রিয়াযুস সালিহীন-ইমাম নববী রহঃ
৬. সালাম-মুসাফাহার আদব
হাদীস নং: ৮৪৪
সালাম-মুসাফাহার আদব
ষষ্ঠ ভাগ : সালামের বিধান ও আদবসমূহ
মানুষ সামাজিক জীব। সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কারও পক্ষেই একা চলা সম্ভব নয়। নানা প্রয়োজনে প্রত্যেককে অন্যের সঙ্গে মেলামেশা করতেই হয়। ফলে প্রতিদিনই প্রত্যেকের অন্যের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করতে হয়। ইচ্ছাকৃত তো বটেই, অনিচ্ছাবশতও নানা অনুষঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ হয়েই যায়। একের সঙ্গে যখন অন্যের সাক্ষাৎ হয়, তখন সভ্য ও ভদ্র লোকদের প্রথম কাজ হয় অভিবাদন করা। সাক্ষাৎকালে একে অন্যের প্রতি সম্মান-স্নেহ ও ভক্তি-ভালোবাসা প্রকাশের জন্য যে বিশেষ রীতি পালন করা হয় সেটাই অভিবাদন। একেক জাতির অভিবাদন একেক রকম। কেউ শুভ সকাল, শুভ সন্ধ্যা ইত্যাদি বলে। কেউ নমস্কার করে। কেউ মাথা ঝোঁকায়। এক কালে তো রাজা- বাদশাদেরকে অভিবাদনস্বরূপ সিজদাও করা হত। প্রত্যেক জাতিরই অভিবাদনের বিশেষ এক রীতি আছে।
ইসলামে সমাজজীবন অতীব গুরুত্বপূর্ণ। এটা সর্বশেষ দীন। পরিপূর্ণ দীন। জীবন সম্পর্কিত প্রতিটি বিষয়ে ইসলামের রয়েছে সুস্পষ্ট ও পরিপূর্ণ শিক্ষা। ইসলাম তার অনুসারীদের অভিবাদন বিষয়ে যে শিক্ষা দিয়েছে, তা সকল জাতির অভিবাদন অপেক্ষা উত্তম, সারগর্ভ ও কল্যাণকর। ইসলামের অভিবাদন হল السَّلَامُ عَلَيْكُمْ । এর জবাব ا وَعَلَيْكُمُ السَّلَامُ
اَلسَّلامُ আল্লাহ তা'আলার মহান নামসমূহের একটি। এর অর্থ শান্তি ও নিরাপত্তাদাতা। اَلسَّلَامُ عَلَيْكُمْ বলার দ্বারা যেন দু'আ করা হয়- আল্লাহ তা'আলা তোমাদের হেফাজত করুন, তোমাদেরকে শান্তি ও নিরাপত্তা দান করুন। তোমাদের প্রতি আল্লাহ তা'আলার এ নামের বরকত নাযিল হোক।
السّلام শব্দের অর্থ শান্তি, মুক্তি, নিরাপত্তা। সালাম দেওয়ার দ্বারা দু'আ করা হয়- তোমরা সকল অনিষ্ট ও অমঙ্গল থেকে নিরাপদ থাকো। এটা এক চমৎকার দু'আ। মানবজীবনে সবচে' বেশি প্রয়োজন অনিষ্ট ও ক্ষতি থেকে নিরাপত্তা। জান, মাল ও ইজ্জতের নিরাপত্তা। কারও যদি সবই থাকে কিন্তু নিরাপত্তা না থাকে, তবে সব থাকার কোনও সার্থকতা তার জীবনে থাকে না। অপরদিকে কারও যদি খুব বেশি কিছু না থাকে কিন্তু নিরাপত্তা থাকে, তবে তার জীবন বড় সুখের, বড় শান্তির। সালাম দেওয়ার উদ্দেশ্য সালামদাতার পক্ষ থেকে উদ্দিষ্ট ব্যক্তিকে নিরাপত্তা দেওয়াও বটে। যেন বলা হয়, আমার দিক থেকে তুমি কোনও ক্ষতির আশঙ্কা করো না। তুমি নিশ্চিন্তে আমার সামনে আসতে পার। তুমি নির্ভয়ে আমাকে তোমার কাছে যেতে দিতে পার। এভাবে সালাম বিনিময় পারস্পরিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। এভাবে সালামের রেওয়াজদান সামাজিক নিরাপত প্রতিষ্ঠার এক শ্রেষ্ঠ উপায়। এক হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
أَفْشُوا السَّلَامَ تَسْلَمُوا
'তোমরা সালামের প্রসার ঘটাও, নিরাপদ থাকবে।'
(মুসনাদে আহমাদ: ১৮৫৩০; বুখারী, আল-আদাবুল মুফরাদ: ৭৮৭; সহীহ ইবন হিব্বান: ৪৯১; বায়হাকী, শুআবুল ঈমান: ৮৩৮২; মুসনাদ আবূ ইয়া'লা : ১৬৮৭)
সালাম দেওয়ার দ্বারা যে নিরাপত্তার আশ্বাসবাণী শোনানো হয়, তা অন্তরে ভালোবাসার বীজ বপন করে। উভয়পক্ষ থেকে সালাম বিনিময়ের দ্বারা একজন আরেকজনের কাছাকাছি চলে আসে। ক্রমে সম্পর্ক গভীর হতে থাকে। এর দ্বারা পূর্ববিদ্বেষ দূর হয়ে যায়। শত্রু বন্ধুতে পরিণত হয়। পারস্পরিক সম্প্রীতি ও বন্ধুত্ব ইসলামে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ইসলাম যে চারিত্রিক শিক্ষাদান করে, তার মধ্যে ভালোবাসা ও সম্প্রীতি অতীব গুরুত্বপূর্ণ। পরস্পরের মধ্যে যা-কিছু দ্বারা ভালোবাসা সৃষ্টি হয়, ইসলাম সেসব করার প্রতি বিশেষভাবে উৎসাহদান করেছে। যেমন হাদিয়া বিনিময় করা ও খাবার খাওয়ানো। সালাম বিনিময়ও অনুরূপ একটি কাজ। এমনিভাবে যেসব কাজ দ্বারা সম্পর্ক নষ্ট হয় এবং বিদ্বেষ ও শত্রুতা সৃষ্টি হয়, ইসলাম তা নিষিদ্ধ করেছে। যেমন গীবত করা, চুগলখোরী করা, অন্যের দোষ খুঁজে বেড়ানো, অন্যের প্রতি অহমিকাপূর্ণ আচরণ ইত্যাদি।
সালাম বিনয়ের পরিচায়ক। বেশি বেশি সালাম দেওয়ার দ্বারা অন্তর থেকে অহমিকা দূর হয়ে যায়। তদস্থলে বিনয়স্বভাব দৃঢ়তা লাভ করে। বিনয় সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠায় বিশেষ ভূমিকা রাখে। কাজেই অন্তরে বিনয় আনয়ন ও সামাজিক সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সালামের ব্যাপক বিস্তার জরুরি। তাই হাদীছে কেবল সালাম দেওয়া নয়; বরং সালামের প্রসার ঘটাতে বলা হয়েছে।
বস্তুত সালাম মুমিনদের দুনিয়া ও আখিরাত উভয় জীবনের অবিচ্ছেদ্য অনুষঙ্গ। মুমিনদেরকে কেবল মুমিনরাই সালাম দেয় না; তাদেরকে সালাম দেয় ফিরিশতাগণও। শবে কদরে তো একদল ফিরিশতা কেবল সালাম দেওয়ার কাজেই নিয়োজিত থাকে। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে-
تَنَزَّلُ الْمَلَائِكَةُ وَالرُّوحُ فِيهَا بِإِذْنِ رَبِّهِمْ مِنْ كُلِّ أَمْرٍ (4) سَلَامٌ هِيَ حَتَّى مَطْلَعِ الْفَجْرِ (5)
'সে রাতে ফিরিশতাগণ ও রূহ প্রত্যেক কাজে তাদের প্রতিপালকের অনুমতিক্রমে অবতীর্ণ হয়। তারা বলে সালাম, এটা ফজরের আবির্ভাব পর্যন্ত’।(সূরা কদর, আয়াত ৪, ৫)
আমরা শ্রেষ্ঠতম ইবাদত নামাযের সমাপ্তি তো সালাম দ্বারাই করি। তাতে ইমাম মুক্তাদীর প্রতি, মুক্তাদী ইমামের প্রতি এবং সেইসঙ্গে ফিরিশতাদের প্রতিও সালাম দেওয়া হয়। 'আত-তাহিয়্যাতু'-এর ভেতর সালাম জানানো হয় নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি এবং সমস্ত নেককার মুমিনদের প্রতি।
