রিয়াযুস সালিহীন-ইমাম নববী রহঃ
২. বিবিধ আদব - শিষ্টাচারের অধ্যায়
হাদীস নং: ৭০৩
বিবিধ আদব - শিষ্টাচারের অধ্যায়
নামায আদায় ও ইলম হাসিল এবং অনুরূপ যে-কোনও ইবাদত-বন্দেগীতে ধীরস্থিরতা ও ভাবগাম্ভীর্যের সঙ্গে চলার প্রতি উৎসাহদান
ঈমানের পর নামায সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। এটা আল্লাহ তা'আলার এক শ্রেষ্ঠ নিদর্শন। নামাযে বান্দা আল্লাহ তা'আলার অভিমুখী হয়। তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে নিজ দাসত্ব ও ক্ষুদ্রতা প্রকাশ করে এবং আল্লাহ তা'আলার গৌরব ও বড়ত্বের স্বীকারোক্তি নেয়। দুনিয়ার রীতি হল কেউ যখন মহান কোনও ব্যক্তির সামনে যায়, তখন বিনয় ও আদব রক্ষার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে থাকে। আল্লাহ তা'আলা আমাদের সৃষ্টিকর্তা ও মালিক। তিনি সকল বাদশার বাদশা। নামায হল তাঁর সামনে উপস্থিতির এক নমুনা। কাজেই নামাযে যাওয়ার সময় বিনয় ও আদব রক্ষার প্রতি অধিকতর সচেতন থাকা বাঞ্ছনীয়।
দীনী ইলম দ্বারা আল্লাহ তা'আলার পরিচয় লাভ হয় এবং তাঁর ইবাদত-বন্দেগী করার পদ্ধতি জানা যায়, যা কিনা মানবসৃষ্টির মূল উদ্দেশ্য। এ ইলমের উৎস হল কুরআন ও হাদীছ, যা ওহীর মাধ্যমে মানুষকে দেওয়া হয়েছে। কাজেই দীনী ইলমের বিশেষ মর্যাদা রয়েছে। এই ইলম যারা শেখে, ফিরিশতারা পর্যন্ত তাদের সম্মান করে। সাগরের মাছও তাদের জন্য দু'আ করে। সুতরাং এ ইলমের শিক্ষার্থীর প্রথম কর্তব্য এর মহিমা উপলব্ধি করা। যে শিক্ষার্থী তা উপলব্ধি করতে সক্ষম হবে, সে অবশ্যই এ ইলমের সঙ্গে সম্পৃক্ত সবকিছুকে মর্যাদাপূর্ণ গণ্য করবে। সে তার প্রত্যেকটির আদব রক্ষা করবে। সে আদব রক্ষা করবে কুরআন মাজীদের, হাদীছ গ্রন্থের, শিক্ষকের, শিক্ষালয়ের এবং ইলমের যাবতীয় উপকরণের। সে ধারায় ইলম শিক্ষার জন্য গমনকালেও আদব-কায়দার প্রতি লক্ষ রাখবে। হাঁটবে শান্তভাবে। অহেতুক কোনও কাজ করবে না। অপ্রয়োজনীয় কোনও কথা বলবে না। তার ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয় এমন কোনওকিছুতেই জড়াবে না। হযরত উমর ফারূক রাযি. বলেন-
تَعَلَّموا العِلمَ وعَلِّموه النَّاسَ، وتعَلَّموا له الوَقارَ والسَّكينةَ، وتواضَعوا لِمَن يُعَلِّمُكم عِندَ العِلمِ، وتواضَعوا لِمن تُعَلِّموه العِلمَ، ولا تكونوا جَبابرةَ العُلَماءِ
‘তোমরা ইলম শেখো। মানুষকে তা শেখাও। ইলমের জন্য ভাবগাম্ভীর্য শেখো এবং শেখো ধীর-শান্ত হতে। যার কাছ থেকে ইলম শেখ, তার সামনে বিনয় অবলম্বন করো। যাকে ইলম শেখাও, তার সঙ্গে নম্র-কোমল থেকো। তোমরা কঠোর-কঠিন উলামা হয়ো না।’(বায়হাকী, শু শু'আবুল ঈমান: ১৭৮৯)
নামায ও দীনী ইলমের মতো ইবাদত-বন্দেগীর সঙ্গে সম্পৃক্ত আরও যা-কিছু আছে, সবকিছুর বেলায়ই আদব রক্ষার বিষয়টি অতীব গুরুত্বপূর্ণ। সে কারণেই এ গ্রন্থে স্বতন্ত্র এক পরিচ্ছেদের অবতারণা করা হয়েছে। ইমাম নববী রহ. এ পরিচ্ছেদে সে সম্পর্কিত আয়াত ও হাদীছ উল্লেখ করেছেন। আমরা সংক্ষেপে তার বঙ্গানুবাদ ও ব্যাখ্যা পেশ করছি। আল্লাহ তা'আলাই তাওফীকদাতা।
‘নামায আদায় ও ইলম হাসিল এবং অনুরূপ যে-কোনও ইবাদত-বন্দেগীতে... চলার প্রতি উৎসাহদান’ সম্পর্কিত একটি আয়াত
وَمَنْ يُعَظِّمْ شَعَائِرَ اللَّهِ فَإِنَّهَا مِنْ تَقْوَى الْقُلُوبِ
অর্থ: আর কেউ আল্লাহর ‘শাআইর’-কে সম্মান করলে তা তো অন্তরস্থ তাকওয়া থেকেই সাধিত হয়।( সূরা হজ্জ (২২), আয়াত ৩২)
ব্যাখ্যা
আল্লাহর শা‘আইর মানে আল্লাহর দীনের শা‘আইর। شَعَائِر শব্দটি شَعِيْرَةٌ বা شِعَارَةُ এর বহুবচন। এর অর্থ আলামত ও নিদর্শন। পরিভাষায় শা‘আইর (شَعَائِر) বলা হয় এমনসব বিষয় ও বস্তুকে, যা কোনও ধর্ম বা মতাদর্শের একান্ত বিষয় ও তার পরিচায়ক। সুতরাং 'দীনে ইসলাম'-এর শাআইর বলতে এমনসব বিষয় ও বস্তুকে বোঝাবে, যা এ দীনের পরিচয় বহন করে বা যা একান্তভাবে এ দীনের সঙ্গেই সম্পর্কযুক্ত। এভাবেও বলা যায় যে, যেসকল বিষয় দেখলে বা শুনলে বোঝা যায় যে, এটা কেবল ইসলামেরই জিনিস, অন্যকিছুর নয়, তাকেই দীনের শাআইর বলে। যেমন ওযু, আযান, নামায, মসজিদ, বায়তুল্লাহ, হজ্জের স্থানসমূহ, কুরবানীর পশু, কুরআন-হাদীছ, কুরআন-হাদীছ ও দীনী ইলমের চর্চা ইত্যাদি।
