রিয়াযুস সালিহীন-ইমাম নববী রহঃ
২. বিবিধ আদব - শিষ্টাচারের অধ্যায়
হাদীস নং: ৬৮০
বিবিধ আদব - শিষ্টাচারের অধ্যায়
দ্বিতীয় ভাগ : আদব ও শিষ্টাচার
পরিচ্ছেদ: ১ লজ্জাশীলতা, লজ্জাশীলতার ফযীলত এবং এ গুণে গুণান্বিত হওয়ার প্রতি উৎসাহদান
اَلْأَدب (আদব) অর্থ প্রশংসনীয় কর্মপন্থা। অর্থাৎ বিশ্বাস, কথা ও কাজে যে পদ্ধতি, রীতিনীতি ও ভাবভঙ্গি শরী'আতে প্রশংসনীয়, তাকে আদব বলা হয়। কথাটি এভাবেও বলা যায় যে, আকীদা-বিশ্বাস, কথা ও কাজে মুসলিম ব্যক্তির যে পন্থা অনুসরণ করা উচিত তাকে আদব বলে। এটা ওয়াজিবও হতে পারে, মুস্তাহাবও হতে পারে। করণীয় ক্ষেত্রেও হতে পারে, বর্জনীয় ক্ষেত্রেও হতে পারে।
আদবের সম্পর্ক রয়েছে আল্লাহ তা'আলার সঙ্গে, তাঁর কিতাবের সঙ্গে, তাঁর রাসূলের সঙ্গে, ব্যক্তির নিজের সঙ্গে এবং সমাজের সঙ্গে। এটা অতি ব্যাপক। জীবনের সকল ক্ষেত্র ও সকল কাজেই এটা প্রযোজ্য।
আদব আমাদের দীনী শিক্ষার এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। এর দ্বারা মানবজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে মুসলিম ব্যক্তির স্বাতন্ত্র্য প্রকাশ পায়। কেননা তার খাওয়া, পান করা, পোশাক পরা, অভিভাদন জানানো, অনুমতি চাওয়া, কথাবার্তা, হাসি-তামাশা, অভিনন্দন জানানো, শোক জ্ঞাপন, হাঁচি দেওয়া, হাই তোলা, ওঠাবসা, চলাফেরা, ঘুমানো, স্ত্রীর সঙ্গে আচরণ, আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে মেলামেশা, মজলিসে বসা, মজলিস ত্যাগ করা তথা জীবনসংশ্লিষ্ট প্রতিটি বিষয়ে রয়েছে তাৎপর্যপূর্ণ আদব-কায়দা। সে আদব-কায়দা রক্ষা করা হলে প্রতিটি কাজ হয় সুন্দর ও সুচারু। তা দ্বারা বোঝা যায় সে ব্যক্তি অন্য কোনও ধর্মের নয়; বরং ইসলামেরই অনুসারী।
আদব রক্ষার দ্বারা সমাজে ব্যক্তির নিজের মর্যাদা রক্ষা পায় এবং অন্যদের প্রতিও মর্যাদা প্রদর্শন করা হয়। এর দ্বারা সমাজে শান্তি রক্ষা হয়। সময়ে বরকত হয়। সবকিছুতে অপচয় রোধ হয়। পরস্পরের মধ্যে সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠিত হয়। মানুষের পার্থিব জীবন হয় শান্তিপূর্ণ এবং তার পরকাল হয় সাফল্যমণ্ডিত।
আমাদের ইসলাম আদব-কায়দার প্রতি বিশেষ গুরুত্বারোপ করেছে। আদবের শিক্ষায় কুরআন মাজীদ ও প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীছ ভরপুর। সেদিকে লক্ষ করলে ধারণা হয় যে, এ দীন আদবেরই দীন।
এ গুরুত্বের কারণে লক্ষ করা যায় প্রতিটি হাদীছগ্রন্থে ইসলামী আদব সম্পর্কে রয়েছে স্বতন্ত্র অধ্যায়। এ সম্পর্কে রচিত হয়েছে পৃথক বহু মূল্যবান গ্রন্থ। কিন্তু আফসোস! মুসলিমসমাজ ইসলামী আদবের এ গুরুত্ব প্রায় ভুলে যেতে বসেছে। সর্বত্র এর প্রতি প্রচণ্ড অবহেলা। আমাদের কর্মপন্থা লক্ষ করলে ধারণা জন্মায় ইসলামী শিক্ষায় আদবের বুঝি বিশেষ গুরুত্ব নেই। এটা যেন আমাদের দীনের অংশই নয়। এ কারণেই আজ কাজকর্ম ও আচার-আচরণে মুসলিম ব্যক্তিকে অন্যান্য ধর্মাবলম্বী থেকে পৃথক করে চেনা যায় না। তার অধিকাংশ কাজই সাক্ষ্য দেয় না যে, সে একজন মুসলিম। এটা তার সাংস্কৃতিক অধঃপতন। এ অধঃপতন জাতীয় অস্তিত্বের জন্যই হুমকিস্বরূপ। সুতরাং জাতীয় অস্তিত্বের সুরক্ষার জন্য এ অবস্থার পরিবর্তন দরকার। পরিবর্তন তখনই হবে, যখন আমরা ইসলামী আদব-কায়দার মূল্য বুঝব এবং গুরুত্বের সঙ্গে সকল ক্ষেত্রে তার অনুসরণে যত্নবান হব। রিয়াযুস সালেহীনের এ অধ্যায়টি ইসলামী আদব-কায়দা সম্পর্কেই। এতে মানবজীবনের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি ক্ষেত্র সম্পর্কিত ইসলামী আদব- কায়দা বিষয়ক হাদীছ তুলে ধরা হয়েছে। আমরা এ হাদীছগুলো মনোযোগ দিয়ে পড়ব এবং এ অনুযায়ী আমল করতে সচেষ্ট হব। আল্লাহ তা'আলা আমাদেরকে তাওফীক দান করুন।
