রিয়াযুস সালিহীন-ইমাম নববী রহঃ
২. বিবিধ আদব - শিষ্টাচারের অধ্যায়
হাদীস নং: ৬৮২
বিবিধ আদব - শিষ্টাচারের অধ্যায়
১ লজ্জাশীলতা, লজ্জাশীলতার ফযীলত এবং এ গুণে গুণান্বিত হওয়ার প্রতি উৎসাহদান
ঈমানের শাখা হিসেবে লজ্জাশীলতার গুরুত্ব
হাদীছ নং: ৬৮২
হযরত আবূ হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ঈমানের সত্তরটির বেশি অথবা ষাটটির বেশি শাখা আছে। তার মধ্যে সর্বোত্তমটি হল লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু বলা এবং সর্বনিম্নটি হল রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক বস্তু সরিয়ে দেওয়া। আর লজ্জাশীলতা ঈমানের এক গুরুত্বপূর্ণ শাখা। -বুখারী ও মুসলিম
(সহীহ বুখারী: ৯; সহীহ মুসলিম: ৩৫; সুনানে আবু দাউদ: ৪৬৭৬; জামে তিরমিযী: ২৮০১; সুনানে নাসাঈ: ৫০০৪; সুনানে ইবন মাজাহ ৫৭; মুসনাদে আহমাদ: ৮৯২৬; সহীহ ইবনে হিব্বান : ১৬৬; মুসনাদুল বাযযার: ৮৯৭৪; তাবারানী, আল মু'জামুল আওসাত : ৬৯৬২; শু'আবুল ঈমান : ৩)
হাদীছ নং: ৬৮২
হযরত আবূ হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ঈমানের সত্তরটির বেশি অথবা ষাটটির বেশি শাখা আছে। তার মধ্যে সর্বোত্তমটি হল লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু বলা এবং সর্বনিম্নটি হল রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক বস্তু সরিয়ে দেওয়া। আর লজ্জাশীলতা ঈমানের এক গুরুত্বপূর্ণ শাখা। -বুখারী ও মুসলিম
(সহীহ বুখারী: ৯; সহীহ মুসলিম: ৩৫; সুনানে আবু দাউদ: ৪৬৭৬; জামে তিরমিযী: ২৮০১; সুনানে নাসাঈ: ৫০০৪; সুনানে ইবন মাজাহ ৫৭; মুসনাদে আহমাদ: ৮৯২৬; সহীহ ইবনে হিব্বান : ১৬৬; মুসনাদুল বাযযার: ৮৯৭৪; তাবারানী, আল মু'জামুল আওসাত : ৬৯৬২; শু'আবুল ঈমান : ৩)
كتاب الأدب
باب الحياء وفضله والحث على التخلق به
682 - وعن أَبي هريرة - رضي الله عنه: أنَّ رسول الله - صلى الله عليه وسلم - قَالَ: «الإيمَانُ بِضْعٌ وَسَبْعُونَ أَوْ بِضْعٌ وَسِتُّونَ شُعْبَةً: فَأفْضَلُهَا قَوْلُ: لاَ إلهَ إِلاَّ الله، وَأدْنَاهَا إمَاطَةُ الأَذَى عَنِ الطَّرِيقِ، وَالحَيَاءُ شُعْبَةٌ مِنَ الإيمَانِ». متفقٌ عَلَيْهِ. (1)
«البِضْعُ» بكسر الباءِ ويجوز فتحها: وَهُوَ مِنَ الثَّلاَثَةِ إِلَى الْعَشَرَةِ.
وَ «الشُّعْبَةُ»: القِطْعَةُ وَالْخَصْلَةُ. وَ «الإمَاطَةُ»: الإزَالَةُ. وَ «الأَذَى»: مَا يُؤْذِي كَحَجَرٍ وشوك وَطِينٍ ورماد وَقَذَرٍ وَنَحْو ذَلِكَ.
«البِضْعُ» بكسر الباءِ ويجوز فتحها: وَهُوَ مِنَ الثَّلاَثَةِ إِلَى الْعَشَرَةِ.
