রিয়াযুস সালিহীন-ইমাম নববী রহঃ

২. বিবিধ আদব - শিষ্টাচারের অধ্যায়

হাদীস নং: ৭০৫
বিবিধ আদব - শিষ্টাচারের অধ্যায়
অতিথিকে সম্মান ও সমাদর করা

অতিথিকে সমাদর করা ইসলামের এক গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা। এটা নবী-রাসূলগণের সুন্নত। সালিহীনের আদর্শ। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে অসামান্য অতিথিপরায়ণ ছিলেন। নবুওয়াতলাভের আগেও অতিথির সেবাযত্ন করতেন। তাঁর প্রতি সর্বপ্রথম যখন ওহী নাযিল হয় এবং ওহীর চাপে তিনি ভীষণ অস্থিরতা বোধ করেন এমনকি মৃত্যুর আশঙ্কা পর্যন্ত করেন, তখন উম্মুল মুমিনীন হযরত খাদীজা রাযি. তাঁর যেসকল সদগুণের উল্লেখপূর্বক তাঁকে সান্ত্বনা দিয়েছিলেন এবং আল্লাহর সাহায্যলাভের বিষয়ে তাঁকে আশ্বস্ত করেছিলেন, তার মধ্যে তাঁর অতিথিপরায়ণতার কথাও ছিল। তিনি বলেছিলেন, আল্লাহর কসম! আল্লাহ আপনাকে কখনওই অসহায় ছেড়ে দেবেন না। কেননা আপনি আত্মীয়তা রক্ষা করেন, অতিথির সেবাযত্ন করেন...। তিনি সাহাবায়ে কেরামকেও এ মহৎগুণের উপর গড়ে তুলেছিলেন। তাঁদের একেকজন অভাবনীয় রকমের অতিথিপরায়ণ ছিলেন। মদীনা মুনাওয়ারায় দূর-দূরান্ত থেকে যেসকল প্রতিনিধি দল ও মেহমান আসত, তাঁরা দু'জন-চারজন করে আপন আপন সামর্থ্য অনুযায়ী তাদেরকে ভাগ করে নিতেন। সামর্থ্য কিই বা ছিল? অনেকের তো নিজেদেরই খাওয়ার মতো কিছু থাকত না। হয়তো বাচ্চাদের খাওয়ার মতো সামান্য কিছু থাকত। তাঁরা নিজেরা না খেয়ে এবং বাচ্চাদেরকে নানা বাহানায় ঘুম পাড়িয়ে রেখে সেই খাবারই অতিথিদের খাইয়ে দিতেন। মদীনার আনসারগণ তো সব মুহাজিরকেই নিজেদের অতিথিরূপে গ্রহণ করেছিলেন। তাঁরা যে অকল্পনীয় ত্যাগ ও আন্তরিকতার সঙ্গে মুহাজিরদের সমাদর করেছিলেন, ইতিহাসে তার কোনও দৃষ্টান্ত নেই। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শিক্ষা এবং সাহাবায়ে কেরামের দ্বারা সে শিক্ষার ব্যাপক চর্চারই ফল যে, অতিথিপরায়ণতা তখনকার ইসলামী সমাজের এক অবিচ্ছেদ্য অনুষঙ্গে পরিণত হয়েছিল।
প্রতিটি বাড়ি যেন ছিল একেকটি মেহমানখানা। মেহমানকে প্রফুল্লমনে গ্রহণ করা, তাকে সম্মানজনকভাবে থাকতে দেওয়া, গভীর আন্তরিকতার সঙ্গে তার আপ্যায়ন করা, পথখরচা দিয়ে সংবর্ধনাসহ তাকে বিদায় করা- এ সবই ছিল যুগ-যুগান্তব্যাপী মুসলিম সমাজের এক বহুল চর্চিত সংস্কার। তখন মেহমান বলতে কেবল আত্মীয়-স্বজনের বেড়ানোকেই বোঝাত না। আত্মীয়ের হক তো আলাদা জিনিস। তখনকার মেহমানদের একটা বড় অংশ হতো পথিকজনেরা। মুসাফির ও পথিকেরা দুপুরের প্রখর রোদে কিংবা রাতের অন্ধকারে কোথায় যাবে, কীভাবে পথ চলবে? বিশ্রাম ও আশ্রয়ের কোনও জায়গা দরকার। এ অবস্থায় সামনে যে বাড়িই পড়ত, সেই বাড়িতেই তার আশ্রয় মিলত। গৃহস্থ পরম যতনে তাকে নিজ বাড়িতে আশ্রয় দিত এবং মেহমানরূপে তার সমাদর করত। মুসাফিরকে তাতে কোনও সংকোচবোধও করতে হতো না। কারণ গৃহকর্তা 'আহলান ওয়া সাহলান' বলে যেভাবে তাকে অকৃত্রিম ও দিলখোলা অভ্যর্থনা জানাত, তাতে সে আপনা-আপনিই সহজ ও হালকা হয়ে যেত।
কিন্তু কালক্রমে আমরা সেই ঐতিহ্য হারিয়ে ফেলেছি। আমাদের সমাজে সেই মেহমানদারি এখন নেই বললেই চলে। আত্মীয় ছাড়াও যে-কেউ অতিথি হতে পারে, তা যেন কেউ ভাবতেই পারে না। সেরূপ আগুন্তুক এখনকার সমাজে নিতান্তই উটকো ঝামেলা। এ ঝামেলা এখন সহজে কেউ গ্রহণ করতে পারে না। একটি মুসলিমসমাজের জন্য এটা কিছুতেই মঙ্গলজনক নয়। অতিথিগ্রহণে কৃপণতা আমাদের পারস্পরিক সৌহার্দ্য-সম্প্রীতিকে ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। সকল মুসলিম ভাই ভাই এবং সকলে মিলে এক দেহের মতো- ইসলামী ঐক্য ও ভ্রাতৃত্বের এই যে মহান শিক্ষা, তা থেকে আমরা যোজন যোজন দূরে সরে পড়েছি। জাতিগতভাবে আমাদের দুর্বলতা ও পশ্চাদপদতার এটা একটা বড় কারণ। আমরা আমাদের আত্মিক উৎকর্ষ ও জাতিগত উন্নতির ভাবনা সত্যিই যদি ভেবে থাকি, তবে আমাদেরকে অবশ্যই আমাদের পুরোনো ঐতিহ্যে ফিরে যেতে হবে। সে ঐতিহ্যের এক বিশেষ অঙ্গ হল অতিথিসমাদর। অতিথির প্রতি সম্মান প্রদর্শন এবং তার সহৃদয় সেবাযত্নের দ্বারা আমরা আমাদের আত্মিক ও বৈষয়িক বহুবিধ উৎকর্ষ সাধন করতে পারি। কুরআন ও হাদীছ আমাদেরকে এর প্রতি বিশেষভাবে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে। রিয়াযুস সালেহীনের বর্তমান পরিচ্ছেদটি সে সম্পর্কেই।


