রিয়াযুস সালিহীন-ইমাম নববী রহঃ

২. বিবিধ আদব - শিষ্টাচারের অধ্যায়

হাদীস নং: ৬৯৫
বিবিধ আদব - শিষ্টাচারের অধ্যায়
শ্রোতার সামনে কথা সুস্পষ্টভাবে বলা, যাতে সে বুঝতে পারে এবং প্রয়োজনে তার পুনরাবৃত্তি করা

মানুষের জন্য বাকশক্তি আল্লাহ তা'আলার এক বিরাট নি'আমত। এ কথা স্বরণ করিয়ে দিয়ে আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেন-
خَلَقَ الْإِنْسَانَ عَلَّمَهُ الْبَيَانَ
‘তিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। তাকে ভাব প্রকাশ করতে শিখিয়েছেন।’(সূরা আর-রাহমান (৫৫), আয়াত ৩-৪)
ভাষা ও বাকশক্তি মূলত ভাবপ্রকাশের জন্যই। কাজেই যে বক্তব্য দ্বারা মনের ভাব যথাযথভাবে প্রকাশ পায় না, সে কথা বলার বিশেষ সার্থকতা থাকে না। তাই বিজ্ঞজনেরা সর্বদা আপন বক্তব্য সুস্পষ্ট ভাষায় প্রদান করেছেন। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বিজ্ঞ মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর প্রতিটি বক্তব্য সুস্পষ্ট ভাষায় দিয়েছেন। তিনি সর্বদা লক্ষ রেখেছেন যাতে শ্রোতা তাঁর কথা ভালোভাবে বুঝতে পারে। শ্রোতাকে বোঝানোর উদ্দেশ্যে তিনি অনেক সময়ই একই কথা তিনবার পর্যন্ত বলেছেন। কুরআন মাজীদও এমনই এক গ্রন্থ। এ গ্রন্থের বাণীসমূহ অতি স্পষ্ট। কুরআন মাজীদ তার নিজের সম্পর্কে বলছে-
وَكُلَّ شَيْءٍ فَصَّلْنَاهُ تَفْصِيلًا
‘আমি সবকিছু পৃথক-পৃথকভাবে স্পষ্ট করে দিয়েছি।’(সূরা বনী ইসরাঈল (১৭), আয়াত ১২)

অন্যত্র ইরশাদ
قَدْ فَصَّلْنَا الْآيَاتِ لِقَوْمٍ يَعْلَمُونَ
‘আমি আয়াতসমূহ স্পষ্ট করে দিয়েছি সেইসকল লোকের জন্য, যারা জ্ঞানকে কাজে লাগায়।’(সূরা আন'আম (৬), আয়াত ৯৭)
এর দ্বারা আমরা কথাবার্তা সুস্পষ্টভাবে বলার শিক্ষা পাই। কথা স্পষ্টভাবে না বললে বিভ্রান্তি সৃষ্টির আশঙ্কা থাকে। অনেক সময় তা সৃষ্টি হয়েও যায়। এর ফলে অপ্রীতিকর অনেক ঘটনাও ঘটে যায়। বক্তা বলে এক কথা, কিন্তু শ্রোতা তা ভালোভাবে বুঝতে না পারার কারণে বোঝে অন্য কিছু। তাতে পারিবারিক ও সামাজিক নানা অনর্থ দেখা দেয়। অনেক সময়ই তা প্রতিকার করারও কোনও সুযোগ থাকে না। সে কথা যদি শরী'আত সম্পর্কিত হয়, তবে তো তার ক্ষতি ভয়াবহ। বক্তার কথা ভালোভাবে বুঝতে না পারার কারণে শ্রোতা হয়তো হালালকে হারাম, হারামকে হালাল, জায়েযকে নাজায়েয বা নাজায়েযকে জায়েয বুঝে বসবে। এমনকি ঈমান-আকীদা বিষয়েও সে ভুল কিছু বুঝে বসবে। আর এভাবে তার ঈমান-আকীদা ক্ষতিগ্রস্ত হবে কিংবা ভুল আমল করে ছাওয়াবের স্থানে গুনাহগার হবে।
কথার দ্বারা কাউকে বিভ্রান্তিতে ফেলা কিছুতেই সমীচীন নয়। এটা কথা বলার উদ্দেশ্যের পরিপন্থী। কথা তো বলাই হয় উদ্দিষ্ট বিষয়কে শ্রোতার কাছে পরিষ্কার করে দেওয়ার জন্য, যাতে সে বিষয়টি ভালোভাবে বুঝতে পারে এবং সে অনুযায়ী নিজ কর্তব্য স্থির করতে পারে। কাজেই কাউকে কোনও সংবাদ দেওয়া, কোনও ঘটনা সম্পর্কে অবহিত করা, কোনও বিষয়ে আদেশ বা নিষেধ করা ইত্যাদি যে-কোনও বিষয়ক কথা সুস্পষ্টভাবেই বলা উচিত। প্রয়োজনে সে কথার পুনরাবৃত্তিও করা যেতে পারে। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাই করতেন। সুতরাং এ বিষয়েও আমাদেরকে তাঁর অনুসরণ করতে হবে। সে লক্ষ্যেই ইমাম নববী রহ. এ পরিচ্ছেদটির অবতারণা করেছেন এবং এ বিষয়ক হাদীছ এতে উদ্ধৃত করেছেন।
বক্তব্য ও সালামের পুনরাবৃত্তি করা
হাদীছ নং: ৬৯৫

