রিয়াযুস সালিহীন-ইমাম নববী রহঃ

ভূমিকা অধ্যায়

হাদীস নং: ৮৩
ভূমিকা অধ্যায়
ইয়াকীন ও তাওয়াক্কুল।
ঘর থেকে বের হওয়ার আরেকটি দু‘আ ও তার ফযীলত
হাদীছ নং : ৮৩

হযরত আনাস রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি ঘর থেকে বের হওয়ার সময় বলে-
بِسْمِ اللهِ تَوَكَّلْتُ عَلَى اللهِ وَلَا حَوْلَ وَلَا قُوَّةَ إِلَّا بِاللهِ
(আমি আল্লাহর নামে বের হচ্ছি, আমি আল্লাহর উপর ভরসা করলাম, আল্লাহর সাহায্য ছাড়া কারও পক্ষে গুনাহ হতে বাঁচা এবং তাঁর তাওফীক ছাড়া কারও পক্ষে নেক কাজ করা সম্ভব নয়।), তাকে বলা হয়- তোমাকে হিদায়াত দিয়ে দেওয়া হল, তোমার দায়িত্ব নিয়ে নেওয়া হল এবং তোমাকে রক্ষা করা হল। আর শয়তান তার থেকে দূরে সরে যায়।সুনানে আবূ দাউদ, হাদীছ নং ৫০৯৫; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ৩৫২৬
হাদীছটি বর্ণনা করেছেন ইমাম আবূ দাউদ, তিরমিযী, নাসাঈ প্রমুখ। তিরমিযী রহ. বলেন, এটি একটি 'হাসান' স্তরের হাদীছ। ইমাম আবূ দাউদ রহ.-এর বর্ণনায় অতিরিক্ত আছে— “তখন এক শয়তান অন্য শয়তানকে বলে, যে ব্যক্তিকে হিদায়াত দিয়ে দেওয়া হয়েছে, যার দায়িত্ব নিয়ে নেওয়া হয়েছে এবং যাকে রক্ষা করা হয়েছে, তুমি তার কী করতে পারবে?”
مقدمة الامام النووي
7 - باب في اليقين والتوكل
83 - العاشر: عن أنس - رضي الله عنه - قَالَ: قَالَ رَسُول الله - صلى الله عليه وسلم: «مَنْ قَالَ - يَعْني: إِذَا خَرَجَ مِنْ بَيتِهِ: بِسمِ اللهِ تَوَكَّلْتُ عَلَى اللهِ، وَلا حَولَ وَلا قُوَّةَ إلاَّ باللهِ، يُقالُ لَهُ: هُدِيتَ [ص:48] وَكُفِيتَ وَوُقِيتَ، وَتَنَحَّى (1) عَنْهُ الشَّيطَانُ». رواه أبو داود والترمذي والنسائي (2) وغيرهم. وَقالَ الترمذي: «حديث حسن»، زاد أبو داود: «فيقول - يعني: الشيطان - لِشيطان آخر: كَيفَ لَكَ بِرجلٍ قَدْ هُدِيَ وَكُفِيَ وَوُقِيَ؟».

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এ হাদীছে ঘর থেকে বের হওয়ার সময় بِسْمِ اللهِ تَوَكَّلْتُ عَلَى اللهِ বলার পর وَلَا حَوْلَ وَلَا قُوَّةَ إِلَّا بِاللهِ পড়তে বলা হয়েছে। এ বাক্যটির অর্থ- “আল্লাহর সাহায্য ছাড়া কারও গুনাহ থেকে বাঁচার ক্ষমতা নেই এবং তাঁর সাহায্য ছাড়া কারও ‘ইবাদত-বন্দেগী করারও শক্তি নেই।” এটা আল্লাহর প্রতি তাওয়াক্কুল ও নির্ভরতার ভাষা। এর মাধ্যমে সকল কাজে প্রয়োজনীয় আসবাব-উপকরণ ব্যবহার ও যথাসাধ্য চেষ্টা-শ্রম ব্যয়ের পাশাপাশি কাজের সফলতা ও কাঙ্ক্ষিত ফল লাভের বিষয়টা আল্লাহর প্রতি ন্যস্ত করা হয়। তা ন্যস্ত করাটাই হয়ে থাকে একজন সত্যিকার মুমিন বান্দার নীতি। কারণ সে জানে বস্তুর নিজস্ব কোনও ক্ষমতা নেই। আল্লাহর সাহায্য ছাড়া বান্দার নিজের পক্ষে কোনওকিছুই করা সম্ভব নয়। না কোনও অনিষ্ট থেকে বাঁচা সম্ভব, না সম্ভব কোনও কল্যাণ ও উপকার লাভ করা। বান্দা এ বিশ্বাসের সাথে যখন আল্লাহর প্রতি নির্ভর করে, তখন তার জন্য আল্লাহর রহমত ও সাহায্য নেমে আসে। ফলে তার অন্তর থেকে ভয়ভীতি দূর হয়ে যায় এবং সংশয়-সন্দেহের অবসান ঘটে। তার বুকে হিম্মত জেগে ওঠে এবং সব অবসাদ ও অলসতা ঝেড়ে ফেলে সে করণীয় কাজে নেমে পড়ে। অতঃপর যে ফলাফল লাভ হয় তাতে তৃপ্ত ও সন্তুষ্ট থাকে। সে তৃপ্তি ও সন্তুষ্টিতেই দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণ নিহিত।
এক বর্ণনায় আছে, বান্দা যখন وَلَا حَوْلَ وَلَا قُوَّةَ إِلَّا بِاللهِ বলে, তখন আল্লাহ তার প্রতি দৃষ্টিপাত করেন। আর আল্লাহ যার প্রতি দৃষ্টিপাত করেন, তাকে দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণ দিয়ে দেন।