وَ «الشُّعْبَةُ»: القِطْعَةُ وَالْخَصْلَةُ. وَ «الإمَاطَةُ»: الإزَالَةُ. وَ «الأَذَى»: مَا يُؤْذِي كَحَجَرٍ وشوك وَطِينٍ ورماد وَقَذَرٍ وَنَحْو ذَلِكَ.
হাদীসের ব্যাখ্যা:
এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এক হাদীছ। এতে জানানো হয়েছে ঈমান শাখা-প্রশাখাহীন কোনও বিষয় নয়। এটা সুনির্দিষ্ট একটা জিনিসমাত্র নয় যে, কেউ সেই একটা জিনিস করল আর তাতেই মু'মিন হয়ে গেল। এমনিতে তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে তো এ কথা ঠিক যে, ঈমান অন্তরের বিশ্বাসের নাম। আর বিশ্বাস এক অবিভাজ্য জিনিস। কিন্তু সেই বিশ্বাসও কোনও একটা বিষয়ের উপর হলেই যথেষ্ট হয় না। বরং তাওহীদ, রিসালাত, আখিরাত ইত্যাদি সবগুলোর প্রতি বিশ্বাস রাখলেই কেউ মু'মিন হতে পারে। কাজেই অন্তরের বিশ্বাসের অনেক শাখা-প্রশাখা আছে। তাছাড়া কুরআন-হাদীছ সাধারণত মু'মিন বলে পূর্ণাঙ্গ মু'মিনকেই বোঝায় অর্থাৎ যে ব্যক্তি আন্তরিক বিশ্বাসের সাথে সাথে শরী'আতের সমস্ত আদেশ-নিষেধও মেনে চলে। সে হিসেবে শরী'আত যা-কিছু করতে বলেছে তার প্রত্যেকটিই ঈমানের একটি শাখা। এমনিভাবে যা-কিছু নিষিদ্ধ করেছে তার প্রত্যেকটি থেকে বেঁচে থাকাও ঈমানের একেকটি শাখা। যে ব্যক্তি সবগুলো শাখার উপর আমল করবে, সে-ই প্রকৃত ও পূর্ণাঙ্গ মু'মিন।
এ হাদীছে ঈমানের শাখা বলা হয়েছে ষাট অথবা সত্তরটির কিছু বেশি। এ সংখ্যা দ্বারা মূলত সুনির্দিষ্ট অংক বোঝানো উদ্দেশ্য নয়; বরং বোঝানো উদ্দেশ্য সংখ্যাধিক্য। অর্থাৎ ঈমানের অনেকগুলো শাখা আছে। সুতরাং ষাট বা সত্তরের সুনির্দিষ্ট সংখ্যা মেলানোর চেষ্টা বৃথা।
এ হাদীছ দ্বারা মূলত বোঝানো উদ্দেশ্য ঈমানের শাখা অনেকগুলো। সুতরাং তোমরা সামান্য কিছু আমল নিয়ে বসে থেকো না; বরং কুরআন-হাদীছে যত সৎকর্মের কথা বলা হয়েছে সবগুলো করার চেষ্টা করো। তবেই পূর্ণাঙ্গ মু'মিন হতে পারবে। কুরআন ও হাদীছে যেসব কাজ সম্পর্কে কোনও ফযীলত ও ছাওয়াবের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, আগ্রহভরে তা করে যাও। এবং যেসব কাজ সম্পর্কে আল্লাহর অসন্তুষ্টি ও শাস্তির সতর্কবাণী শোনানো হয়েছে, তা থেকে বেঁচে থাকার চেষ্টা করো।
এ হাদীছে ঈমানের সর্বোচ্চ শাখা বলা হয়েছে 'লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ' অর্থাৎ আল্লাহ ছাড়া কোনও মা'বুদ নেই- এ সাক্ষ্য দেওয়াকে। এটা ঈমানের সর্বপ্রধান শাখা। এর অপর নাম তাওহীদ। তাওহীদের প্রতি বিশ্বাস পূর্ণাঙ্গ হয় রিসালাত ও আখিরাতের প্রতি বিশ্বাস দ্বারা। মূলত এসব বিশ্বাস পরস্পর অবিচ্ছেদ্য। একটি ছাড়া অন্যটি গ্রহণযোগ্য নয়। সুতরাং বিশ্বাসগত যতগুলো বিষয় আছে সবগুলোই অন্তরে লালন করা জরুরি।