এমনিভাবে যেসকল ব্যক্তিবর্গ দীন ইসলামের বিশেষ কোনও আমলের সঙ্গে এমনভাবে সম্পৃক্ত, যদ্দরুন সেই আমলের বিশেষণে তারা বিশেষিত হয়ে থাকে, তারাও ইসলামের শা'আইরের অন্তর্ভুক্ত। যেমন মুআযযিন, ইমাম, ইসলামী রাষ্ট্রের খলীফা, হাজী, মুসল্লী, মু'আল্লিম (ইলমে দীনের শিক্ষক), তালিবুল ইলম প্রমুখ। এসকল উপাধি অন্য কোনও ধর্মের আচার-অনুষ্ঠানকারীর জন্য প্রযোজ্য হয় না। এর যে-কোনও উপাধি উচ্চারণ মাত্রই শ্রোতার দৃষ্টি চলে যায় ইসলামের দিকে। সুতরাং এ উপাধিধারীগণ ইসলামের নিদর্শন।
এ আয়াতে দীনের শাআইরের প্রতি সম্মান প্রদর্শন সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, فَإِنَّهَا مِنْ تَقْوَى الْقُلُوبِ (তা তো অন্তরস্থ তাকওয়া থেকেই সাধিত হয়)। অর্থাৎ যার অন্তরে তাকওয়া ও আল্লাহভীতি আছে, সেই-ই এটা করে। সে হিসেবে এটা তাকওয়ার আলামতও বটে। এ আয়াত দ্বারা জানা গেল, তাকওয়া অন্তরের বিষয়। এক হাদীছেও আছে, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজ বুকের দিকে ইশারা করে বলেন, أَلَا إِنَّ التَّقْوَى ههُنَا ‘জেনে রেখো, তাকওয়া এখানে'। তাকওয়া যেহেতু অন্তরের বিষয়, তাই তা চোখে দেখা যায় না, আলামত দ্বারা বোঝা যায়। শাআইরকে সম্মান করা একটা আলামত। কেউ এটা করলে এর দ্বারা বোঝা যায় তার অন্তরে তাকওয়া আছে।
এ আয়াত দ্বারা মূলত মু'মিন-মুত্তাকীকে তাগিদ করা হয়েছে সে যেন দীনের শা'আইর ও নিদর্শনসমূহকে সম্মান করে ও তার আদব বজায় রাখে। কাজেই নামায যেহেতু দীনের গুরুত্বপূর্ণ এক নিদর্শন, তাই সর্বোতভাবে এর আদব রক্ষা করা জরুরি। নামাযের যাওয়ার সময় না দৌড়িয়ে ধীরস্থিরভাবে হাঁটাও সে আদবের অন্তর্ভুক্ত। এমনিভাবে ইলমে দীনের চর্চাও যেহেতু দীনের এক নিদর্শন, তাই এ চর্চার সঙ্গে যারা জড়িত, প্রথমত তাদের কর্তব্য নিজেদের অন্তরে এ কাজের মূল্যবোধ সৃষ্টি করা ও আদবের সঙ্গে এ কাজ আঞ্জাম দেওয়া। মু'আল্লিম শিক্ষাদানের কাজটি করবে সংশ্লিষ্ট আদবসমূহ রক্ষা করে। অনুরূপ তালিবুল ইলমও ইলম হাসিলের যা-কিছু আদব আছে, সেসবের প্রতি লক্ষ রেখেই দীনী ইলম হাসিল করবে। ধীর-শান্তভাবে যাওয়াটাও সে আদবের একটি।
আয়াতটির শিক্ষা
ক. প্রত্যেক মুসলিমের উচিত দীনের নিদর্শনসমূহকে মর্যাদা দেওয়া। এটা তাকওয়া- পরহেযগারীর পরিচায়ক।
খ. নামায, দীনী ইলমের চর্চা এবং এ জাতীয় অন্যান্য ইবাদত-বন্দেগী যেহেতু দীনের নিদর্শন, তাই এসবের সম্মান রক্ষা করা একান্ত কর্তব্য।
গ. নামায পড়তে যাওয়া কিংবা দীনী ইলম শিক্ষার উদ্দেশ্যে যাওয়ার সময় ধীর- শান্তভাবে চলা উচিত। এর দ্বারা দীনের নিদর্শনের মর্যাদা রক্ষা হয়।
ঈমানের পর নামায সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। এটা আল্লাহ তা'আলার এক শ্রেষ্ঠ নিদর্শন। নামাযে বান্দা আল্লাহ তা'আলার অভিমুখী হয়। তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে নিজ দাসত্ব ও ক্ষুদ্রতা প্রকাশ করে এবং আল্লাহ তা'আলার গৌরব ও বড়ত্বের স্বীকারোক্তি নেয়। দুনিয়ার রীতি হল কেউ যখন মহান কোনও ব্যক্তির সামনে যায়, তখন বিনয় ও আদব রক্ষার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে থাকে। আল্লাহ তা'আলা আমাদের সৃষ্টিকর্তা ও মালিক। তিনি সকল বাদশার বাদশা। নামায হল তাঁর সামনে উপস্থিতির এক নমুনা। কাজেই নামাযে যাওয়ার সময় বিনয় ও আদব রক্ষার প্রতি অধিকতর সচেতন থাকা বাঞ্ছনীয়।
