عن هَذَا نسألُكَ، قَالَ: «فَيُوسُفُ نَبِيُّ اللهِ [ص:43] ابنُ نَبِيِّ اللهِ ابنِ نَبيِّ اللهِ ابنِ خليلِ اللهِ» (2) قالوا: لَيْسَ عن هَذَا نسألُكَ، قَالَ: «فَعَنْ مَعَادِنِ العَرَبِ (3) تَسْأَلوني؟ خِيَارُهُمْ في الجَاهِليَّةِ خِيَارُهُمْ في الإِسْلامِ إِذَا فقُهُوا». مُتَّفَقٌ عَلَيهِ. (4)
و «فَقُهُوا» بِضم القافِ عَلَى المشهورِ وَحُكِيَ كَسْرُها: أيْ عَلِمُوا أحْكَامَ الشَّرْعِ.
و «فَقُهُوا» بِضم القافِ عَلَى المشهورِ وَحُكِيَ كَسْرُها: أيْ عَلِمُوا أحْكَامَ الشَّرْعِ.
হাদীসের ব্যাখ্যা:
এ হাদীছ দ্বারা তাকওয়ার গুরুত্ব ও মর্যাদা বোঝা যায়। যখন সাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেন, মানুষের মধ্যে সবচে' বেশি মর্যাদাবান কে? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাধারণভাবে বললেন, যে ব্যক্তি সবচে' বেশি মুত্তাকী। অর্থাৎ যে ব্যক্তি আল্লাহ তা'আলাকে সবচে' বেশি ভয় করে চলে, আল্লাহর কাছে তার মর্যাদা সবচে বেশি। কেননা যে ব্যক্তি আল্লাহকে সবচে' বেশি ভয় করে, সে শরী'আতের অনুসরণ ও বেশি করে। সে সর্বপ্রকার পাপকর্ম থেকে দূরে থাকে এবং বেশি বেশি নেককাজ করতে সচেষ্ট থাকে। ফলে তার পুণ্য ও ছওয়াবও বেশি অর্জিত হয় এবং আল্লাহ ও বেশি নৈকট্য লাভ হয়। এরূপ ব্যক্তির জন্য আখিরাতে উচ্চ মর্যাদা তো রয়েছেই, দুনিয়ায়ও তারা নেককারদের দৃষ্টিতে বেশি মর্যাদাবান হয়ে থাকে। এ ব্যাপারে সাদা কালো, ধনী-গরীব, আরব-অনারব ও বংশ-গোত্রের কোনও পার্থক্য নেই। এ হাদীছে সেরকম কোনও পার্থক্য করা হয়নি। মানুষ যে রঙেরই হোক, যে দেশেরই হোক, যে গোত্রেরই হোক এবং সে যত গরীবই হোক না কেন, তার মধ্যে যদি তাকওয়া ও আল্লাহভীতি থাকে, ফলে শরী'আত মোতাবেক জীবনযাপন করে, তবে আল্লাহ তা'আলার কাছে তার জন্য রয়েছে অনেক উচ্চমর্যাদা। হাঁ, দুনিয়ার অর্থবিত্ত ও প্রভাব প্রতিপত্তিই যাদের দৃষ্টিতে সবকিছু, তাদের কাছে হয়তো এরূপ লোকের বিশেষ মর্যাদা নেই। তাতে কিছু যায় আসে না। এটা তাদের বিকৃত চিন্তা-চেতনার ফল। যাদের চিন্তা চেতনা দীনের রঙে রঞ্জিত, তারা মুত্তাকীদেরকেই সর্বাধিক মর্যাদা দিয়ে থাকে, যেহেতু আল্লাহ তা'আলার কাছে তারা বেশি মর্যাদাবান। কুরআন মাজীদেও সাধারণভাবে সকলের জন্য ইরশাদ হয়েছে
إِنَّ أَكْرَمَكُمْ عِنْدَ اللَّهِ أَتْقَاكُمْ
‘আল্লাহর কাছে তোমাদের মধ্যে সবচে' বেশি মর্যাদাবান সেই ব্যক্তি, যে বেশি আল্লাহভীরু।