‘অতিথিকে সম্মান ও সমাদর করা’ সম্পর্কিত দু'টি আয়াত

এক নং আয়াত
هَلْ أَتَاكَ حَدِيثُ ضَيْفِ إِبْرَاهِيمَ الْمُكْرَمِينَ (24) إِذْ دَخَلُوا عَلَيْهِ فَقَالُوا سَلَامًا قَالَ سَلَامٌ قَوْمٌ مُنْكَرُونَ (25) فَرَاغَ إِلَى أَهْلِهِ فَجَاءَ بِعِجْلٍ سَمِينٍ (26) فَقَرَّبَهُ إِلَيْهِمْ قَالَ أَلَا تَأْكُلُونَ (27)
অর্থ: (হে রাসূল!) তোমার কাছে কি ইবরাহীমের সম্মানিত অতিথিদের বৃত্তান্ত পৌঁছেছে? যখন তারা ইবরাহীমের কাছে উপস্থিত হয়ে বলল সালাম, তখন ইবরাহীমও বলল সালাম। (এবং সে মনে মনে চিন্তা করল যে,) এরা তো অপরিচিত লোক। তারপর সে চুপিসারে নিজ পরিবারবর্গের কাছে গেল এবং একটি মোটাতাজা বাছুর (-ভাজা) নিয়ে আসল। এবং তা সেই অতিথিদের সামনে এগিয়ে দিল এবং বলল, আপনারা খাচ্ছেন না যে?(সূরা যারিয়াত (৫১), আয়াত ২৪-২৭)