জান্নাতে মুমিনদের পারস্পরিক অভিবাদন হবে এ সালাম। ইরশাদ হয়েছে-
تَحِيَّتُهُمْ يَوْمَ يَلْقَوْنَهُ سَلَامٌ
'যেদিন তারা তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করবে, সেদিন তাদের অভিবাদন হবে সালাম।
(সূরা আহযাব, আয়াত ৪৪)
জান্নাতে ফিরিশতাগণও সালাম দিয়ে অভিবাদন জানাবে। ইরশাদ হয়েছে-
وَالْمَلَائِكَةُ يَدْخُلُونَ عَلَيْهِمْ مِنْ كُلِّ بَابٍ (23) سَلَامٌ عَلَيْكُمْ بِمَا صَبَرْتُمْ فَنِعْمَ عُقْبَى الدَّارِ (24)
'আর (তাদের অভ্যর্থনার জন্য) ফিরিশতাগণ তাদের নিকট প্রত্যেক দরজা দিয়ে প্রবেশ করবে (আর বলতে থাকবে-) তোমরা (দুনিয়ায়) যে সবর অবলম্বন করেছিলে, তার বদৌলতে এখন তোমাদের প্রতি সালাম (শান্তিই বর্ষিত হবে) এবং (তোমাদের) প্রকৃত নিবাসে এটা কতইনা উৎকৃষ্ট পরিণাম।'
(সূরা রা'দ, আয়াত ২৩, ২৪)
জান্নাত তো সালাম তথা শান্তির নিবাস। জান্নাতের এক নামই দারুস-সালাম। ইরশাদ হয়েছে-
لَهُمْ دَارُ السَّلَامِ عِنْدَ رَبِّهِمْ
‘তাদের প্রতিপালকের কাছে তাদের জন্য রয়েছে সালাম তথা শান্তির নিবাস'।(সূরা আন'আম,আয়াত ১২৭)
জান্নাতে কোনও বেহুদা কথা নেই। সেখানে শোনা যাবে কেবল সালাম। আল্লাহ তা'আলা বলেন-
لَا يَسْمَعُونَ فِيهَا لَغْوًا إِلَّا سَلَامًا
‘সেখানে তারা কোনও অনর্থক কথা শুনবে না। শুনবে কেবল সালাম।'(সূরা মারয়াম, আয়াত ৬২)
মোটকথা ইসলামের এ বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত অভিবাদন তথা সালাম বিনিময় অত্যন্ত কল্যাণকর একটি আমল। এর বহুমুখী কল্যাণ উপলব্ধি করতে পেরে ইহুদি জাতি ঈর্ষান্বিত হয়ে পড়েছিল। তাই তারা সালামকে বিকৃত করত। মুসলিমদের দেখে তারা বিকৃত উচ্চারণে সালাম দিত। বলত اَلسَّامُ عَلَيْكُمْ (তুমি ধ্বংস হও)। তাই নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পূর্ণ উত্তর না দিয়ে কেবল عَلَيْكُمْ বলতে বলেছেন। তারা যে এ বিষয়ে ঈর্ষান্বিত ছিল, সে সম্পর্কে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
مَا حَسَدَتْكُمُ الْيَهُودُ عَلَى شَيْءٍ، مَا حَسَدَتْكُمْ عَلَى السَّلاَمِ وَالتَّأْمِينِ
'সালাম ও আমীন বলার কারণে ইহুদিরা তোমাদের প্রতি যতটা ঈর্ষান্বিত, অতটা ঈর্ষান্বিত অন্য কোনও কারণে নয়।'
(সুনানে ইবন মাজাহ: ৮৫৬; সহীহ ইবনে খুযায়মা : ৫৭৪; বুখারী, আল আদাবুল মুফরাদ : ৯৮৮; মুসনাদে আহমাদ: ২৫০২৯)
এই যে মহান অভিবাদন- সালাম, এটা দেওয়া উচিত প্রতিযোগিতার সঙ্গে। কে আগে দিতে পারে সেই প্রতিযোগিতা। আগে সালাম দেওয়ার জন্য উৎসাহিতও করা হয়েছে। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
إِنَّ أَوْلَى النَّاسِ بِاللَّهِ مَنْ بَدَأَهُمْ بِالسَّلَامِ
'আল্লাহ তা'আলার সর্বাপেক্ষা নিকটতম ব্যক্তি সেই, যে আগে সালাম দেয়।’
(সুনানে আবু দাউদ: ৫১৯৭; জামে তিরমিযী: ২৬৯৪; মুসনাদে আহমাদ: ২২১৯২ )
সালামের রয়েছে বহু আদব। যেমন ছোট বড়কে সালাম দেবে, আরোহী ব্যক্তি পদাতিক ব্যক্তিকে সালাম দেবে, চলমান ব্যক্তি বসে থাকা ব্যক্তিকে সালাম দেবে, ছোট দল বড় দলকে সালাম দেবে ইত্যাদি। যদিও এগুলো আদব, তবে সর্বাবস্থায় আগে সালাম দেওয়াই উত্তম, যেমন উল্লিখিত হাদীছ দ্বারা বোঝা যায়। তাছাড়া সালামের প্রসার ঘটানোর দাবিও তাই।
ইসলামের শিক্ষায় আরেক সালাম আছে, যার ব্যবহার আমরা প্রায় ভুলেই গেছি। তা হল কোনও বিষয়ে কারও সঙ্গে অহেতুক তর্ক-বিতর্ক দেখা দিলে বা ঝগড়া-ফাসাদের উপক্রম ঘটলে তখন নিজেকে তা থেকে মুক্ত রাখার জন্য 'সালাম'-এর আশ্রয় গ্রহণ করা। যেমন বলে দেওয়া- ভাই, সালাম! অর্থাৎ আমি তোমার সঙ্গে তর্কে জড়াতে চাই না। তোমার সঙ্গে এ বিষয় নিয়ে আমার আর কোনও কথা নেই। তুমিও শান্তিতে একো, আমিও শান্তিতে থাকি। কুরআন মাজীদে আল্লাহর নেক বান্দাদের পরিচয় দিতে গিয়ে ইরশাদ হয়েছে-
وَإِذَا خَاطَبَهُمُ الْجَاهِلُونَ قَالُوا سَلَامًا
'এবং অজ্ঞলোক যখন তাদেরকে লক্ষ্য করে (অজ্ঞতাসুলভ) কথা বলে, তখন তারা বলে সালাম।
(সূরা ফুরকান, আয়াত ৬৩)
অর্থাৎ আমরা তোমাদের এসব অজ্ঞতাসুলভ কথার জবাব দিতে চাই না। তোমাদের মন্দ আচরণের বিপরীতে আমরা মন্দ আচরণ করব না। তোমরা ফাসাদ সৃষ্টি করতে চাইলেও আমরা শান্তির পথেই থাকব।
পূর্ববর্তী কিতাবীদের মধ্যে যারা সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল, তাদের কর্মপন্থা ও আদর্শ সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে-
وَإِذَا سَمِعُوا اللَّغْوَ أَعْرَضُوا عَنْهُ وَقَالُوا لَنَا أَعْمَالُنَا وَلَكُمْ أَعْمَالُكُمْ سَلَامٌ عَلَيْكُمْ لَا نَبْتَغِي الْجَاهِلِينَ
'তারা যখন কোনও বেহুদা কথা শোনে, তা এড়িয়ে যায় এবং বলে, আমাদের জন্য আমাদের কর্ম এবং তোমাদের জন্য তোমাদের কর্ম। তোমাদেরকে সালাম। আমরা অজ্ঞদের সাথে জড়িত হতে চাই না।'
(সূরা কাসাস, আয়াত ৫৫)
অর্থাৎ আমরা তোমাদের বেহুদা কথাবার্তায় জড়াব না। তোমাদেরকে গালিও দেব না, কোনও মন্দ কথাও বলব না। তোমাদের কথার কোনও জবাবই দেব না। তোমরা তোমাদের কর্মফল ভোগ করবে, আমরা আমাদের কর্মফল ভোগ করব। তোমাদের সঙ্গে আমাদের কোনও সম্পর্ক নেই।
মূর্তিপুজার বিরোধিতা করার কারণে হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামকে যখন তাঁর পিতা পাথর মেরে হত্যা করার হুমকি দিয়েছিল এবং তাঁকে চিরদিনের জন্য পরিত্যাগ করার ঘোষণা দিয়েছিল, তখন ইবরাহীম আলাইহিস সালাম তাকে লক্ষ্য করে বলেছিলেন-
