রিয়াযুস সালিহীন-ইমাম নববী রহঃ
২. বিবিধ আদব - শিষ্টাচারের অধ্যায়
হাদীস নং: ৬৮৮
বিবিধ আদব - শিষ্টাচারের অধ্যায়
প্রতিশ্রুতি পূরণ করা ও ওয়াদা রক্ষা করা
العَهْدُ অর্থ অঙ্গীকার, প্রতিশ্রুতি। পরিভাষায় শর্তযুক্ত ওয়াদাকে العَهْدُ বলে। যেমন তুমি পরীক্ষায় ১ম বিভাগে উত্তীর্ণ হলে তোমাকে এই কিতাবটি পুরস্কার দেব, তুমি আমার বাড়ি বেড়াতে আসলে আমিও তোমার বাড়ি বেড়াতে যাব, তুমি তার দেনা পরিশোধ করলে আমি তোমাকে সে পরিমাণ অর্থ দিয়ে দেব ইত্যাদি। অঙ্গীকার পূরণ করা ওয়াজিব ও অবশ্যকর্তব্য। তা পূরণ না করা কঠিন পাপ। আখিরাতে এ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে।
الْوَعْدُ অর্থ ওয়াদা। এটা শর্তবিহীন হয়ে থাকে। যেমন বলল, আমি তোমাকে এই কিতাবখানি দেব, আমি তোমাকে এত টাকা ঋণ দেব, আমি তোমার বাড়ি বেড়াতে যাব, আমি অমুক রোগীকে দেখতে যাব, আমি তার চিকিৎসার খরচ দেব ইত্যাদি। এটা এক রকম হাদিয়া ও উপহার, যা পূরণ করা ওয়াজিব নয়। কাজেই তা পূরণ না করলে কোনও গুনাহও হবে না। অবশ্য ওয়াদা করার সময় যদি মনে মনে তা পূরণ না করার নিয়ত থাকে, তবে অবশ্যই গুনাহ হবে। কেননা সে ক্ষেত্রে ওয়াদাটি মিথ্যা কথার অন্তর্ভুক্ত হবে। মিথ্যা বলা কঠিন গুনাহ। যদি পূরণ করার নিয়ত থাকে আর পরে মন ঘুরে যায় এবং সে কারণে ওয়াদা পূরণ না করে, তবে কোনও গুনাহ হবে না। হাঁ, মানুষের মুখের কথার মূল্য আছে। তাই ওয়াদা যখন করা হয়েছে, তখন পূরণ করাই বাঞ্ছনীয়। বলা হয়ে থাকে- اَلْكَرِيمُ إِذَا وَعَدَ وَفَى (ভদ্র লোক যখন কোনও বিষয়ে ওয়াদা করে, তা পূরণ করে)। হযরত ইসমা'ঈল আলাইহিস সালাম ওয়াদাপূরণে খুব বেশি যত্নবান ছিলেন। তাই কুরআন মাজীদে তাঁর প্রশংসা করে বলা হয়েছে-
إِنَّهُ كَانَ صَادِقَ الْوَعْدِ وَكَانَ رَسُولًا نَبِيًّا
‘নিশ্চয়ই সে ছিল ওয়াদার ক্ষেত্রে সত্যবাদী এবং রাসূল ও নবী।(সূরা মারয়াম (১৯), আয়াত ৫৪)
প্রকাশ থাকে যে, শরী'আতবিরোধী কোনও কাজের ওয়াদা করলে তা রক্ষা করা নয়। বরং সে ওয়াদা ভঙ্গ করাই জরুরি। যেমন বলল, তোমরা এখানে কনসার্টের আয়োজন করো, খরচ আমি দেব। এ ওয়াদাটি সম্পূর্ণ শরী'আতবিরোধী। তাই এটা পূরণ করা জরুরি তো নয়ই, জায়েযও নয়।
আমাদের দীনে অন্যান্য বিষয়ের মতো আখলাক-চরিত্রেরও পূর্ণাঙ্গ শিক্ষাদান করা হয়েছে। সে শিক্ষার এক গুরুত্বপূর্ণ দিক হল প্রতিশ্রুতি ও ওয়াদা রক্ষা। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে প্রতিশ্রুতি রক্ষা ও ওয়াদা পূরণে অত্যন্ত সচেতন ছিলেন। তিনি সাহাবায়ে কেরামকেও এ বিষয়ে সচেতন করে তুলেছিলেন। তাই তাঁরা কখনও প্রতিশ্রুতি ও ওয়াদার বরখেলাপ করতেন না। তাঁদের অনুসরণে প্রত্যেক মুসলিমেরই এ বিষয়ে সচেতন থাকা উচিত। সে লক্ষ্যেই বর্তমান পরিচ্ছেদে এ বিষয় সম্পর্কিত কয়েকটি আয়াত ও হাদীছ উল্লেখ করা হয়েছে। আমরা তার বঙ্গানুবাদ ও সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা পেশ করছি। আল্লাহ তা'আলাই তাওফীকদাতা।
‘প্রতিশ্রুতি পূরণ করা ও ওয়াদা রক্ষা করা’ সম্পর্কিত কিছু আয়াত
এক নং আয়াত
وَأَوْفُوا بِالْعَهْدِ إِنَّ الْعَهْدَ كَانَ مَسْئُولًا
অর্থ: আর অঙ্গীকার পূরণ করো। নিশ্চয়ই অঙ্গীকার সম্পর্কে (তোমাদের) জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।(সূরা বনী ইসরাঈল (১৭), আয়াত ৩৪)
ব্যাখ্যা
এ আয়াতটি ৮৫ নং অধ্যায়ে গত হয়েছে। সেখানে এর ব্যাখ্যা দ্রষ্টব্য।
দুই নং আয়াত
وَأَوْفُوا بِعَهْدِ اللَّهِ إِذَا عَاهَدْتُمْ
অর্থ: তোমরা যখন কোনও অঙ্গীকার কর, তখন আল্লাহর সঙ্গে কৃত অঙ্গীকার পূর্ণ করো।(সূরা নাহল (১৬), আয়াত ৯১)
ব্যাখ্যা
আল্লাহর সঙ্গে কৃত অঙ্গীকার বলতে শরী'আতের বিধানাবলি বোঝানো হয়েছে। বান্দা যখন ঈমান এনেছে অর্থাৎ স্বীকার করে নিয়েছে যে, আল্লাহ ছাড়া কোনও মা'বৃদ নেই এবং হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর বান্দা ও রাসূল, তখন এর মাধ্যমে সে যেন এ অঙ্গীকারে আবদ্ধ হয়ে গেছে যে, আল্লাহ তা'আলা তাঁর রাসূলের মাধ্যমে যে দীন ও শরী'আত দান করেছেন সে তা পুরোপুরি মেনে চলবে। আয়াতে একেই 'আল্লাহর সঙ্গে কৃত অঙ্গীকার' শব্দে ব্যক্ত করা হয়েছে। তাছাড়া মানুষ একে অন্যের সঙ্গে যে অঙ্গীকার বা চুক্তি করে, তাও এর অন্তর্ভুক্ত। কেননা আল্লাহ তা'আলার পক্ষ থেকে তা রক্ষা করারও নির্দেশ রয়েছে।
আয়াতটির শিক্ষা
অঙ্গীকার রক্ষা ইসলামের এক গুরুত্বপূর্ণ হুকুম। সুতরাং তা অবশ্যই রক্ষা করতে হবে।
তিন নং আয়াত
يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَوْفُوا بِالْعُقُودِ
অর্থ: হে মুমিনগণ! তোমরা অঙ্গীকার পূরণ করো।(সূরা মায়িদা (৫), আয়াত ১)
ব্যাখ্যা
عُقُودٌ শব্দটি عَقْدٌ এর বহুবচন। এর অর্থ অঙ্গীকার, ওয়াদা ও চুক্তি। আয়াতে ব্যাপকভাবে সর্বপ্রকার অঙ্গীকার ও চুক্তি পূরণের হুকুম দেওয়া হয়েছে। সুতরাং শরী'আতের বিধানাবলি, বেচাকেনা, আমানত, ইজারা, ঋণ, বন্ধক, বিবাহ এবং দুই দেশ বা দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্পাদিত যে-কোনও চুক্তি এর অন্তর্ভুক্ত। সুতরাং এ আয়াতের হুকুম মোতাবেক দুই পক্ষের মধ্যে সম্পাদিত যে-কোনও অঙ্গীকার বা চুক্তি রক্ষা করা অবশ্যকর্তব্য।
আল্লাহ তা'আলা ঈমানদারদেরকে ডাক দিয়ে অঙ্গীকার পূরণের হুকুম দিয়েছেন। এর মধ্যে ইঙ্গিত রয়েছে অঙ্গীকার পূরণ করা ঈমানেরই দাবি। সুতরাং এক হাদীছে ইরশাদ হয়েছে-
لَا إِيْمَانَ لِمَنْ لَا أَمَانَةَ لَهُ ، وَلَا دِيْنَ لِمَنْ لَا عَهْدَ لَهُ
‘ওই ব্যক্তির ঈমান নেই, যার আমানতদারি নেই এবং ওই ব্যক্তির দীন নেই, যে অঙ্গীকার রক্ষা করে না।(সহীহ ইবনে হিব্বান: ১৯৪; মুসান্নাফে ইবন আবী শায়বা: ৩০৪০১; মুসনাদুল বাযযার: ৭১৯৬ মুসনাদে আবু ইয়া'লা: ২৪৫৮; তহাবী, শারহু মুশকিলিল আছার ৪৬৯৩; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর: ১০৫৫৩; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা: ১২৬৯০; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ ৩৯)
ঈমানদারদের লক্ষ্য করে অঙ্গীকার ও চুক্তি রক্ষার হুকুম দেওয়ার দ্বারা এদিকেও ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, কেবল ওইসকল অঙ্গীকার রক্ষা করাই জরুরি, যা ঈমানের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। সুতরাং কেউ যদি কারও সঙ্গে শরী'আতবিরোধী কোনও ওয়াদা বা চুক্তি করে, তবে তা রক্ষা করা জরুরি নয়। বরং সে চুক্তি ভঙ্গ করাই জরুরি। যেমন সুদ-ঘুষের চুক্তি।
