রিয়াযুস সালিহীন-ইমাম নববী রহঃ
৪. পোষাক-পরিচ্ছদের বর্ণনা
হাদীস নং: ৭৯৭
পোষাক-পরিচ্ছদের বর্ণনা
পরিচ্ছেদ:৩ জামা, জামার হাতা, লুঙ্গি ও পাগড়ির শামলার দৈর্ঘ্য, অহংকারবশত এগুলোর কোনওটি ঝুলিয়ে দেওয়ার নিষেধাজ্ঞা এবং বিনা অহংকারে হলে তার কারাহাত
হযরত আবুদ দারদা রাযি. ও হযরত ইবনুল হানযালিয়্যাহ রাযি.-এর পারস্পরিক সাক্ষাৎ ও অপূর্ব নসীহত
হাদীছ নং: ৭৯৭
কায়স ইবন বিশর তাগলিবী বলেন, আমার পিতা, যিনি আবুদ দারদা রাযি.-এর মজলিসে বসতেন, আমাকে জানিয়েছেন যে, দামেশকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একজন সাহাবী ছিলেন। তাকে ইবনুল হানযালিয়্যাহ বলা হত। তিনি একাকী থাকতে পসন্দ করতেন। মানুষের সঙ্গে ওঠাবসা খুব কমই করতেন। তার কাজ ছিল কেবল নামায পড়া। নামায শেষ হলে তার কাজ ছিল তাসবীহ ও তাকবীর পড়া, যতক্ষণ না নিজ পরিবার-পরিজনের কাছে ফিরে আসতেন। একবার তিনি আমাদের কাছ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তখন আমরা আবুদ দারদা রাযি.-এর নিকট বসা। আবুদ দারদা রাখি, তাকে বললেন, এমন কোনও কথা বলুন, যা আমাদের উপকার দেবে, অথচ আপনার কোনও ক্ষতি করবে না।
তিনি বললেন, একবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি বাহিনী পাঠালেন। তারপর সেই বাহিনীটি যখন ফিরে আসল, তখন বাহিনীর এক ব্যক্তি এসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেখানে বসতেন সেই জায়গায় বসল। তারপর সে তার পাশের এক ব্যক্তিকে বলল, যদি তুমি ওই সময় আমাদের দেখতে, যখন আমরা এবং শত্রুদল মুখোমুখি হই আর এ অবস্থায় অমুক ব্যক্তি এই বলে বর্শা দিয়ে আক্রমণ করল যে, নে এটা আমার পক্ষ থেকে আর জেনে রাখ, আমি হলাম গিফার বংশের তরুণ। তুমি তার এ কথাটা কেমন মনে কর? লোকটি বলল, আমার তো মনে হয় তার ছাওয়াব নষ্ট হয়ে গেছে। তার এ কথা অন্য একজন শুনতে পেল। সে বলল, আমি তো এতে কোনও দোষ দেখি না। তারা তর্কে লিপ্ত হয়ে পড়ল। এমনকি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা শুনে ফেললেন। তিনি বললেন, সুবহানাল্লাহ! তার পুরস্কারপ্রাপ্তি ও প্রশংসিত হওয়ায় কোনও সমস্যা নেই। আমি দেখলাম আবুদ দারদা রাযি. এটা শুনে খুশি হয়ে গেলেন। তিনি তার দিকে মাথা তুলে বলতে লাগলেন, তুমি এটা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছ? তিনি বললেন, হাঁ। আবুদ দারদা রাযি. তার সামনে এ কথাটির পুনরাবৃত্তি করতে থাকলেন। পরিশেষে আমি বলেই ফেলছিলাম, নিশ্চয়ই তিনি দুই হাঁটু গেড়ে বসে যাবেন।
আমার পিতা বলেন, অন্য একদিন তিনি আমাদের নিকট দিয়ে যাচ্ছিলেন। তখন আবুদ দারদা রাযি. তাকে বললেন, একটি কথা বলুন, যা আমাদের উপকার দেবে, অথচ আপনার কোনও ক্ষতি করবে না। তিনি বললেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের বলেছেন, যে ব্যক্তি ঘোড়ার উপর খরচ করে, সে ওই ব্যক্তির সমতুল্য, যে দান-সদাকায় হাত বিস্তার করে রাখে আর তা বন্ধ করে না।
অতঃপর তিনি আরেকদিন আমাদের নিকট দিয়ে যাচ্ছিলেন। তখন আবুদ দারদা রাযি. তাকে বললেন, একটি কথা বলুন, যা আমাদের উপকার দেবে, অথচ আপনার কোনও ক্ষতি করবে না। তিনি বললেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, খুরায়ম আল আসাদী বড় ভালো লোক, যদি না তার বাবরি বেশি লম্বা হত এবং নিজ লুঙ্গি না ঝুলিয়ে দিত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এ কথাটি খুরায়মের কাছে পৌছে গেল। তিনি খুব তাড়াতাড়ি একটি ছুরি নিয়ে নিজ বাবরি কান বরাবর কেটে ফেললেন এবং নিজ লুঙ্গি নলার মাঝ বরাবর তুলে ফেললেন।
অতঃপর তিনি আরেকদিন আমাদের নিকট দিয়ে যাচ্ছিলেন। তখন আবুদ দারদা রাযি. তাকে বললেন, একটি কথা বলুন, যা আমাদের উপকার দেবে, অথচ আপনার কোনও ক্ষতি করবে না। তিনি বললেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, তোমরা তোমাদের ভাইদের নিকট উপস্থিত হতে যাচ্ছ। সুতরাং তোমরা নিজেদের হাওদাগুলো ঠিক করে নাও এবং নিজেদের পোশাক পরিপাটি করে নাও, যাতে তোমরা মানুষের মধ্যে তিলকের মতো হয়ে যাও। কেননা আল্লাহ পসন্দ করেন না স্বভাবগত অশালীনতা ও কৃত্রিম অশালীনতা। -আবু দাউদ
(সুনানে আবূ দাউদ: ৪০৮৯; মুসনাদে আহমাদ: ১৭৬২২; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর: ৫৬১৬; বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান: ৬২০৪)
হাদীছ নং: ৭৯৭
কায়স ইবন বিশর তাগলিবী বলেন, আমার পিতা, যিনি আবুদ দারদা রাযি.-এর মজলিসে বসতেন, আমাকে জানিয়েছেন যে, দামেশকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একজন সাহাবী ছিলেন। তাকে ইবনুল হানযালিয়্যাহ বলা হত। তিনি একাকী থাকতে পসন্দ করতেন। মানুষের সঙ্গে ওঠাবসা খুব কমই করতেন। তার কাজ ছিল কেবল নামায পড়া। নামায শেষ হলে তার কাজ ছিল তাসবীহ ও তাকবীর পড়া, যতক্ষণ না নিজ পরিবার-পরিজনের কাছে ফিরে আসতেন। একবার তিনি আমাদের কাছ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তখন আমরা আবুদ দারদা রাযি.-এর নিকট বসা। আবুদ দারদা রাখি, তাকে বললেন, এমন কোনও কথা বলুন, যা আমাদের উপকার দেবে, অথচ আপনার কোনও ক্ষতি করবে না।
তিনি বললেন, একবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি বাহিনী পাঠালেন। তারপর সেই বাহিনীটি যখন ফিরে আসল, তখন বাহিনীর এক ব্যক্তি এসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেখানে বসতেন সেই জায়গায় বসল। তারপর সে তার পাশের এক ব্যক্তিকে বলল, যদি তুমি ওই সময় আমাদের দেখতে, যখন আমরা এবং শত্রুদল মুখোমুখি হই আর এ অবস্থায় অমুক ব্যক্তি এই বলে বর্শা দিয়ে আক্রমণ করল যে, নে এটা আমার পক্ষ থেকে আর জেনে রাখ, আমি হলাম গিফার বংশের তরুণ। তুমি তার এ কথাটা কেমন মনে কর? লোকটি বলল, আমার তো মনে হয় তার ছাওয়াব নষ্ট হয়ে গেছে। তার এ কথা অন্য একজন শুনতে পেল। সে বলল, আমি তো এতে কোনও দোষ দেখি না। তারা তর্কে লিপ্ত হয়ে পড়ল। এমনকি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা শুনে ফেললেন। তিনি বললেন, সুবহানাল্লাহ! তার পুরস্কারপ্রাপ্তি ও প্রশংসিত হওয়ায় কোনও সমস্যা নেই। আমি দেখলাম আবুদ দারদা রাযি. এটা শুনে খুশি হয়ে গেলেন। তিনি তার দিকে মাথা তুলে বলতে লাগলেন, তুমি এটা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছ? তিনি বললেন, হাঁ। আবুদ দারদা রাযি. তার সামনে এ কথাটির পুনরাবৃত্তি করতে থাকলেন। পরিশেষে আমি বলেই ফেলছিলাম, নিশ্চয়ই তিনি দুই হাঁটু গেড়ে বসে যাবেন।
আমার পিতা বলেন, অন্য একদিন তিনি আমাদের নিকট দিয়ে যাচ্ছিলেন। তখন আবুদ দারদা রাযি. তাকে বললেন, একটি কথা বলুন, যা আমাদের উপকার দেবে, অথচ আপনার কোনও ক্ষতি করবে না। তিনি বললেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের বলেছেন, যে ব্যক্তি ঘোড়ার উপর খরচ করে, সে ওই ব্যক্তির সমতুল্য, যে দান-সদাকায় হাত বিস্তার করে রাখে আর তা বন্ধ করে না।
অতঃপর তিনি আরেকদিন আমাদের নিকট দিয়ে যাচ্ছিলেন। তখন আবুদ দারদা রাযি. তাকে বললেন, একটি কথা বলুন, যা আমাদের উপকার দেবে, অথচ আপনার কোনও ক্ষতি করবে না। তিনি বললেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, খুরায়ম আল আসাদী বড় ভালো লোক, যদি না তার বাবরি বেশি লম্বা হত এবং নিজ লুঙ্গি না ঝুলিয়ে দিত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এ কথাটি খুরায়মের কাছে পৌছে গেল। তিনি খুব তাড়াতাড়ি একটি ছুরি নিয়ে নিজ বাবরি কান বরাবর কেটে ফেললেন এবং নিজ লুঙ্গি নলার মাঝ বরাবর তুলে ফেললেন।
অতঃপর তিনি আরেকদিন আমাদের নিকট দিয়ে যাচ্ছিলেন। তখন আবুদ দারদা রাযি. তাকে বললেন, একটি কথা বলুন, যা আমাদের উপকার দেবে, অথচ আপনার কোনও ক্ষতি করবে না। তিনি বললেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, তোমরা তোমাদের ভাইদের নিকট উপস্থিত হতে যাচ্ছ। সুতরাং তোমরা নিজেদের হাওদাগুলো ঠিক করে নাও এবং নিজেদের পোশাক পরিপাটি করে নাও, যাতে তোমরা মানুষের মধ্যে তিলকের মতো হয়ে যাও। কেননা আল্লাহ পসন্দ করেন না স্বভাবগত অশালীনতা ও কৃত্রিম অশালীনতা। -আবু দাউদ
(সুনানে আবূ দাউদ: ৪০৮৯; মুসনাদে আহমাদ: ১৭৬২২; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর: ৫৬১৬; বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান: ৬২০৪)
كتاب اللباس
باب صفة طول القميص والكُم والإزار وطرف العمامة وتحريم إسبال شيء من ذلك على سبيل الخيلاء وكراهته من غير خيلاء
797 - وعن قيس بن بشر التَّغْلِبيِّ، قَالَ: أخْبَرَني أَبي - وكان جَلِيسًا لأَبِي الدرداء - قَالَ: كَانَ بِدمَشْق رَجُلٌ مِنْ أصْحَابِ النَّبيِّ - صلى الله عليه وسلم - يقال لَهُ سهل بن الْحَنْظَلِيَّةِ، وَكَانَ رَجُلًا مُتَوَحِّدًا قَلَّمَا يُجَالِسُ النَّاسَ، إنَّمَا هُوَ صَلاَةٌ، فإذا فَرَغَ فَإنَّمَا هُوَ تَسْبِيحٌ وَتَكْبيرٌ حَتَّى يَأتي أهْلَهُ، فَمَرَّ بنا وَنَحْنُ عِنْدَ أَبي الدَّرداء، فَقَالَ لَهُ أَبُو الدرداءِ: كَلِمَةً تَنْفَعُنَا وَلاَ تَضُرُّكَ. قَالَ: بَعَثَ رسول الله - صلى الله عليه وسلم - سَرِيَّةً فَقَدِمَتْ، فَجَاءَ رَجُلٌ مِنْهُمْ فَجَلَسَ في المَجْلِسِ الَّذِي يَجْلِسُ فِيهِ رسُولُ الله - صلى الله عليه وسلم - فَقَالَ لِرَجُلٍ إِلَى جَنْبِهِ: لَوْ رَأيْتَنَا حِيْنَ التَقَيْنَا نَحْنُ وَالعَدُوُّ، فَحَمَلَ فُلانٌ وَطَعَنَ، فَقَالَ: خُذْهَا مِنِّي، وَأنَا الغُلاَمُ الغِفَاريُّ، كَيْفَ تَرَى في قَوْلِهِ؟ قَالَ: مَا أرَاهُ إِلاَّ قَدْ بَطَلَ أجْرُهُ. فَسَمِعَ بِذلِكَ آخَرُ، فَقَالَ: مَا أرَى بِذلِكَ بَأسًا، فَتَنَازَعَا حَتَّى سَمِعَ رسول الله - صلى الله عليه وسلم - فَقَالَ: «سُبْحَانَ الله؟ لاَ بَأسَ أَنْ يُؤجَرَ وَيُحْمَدَ» فَرَأَيْتُ أَبَا الدَّرْدَاء سُرَّ بِذلِكَ، وَجَعَلَ يَرْفَعُ رَأسَهُ إِلَيْهِ، وَيَقُولُ: أأنْتَ سَمِعْتَ ذَلِكَ مِنْ رَسُول الله - صلى الله عليه وسلم؟ فيقول: نَعَمْ، فما زال يُعِيدُ عَلَيْهِ حَتَّى إنّي لأَقُولُ لَيَبْرُكَنَّ عَلَى رُكْبَتَيْهِ، قَالَ: فَمَرَّ بِنَا يَوْمًا آخَرَ، فَقَالَ لَهُ أَبُو الدَّرْداء: كَلِمَةً تَنْفَعُنَا وَلاَ تَضُرُّكَ، قَالَ: قَالَ لنا رسول الله [ص:252] صلى الله عليه وسلم: «المُنْفِقُ عَلَى الخَيْلِ، كَالبَاسِطِ يَدَهُ بالصَّدَقَةِ لاَ يَقْبضُهَا»، ثُمَّ مَرَّ بِنَا يَومًا آخَرَ، فَقَالَ لَهُ أَبُو الدَّرْداء: كَلِمَةً تَنْفَعنَا وَلاَ تَضُرُّكَ، قَالَ: قَالَ رسول الله - صلى الله عليه وسلم: «نِعْمَ الرَّجُلُ خُرَيمٌ الأسَديُّ! لولا طُولُ جُمَّتِهِ وَإسْبَالُ إزَارِهِ!» فَبَلَغَ ذَلِكَ خُرَيْمًا فَعَجَّلَ، فَأَخَذَ شَفْرَةً فَقَطَعَ بِهَا جُمَّتَهُ إِلَى أُذُنَيْهِ، وَرَفَعَ إزارَهُ إِلَى أنْصَافِ سَاقَيْهِ. ثُمَّ مَرَّ بِنَا يَوْمًا آخَرَ فَقَالَ لَهُ أَبُو الدَّرْداء: كَلِمَةً تَنْفَعُنَا وَلاَ تَضُرُّكَ، قَالَ: سَمِعْتُ رسول الله - صلى الله عليه وسلم - يقول: «إنَّكُمْ قَادِمُونَ عَلَى إخْوانِكُمْ، فَأصْلِحُوا رِحَالكُمْ، وَأصْلِحُوا لِبَاسَكُمْ حَتَّى تَكُونُوا كَأنَّكُمْ شَامَةٌ في النَّاسِ؛ فإِنَّ الله لاَ يُحِبُّ الفُحْشَ وَلاَ التَّفَحُّش». رواه أَبُو داود بإسنادٍ حسنٍ، (1) إِلاَّ قيس بن بشر فاختلفوا في توثِيقِهِ وَتَضْعِيفِهِ (2)، وَقَدْ روى لَهُ مسلم (3).
হাদীসের ব্যাখ্যা:
নেককার লোকের সাহচর্য অবলম্বন
কায়স ইবন বিশর একজন তাবে তাবি'ঈ। তার পিতা বিশর ইবন কায়স তাগলিবী একজন প্রবীণ তাবি'ঈ ছিলেন। কায়স তার পিতা সম্পর্কে বলেন যে, তিনি বিখ্যাত সাহাবী হযরত আবুদ দারদা রাযি.-এর সাহচর্যে থাকতেন এবং তাঁর সঙ্গে ওঠাবসা করতেন। এটা বিশর ইবন কায়সের একটি বড় গুণ। এটা অনুসরণীয়। সবকালেই যারা আল্লাহওয়ালা আলেম ও বুযুর্গ ব্যক্তি, সাধারণ লোকদের উচিত তাদের সাহচর্য অবলম্বন করা তাদের সাহচর্যে থাকলে সাধারণ ব্যক্তিও বিশিষ্ট ব্যক্তিতে পরিণত হয়ে যায়। নিজে আলেম না হলেও তাদের সাহচর্যে থাকার কারণে অনেক কিছুই শেখা যায়। এক তো সরাসরি তাদের নিকট থেকে কুরআন ও হাদীছের বিভিন্ন শিক্ষা জানা যায়, বিভিন্ন মাসআলা-মাসাইল শেখা যায় এবং ইসলামী আদব-কায়দা ও জীবন গঠনমূলক নানা দিকনির্দেশনা পাওয়া যায়। তাছাড়া তাদের কাছে বিশিষ্ট যে ব্যক্তিবর্গ আসা-যাওয়া করেন তাদের সাক্ষাৎ লাভ হয় এবং তাদের কাছ থেকেও দীনের বিভিন্ন বিষয়ে জানার সুযোগ হয়। কাজেই আল্লাহওয়ালাদের সোহবত অনেক বড় নি'আমত। প্রত্যেকেরই এ নি'আমতলাভের আগ্রহ থাকা উচিত।
বিশর ইবন কায়স রহ. হযরত আবুদ দারদা রাযি.-এর সাহচর্যে থাকার সুবাদে তাঁর নিকট থেকে দীন শিক্ষার সুযোগ তো পেয়েছিলেনই, সেইসঙ্গে তাঁর কাছে যারা আসা-যাওয়া করতেন তাদের কাছ থেকেও দীনী জ্ঞান অর্জনের সুযোগ পেয়ে যেতেন। তার এক নমুনা এ বর্ণনাটির ভেতরই পাওয়া যাচ্ছে।