হাদীছে এ দু'আর চারটি ফযীলত বলা হয়েছে

ক. ফিরিশতার পক্ষ থেকে তাকে বলা হয় هديت। অর্থাৎ তুমি যখন আল্লাহর নামের সাহায্য গ্রহণ করলে এবং তাঁর প্রতি নির্ভরশীল হলে, তখন তোমাকে সরল পথের হিদায়াত দিয়ে দেওয়া হল। তুমি যাতে এ পথে প্রতিষ্ঠিত থাকতে পার সেজন্য তোমার অনুকূলে আল্লাহর সাহায্য থাকবে। আর আল্লাহর সাহায্য থাকলে কেউ তোমাকে এ পথ থেকে বিচ্যুত করতে পারবে না।

খ. তাকে বলা হয় كفيت। অর্থাৎ তোমার দুনিয়া ও আখিরাতের যাবতীয় প্রয়োজন যাতে সুচারুরূপে সমাধা হয়ে যায়, আল্লাহ তা'আলা তার দায়িত্ব নিয়ে নিলেন। তাঁর দায়িত্বগ্রহণই তোমার জন্য যথেষ্ট; আর কারও উপর তোমার ভরসা করার প্রয়োজন নেই। তুমি নিশ্চিন্ত ও পেরেশানীমুক্ত হয়ে যেতে পার। দুনিয়ার কোনওকিছুই তোমার কল্যাণ ব্যাহত করতে পারবে না। আল্লাহ যখন দায়িত্ব নিয়ে নিয়েছেন তখন উদ্দিষ্ট বিষয়ে তোমার সফলতা আসবেই আসবে।

গ. এবং তাকে বলা হয় وقيت। অর্থাৎ তুমি যখন তোমার যাবতীয় বিষয় আল্লাহর প্রতি ন্যস্ত করলে এবং সকল মাখলুক ও যাবতীয় বস্তু থেকে আস্থা ও নির্ভরতা গুটিয়ে নিলে, তখন তুমি আল্লাহর হেফাজতে চলে গেলে। তিনি তোমাকে সকল শত্রুর অনিষ্ট থেকে রক্ষা করবেন। মানব ও জিন শয়তান এবং অনিষ্টকর কোন কিছুই তোমার কোনও ক্ষতি করতে সক্ষম হবে না।

ঘ. এ হাদীছে দু'আটির চতুর্থ ফযীলত বলা হয়েছে- وَتَنَحَّى عَنْهُ الشَّيْطَانُ. শয়তান তার থেকে দূরে সরে যায়। অর্থাৎ আল্লাহর প্রতি নির্ভর করার কারণে সে এমনভাবে আল্লাহর আশ্রয়ে চলে যায় যে, আল্লাহ তার সবরকম হেফাজতের ব্যবস্থা করেন। তিনি ফিরিশতাদের বাহিনী তার সাহায্যে নিয়োগ করেন। ফলে শয়তান তার পথ ছেড়ে দেয় এবং তার থেকে দূরে সরে যেতে বাধ্য হয়। এখন আর কোনও উপায়েই তার পক্ষে সে বান্দার কোনওরকম ক্ষতি করা সম্ভব হয় না। না তার ইবাদত- বন্দেগীতে বাধা দিতে পারে, আর না তাকে পাপাচারে প্ররোচিত করতে পারে। ফলে বাইরের হাজারও প্রলোভন ও পাপাচারের হাতছানির ভেতরও নিজ বন্দেগীসুলভ মহিমা ও শুদ্ধতা অক্ষুণ্ণ রাখতে সক্ষম হয়। ব্যর্থমনোরথ শয়তানেরা তখন আক্ষেপ করে একে অন্যকে বলতে থাকে, যে ব্যক্তিকে হিদায়াত দিয়ে দেওয়া হয়েছে, যার কাজের দায়িত্বভার আল্লাহ তা'আলা নিজে নিয়ে নিয়েছেন এবং যার হেফাজতের সবরকম ব্যবস্থা করে ফেলা হয়েছে, তাকে প্ররোচিত ও বিভ্রান্ত করতে তুমি কিভাবে সক্ষম হবে? তার বিরুদ্ধে তোমার চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্র কিভাবে সফল হতে পারে?