سَلَامٌ عَلَيْكَ
'আপনার প্রতি (বিদায়ী) সালাম’। (সূরা মারয়াম, আয়াত ৪৭)
অর্থাৎ আমি আপনার সঙ্গে বিবাদ করতে চাই না। আপনি আমাকে যতই কষ্ট দেন না কেন, আমি আপনাকে কোনও কষ্ট দেব না। আমার পক্ষ থেকে আপনি নিরাপদেই থাকবেন।
মক্কার কাফেরদের অহেতুক বিতণ্ডার ক্ষেত্রে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইছি ওয়াসাল্লামকে তাঁর করণীয় সম্পর্কে নির্দেশনা দিতে গিয়ে আল্লাহ তা'আলা বলেন-
فَاصْفَحْ عَنْهُمْ وَقُلْ سَلَامٌ
'সুতরাং (হে রাসূল!) তুমি তাদেরকে অগ্রাহ্য করো এবং বলে দাও, সালাম।(সূরা যুখরুফ, আয়াত ৮৯)
অর্থাৎ তোমাদের সঙ্গে আমার কোনও সম্পর্ক নেই। তোমাদের পথ ও আমার পথ সম্পূর্ণ ভিন্ন। কিয়ামতেই ফয়সালা হবে কার পথ সত্য।
এ সালাম শান্তি রক্ষার সালাম। অহেতুক তর্ক-বিতর্ক ও অর্থহীন ঝগড়া-ফাসাদ ইসলামে পসন্দনীয় নয়। সেরকম কোনও আশঙ্কা দেখা দিলে ইসলাম আমাদেরকে সালামের ঢাল ব্যবহার করতে বলেছে। অর্থাৎ সালাম দিয়ে প্রতিপক্ষ হতে নিজেকে সরিয়ে নিতে বলা হয়েছে। ইসলামের এ শিক্ষা অনুসরণ করলে পারিবারিক ও সামাজিক হাজারও কলহ-কোন্দল থেকে আমরা বেঁচে যেতে পারি।
উল্লেখ্য, সালাম ইসলামের নিদর্শন। মুসলিমসমাজে এখনও পর্যন্ত এ নিদর্শন টিকে আছে। ইসলামী সংস্কৃতির অনেক কিছুই অধিকাংশ মানুষ ভুলে গেছে। তবে যারা সেসব ভুলে গেছে, তাদেরও অনেকে সালামের আমলটি করে থাকে। হাঁ, এ আমলটি এমন, যা মুসলিম মাত্রেরই ধরে রাখা প্রয়োজন ছিল। কথা তো ছিল প্রত্যেক মুসলিমগৃহে ছোট- বড়, নারী-পুরুষ প্রত্যেকেই সালাম দেওয়া-নেওয়ায় অভ্যস্ত থাকবে। সালামের যতগুলো প্রয়োগক্ষেত্র আছে, তার প্রত্যেকটিতেই প্রত্যেকে আগ্রহভরে সালাম দেবে। কিন্তু আফসোস হল, সালাম ঠিক সেইভাবে আজ আমাদের সমাজে প্রচলিত নয়। এ অবহেলার কুফলও আজ আমাদের ভোগ করতে হচ্ছে। বর্তমানকালে যে ঘরে-বাইরে সর্বত্র অশান্তি, মানুষ জান-মাল ও ইজ্জতের নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে, পারস্পরিক ঐক্য ও সম্প্রীতি ভেঙে চূর্ণ-বিচূর্ণ, এর এক অন্যতম কারণ কি এইও নয় যে, আমরা সালাম দেওয়া-নেওয়ার রেওয়াজ নষ্ট করে ফেলেছি? না ঘরের ভেতর সালামের ব্যাপক চর্চা আছে, না ঘরের বাইরে। শান্তিবাহী সালামের স্থানে অন্যদের কৃষ্টি-সংস্কৃতির ব্যাপকতা লাভ করেছে। এরই ভোগান্তি পোহাচ্ছি আমরা সর্বত্র। এ ভোগান্তি থেকে মুক্তির উপায় একটাই- সব ক্ষেত্রে ইসলামী তাহযীব ও সংস্কৃতির প্রতিষ্ঠাদান। সালামের রেওয়াজদানও তার একটি প্রধান অঙ্গ।
পরিচ্ছেদ: ১
সালামের ফযীলত ও সালামের রেওয়াজদানের আদেশ
'সালামের ফযীলত...' সম্পর্কিত কিছু আয়াত
• এক নং আয়াত
يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَدْخُلُوا بُيُوتًا غَيْرَ بُيُوتِكُمْ حَتَّى تَسْتَأْنِسُوا وَتُسَلِّمُوا عَلَى أَهْلِهَا
অর্থ : হে মুমিনগণ! নিজ গৃহ ছাড়া অন্যের গৃহে প্রবেশ করো না, যতক্ষণ না অনুমতি গ্রহণ কর ও তার বাসিন্দাদেরকে সালাম দাও। (সূরা নূর, আয়াত ২৭)
ব্যাখ্যা
এ আয়াতে অন্যের ঘরে প্রবেশকালে অনুমতি নেওয়া ও সালাম দেওয়ার হুকুম করা হয়েছে। অনুমতি ছাড়া এবং সালাম না দিয়ে অন্যের ঘরে প্রবেশ করা যাবে না। অন্যের ঘর বলতে এমন ঘর বোঝানো উদ্দেশ্য, যে ঘরে অন্য কেউ থাকে। তার মানে কেউ যদি নিজ ঘর অন্যকে ভাড়া দেয়, তবে যাকে ভাড়া দিল তার অনুমতি ছাড়া সে নিজেও ওই ঘরে প্রবেশ করতে পারবে না।
অনুমতি গ্রহণ বোঝানোর জন্য আয়াতে শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে تستأنسوا (অনুমতি গ্রহণ কর)। শব্দটির উৎপত্তি الأنس থেকে। এর অর্থ প্রীতি, পসন্দ, পরিচিতি, সৌজন্য, বন্ধুত্ব ইত্যাদি। অনুমতি গ্রহণের অর্থে এই মূলধাতু থেকে উৎপন্ন تستأنسوا শব্দটির ব্যবহার খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। কেননা অন্যের গৃহে অনুমতি ছাড়া প্রবেশ করাটা সৌজন্য ও ভদ্রতার পরিপন্থি। গৃহবাসী এটা পসন্দ করে না। সে এতে বিরক্তি বোধ করে। অনুমতি চাইলে প্রথমে গৃহবাসী তাকে চিনতে পারে। সে তার ভদ্রতার পরিচয় পেয়ে তার প্রতি আগ্রহবোধ করে এবং খুশিমনে তাকে প্রবেশ করতে অনুমতি দেয়। ফলে উভয়ের মধ্যে সুসম্পর্ক ও বন্ধুত্ব গড়ে ওঠার পথ তৈরি হয়।
আয়াতে অন্যের ঘরে প্রবেশকালে দু'টি কাজ করতে বলা হয়েছে। এক তো হল অনুমতি চাওয়া। আর দ্বিতীয় হল গৃহবাসীকে সালাম দেওয়া। বোঝা গেল কেবল অনুমতি চাওয়াই যথেষ্ট নয়, সালামও দিতে হবে। প্রশ্ন হচ্ছে, আগে কোনটি করবে? সলাম দেবে তারপর অনুমতি চাবে, নাকি আগে অনুমতি চেয়ে তারপর সালাম দেবে? আয়াতে আগে অনুমতি চাওয়ার উল্লেখ আছে। তাই কেউ কেউ বলেন, প্রথম কাজ অনুমতি চাওয়া। কিন্তু ব্যাকরণের নিয়ম অনুযায়ী আগে উল্লেখের দ্বারা আগে করার প্রতি নির্দেশ হয় না। সংযোজক অব্যয় 'و' (ওয়াও) এর দ্বারা কেবল দু'টি বিষয়কে একত্র করা হয়। এর দ্বারা তারতীব বা পর্যায়ক্রম বোঝানো উদ্দেশ্য হয় না। অধিকাংশ আলেমের মতে নিয়ম হল আগে সালাম দেওয়া, তারপর অনুমতি চাওয়া। এর সপক্ষে তারা হাদীছ উল্লেখ করেন যে, একবার এক সাহাবী নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট প্রবেশ করলেন। কিন্তু তিনি সালামও দিলেন না, অনুমতিও চাইলেন না। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন-
ارْجِعْ فَقُلْ : السَّلَامُ عَلَيْكُمْ، أَأَدْخُل ؟
'তুমি ফিরে যাও এবং বলো- আসসালামু আলাইকুম, আমি কি প্রবেশ করতে পারি?’
(জামে' তিরমিযী : ২৭১০; সুনানে আবু দাউদ: ৫১৭৬; বুখারী, আল আদাবুল মুফরাদ: ১০৮১; নাসাঈ, আস সুনানুল কুবরা : ৬৭০২; ইবনুস সুন্নী, আমালুল ইয়াওমি ওয়াল লায়লা :৬৬৪; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা: ১৭৬৬৬)
হযরত জাবির রাযি. থেকে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
لَا تَأْذَنُوا لِمَنْ لَمْ يَبْدَأُ بِالسَّلَامِ
'তোমরা তাকে অনুমতি দেবে না, যে প্রথমে সালাম দেবে না।'
(বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান : ৮৪৩৩; মুসনাদে আবূ ইয়া'লা : ১৮০৯)
মোটকথা, অন্যের ঘরে বা কক্ষে প্রবেশকালে অবশ্যই সালাম দিয়ে অনুমতি নিতে হবে, তাতে সে ব্যক্তি যতই কাছের বা যতই প্রিয় হোক, এমনকি নিজ পিতা-মাতা বা ছেলেমেয়েও যদি হয়।
আয়াতটির শিক্ষা
অন্যের ঘরে প্রবেশকালে সালাম দিয়ে অনুমতি নেওয়া জরুরি।
• দুই নং আয়াত
فَإِذَا دَخَلْتُمْ بُيُوتًا فَسَلِّمُوا عَلَى أَنْفُسِكُمْ تَحِيَّةً مِنْ عِنْدِ اللَّهِ مُبَارَكَةً طَيِّبَةً
অর্থ: যখন তোমরা ঘরে ঢুকবে নিজেদেরকে সালাম করবে, কারণ এটা সাক্ষাতের জন্য আল্লাহর পক্ষ হতে প্রদত্ত বরকতপূর্ণ ও পবিত্র দু'আ। (সূরা নূর, আয়াত ৬১)
ব্যাখ্যা
এ আয়াতে যে-কোনও ঘরে প্রবেশকালে সালাম দিতে বলা হয়েছে। অন্যের ঘরে তো বটেই, এমনকি নিজ ঘরেও। এমনকি ঘরে যদি কেউ নাও থাকে, তবুও সালাম দেবে। বলা হয়েছে- فَسَلِّمُوا عَلَى أَنْفُسِكُمْ (নিজেদেরকে সালাম করবে)। ঘরে কেউ না থাকলে সে সালাম তো নিজেকেই দেওয়া হল। আর যদি কেউ থাকে, তবে তারে দেওয়াটা নিজেকেই দেওয়া, যেহেতু সে নিজেরই লোক। সে আত্মীয় না হলেও নিজের লোক। কারণ দুনিয়ার সব মুসলিম ভাই ভাই। ঘরে লোক থাকলে তখন তো আসসালামু আলাইকুম বলবে। আর কেউ না থাকলে বলবে- السَّلَامُ عَلَيْنَا وَعَلَى عِبَادِ اللَّهِ الصَّالِحِينَ (সালাম আমাদের প্রতি এবং আল্লাহর সৎকর্মশীল বান্দাদের প্রতি)।
নিজ ঘরে প্রবেশকালে সালাম দেওয়ার কথা হাদীছেও স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত আনাস ইবন মালিক রাযি.-কে উপদেশ দেন-
يَا بُنَيَّ, إِذَا دَخَلْتَ عَلَى أَهْلِكَ فَسَلِّمْ يَكُونُ بَرَكَةً عَلَيْكَ وَعَلَى أَهْلِ بَيْتِكَ
'হে বাছা! তুমি যখন তোমার পরিবারের নিকট প্রবেশ করবে, তখন সালাম দেবে। তাতে তোমার ও তোমার পরিবারের উপর বরকত হবে।’
(জামে' তিরমিযী: ২৬৯৮; খারাইতী, মাকারিমুল আখলাক: ৮৪৬; তাবারানী, আল মু'জামুল আওসাত: ৫৯৯১; বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান: ৮৩৮৬)
সালাম দেওয়াটা ঘরে প্রবেশের এক গুরুত্বপূর্ণ আদব। কেবল অনুমতি চাওয়ার রেওয়াজ অন্য ধর্মেও আছে। কিন্তু সালামের দ্বারা অনুমতি চাওয়া ইসলামেরই বৈশিষ্ট্য। এটা সরাসরি আল্লাহ তা'আলার পক্ষ থেকে শিক্ষা। আল্লাহ তা'আলা বলেন- تَحِيةً مِنْ عند الله (কারণ এটা সাক্ষাতের জন্য আল্লাহর পক্ষ হতে প্রদত্ত দু'আ)। تَحِيّة এর প্রকৃত অর্থ দীর্ঘ জীবনের জন্য দু'আ করা। এর মধ্যে ইঙ্গিত রয়েছে, সালাম বিনিময়ের দ্বারা হায়াতে বরকত হয়। বাক্যটির অর্থ এরকম হতে পারে যে, এ সালাম আল্লাহ তা'আলার পক্ষ থেকে প্রদত্ত অভিবাদন। অর্থাৎ এটা কারও মনগড়া নিয়ম নয়; বরং আল্লাহ তা'আলা নিজেই তোমাদের এ নিয়ম শিক্ষা দিয়েছেন। বলাবাহুল্য আল্লাহ তা'আলা বন্দাকে যে নিয়ম শিক্ষা দেন তা প্রভৃত কল্যাণকর হয়ে থাকে। গৃহে প্রবেশকালীন এ নিয়মও তার ব্যতিক্রম নয়। আল্লাহ তা'আলা বলেন-
مُبَارَكَةً طَيِّبَةً (বরকতপূর্ণ ও পবিত্র)। অর্থাৎ সালাম দেওয়ার দ্বারা বান্দা বরকত ও কল্যাণের অধিকারী হয়। এতে অন্তর হিংসা-বিদ্বেষ ও শত্রুতা থেকে মুক্ত ও পবিত্র হয়। যাকে সালাম দেওয়া হয় সে খুশি হয়। এভাবে এর দ্বারা পরস্পরের মধ্যে সম্প্রীতি জন্মায়। হযরত আনাস রাযি. থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে লক্ষ্য করে বলেন-
يَا أَنسُ، إِذَا دَخَلْتَ بَيْتَكَ فَسَلِّمْ عَلَى أَهْلِكَ يَكْثُرْ خَيْرُ بَيْتِكَ
'হে আনাস! যখন ঘরে প্রবেশ করবে, তখন তোমার পরিবারকে সালাম দেবে। এতে তোমার ঘরের কল্যাণ বৃদ্ধি পাবে।'
(বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান : ৮৩৮৬; খারাইতী, মাকারিমুল আখলাক : ৮৪৬)
আয়াতের শব্দাবলির প্রতি লক্ষ করে কেউ কেউ ঘরে প্রবেশকালীন সালামের বাক্য এরূপ বলেছেন-
السَّلَامُ عَلَيْكُمْ تَحِيَّة مِنْ عِنْدِااللهِ مُبَارَكَةً طَيِّبة
আয়াতটির শিক্ষা
ক. নিজের বা অন্যের যে-কারও ঘরে প্রবেশকালে সালাম দেওয়া চাই।
খ. খালিঘরে প্রবেশকালেও সালাম দেবে।
গ. সালামের বিধান আল্লাহপ্রদত্ত, কারও মনগড়া নয়।
ঘ. সালাম দ্বারা ঘরে বরকত ও কল্যাণ হয়।
ঙ. সালাম দেওয়ার দ্বারা হায়াতেও বরকত হয়।
চ. সালাম পারস্পরিক সদ্ভাব ও আন্তরিকতা সৃষ্টিতে সহায়ক।
• তিন নং আয়াত
وَإِذَا حُيِّيْتُمْ بِتَحِيَّةٍ فَحَيُّوا بِأَحْسَنَ مِنْهَا أَوْ رُدُّوهَا
অর্থ: যখন কেউ তোমাদেরকে সালাম করে, তখন তোমরা (তাকে) তদপেক্ষা উত্তমরূপে সালাম দিয়ো কিংবা (অন্ততপক্ষে) সেই শব্দেই তার জবাব দিয়ো।
(সূরা নিসা, আয়াত ৮৬)
ব্যাখ্যা
এ আয়াতে সালামের জবাব দেওয়ার নিয়ম শেখানো হয়েছে। উত্তম হল সালাম অপেক্ষা সালামের জবাব উৎকৃষ্ট হওয়া। অর্থাৎ সালামদাতা সালামে যে পরিমাণ শব্দ ব্যবহার করবে, জবাবদাতা তারচে' বেশি শব্দ ব্যবহার করবে।
যেমন সালামদাতা যদি বলে السَّلَامُ عَلَيْكُمْ , তবে জবাবদাতা বলবে وَعَلَيْكُمُ السَّلَامُ وَرَحْمَةُ اللَّهِ যদি বলে السَّلامُ عَلَيْكُمْ وَرَحْمَةُ الله তবে জবাবে বলবে وَعَلَيْكُمُ السَّلَامُ وَرَحْمَةُ اللهِ وَبَرَكَاتُهُ
এটাই শেষ সীমা। এরপর সালামের আর কোনও শব্দ নেই। কোনও কোনও বর্ণনায় এরপর وَمَغْفرته শব্দেরও উল্লেখ আছে। তবে সে বর্ণনা সহীহ নয়। তা বলা থেকে বিরত থাকাই সঙ্গত। একবার হযরত আব্দুল্লাহ ইবন উমর রাযি.-এর নিকট এক ব্যক্তি এসে وَمَغْفِرَتُهُ -যোগে সালাম দিয়েছিল। হযরত ইবন উমর রাযি. তাকে ধমক দিয়ে বললেন, وَبَرَكَاتُهُ পর্যন্ত বলাটাই তোমার জন্য যথেষ্ট।
(বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান: ৮৪৯০)
হযরত আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাযি. বলেন, সবকিছুর একটা সীমা আছে। সালামের সীমা হল وَبَرَكَاتُهُ।
(বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান: ৮৪৮৯)
একবার হযরত ইবন আব্বাস রাযি.-এর কাছে এসে এক ব্যক্তি وَبَرَكَاتُهُ এর পর আরও কয়েকটি শব্দ। যোগ করে সালাম দিলে হযরত ইবন আব্বাস রাযি. বললেন, এটা কেমন সালাম? রাগে তাঁর চেহারা লাল হয়ে গেল। তিনি বললেন, আল্লাহ তা'আলা সালামের একটা সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছেন। সে সীমা অতিক্রম করতে নিষেধ করেছেন। এই বলে তিনি পাঠ করলেন -
رَحْمَتُ اللهِ وَبَرَكْتُهُ عَلَيْكُمْ أَهْلَ الْبَيْتِ
‘হে গৃহবাসী! তোমাদের প্রতি আল্লাহর রহমত ও তাঁর বরকত’।
( সূরা হুদ, আয়াত ৭৩)(বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান : ৮৪৮৮)
উল্লিখিত সীমার ভেতর যে যত বেশি শব্দ ব্যবহার করবে, সে ততো বেশি ছাওয়াব পাবে। একবার এক ব্যক্তি নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট উপস্থিত হয়ে সালাম দিল السَّلَامُ عَلَيْكُم তিনি তার উত্তর দিলে বললেন- দশ। অর্থাৎ দশ একী হল। সে ব্যক্তি বসে গেল। তারপর আরেক ব্যক্তি এসে সালাম দিল السَّلَامُ عَلَيْكُمُ وَرَحْمَةُ اللَّهِ । তিনি তার জবাব দিয়ে বললেন- বিশ। সেও বসে গেল। তারপর আরেক ব্যক্তি এসে সালাম দিল السَّلامُ عَلَيْكُمْ وَرَحْمَةُ الله وبركاته। তিনি তার জবাব দিয়ে বললেন- ত্রিশ।
(জামে' তিরমিযী: ২৬৮৯; সুনানে আবু দাউদ: ৫১৯৫; সুনানে দারিমী: ২৬৮২; বুখারী, আল আদাবুল মুফরাদ: ৯৮৬; মুসনাদুল বাযযার: ৩৫৮৮; নাসাঈ, আস সুনানুল কুবরা : ১০০৯৭; সহীহ ইবনে হিব্বান : ৪৯৩; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর: ৫৫৬৩; বায়হাকী, শু'আবুলঈমান: ৮৪৮৪)
আয়াতটির শিক্ষা
সালামের জবাব দেওয়া ওয়াজিব। তবে সালাম অপেক্ষা অতিরিক্ত শব্দে জবাব দেওয়া মুস্তাহাব।
• চার নং আয়াত
هَلْ أَتَاكَ حَدِيثُ ضَيْفِ إِبْرَاهِيمَ الْمُكْرَمِينَ (24) إِذْ دَخَلُوا عَلَيْهِ فَقَالُوا سَلَامًا قَالَ سَلَامٌ
অর্থ : (হে রাসূল!) তোমার কাছে কি ইবরাহীমের সম্মানিত অতিথিদের বৃত্তান্ত পৌছেছে? যখন তারা ইবরাহীমের কাছে উপস্থিত হয়ে বলল 'সালাম', তখন ইবরাহীমও বলল 'সালাম'।
(সূরা যারিয়াত, আয়াত ২৪, ২৫)
ব্যাখ্যা
এ আয়াতদু'টি সূরা যারিয়াতের। একবার হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামের কাছে মানুষের আকৃতিতে কয়েকজন ফিরিশতা আগমন করেন। অতিথি হিসেবে ইবরাহীম আলাইহিস সালামের পক্ষ থেকে তাদের সেবাযত্নে মনোযোগী থাকেন। তখন তাদের মধ্যে যা যা ঘটেছিল, এ সূরায় তার একটা অংশ বর্ণিত হয়েছে। তারই খানিকটা রয়েছে এ আয়াতদু'টিতে। প্রথমে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে লক্ষ্য করে বলা হয়েছে-
هَلْ أَثْكَ حَدِيثُ ضَيْفِ إِبْرَاهِيمَ الْمُكْرَمِينَ ‘(হে রাসূল!) সম্মানিত অতিথিদের বৃত্তান্ত পৌঁছেছে'? এ প্রশ্নটি স্বীকৃতিমূলক। বোঝানো হয়েছে, তাদের বৃত্তান্ত তোমার কাছে অবশ্যই এসেছে। তুমি তাদের সম্পর্কে জান। এর দ্বারা দে বৃত্তান্তের গুরুত্ব তুলে ধরা উদ্দেশ্য। এর দ্বারা বোঝা যাচ্ছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লআহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এর আগে আরও ওহী এসেছে।
আয়াতে হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামের অতিথিদেরকে المكرمين বিশেষণে বিশেষিত করা হয়েছে। এর অর্থ সম্মানিত। ফিরিশতাগণ সম্মানিত এ কারণে যে, তারা কোনও গুনাহ করেন না। তারা আল্লাহ তা'আলার হুকুম পালন করেন এবং তাঁর মহিমা ও গৌরব বর্ণনায় রত থাকেন। আবার হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম কর্তৃকও তারা সম্মানিত হয়েছিলেন। তিনি জানতেন না তারা ফিরিশতা। তথাপি অতিথি হিসেবে তিনি তাদেরকে সম্মান করেছিলেন। তিনি নিজে ও তাঁর স্ত্রী তাদের সেবাযত্ন করেছিলেন।
ফিরিশতাগণ তাঁর ঘরে প্রবেশকালে বললেন- سَلَامًا (সালাম)। বোঝা গেল কারও ঘরে প্রবেশকালে সালাম দিতে হয়। এখানে আরবী শব্দটি হল سَلَامًا । এটি ক্রিয়াপ্রধান বাক্য। এর মূল রূপ হল نُسَلِّمُكَ سَلَامًا (আমরা আপনাকে সালাম দিচ্ছি)। এর উত্তরে হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম বললেন-
سَلَام (সালাম)। তিনি উত্তরে ব্যবহার করলেন বিশেষ্যপ্রধান বাক্য। কেননা سَلَام এর প্রকৃত রূপ হল سَلَامٌ عَلَيْكُمْ (আপনাদের প্রতিও সালাম)। ক্রিয়াপ্রধান বাক্য ক্ষণস্থায়িত্বের। অর্থ দেয় আর বিশেষপ্রধান বাক্য স্থায়িত্বের অর্থ দেয়। এ হিসেবে ফিরিশতাদের সালাম অপেক্ষা হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামের উত্তর উৎকৃষ্ট হয়েছে। জবাব দেওয়ার ক্ষেত্রে এদিকে লক্ষ রাখা ভালো। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে-
وَإِذَا حُيِّيْتُمْ بِتَحِيَّةٍ فَحَيُّوا بِأَحْسَنَ مِنْهَا أَوْ رُدُّوهَا
'যখন কেউ তোমাদেরকে সালাম করে, তখন তোমরা (তাকে) তদপেক্ষাও উত্তমরূপে সালাম দিয়ো কিংবা (অন্ততপক্ষে) সেই শব্দেই তার জবাব দিয়ো’। (সূরা নিসা, আয়াত ৮৬)
আয়াতের শিক্ষা
ক. মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উম্মী হওয়া সত্ত্বেও কুরআনের মাধ্যমে প্রাচীনকালের নবী হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামের বৃত্তান্ত আমাদেরকে অবহিত করেছেন। এটা প্রমাণ করে কুরআন আল্লাহর বাণী এবং তিনি আল্লাহর নবী।
খ. অতিথি সম্মানযোগ্য। তার প্রতি সম্মানজনক আচরণ করা কর্তব্য।
গ . ফিরিশতাগণ আল্লাহ তা'আলার সম্মানিত সৃষ্টি। তারা আকৃতি বদল করতে পারেন।
ঘ. অন্যের গৃহে প্রবেশকালে সালাম দেওয়া অবশ্যকর্তব্য।
ঙ. সালাম অপেক্ষা সালামের জবাব উত্তম হওয়া কাম্য।