ব্যাখ্যা
এ আয়াতগুলোতে হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামের কাছে মানুষের আকৃতিতে কয়েকজন ফিরিশতার আগমন এবং অতিথি হিসেবে ইবরাহীম আলাইহিস সালামের পক্ষ থেকে তাদের সেবাযত্নের কথা বর্ণিত হয়েছে। প্রথমে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে লক্ষ্য করে বলা হয়েছে-
هَلْ أَتَاكَ حَدِيثُ ضَيْفِ إِبْرَاهِيمَ الْمُكْرَمِينَ ‘(হে রাসূল!) তোমার কাছে কি ইবরাহীমের সম্মানিত অতিথিদের বৃত্তান্ত পৌছেছে'? এ প্রশ্নটি স্বীকৃতিমূলক। বোঝানো হয়েছে, তাদের বৃত্তান্ত তোমার কাছে অবশ্যই এসেছে। তুমি তাদের সম্পর্কে জান। এর দ্বারা সে বৃত্তান্তের গুরুত্ব তুলে ধরা উদ্দেশ্য। সেইসঙ্গে এদিকেও ইঙ্গিত করে দেওয়া হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এর আগে আরও ওহী এসেছে।
হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামের কাছে আগত অতিথিদের বিশেষণরূপে الْمُكْرَمِينَ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। এর অর্থ সম্মানিত। এর দ্বারা দু'টি বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিত হয়। এক তো ফিরিশতাগণ এমনিতেই সম্মানিত। তারা কোনও গুনাহ করেন না। তারা আল্লাহ তা'আলার হুকুম পালন করেন এবং তাঁর মহিমা ও গৌরব বর্ণনায় রত থাকেন। দ্বিতীয়ত হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম কর্তৃক তারা সম্মানিত হয়েছিলেন। তিনি জানতেন না তারা ফিরিশতা। তথাপি অতিথি হিসেবে তিনি তাদেরকে সম্মান করেছিলেন। তিনি নিজে ও তাঁর স্ত্রী তাদের সেবাযত্ন করেছিলেন।
ফিরিশতাগণ মানুষের আকৃতিতে তাঁর ঘরে প্রবেশ করে বললেন- سَلَامًا (সালাম)। এখানে আরবী শব্দটি হল سَلَامًا । এটি ক্রিয়াপ্রধান বাক্য। এর মূল রূপ হল يُسَلِّمُكَ سَلَامًا (আমরা আপনাকে সালাম দিচ্ছি)। এর উত্তরে হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম বললেন-
سَلَمٌ قَوْمٌ مُّنْكَرُوْنَ ‘সালাম। (এবং সে মনে মনে চিন্তা করল যে,) এরা তো অপরিচিত লোক'। তিনি উত্তরে ব্যবহার করলেন বিশেষ্যপ্রধান বাক্য। কেননা سَلَامٌ এর প্রকৃত রূপ হল سَلَامٌ عَلَيْكُمْ (আপনাদের প্রতিও সালাম)। ক্রিয়াপ্রধান বাক্য ক্ষণস্থায়িত্বের অর্থ দেয় আর বিশেষ্যপ্রধান বাক্য স্থায়িত্বের অর্থ দেয়। এ হিসেবে ফিরিশতাদের সালাম অপেক্ষা হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামের উত্তর উৎকৃষ্ট হয়েছে। জবাব দেওয়ার ক্ষেত্রে এদিকে লক্ষ রাখা ভালো। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে-
وَإِذَا حُيِّيتُمْ بِتَحِيَّةٍ فَحَيُّوا بِأَحْسَنَ مِنْهَا أَوْ رُدُّوهَا
‘যখন কেউ তোমাদেরকে সালাম করে, তখন তোমরা (তাকে) তদপেক্ষাও উত্তমরূপে সালাম দিয়ো কিংবা (অন্ততপক্ষে) সেই শব্দেই তার জবাব দিয়ো।’(সূরা নিসা (৪) আয়াত ৮৬)
সালামের উত্তর দেওয়ার পর হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম মনে মনে বললেন, এরা কারা? এরা তো আমার অপরিচিত! এরা এখানকার স্থানীয় নয়। যে কারণে আমি এদের চিনতে পারছি না।
এমনও হতে পারে যে, তিনি সরাসরি তাদেরকে বলেছিলেন, আপনাদেরকে আমার অপরিচিত মনে হচ্ছে। আমি আপনাদের চিনতে পারছি না । এ বলে সম্ভবত তিনি তাদের পরিচয় জানতে চেয়েছিলেন।
তারপর তিনি চুপিসারে নিজ স্ত্রীর কাছে চলে গেলেন। মেহমানদের জন্য খানাদানার ব্যবস্থা করলেন। তিনি তাদের জন্য একটা মোটাতাজা বাছুর ভুনা করলেন। সেই ভুনা বাছুর এনে তাদের সামনে পরিবেশন করলেন। তারপর বললেন- أَلَا تَأْكُلُونَ (আপনারা খাচ্ছেন না যে)? অথবা এর অর্থ- আপনারা খাবেন না? এ বলে তিনি আদবের সঙ্গে তাদেরকে খাওয়ার অনুরোধ করেছিলেন। অথবা তিনি তাদের সামনে খাবার পরিবেশন করার পর দেখতে পেলেন যে, তারা যথারীতি হাত গুটিয়ে বসে আছেন। খাবারের দিকে হাত বাড়াচ্ছেন না। তা দেখে তাঁর মনে হল তারা হয়তো খাবেন না। তারা কেন খাবেন না তা জানার জন্য তিনি জিজ্ঞেস করলেন, আপনারা খাচ্ছেন না যে? তাঁর মনে একটু ভীতিও সঞ্চার হল, যেমন পরবর্তী আয়াতে জানানো হয়েছে। ফলে ফিরিশতাগণ নিজেদের পরিচয় প্রকাশ করেন এবং হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামকে পুত্রসন্তান জন্মের সুসংবাদ দিয়ে তাদের আগমনের উদ্দেশ্য ব্যক্ত করেন। সে উদ্দেশ্য ছিল হযরত লূত আলাইহিস সালামের কওমকে শাস্তি দেওয়া।