দীনী ইলম দ্বারা আল্লাহ তা'আলার পরিচয় লাভ হয় এবং তাঁর ইবাদত-বন্দেগী করার পদ্ধতি জানা যায়, যা কিনা মানবসৃষ্টির মূল উদ্দেশ্য। এ ইলমের উৎস হল কুরআন ও হাদীছ, যা ওহীর মাধ্যমে মানুষকে দেওয়া হয়েছে। কাজেই দীনী ইলমের বিশেষ মর্যাদা রয়েছে। এই ইলম যারা শেখে, ফিরিশতারা পর্যন্ত তাদের সম্মান করে। সাগরের মাছও তাদের জন্য দু'আ করে। সুতরাং এ ইলমের শিক্ষার্থীর প্রথম কর্তব্য এর মহিমা উপলব্ধি করা। যে শিক্ষার্থী তা উপলব্ধি করতে সক্ষম হবে, সে অবশ্যই এ ইলমের সঙ্গে সম্পৃক্ত সবকিছুকে মর্যাদাপূর্ণ গণ্য করবে। সে তার প্রত্যেকটির আদব রক্ষা করবে। সে আদব রক্ষা করবে কুরআন মাজীদের, হাদীছ গ্রন্থের, শিক্ষকের, শিক্ষালয়ের এবং ইলমের যাবতীয় উপকরণের। সে ধারায় ইলম শিক্ষার জন্য গমনকালেও আদব-কায়দার প্রতি লক্ষ রাখবে। হাঁটবে শান্তভাবে। অহেতুক কোনও কাজ করবে না। অপ্রয়োজনীয় কোনও কথা বলবে না। তার ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয় এমন কোনওকিছুতেই জড়াবে না। হযরত উমর ফারূক রাযি. বলেন-
تَعَلَّموا العِلمَ وعَلِّموه النَّاسَ، وتعَلَّموا له الوَقارَ والسَّكينةَ، وتواضَعوا لِمَن يُعَلِّمُكم عِندَ العِلمِ، وتواضَعوا لِمن تُعَلِّموه العِلمَ، ولا تكونوا جَبابرةَ العُلَماءِ
‘তোমরা ইলম শেখো। মানুষকে তা শেখাও। ইলমের জন্য ভাবগাম্ভীর্য শেখো এবং শেখো ধীর-শান্ত হতে। যার কাছ থেকে ইলম শেখ, তার সামনে বিনয় অবলম্বন করো। যাকে ইলম শেখাও, তার সঙ্গে নম্র-কোমল থেকো। তোমরা কঠোর-কঠিন উলামা হয়ো না।’(বায়হাকী, শু শু'আবুল ঈমান: ১৭৮৯)
নামায ও দীনী ইলমের মতো ইবাদত-বন্দেগীর সঙ্গে সম্পৃক্ত আরও যা-কিছু আছে, সবকিছুর বেলায়ই আদব রক্ষার বিষয়টি অতীব গুরুত্বপূর্ণ। সে কারণেই এ গ্রন্থে স্বতন্ত্র এক পরিচ্ছেদের অবতারণা করা হয়েছে। ইমাম নববী রহ. এ পরিচ্ছেদে সে সম্পর্কিত আয়াত ও হাদীছ উল্লেখ করেছেন। আমরা সংক্ষেপে তার বঙ্গানুবাদ ও ব্যাখ্যা পেশ করছি। আল্লাহ তা'আলাই তাওফীকদাতা।
‘নামায আদায় ও ইলম হাসিল এবং অনুরূপ যে-কোনও ইবাদত-বন্দেগীতে... চলার প্রতি উৎসাহদান’ সম্পর্কিত একটি আয়াত
وَمَنْ يُعَظِّمْ شَعَائِرَ اللَّهِ فَإِنَّهَا مِنْ تَقْوَى الْقُلُوبِ
অর্থ: আর কেউ আল্লাহর ‘শাআইর’-কে সম্মান করলে তা তো অন্তরস্থ তাকওয়া থেকেই সাধিত হয়।( সূরা হজ্জ (২২), আয়াত ৩২)
ব্যাখ্যা
আল্লাহর শা‘আইর মানে আল্লাহর দীনের শা‘আইর। شَعَائِر শব্দটি شَعِيْرَةٌ বা شِعَارَةُ এর বহুবচন। এর অর্থ আলামত ও নিদর্শন। পরিভাষায় শা‘আইর (شَعَائِر) বলা হয় এমনসব বিষয় ও বস্তুকে, যা কোনও ধর্ম বা মতাদর্শের একান্ত বিষয় ও তার পরিচায়ক। সুতরাং 'দীনে ইসলাম'-এর শাআইর বলতে এমনসব বিষয় ও বস্তুকে বোঝাবে, যা এ দীনের পরিচয় বহন করে বা যা একান্তভাবে এ দীনের সঙ্গেই সম্পর্কযুক্ত। এভাবেও বলা যায় যে, যেসকল বিষয় দেখলে বা শুনলে বোঝা যায় যে, এটা কেবল ইসলামেরই জিনিস, অন্যকিছুর নয়, তাকেই দীনের শাআইর বলে। যেমন ওযু, আযান, নামায, মসজিদ, বায়তুল্লাহ, হজ্জের স্থানসমূহ, কুরবানীর পশু, কুরআন-হাদীছ, কুরআন-হাদীছ ও দীনী ইলমের চর্চা ইত্যাদি।
এমনিভাবে যেসকল ব্যক্তিবর্গ দীন ইসলামের বিশেষ কোনও আমলের সঙ্গে এমনভাবে সম্পৃক্ত, যদ্দরুন সেই আমলের বিশেষণে তারা বিশেষিত হয়ে থাকে, তারাও ইসলামের শা'আইরের অন্তর্ভুক্ত। যেমন মুআযযিন, ইমাম, ইসলামী রাষ্ট্রের খলীফা, হাজী, মুসল্লী, মু'আল্লিম (ইলমে দীনের শিক্ষক), তালিবুল ইলম প্রমুখ। এসকল উপাধি অন্য কোনও ধর্মের আচার-অনুষ্ঠানকারীর জন্য প্রযোজ্য হয় না। এর যে-কোনও উপাধি উচ্চারণ মাত্রই শ্রোতার দৃষ্টি চলে যায় ইসলামের দিকে। সুতরাং এ উপাধিধারীগণ ইসলামের নিদর্শন।