তারপর সাহাবায়ে কিরাম যখন বললেন- আমরা এ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করিনি, অর্থাৎ যে মর্যাদার ভিত্তি নেককাজ আমাদের জিজ্ঞাসা সে সম্পর্কে নয়, তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম মনে করলেন, তারা বংশ-গোত্রভিত্তিক মর্যাদা সম্পর্কে জানতে চাচ্ছে। সুতরাং তিনি বললেন, হযরত ইউসুফ আলাইহিস-সালাম। কেননা ইউসুফ আলাইহিস-সালাম নবুওয়াতী মর্যাদার সাথে সাথে বংশীয় মর্যাদার অধিকারী ছিলেন। পিতা, পিতামহ ও প্রপিতামহ তিনজনই নবী ছিলেন। তিনি চতুর্থ পুরুষ হিসেবে নিজেও নবী। এভাবে হযরত ইউসুফ আলাইহিস-সালাম বাপ-দাদার সিলসিলায় পরপর চারজন নবীর চতুর্থতম নবী। হযরত ইউসুফ আলাইহিস-সালামের আগে ও পরে কখনও এরূপ পাওয়া যায়নি। এটা কেবল তাঁরই বিশেষত্ব। তাঁর বাড়তি বিশেষত্ব ছিল নবুওয়াতের সাথে রাজত্বের অধিকারী হওয়া। তিনি মিশরের রাজক্ষমতা লাভ করেছিলেন। আরও একটি বৈশিষ্ট্য স্বপ্নের তা'বীর। স্বপ্নব্যাখ্যার বিশেষ জ্ঞান আল্লাহ তা'আলা তাঁকে দান করেছিলেন।
প্রকাশ থাকে যে, এতসব বিশেষত্ব থাকার দ্বারা অন্য সকল নবীর উপর হযরত ইউসুফ আলাইহিস-সালামের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণিত হয় না। কেননা এগুলো শাখাগত বিশেষত্ব। মূল নবুওয়াত ও রিসালাতের মর্যাদায় আল্লাহ তা'আলা আম্বিয়া আলাইহিমুস-সালামের মধ্যে যে পার্থক্য করেছেন তাতে হযরত ইবরাহীম আলাইহিস-সালাম, হযরত মুসা আলাইহিস-সালাম প্রমুখের মর্যাদা অনেক উপরে। সাধারণভাবে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ নবী হলেন খাতামুল আম্বিয়া ওয়া সায়্যিদুল মুরসালীন হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম।
কিন্তু সাহাবায়ে কিরামের জিজ্ঞাসা ছিল মূলত আরব গোত্রসমূহ সম্পর্কে। নদী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন তা বুঝতে পারলেন, তখন বললেন- বংশ, গোত্রের দিক থেকে ইসলামেও তারাই শ্রেষ্ঠ, যারা জহিলী যুগে শ্রেষ্ঠ ছিল। তবে একটা শর্ত রয়েছে। শর্তটি হল দীনের জ্ঞান-বুঝ থাকা। যারা দীনের জ্ঞান-বুঝ হাসিল করেছে, প্রকৃত শ্রেষ্ঠত্ব তাদেরই। জাহিলী যুগে যদি তারা শ্রেষ্ঠ হয়ে থাকে, তবে ইসলামে তারা অধিকতর শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী হবে। কেননা জাহিলী যুগে যে সমস্ত সদগুণের কারণে তারা অন্যদের ছাড়িয়ে গিয়েছিল, যেমন সাহসিকতা, অতিথিপরায়ণতা, প্রতিশ্রুতি রক্ষা, সত্যবাদিতা ইত্যাদি, ইসলামেও সেগুলোর বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। তো যখন এসব সদগুণ আগে থেকেই তাদের মধ্যে বিদ্যমান রয়েছে, সেইসংগে দীনের ইলম ও অনুসরণের বাড়তি