আয়াতটির শিক্ষা
ক. ওয়াদা বা চুক্তি রক্ষা করা ঈমানের দাবি। সুতরাং প্রত্যেক মুমিনকে চুক্তি রক্ষায় যত্নবান থাকতে হবে।
খ. যেসব ওয়াদা ও চুক্তি শরী'আতসম্মত নয়, তা রক্ষা করাও জরুরি নয়।
চার নং আয়াত
يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لِمَ تَقُولُونَ مَا لَا تَفْعَلُونَ (2) كَبُرَ مَقْتًا عِنْدَ اللَّهِ أَنْ تَقُولُوا مَا لَا تَفْعَلُونَ (3)
অর্থ: হে মুমিনগণ! তোমরা এমন কথা কেন বল, যা কর না? আল্লাহর কাছে এ বিষয়টা অতি ঘৃণ্য যে, তোমরা এমন কথা বলবে, যা তোমরা কর না।(সূরা সাফ্ফ (৬১), আয়াত ২-৩)
ব্যাখ্যা
আয়াতটির সম্পর্ক তিন শ্রেণির লোকের সঙ্গে। ক. যারা ভালো ভালো কাজ করবে বলে ওয়াদা করে, কিন্তু পরে সে ওয়াদা রক্ষা করে না। খ. যারা ভালো ভালো কাজ করেছে বলে প্রকাশ করে, কিন্তু বাস্তবে তা করেনি। গ. যারা ভালো ভালো কাজের উপদেশ ও নসীহত করে, কিন্তু নিজেরা সে অনুযায়ী আমল করে না।
এক শ্রেণির লোক আছে, যারা বিশেষ বিশেষ পরিস্থিতিতে বড় গলায় বলে ওঠে যে, সময় আসলে দেখিয়ে দেব আমি কী করতে পারি। পরে যখন সময় আসে, তখন তাদেরকে ধারেকাছেও পাওয়া যায় না। এমনকি বদর যুদ্ধের পরও কতক সাহাবীর বেলায় এমনটা ঘটেছিল। তারা বলেছিলেন, বদর যুদ্ধ হঠাৎ করেই হয়ে যাওয়ায় আমরা তাতে শরীক হতে পারিনি। ভবিষ্যতে যদি কখনও এমন যুদ্ধের অবকাশ আসে, তখন আমরা দেখিয়ে দেব কেমন জানপ্রাণ দিয়ে লড়াই করি।
কোনও কোনও লোক বলেছিল, আমরা যদি জানতে পারতাম কোন আমল আল্লাহর কাছে বেশি প্রিয়, তবে আমরা তা করতাম। আল্লাহ তা'আলা জানিয়ে দেন যে, আল্লাহ তা'আলার কাছে জিহাদই সবচে' প্রিয় আমল। কিন্তু তাদের কাছে এটা খুব কঠিন মনে হল। ফলে যখনই জিহাদের ডাক আসল, তারা তা থেকে পিছিয়ে থাকল।
মুনাফিকদের তো এটা সব সময়কার অভ্যাস। তারা ভালো কাজের ওয়াদা করে, কিন্তু বাস্তবে তা করে না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যমানায়ও এরকম ছিল। তারা মুমিনদের বলত, তোমরা যখন যুদ্ধে যাবে, তখন আমরাও তোমাদের সঙ্গে যাব এবং তোমাদের সাহায্য করব। কিন্তু তারা এক তো যুদ্ধে যেতই না, আবার গেলেও তারা সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করত না। সর্বদাই তারা অসহযোগিতা করত। এটা সুস্পষ্টই ওয়াদা খেলাফি ও নীতিভ্রষ্টতা। এদেরকে তিরস্কার করে আল্লাহ তা'আলা বলেন- لِمَ تَقُوْلُوْنَ مَا لَا تَفْعَلُوْنَ (তোমরা এমন কথা কেন বল, যা কর না)। অর্থাৎ এমন ওয়াদা কেন কর বা এমন প্রতিশ্রুতি কেন দাও, যা তোমরা পূরণ কর না?
কিছু লোক এমনও আছে, যারা মুখে বলে বেড়ায় আমরা তাহাজ্জুদ পড়ি, আল্লাহর পথে দান-খয়রাত করি, অমুক মসজিদটি আমাদের করা, অমুক সেতুটি আমরাই করে দিয়েছি, আমরা এই করেছি সেই করেছি। বাস্তবে কিছুই করেনি। অনেকেই বলে থাকে আমি অনেক ধৈর্য ধরেছি, আর নয়। বাস্তবে মোটেই ধৈর্য ধরেনি। বলে থাকে, আমি তাকে অনেক বুঝিয়েছি, অনেক দরদের সঙ্গে উপদেশ দিয়েছি। প্রকৃতপক্ষে সে এর কিছুই করেনি। অনেক সময় তারা হাবভাব দ্বারাও এ জাতীয় কাজ করে থাকে বলে বোঝানোর চেষ্টা করে। প্রকৃতপক্ষে তারা আদৌ তা করে না। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যমানায় মুনাফিকরা এরকমই ছিল। কিছুই না করেও 'করেছি' বলে প্রচার করত। আল্লাহ তা'আলা বলছেন- لِمَ تَقُوْلُوْنَ مَا لَا تَفْعَلُونَ (তোমরা এমন কথা কেন বল, যা কর না)। অর্থাৎ বাস্তবে যা করনি, তা করেছ বলে প্রচার করছ কেন?
এমনিভাবে বেআমল ওয়ায়েজদের জন্যও আয়াতটি প্রযোজ্য। অনেক ওয়াজ- নসীহতকারী মানুষকে ভালো ভালো কাজের উপদেশ দেয়। বিভিন্ন নেক আমলের ফযীলত বলে মানুষকে তা করার প্রতি উৎসাহ যোগায়। কিন্তু নিজেদের আমল নেই। নিজেরা সেসব আমল থেকে অনেক দূরে। আল্লাহ তা'আলা বলছেন- لِمَ تَقُوْلُوْنَ مَا لَا تَفْعَلُوْنَ (তোমরা এমন কথা কেন বল, যা কর না)। অর্থাৎ যেসব নেক আমল নিজেরা কর না, মানুষকে তার উপদেশ দাও কেন? যেমন অপর এক আয়াতে আছে-
أَتَأْمُرُونَ النَّاسَ بِالْبِرِّ وَتَنْسَوْنَ أَنْفُسَكُمْ
‘তোমরা কি অন্য লোকদেরকে পুণ্যের আদেশ কর আর নিজেদেরকে ভুলে যাও?'(সূরা বাকারা (২), আয়াত ৪৪)
এর দ্বারা এ কথা বোঝানো উদ্দেশ্য নয় যে, আমল নেই বলে ওয়াজ করা যাবে না। বরং উদ্দেশ্য হল মানুষকে যখন ভালো কাজের উপদেশ দিচ্ছ, তখন তোমাদের নিজেদেরও সে অনুযায়ী আমল করা উচিত।
মোটকথা ভালো কাজের প্রতিশ্রুতি দিয়ে সে প্রতিশ্রুতি রক্ষা না করা, ভালো কাজ না করেও 'করেছি' বলে প্রচার করা এবং নিজে নেক আমলে উদাসীন থেকে অন্যদের ওয়াজ-নসীহত করা নিন্দনীয় কাজ। আল্লাহ তা'আলা এ আয়াতে এদের সকলকেই তিরস্কার করেছেন। কাজেই এর থেকে সকলেরই বিরত থাকা উচিত। কেননা যারা এরূপ করে, আল্লাহ তা'আলা তাদের প্রতি নারাজ হন। আয়াতে আল্লাহ তা'আলা বলেন-
كَبُرَ مَقْتًا عِنْدَ اللَّهِ أَنْ تَقُوْلُوْا مَا لَا تَفْعَلُونَ (আল্লাহর কাছে এ বিষয়টা অতি ঘৃণ্য যে, তোমরা এমন কথা বলবে, যা তোমরা কর না)। বলাবাহুল্য, যে কাজ আল্লাহ তা'আলার কাছে ঘৃণ্য তা যে করবে, সে তাঁর ঘৃণার পাত্রে পরিণত হবে। আল্লাহ তা'আলা আমাদেরকে তা থেকে রক্ষা করুন।
আয়াতটির শিক্ষা
ক. কোনও সৎকর্মের অঙ্গীকার করলে তা অবশ্যই পূরণ করা উচিত।
খ. যেসব নেক আমল নিজে করা হয় না, তা 'করি' বলে প্রকাশ করতে নেই। কারণ তা সুস্পষ্ট মিথ্যাচার।
গ. অন্যকে সৎকর্মের উপদেশ দিয়ে নিজে তা থেকে গাফেল থাকা উচিত নয়। বরং উপদেশ দেওয়ার পাশাপাশি নিজেরও সে অনুযায়ী আমলে যত্নবান থাকা চাই।
العَهْدُ অর্থ অঙ্গীকার, প্রতিশ্রুতি। পরিভাষায় শর্তযুক্ত ওয়াদাকে العَهْدُ বলে। যেমন তুমি পরীক্ষায় ১ম বিভাগে উত্তীর্ণ হলে তোমাকে এই কিতাবটি পুরস্কার দেব, তুমি আমার বাড়ি বেড়াতে আসলে আমিও তোমার বাড়ি বেড়াতে যাব, তুমি তার দেনা পরিশোধ করলে আমি তোমাকে সে পরিমাণ অর্থ দিয়ে দেব ইত্যাদি। অঙ্গীকার পূরণ করা ওয়াজিব ও অবশ্যকর্তব্য। তা পূরণ না করা কঠিন পাপ। আখিরাতে এ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে।