তাওহীদের বিশ্বাস ঈমানের সর্বপ্রধান শাখা এ কারণে যে, এর উপর সমস্ত আমলের ভিত্তি। এছাড়া কোনও আমলই গ্রহণযোগ্য নয়। দুনিয়ায় মানুষ যত ভালো কাজই করুক, যদি অন্তরের আকীদা-বিশ্বাস সঠিক না থাকে তবে আখিরাতে সেসব কাজের কোনও সুফল পাওয়া যাবে না। হাঁ, কাজ যেহেতু ভালো তাই দুনিয়ায় তাকে তার বদলা দিয়ে দেওয়া হয়। আখিরাতে বদলা পেতে হলে আকীদা-বিশ্বাস ঠিক থাকা জরুরি। আর সেজন্যই একে ঈমানের সর্বোত্তম শাখা বলা হয়েছে।
ঈমানের সর্বনিম্ন শাখা বলা হয়েছে রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক বস্তু দূর করে দেওয়াকে। আপাতদৃষ্টিতে এ আমলটি অতি সামান্য মনে হলেও হাকীকতের দিক থেকে এটি অনেক বড়। কেননা এ কাজটি করা হয় মানুষের প্রতি মমত্ববোধ থেকে। আল্লাহর বান্দাগণ এ পথে যাতায়াত করতে গিয়ে কষ্ট পেতে পারে, সে চিন্তা থেকেই একজন মু'মিন কষ্টদায়ক বস্তুটি সরিয়ে ফেলে। অর্থাৎ সে অন্যের কষ্টকে নিজের কষ্ট মনে করছে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সে শিক্ষাই আমাদের দান করেছেন। তিনি এক হাদীছে বলেন-
الْمُسْلِمُوْنَ كَرَجُلٍ وَاحِدٍ إِنِ اسْتَكى عَيْنُهُ اشْتَكَى كُلُّهُ ، وَإِنِ اشْتَكَى رَأْسُهُ اشْتَكَى كُلُّهُ
মুসলিমগণ সকলে মিলে এক ব্যক্তির মতো, যার চোখ অসুস্থ হলে সারা শরীর অসুস্থ হয়ে পড়ে এবং মাথা অসুস্থ হলে সারা শরীর অসুস্থ হয়ে পড়ে। (সহীহ মুসলিম: ২৫৮৬, ৬৭)
হাদীছে ঈমানের সর্বোত্তম ও সর্বনিম্ন শাখা উল্লেখের পর মধ্যবর্তী শাখাসমূহের মধ্য থেকে কেবল লজ্জার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। লজ্জার এমন কী বিশেষত্ব, যে কারণে অন্যসব শাখা থেকে বাছাই করে কেবল এর কথাই উল্লেখ করা হল? এর উত্তর মেলে অন্য এক হাদীছে। তাতে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
إِنَّ مِمَّا أَدْرَكَ النَّاسُ مِنْ كَلَامِ النُّبُوَّةِ الْأُولَى إِذَا لَمْ تَسْتَحْيِ فَاصْنَعْ مَا شِئْتَ
মানুষ পূর্ববর্তী নবুওয়াতের যে বাণী লাভ করেছে (অর্থাৎ পূর্ববর্তী নবীদের যে শিক্ষা এ পর্যন্ত পৌছেছে) তা হচ্ছে- তুমি যদি লজ্জাই না কর, তবে যা চাও করতে পার। (সহীহ বুখারী: ৩৪৮৩; আল-আদাবুল মুফরাদ: ৫৯৭; মুসনাদে আহমাদ: ১৭০৯১; মুআত্তা মালিক: ৫৪৫; সুনানে ইবন মাজাহ: ৪১৮২: সনানে আব দাউদ: ৪৭৯৭)