মহিমাও অর্জন হয়ে গেল, তখন স্বাভাবিকভাবেই তারা ইসলামেও অন্যান্যদের থেকে এগিয়ে থাকবে। বাস্তব ইতিহাসও তাই প্রমাণ করে। জাহিলী যুগে কুরায়শ গোত্র বিভিন্ন সদগুণে অন্যসব গোত্রের চেয়ে অগ্রসর ছিল। এ কারণে তারা অন্যান্য গোত্রের উপর নেতৃত্ব দান করত। ইসলামী যুগেও দেখা গেল তারা সকলের অগ্রগামী। সেই কুরায়শ গোত্রের ভেতর আবার বনু হাশিমকে শ্রেষ্ঠ মনে করা হত। তার মানে বন্ হাশিম সর্বকালের শ্রেষ্ঠ গোত্র। তাই এ গোত্রেই নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামের আবির্ভাব হয়। এক হাদীছে তিনি এ গোত্রের শ্রেষ্ঠত্বের সাক্ষ্য দান করেছেন। ইসলামী যুগেও তাদের সে শ্রেষ্ঠত্ব বজায় থাকে।
শ্রেষ্ঠত্ব লাভের জন্য এ হাদীছে যে শর্তের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, অর্থাৎ দীনের বুঝ-জ্ঞান, তা না পাওয়া গেলে কোনও গোত্র শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী হতে পারবে না, তাতে সে গোত্র জাহিলী যুগে যতই অভিজাত গণ্য হোক না কেন। বরং জাহিলী যুগে সর্বনিম্ন স্তরের গণ্য হওয়া সত্ত্বেও যে গোত্র দীন বুঝবে ও দীনের অনুসরণ করবে, তারা অবশ্যই বেদীন গোত্রসমূহ অপেক্ষা অনেক বেশি মর্যাদাবান সাব্যস্ত হবে। ইসলামে প্রকৃত মর্যাদার মাপকাঠি কেবলই দীনের বুঝ-জ্ঞান।
উল্লেখ্য, দীনের বুঝ-জ্ঞান ও আমল-অনুসরণ পরস্পর অবিচ্ছেদ্য। দীনের অনুসরণ যদি না করা হয়, তবে কেবল বুঝ-জ্ঞানের কোনও মূল্য নেই। সুতরাং যে সকল স্থানে দীনের ইলম ও দীনের বুঝ-সমঝের মর্যাদা বর্ণনা করা হয়েছে, তাতে আমল ও অনুসরণের বিষয়টাও অপরিহার্যভাবে তার অন্তর্ভুক্ত থাকবে।
এ হাদীছে বংশ-গোত্র বোঝানোর জন্য معادن শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। শব্দটি معدن -এর বহুবচন। এর অর্থ খনি। খনিতে সোনা-রূপা প্রভৃতি মূল্যবান সম্পদ থাকে। বংশ গোত্রও যেহেতু বিভিন্ন সদগুণের ধারক হয়ে থাকে, তাই রূপকার্থে তাকে معدن (খনি) বলা হয়েছে।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. তাকওয়া ও আল্লাহভীতিই মানুষের মর্যাদার প্রকৃত মাপকাঠি।
খ. আল্লাহর কাছে যেহেতু তাকওয়া দ্বারাই মর্যাদা লাভ করা যায়, তাই আমাদের প্রত্যেকের কর্তব্য শক্তভাবে তাকওয়া-পরহেযগারী ধরে রাখা।
গ. দীনদারী ও তাকওয়া-পরহেযগারী না থাকলে বংশীয় আভিজাত্যের কোনও মূল্য নেই। সুতরাং বংশীয় অহমিকা অবশ্যপরিত্যাজ্য।
إِنَّ أَكْرَمَكُمْ عِنْدَ اللَّهِ أَتْقَاكُمْ
‘আল্লাহর কাছে তোমাদের মধ্যে সবচে' বেশি মর্যাদাবান সেই ব্যক্তি, যে বেশি আল্লাহভীরু।
তারপর সাহাবায়ে কিরাম যখন বললেন- আমরা এ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করিনি, অর্থাৎ যে মর্যাদার ভিত্তি নেককাজ আমাদের জিজ্ঞাসা সে সম্পর্কে নয়, তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম মনে করলেন, তারা বংশ-গোত্রভিত্তিক মর্যাদা সম্পর্কে জানতে চাচ্ছে। সুতরাং তিনি বললেন, হযরত ইউসুফ আলাইহিস-সালাম। কেননা ইউসুফ আলাইহিস-সালাম নবুওয়াতী মর্যাদার সাথে সাথে বংশীয় মর্যাদার অধিকারী ছিলেন। পিতা, পিতামহ ও প্রপিতামহ তিনজনই নবী ছিলেন। তিনি চতুর্থ পুরুষ হিসেবে নিজেও নবী। এভাবে হযরত ইউসুফ আলাইহিস-সালাম বাপ-দাদার সিলসিলায় পরপর চারজন নবীর চতুর্থতম নবী। হযরত ইউসুফ আলাইহিস-সালামের আগে ও পরে কখনও এরূপ পাওয়া যায়নি। এটা কেবল তাঁরই বিশেষত্ব। তাঁর বাড়তি বিশেষত্ব ছিল নবুওয়াতের সাথে রাজত্বের অধিকারী হওয়া। তিনি মিশরের রাজক্ষমতা লাভ করেছিলেন। আরও একটি বৈশিষ্ট্য স্বপ্নের তা'বীর। স্বপ্নব্যাখ্যার বিশেষ জ্ঞান আল্লাহ তা'আলা তাঁকে দান করেছিলেন।
প্রকাশ থাকে যে, এতসব বিশেষত্ব থাকার দ্বারা অন্য সকল নবীর উপর হযরত ইউসুফ আলাইহিস-সালামের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণিত হয় না। কেননা এগুলো শাখাগত বিশেষত্ব। মূল নবুওয়াত ও রিসালাতের মর্যাদায় আল্লাহ তা'আলা আম্বিয়া আলাইহিমুস-সালামের মধ্যে যে পার্থক্য করেছেন তাতে হযরত ইবরাহীম আলাইহিস-সালাম, হযরত মুসা আলাইহিস-সালাম প্রমুখের মর্যাদা অনেক উপরে। সাধারণভাবে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ নবী হলেন খাতামুল আম্বিয়া ওয়া সায়্যিদুল মুরসালীন হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম।
কিন্তু সাহাবায়ে কিরামের জিজ্ঞাসা ছিল মূলত আরব গোত্রসমূহ সম্পর্কে। নদী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন তা বুঝতে পারলেন, তখন বললেন- বংশ, গোত্রের দিক থেকে ইসলামেও তারাই শ্রেষ্ঠ, যারা জহিলী যুগে শ্রেষ্ঠ ছিল। তবে একটা শর্ত রয়েছে। শর্তটি হল দীনের জ্ঞান-বুঝ থাকা। যারা দীনের জ্ঞান-বুঝ হাসিল করেছে, প্রকৃত শ্রেষ্ঠত্ব তাদেরই। জাহিলী যুগে যদি তারা শ্রেষ্ঠ হয়ে থাকে, তবে ইসলামে তারা অধিকতর শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী হবে। কেননা জাহিলী যুগে যে সমস্ত সদগুণের কারণে তারা অন্যদের ছাড়িয়ে গিয়েছিল, যেমন সাহসিকতা, অতিথিপরায়ণতা, প্রতিশ্রুতি রক্ষা, সত্যবাদিতা ইত্যাদি, ইসলামেও সেগুলোর বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। তো যখন এসব