রিয়াযুস সালিহীন-ইমাম নববী রহঃ

৪. পোষাক-পরিচ্ছদের বর্ণনা

হাদীস নং: ৮১২
পোষাক-পরিচ্ছদের বর্ণনা
পরিচ্ছেদ:১০ পোশাক পরিধান ডানদিক থেকে শুরু করার ইস্তিহবাব
ইস্তিহবাব অর্থ পসন্দ করা, ভালোবাসা। এর থেকে 'মুস্তাহাব' শব্দটি গঠিত। বলা হয়, অমুক কাজটি মুস্তাহাব। অর্থাৎ শরী'আত এ কাজটি পসন্দ করে। পোশাক পরিধানের শুরুটা ডানদিক থেকে হওয়া মুস্তাহাব। যেমন জামা পরার সময় প্রথমে ডান হাতায় হাত ঢোকানো, পায়জামা পরার সময় প্রথমে ডান পা ঢোকানো, মোজা পরার সময় প্রথমে ডান পায়ে পরা ইত্যাদি। এর কারণ কোনও অঙ্গে পোশাক পরানোর দ্বারা সে অঙ্গকে সম্মান করা হয়। সম্মান পাওয়ার ক্ষেত্রে বাম অঙ্গের তুলনায় ডান অঙ্গ অগ্রাধিকার রাখে। কেননা মানুষ বামের তুলনায় ডানকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকে।
ইমাম নববী রহ. এ পরিচ্ছেদে কোনও হাদীছ উল্লেখ করেননি। কেননা এখানে উল্লেখ করার উপযুক্ত হাদীছ পেছনে বিভিন্ন জায়গায় গত হয়েছে। যেমন উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রাযি. থেকে বর্ণিত আছে-
كَانَ رسول الله ﷺ يُعْجِبُهُ التَّيَمُّنُ في شَأْنِهِ كُلِّهِ : فِي طُهُوْرِهِ وَتَرَجُلِهِ وَتَنَعَلِهِ
'রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সকল কাজে ডান দিককে প্রাধান্য দেওয়া পসন্দ করতেন- পবিত্রতা অর্জনে, দাঁড়ি-চুল আঁচড়ানোতে ও জুতা পরায়।'
(সহীহ বুখারী: ১৬৮; সহীহ মুসলিম: ২৬৮; সুনানে আবু দাউদ: ৪১৪০; জামে' তিরমিযী: ৬১৪; সুনানে ইবন মাজাহ: ৪০১; সুনানে নাসাঈ ৪২১; মুসনাদে আহমাদ: ২৪৬২৭; সহীহ ইবনে হিব্বান: ১০৯১; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা: ৪০৪; শু'আবুল ঈমান ৬০৪৭)
উম্মুল মুমিনীন হযরত হাফসা রাযি. থেকে বর্ণিত-
أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ ﷺ كَانَ يَجْعَلُ يَمِينَهُ لطَعَامِهِ وَشَرَابِهِ وَثِيَابِهِ، وَيَجْعَلُ يَسَارَهُ لِمَا سِوَى ذَلِكَ
'রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর ডানহাত ব্যবহার করতেন খানা খাওয়া, পানি পান করা ও পোশাক পরিধানের বেলায়। আর এছাড়া অন্যান্য কাজে। বামহাত ব্যবহার করতেন।'
(সুনানে আবু দাউদ: ৩২; সহীহ ইবনে হিব্বান ৫২২৭; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর: ৩৪৬; হাকিম, আল মুস্তাদরাক: ৭০৯১; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা: ৫৪৭)
হযরত আবূ হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত-
أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ ﷺ قَالَ : إِذَا لَبِسْتُمْ ، وَإِذَا تَوَضَّأْتُمْ، فَابْدَأوْا بِأَيَامِنكُمْ
'রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, তোমরা যখন পোশাক পরবে এবং ওযু করবে, তখন ডানদিক থেকে শুরু করবে।’
(সুনানে আবু দাউদ: ৪১৪১; জামে তিরমিযী: ১৭৬৬; সুনানে ইবন মাজাহ: ৪০৩; মুসনাদে আহমাদ: ৮৬৩৭; সহীহ ইবনে খুযায়মা: ১৭৮; সহীহ ইবনে হিব্বান: ১০৯০; তাবারানী, আল মু'জামুল আওসাত: ১০৯৭; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা: ৪০৫; শু'আবুল ঈমান: ৫৮৬৮)
এসব হাদীছের শিক্ষা হল জামা, পায়জামা, জুতা, মোজা ইত্যাদি পরার সময় শুরুটা ডানদিক থেকে করা চাই। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেও তাই করতেন এবং আমাদেরকেও তিনি এরূপ করার হুকুম দিয়েছেন। এটা ইসলামী তাহযীব বা সংস্কৃতির অঙ্গ। এটা পোশাক পরিধানের ক্ষেত্রে অন্যান্য ধর্মাবলম্বী হতে ইসলামের অনুসারীদের পার্থক্য নির্দেশ করে। সুতরাং প্রত্যেক মুসলিমের অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে এ হুকুম পালন করা উচিত।
হাদীছ নং: ৮১২

হযরত আবু সা'ঈদ খুদরী রাযি. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন কোনও নতুন কাপড় পরতেন, সেটি পাগড়ি হোক, জামা হোক কিংবা চাদর, তার নাম নিয়ে বলতেন
اللَّهُمَّ لَكَ الْحَمْدُ ، أَنْتَ كَسَوْتَنِيهِ ، أَسْأَلُكَ مِنْ خَيْرِهِ وَخَيْرِ مَا صُنِعَ لَهُ ، وَأَعُوذُ بِكَ مِنْ شَرِّهِ وَشَرِّ مَا صُنِعَ لَهُ
‘হে আল্লাহ! তোমারই সমস্ত প্রশংসা। তুমিই এটি আমাকে পরিয়েছ। আমি তোমার কাছে প্রার্থনা করি এর কল্যাণ এবং যেজন্য এটি তৈরি করা হয়েছে তারও কল্যাণ। আর আমি তোমার আশ্রয় গ্রহণ করছি এর অনিষ্ট থেকে এবং যেজন্য এটি তৈরি করা হয়েছে তারও অনিষ্ট থেকে’। -আবু দাউদ ও তিরমিযী
(সুনানে আবু দাউদ: ৪৫২০; জামে তিরমিযী: ১৭৬৭; হাকিম, আল মুস্তাদরাক: ৭৪০৮; বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান: ৫৮৭১; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ: ৩১১১; নাসাঈ, আস সুনানুল কুবরা: ১০০৬৯; মুসনাদে আহমাদ: ১১২৪৮; সহীহ ইবনে হিব্বান: ৫৪২০)
كتاب اللباس
باب مَا يقول إِذَا لبس ثوبًا جديدًا أَوْ نعلًا أَوْ نحوه

باب استحباب الابتداء باليمين في اللباس
هَذَا الباب قَدْ تقدم مقصوده وذكرنا الأحاديث الصحيحة فِيهِ
812 - عن أَبي سعيد الخدْريِّ - رضي الله عنه - قَالَ: كَانَ رسول الله - صلى الله عليه وسلم - إِذَا اسْتَجَدَّ ثَوبًا سَمَّاهُ باسْمِهِ - عِمَامَةً، أَوْ قَميصًا، أَوْ رِدَاءً - يقولُ: «اللَّهُمَّ لَكَ الْحَمْدُ أَنْتَ كَسَوْتَنِيهِ، أَسْأَلكَ خَيْرَهُ وَخَيْرَ مَا صُنِعَ لَهُ، وَأَعُوذُ بِكَ مِنْ شَرِّهِ وَشَرِّ مَا صُنِعَ لَهُ». رواه أَبُو داود والترمذي، (1) وقال: «حديث حسن».

হাদীসের ব্যাখ্যা:

পোশাক আল্লাহ তা'আলার অনেক বড় এক নি'আমত। বান্দার কোনও যোগ্যতা ও অধিকার ছাড়াই আল্লাহ তা'আলা নিজ অনুগ্রহে এটা দান করেন। তাই বান্দার কর্তব্য এর জন্য আল্লাহ তা'আলার শোকর আদায় করা। যে-কোনও নি'আমত আল্লাহ তা'আলার হুকুম মোতাবেক ব্যবহার করলে তা বান্দার জন্য কল্যাণকর হয়। অন্যথায় তা বহুবিধ অকল্যাণের কারণ হয়ে থাকে। তাই নি'আমত ব্যবহারকালে আল্লাহ তা'আলার কাছে সে নি'আমতের কল্যাণ লাভ করা ও অকল্যাণ থেকে মুক্ত থাকার জন্য দু'আও করা উচিত। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে নি'আমত ভোগকালীন যেসকল দু'আ শিক্ষা দিয়েছেন, তার ভেতর একইসঙ্গে উল্লিখিত শোকর ও প্রার্থনা দু'টিই বিদ্যমান রয়েছে। পোশাক পরিধানকালীন যে দু'আ এ হাদীছটিতে শেখানো হয়েছে, তাও এর ব্যতিক্রম নয়।

দু'আটির প্রথম বাক্য হল-
اَللَّهُمَّ لَكَ الْحَمْدُ أَنْتَ كَسَوْتَنِيْهِ (হে আল্লাহ! তোমারই সমস্ত প্রশংসা। তুমিই এটি আমাকে পরিয়েছ)। অর্থাৎ এই জামা, লুঙ্গি, পায়জামা, টুপি কিংবা চাদর তুমিই আমাকে দান করেছ। এটা পাওয়ার কোনও অধিকার আমার ছিল না। এমন কোনও যোগ্যতাও ছিল না, যদ্দরুন এটা আমি পেতে পারি। এটা নিতান্তই নিজ মেহেরবানিতে তুমি এটা আমাকে দান করেছ। তুমি না দিলে এটা আমি পেতাম না। সুতরাং হে আল্লাহ! এর জন্য আমি তোমার কৃতজ্ঞতা জানাই।

দু'আটির দ্বিতীয় বাক্য হল- أَسْأَلكَ خَيْرَهُ (আমি তোমার কাছে প্রার্থনা করি এর কল্যাণ)। অর্থাৎ এ পোশাক যেন আমার শীত বা তাপ নিবারণের কাজে আসে। এটা যেন আমার শরীর ও স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী হয়।

দু'আটির তৃতীয় বাক্য হল- وَخَيْرٌ مَا صُنْعَ لَهُ (এবং যেজন্য এটি তৈরি করা হয়েছে তারও কল্যাণ)। অর্থাৎ এ পোশাক যেন আমি শরী'আতসম্মতভাবে ব্যবহার করি। এটা পরে আমি যেন তোমার ইবাদত-আনুগত্য করি ও সৎকর্মে লিপ্ত থাকি।

দু'আটির চতুর্থ বাক্য হল- وَأَعَوْذُ بِكَ مِنْ شَرِّهِ (আর আমি তোমার আশ্রয় গ্রহণ করছি এর অনিষ্ট থেকে)। অর্থাৎ এ পোশাক যেন কোনওভাবেই আমার শরীর ও স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর না হয় কিংবা অন্য কোনওভাবে বিপদের কারণ না হয়।

দু'আটির সর্বশেষ বাক্য হল- وَشَرٌ مَا صُنْعَ لَهُ (এবং যেজন্য এটি তৈরি করা হয়েছে তারও অনিষ্ট থেকে)। অর্থাৎ এ পোশাক পরে আমি যেন তোমার অকৃতজ্ঞতা না করি এবং অহংকার-অহমিকার শিকার না হই। এ পোশাক পরে আমি যেন কোনও পাপকর্মে লিপ্ত না হই কিংবা এ পোশাক যেন আমার কোনও পাপকর্মে লিপ্ত হওয়ার পক্ষে সহায়ক না হয়।

প্রকাশ থাকে যে, এ হাদীছে যদিও দু'আটি নতুন কাপড় পরিধানের বেলায় পড়ার কথা বলা হয়েছে, কিন্তু কোনও বর্ণনায় সাধারণভাবে কাপড় পড়ার দু’আ হিসেবে এটি উল্লেখ করা হয়েছে। কাজেই নতুন-পুরোনো যে-কোপড় পরার দু'আ সময়ই এ দু'আটি প্রযোজ্য।