লজ্জাশীলতা, লজ্জাশীলতার ফযীলত এবং এ গুণে গুণান্বিত হওয়ার প্রতি উৎসাহদান
الْحَيَاءُ অর্থ লজ্জাশীলতা। ইমাম রাগিব রহ. বলেন, মন্দ বিষয়াবলির কারণে অন্তরে সংকোচন ও জড়ত্ব দেখা দেওয়া এবং সে কারণে তা পরিত্যাগ করাকে الْحَيَاءُ (হায়া) বলে। জুনায়দ রহ. বলেন, একদিকে আল্লাহ তা'আলার নি'আমতরাজি, অপরদিকে নিজ ত্রুটি-বিচ্যুতি- এ উভয়ের প্রতি দৃষ্টিপাত করার দ্বারা অন্তরে যে অবস্থার সৃষ্টি হয়, সেটাই হায়া। এটা এমন এক চরিত্র, যা মানুষকে মন্দকাজ পরিত্যাগে উৎসাহ যোগায় এবং অন্যের হক আদায়ে শিথিলতা করা হতে বিরত রাখে।
বস্তুত হায়া বা লজ্জাশীলতা একটি মহৎ গুণ। মানুষের মনুষ্যত্ব রক্ষার জন্য এ গুণটি অপরিহার্য। এটি না থাকলে মানুষের মনুষ্যত্বের মৃত্যু ঘটে। তাই তো দেখা যায়, হায়াত (الْحَيَاةُ) ও হায়া শব্দদু'টি একই মূলধাতু থেকে উৎপন্ন। অর্থাৎ উভয়টি পরস্পর অবিচ্ছেদ্য। যার হায়াত বা জীবন আছে, তার হায়া বা লজ্জাশীলতাও থাকতে হবে। তা যার নেই, সে জীবিত থেকেও যেন মৃত।
এটি এমনই এক গুরুত্বপূর্ণ গুণ, যা জীবন্ত সত্তা আল্লাহ তা'আলার সঙ্গেও ব্যবহৃত হয়ে থাকে। যেমন এক হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-
إِنَّ رَبَّكُمْ تَبَارَكَ وَتَعَالَى حَييٌّ كَرِيمٌ ، يَسْتَحْيِي مِنْ عَبْدِهِ إِذَا رَفَعَ يَدَيْهِ إِلَيْهِ أَنْ يَرُدَّهُمَا صِفْرًا
‘তোমাদের মহান প্রতিপালক লজ্জাশীল, মহানুভব। বান্দা যখন তাঁর কাছে দু'হাত তোলে, তিনি তা খালি ফিরিয়ে দিতে লজ্জাবোধ করেন।(সুনানে আবু দাউদ: ১৪৮৮; জামে তিরমিযী: ৩৫৫৬; সুনানে ইবন মাজাহ ৩৮৬৫; মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাক ৩২৫০; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর ১৩৫৫৭; হামিক, আল মুস্তাদরাক: ১৮৩১)
অপর একটি হাদীছ দ্বারা এ গুণটির গুরুত্ব উপলব্ধি করা যায়। তাতে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
إِنَّ لِكُلِّ دِيْنِ خُلُقًا، وَخُلُقُ الْإِسْلَامِ الْحَيَاء
‘প্রত্যেক দীনের এক বিশেষ চরিত্র আছে। ইসলামের সে চরিত্র হল লজ্জাশীলতা।(সুনানে ইবন মাজাহ: ৪১৮১; মুআত্তা মালিক: ৩৩৫১; মুসনাদু ইবনিল জা'দ : ২৮৭৭; তাবারানী, আল মু'জামুস সগীর: ১৩; শু'আবুল ঈমান: ৭৩১৪; মুসনাদে আবূ ইয়া'লা : ৩৫৭৩)
উল্লেখ্য, মানুষের লজ্জা দু'প্রকার। এক লজ্জা জন্মগত বা স্বভাবগত। মানুষের স্বভাবগত গুণাবলির মধ্যে এটি শ্রেষ্ঠ। এটি মুসলিম-অমুসলিম যে-কারও মধ্যেই থাকতে পারে। এ গুণ মানুষকে মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখে এবং ভালো কাজে উৎসাহ যোগায়।