الْوَعْدُ অর্থ ওয়াদা। এটা শর্তবিহীন হয়ে থাকে। যেমন বলল, আমি তোমাকে এই কিতাবখানি দেব, আমি তোমাকে এত টাকা ঋণ দেব, আমি তোমার বাড়ি বেড়াতে যাব, আমি অমুক রোগীকে দেখতে যাব, আমি তার চিকিৎসার খরচ দেব ইত্যাদি। এটা এক রকম হাদিয়া ও উপহার, যা পূরণ করা ওয়াজিব নয়। কাজেই তা পূরণ না করলে কোনও গুনাহও হবে না। অবশ্য ওয়াদা করার সময় যদি মনে মনে তা পূরণ না করার নিয়ত থাকে, তবে অবশ্যই গুনাহ হবে। কেননা সে ক্ষেত্রে ওয়াদাটি মিথ্যা কথার অন্তর্ভুক্ত হবে। মিথ্যা বলা কঠিন গুনাহ। যদি পূরণ করার নিয়ত থাকে আর পরে মন ঘুরে যায় এবং সে কারণে ওয়াদা পূরণ না করে, তবে কোনও গুনাহ হবে না। হাঁ, মানুষের মুখের কথার মূল্য আছে। তাই ওয়াদা যখন করা হয়েছে, তখন পূরণ করাই বাঞ্ছনীয়। বলা হয়ে থাকে- اَلْكَرِيمُ إِذَا وَعَدَ وَفَى (ভদ্র লোক যখন কোনও বিষয়ে ওয়াদা করে, তা পূরণ করে)। হযরত ইসমা'ঈল আলাইহিস সালাম ওয়াদাপূরণে খুব বেশি যত্নবান ছিলেন। তাই কুরআন মাজীদে তাঁর প্রশংসা করে বলা হয়েছে-
إِنَّهُ كَانَ صَادِقَ الْوَعْدِ وَكَانَ رَسُولًا نَبِيًّا
‘নিশ্চয়ই সে ছিল ওয়াদার ক্ষেত্রে সত্যবাদী এবং রাসূল ও নবী।(সূরা মারয়াম (১৯), আয়াত ৫৪)
প্রকাশ থাকে যে, শরী'আতবিরোধী কোনও কাজের ওয়াদা করলে তা রক্ষা করা নয়। বরং সে ওয়াদা ভঙ্গ করাই জরুরি। যেমন বলল, তোমরা এখানে কনসার্টের আয়োজন করো, খরচ আমি দেব। এ ওয়াদাটি সম্পূর্ণ শরী'আতবিরোধী। তাই এটা পূরণ করা জরুরি তো নয়ই, জায়েযও নয়।
আমাদের দীনে অন্যান্য বিষয়ের মতো আখলাক-চরিত্রেরও পূর্ণাঙ্গ শিক্ষাদান করা হয়েছে। সে শিক্ষার এক গুরুত্বপূর্ণ দিক হল প্রতিশ্রুতি ও ওয়াদা রক্ষা। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে প্রতিশ্রুতি রক্ষা ও ওয়াদা পূরণে অত্যন্ত সচেতন ছিলেন। তিনি সাহাবায়ে কেরামকেও এ বিষয়ে সচেতন করে তুলেছিলেন। তাই তাঁরা কখনও প্রতিশ্রুতি ও ওয়াদার বরখেলাপ করতেন না। তাঁদের অনুসরণে প্রত্যেক মুসলিমেরই এ বিষয়ে সচেতন থাকা উচিত। সে লক্ষ্যেই বর্তমান পরিচ্ছেদে এ বিষয় সম্পর্কিত কয়েকটি আয়াত ও হাদীছ উল্লেখ করা হয়েছে। আমরা তার বঙ্গানুবাদ ও সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা পেশ করছি। আল্লাহ তা'আলাই তাওফীকদাতা।
‘প্রতিশ্রুতি পূরণ করা ও ওয়াদা রক্ষা করা’ সম্পর্কিত কিছু আয়াত
এক নং আয়াত
وَأَوْفُوا بِالْعَهْدِ إِنَّ الْعَهْدَ كَانَ مَسْئُولًا
অর্থ: আর অঙ্গীকার পূরণ করো। নিশ্চয়ই অঙ্গীকার সম্পর্কে (তোমাদের) জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।(সূরা বনী ইসরাঈল (১৭), আয়াত ৩৪)
ব্যাখ্যা
এ আয়াতটি ৮৫ নং অধ্যায়ে গত হয়েছে। সেখানে এর ব্যাখ্যা দ্রষ্টব্য।
দুই নং আয়াত
وَأَوْفُوا بِعَهْدِ اللَّهِ إِذَا عَاهَدْتُمْ
অর্থ: তোমরা যখন কোনও অঙ্গীকার কর, তখন আল্লাহর সঙ্গে কৃত অঙ্গীকার পূর্ণ করো।(সূরা নাহল (১৬), আয়াত ৯১)
ব্যাখ্যা
আল্লাহর সঙ্গে কৃত অঙ্গীকার বলতে শরী'আতের বিধানাবলি বোঝানো হয়েছে। বান্দা যখন ঈমান এনেছে অর্থাৎ স্বীকার করে নিয়েছে যে, আল্লাহ ছাড়া কোনও মা'বৃদ নেই এবং হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর বান্দা ও রাসূল, তখন এর মাধ্যমে সে যেন এ অঙ্গীকারে আবদ্ধ হয়ে গেছে যে, আল্লাহ তা'আলা তাঁর রাসূলের মাধ্যমে যে দীন ও শরী'আত দান করেছেন সে তা পুরোপুরি মেনে চলবে। আয়াতে একেই 'আল্লাহর সঙ্গে কৃত অঙ্গীকার' শব্দে ব্যক্ত করা হয়েছে। তাছাড়া মানুষ একে অন্যের সঙ্গে যে অঙ্গীকার বা চুক্তি করে, তাও এর অন্তর্ভুক্ত। কেননা আল্লাহ তা'আলার পক্ষ থেকে তা রক্ষা করারও নির্দেশ রয়েছে।
আয়াতটির শিক্ষা
অঙ্গীকার রক্ষা ইসলামের এক গুরুত্বপূর্ণ হুকুম। সুতরাং তা অবশ্যই রক্ষা করতে হবে।
তিন নং আয়াত
يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَوْفُوا بِالْعُقُودِ
অর্থ: হে মুমিনগণ! তোমরা অঙ্গীকার পূরণ করো।(সূরা মায়িদা (৫), আয়াত ১)
ব্যাখ্যা
عُقُودٌ শব্দটি عَقْدٌ এর বহুবচন। এর অর্থ অঙ্গীকার, ওয়াদা ও চুক্তি। আয়াতে ব্যাপকভাবে সর্বপ্রকার অঙ্গীকার ও চুক্তি পূরণের হুকুম দেওয়া হয়েছে। সুতরাং শরী'আতের বিধানাবলি, বেচাকেনা, আমানত, ইজারা, ঋণ, বন্ধক, বিবাহ এবং দুই দেশ বা দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্পাদিত যে-কোনও চুক্তি এর অন্তর্ভুক্ত। সুতরাং এ আয়াতের হুকুম মোতাবেক দুই পক্ষের মধ্যে সম্পাদিত যে-কোনও অঙ্গীকার বা চুক্তি রক্ষা করা অবশ্যকর্তব্য।
আল্লাহ তা'আলা ঈমানদারদেরকে ডাক দিয়ে অঙ্গীকার পূরণের হুকুম দিয়েছেন। এর মধ্যে ইঙ্গিত রয়েছে অঙ্গীকার পূরণ করা ঈমানেরই দাবি। সুতরাং এক হাদীছে ইরশাদ হয়েছে-
لَا إِيْمَانَ لِمَنْ لَا أَمَانَةَ لَهُ ، وَلَا دِيْنَ لِمَنْ لَا عَهْدَ لَهُ
‘ওই ব্যক্তির ঈমান নেই, যার আমানতদারি নেই এবং ওই ব্যক্তির দীন নেই, যে অঙ্গীকার রক্ষা করে না।(সহীহ ইবনে হিব্বান: ১৯৪; মুসান্নাফে ইবন আবী শায়বা: ৩০৪০১; মুসনাদুল বাযযার: ৭১৯৬ মুসনাদে আবু ইয়া'লা: ২৪৫৮; তহাবী, শারহু মুশকিলিল আছার ৪৬৯৩; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর: ১০৫৫৩; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা: ১২৬৯০; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ ৩৯)
ঈমানদারদের লক্ষ্য করে অঙ্গীকার ও চুক্তি রক্ষার হুকুম দেওয়ার দ্বারা এদিকেও ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, কেবল ওইসকল অঙ্গীকার রক্ষা করাই জরুরি, যা ঈমানের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। সুতরাং কেউ যদি কারও সঙ্গে শরী'আতবিরোধী কোনও ওয়াদা বা চুক্তি করে, তবে তা রক্ষা করা জরুরি নয়। বরং সে চুক্তি ভঙ্গ করাই জরুরি। যেমন সুদ-ঘুষের চুক্তি।
আয়াতটির শিক্ষা
ক. ওয়াদা বা চুক্তি রক্ষা করা ঈমানের দাবি। সুতরাং প্রত্যেক মুমিনকে চুক্তি রক্ষায় যত্নবান থাকতে হবে।
খ. যেসব ওয়াদা ও চুক্তি শরী'আতসম্মত নয়, তা রক্ষা করাও জরুরি নয়।
চার নং আয়াত
يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لِمَ تَقُولُونَ مَا لَا تَفْعَلُونَ (2) كَبُرَ مَقْتًا عِنْدَ اللَّهِ أَنْ تَقُولُوا مَا لَا تَفْعَلُونَ (3)
অর্থ: হে মুমিনগণ! তোমরা এমন কথা কেন বল, যা কর না? আল্লাহর কাছে এ বিষয়টা অতি ঘৃণ্য যে, তোমরা এমন কথা বলবে, যা তোমরা কর না।(সূরা সাফ্ফ (৬১), আয়াত ২-৩)
ব্যাখ্যা
আয়াতটির সম্পর্ক তিন শ্রেণির লোকের সঙ্গে। ক. যারা ভালো ভালো কাজ করবে বলে ওয়াদা করে, কিন্তু পরে সে ওয়াদা রক্ষা করে না। খ. যারা ভালো ভালো কাজ করেছে বলে প্রকাশ করে, কিন্তু বাস্তবে তা করেনি। গ. যারা ভালো ভালো কাজের উপদেশ ও নসীহত করে, কিন্তু নিজেরা সে অনুযায়ী আমল করে না।