অর্থাৎ যে ব্যক্তির লজ্জা নেই সে হেন কাজ নেই যা করতে পারে না। যে-কোনও অন্যায়-অপরাধ লজ্জাহীন মানুষ অবলীলায় করতে পারে। কিন্তু যে ব্যক্তির লজ্জা আছে, সে সহজে অন্যায়-অপরাধে লিপ্ত হতে পারে না। লজ্জা তার সামনে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। যখনই কোনও মন্দ কাজ করার ইচ্ছা জাগে, তখন লোকে দেখলে কী বলবে এই অনুভূতি তাকে সে কাজ করতে দেয় না। সে মনের ইচ্ছা মনেই দমন করে ফেলে। মানুষকে লজ্জা করার কারণেই যখন মানুষ এভাবে পাপ কাজ থেকে দূরে থাকে, তখন যে ব্যক্তি আল্লাহ তা'আলাকে লজ্জা করবে সে তো কোনওক্রমেই পাপ কাজের ধারেকাছে যাবে না।
মূলত আল্লাহ তা'আলাকে লজ্জা করাই প্রকৃত লজ্জা। তাই উলামায়ে কেরাম লজ্জার ব্যাখ্যা দেন- أَنْ لَا يَرَى مَوْلَاكَ فِيْمَا نَهَاكَ عَنْهُ ‘লজ্জা হল এই যে, তোমার মাওলা যেন তোমাকে এমন কাজে না দেখেন, যা করতে তিনি তোমাকে নিষেধ করেছেন'
প্রকাশ থাকে যে, শরী'আতের আদেশ নিষেধ পালনে যে লজ্জা বাধা হয় তা আদৌ লজ্জা নয়; তা ঈমানের দুর্বলতা। প্রকৃত লজ্জা তো তাই, যা লোকে কী বলবে না বলবে তা উপেক্ষা করে মানুষকে শরী'আতের হুকুম মানতে উৎসাহিত করে। তাই তো হযরত আব্দুল্লাহ ইবন মাসউদ রাযি. বর্ণিত এক হাদীছে আছে-
قَالَ رَسُولُ اللَّهِ ﷺ استَحيوا منَ اللَّهِ حقَّ الحياءِ ، قُلنا : يا رسولَ اللَّهِ إنَّا لنَستحيي والحمد لله ، قالَ : ليسَ ذاكَ ، ولَكِنَّ الاستحياءَ منَ اللَّهِ حقَّ الحياءِ أن تحفَظ الرَّأسَ ، وما وَعى ، وتحفَظَ البَطنَ ، وما حوَى ، ولتَذكرِ الموتَ والبِلى ، ومَن أرادَ الآخرةَ ترَكَ زينةَ الدُّنيا ، فمَن فَعلَ ذلِكَ فقدَ استحيا يعني : منَ اللَّهِ حقَّ الحياءِ
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদিন বললেন, তোমরা আল্লাহকে লজ্জা করো যথার্থ লজ্জার সাথে। হযরত ইবন মাস'ঊদ রাযি. বলেন, আমরা বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আল্লাহর শোকর যে, আমরা লজ্জা করি। তিনি বললেন, ওই লজ্জা নয়; বরং আল্লাহ তা'আলাকে যথার্থ লজ্জা করা হল এই যে, তুমি হেফাজত করবে নিজ মাথা এবং মাথা যা চিন্তা-ভাবনা করে, নিজ উদর এবং উদর যা ধারণ করে। আর স্মরণ করবে মৃত্যু এবং মৃত্যুর পর পচে-গলে যাওয়াকে। যে ব্যক্তি আখিরাত কামনা করে সে দুনিয়ার সাজসজ্জা পরিত্যাগ করে। যে ব্যক্তি এসব করল, সে-ই আল্লাহকে যথার্থভাবে লজ্জা করল। (জামে' তিরমিযী: ২৪৫৮; মুসনাদে আহমাদ: ৩৬৭১; তাবারানী, আল-মু'জামুল কাবীর : ৩১৯২; মুসতাদরাক হাকিম: ৭৯১৫; বাগাবী, শারহুস্-সুন্নাহ: ৪০৩৩)
অর্থাৎ প্রকৃত লজ্জা এই যে, আল্লাহ তা'আলা যা পসন্দ করেন না ও ভালোবাসেন না, তা পরিত্যাগ করা হবে। যা-কিছুই করা হবে বা ত্যাগ করা হবে, তাতে কেবল তাঁরই ভয় কার্যকর থাকবে এবং কেবল তাঁরই সন্তুষ্টি কামনা করা হবে। আর এজন্য প্রত্যেকটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ও প্রত্যেক শক্তি-সামর্থ্যকে আল্লাহর অপসন্দনীয় সবকিছু থেকে হেফাজত করা হবে এবং তিনি যা-কিছু পসন্দ করেন কেবল তাতেই ব্যবহার করা হবে। এমনিভাবে বিশ্বাস করা হবে দুনিয়া অপেক্ষা আখিরাতই উত্তম, আখিরাতই স্থায়ী। আর সে বিশ্বাসের পরিপ্রেক্ষিতে দুনিয়ার ভোগ-বিলাস ও অনুরাগ-আসক্তি পরিহার করে আখিরাতের নাজাত ও মুক্তির লক্ষ্যেই যাবতীয় কর্ম সম্পাদন করা হবে।
