রিয়াযুস সালিহীন-ইমাম নববী রহঃ
২. বিবিধ আদব - শিষ্টাচারের অধ্যায়
হাদীস নং: ৬৯২
বিবিধ আদব - শিষ্টাচারের অধ্যায়
সাক্ষাৎকালে উত্তম কথা বলা ও হাসিমুখে থাকা
মানুষ সামাজিক জীব হওয়ায় একের সঙ্গে অন্যের নানাবিধ প্রয়োজন থাকেই। অন্যের সাহায্য-সহযোগিতা নেওয়া ছাড়া কেউ চলতে পারে না। তাই নানা প্রয়োজনে একের সঙ্গে অন্যের দেখা-সাক্ষাতের প্রয়োজন পড়ে। পরস্পরে দেখা-সাক্ষাৎ করার দ্বারা প্রয়োজন পূরণ অনেক সহজ হয়।
মানুষের প্রয়োজন দুই রকম। পার্থিব প্রয়োজন ও দীনী প্রয়োজন। দেখা-সাক্ষাৎ করা দরকার হয় উভয় প্রয়োজন পূরণের জন্যই।
কেউ যখন তার দীনী বা দুনিয়াবী প্রয়োজনে কারও সঙ্গে সাক্ষাৎ করে, তখন তার উচিত সাক্ষাৎকারীকে আন্তরিকতার সঙ্গে গ্রহণ করা। উত্তম কথা বলা ও মুখে হাসি ফুটিয়ে তোলা আন্তরিকতার প্রকাশ। এর দ্বারা সাক্ষাৎপ্রার্থী বুঝতে পারে তার আগমনে সে বিরক্ত হয়নি; বরং খুশি হয়েছে। এতে করে সে যে উদ্দেশ্যে এসেছে তা পূরণ হবে বলে তার মনে আশা জন্মাবে। তাই ইসলাম মানুষকে উত্তম কথা বলার হুকুম করেছে।
কুরআন মাজীদে ইরশাদ-
وَقُولُوا لِلنَّاسِ حُسْنًا
‘মানুষের সাথে ভালো কথা বলবে।(সূরা বাকারা (২), আয়াত ৮৩)
অন্যত্র ইরশাদ-
وَقُلْ لِعِبَادِي يَقُولُوا الَّتِي هِيَ أَحْسَنُ
‘আমার (মুমিন) বান্দাদের বলে দাও, তারা যেন এমন কথাই বলে, যা উত্তম।'(সূরা বনী ইসরাঈল (১৭) আয়াত ৫৩)
মুমিন বান্দা হিসেবে উত্তম কথা আমাদের বলতেই হবে। কেননা আখেরে এর দ্বারা নিজেরই লাভ। এই যে অন্যের প্রয়োজন সমাধার কথা বলা হল, এটা তো এক মানবিক কাজ, যা দ্বারা আল্লাহ তা'আলা খুশি হন এবং এর অনেক ছাওয়াব। কাজেই অন্যের প্রয়োজন পূরণের সঙ্গে নিজ স্বার্থ জড়িত রয়েছে। পরকালীন স্বার্থ। তাই খুশিমনেই তা পূরণের চেষ্টা করা উচিত। বরং যে ব্যক্তি সাহায্য গ্রহণের জন্য এসেছে, তার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করাই বাঞ্ছনীয়। কারণ সে উপকার নিতে এসে প্রকৃতপক্ষে তারই উপকার করছে। কাজেই তার আগমনে সে যে খুশি, কথাবার্তা ও মুখের ভাব দ্বারা তা প্রকাশ করা উচিত।
উত্তম কথা ও মুখের হাসি দ্বারা আগন্তুককে খুশিও করা যায়। মানুষকে খুশি করা স্বতন্ত্র এক ছাওয়াবের কাজ। তাছাড়া খুশির সঙ্গে কারও প্রয়োজন সমাধা করলে তার পক্ষে তা গ্রহণ করা সহজ হয়। এতে মনে চাপ পড়ে না। উপকারকারীর কাছে নিজেকে ছোট মনে হয় না। সে ক্ষেত্রে তার দ্বারা কৃতজ্ঞতা প্রকাশও সহজ হয়।
যে ব্যক্তি মুখ ভার করে অন্যের উপকার করে, তার প্রতি উপকারগ্রহীতা স্বচ্ছন্দ হতে পারে না। উপকারগ্রহণটা তার মাথার উপর এক কঠিন বোঝা হয়ে থাকে। ফলে সে মনেপ্রাণে উপকারকারীর প্রতি কৃতজ্ঞ থাকতে পারে না। এ অবস্থায় অনেক সময় তার আচরণ উপকারকারীর কাছে অপ্রীতিকর বোধ হয়। তখন সে মনে মনে তাকে অকৃতজ্ঞ ঠাওরায়। কখনও মুখেও তা প্রকাশ করে। বহুলাংশেই এ অকৃতজ্ঞতার জন্য সে নিজেই দায়ী। সে উপকার করেছে বটে, কিন্তু আচরণটা সুন্দর করেনি। খুশিমনে করেনি।
সাক্ষাৎ যে কেবল প্রয়োজনের দায়েই হতে হবে, এমন কোনও কথা নেই। ইসলামী ভ্রাতৃত্ববোধের তাগিদেও এক মুসলিমের অপর মুসলিমের সঙ্গে সাক্ষাৎ করা উচিত। এতে আল্লাহ তা'আলা খুশি হন। এর অনেক ছাওয়াব। সুতরাং বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া কেবল সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে সাক্ষাৎ করাও একটি দীনী কাজ। সুতরাং কেউ যদি এ কারণেও সাক্ষাৎ করতে আসে, তখন তার সে আসাটাকে ভালোভাবে গ্রহণ করা উচিত। কেননা এ আসাটা একটি মহৎ কাজ। একে ভালোভাবে গ্রহণ করলে নিজেরও অনেক ছাওয়াব হবে। উভয়ের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব ও সম্প্রীতি দৃঢ় তো হবেই, যা কিনা আমাদের দীনের এক গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা।
মোটকথা সর্ববিচারেই কেউ সাক্ষাৎ করতে আসলে তাকে হাসিমুখে গ্রহণ করা উচিত এবং তার সঙ্গে ভালো ভালো কথা বলা উচিত। এ বিষয়ে কুরআন মাজীদ ও হাদীছের সুস্পষ্ট শিক্ষা রয়েছে। সে শিক্ষা সম্পর্কেই এ পরিচ্ছেদটির অবতারণা। আল্লাহ তা'আলা আমাদেরকে এর উপর আমল করার তাওফীক দান করুন।
‘সাক্ষাৎকালে উত্তম কথা বলা ও হাসিমুখে থাকা’ সম্পর্কিত দুটি আয়াত
এক নং আয়াত
وَاخْفِضْ جَنَاحَكَ لِلْمُؤْمِنِينَ
অর্থ: আর যারা ঈমান এনেছে তাদের জন্য তোমার (বাৎসল্যের) ডানা নামিলে দাও।(সূরা হিজর (১৫), আয়াত ৮৮)
ব্যাখ্যা
وَاخْفِضْ جَنَاحَكَ এর মূল অর্থ- তোমার ডানা নামিয়ে দাও। ‘ডানা নামানো’ দ্বারা মমত্বপূর্ণ আচরণ বোঝানো হয়। ‘মুমিনদের প্রতি ডানা নামিয়ে দাও’-এর অর্থ হবে- যারা তোমার প্রতি ঈমান এনেছে, তুমি তাদের প্রতি মমত্বের আচরণ করো, যাতে তারা তোমার কাছে কাছে থাকে, দূরে সরে না যায়।
সরাসরি এ আদেশটি করা হয়েছে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে, যাতে তিনি মুমিন-মুসলিমদের প্রতি নম্রকোমল আচরণ বজায় রাখেন। প্রকৃতপক্ষে তিনি সকলের প্রতি এরকম আচরণই করতেন। তারপরও তাঁকে এ আদেশ করার দ্বারা বিষয়টির গুরুত্ব তুলে ধরা হয়েছে, যাতে তাঁর উম্মতের প্রত্যেকেও সকলের সঙ্গে স্নেহ-মমতা ও ভালোবাসার আচরণ করে। সে আচরণের একটা দিক এইও যে, যখন যার সঙ্গে সাক্ষাৎ হবে, তাকে আন্তরিকতার সঙ্গে গ্রহণ করবে। চেহারায় আনন্দের ভাব ফুটিয়ে তুলবে এবং কথা বলবে হাসি দিয়ে। যদি রাশভারি চেহারায় সাক্ষাৎ করে, মুখে হাসি না থাকে, তবে আগুন্তুক ব্যক্তি অস্বস্তি বোধ করবে। সে ভাববে আমার আগমনে ইনি খুশি নন। ফলে সে পরে আর কখনও তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চাইবে না। এভাবে সে তার থেকে দূরে সরে যাবে। ফলে পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ব ও ভালোবাসার সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যাবে, যা কিছুতেই কাম্য নয়। ইসলাম তার অনুসারীদের পারস্পরিক সম্প্রীতি ও ভালোবাসার বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে থাকে। এটা ঈমানেরও অঙ্গ। তাই এদিকে বিশেষভাবে লক্ষ রাখা প্রয়োজন। প্রত্যেক মুমিনের কর্তব্য অপরাপর মুমিনদের উপর মমত্বের ডানা বিছিয়ে দেওয়া এবং সকলকে খুশিমনে ও উৎফুল্ল চেহারায় গ্রহণ করে নেওয়া।
উল্লেখ্য, এ আয়াতটি ৭ম খণ্ডের ৭১ নং অধ্যায়ের ১নং আয়াতরূপে গত হয়েছে। সেখানে এর বিস্তারিত ব্যাখ্যা দ্রষ্টব্য।
আয়াতটির শিক্ষা
ক. প্রত্যেক মুমিনের কর্তব্য আত্মীয়-অনাত্মীয় নির্বিশেষে যে-কোনও মুমিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ হবে, তার প্রতি ভালোবাসা ও আন্তরিকতা প্রদর্শন করবে এবং হাসিমুখে তাকে গ্রহণ করবে।
খ. আয়াতটির শব্দসমূহের প্রতি লক্ষ করলে জানা যায় যে, কুরআন মাজীদের কোনও কোনও শব্দ তার প্রকৃত অর্থে নয়; বরং রূপক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। কাজেই আয়াতের অর্থ ও ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে সেদিকেও লক্ষ রাখা জরুরি।
দুই নং আয়াত
وَلَوْ كُنْتَ فَظًّا غَلِيظَ الْقَلْبِ لَانْفَضُّوا مِنْ حَوْلِكَ
অর্থ: তুমি যদি রূঢ় প্রকৃতির ও কঠোর হৃদয় হতে, তবে তারা তোমার আশপাশ থেকে সরে বিক্ষিপ্ত হয়ে যেত।(সূরা আলে ইমরান (৩), আয়াত ১৫৯)
ব্যাখ্যা
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অত্যন্ত কোমল চরিত্রের ছিলেন। তিনি সাহাবায়ে কেরামের প্রতি পিতার মতো আচরণ করতেন। সাক্ষাৎকালে চেহারায় আনন্দ প্রকাশ করতেন ও হাসিমুখে কথা বলতেন। এতে তারা তাঁর সঙ্গে সহজ হয়ে যেতেন। ফলে যে-কোনও কথা তাঁর সঙ্গে সচ্ছন্দে বলতে পারতেন। যে-কোনও প্রয়োজন অসংকোচে তাঁর সামনে পেশ করতে পারতেন। তাঁর প্রফুল্ল চেহারার সাক্ষাৎ ও হাসিমুখের কথা তাদের অন্তরে ভালোবাসার বীজ বুনে দিত। তারা যে তাঁর জন্য অকাতরে নিজেদের জান-মাল বিলিয়ে দিতেন, তা তাঁর সেই মধুর আচরণ ও প্রাণজুড়ানো হাসির ফল বৈ কি।
অনেক সময় তাদের দ্বারা ভুল-ত্রুটিও হয়ে যেত, কিন্তু তিনি তা ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখতেন এবং পরম মমত্বের সঙ্গে তাদের বোঝাতেন ও সংশোধন করে দিতেন। তাঁর ক্ষমাপরায়ণতা ও মমত্বসুলভ আচরণের ঘটনাবলি দ্বারা হাদীছ ও সীরাত গ্রন্থসমূহ ভরপুর। তা দ্বারা প্রমাণ হয় তিনি ব্যক্তিগত বিষয়ে কখনও কারও থেকে প্রতিশোধ নেননি। জীবনভর কেবল ক্ষমাই করে গেছেন। এটা তাঁর নবুওয়াতী গুণের এক দিক। তাঁর নবুওয়াতী গুণেরই আরেক দিক হল তিনি দীনী অন্যায়-অপরাধের ক্ষেত্রে খুবই কঠোর ছিলেন। সে কঠোরতা ছিল আল্লাহরই জন্য। আল্লাহ তা'আলাই নম্রতা প্রদর্শনের ক্ষেত্রে সীমারেখা নির্ধারণ করে দিয়েছেন। কারও দ্বারা যদি শরী'আতের অবমাননা হয়, সে ক্ষেত্রে কঠোরতাই কাম্য। বিভিন্ন ঘটনা দ্বারা তাঁর চরিত্রের এ দিকটিও সুস্পষ্ট হয়ে আছে।
উহুদের যুদ্ধে কতক সাহাবীর দ্বারা একটা ভুল হয়ে গিয়েছিল। সে ভুলের কারণে এ যুদ্ধে মুসলিমদের ব্যাপক হতাহতের শিকার হতে হয় এবং পরাজয়ও বরণ করতে হয়। এ অপূরণীয় ক্ষতির কারণে খুবই স্বাভাবিক ছিল যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অত্যন্ত মর্মাহত হবেন এবং যারা ভুল করেছিল তাদের প্রতি নারাজ হয়ে কঠোরতা প্রদর্শন করবেন। কিন্তু তা করতে গেলে ক্ষতিরও আশঙ্কা ছিল। এ আয়াতে সে ক্ষতির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে তাদের সঙ্গে নম্র-কোমল আচরণ করতে বলা হয়েছে। আল্লাহ তা'আলা বলেন-
وَلَوْ كُنْتَ فَظًّا غَلِيظَ الْقَلْبِ لَانْفَضُّوا مِنْ حَوْلِكَ (তুমি যদি রূঢ় প্রকৃতির ও কঠোর হৃদয় হতে, তবে তারা তোমার আশপাশ থেকে সরে বিক্ষিপ্ত হয়ে যেত)। অর্থাৎ নরম স্বভাবের হওয়ার কারণে আপনি সর্বদা সাহাবীদের প্রতি কোমল আচরণ করে এসেছেন। তাদের ভুল-ত্রুটি হলেও তা ক্ষমা করে দিয়েছেন। ক্ষমা না করে যদি কঠোর ও রুক্ষ আচরণ করতেন, তবে তারা এখন যেমন আপনার কাছে ভিড়ছে এবং আপনার জন্য জান-মাল সব উৎসর্গ করে দিচ্ছে, সেরকম করতে পারত না। তারা ভীত ও কুণ্ঠিত হয়ে থাকত। এক পর্যায়ে উৎসাহ-উদ্দীপনা হারিয়ে দূরেই সরে পড়ত। সে ক্ষেত্রে তাদের অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে যেত। আপনার সাহচর্যে লেগে থাকায় তারা দীন শিখতে পারছে, চারিত্রিক উন্নতি ঘটাতে পারছে এবং আল্লাহ তা'আলার রহমত ও করুণাধারায় সদা সিক্ত হয়ে থাকছে। তারা তাদের এ সৌভাগ্য এ কারণেই লাভ করতে পারছে যে, আপনি সর্বদাই তাদের প্রতি নম্র-কোমল আচরণ করে যাচ্ছেন। এ বাক্যের আগে আল্লাহ তা'আলা বলেছেন-
فَبِمَا رَحْمَةٍ مِنَ اللَّهِ لِنْتَ لَهُمْ (আল্লাহর রহমতেই তুমি তাদের প্রতি কোমল হৃদয় হয়েছ)। সুতরাং উহুদ যুদ্ধের এ ভুলের ক্ষেত্রেও আপনার হৃদয়ের সে কোমলতার দাবি আপনি তাদের ক্ষমা করে দেবেন। সুতরাং এর পরেই আল্লাহ তা'আলা বলছেন-
فَاعْفُ عَنْهُمْ وَاسْتَغْفِرْ لَهُمْ ‘তুমি তাদের ক্ষমা করে দাও এবং (আল্লাহর কাছেও) তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করো'। অর্থাৎ তাদের যে ভুলের সম্পর্ক ব্যক্তিগতভাবে আপনার সঙ্গে, তা আপনি ক্ষমা করে দিন। আর সে ভুলের যে সম্পর্ক আল্লাহ তা'আলার সঙ্গে, সেজন্য আপনি আল্লাহ তা'আলার কাছেও তাদের অনুকূলে ক্ষমা প্রার্থনা করুন, যাতে আল্লাহ তা'আলাও তাদের ক্ষমা করে দেন।
আয়াতটির শিক্ষা
ক. ব্যক্তিগত বিষয়ে মানুষের প্রতি ক্ষমাপরায়ণ থাকা ও নম্র-কোমল আচরণ করাই ছিল নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চরিত্র। আমাদেরও এ গুণ রপ্ত করতে হবে।
খ. দীনের অনুসরণীয় ব্যক্তি ও নেতৃবর্গের উচিত তাদের অনুসারী ও সাথী-সঙ্গীদের প্রতি মমত্বপূর্ণ আচরণ করা। এটা তাদের শিক্ষাদান ও তরবিয়াতের পক্ষে খুব বেশি সহায়ক।
গ. যখন যার সঙ্গেই সাক্ষাৎ হবে, তখন মুমিন ব্যক্তির কর্তব্য হবে তার প্রতি আন্তরিকতা প্রকাশ করা এবং তার সঙ্গে হাসিমুখে কথা বলা।
ঘ. অনুসারী ও অনুচরদের প্রতি কঠোর আচরণ অবাঞ্ছনীয়। এতে করে তারা ক্রমে দূরে সরে যায় এবং পরিণামে দীনী ও দুনিয়াবী দিক থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
মানুষ সামাজিক জীব হওয়ায় একের সঙ্গে অন্যের নানাবিধ প্রয়োজন থাকেই। অন্যের সাহায্য-সহযোগিতা নেওয়া ছাড়া কেউ চলতে পারে না। তাই নানা প্রয়োজনে একের সঙ্গে অন্যের দেখা-সাক্ষাতের প্রয়োজন পড়ে। পরস্পরে দেখা-সাক্ষাৎ করার দ্বারা প্রয়োজন পূরণ অনেক সহজ হয়।
মানুষের প্রয়োজন দুই রকম। পার্থিব প্রয়োজন ও দীনী প্রয়োজন। দেখা-সাক্ষাৎ করা দরকার হয় উভয় প্রয়োজন পূরণের জন্যই।
কেউ যখন তার দীনী বা দুনিয়াবী প্রয়োজনে কারও সঙ্গে সাক্ষাৎ করে, তখন তার উচিত সাক্ষাৎকারীকে আন্তরিকতার সঙ্গে গ্রহণ করা। উত্তম কথা বলা ও মুখে হাসি ফুটিয়ে তোলা আন্তরিকতার প্রকাশ। এর দ্বারা সাক্ষাৎপ্রার্থী বুঝতে পারে তার আগমনে সে বিরক্ত হয়নি; বরং খুশি হয়েছে। এতে করে সে যে উদ্দেশ্যে এসেছে তা পূরণ হবে বলে তার মনে আশা জন্মাবে। তাই ইসলাম মানুষকে উত্তম কথা বলার হুকুম করেছে।
কুরআন মাজীদে ইরশাদ-
وَقُولُوا لِلنَّاسِ حُسْنًا
‘মানুষের সাথে ভালো কথা বলবে।(সূরা বাকারা (২), আয়াত ৮৩)
অন্যত্র ইরশাদ-
وَقُلْ لِعِبَادِي يَقُولُوا الَّتِي هِيَ أَحْسَنُ
‘আমার (মুমিন) বান্দাদের বলে দাও, তারা যেন এমন কথাই বলে, যা উত্তম।'(সূরা বনী ইসরাঈল (১৭) আয়াত ৫৩)
মুমিন বান্দা হিসেবে উত্তম কথা আমাদের বলতেই হবে। কেননা আখেরে এর দ্বারা নিজেরই লাভ। এই যে অন্যের প্রয়োজন সমাধার কথা বলা হল, এটা তো এক মানবিক কাজ, যা দ্বারা আল্লাহ তা'আলা খুশি হন এবং এর অনেক ছাওয়াব। কাজেই অন্যের প্রয়োজন পূরণের সঙ্গে নিজ স্বার্থ জড়িত রয়েছে। পরকালীন স্বার্থ। তাই খুশিমনেই তা পূরণের চেষ্টা করা উচিত। বরং যে ব্যক্তি সাহায্য গ্রহণের জন্য এসেছে, তার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করাই বাঞ্ছনীয়। কারণ সে উপকার নিতে এসে প্রকৃতপক্ষে তারই উপকার করছে। কাজেই তার আগমনে সে যে খুশি, কথাবার্তা ও মুখের ভাব দ্বারা তা প্রকাশ করা উচিত।
উত্তম কথা ও মুখের হাসি দ্বারা আগন্তুককে খুশিও করা যায়। মানুষকে খুশি করা স্বতন্ত্র এক ছাওয়াবের কাজ। তাছাড়া খুশির সঙ্গে কারও প্রয়োজন সমাধা করলে তার পক্ষে তা গ্রহণ করা সহজ হয়। এতে মনে চাপ পড়ে না। উপকারকারীর কাছে নিজেকে ছোট মনে হয় না। সে ক্ষেত্রে তার দ্বারা কৃতজ্ঞতা প্রকাশও সহজ হয়।
যে ব্যক্তি মুখ ভার করে অন্যের উপকার করে, তার প্রতি উপকারগ্রহীতা স্বচ্ছন্দ হতে পারে না। উপকারগ্রহণটা তার মাথার উপর এক কঠিন বোঝা হয়ে থাকে। ফলে সে মনেপ্রাণে উপকারকারীর প্রতি কৃতজ্ঞ থাকতে পারে না। এ অবস্থায় অনেক সময় তার আচরণ উপকারকারীর কাছে অপ্রীতিকর বোধ হয়। তখন সে মনে মনে তাকে অকৃতজ্ঞ ঠাওরায়। কখনও মুখেও তা প্রকাশ করে। বহুলাংশেই এ অকৃতজ্ঞতার জন্য সে নিজেই দায়ী। সে উপকার করেছে বটে, কিন্তু আচরণটা সুন্দর করেনি। খুশিমনে করেনি।
সাক্ষাৎ যে কেবল প্রয়োজনের দায়েই হতে হবে, এমন কোনও কথা নেই। ইসলামী ভ্রাতৃত্ববোধের তাগিদেও এক মুসলিমের অপর মুসলিমের সঙ্গে সাক্ষাৎ করা উচিত। এতে আল্লাহ তা'আলা খুশি হন। এর অনেক ছাওয়াব। সুতরাং বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া কেবল সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে সাক্ষাৎ করাও একটি দীনী কাজ। সুতরাং কেউ যদি এ কারণেও সাক্ষাৎ করতে আসে, তখন তার সে আসাটাকে ভালোভাবে গ্রহণ করা উচিত। কেননা এ আসাটা একটি মহৎ কাজ। একে ভালোভাবে গ্রহণ করলে নিজেরও অনেক ছাওয়াব হবে। উভয়ের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব ও সম্প্রীতি দৃঢ় তো হবেই, যা কিনা আমাদের দীনের এক গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা।
মোটকথা সর্ববিচারেই কেউ সাক্ষাৎ করতে আসলে তাকে হাসিমুখে গ্রহণ করা উচিত এবং তার সঙ্গে ভালো ভালো কথা বলা উচিত। এ বিষয়ে কুরআন মাজীদ ও হাদীছের সুস্পষ্ট শিক্ষা রয়েছে। সে শিক্ষা সম্পর্কেই এ পরিচ্ছেদটির অবতারণা। আল্লাহ তা'আলা আমাদেরকে এর উপর আমল করার তাওফীক দান করুন।
‘সাক্ষাৎকালে উত্তম কথা বলা ও হাসিমুখে থাকা’ সম্পর্কিত দুটি আয়াত
এক নং আয়াত
وَاخْفِضْ جَنَاحَكَ لِلْمُؤْمِنِينَ
অর্থ: আর যারা ঈমান এনেছে তাদের জন্য তোমার (বাৎসল্যের) ডানা নামিলে দাও।(সূরা হিজর (১৫), আয়াত ৮৮)
ব্যাখ্যা
وَاخْفِضْ جَنَاحَكَ এর মূল অর্থ- তোমার ডানা নামিয়ে দাও। ‘ডানা নামানো’ দ্বারা মমত্বপূর্ণ আচরণ বোঝানো হয়। ‘মুমিনদের প্রতি ডানা নামিয়ে দাও’-এর অর্থ হবে- যারা তোমার প্রতি ঈমান এনেছে, তুমি তাদের প্রতি মমত্বের আচরণ করো, যাতে তারা তোমার কাছে কাছে থাকে, দূরে সরে না যায়।
সরাসরি এ আদেশটি করা হয়েছে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে, যাতে তিনি মুমিন-মুসলিমদের প্রতি নম্রকোমল আচরণ বজায় রাখেন। প্রকৃতপক্ষে তিনি সকলের প্রতি এরকম আচরণই করতেন। তারপরও তাঁকে এ আদেশ করার দ্বারা বিষয়টির গুরুত্ব তুলে ধরা হয়েছে, যাতে তাঁর উম্মতের প্রত্যেকেও সকলের সঙ্গে স্নেহ-মমতা ও ভালোবাসার আচরণ করে। সে আচরণের একটা দিক এইও যে, যখন যার সঙ্গে সাক্ষাৎ হবে, তাকে আন্তরিকতার সঙ্গে গ্রহণ করবে। চেহারায় আনন্দের ভাব ফুটিয়ে তুলবে এবং কথা বলবে হাসি দিয়ে। যদি রাশভারি চেহারায় সাক্ষাৎ করে, মুখে হাসি না থাকে, তবে আগুন্তুক ব্যক্তি অস্বস্তি বোধ করবে। সে ভাববে আমার আগমনে ইনি খুশি নন। ফলে সে পরে আর কখনও তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চাইবে না। এভাবে সে তার থেকে দূরে সরে যাবে। ফলে পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ব ও ভালোবাসার সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যাবে, যা কিছুতেই কাম্য নয়। ইসলাম তার অনুসারীদের পারস্পরিক সম্প্রীতি ও ভালোবাসার বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে থাকে। এটা ঈমানেরও অঙ্গ। তাই এদিকে বিশেষভাবে লক্ষ রাখা প্রয়োজন। প্রত্যেক মুমিনের কর্তব্য অপরাপর মুমিনদের উপর মমত্বের ডানা বিছিয়ে দেওয়া এবং সকলকে খুশিমনে ও উৎফুল্ল চেহারায় গ্রহণ করে নেওয়া।
উল্লেখ্য, এ আয়াতটি ৭ম খণ্ডের ৭১ নং অধ্যায়ের ১নং আয়াতরূপে গত হয়েছে। সেখানে এর বিস্তারিত ব্যাখ্যা দ্রষ্টব্য।
আয়াতটির শিক্ষা
ক. প্রত্যেক মুমিনের কর্তব্য আত্মীয়-অনাত্মীয় নির্বিশেষে যে-কোনও মুমিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ হবে, তার প্রতি ভালোবাসা ও আন্তরিকতা প্রদর্শন করবে এবং হাসিমুখে তাকে গ্রহণ করবে।
খ. আয়াতটির শব্দসমূহের প্রতি লক্ষ করলে জানা যায় যে, কুরআন মাজীদের কোনও কোনও শব্দ তার প্রকৃত অর্থে নয়; বরং রূপক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। কাজেই আয়াতের অর্থ ও ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে সেদিকেও লক্ষ রাখা জরুরি।
দুই নং আয়াত
وَلَوْ كُنْتَ فَظًّا غَلِيظَ الْقَلْبِ لَانْفَضُّوا مِنْ حَوْلِكَ
অর্থ: তুমি যদি রূঢ় প্রকৃতির ও কঠোর হৃদয় হতে, তবে তারা তোমার আশপাশ থেকে সরে বিক্ষিপ্ত হয়ে যেত।(সূরা আলে ইমরান (৩), আয়াত ১৫৯)
ব্যাখ্যা
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অত্যন্ত কোমল চরিত্রের ছিলেন। তিনি সাহাবায়ে কেরামের প্রতি পিতার মতো আচরণ করতেন। সাক্ষাৎকালে চেহারায় আনন্দ প্রকাশ করতেন ও হাসিমুখে কথা বলতেন। এতে তারা তাঁর সঙ্গে সহজ হয়ে যেতেন। ফলে যে-কোনও কথা তাঁর সঙ্গে সচ্ছন্দে বলতে পারতেন। যে-কোনও প্রয়োজন অসংকোচে তাঁর সামনে পেশ করতে পারতেন। তাঁর প্রফুল্ল চেহারার সাক্ষাৎ ও হাসিমুখের কথা তাদের অন্তরে ভালোবাসার বীজ বুনে দিত। তারা যে তাঁর জন্য অকাতরে নিজেদের জান-মাল বিলিয়ে দিতেন, তা তাঁর সেই মধুর আচরণ ও প্রাণজুড়ানো হাসির ফল বৈ কি।
অনেক সময় তাদের দ্বারা ভুল-ত্রুটিও হয়ে যেত, কিন্তু তিনি তা ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখতেন এবং পরম মমত্বের সঙ্গে তাদের বোঝাতেন ও সংশোধন করে দিতেন। তাঁর ক্ষমাপরায়ণতা ও মমত্বসুলভ আচরণের ঘটনাবলি দ্বারা হাদীছ ও সীরাত গ্রন্থসমূহ ভরপুর। তা দ্বারা প্রমাণ হয় তিনি ব্যক্তিগত বিষয়ে কখনও কারও থেকে প্রতিশোধ নেননি। জীবনভর কেবল ক্ষমাই করে গেছেন। এটা তাঁর নবুওয়াতী গুণের এক দিক। তাঁর নবুওয়াতী গুণেরই আরেক দিক হল তিনি দীনী অন্যায়-অপরাধের ক্ষেত্রে খুবই কঠোর ছিলেন। সে কঠোরতা ছিল আল্লাহরই জন্য। আল্লাহ তা'আলাই নম্রতা প্রদর্শনের ক্ষেত্রে সীমারেখা নির্ধারণ করে দিয়েছেন। কারও দ্বারা যদি শরী'আতের অবমাননা হয়, সে ক্ষেত্রে কঠোরতাই কাম্য। বিভিন্ন ঘটনা দ্বারা তাঁর চরিত্রের এ দিকটিও সুস্পষ্ট হয়ে আছে।
উহুদের যুদ্ধে কতক সাহাবীর দ্বারা একটা ভুল হয়ে গিয়েছিল। সে ভুলের কারণে এ যুদ্ধে মুসলিমদের ব্যাপক হতাহতের শিকার হতে হয় এবং পরাজয়ও বরণ করতে হয়। এ অপূরণীয় ক্ষতির কারণে খুবই স্বাভাবিক ছিল যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অত্যন্ত মর্মাহত হবেন এবং যারা ভুল করেছিল তাদের প্রতি নারাজ হয়ে কঠোরতা প্রদর্শন করবেন। কিন্তু তা করতে গেলে ক্ষতিরও আশঙ্কা ছিল। এ আয়াতে সে ক্ষতির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে তাদের সঙ্গে নম্র-কোমল আচরণ করতে বলা হয়েছে। আল্লাহ তা'আলা বলেন-
وَلَوْ كُنْتَ فَظًّا غَلِيظَ الْقَلْبِ لَانْفَضُّوا مِنْ حَوْلِكَ (তুমি যদি রূঢ় প্রকৃতির ও কঠোর হৃদয় হতে, তবে তারা তোমার আশপাশ থেকে সরে বিক্ষিপ্ত হয়ে যেত)। অর্থাৎ নরম স্বভাবের হওয়ার কারণে আপনি সর্বদা সাহাবীদের প্রতি কোমল আচরণ করে এসেছেন। তাদের ভুল-ত্রুটি হলেও তা ক্ষমা করে দিয়েছেন। ক্ষমা না করে যদি কঠোর ও রুক্ষ আচরণ করতেন, তবে তারা এখন যেমন আপনার কাছে ভিড়ছে এবং আপনার জন্য জান-মাল সব উৎসর্গ করে দিচ্ছে, সেরকম করতে পারত না। তারা ভীত ও কুণ্ঠিত হয়ে থাকত। এক পর্যায়ে উৎসাহ-উদ্দীপনা হারিয়ে দূরেই সরে পড়ত। সে ক্ষেত্রে তাদের অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে যেত। আপনার সাহচর্যে লেগে থাকায় তারা দীন শিখতে পারছে, চারিত্রিক উন্নতি ঘটাতে পারছে এবং আল্লাহ তা'আলার রহমত ও করুণাধারায় সদা সিক্ত হয়ে থাকছে। তারা তাদের এ সৌভাগ্য এ কারণেই লাভ করতে পারছে যে, আপনি সর্বদাই তাদের প্রতি নম্র-কোমল আচরণ করে যাচ্ছেন। এ বাক্যের আগে আল্লাহ তা'আলা বলেছেন-
فَبِمَا رَحْمَةٍ مِنَ اللَّهِ لِنْتَ لَهُمْ (আল্লাহর রহমতেই তুমি তাদের প্রতি কোমল হৃদয় হয়েছ)। সুতরাং উহুদ যুদ্ধের এ ভুলের ক্ষেত্রেও আপনার হৃদয়ের সে কোমলতার দাবি আপনি তাদের ক্ষমা করে দেবেন। সুতরাং এর পরেই আল্লাহ তা'আলা বলছেন-
فَاعْفُ عَنْهُمْ وَاسْتَغْفِرْ لَهُمْ ‘তুমি তাদের ক্ষমা করে দাও এবং (আল্লাহর কাছেও) তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করো'। অর্থাৎ তাদের যে ভুলের সম্পর্ক ব্যক্তিগতভাবে আপনার সঙ্গে, তা আপনি ক্ষমা করে দিন। আর সে ভুলের যে সম্পর্ক আল্লাহ তা'আলার সঙ্গে, সেজন্য আপনি আল্লাহ তা'আলার কাছেও তাদের অনুকূলে ক্ষমা প্রার্থনা করুন, যাতে আল্লাহ তা'আলাও তাদের ক্ষমা করে দেন।
আয়াতটির শিক্ষা
ক. ব্যক্তিগত বিষয়ে মানুষের প্রতি ক্ষমাপরায়ণ থাকা ও নম্র-কোমল আচরণ করাই ছিল নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চরিত্র। আমাদেরও এ গুণ রপ্ত করতে হবে।
খ. দীনের অনুসরণীয় ব্যক্তি ও নেতৃবর্গের উচিত তাদের অনুসারী ও সাথী-সঙ্গীদের প্রতি মমত্বপূর্ণ আচরণ করা। এটা তাদের শিক্ষাদান ও তরবিয়াতের পক্ষে খুব বেশি সহায়ক।
গ. যখন যার সঙ্গেই সাক্ষাৎ হবে, তখন মুমিন ব্যক্তির কর্তব্য হবে তার প্রতি আন্তরিকতা প্রকাশ করা এবং তার সঙ্গে হাসিমুখে কথা বলা।
ঘ. অনুসারী ও অনুচরদের প্রতি কঠোর আচরণ অবাঞ্ছনীয়। এতে করে তারা ক্রমে দূরে সরে যায় এবং পরিণামে দীনী ও দুনিয়াবী দিক থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
জাহান্নাম থেকে বাঁচার উপায়
হাদীছ নং: ৬৯২
হযরত আদী ইবন হাতিম রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, তোমরা (জাহান্নামের) আগুন থেকে বাঁচো, যদিও খেজুরের একটা টুকরার বিনিময়ে হয়। আর যে ব্যক্তি তাও পায় না, সে উত্তম কথার বিনিময়ে। -বুখারী ও মুসলিম
(সহীহ বুখারী: ১৪১৭; সহীহ মুসলিম: ১০১৬; সুনানে নাসাঈ ২৫৫২; বায়হাকী : ১০১৩১; মুসনাদে আহমাদ: ৩৬৭৯; তাবারানী, আল-মু'জামুল কাবীর : ৮০১৭)
হাদীছ নং: ৬৯২
হযরত আদী ইবন হাতিম রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, তোমরা (জাহান্নামের) আগুন থেকে বাঁচো, যদিও খেজুরের একটা টুকরার বিনিময়ে হয়। আর যে ব্যক্তি তাও পায় না, সে উত্তম কথার বিনিময়ে। -বুখারী ও মুসলিম
(সহীহ বুখারী: ১৪১৭; সহীহ মুসলিম: ১০১৬; সুনানে নাসাঈ ২৫৫২; বায়হাকী : ১০১৩১; মুসনাদে আহমাদ: ৩৬৭৯; তাবারানী, আল-মু'জামুল কাবীর : ৮০১৭)
كتاب الأدب
باب استحباب طيب الكلام وطلاقة الوَجه عند اللقاء
قَالَ الله تَعَالَى: {وَاخْفِضْ جَنَاحَكَ لِلْمُؤْمِنينَ} [الحجر: 88]، وقال تَعَالَى: {وَلَوْ كُنْتَ فَظًّا غَلِيظَ القَلْبِ لاَنْفَضُّوا مِنْ حَوْلِكَ} [آل عمران: 159].
قَالَ الله تَعَالَى: {وَاخْفِضْ جَنَاحَكَ لِلْمُؤْمِنينَ} [الحجر: 88]، وقال تَعَالَى: {وَلَوْ كُنْتَ فَظًّا غَلِيظَ القَلْبِ لاَنْفَضُّوا مِنْ حَوْلِكَ} [آل عمران: 159].
692 - وعن عدي بن حاتمٍ - رضي الله عنه - قَالَ: قَالَ رسول الله - صلى الله عليه وسلم: «اتَّقُوا النَّارَ وَلَوْ بِشِقِّ تَمْرَةٍ، فَمَنْ لَمْ يَجِدْ فَبِكَلِمَةٍ طَيِّبَةٍ». متفقٌ عَلَيْهِ. (1)
হাদীসের ব্যাখ্যা:
এ হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে জাহান্নাম থেকে বাঁচার চেষ্টা করতে বলেছেন। জাহান্নাম পাপীদের ঠিকানা। সেখানে কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা আছে। তার প্রধান শাস্তি النار (আগুন)। তাই জাহান্নামের অপর নামই النار। কুরআন মাজীদে আল্লাহ তা'আলা বার বার মানুষকে এ সম্পর্কে সতর্ক করেছেন এবং এর থেকে বাঁচার তাগিদ দিয়েছেন। যেমন ইরশাদ হয়েছে-
يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا قُوا أَنْفُسَكُمْ وَأَهْلِيكُمْ نَارًا وَقُودُهَا النَّاسُ وَالْحِجَارَةُ
হে মুমিনগণ! নিজেদেরকে এবং তোমাদের পরিবারবর্গকে রক্ষা কর সেই আগুন থেকে, যার ইন্ধন হবে মানুষ ও পাথর। (সুরা তাহরীম (৬৬), আয়াত ৬)
আরও ইরশাদ হয়েছে-
فَاتَّقُوا النَّارَ الَّتِي وَقُودُهَا النَّاسُ وَالْحِجَارَةُ
তোমরা বাঁচো ওই আগুন থেকে, যার ইন্ধন মানুষ ও পাথর। (সূরা বাকারা (২), আয়াত ২৪)
জাহান্নাম আল্লাহ তা'আলার গজব ও ক্রোধের স্থান। আল্লাহর গজব থেকে বাঁচার উপায় হচ্ছে তাঁর আদেশ-নিষেধ পালন করা। অর্থাৎ সৎকর্ম করতে থাকা ও অসৎকর্ম পরিহার করে চলা। সৎকর্ম আছে বিভিন্ন রকম, যেমন বিভিন্ন হাদীছ দ্বারা আমরা জানতে পারি। তার মধ্যে একটা সৎকর্ম হল আল্লাহর পথে দান-সদাকা করা। দান-সদাকা করা সম্পর্কে হাদীছে ইরশাদ হয়েছে-
الصَّدَقَةُ تُطْفِئُ غَضَبَ الرَّبِّ، وَتَدْفَعُ مِيتَةَ السُّوْءِ
দান-সদাকা প্রতিপালকের গজব নিভিয়ে দেয় এবং অপমৃত্যু রোধ করে। (সহীহ ইবনে হিব্বান: ৩৩০৯; তাবারানী, আল মু'জামুল আওসাত: ৭৭৬১; হাকিম, আল মুস্তাদরাক: ৬৪১৮; বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান : ৩০৮০)
এ হাদীছে প্রধানত সদাকার কথাই বলা হয়েছে যে, একটা খেজুরের একটি অংশ সদাকা করে হলেও জাহান্নাম থেকে বাঁচো। এর দ্বারা সর্বনিম্ন সামর্থ্যের কথা বোঝানো হয়েছে। কারও অবস্থা যদি এমন হয় যে, সে কোনও ক্ষুধার্তকে একটা মাত্র খেজুর দেওয়ারও সামর্থ্য রাখে না, অর্থাৎ দেওয়ার মতো একটা খেজুরও তার কাছে নেই, একটা খেজুরের অর্ধেক মাত্র আছে, তবে সে ওই অর্ধেকটুকুই দিয়ে দেবে। আল্লাহ তা'আলা মানুষের দানের অংক দেখেন না। তিনি দেখেন তার মন। অর্থাৎ তার মনে দেওয়ার ইচ্ছা ও ইখলাস আছে কি না। যদি দেওয়ার ইচ্ছা ও ইখলাস থাকে, তবে তার সামর্থ্য অনুযায়ী যা দেবে তাই আল্লাহর কাছে মূল্যবান। তাকেই আল্লাহ তার জাহান্নাম থেকে বাঁচার উপায় হিসেবে কবুল করে নেবেন।
এরপর বলা হয়েছে যদি কারও অর্ধেকটুকু দেওয়ারও ক্ষমতা না থাকে, তবে তার যে আর জাহান্নাম থেকে বাঁচার কোনও উপায় রইল না এমন নয়, সে এর জন্য অন্য কোনও উপায় অবলম্বন করতে পারে। সেরকম একটি উপায় হচ্ছে উত্তম কথা বলা। এক হাদীছে আছে, উত্তম কথা বলাও সদাকাতুল্য। অর্থাৎ এর দ্বারাও সদাকার ছাওয়াব পাওয়া যায়। সুতরাং যে ব্যক্তি দান-সদাকা করার সামর্থ্য রাখে না, সে যদি উত্তম কথা বলে, তবে এর মাধ্যমেও সে জাহান্নাম থেকে বাঁচতে পারবে।
উত্তম কথা অতি ব্যাপক। এর মধ্যে যেমন কুরআন তিলাওয়াত ও যিকির-তাসবীহ ইত্যাদি রয়েছে, তেমনি মানুষকে সুপরামর্শ দেওয়া, সৎকাজের আদেশ করা, অসৎকাজে নিষেধ করা, বৈধ সুপারিশ করা, দীনী ইলম শেখানো, শোকার্তকে সান্ত্বনা দেওয়া ইত্যাদিও এর অন্তর্ভুক্ত।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. দান-সদাকা জাহান্নাম থেকে বাঁচার একটি উপায়। কাজেই যার পক্ষে যতটুকু সম্ভব দান-সদাকা করা উচিত।