আয়াতের শিক্ষা
এ আয়াত দ্বারা আতিথেয়তার কয়েকটি আদব জানা যায়। যেমন-
ক. প্রথমত সালাম বিনিময় এবং মেহমানদের ঘরের ভেতর বসানো ও বিশ্রামের ব্যবস্থা করা।
খ. তাদের জন্য যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি খানাদানার ব্যবস্থা করা।
গ. তাদের জিজ্ঞেস করতে নেই আপনারা খাবেন কি? বরং চুপিসারে যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি খাবার প্রস্তুত করে তাদের সামনে পরিবেশন করা।
ঘ. মেহমানের জন্য নিজ সাধ্যমতো উত্তম খাবার প্রস্তুত করা কাম্য।
ঙ. মেহমানের সঙ্গে কথাবার্তা বলতে হবে সম্মানজনকভাবে ও বিনয়ের সঙ্গে।
চ.খাবার পরিবেশনের পর অতিথির চাহিদা থাকলে খাবে, নয়তো নয়। খাওয়ার জন্য তাদেরকে পীড়াপীড়ি করা উচিত নয়।

দুই নং আয়াত
وَجَاءَهُ قَوْمُهُ يُهْرَعُونَ إِلَيْهِ وَمِنْ قَبْلُ كَانُوا يَعْمَلُونَ السَّيِّئَاتِ قَالَ يَاقَوْمِ هَؤُلَاءِ بَنَاتِي هُنَّ أَطْهَرُ لَكُمْ فَاتَّقُوا اللَّهَ وَلَا تُخْزُونِ فِي ضَيْفِي أَلَيْسَ مِنْكُمْ رَجُلٌ رَشِيدٌ (78)
অর্থ: তার সম্প্রদায়ের লোক তার দিকে ছুটে আসল। তারা পূর্ব থেকেই কুকর্মে লিপ্ত ছিল। লুত বলল, হে আমার সম্প্রদায়! এই আমার কন্যাগণ উপস্থিত রয়েছে। এরা তোমাদের পক্ষে ঢের পবিত্র! সুতরাং আল্লাহকে ভয় করো এবং আমার মেহমানদের ব্যাপারে তোমরা আমাকে হেয় করো না। তোমাদের মধ্যে কি একজনও ভালো লোক নেই?(সূরা হুদ (১১), আয়াত ৭৮)

ব্যাখ্যা
এ আয়াতে হযরত লূত আলাইহিস সালাম ও তাঁর সম্প্রদায়ের ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। তাঁর সম্প্রদায় বিকৃত যৌনাচার (সমকামিতা)-সহ নানা অপকর্মে লিপ্ত ছিল। তিনি তাদেরকে তা থেকে ফেরানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছিলেন। তাদেরকে নানাভাবে বোঝাচ্ছিলেন। তা থেকে বিরত না হলে তারা আল্লাহর আযাবে আক্রান্ত হতে পারে বলেও তাদেরকে সতর্ক করেছিলেন। কিন্তু কোনওক্রমেই তারা তা থেকে বিরত হচ্ছিল না। পরিশেষে তাদেরকে শাস্তি দেওয়ার জন্য আল্লাহ তা'আলা একদল ফিরিশতা পাঠালেন। ফিরিশতাগণ রূপবান যুবকের বেশে হযরত লূত আলাইহিস সালামের বাড়িতে আসলেন। তিনি তাদেরকে মানুষ ও অতিথি মনে করলেন। ওদিকে তাঁর সম্প্রদায় জানতে পারল যে, তাঁর বাড়িতে কয়েকজন অতিথি এসেছে। অমনি তারা তাদের বিকৃত যৌনলালসা চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যে তাঁর বাড়িতে ছুটে আসল। তিনি তাদের হাত থেকে মেহমানদের রক্ষা করার সবরকম চেষ্টা করতে থাকলেন। কিন্তু তারা কোনওকিছুই মানছিল না। শেষে তিনি তাদেরকে বললেন-
يَا قَوْمِ هَٰؤُلَاءِ بَنَاتِي هُنَّ أَطْهَرُ لَكُمْ (হে আমার সম্প্রদায়! এই আমার কন্যাগণ উপস্থিত রয়েছে। এরা তোমাদের পক্ষে ঢের পবিত্র)! অর্থাৎ তোমরা তোমাদের এ দুষ্কর্ম থেকে ক্ষান্ত হও। আমি আমার মেয়েদেরকে তোমাদের নেতাদের সঙ্গে বিয়ে দেব। তোমরা যা চাচ্ছ তা অপবিত্র কাজ। আমার মেয়েদেরকে বিবাহ করলে তা তোমাদের জন্য পবিত্র ও হালাল সাব্যস্ত হবে। উল্লেখ্য, সেকালে অমুসলিম পুরুষের সঙ্গে মুসলিম নারীদের বিবাহ জায়েয ছিল। সে হিসেবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও তাঁর কন্যা হযরত যায়নাব রাযি.-কে আবুল 'আস ইবনুর রাবী'র সঙ্গে বিবাহ দিয়েছিলেন। তখনও পর্যন্ত আবুল 'আস ইসলাম গ্রহণ করেননি। তিনি তাঁর অপর এক কন্যাকে আবু লাহাবের পুত্র উতবার সঙ্গে বিবাহ দিয়েছিলেন। পরবর্তীতে এরূপ বিবাহ নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়। সুতরাং এখন কোনও অমুসলিম পুরুষের সঙ্গে মুসলিম নারীর বিবাহ জায়েয নয়।
কোনও কোনও মুফাসসিরের মতে এ আয়াতে 'কন্যা' বলে হযরত লূত আলাইহিস সালামের সম্প্রদায়ের কন্যাদের বোঝানো হয়েছে। নবী তাঁর নিজ সম্প্রদায়ের জন্য পিতা স্বরূপ এবং তাঁর সম্প্রদায় তাঁর পক্ষে সন্তান স্বরূপ। যেমন কুরআন মাজীদের এক আয়াতে ইরশাদ হয়েছে-
النَّبِيُّ أَوْلَى بِالْمُؤْمِنِينَ مِنْ أَنْفُسِهِمْ وَأَزْوَاجُهُ أُمَّهَاتُهُمْ
‘মুমিনদের পক্ষে নবী তাদের নিজেদের প্রাণ অপেক্ষাও বেশি ঘনিষ্ঠ। আর তাঁর স্ত্রীগণ তাদের মা।’(সূরা আহযাব (৩৩), আয়াত ৬)