এক শ্রেণির লোক আছে, যারা বিশেষ বিশেষ পরিস্থিতিতে বড় গলায় বলে ওঠে যে, সময় আসলে দেখিয়ে দেব আমি কী করতে পারি। পরে যখন সময় আসে, তখন তাদেরকে ধারেকাছেও পাওয়া যায় না। এমনকি বদর যুদ্ধের পরও কতক সাহাবীর বেলায় এমনটা ঘটেছিল। তারা বলেছিলেন, বদর যুদ্ধ হঠাৎ করেই হয়ে যাওয়ায় আমরা তাতে শরীক হতে পারিনি। ভবিষ্যতে যদি কখনও এমন যুদ্ধের অবকাশ আসে, তখন আমরা দেখিয়ে দেব কেমন জানপ্রাণ দিয়ে লড়াই করি।
কোনও কোনও লোক বলেছিল, আমরা যদি জানতে পারতাম কোন আমল আল্লাহর কাছে বেশি প্রিয়, তবে আমরা তা করতাম। আল্লাহ তা'আলা জানিয়ে দেন যে, আল্লাহ তা'আলার কাছে জিহাদই সবচে' প্রিয় আমল। কিন্তু তাদের কাছে এটা খুব কঠিন মনে হল। ফলে যখনই জিহাদের ডাক আসল, তারা তা থেকে পিছিয়ে থাকল।
মুনাফিকদের তো এটা সব সময়কার অভ্যাস। তারা ভালো কাজের ওয়াদা করে, কিন্তু বাস্তবে তা করে না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যমানায়ও এরকম ছিল। তারা মুমিনদের বলত, তোমরা যখন যুদ্ধে যাবে, তখন আমরাও তোমাদের সঙ্গে যাব এবং তোমাদের সাহায্য করব। কিন্তু তারা এক তো যুদ্ধে যেতই না, আবার গেলেও তারা সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করত না। সর্বদাই তারা অসহযোগিতা করত। এটা সুস্পষ্টই ওয়াদা খেলাফি ও নীতিভ্রষ্টতা। এদেরকে তিরস্কার করে আল্লাহ তা'আলা বলেন- لِمَ تَقُوْلُوْنَ مَا لَا تَفْعَلُوْنَ (তোমরা এমন কথা কেন বল, যা কর না)। অর্থাৎ এমন ওয়াদা কেন কর বা এমন প্রতিশ্রুতি কেন দাও, যা তোমরা পূরণ কর না?
কিছু লোক এমনও আছে, যারা মুখে বলে বেড়ায় আমরা তাহাজ্জুদ পড়ি, আল্লাহর পথে দান-খয়রাত করি, অমুক মসজিদটি আমাদের করা, অমুক সেতুটি আমরাই করে দিয়েছি, আমরা এই করেছি সেই করেছি। বাস্তবে কিছুই করেনি। অনেকেই বলে থাকে আমি অনেক ধৈর্য ধরেছি, আর নয়। বাস্তবে মোটেই ধৈর্য ধরেনি। বলে থাকে, আমি তাকে অনেক বুঝিয়েছি, অনেক দরদের সঙ্গে উপদেশ দিয়েছি। প্রকৃতপক্ষে সে এর কিছুই করেনি। অনেক সময় তারা হাবভাব দ্বারাও এ জাতীয় কাজ করে থাকে বলে বোঝানোর চেষ্টা করে। প্রকৃতপক্ষে তারা আদৌ তা করে না। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যমানায় মুনাফিকরা এরকমই ছিল। কিছুই না করেও 'করেছি' বলে প্রচার করত। আল্লাহ তা'আলা বলছেন- لِمَ تَقُوْلُوْنَ مَا لَا تَفْعَلُونَ (তোমরা এমন কথা কেন বল, যা কর না)। অর্থাৎ বাস্তবে যা করনি, তা করেছ বলে প্রচার করছ কেন?
এমনিভাবে বেআমল ওয়ায়েজদের জন্যও আয়াতটি প্রযোজ্য। অনেক ওয়াজ- নসীহতকারী মানুষকে ভালো ভালো কাজের উপদেশ দেয়। বিভিন্ন নেক আমলের ফযীলত বলে মানুষকে তা করার প্রতি উৎসাহ যোগায়। কিন্তু নিজেদের আমল নেই। নিজেরা সেসব আমল থেকে অনেক দূরে। আল্লাহ তা'আলা বলছেন- لِمَ تَقُوْلُوْنَ مَا لَا تَفْعَلُوْنَ (তোমরা এমন কথা কেন বল, যা কর না)। অর্থাৎ যেসব নেক আমল নিজেরা কর না, মানুষকে তার উপদেশ দাও কেন? যেমন অপর এক আয়াতে আছে-
أَتَأْمُرُونَ النَّاسَ بِالْبِرِّ وَتَنْسَوْنَ أَنْفُسَكُمْ
‘তোমরা কি অন্য লোকদেরকে পুণ্যের আদেশ কর আর নিজেদেরকে ভুলে যাও?'(সূরা বাকারা (২), আয়াত ৪৪)
এর দ্বারা এ কথা বোঝানো উদ্দেশ্য নয় যে, আমল নেই বলে ওয়াজ করা যাবে না। বরং উদ্দেশ্য হল মানুষকে যখন ভালো কাজের উপদেশ দিচ্ছ, তখন তোমাদের নিজেদেরও সে অনুযায়ী আমল করা উচিত।
মোটকথা ভালো কাজের প্রতিশ্রুতি দিয়ে সে প্রতিশ্রুতি রক্ষা না করা, ভালো কাজ না করেও 'করেছি' বলে প্রচার করা এবং নিজে নেক আমলে উদাসীন থেকে অন্যদের ওয়াজ-নসীহত করা নিন্দনীয় কাজ। আল্লাহ তা'আলা এ আয়াতে এদের সকলকেই তিরস্কার করেছেন। কাজেই এর থেকে সকলেরই বিরত থাকা উচিত। কেননা যারা এরূপ করে, আল্লাহ তা'আলা তাদের প্রতি নারাজ হন। আয়াতে আল্লাহ তা'আলা বলেন-
كَبُرَ مَقْتًا عِنْدَ اللَّهِ أَنْ تَقُوْلُوْا مَا لَا تَفْعَلُونَ (আল্লাহর কাছে এ বিষয়টা অতি ঘৃণ্য যে, তোমরা এমন কথা বলবে, যা তোমরা কর না)। বলাবাহুল্য, যে কাজ আল্লাহ তা'আলার কাছে ঘৃণ্য তা যে করবে, সে তাঁর ঘৃণার পাত্রে পরিণত হবে। আল্লাহ তা'আলা আমাদেরকে তা থেকে রক্ষা করুন।
আয়াতটির শিক্ষা
ক. কোনও সৎকর্মের অঙ্গীকার করলে তা অবশ্যই পূরণ করা উচিত।
খ. যেসব নেক আমল নিজে করা হয় না, তা 'করি' বলে প্রকাশ করতে নেই। কারণ তা সুস্পষ্ট মিথ্যাচার।
গ. অন্যকে সৎকর্মের উপদেশ দিয়ে নিজে তা থেকে গাফেল থাকা উচিত নয়। বরং উপদেশ দেওয়ার পাশাপাশি নিজেরও সে অনুযায়ী আমলে যত্নবান থাকা চাই।
মুনাফিকের তিন আলামত
হাদীছ নং: ৬৮৮
হযরত আবূ হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, মুনাফিকের আলামত তিনটি- যখন কথা বলে মিথ্যা বলে। যখন ওয়াদা করে তা ভঙ্গ করে এবং যখন তাদের কাছে আমানত রাখা হয় তাতে খেয়ানত করে। -বুখারী ও মুসলিম
(সহীহ বুখারী: ৩৩; সহীহ মুসলিম: ৫৯; জামে' তিরমিযী: ২৬৩১; সুনানে নাসাঈ: ৫০২১ মুসনাদে আহমাদ: ৮৬৭০; বাগাবী, শারহুস্ সুন্নাহ: ৩৫; মুসনাদুল বাযযার: ৮৩১৫; মুসনাদে আবু ইয়া'লা : ৬৫৩৩; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা: ১১৪৫৮; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ: ৩৫)
মুসলিমের এক বর্ণনায় অতিরিক্ত আছে, যদিও সে রোযা রাখে ও নামায পড়ে এবং মনে করে সে একজন মুসলিম।
হাদীছ নং: ৬৮৮
হযরত আবূ হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, মুনাফিকের আলামত তিনটি- যখন কথা বলে মিথ্যা বলে। যখন ওয়াদা করে তা ভঙ্গ করে এবং যখন তাদের কাছে আমানত রাখা হয় তাতে খেয়ানত করে। -বুখারী ও মুসলিম
(সহীহ বুখারী: ৩৩; সহীহ মুসলিম: ৫৯; জামে' তিরমিযী: ২৬৩১; সুনানে নাসাঈ: ৫০২১ মুসনাদে আহমাদ: ৮৬৭০; বাগাবী, শারহুস্ সুন্নাহ: ৩৫; মুসনাদুল বাযযার: ৮৩১৫; মুসনাদে আবু ইয়া'লা : ৬৫৩৩; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা: ১১৪৫৮; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ: ৩৫)
মুসলিমের এক বর্ণনায় অতিরিক্ত আছে, যদিও সে রোযা রাখে ও নামায পড়ে এবং মনে করে সে একজন মুসলিম।
كتاب الأدب
باب الوفاء بالعهد وَإنجاز الوَعد
قَالَ الله تَعَالَى: {وَأوْفُوا بِالعَهْدِ إنَّ العَهْدَ كَانَ مَسْئُولًا} [الإسراء: 34]، وقال تَعَالَى: {وَأوْفُوا بِعَهْدِ اللهِ إِذَا عَاهَدْتُمْ} [النحل: 91]، وقال تَعَالَى: {يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أوْفُوا بِالْعُقُودِ} [المائدة: 1]، وقال تَعَالَى: {يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لِمَ تَقُولُونَ مَا لاَ تَفْعَلُونَ كَبُرَ مَقْتًا عِنْدَ اللهِ أَنْ تَقُولُوا مَا لاَ تَفْعَلُونَ} [الصف: 2 - 3].
قَالَ الله تَعَالَى: {وَأوْفُوا بِالعَهْدِ إنَّ العَهْدَ كَانَ مَسْئُولًا} [الإسراء: 34]، وقال تَعَالَى: {وَأوْفُوا بِعَهْدِ اللهِ إِذَا عَاهَدْتُمْ} [النحل: 91]، وقال تَعَالَى: {يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أوْفُوا بِالْعُقُودِ} [المائدة: 1]، وقال تَعَالَى: {يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لِمَ تَقُولُونَ مَا لاَ تَفْعَلُونَ كَبُرَ مَقْتًا عِنْدَ اللهِ أَنْ تَقُولُوا مَا لاَ تَفْعَلُونَ} [الصف: 2 - 3].
688 - وعن أَبي هريرة - رضي الله عنه: أنَّ رسول الله - صلى الله عليه وسلم - قَالَ: «آيَةُ المُنَافِقِ ثَلاَثٌ: إِذَا حَدَّثَ كَذَبَ، وَإِذَا وَعَدَ أَخْلَفَ، وَإِذَا اؤْتُمِنَ خَانَ». متفقٌ عَلَيْهِ. (1)
زَادَ في روايةٍ لمسلم: «وإنْ صَامَ وَصَلَّى وَزَعَمَ أنَّهُ مُسْلِمٌ».
زَادَ في روايةٍ لمسلم: «وإنْ صَامَ وَصَلَّى وَزَعَمَ أنَّهُ مُسْلِمٌ».
হাদীসের ব্যাখ্যা:
الْمُنَافِقُ শব্দটির উৎপত্তি نِفَاقُ থেকে। نِفَاق (নিফাক) অর্থ ধোঁকা দেওয়া, প্রতারণা করা, কথায় ও কাজে মিল না রাখা, অন্তরে অসাধুতা পোষণ করে বাইরে সাধুতা প্রকাশ করা। শরী'আতের পরিভাষায় নিফাক দু'প্রকার। বড় নিফাক ও ছোট নিফাক। বড় নিফাক হল বিশ্বাসগত। অর্থাৎ অন্তরে কুফর বিদ্যমান রেখে মুখে ঈমান ও ইসলাম প্রকাশ করা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যমানায় যারা মুনাফিক ছিল, তাদের নিফাক এ রকমই ছিল। কুরআন মাজীদ তাদের মুখোশ খুলে দিয়েছে এবং তাদেরকে কাফের ঘোষণা করে সতর্ক করে দিয়েছে যে, তাদের পরিণাম ও ঠিকানা জাহান্নামের সর্বনিম্ন স্তর।
ছোট নিফাক হল কর্মগত নিফাক। অর্থাৎ প্রকাশ্যে নিজেকে সৎ ও সাধু পুরুষরূপে প্রদর্শন করা আর অন্তরে তার বিপরীত অবস্থা পোষণ করা। নামের দিক থেকে যদিও এটা ছোট নিফাক, কিন্তু গুনাহ হিসেবে মোটেই ছোট নয়। হাদীছে যেসব বিষয়কে এরূপ নিফাক হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, তার প্রত্যেকটিই কবীরা গুনাহ। যেমন মিথ্যা বলা, আমানতের খেয়ানত করা ইত্যাদি।
এ হাদীছে যে মুনাফিকের আলামত বলা হয়েছে, তা দ্বারা মূলত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যমানায় বিদ্যমান মুনাফিকদের বোঝানো হয়েছে। অর্থাৎ বিশ্বাসগত মুনাফিক। এ আলামতগুলো তাদের মধ্যেই বিদ্যমান ছিল। এসব আলামতের প্রত্যেকটিই কর্মগত নিফাক। তবে সেকালে এগুলো ইঙ্গিত বহন করত যে, যাদের মধ্যে এগুলো আছে, বিশ্বাসগত দিক থেকে তারা মুনাফিক। অর্থাৎ নিজেদেরকে মুমিন বলে পরিচয় দিলেও প্রকৃতপক্ষে তারা কাফের।
বর্তমানকালে মানুষের আমল-আখলাকের ব্যাপক অধঃপতন ঘটেছে। তাই এসব আলামত মুমিনদের মধ্যেও দেখা যাচ্ছে। হাদীছের ভাষায় এরূপ মুমিনও এক রকম মুনাফিক। তবে তারা বিশ্বাসগত মুনাফিক নয়; বরং কর্মগত মুনাফিক। অর্থাৎ তাদের কাজকর্ম প্রকৃত মুনাফিকদের কাজকর্মের মতো। তাদেরই মতো এরাও বলে এক, করে আরেক। অথচ এমন হওয়া উচিত নয়। যে ব্যক্তি প্রকৃত মুমিন, তার কথায়-কাজে মিল থাকা উচিত। তার কাজকর্ম কিছুতেই মুনাফিকদের মতো প্রতারণামূলক হওয়া উচিত নয়।
আলোচ্য হাদীছে যে মুনাফিকদের আলামত বলা হয়েছে, তা বিশ্বাসগত মুনাফিক ও কর্মগত মুনাফিক উভয়ের জন্যই প্রযোজ্য। যারা কর্মর্গত দিক থেকে মুনাফিক, বিশ্বাসগত দিক থেকে নয়, অর্থাৎ যাদের অন্তরে ঈমান আছে, হাদীছের শব্দ দ্বারা তাদের খুব সাবধান হওয়া উচিত যে, কতগুলো মন্দকর্মে লিপ্ত থাকার কারণে তাদেরকেও মুনাফিক নামে অভিহিত করা হয়েছে। একজন মুমিনের পক্ষে তা কতইনা লজ্জাজনক! সুতরাং তাদের উচিত এসব কর্ম থেকে তাওবা করে বিশ্বাস ও কর্ম উভয় দিক থেকেই প্রকৃত মুমিন হয়ে যাওয়া।
এ হাদীছে মুনাফিকের আলামত বলা হয়েছে তিনটি। কিন্তু অপর এক হাদীছে আছে, মুনাফিকের আলামত চারটি। ইরশাদ হয়েছে-
أَرْبَعٌ مَن كُنَّ فيه كانَ مُنَافِقًا خَالِصًا، ومَن كَانَتْ فيه خَصْلَةٌ منهنَّ كَانَتْ فيه خَصْلَةٌ مِنَ النِّفَاقِ حتَّى يَدَعَهَا: إذَا اؤْتُمِنَ خَانَ، وإذَا حَدَّثَ كَذَبَ، وإذَا عَاهَدَ غَدَرَ، وإذَا خَاصَمَ فَجَرَ
‘চারটি বিষয় যে ব্যক্তির মধ্যে থাকবে সে একজন খাঁটি মুনাফিক সাব্যস্ত হবে। যার মধ্যে তা থেকে একটি থাকবে তার মধ্যে মুনাফিকীরই একটা খাসলত থাকবে, যাবৎ না সে তা ছেড়ে দেয়। তা হচ্ছে- তার কাছে যখন আমানত রাখা হয় খেয়ানত করে, যখন কথা বলে মিথ্যা বলে, যখন প্রতিশ্রুতি দেয় তা ভঙ্গ করে আর যখন কলহ-বিবাদ করে তখন সীমালঙ্ঘন করে।' (সহীহ বুখারী : ৩৪; সহীহ মুসলিম: ৫৮; সুনানে আবূ দাউদ: ৪৬৮৮; জামে তিরমিযী: ২৬৩২ সহীহ ইবনে হিব্বান: ২৫৪)
প্রথম হাদীছে মুনাফিকদের যে তিনটি আলামত বলা হয়েছে, তার দু'টি এ হাদীছেও আছে। তা হল মিথ্যা বলা ও আমানতের খেয়ানত করা। ওয়াদা ভঙ্গ করার কথাটি এ হাদীছে নেই। সুতরাং এ হাদীছে বর্ণিত চারটি আলামতের সঙ্গে উপরের হাদীছের তৃতীয় আলামতটি যোগ করলে মোট আলামত হয় পাঁচটি। পূর্ণ পাঁচটি দুই হাদীছের কোনওটিতেই বর্ণিত হয়নি। বস্তুত নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীছে স্থান-কাল-পাত্রের দিকে লক্ষ রাখা হত। এ ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। যেখানে যে আলামতগুলোর কথা উল্লেখ করার প্রয়োজন হয়েছে, সেখানে কেবল সেগুলোই বর্ণিত হয়েছে। তাই কোথাও তিনটি আলামত উল্লেখ করা হয়েছে এবং কোথাও চারটি। তার মানে এ নয় যে, এর অতিরিক্ত কোনও আলামত নেই।
ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী রহ. বলেন, উভয় হাদীছের মধ্যে কোনও বিরোধ নেই। কেননা এই হাদীছে তিনটি আলামত উল্লেখ করার দ্বারা এ কথা প্রমাণ হয় না যে, অপর হাদীছে বর্ণিত চতুর্থটি আলামত নয়। মূল কথা হচ্ছে সবগুলোই মুনাফিকের আলামত, তবে সময় অনুপাতে একেকবার একেক ধরনের আলামত উল্লেখ করা হয়েছে।
মুনাফিকের প্রথম আলামত
এ হাদীছে বর্ণিত তিনটি আলামতের প্রথমটি হচ্ছে- إِذَا حَدَّثَ كَذَبَ (যখন কথা বলে, মিথ্যা বলে)। এর দ্বারা মিথ্যা কথা কত গুরুতর পাপ তা অনুমান করা যায়। কেননা প্রকৃত মুনাফিক হচ্ছে একজন সুবিধাবাদী কাফের। সে অন্তরে তার কুফর ও বেঈমানী গোপন রাখে আর বিভিন্ন স্বার্থ ও সুবিধাভোগের খাতিরে নিজেকে মুসলিম বলে জাহির করে। তার সবচে' বড় মিথ্যাচার হচ্ছে কাফের হয়েও নিজেকে মু'মিন ও মুসলিম বলে প্রকাশ করা। এত বড় বিষয়েও যখন সে মিথ্যা বলতে দ্বিধাবোধ করে না, তখন অন্যান্য ক্ষেত্রে তার মিথ্যা বলাটা তো খুবই স্বাভাবিক।
মোটকথা মিথ্যা বলাটা মুনাফিকের স্বভাব। কাজেই একজন মুসলিম ব্যক্তির কোনওক্রমেই মিথ্যা বলা উচিত নয়।
একবার হযরত আব্দুল্লাহ ইবন জারাদ রাযি. নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ইয়া নাবিয়্যাল্লাহ! মু'মিন কি ব্যাভিচার করতে পারে? তিনি বললেন, হাঁ, কখনও তার দ্বারা এটা ঘটে যেতে পারে। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, মু'মিন কি চুরি করতে পারে? তিনি বললেন, হাঁ, এটাও তার দ্বারা কখনও ঘটে যেতে পারে। তাঁর শেষ প্রশ্ন ছিল-
يَا نَبِيَّ اللَّهِ ، هَلْ يَكْذِبُ الْمُؤْمِنُ؟ قَالَ: " لَا " . ثُمَّ أَتْبَعَهَا رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقَالَ هَذِهِ الْكَلِمَةَ: إِنَّمَا يَفْتَرِي الْكَذِبَ الَّذِينَ لَا يُؤْمِنُونَ بِآيَاتِ اللَّهِ وَأُولَئِكَ هُمُ الْكَاذِبُونَ
ইয়া নাবিয়্যাল্লাহ! মু'মিন কি মিথ্যা বলতে পারে? তিনি বললেন, না। এই বলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আয়াত পাঠ করলেন-
إِنَّمَا يَفْتَرِي الْكَذِبَ الَّذِينَ لَا يُؤْمِنُونَ بِآيَاتِ اللَّهِ وَأُولَئِكَ هُمُ الْكَاذِبُونَ
নিশ্চয়ই মিথ্যা রচনা তো (নবী নয়, বরং) তারাই করে, যারা আল্লাহর আয়াতের উপর ঈমান রাখে না। প্রকৃতপক্ষে তারাই মিথ্যাবাদী। (সূরা নাহল (১৬), আয়াত ১০৫) (খারাইতী, মাসাবিউল আখলাক: ১২৭)
মিথ্যা বলাটা এক রকম বিশ্বাসঘাতকতাও বটে। কেননা মিথ্যা যাকে বলা হয়, সে তো সেই কথাটিকে সত্যই মনে করে এবং বক্তাকে সে সত্যবাদী বলে বিশ্বাস করে। কিন্তু মিথ্যুক ব্যক্তি তার বিশ্বাসের পরিপন্থী কাজ করে। তার বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে তাকে দিয়ে মিথ্যা গ্রহণ করায়। এটা তো মারাত্মক বিশ্বাসঘাতকতা। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক হাদীছে ইরশাদ করেন-
كَبُرَتْ خِيَانَةً أَنْ تُحَدِّثَ أَخَاكَ حَدِيثًا هُوَ لَكَ بِهِ مُصَدِّقٌ، وَأَنْتَ لَهُ بِهِ كَاذِبٌ
‘এটা এক মহা বিশ্বাসঘাতকতা যে, তুমি তোমার ভাইয়ের সঙ্গে কোনও কথা বলছ আর সে তোমাকে বিশ্বাস করছে, অথচ তুমি তার সঙ্গে মিথ্যা বলছ।' (সুনানে আবু দাউদ: ৪৯৭১; আল-আদাবুল মুফরাদ: ৩৯৩; খারাইতী, মাসাবিউল আখলাক : ১০৯; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা ২০৮৪৬; শু'আবুল ঈমান: ৪৪৭৯; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ: ৩৫৭৯; তাবারানী, মুসনাদুশ শামিয়্যীন: ৪৯৫; মুসনাদে আহমাদ: ১৭৬৩৫)
মুনাফিকের দ্বিতীয় আলামত
মুনাফিকের দ্বিতীয় আলামত হল- وَإِذَا وَعَدَ أَخْلَفَ (যখন ওয়াদা করে, তা ভঙ্গ করে)। মু'মিন ব্যক্তি ওয়াদা রক্ষাকারী হয়ে থাকে।
ওয়াদাভঙ্গ কথা দ্বারাও হতে পারে, কাজ দ্বারাও হতে পারে। উভয়টিই মুনাফিকের আলামত। তবে এটা মুনাফিকের আলামত হবে তখনই, যখন ওয়াদা দেওয়ার সময়ই মনে মনে তা রক্ষা করার নিয়ত না থাকে। পক্ষান্তরে যদি রক্ষা করার নিয়ত থাকে কিন্তু বাস্তবিক কোনও ওজরবশত সে তা রক্ষা করতে না পারে, তবে তা মুনাফিকের আলামতরূপে গণ্য হবে না। এক হাদীছে আছে-
إِذَا وَعَدَ الرَّجُلُ أَخَاهُ، وَمِنْ نِيَّتِهِ أَنْ يَفِيَ لَهُ ، فَلَمْ يَفِ وَلَمْ يَجِئْ لِلْمِيعَادِ، فَلَا إِثْمَ عَلَيْهِ
‘কোনও ব্যক্তি যদি তার ভাইয়ের সঙ্গে কোনও ওয়াদা করে এবং সে ওয়াদা পূরণ করার নিয়তও তার থাকে, কিন্তু পরে সে তা পূরণ করতে না পারে এবং সময়মতো আসতে সক্ষম না হয়, তবে তার কোনও গুনাহ হবে না।' (সুনানে আবু দাউদ: ৪৯৯৫; জামে' তিরমিযী: ২৬৩৩; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর: ৫০৮০; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা: ২০৮৩৮)
সুতরাং কেউ যখন কোনও ওয়াদা করে, তখন অবশ্যই তা পূরণ করার নিয়ত থাকতে হবে। পূরণ করার নিয়ত না থাকলে তা মিথ্যা কথা ও বিশ্বাসঘাতকতা বলে গণ্য হবে, যা কিনা মুনাফিকীর আলামত। কোনও মুমিন ও ভদ্র ব্যক্তির কিছুতেই এটা করা উচিত নয়। বলা হয়ে থাকে, ভদ্র লোক যখন কোনও ওয়াদা করে, তখন সে তা অবশ্যই পূরণ করে। হযরত আব্দুল্লাহ ইবন আমির ইবন রাবী'আ রাযি. বলেন, একবার নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের বাড়িতে আসলেন। তখন আমি শিশু। আমি খেলতে বের হয়ে গেলাম। আমার মা আমাকে ডাকলেন, হে আব্দুল্লাহ! এসো, তোমাকে দেব। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তুমি তাকে কী দেওয়ার ইচ্ছা করেছ? তিনি বললেন, তাকে একটি খেজুর দেওয়ার ইচ্ছা করেছি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তুমি তা না করলে তোমার আমলনামায় একটি মিথ্যা লেখা হত। (সুনানে আবু দাউদ: ৪৯৯১; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা ২০৮৩৯; শু'আবুল ঈমান: ৪৪৮২; মুসনাদে আহমাদ: ১৫৭০২; খারাইতী, মাকারিমুল আখলাক: ২০২)
হাদীছটি দ্বারা বোঝা গেল ওয়াদা পূরণ না করলে তা মিথ্যা কথা বলে গণ্য হয়। এমনকি সে ওয়াদা শিশুর সঙ্গে করলেও। আর তা মুনাফিকীর আলামত তো বটেই।
মুনাফিকের তৃতীয় আলামত
মুনাফিকের তৃতীয় আলামত হচ্ছে- وَإِذَا اؤْتُمِنَ خَانَ (যখন তার কাছে আমানত রাখা হয়, সে তাতে খেয়ানত করে)। আমানত রক্ষা করা মু'মিন ব্যক্তির এক অপরিহার্য গুণ। আল্লাহ তা'আলা মু'মিনের পরিচয় দিতে গিয়ে যেসকল গুণের উল্লেখ করেছেন তার মধ্যে এটিও একটি। ইরশাদ হয়েছে-
وَالَّذِينَ هُمْ لِأَمَانَاتِهِمْ وَعَهْدِهِمْ رَاعُونَ
‘এবং যারা তাদের আমানত ও প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে।' (সূরা মা'আরিজ (৭০), আয়াত ৩২)
যেহেতু আমানত রক্ষা মু'মিনের অপরিহার্য গুণ, তাই আমানতের খেয়ানত করতে কঠিনভাবে নিষেধ করা হয়েছে। যেমন ইরশাদ হয়েছে-
يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَخُونُوا اللَّهَ وَالرَّسُولَ وَتَخُونُوا أَمَانَاتِكُمْ وَأَنْتُمْ تَعْلَمُونَ
হে মুমিনগণ! আল্লাহ ও রাসূলের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করো না এবং জেনেশুনে নিজেদের আমানতের খেয়ানত করো না। (সূরা আনফাল (৮), আয়াত ২৭)
এতে সম্বোধন করা হয়েছে 'মুমিন' বলে। অর্থাৎ খেয়ানত করা মু'মিনের কাজ হতে পারে না। আর আলোচ্য হাদীছ দ্বারা জানা গেল এটা মুনাফিকের আলামত।
আমানতের খেয়ানত করা কঠিন পাপ। এক হাদীছ দ্বারা জানা যায়, আল্লাহর পথে শহীদ হওয়ার দ্বারা সব গুনাহ মাফ হয়, কিন্তু আমানতের খেয়ানত করার গুনাহ মাফ হয় না। কিয়ামতের দিন খেয়ানতকারীকে ডেকে বলা হবে, তোমার কাছে যে আমানত রাখা হয়েছিল তা আদায় করো। সে বলবে, হে আমার প্রতিপালক! এটা কীভাবে সম্ভব, যখন আমরা দুনিয়া থেকে চলে এসেছি? তখন ঘোষণা করা হবে, একে জাহান্নামে নিয়ে যাও। সুতরাং এহেন কঠিন পাপ থেকে প্রত্যেক মুমিনকে অবশ্যই বিরত থাকতে হবে।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. যে ব্যক্তি নিজেকে মুমিন বলে পরিচয় দেয়, তার কিছুতেই মিথ্যা বলা সাজে না।
খ. আমাদেরকে অবশ্যই ওয়াদা রক্ষায় যত্নবান থাকতে হবে।
গ. আমানতের খেয়ানত করা কঠিন পাপ। এর থেকে আমাদের বিরত থাকতে হবে।
ছোট নিফাক হল কর্মগত নিফাক। অর্থাৎ প্রকাশ্যে নিজেকে সৎ ও সাধু পুরুষরূপে প্রদর্শন করা আর অন্তরে তার বিপরীত অবস্থা পোষণ করা। নামের দিক থেকে যদিও এটা ছোট নিফাক, কিন্তু গুনাহ হিসেবে মোটেই ছোট নয়। হাদীছে যেসব বিষয়কে এরূপ নিফাক হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, তার প্রত্যেকটিই কবীরা গুনাহ। যেমন মিথ্যা বলা, আমানতের খেয়ানত করা ইত্যাদি।
এ হাদীছে যে মুনাফিকের আলামত বলা হয়েছে, তা দ্বারা মূলত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যমানায় বিদ্যমান মুনাফিকদের বোঝানো হয়েছে। অর্থাৎ বিশ্বাসগত মুনাফিক। এ আলামতগুলো তাদের মধ্যেই বিদ্যমান ছিল। এসব আলামতের প্রত্যেকটিই কর্মগত নিফাক। তবে সেকালে এগুলো ইঙ্গিত বহন করত যে, যাদের মধ্যে এগুলো আছে, বিশ্বাসগত দিক থেকে তারা মুনাফিক। অর্থাৎ নিজেদেরকে মুমিন বলে পরিচয় দিলেও প্রকৃতপক্ষে তারা কাফের।
বর্তমানকালে মানুষের আমল-আখলাকের ব্যাপক অধঃপতন ঘটেছে। তাই এসব আলামত মুমিনদের মধ্যেও দেখা যাচ্ছে। হাদীছের ভাষায় এরূপ মুমিনও এক রকম মুনাফিক। তবে তারা বিশ্বাসগত মুনাফিক নয়; বরং কর্মগত মুনাফিক। অর্থাৎ তাদের কাজকর্ম প্রকৃত মুনাফিকদের কাজকর্মের মতো। তাদেরই মতো এরাও বলে এক, করে আরেক। অথচ এমন হওয়া উচিত নয়। যে ব্যক্তি প্রকৃত মুমিন, তার কথায়-কাজে মিল থাকা উচিত। তার কাজকর্ম কিছুতেই মুনাফিকদের মতো প্রতারণামূলক হওয়া উচিত নয়।
আলোচ্য হাদীছে যে মুনাফিকদের আলামত বলা হয়েছে, তা বিশ্বাসগত মুনাফিক ও কর্মগত মুনাফিক উভয়ের জন্যই প্রযোজ্য। যারা কর্মর্গত দিক থেকে মুনাফিক, বিশ্বাসগত দিক থেকে নয়, অর্থাৎ যাদের অন্তরে ঈমান আছে, হাদীছের শব্দ দ্বারা তাদের খুব সাবধান হওয়া উচিত যে, কতগুলো মন্দকর্মে লিপ্ত থাকার কারণে তাদেরকেও মুনাফিক নামে অভিহিত করা হয়েছে। একজন মুমিনের পক্ষে তা কতইনা লজ্জাজনক! সুতরাং তাদের উচিত এসব কর্ম থেকে তাওবা করে বিশ্বাস ও কর্ম উভয় দিক থেকেই প্রকৃত মুমিন হয়ে যাওয়া।
এ হাদীছে মুনাফিকের আলামত বলা হয়েছে তিনটি। কিন্তু অপর এক হাদীছে আছে, মুনাফিকের আলামত চারটি। ইরশাদ হয়েছে-
أَرْبَعٌ مَن كُنَّ فيه كانَ مُنَافِقًا خَالِصًا، ومَن كَانَتْ فيه خَصْلَةٌ منهنَّ كَانَتْ فيه خَصْلَةٌ مِنَ النِّفَاقِ حتَّى يَدَعَهَا: إذَا اؤْتُمِنَ خَانَ، وإذَا حَدَّثَ كَذَبَ، وإذَا عَاهَدَ غَدَرَ، وإذَا خَاصَمَ فَجَرَ
‘চারটি বিষয় যে ব্যক্তির মধ্যে থাকবে সে একজন খাঁটি মুনাফিক সাব্যস্ত হবে। যার মধ্যে তা থেকে একটি থাকবে তার মধ্যে মুনাফিকীরই একটা খাসলত থাকবে, যাবৎ না সে তা ছেড়ে দেয়। তা হচ্ছে- তার কাছে যখন আমানত রাখা হয় খেয়ানত করে, যখন কথা বলে মিথ্যা বলে, যখন প্রতিশ্রুতি দেয় তা ভঙ্গ করে আর যখন কলহ-বিবাদ করে তখন সীমালঙ্ঘন করে।' (সহীহ বুখারী : ৩৪; সহীহ মুসলিম: ৫৮; সুনানে আবূ দাউদ: ৪৬৮৮; জামে তিরমিযী: ২৬৩২ সহীহ ইবনে হিব্বান: ২৫৪)
প্রথম হাদীছে মুনাফিকদের যে তিনটি আলামত বলা হয়েছে, তার দু'টি এ হাদীছেও আছে। তা হল মিথ্যা বলা ও আমানতের খেয়ানত করা। ওয়াদা ভঙ্গ করার কথাটি এ হাদীছে নেই। সুতরাং এ হাদীছে বর্ণিত চারটি আলামতের সঙ্গে উপরের হাদীছের তৃতীয় আলামতটি যোগ করলে মোট আলামত হয় পাঁচটি। পূর্ণ পাঁচটি দুই হাদীছের কোনওটিতেই বর্ণিত হয়নি। বস্তুত নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীছে স্থান-কাল-পাত্রের দিকে লক্ষ রাখা হত। এ ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। যেখানে যে আলামতগুলোর কথা উল্লেখ করার প্রয়োজন হয়েছে, সেখানে কেবল সেগুলোই বর্ণিত হয়েছে। তাই কোথাও তিনটি আলামত উল্লেখ করা হয়েছে এবং কোথাও চারটি। তার মানে এ নয় যে, এর অতিরিক্ত কোনও আলামত নেই।
ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী রহ. বলেন, উভয় হাদীছের মধ্যে কোনও বিরোধ নেই। কেননা এই হাদীছে তিনটি আলামত উল্লেখ করার দ্বারা এ কথা প্রমাণ হয় না যে, অপর হাদীছে বর্ণিত চতুর্থটি আলামত নয়। মূল কথা হচ্ছে সবগুলোই মুনাফিকের আলামত, তবে সময় অনুপাতে একেকবার একেক ধরনের আলামত উল্লেখ করা হয়েছে।
মুনাফিকের প্রথম আলামত
এ হাদীছে বর্ণিত তিনটি আলামতের প্রথমটি হচ্ছে- إِذَا حَدَّثَ كَذَبَ (যখন কথা বলে, মিথ্যা বলে)। এর দ্বারা মিথ্যা কথা কত গুরুতর পাপ তা অনুমান করা যায়। কেননা প্রকৃত মুনাফিক হচ্ছে একজন সুবিধাবাদী কাফের। সে অন্তরে তার কুফর ও বেঈমানী গোপন রাখে আর বিভিন্ন স্বার্থ ও সুবিধাভোগের খাতিরে নিজেকে মুসলিম বলে জাহির করে। তার সবচে' বড় মিথ্যাচার হচ্ছে কাফের হয়েও নিজেকে মু'মিন ও মুসলিম বলে প্রকাশ করা। এত বড় বিষয়েও যখন সে মিথ্যা বলতে দ্বিধাবোধ করে না, তখন অন্যান্য ক্ষেত্রে তার মিথ্যা বলাটা তো খুবই স্বাভাবিক।
মোটকথা মিথ্যা বলাটা মুনাফিকের স্বভাব। কাজেই একজন মুসলিম ব্যক্তির কোনওক্রমেই মিথ্যা বলা উচিত নয়।
একবার হযরত আব্দুল্লাহ ইবন জারাদ রাযি. নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ইয়া নাবিয়্যাল্লাহ! মু'মিন কি ব্যাভিচার করতে পারে? তিনি বললেন, হাঁ, কখনও তার দ্বারা এটা ঘটে যেতে পারে। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, মু'মিন কি চুরি করতে পারে? তিনি বললেন, হাঁ, এটাও তার দ্বারা কখনও ঘটে যেতে পারে। তাঁর শেষ প্রশ্ন ছিল-
يَا نَبِيَّ اللَّهِ ، هَلْ يَكْذِبُ الْمُؤْمِنُ؟ قَالَ: " لَا " . ثُمَّ أَتْبَعَهَا رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقَالَ هَذِهِ الْكَلِمَةَ: إِنَّمَا يَفْتَرِي الْكَذِبَ الَّذِينَ لَا يُؤْمِنُونَ بِآيَاتِ اللَّهِ وَأُولَئِكَ هُمُ الْكَاذِبُونَ