আরেক লজ্জা হল সাধনালব্ধ। অর্থাৎ যা চেষ্টা ও সাধনা দ্বারা অর্জন করা হয়। যে ব্যক্তি আল্লাহ তা'আলার শ্রেষ্ঠত্ব, বড়ত্ব ও নৈকট্য সম্পর্কে জানে, তাঁর রহমত ও দয়া, তাঁর অনুগ্রহ ও নি'আমতরাশি সম্পর্কে সচেতন এবং এ বিষয়েও সচেতন যে, তিনি বান্দার যাবতীয় কাজকর্ম ও আচার-আচরণের উপর দৃষ্টি রাখেন, বান্দার চোখের চোরাচাহনি সম্পর্কেও তিনি অবগত এবং তিনি তার মনে কী আছে তাও পরিপূর্ণরূপে জানেন, স্বাভাবিকভাবেই তার আল্লাহর নাফরমানি করতে লজ্জাবোধ হবে। বান্দা যখন নিয়মিতভাবে তাঁর এ গুণের ধ্যান করবে আর এভাবে যথেষ্ট পরিমাণে তাঁর মা'রিফাত হাসিল হয়ে যাবে, তখন তার অন্তরে আল্লাহ তা'আলার প্রতি লজ্জাবোধ এমন বদ্ধমূল হয়ে যাবে যে, সে সহজে তাঁর নাফরমানি করতে প্রস্তুত হবে না; বরং সর্বদা তাঁর আনুগত্যমূলক কাজকর্ম করার প্রতি উৎসাহবোধ করবে। আল্লাহ তা'আলার মা'রিফাত ও তাঁর সম্পর্কে জানার ভিত্তিতে এই যে লজ্জাশীলতা অন্তরে জন্ম নেয়, এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটা ঈমানের এক গুরুত্বপূর্ণ শাখা। ইসলাম এ প্রকারের লজ্জাশীলতা অর্জন ও অবলম্বনের প্রতি বিশেষভাবে উৎসাহ প্রদান করেছে। এ সম্পর্কে বহু হাদীছ আছে। ইমাম নববী রহ. এ পরিচ্ছেদে তা থেকে কয়েকটি হাদীছ উদ্ধৃত করেছেন। আমরা তার বঙ্গানুবাদ ও সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা পেশ করছি। আল্লাহ তা'আলাই তাওফীকদাতা।
পরিচ্ছেদ: ১ লজ্জাশীলতা, লজ্জাশীলতার ফযীলত এবং এ গুণে গুণান্বিত হওয়ার প্রতি উৎসাহদান
اَلْأَدب (আদব) অর্থ প্রশংসনীয় কর্মপন্থা। অর্থাৎ বিশ্বাস, কথা ও কাজে যে পদ্ধতি, রীতিনীতি ও ভাবভঙ্গি শরী'আতে প্রশংসনীয়, তাকে আদব বলা হয়। কথাটি এভাবেও বলা যায় যে, আকীদা-বিশ্বাস, কথা ও কাজে মুসলিম ব্যক্তির যে পন্থা অনুসরণ করা উচিত তাকে আদব বলে। এটা ওয়াজিবও হতে পারে, মুস্তাহাবও হতে পারে। করণীয় ক্ষেত্রেও হতে পারে, বর্জনীয় ক্ষেত্রেও হতে পারে।
আদবের সম্পর্ক রয়েছে আল্লাহ তা'আলার সঙ্গে, তাঁর কিতাবের সঙ্গে, তাঁর রাসূলের সঙ্গে, ব্যক্তির নিজের সঙ্গে এবং সমাজের সঙ্গে। এটা অতি ব্যাপক। জীবনের সকল ক্ষেত্র ও সকল কাজেই এটা প্রযোজ্য।
আদব আমাদের দীনী শিক্ষার এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। এর দ্বারা মানবজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে মুসলিম ব্যক্তির স্বাতন্ত্র্য প্রকাশ পায়। কেননা তার খাওয়া, পান করা, পোশাক পরা, অভিভাদন জানানো, অনুমতি চাওয়া, কথাবার্তা, হাসি-তামাশা, অভিনন্দন জানানো, শোক জ্ঞাপন, হাঁচি দেওয়া, হাই তোলা, ওঠাবসা, চলাফেরা, ঘুমানো, স্ত্রীর সঙ্গে আচরণ, আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে মেলামেশা, মজলিসে বসা, মজলিস ত্যাগ করা তথা জীবনসংশ্লিষ্ট প্রতিটি বিষয়ে রয়েছে তাৎপর্যপূর্ণ আদব-কায়দা। সে আদব-কায়দা রক্ষা করা হলে প্রতিটি কাজ হয় সুন্দর ও সুচারু। তা দ্বারা বোঝা যায় সে ব্যক্তি অন্য কোনও ধর্মের নয়; বরং ইসলামেরই অনুসারী।
আদব রক্ষার দ্বারা সমাজে ব্যক্তির নিজের মর্যাদা রক্ষা পায় এবং অন্যদের প্রতিও মর্যাদা প্রদর্শন করা হয়। এর দ্বারা সমাজে শান্তি রক্ষা হয়। সময়ে বরকত হয়। সবকিছুতে অপচয় রোধ হয়। পরস্পরের মধ্যে সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠিত হয়। মানুষের পার্থিব জীবন হয় শান্তিপূর্ণ এবং তার পরকাল হয় সাফল্যমণ্ডিত।