তিনি তাদেরকে আরও বলেছিলেন- فَاتَّقُوا اللَّهَ وَلَا تُخْزُونِ فِي ضَيْفِي (সুতরাং আল্লাহকে ভয় করো এবং আমার মেহমানদের ব্যাপারে তোমরা আমাকে হেয় করো না)। অর্থাৎ তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং এ অশ্লীল কাজ থেকে বিরত থাকো। আল্লাহ সব দেখছেন। তোমরা এর থেকে বিরত না হলে তিনি তোমাদের কঠিন শাস্তি দেবেন। তোমরা সুমতির পরিচয় দাও। আমার অতিথিদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে আমাকে অপদস্থ করো না। তোমরা কি বোঝ না অতিথিকে অপদস্থ করা গৃহস্থকে অপদস্থ করারই নামান্তর?
তিনি আক্ষেপ করে বললেন- أَلَيْسَ مِنكُمْ رَجُلٌ رَّشِيدٌ (তোমাদের মধ্যে কি একজনও ভালো লোক নেই)! অর্থাৎ এমন একজনও নেই, যে আমার অনুরোধ ও উপদেশে কর্ণপাত করবে এবং এসব অন্যায়-অপরাধ থেকে বেঁচে থাকবে! ইবন ইসহাক রহ. বলেন, رَشِيدٌ হলা হয় এমন ব্যক্তিকে, যে সৎকাজের আদেশ দেয় ও অসৎকাজে নিষেধ করে। এ হিসেবে সম্ভবত হযরত লূত আলাইহিস সালাম বোঝাতে চাচ্ছিলেন যে, তোমরা সকলেই কি এমন দুরাচার? তোমাদের মধ্যে একজনও নেই, যে আমার কথার সমর্থন করবে এবং তোমাদেরকে এ জঘন্য কাজ থেকে নিবৃত্ত করবে!
মোটকথা, তাঁর সম্প্রদায়কে তিনি কোনওক্রমেই নিবৃত্ত করতে সক্ষম হচ্ছিলেন না। তারা তাঁর কোনও কথায়ই কান দিচ্ছিল না। পরিশেষে অতিথিগণ আপন পরিচয় ব্যক্ত করলেন। তারা জানালেন যে, তারা মানুষ নয়; বরং আল্লাহ তা'আলার ফিরিশতা। তারা এ অপরাধী সম্প্রদায়কে আল্লাহ তা'আলার আদেশে শাস্তি দেওয়ার জন্যই এসেছে। শেষে তাই হল। ফিরিশতাগণ গোটা সম্প্রদায়কে সমূলে ধ্বংস করে দিলেন। তার আগে হযরত লূত আলাইহিস সালাম তাঁর কন্যাদের নিয়ে সে জনপদ ত্যাগ করে অন্যত্র চলে গেলেন।

আয়াতটির শিক্ষা
ক. গৃহকর্তার কর্তব্য অতিথির সঙ্গে সম্মানজনক আচরণ করা এবং অন্য কেউ তাদের অসম্মান করতে চাইলে সর্বোতপ্রকারে তা থেকে অতিথিকে রক্ষার ব্যবস্থা নেওয়া।
খ. অন্যের অতিথিকে সম্মান করা উচিত। কেননা তাকে অসম্মান করা গৃহকর্তাকে অসম্মান করার নামান্তর।
অতিথির প্রতি সম্মানজনক আচরণ ঈমানের দাবি
হাদীছ নং: ৭০৫