দামেশক ছিল ইসলামী শিক্ষার বৃহৎ কেন্দ্রসমূহের একটি। এ অঞ্চলটি ছিল মুসলিম জাহানের এক প্রান্ত। এর পরেই ছিল রোমান সাম্রাজ্য। এ অঞ্চলটিও রোমান সাম্রাজ্যের অধীন ছিল। হযরত উমর রাযি.-এর আমলে সাহাবায়ে কেরাম এ অঞ্চলটি জয় করে ইসলামী খেলাফতের অধীনে নিয়ে আসেন। প্রথমে এটি ইসলামী খেলাফতের একটি প্রদেশে পরিণত হয়। হযরত মু'আবিয়া রাযি. ছিলেন এ প্রদেশের গভর্নর। সীমান্ত এলাকা হওয়ার কারণে এখানে বহু সাহাবী বাস করতেন, যাতে সীমান্ত রক্ষার মহান কাজে অংশগ্রহণ করা যায়। খেলাফতে রাশেদার পর হযরত মু'আবিয়া রাযি. যখন মুসলিম জাহানের খলীফা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন, তখন থেকে এটি ইসলামী খেলাফতের রাজধানীতে পরিণত হয়ে যায়।
মানুষের সঙ্গে অহেতুক মেলামেশা না করে একাকী থাকা
বিখ্যাত সাহাবী হযরত আবুদ দারদা রাযি. এখানে বাস করতেন। অপর এক বিশিষ্ট সাহাবী হযরত সাহ্ল ইবনুল হানযালিয়্যাহও এখানকার বাসিন্দা ছিলেন। দামেস্কের মসজিদে উভয়ের দেখা-সাক্ষাৎ হত। হযরত আবুদ দারদা রাযি.-এর মজলিসে নিয়মিত বসার সুবাদে বিশর ইবন কায়স তাঁরও সাক্ষাৎ পেয়ে যেতেন। বিশর তাঁর পরিচয় দিতে গিয়ে বলেন-
وَكَانَ رَجُلًا مُتَوَحِّداً قَلَّمَا يُجَالِسُ النَّاسَ (তিনি একাকী থাকতে পসন্দ করতেন। মানুষের সঙ্গে ওঠাবসা খুব কমই করতেন)। আল্লাহ তা'আলা মানুষকে নানারকম স্বভাব-প্রকৃতি দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। একেকজন একেক স্বভাবের হয়ে থাকে। কেউ একা থাকতে পসন্দ করে। কারও পসন্দ মানুষের সঙ্গে মেলামেশা করা। স্বভাব যার যেমনই হোক তা বড় কথা নয়। বড় কথা হল আপন আপন স্বভাব অনুযায়ী জীবনযাপনটা শরী'আত মোতাবেক হয় কি না। তবে হাঁ, মানুষের সঙ্গে মেলামেশা করা যাদের স্বভাব, তাদের দ্বারা জনকল্যাণমূলক অনেক বড় বড় কাজ হতে পারে। কিন্তু এতে ঝুঁকিও আছে। এর জন্য অনেক সবর ও হিকমতের দরকার হয়। তা সকলের থাকে না। সে ক্ষেত্রে বেশি মেলামেশা করতে গেলে নানারকম গুনাহে জড়িয়ে পড়ারও আশঙ্কা থাকে। সে হিসেবে একাকী থাকাটা বেশি নিরাপদ, যদি সময় কাজে লাগানো হয় এবং অহংকার ও গোপনীয় পাপকর্ম থেকে আত্মরক্ষা করা হয়।
হযরত সাহ্ল ইবনুল হানযালিয়্যাহ রাযি. একাকী থাকতে পসন্দ করতেন, কিন্তু সময় অযথা নষ্ট করতেন না। বিশর তাঁর পরিচয় দিতে গিয়ে বলেন, তার কাজ ছিল কেবল নামায পড়া। নামায শেষ হলে তার কাজ ছিল তাসবীহ ও তাকবীর পড়া, যতক্ষণ না নিজ পরিবার-পরিজনের কাছে ফিরে আসতেন। অর্থাৎ মসজিদে নামায শেষ হওয়ার পর তিনি দীর্ঘ সময় বিভিন্ন রকম যিকিরে মশগুল থাকতেন। তারপর পরিবার-পরিজনের কাছে ফিরে আসতেন এবং পারিবারিক কাজকর্ম সম্পন্ন করতেন।
হযরত আবুদ দারদা রাযি.-এর নসীহত কামনা
বিশর বলেন - فَمَرَّ بِنَا وَنَحْنُ عِنْدَ أَبِي الدَّرْدَاءِ، فَقَالَ لَهُ أَبُو الدَّرْدَاءِ: كَلِمَةً تَنْفَعُنَا وَلَا تَضُرُّكَ (একবার তিনি আমাদের কাছ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তখন আমরা আবুদ দারদা রাযি.-এর নিকট বসা। আবুদ দারদা রাযি. তাকে বললেন, এমন কোনও কথা বলুন, যা আমাদের উপকার দেবে, অথচ আপনার কোনও ক্ষতি করবে না)। এ কথাটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। হযরত আবুদ দারদা রাযি. নিজে একজন বিশিষ্ট সাহাবী এবং অনেক বড় আলেম ও ফকীহ ছিলেন। তা সত্ত্বেও অপর এক সাহাবীকে পেয়ে তিনি তাঁর কাছে উপকারী কথা জানতে চাচ্ছেন। উপকারী কথা বলতে এমন কথা, যা দ্বারা জ্ঞান বাড়ে এবং আমল করার উৎসাহ পাওয়া যায়। এরূপ কথা ব্যক্তির নিজ উপদেশও হতে পারে এবং হতে পারে কুরআন মাজীদের কোনও আয়াত বা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কোনও হাদীছ। হযরত আবুদ দারদা রাযি. বলেছেন, এমন কোনও কথা বলুন, যা আমাদের উপকার দেবে এবং আপনার কোনও ক্ষতি করবে না। এ কথাটি খুবই হিকমতপূর্ণ। কেননা উপকারী কথা বলার দ্বারা অনেক সময় ব্যক্তির নিজের ক্ষতি হয়ে যায়। হতে পারে সে কথাটি ক্ষমতাসীনের পসন্দ নয়। ফলে ক্ষমতাসীন ব্যক্তি জানতে পারলে বক্তার ক্ষতি করে বসবে। অথবা এমনও হতে পারে যে, সে ব্যক্তির অনেক তাড়া আছে। উপদেশ দিতে গেলে শ্রোতার উপকার হবে বটে, কিন্তু সময়স্বল্পতার কারণে নিজের কোনও গুরুত্বপূর্ণ কাজ নষ্ট হয়ে যাবে। ক্ষতির এরকম নানা কারণই থাকতে পারে। হযরত আবুদ দারদা রাযি. যেহেতু ফকীহ ছিলেন, তাই উপদেশ চাইতে গিয়ে এ দিকটির প্রতিও লক্ষ রেখেছেন।
হযরত সাহ্ল ইবনুল হানযালিয়্যাহ রাযি. বললেন- بعث رسول الله ﷺ سرية (একবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি বাহিনী পাঠালেন)। (সারিয়্যা) বলা হয় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগে প্রেরিত এমন বাহিনীকে, যাতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে যোগদান করতেন না; বরং অন্য কোনও সাহাবী সে বাহিনীর নেতৃত্ব দিতেন। এরকম বাহিনীর সদস্য সংখ্যা হত চারশ'র নিচে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে যে বাহিনীতে যোগদান করতেন, তাকে বলা হয় غَزْوَةٌ (গাযওয়া)।
রণক্ষেত্রে শত্রুর সামনে দর্প দেখানো
যেসব বাহিনী প্রেরিত হত, তার প্রত্যেকটিরই যে শত্রুবাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষও হত এমন নয়। কোনও কোনও বাহিনী লক্ষ্যস্থলে পৌঁছার পর হয়তো শত্রুরা পালিয়ে যেত কিংবা তাদের সঙ্গে সন্ধি হত, ফলে বিনাযুদ্ধেই তারা ফিরে আসত। আবার অনেক বাহিনীর শত্রুর সঙ্গে যথারীতি যুদ্ধও হত। এ হাদীছে যে বাহিনীর কথা বলা হয়েছে, তাদের যুদ্ধ করতে হয়েছিল। সে যুদ্ধে মুজাহিদ বাহিনীর এক সদস্য এই বলে শত্রুর উপর বর্শা নিক্ষেপ করে যে- خُذْهَا مِنِّي، وَأَنَا الْغُلَامُ الْغِفَارِيُّ (নে এটা আমার পক্ষ থেকে আর জেনে রাখ, আমি হলাম গিফার বংশের তরুণ)। এই মুজাহিদের নাম কী তা জানা যায় না। তার এ কথা দ্বারা কেবল এতটুকু জানা গেল যে, তিনি গিফার গোত্রের লোক ছিলেন। বিখ্যাত সাহাবী হযরত আবূ যার গিফারী রাযি. এ গোত্রেরই লোক। এই যে তিনি বললেন আমার পক্ষ থেকে এই আঘাত তুই গ্রহণ কর আর জেনে রাখ আমি হলাম গিফার গোত্রের তরুণ, এটা বলেছিলেন শত্রুর উপর বীরত্ব প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে। যুদ্ধক্ষেত্রে এরূপ অহমিকাপূর্ণ কথা বলা বা দর্পসুলভ ভঙ্গি করা জায়েয। ইসলামী জিহাদ কেবলই আল্লাহর জন্য। তাই শত্রুর বিরুদ্ধে এ জাতীয় অহংকার প্রকাশও আল্লাহ তা'আলার জন্যই হয়ে থাকে। তাই এতে কোনও গুনাহ নেই; বরং ছাওয়াবেরই আশা আছে।
রণক্ষেত্রে আরও একাধিক সাহাবী থেকে এ জাতীয় বাক্য উচ্চারণের প্রমাণ আছে। তবে বিষয়টি তখনও পর্যন্ত সকলের কাছে পরিষ্কার না থাকায় যেই সহযোদ্ধা ওই সাহাবীর এ কথাটি শুনেছিলেন তার মনে খটকা লাগল যে, তার এ কথাটি সঙ্গত হয়েছে কি না এবং এর ফলে তার ছাওয়াব বাতিল হয়ে যাবে কি না। তাই বাহিনী ফিরে আসার পর সেই সাহাবী নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মজলিসে যখন বসলেন, তখন পাশে উপবিষ্ট অপর এক সাহাবীকে এ কথাটি জানালেন এবং তার মতামত জানতে চাইলেন। তিনি বললেন, আমার তো ধারণা এ কথার কারণে তার ছাওয়াব বাতিল হয়ে গেছে। তার এ মন্তব্য অপর এক সাহাবী শুনলেন। তিনি বললেন, আমার মতে তার এ কথায় কোনও দোষ হয়নি। এ নিয়ে তাদের মধ্যে তর্ক লেগে গেল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা শুনে ফেললেন। তিনি ফয়সালা দিলেন-
পার্থিব প্রাপ্তিতে পরকালীন ছাওয়াব নষ্ট না হওয়া
سُبحان الله؟ لَا بَأْسَ أَنْ يُؤجَرَ وَيُحْمَدَ (সুবহানাল্লাহ! তার পুরস্কারপ্রাপ্তি ও প্রশংসিত হওয়ায় কোনও সমস্যা নেই)। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সুবহানাল্লাহ বলে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন যে, কেন তার ছাওয়াব বাতিল হবে? অথবা আল্লাহ তা'আলার অপার দয়ার প্রতি লক্ষ করে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন যে, ওই ব্যক্তি আখিরাতের ছাওয়াব এবং দুনিয়ার প্রশংসা দু-ই পাচ্ছেন। জিহাদ করার কারণে আখিরাতে পুরস্কৃত হবে এবং আল্লাহর দুশমনের বিরুদ্ধে বীরত্ব ও গৌরব প্রকাশ করার কারণে দুনিয়ায় সে একজন বীরপুরুষরূপে প্রশংসিত হবে। নিয়ত সহীহ থাকলে একইসঙ্গে এ দুটির অধিকারী হওয়াতে কোনও সমস্যা বা বাধা নেই। এর দ্বারা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পরোক্ষভাবে উৎসাহ প্রদান করছেন যে, রণক্ষেত্রে শত্রুকে আতঙ্কিত করার উদ্দেশ্যে মুসলিম মুজাহিদ যদি 'আমি অমুক' বা 'আমি অমুকের পুত্র' বলে গৌরব প্রকাশ করে, তাতে দোষ নেই।
বিশর ইবন কায়স বলেন, হযরত ইবনুল হানযালিয়্যাহ রাযি.-এর এ বর্ণনা শুনে হযরত আবুদ দারদা রাযি. খুব খুশি হন। কেননা এতে জানানো হয়েছে, দুনিয়াবী উপকার লাভ পরকালীন ছাওয়াব পাওয়ার পক্ষে বাধা নয় এবং ইহলৌকিক কোনও প্রাপ্তি মুমিনের সৎকর্মের প্রতিদান নষ্ট করে না। তিনি তো এতক্ষণ মাথা নিচু করে বসা ছিলেন। কিন্তু এ কথা শোনার পর খুশিতে মাথা উঁচু করতে থাকলেন আর বার বার জিজ্ঞেস করতে লাগলেন যে, আপনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এ কথা বলতে শুনেছেন? ইবনুল হানযালিয়্যাহ রাযি.-ও প্রতিবার উত্তর দিলেন যে, হাঁ। অর্থাৎ আমি স্বয়ং তাঁর মুখে এ কথা শুনেছি।
বিশর ইবন কায়স বলেন- حَتَّى إِنِّي لأَقُولُ : لَيَبْرُكَنَّ عَلَى رُكْبَتَيْهِ (পরিশেষে আমি বলেই ফেলছিলাম, নিশ্চয়ই তিনি দুই হাঁটু গেড়ে বসে যাবেন)। অর্থাৎ ইবনুল ও এমন উপকারী হাদীছ জানতে তিনি এতটা কৃতজ্ঞ ও বিনয়ী হয়ে উঠলেন যে, আমার মনে হচ্ছিল ছাত্র যেমন শিক্ষকের সামনে হাঁটু গেড়ে বিনয়ী ভঙ্গিতে বসে পড়ে, হযরত আবুদ দারদা রাযি.-ও বুঝি তার সামনে সেইরকম হাঁটু গেড়ে বসে পড়বেন। এর দ্বারা শিক্ষকের সামনে ছাত্র কীভাবে বসবে ও কেমন বিনয়ভাব অবলম্বন করবে তার শিক্ষা পাওয়া যায়।
পরে আরেকদিন হযরত ইবনুল হানযালিয়্যাহ রাযি. হযরত আবুদ দারদা রাযি.-এর মজলিসে উপস্থিত হলে হযরত আবুদ দারদা রাযি. আগের মতো একই অনুরোধ তাঁকে করলেন। বললেন, একটি কথা বলুন, যা আমাদের উপকার দেবে, অথচ আপনার কোনও ক্ষতি করবে না।
জিহাদের আসবাব-উপকরণে অর্থব্যয়ের ফযীলত
ইবনুল হানযালিয়্যাহ রাযি. অনুরোধ রক্ষা করলেন। তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীছ শোনালেন যে, তিনি ইরশাদ করেছেন- الْمُنْفِقُ عَلَى الْخَيْلِ، كَالْبَاسِطِ بَدَهُ بِالصَّدَقَةِ لَا يَقْبِضُهَا (যে ব্যক্তি ঘোড়ার উপর খরচ করে, সে ওই ব্যক্তির সমতুল্য, যে দান-সদাকায় হাত বিস্তার করে রাখে আর তা বন্ধ করে না)। অর্থাৎ যে ঘোড়া আল্লাহর পথে জিহাদ করার জন্য কিংবা কোনও মুজাহিদের সহযোগিতা করার জন্য প্রস্তুত রাখা হয়, সে ঘোড়ার দানা-পানির জন্য অর্থব্যয় করা অনেক বড় ছাওয়াবের কাজ। যে ব্যক্তি তা করে, সে ওই ব্যক্তির সমতুল্য ছাওয়াবের অধিকারী হয়, যে সর্বদা দান-খয়রাত করার জন্য তার হাত খুলে রাখে এবং কখনও তা বন্ধ করে না অর্থাৎ অবিরাম দান-খয়রাত করে যায়। বলাবাহুল্য, এটা অনেক কঠিন কাজ। অবিরাম দান- খয়রাত করতে থাকা কতজনের পক্ষে সম্ভব হয়? সে তুলনায় ঘোড়ার পেছনে খরচ করতে থাকা অনেক সহজ। কাজ সহজ হওয়া সত্ত্বেও এর ছাওয়াব অনেক কঠিন কাজের সমতুল্য। এটা আল্লাহ তা'আলার মেহেরবানি যে, সহজ সহজ কাজেও তিনি বান্দাকে বিপুল ছাওয়াব দিয়ে থাকেন। এর দ্বারা জিহাদের গুরুত্বও বুঝে আসে। জিহাদের জন্য প্রস্তুত ঘোড়ার পেছনে খরচ করাতে যখন এত ছাওয়াব, তখন স্বয়ং জিহাদে অংশগ্রহণ করলে কত বেশি ছাওয়াব হতে পারে?
খুরায়ম বড় ভালো লোক, যদি না...
তারপর তৃতীয় একদিন হযরত ইবনুল হানযালিয়্যাহ রাযি, হযরত আবুদ দারদা রাযি.-এর মজলিসে উপস্থিত হলে এবারও তিনি একই অনুরোধ করলেন। এবার তিনি হাদীছ শোনালেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন- ! نِعْمَ الرَّجُلُ خُرَيْمٌ الأَسَدِيُّ لَوْلاَ طُولُ جُمَّتِهِ وَإِسْبَالُ إِزَارِهِ (খুরায়ম আল আসাদী বড় ভালো লোক, যদি না তার বাবরি বেশি লম্বা হত এবং নিজ লুঙ্গি না ঝুলিয়ে দিত)। হযরত খুরায়ম রাযি. আসাদ গোত্রীয় একজন সাহাবী এবং বদর যুদ্ধের একজন যোদ্ধা। তিনি তাঁর বাবরি চুল অনেক লম্বা করতেন। ফলে পিঠের উপর ঝুলে পড়ত। তাঁর আরেকটি অভ্যাস ছিল লুঙ্গি টাখনুর নিচে ঝুলিয়ে পরা। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর এ ত্রুটি সংশোধনের জন্য উৎসাহদানের পন্থা অবলম্বন করেন। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শিক্ষাদানের এটি ছিল একটি মৌলিক পন্থা। তিনি তিরস্কার করার উপর উৎসাহ দেওয়াকে প্রাধান্য দিতেন। হাঁ, যে ক্ষেত্রে তিরস্কারের প্রয়োজন হত সে ক্ষেত্রে তিরস্কারও করতেন। তবে উৎসাহদানই ছিল তাঁর অগ্রগণ্য ব্যবস্থা। সেমতে তিনি হযরত খুরায়ম রাযি.-এর প্রশংসা করলেন যে, খুরায়ম বড় ভালো লোক, যদি না তার এ দু'টি ত্রুটি থাকত। কোনও কোনও বর্ণনায় আছে, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সরাসরিই তাঁকে এ কথা বলেছিলেন। অর্থাৎ এমনিতে খুরায়ম একজন ভালো মানুষ। আর যেহেতু সে একজন ভালো মানুষ, তাই তার মধ্যে এ ত্রুটিদু'টি থাকা উচিত নয়। প্রশংসা করার দ্বারা মানুষ উপদেশ গ্রহণে উৎসাহ পায়। হযরত খুরায়ম রাযি.-এর ক্ষেত্রেও তাই হল। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কথা মানতে তাঁর এক মুহূর্তও দেরি হয়নি। তিনি তাঁর চুল কেটে কান বরাবর করে ফেলেন এবং লুঙ্গি নলার মাঝখান পর্যন্ত পরতে শুরু করেন।
ইসলামের সৌন্দর্য ও শালীনতার গুরুত্ব
বিশর ইবন কায়স বলেন, চতুর্থ একদিন হযরত ইবনুল হানযালিয়্যাহ রাযি. হযরত আবুদ দারদা রাযি.-এর মজলিসে আসলেন। এবারও তাঁকে একই রকমের অনুরোধ করা হল। এবারও তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একটি হাদীছ শুনিয়ে দিলেন। তিনি বললেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি-
إِنَّكُمْ قَادِمُونَ عَلَى إِخْوَانِكُمْ، فَأَصْلِحُوا لِبَاسَكُمْ وَأَصْلِحُوا رِحَالَكُمْ حَتَّى تَكُونُوا كَأَنَّكُمْ شَامَةٌ فِي النَّاسِ، إِنَّ اللَّهَ لَا يُحِبُّ الْفُحْشَ وَالتَّفَحُّشَ
‘তোমরা তোমাদের ভাইদের নিকট উপস্থিত হতে যাচ্ছ। সুতরাং তোমরা নিজেদের হাওদাগুলো ঠিক করে নাও এবং নিজেদের পোশাক পরিপাটি করে নাও, যাতে তোমরা মানুষের মধ্যে তিলকের মতো হয়ে যাও। কেননা আল্লাহ পসন্দ করেন না স্বভাবগত অশালীনতা ও কৃত্রিম অশালীনতা'। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ কথা বলেছিলেন কোনও এক যুদ্ধ থেকে ফেরার সময়। বললেন, অল্পক্ষণের মধ্যেই তোমরা মদীনায় পৌছে যাবে। সেখানে তোমাদের মুমিন ভাইদের সঙ্গে তোমরা মিলিত হবে। তাই তোমরা পরিপাটি হয়ে নাও। তোমরা যে হাওদায় চলে এসেছ তা গুছিয়ে নাও এবং তোমাদের পোশাক অর্থাৎ লুঙ্গি, চাদর, পাগড়ি ইত্যাদি ঠিকঠাক করে নাও। পরিপাটি হওয়ার হুকুম দেওয়ার কারণ পারস্পরিক সাক্ষাৎ মলিন ও আলুথালু বেশে হলে তা যেমন চোখে অসুন্দর লাগে, তেমনি অন্তরেও বিরক্তি ও ঘৃণা সৃষ্টি করে। অপরদিকে পরিপাটি হয়ে সাক্ষাৎ করলে যেমন দেখতে ভালো লাগে, তেমনি মনেও ভক্তি-ভালোবাসা জন্মায়। মুমিনদের পারস্পরিক সদ্ভাব ও ভালোবাসা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তা যাতে কোনওভাবেই ক্ষুন্ন না হয়, সে বিষয়ে সচেতন থাকা খুব জরুরি। ইসলামের যাবতীয় আচার-অনুষ্ঠানের ভেতর এ বিষয়টি লক্ষ করা যায়। মিসওয়াক করা, পোশাক-আশাক পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা, মসজিদ ও ঘরদোর পরিষ্কার রাখা, পথঘাটে আবর্জনা না ফেলা, সম্মিলিত ব্যবহারের বস্তু মলিন না করা এবং এ জাতীয় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বিষয়ক আরও যত ক্ষেত্র আছে, সবগুলোতে বহুবিধ ফায়দার পাশাপাশি পারস্পরিক সদ্ভাব ও ভালোবাসা রক্ষার বিষয়টিও লক্ষ্যবস্তু বৈ কি। যাহোক নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ হাদীছে পারিপাট্যের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করতে গিয়ে ইরশাদ করেছেন-
حَتَّى تَكُونُوا كَأَنَّكُمْ شَامَةٌ فِي النَّاسِ 'যাতে তোমরা মানুষের মধ্যে তিলকের মতো হয়ে যাও'। ইবনুল আছীর রহ. বলেন, شَامَةٌ এর অর্থ তিলক, যা মানুষের চেহারায় বা শরীরের অন্য কোথাও থাকে। কারও চেহারায় তিল থাকলে তার দিক তাকানো মাত্র সে তিল চোখে ভেসে ওঠে। তাতে চেহারার সৌন্দর্যও বেড়ে যায়। সুতরাং হাদীছটির অর্থ হল- তোমরা ভালো পোশাক-আশাকে সুন্দর ও পরিপাটি হয়ে থাকবে, যাতে চেহারায় তিল যেমন পরিস্ফুট থাকে, তেমনি মানুষের মধ্যে তোমরা পরিস্ফুট হয়ে থাক এবং তোমাদের দ্বারা মানবসমাজের শোভা বৃদ্ধি পায়।
বস্তুত একজন মুমিনের সবকিছুই হবে আল্লাহর জন্য। আল্লাহ তা'আলা যা পসন্দ করেন, সে কেবল তাই করবে। আর আল্লাহ তা'আলা যা অপসন্দ করেন, সে তা থেকে দূরে থাকবে। সুন্দর ও পরিপাটি হয়ে থাকার নির্দেশ মূলত সে কারণেই। সুতরাং নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-
فإنَّ الله لا يُحِبُّ الفُحْشَ وَلَا التَّفَخُسُ (কেননা আল্লাহ পসন্দ করেন না স্বভাবগত অশালীনতা ও কৃত্রিম অশালীনতা)। অর্থাৎ স্বভাবগতভাবে অশালীন হওয়ার কারণে যার লেবাস-পোশাক, কাজকর্ম ও কথাবার্তায় অশালীনতা প্রকাশ পায় তাকেও আল্লাহ তা'আলা পসন্দ করেন না এবং যে ব্যক্তির স্বভাবে অশালীনতা নেই বটে, কিন্তু কৃত্রিমভাবে সে অশালীন পোশাক পরে বা অশালীন কাজকর্ম করে কিংবা অশালীন কথাবার্তা বলে, তাকেও আল্লাহ তা'আলা পসন্দ করেন না। তাই প্রত্যেক মুমিনের উচিত সকল ক্ষেত্রে শালীন হয়ে থাকা। পোশাকের ক্ষেত্রেও সে লক্ষ রাখবে যাতে তার পোশাকের গঠন ও কাটিং শালীন হয় এবং তা পরিধানও করা হয় ভদ্রোচিতভাবে। অন্যের সামনে আসার সময় সে রুচিসম্মত পোশাক পরে আসবে। অন্যের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবে শালীনভাবে।
লক্ষণীয়, হযরত আবুদ দারদা রাযি. একজন শীর্ষস্থানীয় সাহাবী হওয়া সত্ত্বেও তাঁর তুলনায় কম পরিচিত এক সাহাবীর কাছে নসীহত প্রার্থনা করছেন। এক-দু'বার নয়। যখনই সাক্ষাৎ হচ্ছে, তখনই তাঁর কাছে নসীহত চাচ্ছেন। এর দ্বারা ধারণা পাওয়া যায় সাহাবায়ে কেরামের কাছে নসীহত কত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল এবং তাঁরা অন্যের কাছে নসীহত শোনার কী গভীর আগ্রহ পোষণ করতেন।
আরও লক্ষণীয়, হযরত আবুদ দারদা রাযি. যতবারই নসীহত চেয়েছেন, প্রত্যেকবারই হযরত ইবনুল হানযালিয়্যাহ রাযি. নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীছ শুনিয়ে দিয়েছেন। এর দ্বারা শিক্ষা পাওয়া যায় নসীহত করার বেলায় মনগড়া কথা না বলে কিংবা বানোয়াট কিচ্ছা-কাহিনী না শুনিয়ে কুরআন ও হাদীছকেই মূল অবলম্বনরূপে গ্রহণ করা উচিত।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. হক্কানী উলামা ও বুযুর্গানে দীনের সাহচর্য জীবনগঠনের পক্ষে খুব বেশি সহায়ক। তাই তাদের সাহচর্য অবলম্বনের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে।
খ. মানুষের সঙ্গে অহেতুক মেলামেশা না করে একাকী থাকা ঈমান-আমলের পক্ষে বেশি নিরাপদ।
গ. নামাযের বাইরের সময়টায়ও যতবেশি সম্ভব আল্লাহ তা'আলার যিকির করা উচিত।
ঘ. কোনও বুযুর্গ ব্যক্তির সাক্ষাৎ পেলে তার কাছে নসীহতের আবেদন করা চাই।
ঙ. নসীহত চাওয়ার বেলায় সময় ও পরিবেশ ইত্যাদির প্রতি লক্ষ রাখা বাঞ্ছনীয়, যাতে নসীহত করতে গিয়ে নসীহতকারী ব্যক্তি নিজে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়।
চ. রণক্ষেত্রে শত্রুর বিরুদ্ধে দর্প দেখানোর দ্বারা জিহাদের ছাওয়াব নষ্ট হয় না।
ছ. কোনও নেক আমলের কারণে দুনিয়াবী কোনও ফায়দা হাসিল হয়ে গেলে তাতে পরকালীন ছাওয়াব বাতিল হয়ে যায় না।
জ. কারও কোনও কাজের কারণে মনে খটকা দেখা দিলে কোনও বিজ্ঞ ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে সে খটকা দূর করে নেওয়া চাই।
ঝ. শিক্ষার্থীর কর্তব্য শিক্ষকের সামনে বিনয়ী হয়ে থাকা।
ঞ. জিহাদের আসবাব-উপকরণের পেছনে অর্থব্যয় করা অনেক বড় ছাওয়াবের কাজ।
ট. পুরুষের চুল এত বেশি লম্বা করা উচিত নয়, যা দেখতে নারীর চুলের মতো মনে হবে।
ঠ. পোশাক টাখনুর নিচে ঝুলিয়ে পরা জায়েয নয়।
ড. সদুপদেশের উপর আমল করতে অহেতুক বিলম্ব করতে নেই।
ঢ. অন্যের সঙ্গে সাক্ষাৎকালে ভালো পোশাক পরা ও পরিপাটি হয়ে আসা চাই।
ণ. ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় কোনওভাবেই অশালীন কথা বলা বা অশালীন কাজ করা উচিত নয়।
কায়স ইবন বিশর একজন তাবে তাবি'ঈ। তার পিতা বিশর ইবন কায়স তাগলিবী একজন প্রবীণ তাবি'ঈ ছিলেন। কায়স তার পিতা সম্পর্কে বলেন যে, তিনি বিখ্যাত সাহাবী হযরত আবুদ দারদা রাযি.-এর সাহচর্যে থাকতেন এবং তাঁর সঙ্গে ওঠাবসা করতেন। এটা বিশর ইবন কায়সের একটি বড় গুণ। এটা অনুসরণীয়। সবকালেই যারা আল্লাহওয়ালা আলেম ও বুযুর্গ ব্যক্তি, সাধারণ লোকদের উচিত তাদের সাহচর্য অবলম্বন করা তাদের সাহচর্যে থাকলে সাধারণ ব্যক্তিও বিশিষ্ট ব্যক্তিতে পরিণত হয়ে যায়। নিজে আলেম না হলেও তাদের সাহচর্যে থাকার কারণে অনেক কিছুই শেখা যায়। এক তো সরাসরি তাদের নিকট থেকে কুরআন ও হাদীছের বিভিন্ন শিক্ষা জানা যায়, বিভিন্ন মাসআলা-মাসাইল শেখা যায় এবং ইসলামী আদব-কায়দা ও জীবন গঠনমূলক নানা দিকনির্দেশনা পাওয়া যায়। তাছাড়া তাদের কাছে বিশিষ্ট যে ব্যক্তিবর্গ আসা-যাওয়া করেন তাদের সাক্ষাৎ লাভ হয় এবং তাদের কাছ থেকেও দীনের বিভিন্ন বিষয়ে জানার সুযোগ হয়। কাজেই আল্লাহওয়ালাদের সোহবত অনেক বড় নি'আমত। প্রত্যেকেরই এ নি'আমতলাভের আগ্রহ থাকা উচিত।
বিশর ইবন কায়স রহ. হযরত আবুদ দারদা রাযি.-এর সাহচর্যে থাকার সুবাদে তাঁর নিকট থেকে দীন শিক্ষার সুযোগ তো পেয়েছিলেনই, সেইসঙ্গে তাঁর কাছে যারা আসা-যাওয়া করতেন তাদের কাছ থেকেও দীনী জ্ঞান অর্জনের সুযোগ পেয়ে যেতেন। তার এক নমুনা এ বর্ণনাটির ভেতরই পাওয়া যাচ্ছে।
দামেশক ছিল ইসলামী শিক্ষার বৃহৎ কেন্দ্রসমূহের একটি। এ অঞ্চলটি ছিল মুসলিম জাহানের এক প্রান্ত। এর পরেই ছিল রোমান সাম্রাজ্য। এ অঞ্চলটিও রোমান সাম্রাজ্যের অধীন ছিল। হযরত উমর রাযি.-এর আমলে সাহাবায়ে কেরাম এ অঞ্চলটি জয় করে ইসলামী খেলাফতের অধীনে নিয়ে আসেন। প্রথমে এটি ইসলামী খেলাফতের একটি প্রদেশে পরিণত হয়। হযরত মু'আবিয়া রাযি. ছিলেন এ প্রদেশের গভর্নর। সীমান্ত এলাকা হওয়ার কারণে এখানে বহু সাহাবী বাস করতেন, যাতে সীমান্ত রক্ষার মহান কাজে অংশগ্রহণ করা যায়। খেলাফতে রাশেদার পর হযরত মু'আবিয়া রাযি. যখন মুসলিম জাহানের খলীফা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন, তখন থেকে এটি ইসলামী খেলাফতের রাজধানীতে পরিণত হয়ে যায়।
মানুষের সঙ্গে অহেতুক মেলামেশা না করে একাকী থাকা
বিখ্যাত সাহাবী হযরত আবুদ দারদা রাযি. এখানে বাস করতেন। অপর এক বিশিষ্ট সাহাবী হযরত সাহ্ল ইবনুল হানযালিয়্যাহও এখানকার বাসিন্দা ছিলেন। দামেস্কের মসজিদে উভয়ের দেখা-সাক্ষাৎ হত। হযরত আবুদ দারদা রাযি.-এর মজলিসে নিয়মিত বসার সুবাদে বিশর ইবন কায়স তাঁরও সাক্ষাৎ পেয়ে যেতেন। বিশর তাঁর পরিচয় দিতে গিয়ে বলেন-
وَكَانَ رَجُلًا مُتَوَحِّداً قَلَّمَا يُجَالِسُ النَّاسَ (তিনি একাকী থাকতে পসন্দ করতেন। মানুষের সঙ্গে ওঠাবসা খুব কমই করতেন)। আল্লাহ তা'আলা মানুষকে নানারকম স্বভাব-প্রকৃতি দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। একেকজন একেক স্বভাবের হয়ে থাকে। কেউ একা থাকতে পসন্দ করে। কারও পসন্দ মানুষের সঙ্গে মেলামেশা করা। স্বভাব যার যেমনই হোক তা বড় কথা নয়। বড় কথা হল আপন আপন স্বভাব অনুযায়ী জীবনযাপনটা শরী'আত মোতাবেক হয় কি না। তবে হাঁ, মানুষের সঙ্গে মেলামেশা করা যাদের স্বভাব, তাদের দ্বারা জনকল্যাণমূলক অনেক বড় বড় কাজ হতে পারে। কিন্তু এতে ঝুঁকিও আছে। এর জন্য অনেক সবর ও হিকমতের দরকার হয়। তা সকলের থাকে না। সে ক্ষেত্রে বেশি মেলামেশা করতে গেলে নানারকম গুনাহে জড়িয়ে পড়ারও আশঙ্কা থাকে। সে হিসেবে একাকী থাকাটা বেশি নিরাপদ, যদি সময় কাজে লাগানো হয় এবং অহংকার ও গোপনীয় পাপকর্ম থেকে আত্মরক্ষা করা হয়।
হযরত সাহ্ল ইবনুল হানযালিয়্যাহ রাযি. একাকী থাকতে পসন্দ করতেন, কিন্তু সময় অযথা নষ্ট করতেন না। বিশর তাঁর পরিচয় দিতে গিয়ে বলেন, তার কাজ ছিল কেবল নামায পড়া। নামায শেষ হলে তার কাজ ছিল তাসবীহ ও তাকবীর পড়া, যতক্ষণ না নিজ পরিবার-পরিজনের কাছে ফিরে আসতেন। অর্থাৎ মসজিদে নামায শেষ হওয়ার পর তিনি দীর্ঘ সময় বিভিন্ন রকম যিকিরে মশগুল থাকতেন। তারপর পরিবার-পরিজনের কাছে ফিরে আসতেন এবং পারিবারিক কাজকর্ম সম্পন্ন করতেন।
হযরত আবুদ দারদা রাযি.-এর নসীহত কামনা
বিশর বলেন - فَمَرَّ بِنَا وَنَحْنُ عِنْدَ أَبِي الدَّرْدَاءِ، فَقَالَ لَهُ أَبُو الدَّرْدَاءِ: كَلِمَةً تَنْفَعُنَا وَلَا تَضُرُّكَ (একবার তিনি আমাদের কাছ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তখন আমরা আবুদ দারদা রাযি.-এর নিকট বসা। আবুদ দারদা রাযি. তাকে বললেন, এমন কোনও কথা বলুন, যা আমাদের উপকার দেবে, অথচ আপনার কোনও ক্ষতি করবে না)। এ কথাটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। হযরত আবুদ দারদা রাযি. নিজে একজন বিশিষ্ট সাহাবী এবং অনেক বড় আলেম ও ফকীহ ছিলেন। তা সত্ত্বেও অপর এক সাহাবীকে পেয়ে তিনি তাঁর কাছে উপকারী কথা জানতে চাচ্ছেন। উপকারী কথা বলতে এমন কথা, যা দ্বারা জ্ঞান বাড়ে এবং আমল করার উৎসাহ পাওয়া যায়। এরূপ কথা ব্যক্তির নিজ উপদেশও হতে পারে এবং হতে পারে কুরআন মাজীদের কোনও আয়াত বা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কোনও হাদীছ। হযরত আবুদ দারদা রাযি. বলেছেন, এমন কোনও কথা বলুন, যা আমাদের উপকার দেবে এবং আপনার কোনও ক্ষতি করবে না। এ কথাটি খুবই হিকমতপূর্ণ। কেননা উপকারী কথা বলার দ্বারা অনেক সময় ব্যক্তির নিজের ক্ষতি হয়ে যায়। হতে পারে সে কথাটি ক্ষমতাসীনের পসন্দ নয়। ফলে ক্ষমতাসীন ব্যক্তি জানতে পারলে বক্তার ক্ষতি করে বসবে। অথবা এমনও হতে পারে যে, সে ব্যক্তির অনেক তাড়া আছে। উপদেশ দিতে গেলে শ্রোতার উপকার হবে বটে, কিন্তু সময়স্বল্পতার কারণে নিজের কোনও গুরুত্বপূর্ণ কাজ নষ্ট হয়ে যাবে। ক্ষতির এরকম নানা কারণই থাকতে পারে। হযরত আবুদ দারদা রাযি. যেহেতু ফকীহ ছিলেন, তাই উপদেশ চাইতে গিয়ে এ দিকটির প্রতিও লক্ষ রেখেছেন।
হযরত সাহ্ল ইবনুল হানযালিয়্যাহ রাযি. বললেন- بعث رسول الله ﷺ سرية (একবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি বাহিনী পাঠালেন)। (সারিয়্যা) বলা হয় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগে প্রেরিত এমন বাহিনীকে, যাতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে যোগদান করতেন না; বরং অন্য কোনও সাহাবী সে বাহিনীর নেতৃত্ব দিতেন। এরকম বাহিনীর সদস্য সংখ্যা হত চারশ'র নিচে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে যে বাহিনীতে যোগদান করতেন, তাকে বলা হয় غَزْوَةٌ (গাযওয়া)।
রণক্ষেত্রে শত্রুর সামনে দর্প দেখানো
যেসব বাহিনী প্রেরিত হত, তার প্রত্যেকটিরই যে শত্রুবাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষও হত এমন নয়। কোনও কোনও বাহিনী লক্ষ্যস্থলে পৌঁছার পর হয়তো শত্রুরা পালিয়ে যেত কিংবা তাদের সঙ্গে সন্ধি হত, ফলে বিনাযুদ্ধেই তারা ফিরে আসত। আবার অনেক বাহিনীর শত্রুর সঙ্গে যথারীতি যুদ্ধও হত। এ হাদীছে যে বাহিনীর কথা বলা হয়েছে, তাদের যুদ্ধ করতে হয়েছিল। সে যুদ্ধে মুজাহিদ বাহিনীর এক সদস্য এই বলে শত্রুর উপর বর্শা নিক্ষেপ করে যে- خُذْهَا مِنِّي، وَأَنَا الْغُلَامُ الْغِفَارِيُّ (নে এটা আমার পক্ষ থেকে আর জেনে রাখ, আমি হলাম গিফার বংশের তরুণ)। এই মুজাহিদের নাম কী তা জানা যায় না। তার এ কথা দ্বারা কেবল এতটুকু জানা গেল যে, তিনি গিফার গোত্রের লোক ছিলেন। বিখ্যাত সাহাবী হযরত আবূ যার গিফারী রাযি. এ গোত্রেরই লোক। এই যে তিনি বললেন আমার পক্ষ থেকে এই আঘাত তুই গ্রহণ কর আর জেনে রাখ আমি হলাম গিফার গোত্রের তরুণ, এটা বলেছিলেন শত্রুর উপর বীরত্ব প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে। যুদ্ধক্ষেত্রে এরূপ অহমিকাপূর্ণ কথা বলা বা দর্পসুলভ ভঙ্গি করা জায়েয। ইসলামী জিহাদ কেবলই আল্লাহর জন্য। তাই শত্রুর বিরুদ্ধে এ জাতীয় অহংকার প্রকাশও আল্লাহ তা'আলার জন্যই হয়ে থাকে। তাই এতে কোনও গুনাহ নেই; বরং ছাওয়াবেরই আশা আছে।
রণক্ষেত্রে আরও একাধিক সাহাবী থেকে এ জাতীয় বাক্য উচ্চারণের প্রমাণ আছে। তবে বিষয়টি তখনও পর্যন্ত সকলের কাছে পরিষ্কার না থাকায় যেই সহযোদ্ধা ওই সাহাবীর এ কথাটি শুনেছিলেন তার মনে খটকা লাগল যে, তার এ কথাটি সঙ্গত হয়েছে কি না এবং এর ফলে তার ছাওয়াব বাতিল হয়ে যাবে কি না। তাই বাহিনী ফিরে আসার পর সেই সাহাবী নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মজলিসে যখন বসলেন, তখন পাশে উপবিষ্ট অপর এক সাহাবীকে এ কথাটি জানালেন এবং তার মতামত জানতে চাইলেন। তিনি বললেন, আমার তো ধারণা এ কথার কারণে তার ছাওয়াব বাতিল হয়ে গেছে। তার এ মন্তব্য অপর এক সাহাবী শুনলেন। তিনি বললেন, আমার মতে তার এ কথায় কোনও দোষ হয়নি। এ নিয়ে তাদের মধ্যে তর্ক লেগে গেল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা শুনে ফেললেন। তিনি ফয়সালা দিলেন-
পার্থিব প্রাপ্তিতে পরকালীন ছাওয়াব নষ্ট না হওয়া
سُبحان الله؟ لَا بَأْسَ أَنْ يُؤجَرَ وَيُحْمَدَ (সুবহানাল্লাহ! তার পুরস্কারপ্রাপ্তি ও প্রশংসিত হওয়ায় কোনও সমস্যা নেই)। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সুবহানাল্লাহ বলে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন যে, কেন তার ছাওয়াব বাতিল হবে? অথবা আল্লাহ তা'আলার অপার দয়ার প্রতি লক্ষ করে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন যে, ওই ব্যক্তি আখিরাতের ছাওয়াব এবং দুনিয়ার প্রশংসা দু-ই পাচ্ছেন। জিহাদ করার কারণে আখিরাতে পুরস্কৃত হবে এবং আল্লাহর দুশমনের বিরুদ্ধে বীরত্ব ও গৌরব প্রকাশ করার কারণে দুনিয়ায় সে একজন বীরপুরুষরূপে প্রশংসিত হবে। নিয়ত সহীহ থাকলে একইসঙ্গে এ দুটির অধিকারী হওয়াতে কোনও সমস্যা বা বাধা নেই। এর দ্বারা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পরোক্ষভাবে উৎসাহ প্রদান করছেন যে, রণক্ষেত্রে শত্রুকে আতঙ্কিত করার উদ্দেশ্যে মুসলিম মুজাহিদ যদি 'আমি অমুক' বা 'আমি অমুকের পুত্র' বলে গৌরব প্রকাশ করে, তাতে দোষ নেই।
বিশর ইবন কায়স বলেন, হযরত ইবনুল হানযালিয়্যাহ রাযি.-এর এ বর্ণনা শুনে হযরত আবুদ দারদা রাযি. খুব খুশি হন। কেননা এতে জানানো হয়েছে, দুনিয়াবী উপকার লাভ পরকালীন ছাওয়াব পাওয়ার পক্ষে বাধা নয় এবং ইহলৌকিক কোনও প্রাপ্তি মুমিনের সৎকর্মের প্রতিদান নষ্ট করে না। তিনি তো এতক্ষণ মাথা নিচু করে বসা ছিলেন। কিন্তু এ কথা শোনার পর খুশিতে মাথা উঁচু করতে থাকলেন আর বার বার জিজ্ঞেস করতে লাগলেন যে, আপনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এ কথা বলতে শুনেছেন? ইবনুল হানযালিয়্যাহ রাযি.-ও প্রতিবার উত্তর দিলেন যে, হাঁ। অর্থাৎ আমি স্বয়ং তাঁর মুখে এ কথা শুনেছি।
বিশর ইবন কায়স বলেন- حَتَّى إِنِّي لأَقُولُ : لَيَبْرُكَنَّ عَلَى رُكْبَتَيْهِ (পরিশেষে আমি বলেই ফেলছিলাম, নিশ্চয়ই তিনি দুই হাঁটু গেড়ে বসে যাবেন)। অর্থাৎ ইবনুল ও এমন উপকারী হাদীছ জানতে তিনি এতটা কৃতজ্ঞ ও বিনয়ী হয়ে উঠলেন যে, আমার মনে হচ্ছিল ছাত্র যেমন শিক্ষকের সামনে হাঁটু গেড়ে বিনয়ী ভঙ্গিতে বসে পড়ে, হযরত আবুদ দারদা রাযি.-ও বুঝি তার সামনে সেইরকম হাঁটু গেড়ে বসে পড়বেন। এর দ্বারা শিক্ষকের সামনে ছাত্র কীভাবে বসবে ও কেমন বিনয়ভাব অবলম্বন করবে তার শিক্ষা পাওয়া যায়।
পরে আরেকদিন হযরত ইবনুল হানযালিয়্যাহ রাযি. হযরত আবুদ দারদা রাযি.-এর মজলিসে উপস্থিত হলে হযরত আবুদ দারদা রাযি. আগের মতো একই অনুরোধ তাঁকে করলেন। বললেন, একটি কথা বলুন, যা আমাদের উপকার দেবে, অথচ আপনার কোনও ক্ষতি করবে না।
জিহাদের আসবাব-উপকরণে অর্থব্যয়ের ফযীলত
ইবনুল হানযালিয়্যাহ রাযি. অনুরোধ রক্ষা করলেন। তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীছ শোনালেন যে, তিনি ইরশাদ করেছেন- الْمُنْفِقُ عَلَى الْخَيْلِ، كَالْبَاسِطِ بَدَهُ بِالصَّدَقَةِ لَا يَقْبِضُهَا (যে ব্যক্তি ঘোড়ার উপর খরচ করে, সে ওই ব্যক্তির সমতুল্য, যে দান-সদাকায় হাত বিস্তার করে রাখে আর তা বন্ধ করে না)। অর্থাৎ যে ঘোড়া আল্লাহর পথে জিহাদ করার জন্য কিংবা কোনও মুজাহিদের সহযোগিতা করার জন্য প্রস্তুত রাখা হয়, সে ঘোড়ার দানা-পানির জন্য অর্থব্যয় করা অনেক বড় ছাওয়াবের কাজ। যে ব্যক্তি তা করে, সে ওই ব্যক্তির সমতুল্য ছাওয়াবের অধিকারী হয়, যে সর্বদা দান-খয়রাত করার জন্য তার হাত খুলে রাখে এবং কখনও তা বন্ধ করে না অর্থাৎ অবিরাম দান-খয়রাত করে যায়। বলাবাহুল্য, এটা অনেক কঠিন কাজ। অবিরাম দান- খয়রাত করতে থাকা কতজনের পক্ষে সম্ভব হয়? সে তুলনায় ঘোড়ার পেছনে খরচ করতে থাকা অনেক সহজ। কাজ সহজ হওয়া সত্ত্বেও এর ছাওয়াব অনেক কঠিন কাজের সমতুল্য। এটা আল্লাহ তা'আলার মেহেরবানি যে, সহজ সহজ কাজেও তিনি বান্দাকে বিপুল ছাওয়াব দিয়ে থাকেন। এর দ্বারা জিহাদের গুরুত্বও বুঝে আসে। জিহাদের জন্য প্রস্তুত ঘোড়ার পেছনে খরচ করাতে যখন এত ছাওয়াব, তখন স্বয়ং জিহাদে অংশগ্রহণ করলে কত বেশি ছাওয়াব হতে পারে?
খুরায়ম বড় ভালো লোক, যদি না...
তারপর তৃতীয় একদিন হযরত ইবনুল হানযালিয়্যাহ রাযি, হযরত আবুদ দারদা রাযি.-এর মজলিসে উপস্থিত হলে এবারও তিনি একই অনুরোধ করলেন। এবার তিনি হাদীছ শোনালেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন- ! نِعْمَ الرَّجُلُ خُرَيْمٌ الأَسَدِيُّ لَوْلاَ طُولُ جُمَّتِهِ وَإِسْبَالُ إِزَارِهِ (খুরায়ম আল আসাদী বড় ভালো লোক, যদি না তার বাবরি বেশি লম্বা হত এবং নিজ লুঙ্গি না ঝুলিয়ে দিত)। হযরত খুরায়ম রাযি. আসাদ গোত্রীয় একজন সাহাবী এবং বদর যুদ্ধের একজন যোদ্ধা। তিনি তাঁর বাবরি চুল অনেক লম্বা করতেন। ফলে পিঠের উপর ঝুলে পড়ত। তাঁর আরেকটি অভ্যাস ছিল লুঙ্গি টাখনুর নিচে ঝুলিয়ে পরা। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর এ ত্রুটি সংশোধনের জন্য উৎসাহদানের পন্থা অবলম্বন করেন। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শিক্ষাদানের এটি ছিল একটি মৌলিক পন্থা। তিনি তিরস্কার করার উপর উৎসাহ দেওয়াকে প্রাধান্য দিতেন। হাঁ, যে ক্ষেত্রে তিরস্কারের প্রয়োজন হত সে ক্ষেত্রে তিরস্কারও করতেন। তবে উৎসাহদানই ছিল তাঁর অগ্রগণ্য ব্যবস্থা। সেমতে তিনি হযরত খুরায়ম রাযি.-এর প্রশংসা করলেন যে, খুরায়ম বড় ভালো লোক, যদি না তার এ দু'টি ত্রুটি থাকত। কোনও কোনও বর্ণনায় আছে, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সরাসরিই তাঁকে এ কথা বলেছিলেন। অর্থাৎ এমনিতে খুরায়ম একজন ভালো মানুষ। আর যেহেতু সে একজন ভালো মানুষ, তাই তার মধ্যে এ ত্রুটিদু'টি থাকা উচিত নয়। প্রশংসা করার দ্বারা মানুষ উপদেশ গ্রহণে উৎসাহ পায়। হযরত খুরায়ম রাযি.-এর ক্ষেত্রেও তাই হল। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কথা মানতে তাঁর এক মুহূর্তও দেরি হয়নি। তিনি তাঁর চুল কেটে কান বরাবর করে ফেলেন এবং লুঙ্গি নলার মাঝখান পর্যন্ত পরতে শুরু করেন।
ইসলামের সৌন্দর্য ও শালীনতার গুরুত্ব
বিশর ইবন কায়স বলেন, চতুর্থ একদিন হযরত ইবনুল হানযালিয়্যাহ রাযি. হযরত আবুদ দারদা রাযি.-এর মজলিসে আসলেন। এবারও তাঁকে একই রকমের অনুরোধ করা হল। এবারও তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একটি হাদীছ শুনিয়ে দিলেন। তিনি বললেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি-
إِنَّكُمْ قَادِمُونَ عَلَى إِخْوَانِكُمْ، فَأَصْلِحُوا لِبَاسَكُمْ وَأَصْلِحُوا رِحَالَكُمْ حَتَّى تَكُونُوا كَأَنَّكُمْ شَامَةٌ فِي النَّاسِ، إِنَّ اللَّهَ لَا يُحِبُّ الْفُحْشَ وَالتَّفَحُّشَ
‘তোমরা তোমাদের ভাইদের নিকট উপস্থিত হতে যাচ্ছ। সুতরাং তোমরা নিজেদের হাওদাগুলো ঠিক করে নাও এবং নিজেদের পোশাক পরিপাটি করে নাও, যাতে তোমরা মানুষের মধ্যে তিলকের মতো হয়ে যাও। কেননা আল্লাহ পসন্দ করেন না স্বভাবগত অশালীনতা ও কৃত্রিম অশালীনতা'। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ কথা বলেছিলেন কোনও এক যুদ্ধ থেকে ফেরার সময়। বললেন, অল্পক্ষণের মধ্যেই তোমরা মদীনায় পৌছে যাবে। সেখানে তোমাদের মুমিন ভাইদের সঙ্গে তোমরা মিলিত হবে। তাই তোমরা পরিপাটি হয়ে নাও। তোমরা যে হাওদায় চলে এসেছ তা গুছিয়ে নাও এবং তোমাদের পোশাক অর্থাৎ লুঙ্গি, চাদর, পাগড়ি ইত্যাদি ঠিকঠাক করে নাও। পরিপাটি হওয়ার হুকুম দেওয়ার কারণ পারস্পরিক সাক্ষাৎ মলিন ও আলুথালু বেশে হলে তা যেমন চোখে অসুন্দর লাগে, তেমনি অন্তরেও বিরক্তি ও ঘৃণা সৃষ্টি করে। অপরদিকে পরিপাটি হয়ে সাক্ষাৎ করলে যেমন দেখতে ভালো লাগে, তেমনি মনেও ভক্তি-ভালোবাসা জন্মায়। মুমিনদের পারস্পরিক সদ্ভাব ও ভালোবাসা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তা যাতে কোনওভাবেই ক্ষুন্ন না হয়, সে বিষয়ে সচেতন থাকা খুব জরুরি। ইসলামের যাবতীয় আচার-অনুষ্ঠানের ভেতর এ বিষয়টি লক্ষ করা যায়। মিসওয়াক করা, পোশাক-আশাক পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা, মসজিদ ও ঘরদোর পরিষ্কার রাখা, পথঘাটে আবর্জনা না ফেলা, সম্মিলিত ব্যবহারের বস্তু মলিন না করা এবং এ জাতীয় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বিষয়ক আরও যত ক্ষেত্র আছে, সবগুলোতে বহুবিধ ফায়দার পাশাপাশি পারস্পরিক সদ্ভাব ও ভালোবাসা রক্ষার বিষয়টিও লক্ষ্যবস্তু বৈ কি। যাহোক নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ হাদীছে পারিপাট্যের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করতে গিয়ে ইরশাদ করেছেন-
حَتَّى تَكُونُوا كَأَنَّكُمْ شَامَةٌ فِي النَّاسِ 'যাতে তোমরা মানুষের মধ্যে তিলকের মতো হয়ে যাও'। ইবনুল আছীর রহ. বলেন, شَامَةٌ এর অর্থ তিলক, যা মানুষের চেহারায় বা শরীরের অন্য কোথাও থাকে। কারও চেহারায় তিল থাকলে তার দিক তাকানো মাত্র সে তিল চোখে ভেসে ওঠে। তাতে চেহারার সৌন্দর্যও বেড়ে যায়। সুতরাং হাদীছটির অর্থ হল- তোমরা ভালো পোশাক-আশাকে সুন্দর ও পরিপাটি হয়ে থাকবে, যাতে চেহারায় তিল যেমন পরিস্ফুট থাকে, তেমনি মানুষের মধ্যে তোমরা পরিস্ফুট হয়ে থাক এবং তোমাদের দ্বারা মানবসমাজের শোভা বৃদ্ধি পায়।
বস্তুত একজন মুমিনের সবকিছুই হবে আল্লাহর জন্য। আল্লাহ তা'আলা যা পসন্দ করেন, সে কেবল তাই করবে। আর আল্লাহ তা'আলা যা অপসন্দ করেন, সে তা থেকে দূরে থাকবে। সুন্দর ও পরিপাটি হয়ে থাকার নির্দেশ মূলত সে কারণেই। সুতরাং নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-
فإنَّ الله لا يُحِبُّ الفُحْشَ وَلَا التَّفَخُسُ (কেননা আল্লাহ পসন্দ করেন না স্বভাবগত অশালীনতা ও কৃত্রিম অশালীনতা)। অর্থাৎ স্বভাবগতভাবে অশালীন হওয়ার কারণে যার লেবাস-পোশাক, কাজকর্ম ও কথাবার্তায় অশালীনতা প্রকাশ পায় তাকেও আল্লাহ তা'আলা পসন্দ করেন না এবং যে ব্যক্তির স্বভাবে অশালীনতা নেই বটে, কিন্তু কৃত্রিমভাবে সে অশালীন পোশাক পরে বা অশালীন কাজকর্ম করে কিংবা অশালীন কথাবার্তা বলে, তাকেও আল্লাহ তা'আলা পসন্দ করেন না। তাই প্রত্যেক মুমিনের উচিত সকল ক্ষেত্রে শালীন হয়ে থাকা। পোশাকের ক্ষেত্রেও সে লক্ষ রাখবে যাতে তার পোশাকের গঠন ও কাটিং শালীন হয় এবং তা পরিধানও করা হয় ভদ্রোচিতভাবে। অন্যের সামনে আসার সময় সে রুচিসম্মত পোশাক পরে আসবে। অন্যের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবে শালীনভাবে।
লক্ষণীয়, হযরত আবুদ দারদা রাযি. একজন শীর্ষস্থানীয় সাহাবী হওয়া সত্ত্বেও তাঁর তুলনায় কম পরিচিত এক সাহাবীর কাছে নসীহত প্রার্থনা করছেন। এক-দু'বার নয়। যখনই সাক্ষাৎ হচ্ছে, তখনই তাঁর কাছে নসীহত চাচ্ছেন। এর দ্বারা ধারণা পাওয়া যায় সাহাবায়ে কেরামের কাছে নসীহত কত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল এবং তাঁরা অন্যের কাছে নসীহত শোনার কী গভীর আগ্রহ পোষণ করতেন।
আরও লক্ষণীয়, হযরত আবুদ দারদা রাযি. যতবারই নসীহত চেয়েছেন, প্রত্যেকবারই হযরত ইবনুল হানযালিয়্যাহ রাযি. নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীছ শুনিয়ে দিয়েছেন। এর দ্বারা শিক্ষা পাওয়া যায় নসীহত করার বেলায় মনগড়া কথা না বলে কিংবা বানোয়াট কিচ্ছা-কাহিনী না শুনিয়ে কুরআন ও হাদীছকেই মূল অবলম্বনরূপে গ্রহণ করা উচিত।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. হক্কানী উলামা ও বুযুর্গানে দীনের সাহচর্য জীবনগঠনের পক্ষে খুব বেশি সহায়ক। তাই তাদের সাহচর্য অবলম্বনের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে।
খ. মানুষের সঙ্গে অহেতুক মেলামেশা না করে একাকী থাকা ঈমান-আমলের পক্ষে বেশি নিরাপদ।
গ. নামাযের বাইরের সময়টায়ও যতবেশি সম্ভব আল্লাহ তা'আলার যিকির করা উচিত।
ঘ. কোনও বুযুর্গ ব্যক্তির সাক্ষাৎ পেলে তার কাছে নসীহতের আবেদন করা চাই।
ঙ. নসীহত চাওয়ার বেলায় সময় ও পরিবেশ ইত্যাদির প্রতি লক্ষ রাখা বাঞ্ছনীয়, যাতে নসীহত করতে গিয়ে নসীহতকারী ব্যক্তি নিজে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়।
চ. রণক্ষেত্রে শত্রুর বিরুদ্ধে দর্প দেখানোর দ্বারা জিহাদের ছাওয়াব নষ্ট হয় না।
ছ. কোনও নেক আমলের কারণে দুনিয়াবী কোনও ফায়দা হাসিল হয়ে গেলে তাতে পরকালীন ছাওয়াব বাতিল হয়ে যায় না।
জ. কারও কোনও কাজের কারণে মনে খটকা দেখা দিলে কোনও বিজ্ঞ ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে সে খটকা দূর করে নেওয়া চাই।
ঝ. শিক্ষার্থীর কর্তব্য শিক্ষকের সামনে বিনয়ী হয়ে থাকা।
ঞ. জিহাদের আসবাব-উপকরণের পেছনে অর্থব্যয় করা অনেক বড় ছাওয়াবের কাজ।
ট. পুরুষের চুল এত বেশি লম্বা করা উচিত নয়, যা দেখতে নারীর চুলের মতো মনে হবে।
ঠ. পোশাক টাখনুর নিচে ঝুলিয়ে পরা জায়েয নয়।
ড. সদুপদেশের উপর আমল করতে অহেতুক বিলম্ব করতে নেই।
ঢ. অন্যের সঙ্গে সাক্ষাৎকালে ভালো পোশাক পরা ও পরিপাটি হয়ে আসা চাই।
ণ. ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় কোনওভাবেই অশালীন কথা বলা বা অশালীন কাজ করা উচিত নয়।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)