বস্তুত লজ্জা মু'মিনের শোভা। এটা কেবল নারীর নয়; নর-নারী সকলের মধ্যেই থাকা উচিত। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক হাদীছে ইরশাদ করেন-
مَا كَانَ الْحَيَاءُ فِي شَيْءٍ إِلَّا زَانَهُ وَلَا كَانَ الْفُحْشُ فِي شَيْءٍ إِلَّا شَانَه
যে-কোনও বস্তুতে লজ্জা থাকে, তা তাকে শোভা দান করে। আর যে বস্তুতেই নির্লজ্জতা থাকে, তা তাকে অশোভন করে তোলে। (আল-আদাবুল মুফরাদ : ৬০১; মুসনাদে আহমাদ: ১২৬৮৮; জামে তিরমিযী: ১৯৭৪)
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে এক বর্ণনায় আছে-
وَلَوْ كَانَ الْحَيَاءُ رَجُلًا لَكَانَ رَجُلًا صَالِحًا
লজ্জাশীলতা যদি কোনও পুরুষ হত, তবে সে একজন সুপুরুষ হত। (বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান: ৭৩২৬; তাবারানী, আল মু'জামুল আওসাত: ৪৭১৮)
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. এ হাদীছ দ্বারা জানা গেল ঈমানের অনেক শাখা আছে। ঈমানের সমস্ত আদেশ-নিষেধ মেনে চলাই হচ্ছে ঈমানের শাখা-প্রশাখা। সুতরাং পরিপূর্ণ মু'মিন হতে হলে শরী'আতের সমস্ত আদেশ-নিষেধ মেনে চলতে হবে।
খ. আরও জানা গেল রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক জিনিস সরিয়ে ফেলা ঈমানের সর্বনিম্ন শাখা। তাই প্রত্যেকের কর্তব্য রাস্তায় কোনও কষ্টদায়ক জিনিস চোখে পড়লে তা অবশ্যই সরিয়ে ফেলা এবং নিজে কিছুতেই রাস্তায় কোনও কষ্টদায়ক জিনিস না ফেলা।
গ. লজ্জাশীলতা যেহেতু ঈমানের অতি গুরুত্বপূর্ণ শাখা, তাই মু'মিনের কর্তব্য তার সকল কাজে লজ্জাশীলতার পরিচয় দেওয়া।
এ হাদীছে ঈমানের শাখা বলা হয়েছে ষাট অথবা সত্তরটির কিছু বেশি। এ সংখ্যা দ্বারা মূলত সুনির্দিষ্ট অংক বোঝানো উদ্দেশ্য নয়; বরং বোঝানো উদ্দেশ্য সংখ্যাধিক্য। অর্থাৎ ঈমানের অনেকগুলো শাখা আছে। সুতরাং ষাট বা সত্তরের সুনির্দিষ্ট সংখ্যা মেলানোর চেষ্টা বৃথা।
এ হাদীছ দ্বারা মূলত বোঝানো উদ্দেশ্য ঈমানের শাখা অনেকগুলো। সুতরাং তোমরা সামান্য কিছু আমল নিয়ে বসে থেকো না; বরং কুরআন-হাদীছে যত সৎকর্মের কথা বলা হয়েছে সবগুলো করার চেষ্টা করো। তবেই পূর্ণাঙ্গ মু'মিন হতে পারবে। কুরআন ও হাদীছে যেসব কাজ সম্পর্কে কোনও ফযীলত ও ছাওয়াবের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, আগ্রহভরে তা করে যাও। এবং যেসব কাজ সম্পর্কে আল্লাহর অসন্তুষ্টি ও শাস্তির সতর্কবাণী শোনানো হয়েছে, তা থেকে বেঁচে থাকার চেষ্টা করো।