হযরত আনাস রাযি. থেকে বর্ণিত যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন কোনও কথা বলতেন, তিনবার তার পুনরাবৃত্তি করতেন, যাতে তাঁর কাছ থেকে তা বুঝে নেওয়া হয়। তিনি যখন কোনও লোকসমষ্টির কাছে আসতেন এবং তাদেরকে সালাম বলতেন, তখন তাদেরকে সালাম বলতেন তিনবার। -বুখারী
(সহীহ বুখারী: ৯৫; জামে তিরমিযী: ২৭২৩; মুসনাদুল বাযযার: ৯৪১৮; হাকিম, আল মুস্তাদরাক: ৭৭১৬; বাগাবী, শারহুস সন্নাহ: ১৪১)
كتاب الأدب
باب استحباب بيان الكلام وإيضاحه للمخاطب وتكريره ليفهم إذا لَمْ يفهم إِلا بذلك
695 - عن أنسٍ - رضي الله عنه: أنَّ النَّبيَّ - صلى الله عليه وسلم - كَانَ إِذَا تَكَلَّمَ بِكَلِمَةً أعَادَهَا ثَلاَثًا حَتَّى تُفْهَمَ عَنْهُ، وَإِذَا أتَى عَلَى قَوْمٍ فَسَلَّمَ عَلَيْهِمْ سَلَّمَ عَلَيْهِمْ ثَلاثًا. رواه البخاري. (1)

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এ হাদীছটিতে দুটি বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে। একটির সম্পর্ক কথা বলার সঙ্গে, অন্যটির সম্পর্ক সালাম দেওয়ার সঙ্গে। কীভাবে কথা বলতে হয়, কীভাবে সালাম দিতে হয়, তার সর্বোৎকৃষ্ট নমুনা রয়েছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনরীতিতে। কথা বলার আছে বহু আদব-কায়দা। তার একটা হল প্রয়োজনক্ষেত্রে কথার পুনরাবৃত্তি করা। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা করতেন। এখানে বলা হয়েছে-
كَانَ إِذَا تَكَلَّمَ بِكَلِمَة أَعَادَهَا ثَلَاثًا حَتَّى تُفْهَمَ عَنْهُ (তিনি যখন কোনও কথা বলতেন, তিনবার তার পুনরাবৃত্তি করতেন, যাতে তাঁর কাছ থেকে তা বুঝে নেওয়া হয়)। তিনি ছিলেন মানবজাতির মহান শিক্ষক। কথা ও কাজ দ্বারা উম্মতকে দীন শেখাতেন। তাঁর কোনও কথাই অহেতুক হত না। প্রতিটি কথাই ছিল অতি মূল্যবান- উম্মতের পথের নির্দেশনা। তাই তা ভালোভাবে বুঝে নেওয়ার দরকার ছিল। সুতরাং তাঁর শিষ্যবৃন্দ অর্থাৎ সাহাবায়ে কেরাম যাতে তা ভালোভাবে বুঝে নিতে পারেন, তাই একেকটি কথা একাধিক বার বলতেন। অনেক সময় তিনবারও বলতেন। তা বলার প্রয়োজনও রয়েছে। যেখানে প্রয়োজন হত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজ কথার পুনরাবৃত্তি করতেন। বিশেষত যে কথাটি তুলনামূলক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হত, সে কথার পুনরাবৃত্তি করতেন তিনবার, যাতে তাঁরা তা ভালোভাবে বুঝতে পারেন এবং কোনও ভুল বুঝাবুঝির অবকাশ না থাকে। তাঁর কথা যেহেতু শরী'আতের দলীল, তাই ভুল বুঝলে অনেক বড় ক্ষতির কারণ হত। যা শরী'আত নয়, মানুষ তাকে শরী'আত মনে করত। এভাবে উম্মত প্রকৃত দীন থেকে দূরে সরে পড়ত। পুনরাবৃত্তির ফলে সাহাবায়ে কেরাম তাঁর বাণীসমূহ উত্তমরূপে বুঝতে পেরেছেন। ফলে তাঁদের পক্ষে পরবর্তীদের কাছে তা যথাযথভাবে পৌছানো সম্ভব হয়েছে। এভাবে উম্মত তাঁদের কাছ থেকে বিশুদ্ধ দীনের শিক্ষালাভ করতে সক্ষম হয়েছে।