ইয়া নাবিয়্যাল্লাহ! মু'মিন কি মিথ্যা বলতে পারে? তিনি বললেন, না। এই বলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আয়াত পাঠ করলেন-
إِنَّمَا يَفْتَرِي الْكَذِبَ الَّذِينَ لَا يُؤْمِنُونَ بِآيَاتِ اللَّهِ وَأُولَئِكَ هُمُ الْكَاذِبُونَ
নিশ্চয়ই মিথ্যা রচনা তো (নবী নয়, বরং) তারাই করে, যারা আল্লাহর আয়াতের উপর ঈমান রাখে না। প্রকৃতপক্ষে তারাই মিথ্যাবাদী। (সূরা নাহল (১৬), আয়াত ১০৫) (খারাইতী, মাসাবিউল আখলাক: ১২৭)
মিথ্যা বলাটা এক রকম বিশ্বাসঘাতকতাও বটে। কেননা মিথ্যা যাকে বলা হয়, সে তো সেই কথাটিকে সত্যই মনে করে এবং বক্তাকে সে সত্যবাদী বলে বিশ্বাস করে। কিন্তু মিথ্যুক ব্যক্তি তার বিশ্বাসের পরিপন্থী কাজ করে। তার বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে তাকে দিয়ে মিথ্যা গ্রহণ করায়। এটা তো মারাত্মক বিশ্বাসঘাতকতা। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক হাদীছে ইরশাদ করেন-
كَبُرَتْ خِيَانَةً أَنْ تُحَدِّثَ أَخَاكَ حَدِيثًا هُوَ لَكَ بِهِ مُصَدِّقٌ، وَأَنْتَ لَهُ بِهِ كَاذِبٌ
‘এটা এক মহা বিশ্বাসঘাতকতা যে, তুমি তোমার ভাইয়ের সঙ্গে কোনও কথা বলছ আর সে তোমাকে বিশ্বাস করছে, অথচ তুমি তার সঙ্গে মিথ্যা বলছ।' (সুনানে আবু দাউদ: ৪৯৭১; আল-আদাবুল মুফরাদ: ৩৯৩; খারাইতী, মাসাবিউল আখলাক : ১০৯; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা ২০৮৪৬; শু'আবুল ঈমান: ৪৪৭৯; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ: ৩৫৭৯; তাবারানী, মুসনাদুশ শামিয়্যীন: ৪৯৫; মুসনাদে আহমাদ: ১৭৬৩৫)
মুনাফিকের দ্বিতীয় আলামত
মুনাফিকের দ্বিতীয় আলামত হল- وَإِذَا وَعَدَ أَخْلَفَ (যখন ওয়াদা করে, তা ভঙ্গ করে)। মু'মিন ব্যক্তি ওয়াদা রক্ষাকারী হয়ে থাকে।
ওয়াদাভঙ্গ কথা দ্বারাও হতে পারে, কাজ দ্বারাও হতে পারে। উভয়টিই মুনাফিকের আলামত। তবে এটা মুনাফিকের আলামত হবে তখনই, যখন ওয়াদা দেওয়ার সময়ই মনে মনে তা রক্ষা করার নিয়ত না থাকে। পক্ষান্তরে যদি রক্ষা করার নিয়ত থাকে কিন্তু বাস্তবিক কোনও ওজরবশত সে তা রক্ষা করতে না পারে, তবে তা মুনাফিকের আলামতরূপে গণ্য হবে না। এক হাদীছে আছে-
إِذَا وَعَدَ الرَّجُلُ أَخَاهُ، وَمِنْ نِيَّتِهِ أَنْ يَفِيَ لَهُ ، فَلَمْ يَفِ وَلَمْ يَجِئْ لِلْمِيعَادِ، فَلَا إِثْمَ عَلَيْهِ
‘কোনও ব্যক্তি যদি তার ভাইয়ের সঙ্গে কোনও ওয়াদা করে এবং সে ওয়াদা পূরণ করার নিয়তও তার থাকে, কিন্তু পরে সে তা পূরণ করতে না পারে এবং সময়মতো আসতে সক্ষম না হয়, তবে তার কোনও গুনাহ হবে না।' (সুনানে আবু দাউদ: ৪৯৯৫; জামে' তিরমিযী: ২৬৩৩; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর: ৫০৮০; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা: ২০৮৩৮)
সুতরাং কেউ যখন কোনও ওয়াদা করে, তখন অবশ্যই তা পূরণ করার নিয়ত থাকতে হবে। পূরণ করার নিয়ত না থাকলে তা মিথ্যা কথা ও বিশ্বাসঘাতকতা বলে গণ্য হবে, যা কিনা মুনাফিকীর আলামত। কোনও মুমিন ও ভদ্র ব্যক্তির কিছুতেই এটা করা উচিত নয়। বলা হয়ে থাকে, ভদ্র লোক যখন কোনও ওয়াদা করে, তখন সে তা অবশ্যই পূরণ করে। হযরত আব্দুল্লাহ ইবন আমির ইবন রাবী'আ রাযি. বলেন, একবার নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের বাড়িতে আসলেন। তখন আমি শিশু। আমি খেলতে বের হয়ে গেলাম। আমার মা আমাকে ডাকলেন, হে আব্দুল্লাহ! এসো, তোমাকে দেব। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তুমি তাকে কী দেওয়ার ইচ্ছা করেছ? তিনি বললেন, তাকে একটি খেজুর দেওয়ার ইচ্ছা করেছি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তুমি তা না করলে তোমার আমলনামায় একটি মিথ্যা লেখা হত। (সুনানে আবু দাউদ: ৪৯৯১; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা ২০৮৩৯; শু'আবুল ঈমান: ৪৪৮২; মুসনাদে আহমাদ: ১৫৭০২; খারাইতী, মাকারিমুল আখলাক: ২০২)
হাদীছটি দ্বারা বোঝা গেল ওয়াদা পূরণ না করলে তা মিথ্যা কথা বলে গণ্য হয়। এমনকি সে ওয়াদা শিশুর সঙ্গে করলেও। আর তা মুনাফিকীর আলামত তো বটেই।
মুনাফিকের তৃতীয় আলামত
মুনাফিকের তৃতীয় আলামত হচ্ছে- وَإِذَا اؤْتُمِنَ خَانَ (যখন তার কাছে আমানত রাখা হয়, সে তাতে খেয়ানত করে)। আমানত রক্ষা করা মু'মিন ব্যক্তির এক অপরিহার্য গুণ। আল্লাহ তা'আলা মু'মিনের পরিচয় দিতে গিয়ে যেসকল গুণের উল্লেখ করেছেন তার মধ্যে এটিও একটি। ইরশাদ হয়েছে-
وَالَّذِينَ هُمْ لِأَمَانَاتِهِمْ وَعَهْدِهِمْ رَاعُونَ
‘এবং যারা তাদের আমানত ও প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে।' (সূরা মা'আরিজ (৭০), আয়াত ৩২)
যেহেতু আমানত রক্ষা মু'মিনের অপরিহার্য গুণ, তাই আমানতের খেয়ানত করতে কঠিনভাবে নিষেধ করা হয়েছে। যেমন ইরশাদ হয়েছে-
يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَخُونُوا اللَّهَ وَالرَّسُولَ وَتَخُونُوا أَمَانَاتِكُمْ وَأَنْتُمْ تَعْلَمُونَ
হে মুমিনগণ! আল্লাহ ও রাসূলের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করো না এবং জেনেশুনে নিজেদের আমানতের খেয়ানত করো না। (সূরা আনফাল (৮), আয়াত ২৭)
এতে সম্বোধন করা হয়েছে 'মুমিন' বলে। অর্থাৎ খেয়ানত করা মু'মিনের কাজ হতে পারে না। আর আলোচ্য হাদীছ দ্বারা জানা গেল এটা মুনাফিকের আলামত।
আমানতের খেয়ানত করা কঠিন পাপ। এক হাদীছ দ্বারা জানা যায়, আল্লাহর পথে শহীদ হওয়ার দ্বারা সব গুনাহ মাফ হয়, কিন্তু আমানতের খেয়ানত করার গুনাহ মাফ হয় না। কিয়ামতের দিন খেয়ানতকারীকে ডেকে বলা হবে, তোমার কাছে যে আমানত রাখা হয়েছিল তা আদায় করো। সে বলবে, হে আমার প্রতিপালক! এটা কীভাবে সম্ভব, যখন আমরা দুনিয়া থেকে চলে এসেছি? তখন ঘোষণা করা হবে, একে জাহান্নামে নিয়ে যাও। সুতরাং এহেন কঠিন পাপ থেকে প্রত্যেক মুমিনকে অবশ্যই বিরত থাকতে হবে।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. যে ব্যক্তি নিজেকে মুমিন বলে পরিচয় দেয়, তার কিছুতেই মিথ্যা বলা সাজে না।
খ. আমাদেরকে অবশ্যই ওয়াদা রক্ষায় যত্নবান থাকতে হবে।
গ. আমানতের খেয়ানত করা কঠিন পাপ। এর থেকে আমাদের বিরত থাকতে হবে।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)