এ হাদীছে ঈমানের সর্বোচ্চ শাখা বলা হয়েছে 'লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ' অর্থাৎ আল্লাহ ছাড়া কোনও মা'বুদ নেই- এ সাক্ষ্য দেওয়াকে। এটা ঈমানের সর্বপ্রধান শাখা। এর অপর নাম তাওহীদ। তাওহীদের প্রতি বিশ্বাস পূর্ণাঙ্গ হয় রিসালাত ও আখিরাতের প্রতি বিশ্বাস দ্বারা। মূলত এসব বিশ্বাস পরস্পর অবিচ্ছেদ্য। একটি ছাড়া অন্যটি গ্রহণযোগ্য নয়। সুতরাং বিশ্বাসগত যতগুলো বিষয় আছে সবগুলোই অন্তরে লালন করা জরুরি।
তাওহীদের বিশ্বাস ঈমানের সর্বপ্রধান শাখা এ কারণে যে, এর উপর সমস্ত আমলের ভিত্তি। এছাড়া কোনও আমলই গ্রহণযোগ্য নয়। দুনিয়ায় মানুষ যত ভালো কাজই করুক, যদি অন্তরের আকীদা-বিশ্বাস সঠিক না থাকে তবে আখিরাতে সেসব কাজের কোনও সুফল পাওয়া যাবে না। হাঁ, কাজ যেহেতু ভালো তাই দুনিয়ায় তাকে তার বদলা দিয়ে দেওয়া হয়। আখিরাতে বদলা পেতে হলে আকীদা-বিশ্বাস ঠিক থাকা জরুরি। আর সেজন্যই একে ঈমানের সর্বোত্তম শাখা বলা হয়েছে।
ঈমানের সর্বনিম্ন শাখা বলা হয়েছে রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক বস্তু দূর করে দেওয়াকে। আপাতদৃষ্টিতে এ আমলটি অতি সামান্য মনে হলেও হাকীকতের দিক থেকে এটি অনেক বড়। কেননা এ কাজটি করা হয় মানুষের প্রতি মমত্ববোধ থেকে। আল্লাহর বান্দাগণ এ পথে যাতায়াত করতে গিয়ে কষ্ট পেতে পারে, সে চিন্তা থেকেই একজন মু'মিন কষ্টদায়ক বস্তুটি সরিয়ে ফেলে। অর্থাৎ সে অন্যের কষ্টকে নিজের কষ্ট মনে করছে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সে শিক্ষাই আমাদের দান করেছেন। তিনি এক হাদীছে বলেন-
الْمُسْلِمُوْنَ كَرَجُلٍ وَاحِدٍ إِنِ اسْتَكى عَيْنُهُ اشْتَكَى كُلُّهُ ، وَإِنِ اشْتَكَى رَأْسُهُ اشْتَكَى كُلُّهُ
মুসলিমগণ সকলে মিলে এক ব্যক্তির মতো, যার চোখ অসুস্থ হলে সারা শরীর অসুস্থ হয়ে পড়ে এবং মাথা অসুস্থ হলে সারা শরীর অসুস্থ হয়ে পড়ে। (সহীহ মুসলিম: ২৫৮৬, ৬৭)
হাদীছে ঈমানের সর্বোত্তম ও সর্বনিম্ন শাখা উল্লেখের পর মধ্যবর্তী শাখাসমূহের মধ্য থেকে কেবল লজ্জার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। লজ্জার এমন কী বিশেষত্ব, যে কারণে অন্যসব শাখা থেকে বাছাই করে কেবল এর কথাই উল্লেখ করা হল? এর উত্তর মেলে অন্য এক হাদীছে। তাতে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
إِنَّ مِمَّا أَدْرَكَ النَّاسُ مِنْ كَلَامِ النُّبُوَّةِ الْأُولَى إِذَا لَمْ تَسْتَحْيِ فَاصْنَعْ مَا شِئْتَ