খ. নিতান্ত গরীব ব্যক্তি যদি অতি সামান্য কিছুও দান করে, তবে তাও তার জাহান্নাম থেকে বাঁচার কারণ হতে পারে। কাজেই সামান্য বলে তাকে তুচ্ছ মনে করতে নেই।
গ. উত্তম কথা বলাও যেহেতু জাহান্নাম থেকে বাঁচার উপায়, তাই আমাদের প্রত্যেকের উচিত যথাসম্ভব ভালো ভালো কথা বলতে সচেষ্ট থাকা এবং কোনও অবস্থাতেই কোনও মন্দ কথা না বলা।
ঘ. উত্তম কথা বলার একটা অংশ এইও যে, তা বলাও হবে উত্তমরূপে অর্থাৎ মুচকি হাসির সঙ্গে এবং উৎফুল্ল চেহারায়।
يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا قُوا أَنْفُسَكُمْ وَأَهْلِيكُمْ نَارًا وَقُودُهَا النَّاسُ وَالْحِجَارَةُ
হে মুমিনগণ! নিজেদেরকে এবং তোমাদের পরিবারবর্গকে রক্ষা কর সেই আগুন থেকে, যার ইন্ধন হবে মানুষ ও পাথর। (সুরা তাহরীম (৬৬), আয়াত ৬)
আরও ইরশাদ হয়েছে-
فَاتَّقُوا النَّارَ الَّتِي وَقُودُهَا النَّاسُ وَالْحِجَارَةُ
তোমরা বাঁচো ওই আগুন থেকে, যার ইন্ধন মানুষ ও পাথর। (সূরা বাকারা (২), আয়াত ২৪)
জাহান্নাম আল্লাহ তা'আলার গজব ও ক্রোধের স্থান। আল্লাহর গজব থেকে বাঁচার উপায় হচ্ছে তাঁর আদেশ-নিষেধ পালন করা। অর্থাৎ সৎকর্ম করতে থাকা ও অসৎকর্ম পরিহার করে চলা। সৎকর্ম আছে বিভিন্ন রকম, যেমন বিভিন্ন হাদীছ দ্বারা আমরা জানতে পারি। তার মধ্যে একটা সৎকর্ম হল আল্লাহর পথে দান-সদাকা করা। দান-সদাকা করা সম্পর্কে হাদীছে ইরশাদ হয়েছে-
الصَّدَقَةُ تُطْفِئُ غَضَبَ الرَّبِّ، وَتَدْفَعُ مِيتَةَ السُّوْءِ
দান-সদাকা প্রতিপালকের গজব নিভিয়ে দেয় এবং অপমৃত্যু রোধ করে। (সহীহ ইবনে হিব্বান: ৩৩০৯; তাবারানী, আল মু'জামুল আওসাত: ৭৭৬১; হাকিম, আল মুস্তাদরাক: ৬৪১৮; বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান : ৩০৮০)
এ হাদীছে প্রধানত সদাকার কথাই বলা হয়েছে যে, একটা খেজুরের একটি অংশ সদাকা করে হলেও জাহান্নাম থেকে বাঁচো। এর দ্বারা সর্বনিম্ন সামর্থ্যের কথা বোঝানো হয়েছে। কারও অবস্থা যদি এমন হয় যে, সে কোনও ক্ষুধার্তকে একটা মাত্র খেজুর দেওয়ারও সামর্থ্য রাখে না, অর্থাৎ দেওয়ার মতো একটা খেজুরও তার কাছে নেই, একটা খেজুরের অর্ধেক মাত্র আছে, তবে সে ওই অর্ধেকটুকুই দিয়ে দেবে। আল্লাহ তা'আলা মানুষের দানের অংক দেখেন না। তিনি দেখেন তার মন। অর্থাৎ তার মনে দেওয়ার ইচ্ছা ও ইখলাস আছে কি না। যদি দেওয়ার ইচ্ছা ও ইখলাস থাকে, তবে তার সামর্থ্য অনুযায়ী যা দেবে তাই আল্লাহর কাছে মূল্যবান। তাকেই আল্লাহ তার জাহান্নাম থেকে বাঁচার উপায় হিসেবে কবুল করে নেবেন।
এরপর বলা হয়েছে যদি কারও অর্ধেকটুকু দেওয়ারও ক্ষমতা না থাকে, তবে তার যে আর জাহান্নাম থেকে বাঁচার কোনও উপায় রইল না এমন নয়, সে এর জন্য অন্য কোনও উপায় অবলম্বন করতে পারে। সেরকম একটি উপায় হচ্ছে উত্তম কথা বলা। এক হাদীছে আছে, উত্তম কথা বলাও সদাকাতুল্য। অর্থাৎ এর দ্বারাও সদাকার ছাওয়াব পাওয়া যায়। সুতরাং যে ব্যক্তি দান-সদাকা করার সামর্থ্য রাখে না, সে যদি উত্তম কথা বলে, তবে এর মাধ্যমেও সে জাহান্নাম থেকে বাঁচতে পারবে।
উত্তম কথা অতি ব্যাপক। এর মধ্যে যেমন কুরআন তিলাওয়াত ও যিকির-তাসবীহ ইত্যাদি রয়েছে, তেমনি মানুষকে সুপরামর্শ দেওয়া, সৎকাজের আদেশ করা, অসৎকাজে নিষেধ করা, বৈধ সুপারিশ করা, দীনী ইলম শেখানো, শোকার্তকে সান্ত্বনা দেওয়া ইত্যাদিও এর অন্তর্ভুক্ত।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. দান-সদাকা জাহান্নাম থেকে বাঁচার একটি উপায়। কাজেই যার পক্ষে যতটুকু সম্ভব দান-সদাকা করা উচিত।
খ. নিতান্ত গরীব ব্যক্তি যদি অতি সামান্য কিছুও দান করে, তবে তাও তার জাহান্নাম থেকে বাঁচার কারণ হতে পারে। কাজেই সামান্য বলে তাকে তুচ্ছ মনে করতে নেই।
গ. উত্তম কথা বলাও যেহেতু জাহান্নাম থেকে বাঁচার উপায়, তাই আমাদের প্রত্যেকের উচিত যথাসম্ভব ভালো ভালো কথা বলতে সচেষ্ট থাকা এবং কোনও অবস্থাতেই কোনও মন্দ কথা না বলা।
ঘ. উত্তম কথা বলার একটা অংশ এইও যে, তা বলাও হবে উত্তমরূপে অর্থাৎ মুচকি হাসির সঙ্গে এবং উৎফুল্ল চেহারায়।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)