মানুষ সামাজিক জীব। সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কারও পক্ষেই একা চলা সম্ভব নয়। নানা প্রয়োজনে প্রত্যেককে অন্যের সঙ্গে মেলামেশা করতেই হয়। ফলে প্রতিদিনই প্রত্যেকের অন্যের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করতে হয়। ইচ্ছাকৃত তো বটেই, অনিচ্ছাবশতও নানা অনুষঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ হয়েই যায়। একের সঙ্গে যখন অন্যের সাক্ষাৎ হয়, তখন সভ্য ও ভদ্র লোকদের প্রথম কাজ হয় অভিবাদন করা। সাক্ষাৎকালে একে অন্যের প্রতি সম্মান-স্নেহ ও ভক্তি-ভালোবাসা প্রকাশের জন্য যে বিশেষ রীতি পালন করা হয় সেটাই অভিবাদন। একেক জাতির অভিবাদন একেক রকম। কেউ শুভ সকাল, শুভ সন্ধ্যা ইত্যাদি বলে। কেউ নমস্কার করে। কেউ মাথা ঝোঁকায়। এক কালে তো রাজা- বাদশাদেরকে অভিবাদনস্বরূপ সিজদাও করা হত। প্রত্যেক জাতিরই অভিবাদনের বিশেষ এক রীতি আছে।
ইসলামে সমাজজীবন অতীব গুরুত্বপূর্ণ। এটা সর্বশেষ দীন। পরিপূর্ণ দীন। জীবন সম্পর্কিত প্রতিটি বিষয়ে ইসলামের রয়েছে সুস্পষ্ট ও পরিপূর্ণ শিক্ষা। ইসলাম তার অনুসারীদের অভিবাদন বিষয়ে যে শিক্ষা দিয়েছে, তা সকল জাতির অভিবাদন অপেক্ষা উত্তম, সারগর্ভ ও কল্যাণকর। ইসলামের অভিবাদন হল السَّلَامُ عَلَيْكُمْ । এর জবাব ا وَعَلَيْكُمُ السَّلَامُ
اَلسَّلامُ আল্লাহ তা'আলার মহান নামসমূহের একটি। এর অর্থ শান্তি ও নিরাপত্তাদাতা। اَلسَّلَامُ عَلَيْكُمْ বলার দ্বারা যেন দু'আ করা হয়- আল্লাহ তা'আলা তোমাদের হেফাজত করুন, তোমাদেরকে শান্তি ও নিরাপত্তা দান করুন। তোমাদের প্রতি আল্লাহ তা'আলার এ নামের বরকত নাযিল হোক।
السّلام শব্দের অর্থ শান্তি, মুক্তি, নিরাপত্তা। সালাম দেওয়ার দ্বারা দু'আ করা হয়- তোমরা সকল অনিষ্ট ও অমঙ্গল থেকে নিরাপদ থাকো। এটা এক চমৎকার দু'আ। মানবজীবনে সবচে' বেশি প্রয়োজন অনিষ্ট ও ক্ষতি থেকে নিরাপত্তা। জান, মাল ও ইজ্জতের নিরাপত্তা। কারও যদি সবই থাকে কিন্তু নিরাপত্তা না থাকে, তবে সব থাকার কোনও সার্থকতা তার জীবনে থাকে না। অপরদিকে কারও যদি খুব বেশি কিছু না থাকে কিন্তু নিরাপত্তা থাকে, তবে তার জীবন বড় সুখের, বড় শান্তির। সালাম দেওয়ার উদ্দেশ্য সালামদাতার পক্ষ থেকে উদ্দিষ্ট ব্যক্তিকে নিরাপত্তা দেওয়াও বটে। যেন বলা হয়, আমার দিক থেকে তুমি কোনও ক্ষতির আশঙ্কা করো না। তুমি নিশ্চিন্তে আমার সামনে আসতে পার। তুমি নির্ভয়ে আমাকে তোমার কাছে যেতে দিতে পার। এভাবে সালাম বিনিময় পারস্পরিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। এভাবে সালামের রেওয়াজদান সামাজিক নিরাপত প্রতিষ্ঠার এক শ্রেষ্ঠ উপায়। এক হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
أَفْشُوا السَّلَامَ تَسْلَمُوا
'তোমরা সালামের প্রসার ঘটাও, নিরাপদ থাকবে।'
(মুসনাদে আহমাদ: ১৮৫৩০; বুখারী, আল-আদাবুল মুফরাদ: ৭৮৭; সহীহ ইবন হিব্বান: ৪৯১; বায়হাকী, শুআবুল ঈমান: ৮৩৮২; মুসনাদ আবূ ইয়া'লা : ১৬৮৭)
সালাম দেওয়ার দ্বারা যে নিরাপত্তার আশ্বাসবাণী শোনানো হয়, তা অন্তরে ভালোবাসার বীজ বপন করে। উভয়পক্ষ থেকে সালাম বিনিময়ের দ্বারা একজন আরেকজনের কাছাকাছি চলে আসে। ক্রমে সম্পর্ক গভীর হতে থাকে। এর দ্বারা পূর্ববিদ্বেষ দূর হয়ে যায়। শত্রু বন্ধুতে পরিণত হয়। পারস্পরিক সম্প্রীতি ও বন্ধুত্ব ইসলামে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ইসলাম যে চারিত্রিক শিক্ষাদান করে, তার মধ্যে ভালোবাসা ও সম্প্রীতি অতীব গুরুত্বপূর্ণ। পরস্পরের মধ্যে যা-কিছু দ্বারা ভালোবাসা সৃষ্টি হয়, ইসলাম সেসব করার প্রতি বিশেষভাবে উৎসাহদান করেছে। যেমন হাদিয়া বিনিময় করা ও খাবার খাওয়ানো। সালাম বিনিময়ও অনুরূপ একটি কাজ। এমনিভাবে যেসব কাজ দ্বারা সম্পর্ক নষ্ট হয় এবং বিদ্বেষ ও শত্রুতা সৃষ্টি হয়, ইসলাম তা নিষিদ্ধ করেছে। যেমন গীবত করা, চুগলখোরী করা, অন্যের দোষ খুঁজে বেড়ানো, অন্যের প্রতি অহমিকাপূর্ণ আচরণ ইত্যাদি।
সালাম বিনয়ের পরিচায়ক। বেশি বেশি সালাম দেওয়ার দ্বারা অন্তর থেকে অহমিকা দূর হয়ে যায়। তদস্থলে বিনয়স্বভাব দৃঢ়তা লাভ করে। বিনয় সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠায় বিশেষ ভূমিকা রাখে। কাজেই অন্তরে বিনয় আনয়ন ও সামাজিক সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সালামের ব্যাপক বিস্তার জরুরি। তাই হাদীছে কেবল সালাম দেওয়া নয়; বরং সালামের প্রসার ঘটাতে বলা হয়েছে।
বস্তুত সালাম মুমিনদের দুনিয়া ও আখিরাত উভয় জীবনের অবিচ্ছেদ্য অনুষঙ্গ। মুমিনদেরকে কেবল মুমিনরাই সালাম দেয় না; তাদেরকে সালাম দেয় ফিরিশতাগণও। শবে কদরে তো একদল ফিরিশতা কেবল সালাম দেওয়ার কাজেই নিয়োজিত থাকে। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে-
تَنَزَّلُ الْمَلَائِكَةُ وَالرُّوحُ فِيهَا بِإِذْنِ رَبِّهِمْ مِنْ كُلِّ أَمْرٍ (4) سَلَامٌ هِيَ حَتَّى مَطْلَعِ الْفَجْرِ (5)
'সে রাতে ফিরিশতাগণ ও রূহ প্রত্যেক কাজে তাদের প্রতিপালকের অনুমতিক্রমে অবতীর্ণ হয়। তারা বলে সালাম, এটা ফজরের আবির্ভাব পর্যন্ত’।(সূরা কদর, আয়াত ৪, ৫)
আমরা শ্রেষ্ঠতম ইবাদত নামাযের সমাপ্তি তো সালাম দ্বারাই করি। তাতে ইমাম মুক্তাদীর প্রতি, মুক্তাদী ইমামের প্রতি এবং সেইসঙ্গে ফিরিশতাদের প্রতিও সালাম দেওয়া হয়। 'আত-তাহিয়্যাতু'-এর ভেতর সালাম জানানো হয় নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি এবং সমস্ত নেককার মুমিনদের প্রতি।
জান্নাতে মুমিনদের পারস্পরিক অভিবাদন হবে এ সালাম। ইরশাদ হয়েছে-
تَحِيَّتُهُمْ يَوْمَ يَلْقَوْنَهُ سَلَامٌ
'যেদিন তারা তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করবে, সেদিন তাদের অভিবাদন হবে সালাম।
(সূরা আহযাব, আয়াত ৪৪)
জান্নাতে ফিরিশতাগণও সালাম দিয়ে অভিবাদন জানাবে। ইরশাদ হয়েছে-
وَالْمَلَائِكَةُ يَدْخُلُونَ عَلَيْهِمْ مِنْ كُلِّ بَابٍ (23) سَلَامٌ عَلَيْكُمْ بِمَا صَبَرْتُمْ فَنِعْمَ عُقْبَى الدَّارِ (24)
'আর (তাদের অভ্যর্থনার জন্য) ফিরিশতাগণ তাদের নিকট প্রত্যেক দরজা দিয়ে প্রবেশ করবে (আর বলতে থাকবে-) তোমরা (দুনিয়ায়) যে সবর অবলম্বন করেছিলে, তার বদৌলতে এখন তোমাদের প্রতি সালাম (শান্তিই বর্ষিত হবে) এবং (তোমাদের) প্রকৃত নিবাসে এটা কতইনা উৎকৃষ্ট পরিণাম।'
(সূরা রা'দ, আয়াত ২৩, ২৪)
জান্নাত তো সালাম তথা শান্তির নিবাস। জান্নাতের এক নামই দারুস-সালাম। ইরশাদ হয়েছে-
لَهُمْ دَارُ السَّلَامِ عِنْدَ رَبِّهِمْ