আমাদের ইসলাম আদব-কায়দার প্রতি বিশেষ গুরুত্বারোপ করেছে। আদবের শিক্ষায় কুরআন মাজীদ ও প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীছ ভরপুর। সেদিকে লক্ষ করলে ধারণা হয় যে, এ দীন আদবেরই দীন।
এ গুরুত্বের কারণে লক্ষ করা যায় প্রতিটি হাদীছগ্রন্থে ইসলামী আদব সম্পর্কে রয়েছে স্বতন্ত্র অধ্যায়। এ সম্পর্কে রচিত হয়েছে পৃথক বহু মূল্যবান গ্রন্থ। কিন্তু আফসোস! মুসলিমসমাজ ইসলামী আদবের এ গুরুত্ব প্রায় ভুলে যেতে বসেছে। সর্বত্র এর প্রতি প্রচণ্ড অবহেলা। আমাদের কর্মপন্থা লক্ষ করলে ধারণা জন্মায় ইসলামী শিক্ষায় আদবের বুঝি বিশেষ গুরুত্ব নেই। এটা যেন আমাদের দীনের অংশই নয়। এ কারণেই আজ কাজকর্ম ও আচার-আচরণে মুসলিম ব্যক্তিকে অন্যান্য ধর্মাবলম্বী থেকে পৃথক করে চেনা যায় না। তার অধিকাংশ কাজই সাক্ষ্য দেয় না যে, সে একজন মুসলিম। এটা তার সাংস্কৃতিক অধঃপতন। এ অধঃপতন জাতীয় অস্তিত্বের জন্যই হুমকিস্বরূপ। সুতরাং জাতীয় অস্তিত্বের সুরক্ষার জন্য এ অবস্থার পরিবর্তন দরকার। পরিবর্তন তখনই হবে, যখন আমরা ইসলামী আদব-কায়দার মূল্য বুঝব এবং গুরুত্বের সঙ্গে সকল ক্ষেত্রে তার অনুসরণে যত্নবান হব। রিয়াযুস সালেহীনের এ অধ্যায়টি ইসলামী আদব-কায়দা সম্পর্কেই। এতে মানবজীবনের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি ক্ষেত্র সম্পর্কিত ইসলামী আদব- কায়দা বিষয়ক হাদীছ তুলে ধরা হয়েছে। আমরা এ হাদীছগুলো মনোযোগ দিয়ে পড়ব এবং এ অনুযায়ী আমল করতে সচেষ্ট হব। আল্লাহ তা'আলা আমাদেরকে তাওফীক দান করুন।
লজ্জাশীলতা, লজ্জাশীলতার ফযীলত এবং এ গুণে গুণান্বিত হওয়ার প্রতি উৎসাহদান
الْحَيَاءُ অর্থ লজ্জাশীলতা। ইমাম রাগিব রহ. বলেন, মন্দ বিষয়াবলির কারণে অন্তরে সংকোচন ও জড়ত্ব দেখা দেওয়া এবং সে কারণে তা পরিত্যাগ করাকে الْحَيَاءُ (হায়া) বলে। জুনায়দ রহ. বলেন, একদিকে আল্লাহ তা'আলার নি'আমতরাজি, অপরদিকে নিজ ত্রুটি-বিচ্যুতি- এ উভয়ের প্রতি দৃষ্টিপাত করার দ্বারা অন্তরে যে অবস্থার সৃষ্টি হয়, সেটাই হায়া। এটা এমন এক চরিত্র, যা মানুষকে মন্দকাজ পরিত্যাগে উৎসাহ যোগায় এবং অন্যের হক আদায়ে শিথিলতা করা হতে বিরত রাখে।
বস্তুত হায়া বা লজ্জাশীলতা একটি মহৎ গুণ। মানুষের মনুষ্যত্ব রক্ষার জন্য এ গুণটি অপরিহার্য। এটি না থাকলে মানুষের মনুষ্যত্বের মৃত্যু ঘটে। তাই তো দেখা যায়, হায়াত (الْحَيَاةُ) ও হায়া শব্দদু'টি একই মূলধাতু থেকে উৎপন্ন। অর্থাৎ উভয়টি পরস্পর অবিচ্ছেদ্য। যার হায়াত বা জীবন আছে, তার হায়া বা লজ্জাশীলতাও থাকতে হবে। তা যার নেই, সে জীবিত থেকেও যেন মৃত।
এটি এমনই এক গুরুত্বপূর্ণ গুণ, যা জীবন্ত সত্তা আল্লাহ তা'আলার সঙ্গেও ব্যবহৃত হয়ে থাকে। যেমন এক হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-
إِنَّ رَبَّكُمْ تَبَارَكَ وَتَعَالَى حَييٌّ كَرِيمٌ ، يَسْتَحْيِي مِنْ عَبْدِهِ إِذَا رَفَعَ يَدَيْهِ إِلَيْهِ أَنْ يَرُدَّهُمَا صِفْرًا
‘তোমাদের মহান প্রতিপালক লজ্জাশীল, মহানুভব। বান্দা যখন তাঁর কাছে দু'হাত তোলে, তিনি তা খালি ফিরিয়ে দিতে লজ্জাবোধ করেন।(সুনানে আবু দাউদ: ১৪৮৮; জামে তিরমিযী: ৩৫৫৬; সুনানে ইবন মাজাহ ৩৮৬৫; মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাক ৩২৫০; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর ১৩৫৫৭; হামিক, আল মুস্তাদরাক: ১৮৩১)
