রিয়াযুস সালিহীন-ইমাম নববী রহঃ

২. বিবিধ আদব - শিষ্টাচারের অধ্যায়

হাদীস নং: ৬৯৪
বিবিধ আদব - শিষ্টাচারের অধ্যায়
৫ সাক্ষাৎকালে উত্তম কথা বলা ও হাসিমুখে থাকা
উৎফুল্ল চেহারায় সাক্ষাৎ করাও নেকীর কাজ
হাদীছ নং: ৬৯৪

হযরত আবূ যার্র রাযি. বলেন, একবার নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে লক্ষ্য করে বলেন, তুমি কিছুতেই কোনও নেক কাজকে তুচ্ছ মনে করো না, যদি তা তোমার ভাইয়ের সাথে হাসিমুখে সাক্ষাৎ করাও হয়। -মুসলিম
(সহীহ মুসলিম: ২৬২৬; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ: ১৬৮৯; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর: ৬৩৮৫; মুসনাদে আহমাদ: ১৪৭১)
كتاب الأدب
88 - باب استحباب طيب الكلام وطلاقة الوَجه عند اللقاء
694 - وعن أَبي ذَرٍّ - رضي الله عنه - قَالَ: قَالَ لي رسول الله - صلى الله عليه وسلم: «لاَ تَحْقِرَنَّ مِنَ الْمَعْرُوفِ شَيْئًا، وَلَوْ أَنْ تَلْقَى أخَاكَ بوَجْهٍ طَلْقٍ». رواه مسلم (1).

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এ হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে-কোনও নেক কাজকে তুচ্ছ মনে করতে কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন। কারণ আল্লাহর কাছে কখন কোন আমল কবুল হয়ে যায় কেউ জানে না। হতে পারে অতি সাধারণ একটি আমল আল্লাহর কাছে এমন কবুল হয়েছে যে, তার মাধ্যমে তার দুনিয়া চমকে গেছে এবং আখিরাতেও তা নাজাতের অসিলা হবে। হাদীছে বর্ণিত এ ঘটনা অনেকেরই জানা যে, একটি কুকুরকে পানি পান করানোর কারণে এক ব্যক্তি জান্নাত পেয়ে গেছে। এক হাদীছে আছে, মানুষ কখনও কখনও এমন কথা বলে, যে কথার সে বিশেষ গুরুত্ব দেয় না। অথচ তার মাধ্যমে আল্লাহ তা'আলা জান্নাতে অতি উচ্চমর্যাদা তাকে দান করেন।

এ প্রসঙ্গে বিশর হাফী রহ.-এর ঘটনা উল্লেখ করা যেতে পারে। তিনি প্রথম জীবন কাটিয়েছেন আমোদ-ফুর্তি করে। সে অবস্থায় তিনি একদিন পথে হাঁটছিলেন। হঠাৎ দেখতে পেলেন রাস্তায় এক টুকরা কাগজ পড়ে আছে। তুলে দেখেন তাতে আল্লাহর নাম লেখা। কত মানুষ এ পথে চলেছে। তাদের পায়ের তলে পড়ে পড়ে কাগজখানির যাচ্ছেতাই অবস্থা। তার খুব খারাপ লাগল। তিনি সেটি নিয়ে এক আতরের দোকানে গেলেন। সেখান থেকে কিছু আতর কিনলেন এবং কাগজটি যত্নের সাথে পরিষ্কার করে সে আতর তাতে মাখালেন। তারপর সেটি একটি দেয়ালের ফাঁকে রেখে দিলেন। সেই রাতে তিনি স্বপ্নে দেখেন কেউ তাকে লক্ষ্য করে বলছে, হে বিশর! তুমি আমার নাম সুরভিত করেছ। আমিও তোমার নামের সুরভি দুনিয়া ও আখিরাতে ছড়িয়ে দেব। ঘুম থেকে জাগার পর তিনি অতীত জীবনের জন্য তাওবা করেন এবং নতুন জীবন শুরু করেন। সে জীবন তাকওয়া-পরহেযগারীর জীবন, যুহদ ও ইবাদত-বন্দেগীর জীবন। এ জীবনে তিনি কতদূর উন্নতি লাভ করেছিলেন এবং আল্লাহ তা'আলার সান্নিধ্যের কোন্ পর্যায়ে পৌছেছিলেন তা ওলী-বুযুর্গদের পক্ষেই অনুমান করা সম্ভব। আমরা কেবল এতটুকুই জানি- তিনি সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বুযুর্গদের একজন।

তাঁর জীবনের এ মহাপরিবর্তন ঘটেছিল আপাতদৃষ্টিতে একটি মামুলি কাজের বদৌলতে। সুতরাং কোনও ভালো কাজকেই তুচ্ছ মনে করতে নেই, যেমনটা এ হাদীছে বলা হয়েছে।

হাদীছটির দ্বিতীয় বাক্যে জানানো হয়েছে, নিজ ভাইয়ের সাথে হাসিমুখে সাক্ষাৎ করাও একটি নেক কাজ। অপর এক হাদীছে আছে
وَتَبَسُّمُكَ فِي وَجْهِ أَخِيكَ صَدَقَةٌ
‘তোমার ভাইয়ের চেহারার দিকে ফিরে তোমার হাসি দেওয়া এক সদাকা।’(শু'আবুল ঈমান: ৩১০৫)