‘তাদের প্রতিপালকের কাছে তাদের জন্য রয়েছে সালাম তথা শান্তির নিবাস'।(সূরা আন'আম,আয়াত ১২৭)
জান্নাতে কোনও বেহুদা কথা নেই। সেখানে শোনা যাবে কেবল সালাম। আল্লাহ তা'আলা বলেন-
لَا يَسْمَعُونَ فِيهَا لَغْوًا إِلَّا سَلَامًا
‘সেখানে তারা কোনও অনর্থক কথা শুনবে না। শুনবে কেবল সালাম।'(সূরা মারয়াম, আয়াত ৬২)
মোটকথা ইসলামের এ বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত অভিবাদন তথা সালাম বিনিময় অত্যন্ত কল্যাণকর একটি আমল। এর বহুমুখী কল্যাণ উপলব্ধি করতে পেরে ইহুদি জাতি ঈর্ষান্বিত হয়ে পড়েছিল। তাই তারা সালামকে বিকৃত করত। মুসলিমদের দেখে তারা বিকৃত উচ্চারণে সালাম দিত। বলত اَلسَّامُ عَلَيْكُمْ (তুমি ধ্বংস হও)। তাই নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পূর্ণ উত্তর না দিয়ে কেবল عَلَيْكُمْ বলতে বলেছেন। তারা যে এ বিষয়ে ঈর্ষান্বিত ছিল, সে সম্পর্কে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
مَا حَسَدَتْكُمُ الْيَهُودُ عَلَى شَيْءٍ، مَا حَسَدَتْكُمْ عَلَى السَّلاَمِ وَالتَّأْمِينِ
'সালাম ও আমীন বলার কারণে ইহুদিরা তোমাদের প্রতি যতটা ঈর্ষান্বিত, অতটা ঈর্ষান্বিত অন্য কোনও কারণে নয়।'
(সুনানে ইবন মাজাহ: ৮৫৬; সহীহ ইবনে খুযায়মা : ৫৭৪; বুখারী, আল আদাবুল মুফরাদ : ৯৮৮; মুসনাদে আহমাদ: ২৫০২৯)
এই যে মহান অভিবাদন- সালাম, এটা দেওয়া উচিত প্রতিযোগিতার সঙ্গে। কে আগে দিতে পারে সেই প্রতিযোগিতা। আগে সালাম দেওয়ার জন্য উৎসাহিতও করা হয়েছে। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
إِنَّ أَوْلَى النَّاسِ بِاللَّهِ مَنْ بَدَأَهُمْ بِالسَّلَامِ
'আল্লাহ তা'আলার সর্বাপেক্ষা নিকটতম ব্যক্তি সেই, যে আগে সালাম দেয়।’
(সুনানে আবু দাউদ: ৫১৯৭; জামে তিরমিযী: ২৬৯৪; মুসনাদে আহমাদ: ২২১৯২ )
সালামের রয়েছে বহু আদব। যেমন ছোট বড়কে সালাম দেবে, আরোহী ব্যক্তি পদাতিক ব্যক্তিকে সালাম দেবে, চলমান ব্যক্তি বসে থাকা ব্যক্তিকে সালাম দেবে, ছোট দল বড় দলকে সালাম দেবে ইত্যাদি। যদিও এগুলো আদব, তবে সর্বাবস্থায় আগে সালাম দেওয়াই উত্তম, যেমন উল্লিখিত হাদীছ দ্বারা বোঝা যায়। তাছাড়া সালামের প্রসার ঘটানোর দাবিও তাই।
ইসলামের শিক্ষায় আরেক সালাম আছে, যার ব্যবহার আমরা প্রায় ভুলেই গেছি। তা হল কোনও বিষয়ে কারও সঙ্গে অহেতুক তর্ক-বিতর্ক দেখা দিলে বা ঝগড়া-ফাসাদের উপক্রম ঘটলে তখন নিজেকে তা থেকে মুক্ত রাখার জন্য 'সালাম'-এর আশ্রয় গ্রহণ করা। যেমন বলে দেওয়া- ভাই, সালাম! অর্থাৎ আমি তোমার সঙ্গে তর্কে জড়াতে চাই না। তোমার সঙ্গে এ বিষয় নিয়ে আমার আর কোনও কথা নেই। তুমিও শান্তিতে একো, আমিও শান্তিতে থাকি। কুরআন মাজীদে আল্লাহর নেক বান্দাদের পরিচয় দিতে গিয়ে ইরশাদ হয়েছে-
وَإِذَا خَاطَبَهُمُ الْجَاهِلُونَ قَالُوا سَلَامًا
'এবং অজ্ঞলোক যখন তাদেরকে লক্ষ্য করে (অজ্ঞতাসুলভ) কথা বলে, তখন তারা বলে সালাম।
(সূরা ফুরকান, আয়াত ৬৩)
অর্থাৎ আমরা তোমাদের এসব অজ্ঞতাসুলভ কথার জবাব দিতে চাই না। তোমাদের মন্দ আচরণের বিপরীতে আমরা মন্দ আচরণ করব না। তোমরা ফাসাদ সৃষ্টি করতে চাইলেও আমরা শান্তির পথেই থাকব।
পূর্ববর্তী কিতাবীদের মধ্যে যারা সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল, তাদের কর্মপন্থা ও আদর্শ সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে-
وَإِذَا سَمِعُوا اللَّغْوَ أَعْرَضُوا عَنْهُ وَقَالُوا لَنَا أَعْمَالُنَا وَلَكُمْ أَعْمَالُكُمْ سَلَامٌ عَلَيْكُمْ لَا نَبْتَغِي الْجَاهِلِينَ
'তারা যখন কোনও বেহুদা কথা শোনে, তা এড়িয়ে যায় এবং বলে, আমাদের জন্য আমাদের কর্ম এবং তোমাদের জন্য তোমাদের কর্ম। তোমাদেরকে সালাম। আমরা অজ্ঞদের সাথে জড়িত হতে চাই না।'
(সূরা কাসাস, আয়াত ৫৫)
অর্থাৎ আমরা তোমাদের বেহুদা কথাবার্তায় জড়াব না। তোমাদেরকে গালিও দেব না, কোনও মন্দ কথাও বলব না। তোমাদের কথার কোনও জবাবই দেব না। তোমরা তোমাদের কর্মফল ভোগ করবে, আমরা আমাদের কর্মফল ভোগ করব। তোমাদের সঙ্গে আমাদের কোনও সম্পর্ক নেই।
মূর্তিপুজার বিরোধিতা করার কারণে হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামকে যখন তাঁর পিতা পাথর মেরে হত্যা করার হুমকি দিয়েছিল এবং তাঁকে চিরদিনের জন্য পরিত্যাগ করার ঘোষণা দিয়েছিল, তখন ইবরাহীম আলাইহিস সালাম তাকে লক্ষ্য করে বলেছিলেন-
سَلَامٌ عَلَيْكَ
'আপনার প্রতি (বিদায়ী) সালাম’। (সূরা মারয়াম, আয়াত ৪৭)
অর্থাৎ আমি আপনার সঙ্গে বিবাদ করতে চাই না। আপনি আমাকে যতই কষ্ট দেন না কেন, আমি আপনাকে কোনও কষ্ট দেব না। আমার পক্ষ থেকে আপনি নিরাপদেই থাকবেন।
মক্কার কাফেরদের অহেতুক বিতণ্ডার ক্ষেত্রে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইছি ওয়াসাল্লামকে তাঁর করণীয় সম্পর্কে নির্দেশনা দিতে গিয়ে আল্লাহ তা'আলা বলেন-
فَاصْفَحْ عَنْهُمْ وَقُلْ سَلَامٌ
'সুতরাং (হে রাসূল!) তুমি তাদেরকে অগ্রাহ্য করো এবং বলে দাও, সালাম।(সূরা যুখরুফ, আয়াত ৮৯)
অর্থাৎ তোমাদের সঙ্গে আমার কোনও সম্পর্ক নেই। তোমাদের পথ ও আমার পথ সম্পূর্ণ ভিন্ন। কিয়ামতেই ফয়সালা হবে কার পথ সত্য।
এ সালাম শান্তি রক্ষার সালাম। অহেতুক তর্ক-বিতর্ক ও অর্থহীন ঝগড়া-ফাসাদ ইসলামে পসন্দনীয় নয়। সেরকম কোনও আশঙ্কা দেখা দিলে ইসলাম আমাদেরকে সালামের ঢাল ব্যবহার করতে বলেছে। অর্থাৎ সালাম দিয়ে প্রতিপক্ষ হতে নিজেকে সরিয়ে নিতে বলা হয়েছে। ইসলামের এ শিক্ষা অনুসরণ করলে পারিবারিক ও সামাজিক হাজারও কলহ-কোন্দল থেকে আমরা বেঁচে যেতে পারি।