অপর একটি হাদীছ দ্বারা এ গুণটির গুরুত্ব উপলব্ধি করা যায়। তাতে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
إِنَّ لِكُلِّ دِيْنِ خُلُقًا، وَخُلُقُ الْإِسْلَامِ الْحَيَاء
‘প্রত্যেক দীনের এক বিশেষ চরিত্র আছে। ইসলামের সে চরিত্র হল লজ্জাশীলতা।(সুনানে ইবন মাজাহ: ৪১৮১; মুআত্তা মালিক: ৩৩৫১; মুসনাদু ইবনিল জা'দ : ২৮৭৭; তাবারানী, আল মু'জামুস সগীর: ১৩; শু'আবুল ঈমান: ৭৩১৪; মুসনাদে আবূ ইয়া'লা : ৩৫৭৩)
উল্লেখ্য, মানুষের লজ্জা দু'প্রকার। এক লজ্জা জন্মগত বা স্বভাবগত। মানুষের স্বভাবগত গুণাবলির মধ্যে এটি শ্রেষ্ঠ। এটি মুসলিম-অমুসলিম যে-কারও মধ্যেই থাকতে পারে। এ গুণ মানুষকে মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখে এবং ভালো কাজে উৎসাহ যোগায়।
আরেক লজ্জা হল সাধনালব্ধ। অর্থাৎ যা চেষ্টা ও সাধনা দ্বারা অর্জন করা হয়। যে ব্যক্তি আল্লাহ তা'আলার শ্রেষ্ঠত্ব, বড়ত্ব ও নৈকট্য সম্পর্কে জানে, তাঁর রহমত ও দয়া, তাঁর অনুগ্রহ ও নি'আমতরাশি সম্পর্কে সচেতন এবং এ বিষয়েও সচেতন যে, তিনি বান্দার যাবতীয় কাজকর্ম ও আচার-আচরণের উপর দৃষ্টি রাখেন, বান্দার চোখের চোরাচাহনি সম্পর্কেও তিনি অবগত এবং তিনি তার মনে কী আছে তাও পরিপূর্ণরূপে জানেন, স্বাভাবিকভাবেই তার আল্লাহর নাফরমানি করতে লজ্জাবোধ হবে। বান্দা যখন নিয়মিতভাবে তাঁর এ গুণের ধ্যান করবে আর এভাবে যথেষ্ট পরিমাণে তাঁর মা'রিফাত হাসিল হয়ে যাবে, তখন তার অন্তরে আল্লাহ তা'আলার প্রতি লজ্জাবোধ এমন বদ্ধমূল হয়ে যাবে যে, সে সহজে তাঁর নাফরমানি করতে প্রস্তুত হবে না; বরং সর্বদা তাঁর আনুগত্যমূলক কাজকর্ম করার প্রতি উৎসাহবোধ করবে। আল্লাহ তা'আলার মা'রিফাত ও তাঁর সম্পর্কে জানার ভিত্তিতে এই যে লজ্জাশীলতা অন্তরে জন্ম নেয়, এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটা ঈমানের এক গুরুত্বপূর্ণ শাখা। ইসলাম এ প্রকারের লজ্জাশীলতা অর্জন ও অবলম্বনের প্রতি বিশেষভাবে উৎসাহ প্রদান করেছে। এ সম্পর্কে বহু হাদীছ আছে। ইমাম নববী রহ. এ পরিচ্ছেদে তা থেকে কয়েকটি হাদীছ উদ্ধৃত করেছেন। আমরা তার বঙ্গানুবাদ ও সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা পেশ করছি। আল্লাহ তা'আলাই তাওফীকদাতা।
লজ্জাশীলতার প্রতি উৎসাহদান
হাদীছ নং: ৬৮০
হযরত আব্দুল্লাহ ইবন উমর রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জনৈক আনসারী ব্যক্তির নিকট দিয়ে যাচ্ছিলেন। সে তখন তার ভাইকে লজ্জাশীলতার জন্য তিরস্কার করছিল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তাকে ছাড়ো। লজ্জাশীলতা তো ঈমানের অঙ্গ। -বুখারী ও মুসলিম
(সহীহ বুখারী: ২৪; সহীহ মুসলিম: ৩৬; মুসনাদে আহমাদ: ৫১৮২; সুনানে নাসাঈ: ৫০৩৩; সুনানে আবু দাউদ: ৪৭৯৫; তহাবী, শারহু মুশকিলিল আছার: ১৫২৭; খারাইতী, মাকারিমুল আখলাক: ২৯৬; সহীহ ইবনে হিব্বান ৬১০; তাবারানী, আল মু'জামুল আওসাত: ৪৯৩২)
হাদীছ নং: ৬৮০
হযরত আব্দুল্লাহ ইবন উমর রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জনৈক আনসারী ব্যক্তির নিকট দিয়ে যাচ্ছিলেন। সে তখন তার ভাইকে লজ্জাশীলতার জন্য তিরস্কার করছিল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তাকে ছাড়ো। লজ্জাশীলতা তো ঈমানের অঙ্গ। -বুখারী ও মুসলিম