মানুষ পূর্ববর্তী নবুওয়াতের যে বাণী লাভ করেছে (অর্থাৎ পূর্ববর্তী নবীদের যে শিক্ষা এ পর্যন্ত পৌছেছে) তা হচ্ছে- তুমি যদি লজ্জাই না কর, তবে যা চাও করতে পার। (সহীহ বুখারী: ৩৪৮৩; আল-আদাবুল মুফরাদ: ৫৯৭; মুসনাদে আহমাদ: ১৭০৯১; মুআত্তা মালিক: ৫৪৫; সুনানে ইবন মাজাহ: ৪১৮২: সনানে আব দাউদ: ৪৭৯৭)
অর্থাৎ যে ব্যক্তির লজ্জা নেই সে হেন কাজ নেই যা করতে পারে না। যে-কোনও অন্যায়-অপরাধ লজ্জাহীন মানুষ অবলীলায় করতে পারে। কিন্তু যে ব্যক্তির লজ্জা আছে, সে সহজে অন্যায়-অপরাধে লিপ্ত হতে পারে না। লজ্জা তার সামনে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। যখনই কোনও মন্দ কাজ করার ইচ্ছা জাগে, তখন লোকে দেখলে কী বলবে এই অনুভূতি তাকে সে কাজ করতে দেয় না। সে মনের ইচ্ছা মনেই দমন করে ফেলে। মানুষকে লজ্জা করার কারণেই যখন মানুষ এভাবে পাপ কাজ থেকে দূরে থাকে, তখন যে ব্যক্তি আল্লাহ তা'আলাকে লজ্জা করবে সে তো কোনওক্রমেই পাপ কাজের ধারেকাছে যাবে না।
মূলত আল্লাহ তা'আলাকে লজ্জা করাই প্রকৃত লজ্জা। তাই উলামায়ে কেরাম লজ্জার ব্যাখ্যা দেন- أَنْ لَا يَرَى مَوْلَاكَ فِيْمَا نَهَاكَ عَنْهُ ‘লজ্জা হল এই যে, তোমার মাওলা যেন তোমাকে এমন কাজে না দেখেন, যা করতে তিনি তোমাকে নিষেধ করেছেন'
প্রকাশ থাকে যে, শরী'আতের আদেশ নিষেধ পালনে যে লজ্জা বাধা হয় তা আদৌ লজ্জা নয়; তা ঈমানের দুর্বলতা। প্রকৃত লজ্জা তো তাই, যা লোকে কী বলবে না বলবে তা উপেক্ষা করে মানুষকে শরী'আতের হুকুম মানতে উৎসাহিত করে। তাই তো হযরত আব্দুল্লাহ ইবন মাসউদ রাযি. বর্ণিত এক হাদীছে আছে-
قَالَ رَسُولُ اللَّهِ ﷺ استَحيوا منَ اللَّهِ حقَّ الحياءِ ، قُلنا : يا رسولَ اللَّهِ إنَّا لنَستحيي والحمد لله ، قالَ : ليسَ ذاكَ ، ولَكِنَّ الاستحياءَ منَ اللَّهِ حقَّ الحياءِ أن تحفَظ الرَّأسَ ، وما وَعى ، وتحفَظَ البَطنَ ، وما حوَى ، ولتَذكرِ الموتَ والبِلى ، ومَن أرادَ الآخرةَ ترَكَ زينةَ الدُّنيا ، فمَن فَعلَ ذلِكَ فقدَ استحيا يعني : منَ اللَّهِ حقَّ الحياءِ
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদিন বললেন, তোমরা আল্লাহকে লজ্জা করো যথার্থ লজ্জার সাথে। হযরত ইবন মাস'ঊদ রাযি. বলেন, আমরা বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আল্লাহর শোকর যে, আমরা লজ্জা করি। তিনি বললেন, ওই লজ্জা নয়; বরং আল্লাহ তা'আলাকে যথার্থ লজ্জা করা হল এই যে, তুমি হেফাজত করবে নিজ মাথা এবং মাথা যা চিন্তা-ভাবনা করে, নিজ উদর এবং উদর যা ধারণ করে। আর স্মরণ করবে মৃত্যু এবং মৃত্যুর পর পচে-গলে যাওয়াকে। যে ব্যক্তি আখিরাত কামনা করে সে দুনিয়ার সাজসজ্জা পরিত্যাগ করে। যে ব্যক্তি এসব করল, সে-ই আল্লাহকে যথার্থভাবে লজ্জা করল। (জামে' তিরমিযী: ২৪৫৮; মুসনাদে আহমাদ: ৩৬৭১; তাবারানী, আল-মু'জামুল কাবীর : ৩১৯২; মুসতাদরাক হাকিম: ৭৯১৫; বাগাবী, শারহুস্-সুন্নাহ: ৪০৩৩)
