রিয়াযুস সালিহীন-ইমাম নববী রহঃ

৫. ঘুমানো ও মজলিসের আদব

হাদীস নং: ৮২৭
ঘুমানো ও মজলিসের আদব
পরিচ্ছেদ:৩ মজলিস ও মজলিসের সঙ্গীদের সম্পর্কিত আদব-কায়দা
জুমু'আয় যাওয়ার প্রস্তুতি ও বিশেষ কয়েকটি আমল
হাদীছ নং: ৮২৭

হযরত আবু আব্দুল্লাহ সালমান ফারিসী রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, যে-কোনও ব্যক্তি জুমু'আর দিন গোসল করে, সামর্থ্য অনুযায়ী পাক-পবিত্রতা অর্জন করে, তার কাছে যে তেল থাকে তা ব্যবহার করে কিংবা তার ঘরে যে খুশবু থাকে তা লাগায়, তারপর বের হয়ে পড়ে, (মসজিদে গিয়ে) দু'ব্যক্তিকে দু'দিকে সরিয়ে তাদের মাঝখানে বসে না, তারপর নামায পড়ে, যা তার জন্য নির্ধারিত আছে, তারপর ইমাম যখন কথা বলে তখন সে চুপ থাকে, তার সে জুমু'আ ও অপর জুমু'আর মধ্যবর্তী সময়ের যাবতীয় গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হয়। -বুখারী
(সহীহ বুখারী: ৮৮৩; সুনানে দারিমী: ১৫৮২; তহাবী, শারহু মা'আনিল আছার: ২১৬৯; সহীহ ইবনে হিব্বান : ২৭৭৬; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা: ৫৯৫৬; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ: ১০৫৮)
كتاب آداب النوم والاضطجاع والقعود والمجلس والجليس والرؤيا
باب في آداب المجلس والجليس
827 - وعن أَبي عبد الله سَلْمَان الفارسي - رضي الله عنه - قَالَ: قَالَ رسول الله - صلى الله عليه وسلم: «لاَ يَغْتَسِلُ رَجُلٌ يَوْمَ الْجُمُعَةِ، وَيَتَطهَّرُ مَا اسْتَطَاعَ مِنْ طُهْرٍ، وَيَدَّهِنُ مِنْ دُهْنِهِ، أَوْ يَمَسُّ مِنْ طِيب بَيْتِهِ، ثُمَّ يَخْرُجُ فَلاَ يُفَرِّقُ بَيْنَ اثْنَينِ، ثُمَّ يُصَلِّي مَا كُتِبَ لَهُ، ثُمَّ يُنْصِتُ إِذَا تَكَلَّمَ الإمَامُ، إِلاَّ غُفِرَ لَهُ مَا بَيْنَهُ وَبَيْنَ الجُمُعَةِ الأُخْرَى». رواه البخاري. (1)

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এ হাদীছে জুমু'আর নামায পড়ার ফযীলত বলা হয়েছে যে, তা দ্বারা এক জুমু'আ থেকে অপর জুমু'আ পর্যন্ত সাত দিনের গুনাহ মাফ হয়। তবে এর জন্য সাতটি শর্ত বলা হয়েছে। প্রথম শর্ত হল গোসল করা। উলামায়ে কেরামের অধিকাংশের মতে জুমু'আর দিন ফজরের ওয়াক্ত হওয়ার পর থেকে জুমু'আর নামাযের জন্য বের হওয়ার আগ পর্যন্ত যে-কোনও সময়ই এ গোসল করা যেতে পারে। জুমু'আর জন্য বের হওয়ার আগ মুহূর্তে করা জরুরি নয়।

দ্বিতীয় শর্ত পবিত্রতা অর্জন করা। বলা হয়েছে- وَيَتَطَهَّرُ مَا اسْتَطَاعَ مِنْ طُهْرٍ (সামর্থ্য অনুযায়ী পাক-পবিত্রতা অর্জন করে)। এর দ্বারা খুব ভালোভাবে পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতা অর্জনের কথা বোঝানো হয়েছে। অর্থাৎ মাথায় বাবরি থাকলে গোসলের সময় তা ভালোভাবে ধুয়ে নেবে। গোঁফ বড় হয়ে গেলে তা কেটে নেবে। নখ কাটবে। বাড়তি পশম সাফ করবে। পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন কাপড় পরিধান করবে।

তৃতীয় শর্ত হল তেল লাগানো। এর দ্বারা বোঝানো উদ্দেশ্য মাথায় তেল লাগিয়ে চুল পরিপাটি করে নেওয়া এবং দাড়ি আঁচড়ানো। আলুথালু চুল-দাড়ি নিয়ে মসজিদে যাবে না।

চতুর্থ শর্ত হল - أَوْ يَمَس مِن طيب بيته (কিংবা তার ঘরে যে খুশবু থাকে তা লাগায়)। কেউ বলেন এর অর্থ তেল না থাকলে আতর লাগাবে। কারও মতেأَوْ (কিংবা) শব্দটি و (এবং) অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। সে হিসেবে তেল না থাকলে আতর নয়: বরং তেল ও আতর দু'টোই লাগাবে। 'ঘরে যে খুশবু থাকে'-এর দ্বারা ইঙ্গিত পাওয়া যায় আতর ব্যবহারে অভ্যস্ত হওয়া সুন্নত। আর সে কারণেই ঘরে সবসময় আতর রাখবে।

কোনও কোনও বর্ণনায় আছে- وَمَسَّ مِنْ طِيبِ امْرَأَتِهِ إِنْ كَانَ لَهَا (এবং তাঁর স্ত্রীর কাছ থেকে আতর নিয়ে লাগাবে) (সুনানে আবু দাউদ: ৩৪৭; সহীহ ইবনে খুযায়মা: ১৮১০; তহাবী, শারহু মা'আনিল আছার: ২১৬৬; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা: ৫৮৮৭)

এর দ্বারা জুমু'আর দিন আতর ব্যবহারের গুরুত্ব বোঝা যাচ্ছে, যে কারণে নিজের কাছে না থাকলেও স্ত্রীর কাছ থেকে নিয়ে লাগাতে বলা হয়েছে। ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে, পুরুষদের মতো নারীদেরও সুগন্ধি ব্যবহারের অবকাশ আছে। বরং স্বামীকে খুশি রাখার জন্য তারা সুগন্ধি ব্যবহার করবে এবং করাটা ভালো। এ হাদীছ দ্বারা তাদের সুগন্ধি ব্যবহারের প্রতি উৎসাহ পাওয়া যায়, যদিও সুগন্ধি ব্যবহার করে বাইরে যাওয়ার নিষেধাজ্ঞা আছে।

পঞ্চম শর্ত হল মসজিদে গিয়ে নিজে বসার জন্য কাউকে তার জায়গা থেকে সরাবে না। বলা হয়েছে- فَلَا يُفَرِّقُ بَيْنَ اثْنَيْنِ (দু'ব্যক্তিকে দু'দিকে সরিয়ে তাদের মাঝখানে বসে না)। এর এক অর্থ তো এই যে, মসজিদে আগে আগে যাবে, যাতে বসার জন্য সহজে জায়গা পাওয়া যায় এবং অন্যকে সরাতে না হয়। দ্বিতীয় অর্থ এই যে, দু'জন পাশাপাশি থাকলে তাদের মাঝখানে গিয়ে বসবে না। এটা তাদের জন্য বিব্রতকর হতে পারে। স্বভাবগতভাবে অনেকে যে-কারও পাশে বসে স্বস্তিবোধ করে না। এ অবস্থায় কেউ যদি তার পাশের ব্যক্তিকে সরিয়ে নিজে বসে, তবে তাতে সে অস্বস্তিবোধ করবে। তাই এটা সমীচীন নয়।

ষষ্ঠ শর্ত হল খুতবার আগে পৌঁছতে পারলে যতটুকু সময় পাওয়া যায় সে অনুযায়ী সুন্নত ও নফল পড়বে। মসজিদে গিয়ে যদি দেখা যায় খুতবা শুরু হয়ে গেছে বা ইমাম খুতবা দেওয়ার জন্য এসে গেছেন, তখন আর কোনও সুন্নত বা নফল পড়া যাবে না।

সপ্তম শর্ত হল চুপ থাকা। অর্থাৎ ইমাম যখন খুতবা দিতে শুরু করবেন, কোনও কথাবার্তা না বলে নীরবে তার খুতবা শুনতে থাকা। এটা ওয়াজিব। সময় কথা বলা তো নয়ই: নামায পড়াও জায়েয নয়।

এ শর্তগুলো রক্ষার সঙ্গে জুমু'আর নামায আদায় করলে এক জুমু'আ থেকে অপর জুমু'আ পর্যন্ত সাতদিনের গুনাহ মাফ করে দেওয়া হয়। প্রকাশ থাকে যে, আমলের দ্বারা যে গুনাহ মাফ হয় তা সগীরা গুনাহ। কবীরা গুনাহ মাফের জন্য তাওবা শর্ত।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. জুমু'আর দিন গোসল করতে হবে। বিভিন্ন হাদীছ দ্বারা এ গোসলের গুরুত্ব প্রমাণিত হয়।

খ. জুমু'আর দিন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও উত্তম লেবাস পরা মুস্তাহাব।

গ. এদিন তেল ও আতর ব্যবহার করা মুস্তাহাব।

ঘ. মসজিদে অন্যদের সরিয়ে নিজে বসা মাকরূহ।

ঙ. পাশাপাশি বসা দুই ব্যক্তিকে দু'দিকে সরিয়ে মাঝখানে বসা উচিত নয়।

চ. জুমু'আর খুতবার আগে যত ইচ্ছা নফল পড়া যায়।

ছ. খুতবা চলাকালে কথা বলা জায়েয নয়; নীরব থাকা জরুরি।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:বিশুদ্ধ (পারিভাষিক সহীহ)