হযরত আবূ হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি আল্লাহ ও শেষদিবসের প্রতি বিশ্বাস রাখে সে যেন তার অতিথিকে সম্মান করে, যে ব্যক্তি আল্লাহ ও শেষদিবসের প্রতি বিশ্বাস রাখে সে যেন তার আত্মীয়তা রক্ষা করে এবং যে ব্যক্তি আল্লাহ ও শেষদিবসের প্রতি বিশ্বাস রাখে সে যেন ভালো কথা বলে নয়তো চুপ থাকে। -বুখারী ও মুসলিম
(সহীহ বুখারী: ৬১৩৮; সহীহ মুসলিম: ৪৭; জামে' তিরমিযী: ২৬৬৮; সুনানে ইবন মাজাহ: ৩৬৭২; সুনানে আবূ দাউদ: ৫১৫৪; মুসান্নাফে আব্দুর রায্যাক: ১৯৭৪৬; নাসাঈ, আস সুনানুল কুবরা: ১১৭৮২; মুসনাদে আহমাদ: ৭৬২৬; সহীহ ইবনে হিব্বান: ৫১৬; মুসনাদুল বাযযার: ৬৯১০)
كتاب الأدب
باب إكرام الضيف
قَالَ الله تَعَالَى: {هَلْ أتَاكَ حَدِيثُ ضَيْفِ إبْرَاهِيمَ الْمُكْرَمِينَ إذْ دَخَلُوا عَلَيْهِ فَقَالُوا سَلاَمًا قَالَ سَلاَمٌ قَوْمٌ مُنْكَرُونَ فَرَاغَ إِلَى أهْلِهِ فَجَاءَ بِعِجْلٍ سَمِينٍ فَقَرَّبَهُ إلَيْهِمْ قَالَ ألاَ تَأكُلُونَ} [الذاريات: 24 - 27]، وقال تَعَالَى: {وَجَاءهُ قَوْمُهُ يُهْرَعُونَ إِلَيْهِ وَمِنْ قَبْلُ كَانُوا يَعْمَلُونَ السَّيِّئَاتِ قَالَ يَا قَوْمِ هَؤُلاَءِ بَنَاتِي هُنَّ أَطْهَرُ لَكُمْ فَاتَّقُوا اللهَ وَلاَ تُخْزُونِ في ضَيْفِي أَلَيْسَ مِنْكُمْ رَجُلٌ رَشِيدٌ} [هود: 78].
705 - وعن أَبي هريرة - رضي الله عنه: أنَّ النبيَّ - صلى الله عليه وسلم - قَالَ: «مَنْ كَانَ يُؤْمِنُ بِاللهِ وَاليَوْمِ الآخِرِ فَلْيُكْرِمْ ضَيْفَهُ، وَمَنْ كَانَ يُؤْمِنُ بِاللهِ وَاليَومِ الآخِرِ، فَلْيَصِلْ رَحِمَهُ، وَمَنْ كَانَ يُؤْمِنُ بِاللهِ وَاليَومِ الآخِرِ، فَلْيَقُلْ خَيْرًا أَوْ لِيَصْمُتْ». متفقٌ عَلَيْهِ. (1)

হাদীসের ব্যাখ্যা:

নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কাজের হুকুমদানের আগে আল্লাহ ও শেষদিবসে বিশ্বাসের বরাত দিয়েছেন। অর্থাৎ যার এ বিশ্বাস আছে তার এ বিষয়টি পালনে যত্নবান থাকা একান্ত কর্তব্য।

ঈমানের মূল স্তম্ভ সাতটি আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস, ফিরিশতাদের প্রতি বিশ্বাস, আসমানী কিতাবের প্রতি বিশ্বাস, রাসূলগণের প্রতি বিশ্বাস, শেষদিবসের প্রতি বিশ্বাস, তাকদীরে বিশ্বাস এবং মৃত্যুর পর পুনরুত্থানের উপর বিশ্বাস। এ হাদীছে তার মধ্যে মাত্র দু'টি অর্থাৎ আল্লাহ ও শেষদিবসের প্রতি বিশ্বাসের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এর কারণ এ দু'টির উপর যার বিশ্বাস আছে, বাকি পাঁচটিতে বিশ্বাস আপনা-আপনিই তার উপর অবধারিত হয়ে যায়। শরীআতের যাবতীয় বিধানের ভিত্তি মূলত এ দু'টি বিশ্বাসের উপরই। কেননা যার আল্লাহর উপর বিশ্বাস আছে এবং আখেরাতের হিসাব-নিকাশেরও ভয় আছে, সেই তো শরীআত মেনে চলতে সচেষ্ট থাকবে। এরূপ বিশ্বাস থাকলেই সে আল্লাহর প্রেরিত নবী-রাসূলের শিক্ষার দ্বারস্থ হবে। নবী-রাসূলের শিক্ষার উৎস আসমানী কিতাব, যা তাঁরা ফিরিশতাদের মাধ্যমে লাভ করে থাকেন। সুতরাং বিশ্বাসীগণ আসমানী কিতাব ও ফিরিশতাদের উপরও ঈমান রাখবে। আসমানী কিতাবের উপর বিশ্বাস থাকলে তাতে বর্ণিত কোনওকিছুর উপরই অবিশ্বাস করার সুযোগ থাকে না। ফলে তাকদীর ও পুনরুত্থানে বিশ্বাসও অবধারিত হয়ে যায়। ব্যস এভাবে আল্লাহ ও শেষদিবসের বিশ্বাস অন্যসব কিছুর বিশ্বাসকেও অবধারিত করে।