এ আয়াতে দীনের শাআইরের প্রতি সম্মান প্রদর্শন সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, فَإِنَّهَا مِنْ تَقْوَى الْقُلُوبِ (তা তো অন্তরস্থ তাকওয়া থেকেই সাধিত হয়)। অর্থাৎ যার অন্তরে তাকওয়া ও আল্লাহভীতি আছে, সেই-ই এটা করে। সে হিসেবে এটা তাকওয়ার আলামতও বটে। এ আয়াত দ্বারা জানা গেল, তাকওয়া অন্তরের বিষয়। এক হাদীছেও আছে, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজ বুকের দিকে ইশারা করে বলেন, أَلَا إِنَّ التَّقْوَى ههُنَا ‘জেনে রেখো, তাকওয়া এখানে'। তাকওয়া যেহেতু অন্তরের বিষয়, তাই তা চোখে দেখা যায় না, আলামত দ্বারা বোঝা যায়। শাআইরকে সম্মান করা একটা আলামত। কেউ এটা করলে এর দ্বারা বোঝা যায় তার অন্তরে তাকওয়া আছে।
এ আয়াত দ্বারা মূলত মু'মিন-মুত্তাকীকে তাগিদ করা হয়েছে সে যেন দীনের শা'আইর ও নিদর্শনসমূহকে সম্মান করে ও তার আদব বজায় রাখে। কাজেই নামায যেহেতু দীনের গুরুত্বপূর্ণ এক নিদর্শন, তাই সর্বোতভাবে এর আদব রক্ষা করা জরুরি। নামাযের যাওয়ার সময় না দৌড়িয়ে ধীরস্থিরভাবে হাঁটাও সে আদবের অন্তর্ভুক্ত। এমনিভাবে ইলমে দীনের চর্চাও যেহেতু দীনের এক নিদর্শন, তাই এ চর্চার সঙ্গে যারা জড়িত, প্রথমত তাদের কর্তব্য নিজেদের অন্তরে এ কাজের মূল্যবোধ সৃষ্টি করা ও আদবের সঙ্গে এ কাজ আঞ্জাম দেওয়া। মু'আল্লিম শিক্ষাদানের কাজটি করবে সংশ্লিষ্ট আদবসমূহ রক্ষা করে। অনুরূপ তালিবুল ইলমও ইলম হাসিলের যা-কিছু আদব আছে, সেসবের প্রতি লক্ষ রেখেই দীনী ইলম হাসিল করবে। ধীর-শান্তভাবে যাওয়াটাও সে আদবের একটি।
আয়াতটির শিক্ষা
ক. প্রত্যেক মুসলিমের উচিত দীনের নিদর্শনসমূহকে মর্যাদা দেওয়া। এটা তাকওয়া- পরহেযগারীর পরিচায়ক।
খ. নামায, দীনী ইলমের চর্চা এবং এ জাতীয় অন্যান্য ইবাদত-বন্দেগী যেহেতু দীনের নিদর্শন, তাই এসবের সম্মান রক্ষা করা একান্ত কর্তব্য।
গ. নামায পড়তে যাওয়া কিংবা দীনী ইলম শিক্ষার উদ্দেশ্যে যাওয়ার সময় ধীর- শান্তভাবে চলা উচিত। এর দ্বারা দীনের নিদর্শনের মর্যাদা রক্ষা হয়।
নামাযের জামাতে যাওয়াকালীন চলার আদব
হাদীছ নং: ৭০৩
হযরত আবু হুরায়রা রাযি. বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, যখন নামাযের ইকামত হয়ে যায়, তখন তাতে (শরীক হওয়ার জন্য) তোমরা দৌড়ে আসবে না। বরং তোমরা হেঁটে হেঁটে আসবে এবং ধীর-শান্ত ভাব রক্ষা করবে। তারপর তোমরা নামাযের যে অংশ পাও তা পড়বে আর যা ছুটে যায় তা পূর্ণ করে নেবে। -বুখারী ও মুসলিম
(সহীহ বুখারী: ৯০৮; সহীহ মুসলিম: ৬০২; জামে' তিরমিযী: ৩২৭; সুনানে ইবন মাজাহ: ৭৭৬; সুনানে নাসাঈ: ৮৬১; মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাক: ৩৪০৪; মুসনাদুল হুমায়দী: ৯৬৪; মুসান্নাফে ইবন আবী শায়বা: ৭৪০০; সহীহ ইবনে হিব্বান: ২১৪৮; তহাবী, শারহু মা'আনিল আছার: ২৩১০)
মুসলিমের এক বর্ণনায় আছে, কেননা তোমাদের কেউ যখন নামাযের উদ্দেশে যায়, তখন সে নামাযেই থাকে।
হাদীছ নং: ৭০৩
হযরত আবু হুরায়রা রাযি. বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, যখন নামাযের ইকামত হয়ে যায়, তখন তাতে (শরীক হওয়ার জন্য) তোমরা দৌড়ে আসবে না। বরং তোমরা হেঁটে হেঁটে আসবে এবং ধীর-শান্ত ভাব রক্ষা করবে। তারপর তোমরা নামাযের যে অংশ পাও তা পড়বে আর যা ছুটে যায় তা পূর্ণ করে নেবে। -বুখারী ও মুসলিম
(সহীহ বুখারী: ৯০৮; সহীহ মুসলিম: ৬০২; জামে' তিরমিযী: ৩২৭; সুনানে ইবন মাজাহ: ৭৭৬; সুনানে নাসাঈ: ৮৬১; মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাক: ৩৪০৪; মুসনাদুল হুমায়দী: ৯৬৪; মুসান্নাফে ইবন আবী শায়বা: ৭৪০০; সহীহ ইবনে হিব্বান: ২১৪৮; তহাবী, শারহু মা'আনিল আছার: ২৩১০)
মুসলিমের এক বর্ণনায় আছে, কেননা তোমাদের কেউ যখন নামাযের উদ্দেশে যায়, তখন সে নামাযেই থাকে।
كتاب الأدب
باب الندب إِلَى إتيان الصلاة والعلم ونحوهما من العبادات بالسكينة والوقار
قَالَ الله تَعَالَى: {وَمَنْ يُعَظِّمْ شَعَائِرَ اللهِ فَإنَّهَا مِنْ تَقْوَى القُلُوبِ} [الحج: 32].