وَلَا حَوْلَ وَلَا قُوَّةَ إِلَّا بِاللهِ -এর ফযীলত

এটি অত্যন্ত ফযীলতপূর্ণ একটি দু'আ। এক হাদীছে এটিকে জান্নাতের 'কানয' (ধনভাণ্ডার) আখ্যায়িত করা হয়েছে। যেমন হযরত আবূ হুরায়রা রাযি. বলেন, একদিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাকে বললেন, হে আবূ হুরায়রা! আমি কি তোমাকে একটি কথা শিক্ষা দেব, যা কিনা 'আরশের নিচে অবস্থিত জান্নাতের একটি ধনভাণ্ডার? আমি বললাম, আপনার প্রতি আমার পিতামাতা উৎসর্গিত হোক, অবশ্যই বলুন। তিনি বললেন, তা হচ্ছে- وَلَا حَوْلَ وَلَا قُوَّةَ إِلَّا بِاللهِ বান্দা যখন এটি বলে তখন আল্লাহ বলেন, আমার বান্দা আত্মসমর্পণ করেছে ও আনুগত্য প্রকাশ করেছে। মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ৭৯৬৬, হাকেম, আল-মুসতাদরাক, হাদীছ নং ৫৪, ১৮৫; তবারানী, আদ-দু'আ, হাদীছ নং ১৬৩৩, ১৬৩৪, ১৬৩৫
কোনও কোনও বর্ণনা দ্বারা জানা যায় এ দু'আটি যেমন ঘর থেকে বের হওয়ার সময় পড়তে হয়, তেমনি ঘরে প্রবেশের সময়ও পড়া চাই। ঘরে প্রবেশকালে এটি পড়লে বিপদ-আপদ থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। কুরআন মাজীদ দ্বারাও এর প্রমাণ পাওয়া যায়। সূরা কাহফে যে দু'ব্যক্তির ঘটনা বর্ণিত হয়েছে, যাদের একজন ছিল ধনী আরেকজন গরীব এবং ধনী লোকটির ছিল দু'টি ফলের বাগান, যে বাগান নিয়ে সে অত্যন্ত গর্বিত ছিল, সে ঘটনায় আছে— গরীব লোকটি ধনী ব্যক্তিকে লক্ষ্য করে বলেছিল-

وَلَوْلَا إِذْ دَخَلْتَ جَنَّتَكَ قُلْتَ مَا شَاءَ اللَّهُ لَا قُوَّةَ إِلَّا بِاللَّهِ

অর্থ : তুমি যখন নিজ বাগানে প্রবেশ করছিলে, তখন তুমি কেন বললে না- مَا شَاءَ اللَّهُ لَا قُوَّةَ إِلَّا بِاللَّهِ (আল্লাহ যা চান তা-ই হয়। আল্লাহর তাওফীক ছাড়া কারও কোনও ক্ষমতা নেই)? সূরা কাহফ, আয়াত ৩৯
কিন্তু সে তা বলতে রাজি হয়নি। ফলে আল্লাহর আযাবে তার বাগান ধ্বংস হয়ে যায়। এর দ্বারা বোঝা যায় এ দু'আটি পাঠ করলে আল্লাহর সাহায্য লাভ হয় এবং ঘরে-বাইরে সব জায়গায় বালা-মসিবত থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। উল্লিখিত আয়াতের ভিত্তিতে ইমাম মালিক রহ. বলেন, কোনও ব্যক্তি যখন ঘরে প্রবেশ করে, তার জন্য
مَا شَاءَ اللهُ لَا حَوْلَ وَلَا قُوَّةَ إِلَّا بِاللهِ বলা মুস্তাহাব।
প্রকাশ থাকে যে, দু'আটির কাঙ্ক্ষিত বরকত ও ফযীলত লাভের জন্য এর মর্মবস্তুর প্রতি অটুট বিশ্বাস রাখা জরুরি। এ বিশ্বাস যাতে কোনওক্রমেই ক্ষুণ্ণ হতে না পারে, সেজন্য অন্তরে প্রতিটি কাজের ক্ষেত্রে বস্তুর অক্ষমতা ও আল্লাহর অসীম কুদরতের ধ্যান বজায় রাখতে হবে।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. পূর্বের হাদীছের মত এ হাদীছেরও প্রধান শিক্ষা হল সর্বাবস্থায় আল্লাহর প্রতি নির্ভরশীল থাকা।

খ. শয়তান মানুষের প্রধান শত্রু। তার প্ররোচনা থেকে আত্মরক্ষার উপায় এ হাদীছে বর্ণিত দু'আটি পাঠ করা।

গ. আল্লাহর পক্ষ থেকে হিদায়াত ও সাহায্য লাভ করা এবং দীন-দুনিয়ার সর্বপ্রকার অনিষ্ট থেকে বাঁচার উপায় হল আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করা। হাদীছে বর্ণিত দু'আটির মধ্যে সে তাওয়াক্কুলের কথাই ব্যক্ত হয়েছে।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান