রিয়াযুস সালিহীন-ইমাম নববী রহঃ

৪. পোষাক-পরিচ্ছদের বর্ণনা

হাদীস নং: ৭৯৩
পোষাক-পরিচ্ছদের বর্ণনা
পরিচ্ছেদ:৩ জামা, জামার হাতা, লুঙ্গি ও পাগড়ির শামলার দৈর্ঘ্য, অহংকারবশত এগুলোর কোনওটি ঝুলিয়ে দেওয়ার নিষেধাজ্ঞা এবং বিনা অহংকারে হলে তার কারাহাত
আখিরাতে তিন শ্রেণির লোকের ভয়ংকর পরিণাম

হাদীছ নং: ৭৯৩
হযরত আবূ যার্র রাযি. থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাআ’লা তিন ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলবেন না, তাদের প্রতি দৃষ্টিপাত করবেন না এবং তাদেরকে পবিত্র করবেন না। তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাময় শাস্তি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ কথা তিনবার বললেন। আবু যার্র বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! এরূপ লোক তো ব্যর্থ ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে গেল! তারা কারা? তিনি বললেন, যে ব্যক্তি কাপড় নিচে ঝুলিয়ে পরে, যে ব্যক্তি উপকার করে খোঁটা দেয় এবং যে ব্যক্তি মিথ্যা শপথ দ্বারা তার পণ্য বিক্রি করে। -মুসলিম
মুসলিমের অপর এক বর্ণনায় আছে, যে ব্যক্তি তার লুঙ্গি ঝুলিয়ে পরে।
(সহীহ মুসলিম: ১০৬; জামে তিরমিযী: ১২৫৪; সুনানে আবূ দাউদ: ৪০৮৭; সুনানে নাসাঈ: ২৫৬৩; সুনানে ইবন মাজাহ: ২২০৮; মুসনাদে আহমাদ: ২১৩১৮; মুসান্নাফে ইবন আবী শায়বা : ২৪৮১৩; সুনানে দারিমী;২৬৪৭; মুসনাদুল বাযযার ৪০২৪; সহীহ ইবনে হিব্বান: ৪৯০৭; বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান: ৪৫১০)
كتاب اللباس
باب صفة طول القميص والكُم والإزار وطرف العمامة وتحريم إسبال شيء من ذلك على سبيل الخيلاء وكراهته من غير خيلاء
793 - وعن أَبي ذر - رضي الله عنه - عن النبيِّ - صلى الله عليه وسلم - قَالَ: «ثلاثةٌ لاَ يُكَلِّمُهُمُ اللهُ يَوْمَ القِيَامَةِ، وَلاَ يَنْظُرُ إلَيْهِمْ، وَلاَ يُزَكِّيهِمْ، وَلَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ» قَالَ: فقَرأها رسول الله - صلى الله عليه وسلم - ثلاثَ مِرار، قَالَ أَبُو ذرٍّ: خَابُوا وَخَسِرُوا! مَنْ هُمْ يَا رسول الله؟ قَالَ: «المُسْبِلُ (1)، وَالمنَّانُ (2)، وَالمُنْفِقُ سِلْعَتَهُ بِالحَلِفِ الكاذِبِ». رواه مسلم. (3)
وفي رواية لَهُ: «المُسْبِلُ إزَارَهُ».

হাদীসের ব্যাখ্যা:

নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তিন ব্যক্তি সম্পর্কে চারটি সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেন। প্রথমে বলেছেন- لَا يُكَلِّمُهُمُ اللَّهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ (কিয়ামতের দিন আল্লাহ তা'আলা তাদের সঙ্গে কথা বলবেন না)। অর্থাৎ তাদেরকে উপেক্ষা করবেন। অথবা এর অর্থ- তাদের সঙ্গে সন্তোষজনক কথা বলবেন না, যা দ্বারা তারা আনন্দবোধ করবে। বরং তাদের সঙ্গে কথা বলবেন ক্রোধ ও অসন্তুষ্টির সঙ্গে।

দ্বিতীয়ত বলেছেন- وَلَا يَنْظُرُ إِلَيْهِمْ (তিনি তাদের দিকে তাকাবেন না)। অর্থাৎ তাদের প্রতি রহমতের দৃষ্টি দেবেন না। তাদেরকে সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষা করবেন। আল্লাহ তা'আলার তাকানো দ্বারা মূলত রহমত ও দয়া করা বোঝানো হয়ে থাকে।

তৃতীয়ত বলেছেন- وَلَا يُزَكِّيهِمْ (তাদেরকে পবিত্র করবেন না)। অর্থাৎ তাদেরকে ক্ষমা করে পাপের মলিনতা থেকে তাদেরকে মুক্ত ও পবিত্র করবেন না। কেউ কেউ এর অর্থ করেছেন তাদের প্রশংসা করবেন না।

সবশেষে বলেছেন- وَلَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ (তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাময় শাস্তি)। অর্থাৎ এমন শাস্তি তাদেরকে দেওয়া হবে, যা যন্ত্রণায় পরিপূর্ণ। অথবা এর অর্থ যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি। ওয়াহিদী রহ, বলেন, এর দ্বারা এমন শাস্তি বোঝানো উদ্দেশ্য, যার যন্ত্রণা শরীর ভেদ করে অন্তর পর্যন্ত পৌঁছে যাবে।

হাদীসে আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ সতর্কবাণী তিনবার উচ্চারণ করেন। যাতে তা শ্রোতাদের অন্তরে গভীরভাবে রেখাপাত করে, ফলে তারা এর দ্বারা উপকৃত হতে সচেষ্ট থাকে। গুরুত্বপূর্ণ কথার বেলায় সাধারণত এরকমই করা হয়। তা একবার বলে ক্ষান্ত করা হয় না; বরং বার বার বলা হয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও তাই করলেন। ফলে তাঁর এ কথা সাহাবায়ে কেরামের অন্তর নাড়া দিল। তারা জানতে উদগ্রীব হয়ে উঠলেন যে, সেই তিন ব্যক্তি কারা, যাদের পরিণাম এতটা ভয়ংকর! হযরত আবূ যার্র রাযি. তো বলেই ফেললেন- ইয়া রাসূলাল্লাহ! এরূপ লোক তো ব্যর্থ ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে গেল! তারা কারা? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন-
المسبل (যে ব্যক্তি কাপড় নিচে ঝুলিয়ে পরে)। শব্দটির উৎপত্তি اَلإِسْبَالُ থেকে। এর অর্থ পরিধানের কাপড় ঝুলিয়ে দেওয়া। অর্থাৎ টাখনুর নিচে নামানো, যদ্দরুন হাঁটার সময় তা হেঁচড়াতে থাকে। এটা অহংকারের লক্ষণ। অহংকারকারীকে আল্লাহ পসন্দ করেন না। সে কারণেই এরূপ ব্যক্তির আখিরাতে এমন দুর্গতি হবে। আরো বললেন-
الْمنَّان(যে ব্যক্তি উপকার করে খোঁটা দেয়)। অর্থাৎ কারও উপকার করার পর তাকে সে কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। এটা কঠিন পাপ। এর ফলে উপকার করার ছাওয়াব বাতিল হয়ে যায়। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে-
يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تُبْطِلُوا صَدَقَاتِكُمْ بِالْمَنِّ وَالْأَذَى
'হে মুমিনগণ! খোঁটা দিয়ে ও কষ্ট দিয়ে নিজেদের সদাকাকে নষ্ট করো না।(সূরা বাকারা, আয়াত ২৬৪)

আরেক ব্যক্তি হল- المنفق سلعته بالحلف الكاذب (যে ব্যক্তি মিথ্যা শপথ দ্বারা তার পণ্য বিক্রি করে)। অর্থাৎ যে ব্যক্তি কোনও পণ্য বিক্রি করে আর পণ্যটি ভালো না হওয়া সত্ত্বেও সে আল্লাহর নামে কসম করে বলে সেটি ভালো, আর তাতে বিশ্বাস করে ক্রেতা সেটি কিনে নেয়, আখিরাতে তাকে উপরোক্ত দুর্ভোগ পোহাতে হবে। কেননা সে এক তো মন্দ মালকে ভালো বলল। এটা একটা মিথ্যা কথা হল। তদুপরি সেই মিথ্যা কথাকে সত্য বলে বিশ্বাস করানোর জন্য সে আল্লাহর নামে কসম করল। এভাবে সে দুনিয়ার তুচ্ছ অর্থের জন্য আল্লাহ তা'আলার পবিত্র নামের অসম্মান করল। মিথ্যা বলা মহাপাপ। মিথ্যা কসম করা আরও গুরুতর পাপ। সেইসঙ্গে রয়েছে খেয়ানত করা ও ধোঁকা দেওয়ার পাপ। ক্রেতা তার কসমের কারণে তাকে বিশ্বাস করেছে আর মনে করেছে সত্যিই তার পণ্যটি ভালো ও ক্রয়যোগ্য। ফলে সে পণ্যটি কিনে ক্ষতিগ্রস্ত হল। এটা তার প্রতি বিক্রেতার সুস্পষ্ট বিশ্বাসঘাতকতা এবং তার সঙ্গে এক নির্লজ্জ প্রতারণা।

হাদীছটির উদ্দেশ্য হল উম্মতকে সতর্ক করা, যাতে তারা কিছুতেই এ তিন শ্রেণির লোকের অন্তর্ভুক্ত না হয়। যেন কোনও পোশাক টাখনুর নিচে ঝুলিয়ে না পরে, কারও উপকার করার পর যেন কিছুতেই তাকে খোঁটা না দেয় এবং কোনও পণ্য বিক্রিকালে মিথ্যা শপথ করে মানুষকে ধোঁকা না দেয়।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. লুঙ্গি, জামা, পায়জামা কোনওকিছুই টাখনুর নিচে নামিয়ে পরা যাবে না। এটা কঠিন গুনাহ।

খ. মানুষের উপকার করতে হবে ইখলাসের সঙ্গে। সুতরাং উপকার করার পর কিছুতেই খোঁটা দেওয়া যাবে না।

গ. পণ্য বিক্রিতে অবশ্যই সততার পরিচয় দিতে হবে। আল্লাহর নামে কসম করে মন্দ পণ্যকে ভালো পণ্যরূপে চালিয়ে দেওয়ার প্রতারণায় লিপ্ত হওয়া কিছুতেই সঙ্গত নয়।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:বিশুদ্ধ (পারিভাষিক সহীহ)