قَالَ الله تَعَالَى: {وَمَنْ يُعَظِّمْ شَعَائِرَ اللهِ فَإنَّهَا مِنْ تَقْوَى القُلُوبِ} [الحج: 32].
703 - وعن أَبي هريرة - رضي الله عنه - قَالَ: سَمِعْتُ رسول الله - صلى الله عليه وسلم - يقول: «إِذَا أُقِيمَتِ الصَّلاَةُ، فَلاَ تَأتُوهَا وَأَنْتُمْ تَسْعَونَ، وَأتُوهَا وَأَنْتُمْ تَمْشُونَ، وَعَلَيْكُمُ السَّكِينَةُ، فَمَا أدْرَكْتُم فَصَلُّوا، وَمَا فَاتكُمْ فَأَتِمُّوا». متفقٌ عَلَيْهِ. (1)
زاد مسلِمٌ في روايةٍ لَهُ: «فَإنَّ أحَدَكُمْ إِذَا كَانَ يَعْمِدُ إِلَى الصَّلاَةِ فَهُوَ في صَلاَةٍ».
زاد مسلِمٌ في روايةٍ لَهُ: «فَإنَّ أحَدَكُمْ إِذَا كَانَ يَعْمِدُ إِلَى الصَّلاَةِ فَهُوَ في صَلاَةٍ».
হাদীসের ব্যাখ্যা:
এ হাদীছটিতে নামাযে যাওয়ার আদব বর্ণিত হয়েছে এবং যাওয়ার পর যদি দেখা যায় ইমাম দু-এক রাকাত পড়ে ফেলেছে, সে ক্ষেত্রে কী করণীয় সে সম্পর্কে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। প্রথমে ইরশাদ হয়েছে-
إذا أقيمَتِ الصَّلاةُ ، فلا تَأتوها وأنتُمْ تَسعونَ ‘যখন নামাযের ইকামত হয়ে যায়, তখন তাতে (শরীক হওয়ার জন্য) তোমরা দৌড়ে আসবে না'। সাধারণত লক্ষ করা যায় যখন জামাতের ইকামত হয়ে যায়, তখন লোকে জামাত ধরার জন্য দ্রুত ছুটে যায়, যাতে তাকবীরে উলা বা কোনও রাকাত ছুটে না যায়। এ হাদীছে সেটা নিষেধ করা হয়েছে। কেননা জামাত বা তাকবীরে উলা ধরার নিয়তে বের হলে তার ছাওয়াব হাসিল হয়ে যায়, যদিও তা ধরা সম্ভব না হয়। কাজেই দ্রুত হাঁটা বা দৌড়ানোর কোনও প্রয়োজন নেই। যেহেতু প্রয়োজন নেই, তাই তা করাটা হবে নিরর্থক। সেইসঙ্গে তা আদবেরও পরিপন্থী। নামায যেহেতু দীনের গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন এবং নামাযে হাজির হওয়ার দ্বারা যেন আল্লাহর দরবারে ও তাঁর সমীপে হাজিরা দেওয়া হয়, তাই এ যাওয়ার বিশেষ মাহাত্ম্য ও মহিমা রয়েছে। যে-কোনও মর্যাদাপূর্ণ স্থানে গমনকালে গাম্ভীর্য ও ধীর-শান্ত ভাব রক্ষা করাই নিয়ম। নামাযের ক্ষেত্রে তো সে নিয়ম অনেক বেশি গুরুত্ব রাখে। সুতরাং নামাযে গমনকালে কিছুতেই দৌড়ানো বা দ্রুতবেগে হাঁটা বাঞ্ছনীয় নয়।
তাছাড়া দৌড়িয়ে যাওয়ার দ্বারা ছাওয়াব কমে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। কেননা তাতে কদমের সংখ্যা কমে যায়। হেঁটে যাওয়ায় যত কদম লাগে, দৌড়িয়ে গেলে ততো লাগে না। কেননা হাদীছে জানানো হয়েছে, নামাযে যাওয়ার প্রত্যেক কদমে ছাওয়াব পাওয়া যায়। সুতরাং ইরশাদ হয়েছে-
وَبِكُلِّ خَطْوَةٍ تَمْشِيْهَا إِلَى الصَّلَاةِ صَدَقَةٌ
‘কেউ নামাযে যাওয়ার জন্য যে পথ চলে, তার প্রতিটি কদম ফেলার দ্বারা একেকটি সদাকার ছাওয়াব হয়।' (সহীহ বুখারী: ২৭০৭; সহীহ মুসলিম: ১০০৯; সহীহ ইবন হিব্বান ৩৩৮১; মুসনাদে আহমাদ: ৮১৬৭; বায়হাকী, আস্ সুনানুল কুবরা: ৭৮২০; বাগাবী, শারহুস্ সুন্নাহ: ১৬৪৫)
হাদীছটিতে ইকামত হয়ে গেলে নামাযে দ্রুতগতিতে যেতে নিষেধ করা হয়েছে। এর দ্বারা বোঝা যায় ইকামতের আগে রওয়ানা করলে দ্রুতগতিতে চলার কোনও প্রশ্নই আসে না। কেননা ইকামতের পর রওয়ানা করলে রাকাত ছুটে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। সে ক্ষেত্রেই যখন শান্তভাবে চলতে বলা হয়েছে, তখন ইকামতের আগে রওয়ানা করলে যেহেতু রাকাত ছুটে যাওয়ার কোনও আশঙ্কা থাকে না, তাই তখন তো শান্তভাবে চলা আরও বেশি জরুরি।
প্রশ্ন হতে পারে, আযানের পর জুমু‘আয় যাওয়ার ক্ষেত্রে তো দ্রুতবেগেই চলার হুকুম করা হয়েছে? সুতরাং ইরশাদ হয়েছে-
يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِذَا نُودِيَ لِلصَّلَاةِ مِنْ يَوْمِ الْجُمُعَةِ فَاسْعَوْا إِلَى ذِكْرِ اللَّهِ
হে মুমিনগণ! জুমু‘আর দিন যখন নামাযের জন্য ডাকা হয়, তখন আল্লাহর যিকিরের দিকে ধাবিত হও। (সূরা জুমু'আ (৬২), আয়াত ৯)
তবে কি জুমু‘আর জন্য বিধান আলাদা? উত্তর হল, না। সকল নামাযেই ধীর-শান্তভাবে চলা নিয়ম। এ আয়াতে যে فَاسْعَوْا (ধাবিত হও) বলা হয়েছে, এর দ্বারাও দৌড়িয়ে যাওয়া বোঝানো উদ্দেশ্য নয়। এখানে ধাবিত হওয়ার দ্বারা চেষ্টা করা বোঝানো হয়েছে। অর্থাৎ জুমু‘আর আযান হয়ে গেলে তোমাদের কাজ হবে অন্যসব ছেড়ে জুমু‘আর নামাযের প্রস্তুতি নেওয়া এবং নামায ধরার চেষ্টা করা। কিন্তু চলতে হবে শান্তভাবেই, যেমনটা আলোচ্য হাদীছে বলা হয়েছে। মুফাসসিরদের অনেকেই فَاسْعَوْا এর অর্থ 'চেষ্টা করা'-ই বলেছেন। কুরআন মাজীদেও শব্দটি এ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন আছে-
وَإِذَا تَوَلَّى سَعَى فِي الْأَرْضِ لِيُفْسِدَ فِيهَا
‘সে যখন উঠে চলে যায়, তখন যমীনে অশান্তি বিস্তারের চেষ্টা করে।’ (সূরা বাকারা (২), আয়াত ২০৫)
আবার অনেকে বলেছেন, এর অর্থ আন্তরিক নিয়ত ও গাম্ভীর্যের সঙ্গে চলা। হাসান বসরী রহ. বলেন, আল্লাহর কসম! فَاسْعَوْا এর অর্থ দৌড়ানো নয়; বরং শান্তভাবে চলা। কাতাদা রহ. বলেন, سعي বলা হয় পায়ে হেঁটে চলাকে। যেমন ইরশাদ হয়েছে-
فَلَمَّا بَلَغَ مَعَهُ السَّعْيَ
‘অতঃপর সে পুত্র যখন ইবরাহীমের সাথে চলাফেরা করার উপযুক্ত হল।' (সূরা আস-সাফফাত (৩৭), আয়াত ১০২)
মোটকথা জুমু‘আসহ যে-কোনও নামাযের জামাতে শামিল হওয়ার জন্য ধীর-শান্তভাবে চলাটাই আদব। এ হাদীছটিতে সাধারণভাবেই বলা হয়েছে- إذا أقيمَتِ الصَّلاةُ (যখন নামাযের ইকামত হয়ে যায়)। অর্থাৎ তা যে নামাযই হোক। দৈনন্দিন পাঁচ ওয়াক্তের নামায হোক বা জুমু'আর নামায। সকল নামাযের জন্যই হুকুম হল-
وَأتُوهَا وَأنْتُمْ تَمْشُونَ، وَعَلَيْكُمُ السَّكِينَةُ (বরং তোমরা হেঁটে হেঁটে আসবে এবং ধীর-শান্ত ভাব রক্ষা করবে)। অর্থাৎ এমনভাবে হেঁটে আসবে, যাতে ভাবগাম্ভীর্য নষ্ট না হয় ও নামাযে আসার মাহাত্ম্য ক্ষুণ্ণ না হয়। চলবে শান্তভাবে। দৃষ্টিকটু অঙ্গভঙ্গি করবে না। বেহুদা কথা বলবে না। অহেতুক কাজ করবে না। মুসলিম শরীফের বর্ণনাটুকু এদিকে ইঙ্গিত করছে। বলা হয়েছে-
فَإنَّ أحَدَكُمْ إِذَا كَانَ يَعْمِدُ إِلَى الصَّلاَةِ فَهُوَ في صَلاَةٍ (কেননা তোমাদের কেউ যখন নামাযের উদ্দেশে যায়, তখন সে নামাযেই থাকে)। অর্থাৎ এ যাওয়াটা অন্যান্য কাজে যাওয়ার মতো নয়। এ যাওয়ার আলাদা মহিমা আছে। এটা নামাযের মতো মহান এক ইবাদতে শরীক হওয়ার জন্য যাওয়া। এর প্রত্যেক কদমে ছাওয়াব লেখা হয়, গুনাহ মাফ হয়। কাজেই এ সময় অহেতুক সব কাজ থেকে বিরত থাকা চাই। চলতে হবে আদবের সঙ্গে। ধীর-শান্তভাবে। যাতে মাহাত্ম্যপূর্ণ এ গমনের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ না হয়।
এভাবে আসার পর যদি দেখা যায় রাকাত ছুটে গেছে, সে ক্ষেত্রে কী করণীয়? নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-
فَمَا أَدْرَكْتُمْ فَصَلُّوْا، وَمَا فَاتَكُمْ فَأَتِمُّوا (তারপর তোমরা নামাযের যে অংশ পাও তা পড়বে আর যা ছুটে যায় তা পূর্ণ করে নেবে)। অর্থাৎ ইমামের সঙ্গে যা পাবে তা ইমামের অনুসরণে পড়তে থাকবে। তারপর যা ছুটে গেল, ইমাম সালাম ফেরানোর পর উঠে তা আদায় করে নেবে। তাতে পূর্ণ জামাতের ছাওয়াব পেয়ে যাবে।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. জামাতে শামিল হওয়ার জন্য চলাটা অন্যান্য চলার মতো নয়। এর আলাদা মর্যাদা আছে। তাই চলাটা ধীর-শান্তভাবে হওয়া উচিত।