অর্থাৎ প্রকৃত লজ্জা এই যে, আল্লাহ তা'আলা যা পসন্দ করেন না ও ভালোবাসেন না, তা পরিত্যাগ করা হবে। যা-কিছুই করা হবে বা ত্যাগ করা হবে, তাতে কেবল তাঁরই ভয় কার্যকর থাকবে এবং কেবল তাঁরই সন্তুষ্টি কামনা করা হবে। আর এজন্য প্রত্যেকটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ও প্রত্যেক শক্তি-সামর্থ্যকে আল্লাহর অপসন্দনীয় সবকিছু থেকে হেফাজত করা হবে এবং তিনি যা-কিছু পসন্দ করেন কেবল তাতেই ব্যবহার করা হবে। এমনিভাবে বিশ্বাস করা হবে দুনিয়া অপেক্ষা আখিরাতই উত্তম, আখিরাতই স্থায়ী। আর সে বিশ্বাসের পরিপ্রেক্ষিতে দুনিয়ার ভোগ-বিলাস ও অনুরাগ-আসক্তি পরিহার করে আখিরাতের নাজাত ও মুক্তির লক্ষ্যেই যাবতীয় কর্ম সম্পাদন করা হবে।
বস্তুত লজ্জা মু'মিনের শোভা। এটা কেবল নারীর নয়; নর-নারী সকলের মধ্যেই থাকা উচিত। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক হাদীছে ইরশাদ করেন-
مَا كَانَ الْحَيَاءُ فِي شَيْءٍ إِلَّا زَانَهُ وَلَا كَانَ الْفُحْشُ فِي شَيْءٍ إِلَّا شَانَه
যে-কোনও বস্তুতে লজ্জা থাকে, তা তাকে শোভা দান করে। আর যে বস্তুতেই নির্লজ্জতা থাকে, তা তাকে অশোভন করে তোলে। (আল-আদাবুল মুফরাদ : ৬০১; মুসনাদে আহমাদ: ১২৬৮৮; জামে তিরমিযী: ১৯৭৪)
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে এক বর্ণনায় আছে-
وَلَوْ كَانَ الْحَيَاءُ رَجُلًا لَكَانَ رَجُلًا صَالِحًا
লজ্জাশীলতা যদি কোনও পুরুষ হত, তবে সে একজন সুপুরুষ হত। (বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান: ৭৩২৬; তাবারানী, আল মু'জামুল আওসাত: ৪৭১৮)
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. এ হাদীছ দ্বারা জানা গেল ঈমানের অনেক শাখা আছে। ঈমানের সমস্ত আদেশ-নিষেধ মেনে চলাই হচ্ছে ঈমানের শাখা-প্রশাখা। সুতরাং পরিপূর্ণ মু'মিন হতে হলে শরী'আতের সমস্ত আদেশ-নিষেধ মেনে চলতে হবে।
খ. আরও জানা গেল রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক জিনিস সরিয়ে ফেলা ঈমানের সর্বনিম্ন শাখা। তাই প্রত্যেকের কর্তব্য রাস্তায় কোনও কষ্টদায়ক জিনিস চোখে পড়লে তা অবশ্যই সরিয়ে ফেলা এবং নিজে কিছুতেই রাস্তায় কোনও কষ্টদায়ক জিনিস না ফেলা।
গ. লজ্জাশীলতা যেহেতু ঈমানের অতি গুরুত্বপূর্ণ শাখা, তাই মু'মিনের কর্তব্য তার সকল কাজে লজ্জাশীলতার পরিচয় দেওয়া।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)