যাহোক এ হাদীছে বলা হয়েছে (যে ব্যক্তি আল্লাহ ও শেষদিবসের প্রতি বিশ্বাস রাখে, তার কর্তব্য অতিথির প্রতি সম্মানজনক আচরণ করা)। অতিথি গরীব-ধনী, আত্মীয়-অনাত্মীয় যেই হোক না কেন তাকে খুশিমনে গ্রহণ করা চাই। এমন কোনও আচরণ তার সঙ্গে করা যাবে না, যা অতিথির পক্ষে মর্যাদাকর নয়। সুতরাং মেজবানের কর্তব্য তার সঙ্গে হাসিমুখে সাক্ষাত করা, নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী তার জন্য ভালো মেহমানদারীর ব্যবস্থা করা, সামর্থ্য অনুযায়ী তাকে ভালো জায়গায় থাকতে দেওয়া, তার ওযূ-গোসলের প্রতি লক্ষ রাখা, তাকে সঙ্গ দেওয়া, বিদায়কালে তাকে এগিয়ে দেওয়া, সম্ভব হলে তার পথখরচা দিয়ে দেওয়া ইত্যাদি। কোনও কোনও বর্ণনায় আছে, তার প্রতি সম্মানজনক আচরণের একটি হলো অতিথি যেখানে বসবে, নিজে তার চেয়ে একটু নিচে বসা।

এ হাদীছে আত্মীয়তা রক্ষা সম্পর্কে বলা হয়েছে- যে ব্যক্তি আল্লাহ ও শেষদিবসে বিশ্বাস রাখে সে যেন আত্মীয়তা রক্ষা করে। কুরআন মাজীদের বিভিন্ন আয়াত ও বহু হাদীছ দ্বারা বোঝা যায় আত্মীয়তা রক্ষা করা ফরয। ছিন্ন করা নাজায়েয ও কবীরা গুনাহ। আত্মীয়তা রক্ষার বিভিন্ন স্তর আছে। তার সর্বনিম্ন স্তর হলো দেখাসাক্ষাত ও যোগাযোগ বন্ধ না করা এবং সালাম দেওয়া ও কথাবার্তা বলা। যদি এতটুকুও করা না হয়, তবে তা আত্মীয়তা ছিন্ন বলে গণ্য হবে। এর উপরে সাহায্য-সহযোগিতা করা,উপহার-উপঢৌকন দেওয়া ও সৌজন্যমূলক আচরণ করার বিষয়টি প্রত্যেকের সামর্থ্যের উপর নির্ভর করে। কাজেই সামর্থ্যভেদে এর মধ্যে বিভিন্ন স্তরভেদ হতে পারে।প্রত্যেকেই নিজ সামর্থ্য বোঝে। কাজেই আত্মীয়তা রক্ষার ফযীলত লাভের জন্য প্রত্যেকের উচিত আপন আপন সামর্থ্য অনুযায়ী আত্মীয়ের সঙ্গে যতবেশি সম্ভব হৃদ্যতাপূর্ণ আচরণ করা ও সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলা।

হাদীছে বলা হয়েছে- (যে আল্লাহ ও শেষদিবসের প্রতি বিশ্বাস রাখে তার কর্তব্য ভালো কথা বলা, নয়তো চুপ থাকা)। অর্থাৎ বলবে কেবল সেই কথাই, যা ভালো হয়। বোঝা যাচ্ছে চুপ থাকাটাই আসল। কথা বলার অনুমতি আছে তখনই, যখন কথাটা ভালো হয়। ভালো কথা মানে এমন কথা, যাতে কোনও গুনাহ নেই বরং ছাওয়াব আছে। যেমন সৎকাজের আদেশ করা, অসৎকাজে নিষেধ করা, ভালো পরামর্শ দেওয়া ইত্যাদি। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে-

لَا خَيْرَ فِي كَثِيرٍ مِنْ نَجْوَاهُمْ إِلَّا مَنْ أَمَرَ بِصَدَقَةٍ أَوْ مَعْرُوفٍ أَوْ إِصْلَاحٍ بَيْنَ النَّاسِ وَمَنْ يَفْعَلْ ذَلِكَ ابْتِغَاءَ مَرْضَاتِ اللَّهِ فَسَوْفَ نُؤْتِيهِ أَجْرًا عَظِيمًا

'মানুষের বহু গোপন কথায় কোনও কল্যাণ নেই। তবে কোনও ব্যক্তি দান সদাকা বা কোনও সৎকাজের কিংবা মানুষের মধ্যে মীমাংসার আদেশ করলে, সেটা ভিন্ন কথা। যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে এরূপ করবে, আমি তাকে মহাপ্রতিদান দেব।৪০