খ. যদি অলসতা করা না হয় এবং পূর্ণ জামাত ধরার ইচ্ছা থাকে, তবে শান্তভাবে যাওয়ার পর রাকাত ছুটে গেলেও ছাওয়াব কমে না; বরং পূর্ণ জামাতের ছাওয়াবই পাওয়া যায়।
গ. ইমামের সঙ্গে যে রাকাত পাওয়া যায়, তা মাসবুক ব্যক্তির শেষ রাকাত। আর যা ছুটে গেল তা প্রথম দিকের রাকাত। তাই তা শুরুর রাকাত হিসেবেই পড়ে নিতে হবে।
إذا أقيمَتِ الصَّلاةُ ، فلا تَأتوها وأنتُمْ تَسعونَ ‘যখন নামাযের ইকামত হয়ে যায়, তখন তাতে (শরীক হওয়ার জন্য) তোমরা দৌড়ে আসবে না'। সাধারণত লক্ষ করা যায় যখন জামাতের ইকামত হয়ে যায়, তখন লোকে জামাত ধরার জন্য দ্রুত ছুটে যায়, যাতে তাকবীরে উলা বা কোনও রাকাত ছুটে না যায়। এ হাদীছে সেটা নিষেধ করা হয়েছে। কেননা জামাত বা তাকবীরে উলা ধরার নিয়তে বের হলে তার ছাওয়াব হাসিল হয়ে যায়, যদিও তা ধরা সম্ভব না হয়। কাজেই দ্রুত হাঁটা বা দৌড়ানোর কোনও প্রয়োজন নেই। যেহেতু প্রয়োজন নেই, তাই তা করাটা হবে নিরর্থক। সেইসঙ্গে তা আদবেরও পরিপন্থী। নামায যেহেতু দীনের গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন এবং নামাযে হাজির হওয়ার দ্বারা যেন আল্লাহর দরবারে ও তাঁর সমীপে হাজিরা দেওয়া হয়, তাই এ যাওয়ার বিশেষ মাহাত্ম্য ও মহিমা রয়েছে। যে-কোনও মর্যাদাপূর্ণ স্থানে গমনকালে গাম্ভীর্য ও ধীর-শান্ত ভাব রক্ষা করাই নিয়ম। নামাযের ক্ষেত্রে তো সে নিয়ম অনেক বেশি গুরুত্ব রাখে। সুতরাং নামাযে গমনকালে কিছুতেই দৌড়ানো বা দ্রুতবেগে হাঁটা বাঞ্ছনীয় নয়।
তাছাড়া দৌড়িয়ে যাওয়ার দ্বারা ছাওয়াব কমে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। কেননা তাতে কদমের সংখ্যা কমে যায়। হেঁটে যাওয়ায় যত কদম লাগে, দৌড়িয়ে গেলে ততো লাগে না। কেননা হাদীছে জানানো হয়েছে, নামাযে যাওয়ার প্রত্যেক কদমে ছাওয়াব পাওয়া যায়। সুতরাং ইরশাদ হয়েছে-
وَبِكُلِّ خَطْوَةٍ تَمْشِيْهَا إِلَى الصَّلَاةِ صَدَقَةٌ
‘কেউ নামাযে যাওয়ার জন্য যে পথ চলে, তার প্রতিটি কদম ফেলার দ্বারা একেকটি সদাকার ছাওয়াব হয়।' (সহীহ বুখারী: ২৭০৭; সহীহ মুসলিম: ১০০৯; সহীহ ইবন হিব্বান ৩৩৮১; মুসনাদে আহমাদ: ৮১৬৭; বায়হাকী, আস্ সুনানুল কুবরা: ৭৮২০; বাগাবী, শারহুস্ সুন্নাহ: ১৬৪৫)
হাদীছটিতে ইকামত হয়ে গেলে নামাযে দ্রুতগতিতে যেতে নিষেধ করা হয়েছে। এর দ্বারা বোঝা যায় ইকামতের আগে রওয়ানা করলে দ্রুতগতিতে চলার কোনও প্রশ্নই আসে না। কেননা ইকামতের পর রওয়ানা করলে রাকাত ছুটে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। সে ক্ষেত্রেই যখন শান্তভাবে চলতে বলা হয়েছে, তখন ইকামতের আগে রওয়ানা করলে যেহেতু রাকাত ছুটে যাওয়ার কোনও আশঙ্কা থাকে না, তাই তখন তো শান্তভাবে চলা আরও বেশি জরুরি।
প্রশ্ন হতে পারে, আযানের পর জুমু‘আয় যাওয়ার ক্ষেত্রে তো দ্রুতবেগেই চলার হুকুম করা হয়েছে? সুতরাং ইরশাদ হয়েছে-
يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِذَا نُودِيَ لِلصَّلَاةِ مِنْ يَوْمِ الْجُمُعَةِ فَاسْعَوْا إِلَى ذِكْرِ اللَّهِ
হে মুমিনগণ! জুমু‘আর দিন যখন নামাযের জন্য ডাকা হয়, তখন আল্লাহর যিকিরের দিকে ধাবিত হও। (সূরা জুমু'আ (৬২), আয়াত ৯)