এর দ্বারা বোঝা গেল দীনের জরুরি কথা সুস্পষ্টভাবে বলা উচিত। যাতে কোনও ভুল বোঝাবুঝির অবকাশ না থাকে, সে লক্ষ্যে পুনরাবৃত্তিও করা উচিত। শিক্ষকদের জন্য এর প্রয়োজন তো অনেক বেশি। এমনিভাবে যারা ওয়াজ করে বা অন্যের তরবিয়াত করে, তাদেরও এদিকে লক্ষ রাখা দরকার।

সালাম সম্পর্কে হাদীছটিতে বলা হয়েছে- وَإِذَا أَتَى عَلَى قَوْمٍ فَسَلَّمَ عَلَيْهِمْ سَلَّمَ عَلَيْهِمْ ثَلَاثًا (তিনি যখন কোনও লোকসমষ্টির কাছে আসতেন এবং তাদেরকে সালাম বলতেন, তখন তাদেরকে সালাম বলতেন তিনবার)। সালাম তিনবার কেন দিতেন, উলামায়ে কেরাম এর বিভিন্ন ব্যাখ্যা করেছেন। কেউ কেউ বলেন, প্রথমবার সালাম দিতেন অনুমতি গ্রহণের জন্য। দ্বিতীয়বার দিতেন অভিবাদন হিসেবে। অর্থাৎ কারও সঙ্গে সাক্ষাৎকালে যে সালাম দেওয়া হয় সেই সালাম। আর তৃতীয়বার সালাম দিতেন বিদায় গ্রহণকালে।

উল্লেখ্য, কোনও মজলিস বা কারও গৃহে প্রবেশ করতে চাইলে অনুমতি নেওয়া জরুরি। ইসলামে সে অনুমতি গ্রহণের পদ্ধতি হল সালাম দেওয়া।

অনেকে বলেন, তিনওটি সালাম ছিল অনুমতি গ্রহণের জন্য। নিয়ম হল- অনুমতি গ্রহণের জন্য প্রথমে সালাম দেবে। এতে অনুমতি পাওয়া গেলে তো ভালো। অন্যথায় আরও একবার সালাম দেবে। তাতেও যদি অনুমতি পাওয়া না যায়, তবে তৃতীয়বার সালাম দেবে। তা সত্ত্বেও অনুমতি পাওয়া না গেলে ফিরে যাবে। সুতরাং নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
إِذَا اسْتَأْذَنَ أَحَدُكُمْ ثَلَاثًا فَلَمْ يُؤْذَنُ لَهُ فَلْيَرْجِعْ.
তোমাদের কেউ যখন তিনবার অনুমতি চায়, তা সত্ত্বেও তাকে অনুমতি দেওয়া না হয়, তবে সে যেন ফিরে যায়।
(সহীহ বুখারী : ৬২৪৫; সহীহ মুসলিম: ২১৫৩; সুনানে আবু দাউদ: ৫১৮০; মুসনার হুমায়দী: ৭৫১; মুসনাদু ইবনিল জা'দ : ১৪৪৭; মুসনাদে আবূ ইয়া'লা : ৯৮১: তহাবী, শারহু মুশকিলিল আছার: ১৫৭৯; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ: ৩৩১৮)

কারও মতে মজলিস যদি বড় হয়, সে ক্ষেত্রেও তিনবার সালামের প্রয়োজন পড়ে। প্রথমবার মজলিসের শুরুতে। দ্বিতীয়বার মাঝখানে। শেষবার শেষ সীমায় পৌঁছে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে তিনবার সালাম দিতেন, তা সম্ভবত এরূপ ক্ষেত্রে।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. শ্রোতা যাতে ভালোভাবে বুঝতে পারে, সে লক্ষ্যে গুরুত্বপূর্ণ কথা তিনবার পর্যন্ত পুনরাবৃত্তি করা উচিত।

খ. শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে শিক্ষকের উচিত শিক্ষার্থীরা যাতে তার বক্তব্য ভালোভাবে বুঝতে পারে সেদিকে লক্ষ করা। এজন্য যদি নিজ বক্তব্য ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে বার বার বলার প্রয়োজন পড়ে, তাও করবে।

গ. কোনও মজলিস বা কারও বাড়িতে প্রবেশকালে সালামের মাধ্যমে অনুমতি গ্রহণ করা কর্তব্য।

ঘ. বড় মজলিস বা গৃহে প্রবেশের অনুমতি গ্রহণকালে যদি সালামের পুনরাবৃত্তি করার প্রয়োজন হয়, তবে সে পুনরাবৃত্তির সর্বোচ্চ পরিমাণ হল তিনবার।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:বিশুদ্ধ (পারিভাষিক সহীহ)