যে কথায় ছাওয়াবও নেই গুনাহও নেই, এরকম প্রয়োজনীয় দুনিয়াবী কথা বলারও অনুমতি আছে। কিন্তু যে কথার কোনও প্রয়োজন নেই, তা বাহ্যত বৈধ হলেও সে কথা পরিহার করা উচিত। কেননা তাতে অন্ততপক্ষে সময় তো নষ্ট হয়। অহেতুক সময় নষ্ট করাও ইসলামী শিক্ষার পরিপন্থী। এক হাদীছে ইরশাদ-

من حسن إسلام المرء تركه ما لا يعنيه

'অহেতুক সবকিছু পরিহার করা কোনও ব্যক্তির ইসলামের সুষ্ঠুতার পরিচায়ক।৪১
অর্থাৎ এর দ্বারা বোঝা যায় সে একজন ভালো মুসলিম, সে নিষ্ঠার সঙ্গে ইসলামের উপর আছে।

বলা হয়েছে, যদি ভালো কিছু বলার না থাকে তাহলে চুপ থাকবে। অর্থাৎ চুপ থাকাটা হতে হবে ইচ্ছাকৃত, অক্ষমতার কারণে নয়। যেমন এক ব্যক্তি বোবা, সে কথাই বলতে পারে না অথবা বাকশক্তি আছে বটে, কিন্তু কোনওকিছু বলার ক্ষমতা বা সাহস রাখে না, তাই বাধ্য হয়েই চুপ করে আছে, এরূপ চুপ থাকাটা কোনও ছাওয়াবের কাজ নয়। চুপ থাকা ছাওয়াবের কাজ হবে তখনই, যখন তা ইচ্ছাকৃত হয়। যেমন চাইলে সে কোনও শক্ত ও রূঢ় কথা বলতে পারে, তা সত্ত্বেও বলছে না, এ ক্ষেত্রে চুপ থাকাটা একটি ছাওয়াবের কাজরূপে গণ্য হবে। একবার এক সাহাবী আরয করেছিলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমাকে এমন আমলের কথা বলে দিন, যা আমাকে জান্নাতে পৌঁছাবে। উত্তরে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একের পর এক বিভিন্ন আমলের কথা বলতে থাকেন। সবশেষে ইরশাদ করেন-

فإن لم تطق ذلك، فكف لسانك إلا من خير

‘যদি তাও না পার, তবে ভালো কথা ছাড়া অন্য ক্ষেত্রে তোমার জিহ্বা সংযত রাখবে।৪২
অপর এক হাদীছে ইরশাদ من صمت نجا “যে ব্যক্তি নীরবতা অবলম্বন করল সে মুক্তি পেল।"

আবার কোনও কোনও ক্ষেত্রে চুপ থাকাটা গুনাহের কাজও বটে। যেমন কারও সামনে কেউ অন্যায় কিছু বলছে, কিন্তু ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও সে তার প্রতিবাদ করছে না, এটা অন্যায়কে সমর্থন করারই নামান্তর। এরূপ চুপ থাকা নিঃসন্দেহে একটি গুনাহের কাজ। তাই বলা হয়, যে ব্যক্তি সত্য বলার স্থানে চুপ করে থাকে সে এক বোবা শয়তান। (অবশ্য এটি হাদীছ নয়)।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. অন্যায় ও অনুচিত কথা বলা হতে বিরত থাকাও একটি সৎকর্ম

খ. অতিথির সঙ্গে সম্মানজনক আচরণ করা ঈমানের দাবি।

গ. প্রত্যেক মুমিনের কর্তব্য নিজ জিহ্বা সংযত রাখা। হয় ভালো কথা বলবে, নয়তো চুপ থাকবে।

ঘ. আত্মীয়ের প্রতি সদ্ব্যবহার করা ও সর্বাবস্থায় আত্মীয়তা রক্ষায় সচেষ্ট থাকা ঈমানের দাবি।

৪০. সূরা নিসা (৪), আয়াত ১১৪

৪১. জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ২৩১৭; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ১৭৩৭; সুনানে ইবন মাজাহ, হাদীছ নং ৩৯৭৬; সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ২২৯; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর, হাদীছ নং ২৮৮৬; বায়হাকী, শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ৪৬৩২; বাগাবী, শারহুস্ সুন্নাহ, হাদীছ নং ৪১৩২

৪২. বুখারী, আল আদাবুল মুফরাদ, হাদীছ নং ৬৯; সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ৩৭৪; তহাবী, শারহু মুশকিলিল আছার, হাদীছ নং ২৭৪৩; সুনানু দারা কুতনী, হাদীছ নং ২০৫৫; বায়হাকী, আস্ সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ২১৩১৩; শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ৪৫৮০; বাগাবী, শারহুস্ সুন্নাহ, হাদীছ নং ২৪১৯

৪৩. জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ২৫০১; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ৬৪৮১; সুনানুদ্ দারিমী, হাদীছ নং ২৭৫৫; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর, হাদীছ নং ১১৩; বায়হাকী, শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ৪৬২৯
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:বিশুদ্ধ (পারিভাষিক সহীহ)