তবে কি জুমু‘আর জন্য বিধান আলাদা? উত্তর হল, না। সকল নামাযেই ধীর-শান্তভাবে চলা নিয়ম। এ আয়াতে যে فَاسْعَوْا (ধাবিত হও) বলা হয়েছে, এর দ্বারাও দৌড়িয়ে যাওয়া বোঝানো উদ্দেশ্য নয়। এখানে ধাবিত হওয়ার দ্বারা চেষ্টা করা বোঝানো হয়েছে। অর্থাৎ জুমু‘আর আযান হয়ে গেলে তোমাদের কাজ হবে অন্যসব ছেড়ে জুমু‘আর নামাযের প্রস্তুতি নেওয়া এবং নামায ধরার চেষ্টা করা। কিন্তু চলতে হবে শান্তভাবেই, যেমনটা আলোচ্য হাদীছে বলা হয়েছে। মুফাসসিরদের অনেকেই فَاسْعَوْا এর অর্থ 'চেষ্টা করা'-ই বলেছেন। কুরআন মাজীদেও শব্দটি এ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন আছে-
وَإِذَا تَوَلَّى سَعَى فِي الْأَرْضِ لِيُفْسِدَ فِيهَا
‘সে যখন উঠে চলে যায়, তখন যমীনে অশান্তি বিস্তারের চেষ্টা করে।’ (সূরা বাকারা (২), আয়াত ২০৫)
আবার অনেকে বলেছেন, এর অর্থ আন্তরিক নিয়ত ও গাম্ভীর্যের সঙ্গে চলা। হাসান বসরী রহ. বলেন, আল্লাহর কসম! فَاسْعَوْا এর অর্থ দৌড়ানো নয়; বরং শান্তভাবে চলা। কাতাদা রহ. বলেন, سعي বলা হয় পায়ে হেঁটে চলাকে। যেমন ইরশাদ হয়েছে-
فَلَمَّا بَلَغَ مَعَهُ السَّعْيَ
‘অতঃপর সে পুত্র যখন ইবরাহীমের সাথে চলাফেরা করার উপযুক্ত হল।' (সূরা আস-সাফফাত (৩৭), আয়াত ১০২)
মোটকথা জুমু‘আসহ যে-কোনও নামাযের জামাতে শামিল হওয়ার জন্য ধীর-শান্তভাবে চলাটাই আদব। এ হাদীছটিতে সাধারণভাবেই বলা হয়েছে- إذا أقيمَتِ الصَّلاةُ (যখন নামাযের ইকামত হয়ে যায়)। অর্থাৎ তা যে নামাযই হোক। দৈনন্দিন পাঁচ ওয়াক্তের নামায হোক বা জুমু'আর নামায। সকল নামাযের জন্যই হুকুম হল-
وَأتُوهَا وَأنْتُمْ تَمْشُونَ، وَعَلَيْكُمُ السَّكِينَةُ (বরং তোমরা হেঁটে হেঁটে আসবে এবং ধীর-শান্ত ভাব রক্ষা করবে)। অর্থাৎ এমনভাবে হেঁটে আসবে, যাতে ভাবগাম্ভীর্য নষ্ট না হয় ও নামাযে আসার মাহাত্ম্য ক্ষুণ্ণ না হয়। চলবে শান্তভাবে। দৃষ্টিকটু অঙ্গভঙ্গি করবে না। বেহুদা কথা বলবে না। অহেতুক কাজ করবে না। মুসলিম শরীফের বর্ণনাটুকু এদিকে ইঙ্গিত করছে। বলা হয়েছে-
فَإنَّ أحَدَكُمْ إِذَا كَانَ يَعْمِدُ إِلَى الصَّلاَةِ فَهُوَ في صَلاَةٍ (কেননা তোমাদের কেউ যখন নামাযের উদ্দেশে যায়, তখন সে নামাযেই থাকে)। অর্থাৎ এ যাওয়াটা অন্যান্য কাজে যাওয়ার মতো নয়। এ যাওয়ার আলাদা মহিমা আছে। এটা নামাযের মতো মহান এক ইবাদতে শরীক হওয়ার জন্য যাওয়া। এর প্রত্যেক কদমে ছাওয়াব লেখা হয়, গুনাহ মাফ হয়। কাজেই এ সময় অহেতুক সব কাজ থেকে বিরত থাকা চাই। চলতে হবে আদবের সঙ্গে। ধীর-শান্তভাবে। যাতে মাহাত্ম্যপূর্ণ এ গমনের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ না হয়।
এভাবে আসার পর যদি দেখা যায় রাকাত ছুটে গেছে, সে ক্ষেত্রে কী করণীয়? নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-
فَمَا أَدْرَكْتُمْ فَصَلُّوْا، وَمَا فَاتَكُمْ فَأَتِمُّوا (তারপর তোমরা নামাযের যে অংশ পাও তা পড়বে আর যা ছুটে যায় তা পূর্ণ করে নেবে)। অর্থাৎ ইমামের সঙ্গে যা পাবে তা ইমামের অনুসরণে পড়তে থাকবে। তারপর যা ছুটে গেল, ইমাম সালাম ফেরানোর পর উঠে তা আদায় করে নেবে। তাতে পূর্ণ জামাতের ছাওয়াব পেয়ে যাবে।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. জামাতে শামিল হওয়ার জন্য চলাটা অন্যান্য চলার মতো নয়। এর আলাদা মর্যাদা আছে। তাই চলাটা ধীর-শান্তভাবে হওয়া উচিত।
খ. যদি অলসতা করা না হয় এবং পূর্ণ জামাত ধরার ইচ্ছা থাকে, তবে শান্তভাবে যাওয়ার পর রাকাত ছুটে গেলেও ছাওয়াব কমে না; বরং পূর্ণ জামাতের ছাওয়াবই পাওয়া যায়।
গ. ইমামের সঙ্গে যে রাকাত পাওয়া যায়, তা মাসবুক ব্যক্তির শেষ রাকাত। আর যা ছুটে গেল তা প্রথম দিকের রাকাত। তাই তা শুরুর রাকাত হিসেবেই পড়ে নিতে হবে।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)