সদগুণ আগে থেকেই তাদের মধ্যে বিদ্যমান রয়েছে, সেইসংগে দীনের ইলম ও অনুসরণের বাড়তি মহিমাও অর্জন হয়ে গেল, তখন স্বাভাবিকভাবেই তারা ইসলামেও অন্যান্যদের থেকে এগিয়ে থাকবে। বাস্তব ইতিহাসও তাই প্রমাণ করে। জাহিলী যুগে কুরায়শ গোত্র বিভিন্ন সদগুণে অন্যসব গোত্রের চেয়ে অগ্রসর ছিল। এ কারণে তারা অন্যান্য গোত্রের উপর নেতৃত্ব দান করত। ইসলামী যুগেও দেখা গেল তারা সকলের অগ্রগামী। সেই কুরায়শ গোত্রের ভেতর আবার বনু হাশিমকে শ্রেষ্ঠ মনে করা হত। তার মানে বন্ হাশিম সর্বকালের শ্রেষ্ঠ গোত্র। তাই এ গোত্রেই নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামের আবির্ভাব হয়। এক হাদীছে তিনি এ গোত্রের শ্রেষ্ঠত্বের সাক্ষ্য দান করেছেন। ইসলামী যুগেও তাদের সে শ্রেষ্ঠত্ব বজায় থাকে।
শ্রেষ্ঠত্ব লাভের জন্য এ হাদীছে যে শর্তের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, অর্থাৎ দীনের বুঝ-জ্ঞান, তা না পাওয়া গেলে কোনও গোত্র শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী হতে পারবে না, তাতে সে গোত্র জাহিলী যুগে যতই অভিজাত গণ্য হোক না কেন। বরং জাহিলী যুগে সর্বনিম্ন স্তরের গণ্য হওয়া সত্ত্বেও যে গোত্র দীন বুঝবে ও দীনের অনুসরণ করবে, তারা অবশ্যই বেদীন গোত্রসমূহ অপেক্ষা অনেক বেশি মর্যাদাবান সাব্যস্ত হবে। ইসলামে প্রকৃত মর্যাদার মাপকাঠি কেবলই দীনের বুঝ-জ্ঞান।
উল্লেখ্য, দীনের বুঝ-জ্ঞান ও আমল-অনুসরণ পরস্পর অবিচ্ছেদ্য। দীনের অনুসরণ যদি না করা হয়, তবে কেবল বুঝ-জ্ঞানের কোনও মূল্য নেই। সুতরাং যে সকল স্থানে দীনের ইলম ও দীনের বুঝ-সমঝের মর্যাদা বর্ণনা করা হয়েছে, তাতে আমল ও অনুসরণের বিষয়টাও অপরিহার্যভাবে তার অন্তর্ভুক্ত থাকবে।
এ হাদীছে বংশ-গোত্র বোঝানোর জন্য معادن শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। শব্দটি معدن -এর বহুবচন। এর অর্থ খনি। খনিতে সোনা-রূপা প্রভৃতি মূল্যবান সম্পদ থাকে। বংশ গোত্রও যেহেতু বিভিন্ন সদগুণের ধারক হয়ে থাকে, তাই রূপকার্থে তাকে معدن (খনি) বলা হয়েছে।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. তাকওয়া ও আল্লাহভীতিই মানুষের মর্যাদার প্রকৃত মাপকাঠি।
খ. আল্লাহর কাছে যেহেতু তাকওয়া দ্বারাই মর্যাদা লাভ করা যায়, তাই আমাদের প্রত্যেকের কর্তব্য শক্তভাবে তাকওয়া-পরহেযগারী ধরে রাখা।
গ. দীনদারী ও তাকওয়া-পরহেযগারী না থাকলে বংশীয় আভিজাত্যের কোনও মূল্য নেই। সুতরাং বংশীয় অহমিকা অবশ্যপরিত্যাজ্য।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)