(সহীহ বুখারী: ২৪; সহীহ মুসলিম: ৩৬; মুসনাদে আহমাদ: ৫১৮২; সুনানে নাসাঈ: ৫০৩৩; সুনানে আবু দাউদ: ৪৭৯৫; তহাবী, শারহু মুশকিলিল আছার: ১৫২৭; খারাইতী, মাকারিমুল আখলাক: ২৯৬; সহীহ ইবনে হিব্বান ৬১০; তাবারানী, আল মু'জামুল আওসাত: ৪৯৩২)
كتاب الأدب
كتاب الأدب
باب الحياء وفضله والحث على التخلق به
باب الحياء وفضله والحث على التخلق به
680 - عن ابن عمر رضي الله عنهما: أنَّ رسول الله - صلى الله عليه وسلم - مَرَّ عَلَى رَجُلٍ مِنَ الأنْصَار وَهُوَ يَعِظُ أخَاهُ في الحَيَاءِ، فَقَالَ رسولُ اللهِ - صلى الله عليه وسلم: «دَعْهُ، فَإنَّ الْحَيَاءَ مِنَ الإيمَانِ». متفقٌ عَلَيْهِ. (1)
হাদীসের ব্যাখ্যা:
এক আনসারী সাহাবী তার ভাইকে লজ্জার বিষয়ে তিরস্কার করছিলেন। অর্থাৎ তার ভাই হয়তো কোনও এক কাজ করতে লজ্জাবোধ করছিল। তাই তিনি তিরস্কার করছিলেন যে, তুমি এটা করতে লজ্জা করছ কেন বা এতে লজ্জার কী আছে! ঠিক এ সময়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেখান দিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি সে আনসারী সাহাবীর তিরস্কারমূলক কথা শুনে ফেলেন। তাই তিনি এই বলে তাকে বারণ করেন যে, তুমি তাকে ছেড়ে দাও। অর্থাৎ তাকে তিরস্কার করো না। কেননা সে যে লজ্জা করছে, এটা খারাপ কিছু নয় যে, এ কারণে তাকে তিরস্কার করা যায়। বরং লজ্জা করাটা ভালো। কেননা এটা ঈমানের অঙ্গ। তাই তাকে তিরস্কার করা তো নয়ই; বরং প্রশংসা করা উচিত যে, তার মধ্যে ঈমানের একটা অঙ্গ আছে এবং সে ঈমানের দাবি অনুযায়ী কাজ করছে। বরং ঈমান রক্ষা করার জন্যই লজ্জাশীলতার চর্চা করা জরুরি। কেননা যে ব্যক্তি লজ্জা হারায়, এক পর্যায়ে সে ঈমানও হারিয়ে ফেলে। হযরত আব্দুল্লাহ ইবন উমর রাযি. থেকে বর্ণিত-
إِنَّ الْحَيَاءَ وَالْإِيْمَانَ قُرِنَا جَمِيعًا، فَإِذَا رُفِعَ أَحَدُهُمَا رُفِعَ الْآخَرُ
হায়া ও ঈমান উভয়টা পরস্পর যুক্ত। যখন এর একটা উঠিয়ে নেওয়া হয়, তখন অপরটাও উঠে যায়। (শু'আবুল ঈমান : ৭৩৩১; আল-আদাবুল মুফরাদ: ১৩১৩; মুসান্নাফে ইবন আবী শায়বা: ২৫৩৫০)
প্রশ্ন হতে পারে যে, লজ্জাশীলতা তো স্বভাবগত বিষয়, যা মানুষের এখতিয়াবহির্ভূত, আর যা মানুষের এখতিয়ারবহির্ভূত, তা করার জন্য আল্লাহ তা'আলা হুকুম করেন না, এ অবস্থায় লজ্জাশীলতা ঈমানের অঙ্গ হয় কী করে?
এর উত্তর হল, লজ্জাশীলতা স্বভাবগত বিষয় হলেও এ অনুযায়ী কাজ করা বা না করাটা মানুষের এখতিয়ার ও ইচ্ছাধীন বিষয়। সেদিক থেকে এটা ঈমানের অঙ্গ। তাছাড়া যে লজ্জাশীলতা সাধনা দ্বারা অর্জন করা হয়, অর্থাৎ আল্লাহ তা'আলার নৈকট্য ও তাঁর অনুগ্রহরাজির মধ্যে চিন্তা করার দ্বারা অন্তরে সৃষ্টি হয়, তা মানুষের পুরোপুরি এখতিয়ারাধীন। একে শর'ঈ হায়া বলা হয়ে থাকে। হাদীছে এরূপ হায়াকেই ঈমানের অঙ্গ বলা হয়েছে। এরূপ হায়া ও লজ্জাশীলতা মানুষকে সৎকর্মে উৎসাহিত করে ও অসৎকর্ম হতে বিরত থাকার হিম্মত যোগায়।
আরও প্রশ্ন হতে পারে যে, অনেক সময় দেখা যায় লজ্জার কারণে মানুষ কোনও কোনও ভালো কাজ করতে সংকোচবোধ করে, যেমন যে ব্যক্তি কখনও নামায পড়েনি, তার নামায শুরু করতে কেমন যেন লজ্জাবোধ হয়, এমনিভাবে যে নারী পর্দা করত না, তার পর্দা শুরু করতে লজ্জা লাগে, তো দেখা যাচ্ছে ক্ষেত্রবিশেষে লজ্জা সৎকর্মের পক্ষে বাধা হয়, এ অবস্থায় তা কীভাবে ঈমানের অঙ্গ হয়?