সুতরাং একেও তুচ্ছ মনে করবে না। কেননা এমনিতে একটি অতি সাধারণ কাজ হলেও এর সুফল অনেক বেশি। হাসিমুখে সাক্ষাৎ করার দ্বারা মানুষের মন জয় করা যায়। গোমরামুখো মানুষকে কেউ পসন্দ করে না। এরূপ মানুষের সঙ্গে কেউ সহজে মিশতে চায় না। ফলে তার সৎগুণ দ্বারাও লোকে তেমন একটা উপকৃত হতে পারে না। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি হাসিমুখে কথা বলে, মানুষের সঙ্গে আন্তরিকভাবে মেলামেশা করে, মানুষ তার সঙ্গলাভে প্রীতিবোধ করে। এরূপ লোক অতি সহজে শোকাগ্রস্ত মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে পারে। তার হাসিমুখ দেখলে শত্রুর শত্রুতায়ও ভাটা পড়ে। তার অন্তরে বন্ধুত্বের বীজ বুনে যায়। একপর্যায়ে সে পরম বন্ধুই হয়ে যায়।

মুহাম্মাদ ইবনুন নাযর হারিছী রহ. বলেন, ভদ্রতার প্রথম প্রকাশ হল হাসিমুখে সাক্ষাৎ করা।

ইমাম আওযা'ঈ রহ. বলেন, অতিথির প্রতি সম্মান প্রদর্শন হল মুখে হাসি ফুটিয়ে তোলা।
হযরত আবু হুরায়রা রাযি. বর্ণিত এক হাদীছে আছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-
إِنَّكُمْ لَا تَسَعُونَ اَلنَّاسَ بِأَمْوَالِكُمْ, وَلَكِنْ لِيَسَعْهُمْ بَسْطُ اَلْوَجْهِ, وَحُسْنُ اَلْخُلُقِ
‘তোমরা অর্থ-সম্পদ দিয়ে মানুষের মন ভরতে পারবে না। কিন্তু তোমাদের চেহারার প্রফুল্লতা ও উত্তম চরিত্র তাদের মন ভরাতে পারবে।’ (শু'আবুল ঈমান: ৭৬৯৫)

যারা মানুষকে আল্লাহর পথে ডাকে ও দীনের কাজ করে, এই গুণটি তাদের বিশেষ প্রয়োজন। এর মাধ্যমে মানুষকে কাছে আনা বেশি সহজ হয়। হাসিমুখের কথা মানুষের মনে সহজেই আছর করে। এতে দা'ওয়াত বেশি ফলপ্রসূ হয়। এরূপ ব্যক্তির পারিবারিক জীবন বেশি সুখের হয়। সমাজজীবনে তারা বেশি কীর্তিমান হতে পারে। মানুষের মধ্যে ঐক্য-সম্প্রীতি সৃষ্টিতে তারা বেশি ভূমিকা রাখতে পারে। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তো এমনই ছিলেন। কেউ সাক্ষাৎ করতে আসলে মুচকি হাসি দিয়ে স্বাগত জানাতেন। হাসিমুখে তার সঙ্গে কথা বলতেন। আগন্তুকের অন্তরে তা দারুণ প্রভাব বিস্তার করত। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনুল হারিছ রাযি. বলেন-
مَا رَأَيْتُ أَحَدًا أَكْثَرَ تَبَسُّمًا مِنْ رَسُوْلِ اللَّهِ ﷺ
‘আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চেয়ে বেশি মুচকি হাসির লোক কাউকে দেখিনি।' (শু'আবুল ঈমান: ৭৬৮৭)

মোটকথা হাসিমুখের সাক্ষাৎ একটি বহুবিচিত্র সুফলদায়ী আচরণ। তাই আপাতদৃষ্টিতে মামুলি হলেও প্রকৃতপক্ষে এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সহীহ নিয়তের সঙ্গে ব্যবহার করলে এর মাধ্যমে অকল্পনীয় ছাওয়াব অর্জন করা যেতে পারে। কাজেই একে মামুলি মনে করে উপেক্ষা করা উচিত নয়; বরং প্রত্যেকের উচিত এ গুণ অর্জন করা অর্থাৎ হাসিমুখে সাক্ষাৎ করতে অভ্যস্ত হওয়ার চেষ্টা করা।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. মানবজীবনের যত অনুষঙ্গ আছে, সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে তার প্রত্যেকটি দ্বারাই ছাওয়াব অর্জন করা যায়।

খ. হাসিমুখে সাক্ষাৎ করা যেহেতু একটা নেক কাজ, তাই এতে অভ্যস্ত হওয়ার চেষ্টা করা উচিত।

গ. কোনও নেককাজকেই তুচ্ছ মনে করতে নেই। আখিরাতে নাজাত লাভে সাধারণ সাধারণ নেককাজও অনেক কাজে আসবে। কুরআন মাজীদে ইরশাদ-
فَمَنْ يَعْمَلْ مِثْقَالَ ذَرَّةٍ خَيْرًا يَرَهُ
‘যে ব্যক্তি বিন্দু পরিমাণ সৎকর্ম করবে, সে তা (অর্থাৎ তার ছাওয়াব) দেখতে পাবে।’ (সূরা যিলযাল (৯৯) আয়াত ৭)
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:বিশুদ্ধ (পারিভাষিক সহীহ)