উল্লেখ্য, হাদীছগ্রন্থসমূহে এ দু'আটি ছাড়া পোশাক পরার অন্য দু'আও বর্ণিত আছে। যেমন এক হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-:
الْحَمْدُ لِلَّهِ الَّذِي كَسَانِي مَا أُوَارِي بِهِ عَوْرَتِي، وَأَتَجَمَّلُ بِهِ فِي حَيَاتِي، ثُمَّ عَمَدَ إِلَى الثَّوْبِ الَّذِي أَخْلَقَ فَتَصَدَّقَ بِهِ كَانَ فِي كَنَفِ اللَّهِ، وَفِي حِفْظِ اللَّهِ، وَفِي ستْرِ اللَّهِ حَيًّا وَمَيِّتًا

যে ব্যক্তি কোনও নতুন কাপড় পরে আর বলে-
الْحَمْدُ لِلَّهِ الَّذِي كَسَانِي مَا أُوَارِي بِهِ عَوْرَتِي، وَأَتَجَمَّلُ بِهِ فِي حَيَاتِي
(সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর, যিনি আমাকে এমন কাপড় পরিয়েছেন, যা দ্বারা আমি আমার সতর ঢাকি এবং আমি আমার ইহজীবনে নিজেকে সৌন্দর্যমণ্ডিত করি)

তারপর পুরোনো কাপড়টি সদাকা করে যায়, সে জীবিত ও মৃত অবস্থায় আল্লাহর রহমত ও তাঁর হেফাজতের মধ্যে থাকবে এবং আল্লাহ তা'আলা তার দোষ গোপন রাখবেন।
(জামে' তিরমিযী: ৩৫৬০; সুনানে ইবন মাজাহ ৩৫৭৭; মুসনাদে আহমাদ: ৩০৫; মুসান্নাফে ইবন আবী শায়বা: ২৫০৮৮; মুসনাদে আবু ইয়া'লা ৩২৭; ইবনুস সুন্নী, আমালুল ইয়াওম ওয়াল-লায়লা: ২৭২; হাকিম, আল মুস্তাদরাক ৭৪১০; বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান: ৫৮৭৪; তাবারানী, মাকারিমুল আখলাক: ১৯১)

হযরত মু'আয ইবন আনাস রাযি. থেকে বর্ণিত, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
من لبس ثوبا فقال الحمد لله الذي كساني هذا ورزقنيه من غير حول مني ولا قوة غفر له ما تقدم من ذنبه وما تأخر
'যে ব্যক্তি কোনও কাপড় পরিধান করে এবং বলে- الْحَمْدُ لِلَّهِ الَّذِي كَسَانِي هُذَا الثَّوْبَ، وَرَزَقَنِيهِ مِنْ غَيْرِ حَوْلٍ مِنِّي وَلَا قُوَّةٍ (সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর, যিনি আমাকে এ পোশাক পরিয়েছেন এবং আমার কোনও শক্তি ও ক্ষমতা ছাড়াই এটা আমাকে দান করেছেন), তার আগের-পরের সব গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হয়।
(সুনানে আবূ দাউদ: ৪০২৩; জামে তিরমিযী: ৩৪৫৮; সুনানে ইবন মাজাহ: ৩২৮৫; মুসনাদে আহমাদ: ১৫৬৩২; ইবনুস সুন্নী, আমালুল ইয়াওম ওয়াল লায়লা: ২৭১)

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. কাপড় আল্লাহ তা'আলার অনেক বড় নি'আমত। এর জন্য শোকর আদায় করা জরুরি।

খ. যে-কোনও বস্তুর ভেতর উপকার ও অপকার দুয়েরই অবকাশ থাকে। তাই সে বস্তুর উপকার লাভ ও অপকার থেকে বাঁচার জন্য আল্লাহ তা'আলার কাছে দু'আ করা চাই।

গ. আমরা কাপড় পরার সময় হাদীছে বর্ণিত দু'আ অবশ্যই পাঠ করব।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান
রিয়াযুস সালিহীন - হাদীস নং ৮১২ | মুসলিম বাংলা