এর উত্তর হল, যে লজ্জা সৎকর্মের জন্য বাধা হয়, তা আদৌ লজ্জা নয়। বরং তা এক রকম মানসিক দুর্বলতা, যা পুরোনো অভ্যাস বা পরিবেশ-পরিস্থিতির প্রভাবে সৃষ্টি হয়ে থাকে। প্রকৃত লজ্জা কখনও সৎকর্মের জন্য বাধা হয় না। বরং তা সৎকর্মে অগ্রসর হওয়ার অনুপ্রেরণা যোগায়। এমনকি কোনও ব্যক্তি যদি দীনদারিতে মুখলিস ও নিষ্ঠাবান না হয়, কিন্তু তার মধ্যে লজ্জাশীলতার গুণ থাকে, সেও তার এ গুণের কারণে বহুবিধ গুনাহের কাজ থেকে দূরে থাকে। জনৈক তাবি'ঈ থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন যে, আমি ৪০ বছর পর্যন্ত কেবল লজ্জাশীলতার কারণে গুনাহ পরিত্যাগ করেছি। পরিশেষে আমার পরহেযগারি অর্জিত হয়েছে। ইবনে সাম‘উন রহ. বলেন, আমি লক্ষ করে দেখলাম পাপকর্ম নির্লজ্জতা। তাই ভদ্রতাবশত আমি তা ত্যাগ করেছি। পরিশেষে তা দীনদারিতে রূপান্তরিত হয়েছে।
লক্ষণীয়, হাদীছটিতে লজ্জাশীলতাকে ঈমানের অঙ্গ বলা হয়েছে। বোঝা গেল প্রত্যেক ঈমানদারেরই এ গুণ থাকা উচিত, তা সে নারী হোক বা পুরুষ। এটা যখন ঈমানের অঙ্গ, তখন কেবল নারীর নয়; বরং এটা নারী-পুরুষ সকলেরই ভূষণ।
আরও লক্ষণীয়, আনসারী সাহাবী যে কারণে তার ভাইকে তিরস্কার করছিলেন, তা নিজের কাছে তিরস্কারযোগ্য মনে হয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে তা তিরস্কারের যোগ্য কোনও বিষয় ছিল না। বরং তা ছিল প্রশংসনীয় এবং শরী'আতের কাছে কাম্য একটি বিষয়, যে কারণে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ওই সাহাবীকে তিরস্কার করতে নিষেধ করে দেন। এর দ্বারা বোঝা গেল, কাউকে কোনও কাজের জন্য তিরস্কার করার আগে চিন্তা করে দেখতে হবে সে কাজটি শরী'আতের দৃষ্টিতে কেমন। শরী'আতের দৃষ্টিতে যদি তা ভালো ও কাম্য হয়ে থাকে, তবে কেবল পরিবেশ ও প্রচলিত সমাজ-সংস্কৃতির বিপরীত হওয়ার কারণে সেজন্য তিরস্কার করা যাবে না। বরং এরূপ ক্ষেত্রে সে তিরস্কারটাই একটা মন্দ কাজ, যা থেকে বিরত থাকা একান্ত জরুরি।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. লজ্জাশীলতা ঈমানের এক গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। জীবনের সকল ক্ষেত্রে এর চর্চা করা চাই।
খ. যে কাজ দীন ও শরী'আতের অঙ্গ, কিন্তু প্রচলিত সমাজ-সংস্কৃতির পরিপন্থী, সেজন্য কাউকে তিরস্কার করা কিছুতেই সমীচীন নয়; বরং সে কাজে উৎসাহ দেওয়াই কর্তব্য।
গ. যে কাজ শরী'আতে কাম্য, সে কাজের জন্য কেউ কাউকে তিরস্কার করলে তা একটি গর্হিত কাজ হবে। এজন্য তাকেই সতর্ক করে দেওয়া বাঞ্ছনীয়।
ঘ. শরী'আতের কোনও হুকুম পালনে কারও দ্বিধা-সংকোচ দেখা দিলে তা সত্যিকারের লজ্জাশীলতা নয়; বরং তা শরী'আতের হুকুম পালনে অবহেলাজনিত মানসিক দুর্বলতা। এরূপ দুর্বলতাকে প্রশ্রয় দেওয়া উচিত নয়।
إِنَّ الْحَيَاءَ وَالْإِيْمَانَ قُرِنَا جَمِيعًا، فَإِذَا رُفِعَ أَحَدُهُمَا رُفِعَ الْآخَرُ
হায়া ও ঈমান উভয়টা পরস্পর যুক্ত। যখন এর একটা উঠিয়ে নেওয়া হয়, তখন অপরটাও উঠে যায়। (শু'আবুল ঈমান : ৭৩৩১; আল-আদাবুল মুফরাদ: ১৩১৩; মুসান্নাফে ইবন আবী শায়বা: ২৫৩৫০)
প্রশ্ন হতে পারে যে, লজ্জাশীলতা তো স্বভাবগত বিষয়, যা মানুষের এখতিয়াবহির্ভূত, আর যা মানুষের এখতিয়ারবহির্ভূত, তা করার জন্য আল্লাহ তা'আলা হুকুম করেন না, এ অবস্থায় লজ্জাশীলতা ঈমানের অঙ্গ হয় কী করে?
এর উত্তর হল, লজ্জাশীলতা স্বভাবগত বিষয় হলেও এ অনুযায়ী কাজ করা বা না করাটা মানুষের এখতিয়ার ও ইচ্ছাধীন বিষয়। সেদিক থেকে এটা ঈমানের অঙ্গ। তাছাড়া যে লজ্জাশীলতা সাধনা দ্বারা অর্জন করা হয়, অর্থাৎ আল্লাহ তা'আলার নৈকট্য ও তাঁর অনুগ্রহরাজির মধ্যে চিন্তা করার দ্বারা অন্তরে সৃষ্টি হয়, তা মানুষের পুরোপুরি এখতিয়ারাধীন। একে শর'ঈ হায়া বলা হয়ে থাকে। হাদীছে এরূপ হায়াকেই ঈমানের অঙ্গ বলা হয়েছে। এরূপ হায়া ও লজ্জাশীলতা মানুষকে সৎকর্মে উৎসাহিত করে ও অসৎকর্ম হতে বিরত থাকার হিম্মত যোগায়।
আরও প্রশ্ন হতে পারে যে, অনেক সময় দেখা যায় লজ্জার কারণে মানুষ কোনও কোনও ভালো কাজ করতে সংকোচবোধ করে, যেমন যে ব্যক্তি কখনও নামায পড়েনি, তার নামায শুরু করতে কেমন যেন লজ্জাবোধ হয়, এমনিভাবে যে নারী পর্দা করত না, তার পর্দা শুরু করতে লজ্জা লাগে, তো দেখা যাচ্ছে ক্ষেত্রবিশেষে লজ্জা সৎকর্মের পক্ষে বাধা হয়, এ অবস্থায় তা কীভাবে ঈমানের অঙ্গ হয়?
এর উত্তর হল, যে লজ্জা সৎকর্মের জন্য বাধা হয়, তা আদৌ লজ্জা নয়। বরং তা এক রকম মানসিক দুর্বলতা, যা পুরোনো অভ্যাস বা পরিবেশ-পরিস্থিতির প্রভাবে সৃষ্টি হয়ে থাকে। প্রকৃত লজ্জা কখনও সৎকর্মের জন্য বাধা হয় না। বরং তা সৎকর্মে অগ্রসর হওয়ার অনুপ্রেরণা যোগায়। এমনকি কোনও ব্যক্তি যদি দীনদারিতে মুখলিস ও নিষ্ঠাবান না হয়, কিন্তু তার মধ্যে লজ্জাশীলতার গুণ থাকে, সেও তার এ গুণের কারণে বহুবিধ গুনাহের কাজ থেকে দূরে থাকে। জনৈক তাবি'ঈ থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন যে, আমি ৪০ বছর পর্যন্ত কেবল লজ্জাশীলতার কারণে গুনাহ পরিত্যাগ করেছি। পরিশেষে আমার পরহেযগারি অর্জিত হয়েছে। ইবনে সাম‘উন রহ. বলেন, আমি লক্ষ করে দেখলাম পাপকর্ম নির্লজ্জতা। তাই ভদ্রতাবশত আমি তা ত্যাগ করেছি। পরিশেষে তা দীনদারিতে রূপান্তরিত হয়েছে।
লক্ষণীয়, হাদীছটিতে লজ্জাশীলতাকে ঈমানের অঙ্গ বলা হয়েছে। বোঝা গেল প্রত্যেক ঈমানদারেরই এ গুণ থাকা উচিত, তা সে নারী হোক বা পুরুষ। এটা যখন ঈমানের অঙ্গ, তখন কেবল নারীর নয়; বরং এটা নারী-পুরুষ সকলেরই ভূষণ।
আরও লক্ষণীয়, আনসারী সাহাবী যে কারণে তার ভাইকে তিরস্কার করছিলেন, তা নিজের কাছে তিরস্কারযোগ্য মনে হয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে তা তিরস্কারের যোগ্য কোনও বিষয় ছিল না। বরং তা ছিল প্রশংসনীয় এবং শরী'আতের কাছে কাম্য একটি বিষয়, যে কারণে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ওই সাহাবীকে তিরস্কার করতে নিষেধ করে দেন। এর দ্বারা বোঝা গেল, কাউকে কোনও কাজের জন্য তিরস্কার করার আগে চিন্তা করে দেখতে হবে সে কাজটি শরী'আতের দৃষ্টিতে কেমন। শরী'আতের দৃষ্টিতে যদি তা ভালো ও কাম্য হয়ে থাকে, তবে কেবল পরিবেশ ও প্রচলিত সমাজ-সংস্কৃতির বিপরীত হওয়ার কারণে সেজন্য তিরস্কার করা যাবে না। বরং এরূপ ক্ষেত্রে সে তিরস্কারটাই একটা মন্দ কাজ, যা থেকে বিরত থাকা একান্ত জরুরি।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. লজ্জাশীলতা ঈমানের এক গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। জীবনের সকল ক্ষেত্রে এর চর্চা করা চাই।
খ. যে কাজ দীন ও শরী'আতের অঙ্গ, কিন্তু প্রচলিত সমাজ-সংস্কৃতির পরিপন্থী, সেজন্য কাউকে তিরস্কার করা কিছুতেই সমীচীন নয়; বরং সে কাজে উৎসাহ দেওয়াই কর্তব্য।
গ. যে কাজ শরী'আতে কাম্য, সে কাজের জন্য কেউ কাউকে তিরস্কার করলে তা একটি গর্হিত কাজ হবে। এজন্য তাকেই সতর্ক করে দেওয়া বাঞ্ছনীয়।
ঘ. শরী'আতের কোনও হুকুম পালনে কারও দ্বিধা-সংকোচ দেখা দিলে তা সত্যিকারের লজ্জাশীলতা নয়; বরং তা শরী'আতের হুকুম পালনে অবহেলাজনিত মানসিক দুর্বলতা। এরূপ দুর্বলতাকে প্রশ্রয় দেওয়া উচিত নয়।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)