উল্লেখ্য, সালাম ইসলামের নিদর্শন। মুসলিমসমাজে এখনও পর্যন্ত এ নিদর্শন টিকে আছে। ইসলামী সংস্কৃতির অনেক কিছুই অধিকাংশ মানুষ ভুলে গেছে। তবে যারা সেসব ভুলে গেছে, তাদেরও অনেকে সালামের আমলটি করে থাকে। হাঁ, এ আমলটি এমন, যা মুসলিম মাত্রেরই ধরে রাখা প্রয়োজন ছিল। কথা তো ছিল প্রত্যেক মুসলিমগৃহে ছোট- বড়, নারী-পুরুষ প্রত্যেকেই সালাম দেওয়া-নেওয়ায় অভ্যস্ত থাকবে। সালামের যতগুলো প্রয়োগক্ষেত্র আছে, তার প্রত্যেকটিতেই প্রত্যেকে আগ্রহভরে সালাম দেবে। কিন্তু আফসোস হল, সালাম ঠিক সেইভাবে আজ আমাদের সমাজে প্রচলিত নয়। এ অবহেলার কুফলও আজ আমাদের ভোগ করতে হচ্ছে। বর্তমানকালে যে ঘরে-বাইরে সর্বত্র অশান্তি, মানুষ জান-মাল ও ইজ্জতের নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে, পারস্পরিক ঐক্য ও সম্প্রীতি ভেঙে চূর্ণ-বিচূর্ণ, এর এক অন্যতম কারণ কি এইও নয় যে, আমরা সালাম দেওয়া-নেওয়ার রেওয়াজ নষ্ট করে ফেলেছি? না ঘরের ভেতর সালামের ব্যাপক চর্চা আছে, না ঘরের বাইরে। শান্তিবাহী সালামের স্থানে অন্যদের কৃষ্টি-সংস্কৃতির ব্যাপকতা লাভ করেছে। এরই ভোগান্তি পোহাচ্ছি আমরা সর্বত্র। এ ভোগান্তি থেকে মুক্তির উপায় একটাই- সব ক্ষেত্রে ইসলামী তাহযীব ও সংস্কৃতির প্রতিষ্ঠাদান। সালামের রেওয়াজদানও তার একটি প্রধান অঙ্গ।
পরিচ্ছেদ: ১
সালামের ফযীলত ও সালামের রেওয়াজদানের আদেশ
'সালামের ফযীলত...' সম্পর্কিত কিছু আয়াত
• এক নং আয়াত
يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَدْخُلُوا بُيُوتًا غَيْرَ بُيُوتِكُمْ حَتَّى تَسْتَأْنِسُوا وَتُسَلِّمُوا عَلَى أَهْلِهَا
অর্থ : হে মুমিনগণ! নিজ গৃহ ছাড়া অন্যের গৃহে প্রবেশ করো না, যতক্ষণ না অনুমতি গ্রহণ কর ও তার বাসিন্দাদেরকে সালাম দাও। (সূরা নূর, আয়াত ২৭)
ব্যাখ্যা
এ আয়াতে অন্যের ঘরে প্রবেশকালে অনুমতি নেওয়া ও সালাম দেওয়ার হুকুম করা হয়েছে। অনুমতি ছাড়া এবং সালাম না দিয়ে অন্যের ঘরে প্রবেশ করা যাবে না। অন্যের ঘর বলতে এমন ঘর বোঝানো উদ্দেশ্য, যে ঘরে অন্য কেউ থাকে। তার মানে কেউ যদি নিজ ঘর অন্যকে ভাড়া দেয়, তবে যাকে ভাড়া দিল তার অনুমতি ছাড়া সে নিজেও ওই ঘরে প্রবেশ করতে পারবে না।
অনুমতি গ্রহণ বোঝানোর জন্য আয়াতে শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে تستأنسوا (অনুমতি গ্রহণ কর)। শব্দটির উৎপত্তি الأنس থেকে। এর অর্থ প্রীতি, পসন্দ, পরিচিতি, সৌজন্য, বন্ধুত্ব ইত্যাদি। অনুমতি গ্রহণের অর্থে এই মূলধাতু থেকে উৎপন্ন تستأنسوا শব্দটির ব্যবহার খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। কেননা অন্যের গৃহে অনুমতি ছাড়া প্রবেশ করাটা সৌজন্য ও ভদ্রতার পরিপন্থি। গৃহবাসী এটা পসন্দ করে না। সে এতে বিরক্তি বোধ করে। অনুমতি চাইলে প্রথমে গৃহবাসী তাকে চিনতে পারে। সে তার ভদ্রতার পরিচয় পেয়ে তার প্রতি আগ্রহবোধ করে এবং খুশিমনে তাকে প্রবেশ করতে অনুমতি দেয়। ফলে উভয়ের মধ্যে সুসম্পর্ক ও বন্ধুত্ব গড়ে ওঠার পথ তৈরি হয়।
আয়াতে অন্যের ঘরে প্রবেশকালে দু'টি কাজ করতে বলা হয়েছে। এক তো হল অনুমতি চাওয়া। আর দ্বিতীয় হল গৃহবাসীকে সালাম দেওয়া। বোঝা গেল কেবল অনুমতি চাওয়াই যথেষ্ট নয়, সালামও দিতে হবে। প্রশ্ন হচ্ছে, আগে কোনটি করবে? সলাম দেবে তারপর অনুমতি চাবে, নাকি আগে অনুমতি চেয়ে তারপর সালাম দেবে? আয়াতে আগে অনুমতি চাওয়ার উল্লেখ আছে। তাই কেউ কেউ বলেন, প্রথম কাজ অনুমতি চাওয়া। কিন্তু ব্যাকরণের নিয়ম অনুযায়ী আগে উল্লেখের দ্বারা আগে করার প্রতি নির্দেশ হয় না। সংযোজক অব্যয় 'و' (ওয়াও) এর দ্বারা কেবল দু'টি বিষয়কে একত্র করা হয়। এর দ্বারা তারতীব বা পর্যায়ক্রম বোঝানো উদ্দেশ্য হয় না। অধিকাংশ আলেমের মতে নিয়ম হল আগে সালাম দেওয়া, তারপর অনুমতি চাওয়া। এর সপক্ষে তারা হাদীছ উল্লেখ করেন যে, একবার এক সাহাবী নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট প্রবেশ করলেন। কিন্তু তিনি সালামও দিলেন না, অনুমতিও চাইলেন না। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন-
ارْجِعْ فَقُلْ : السَّلَامُ عَلَيْكُمْ، أَأَدْخُل ؟
'তুমি ফিরে যাও এবং বলো- আসসালামু আলাইকুম, আমি কি প্রবেশ করতে পারি?’
(জামে' তিরমিযী : ২৭১০; সুনানে আবু দাউদ: ৫১৭৬; বুখারী, আল আদাবুল মুফরাদ: ১০৮১; নাসাঈ, আস সুনানুল কুবরা : ৬৭০২; ইবনুস সুন্নী, আমালুল ইয়াওমি ওয়াল লায়লা :৬৬৪; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা: ১৭৬৬৬)
হযরত জাবির রাযি. থেকে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
لَا تَأْذَنُوا لِمَنْ لَمْ يَبْدَأُ بِالسَّلَامِ
'তোমরা তাকে অনুমতি দেবে না, যে প্রথমে সালাম দেবে না।'
(বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান : ৮৪৩৩; মুসনাদে আবূ ইয়া'লা : ১৮০৯)
মোটকথা, অন্যের ঘরে বা কক্ষে প্রবেশকালে অবশ্যই সালাম দিয়ে অনুমতি নিতে হবে, তাতে সে ব্যক্তি যতই কাছের বা যতই প্রিয় হোক, এমনকি নিজ পিতা-মাতা বা ছেলেমেয়েও যদি হয়।
আয়াতটির শিক্ষা
অন্যের ঘরে প্রবেশকালে সালাম দিয়ে অনুমতি নেওয়া জরুরি।
• দুই নং আয়াত
فَإِذَا دَخَلْتُمْ بُيُوتًا فَسَلِّمُوا عَلَى أَنْفُسِكُمْ تَحِيَّةً مِنْ عِنْدِ اللَّهِ مُبَارَكَةً طَيِّبَةً
অর্থ: যখন তোমরা ঘরে ঢুকবে নিজেদেরকে সালাম করবে, কারণ এটা সাক্ষাতের জন্য আল্লাহর পক্ষ হতে প্রদত্ত বরকতপূর্ণ ও পবিত্র দু'আ। (সূরা নূর, আয়াত ৬১)
ব্যাখ্যা
এ আয়াতে যে-কোনও ঘরে প্রবেশকালে সালাম দিতে বলা হয়েছে। অন্যের ঘরে তো বটেই, এমনকি নিজ ঘরেও। এমনকি ঘরে যদি কেউ নাও থাকে, তবুও সালাম দেবে। বলা হয়েছে- فَسَلِّمُوا عَلَى أَنْفُسِكُمْ (নিজেদেরকে সালাম করবে)। ঘরে কেউ না থাকলে সে সালাম তো নিজেকেই দেওয়া হল। আর যদি কেউ থাকে, তবে তারে দেওয়াটা নিজেকেই দেওয়া, যেহেতু সে নিজেরই লোক। সে আত্মীয় না হলেও নিজের লোক। কারণ দুনিয়ার সব মুসলিম ভাই ভাই। ঘরে লোক থাকলে তখন তো আসসালামু আলাইকুম বলবে। আর কেউ না থাকলে বলবে- السَّلَامُ عَلَيْنَا وَعَلَى عِبَادِ اللَّهِ الصَّالِحِينَ (সালাম আমাদের প্রতি এবং আল্লাহর সৎকর্মশীল বান্দাদের প্রতি)।
নিজ ঘরে প্রবেশকালে সালাম দেওয়ার কথা হাদীছেও স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত আনাস ইবন মালিক রাযি.-কে উপদেশ দেন-
يَا بُنَيَّ, إِذَا دَخَلْتَ عَلَى أَهْلِكَ فَسَلِّمْ يَكُونُ بَرَكَةً عَلَيْكَ وَعَلَى أَهْلِ بَيْتِكَ
'হে বাছা! তুমি যখন তোমার পরিবারের নিকট প্রবেশ করবে, তখন সালাম দেবে। তাতে তোমার ও তোমার পরিবারের উপর বরকত হবে।’
(জামে' তিরমিযী: ২৬৯৮; খারাইতী, মাকারিমুল আখলাক: ৮৪৬; তাবারানী, আল মু'জামুল আওসাত: ৫৯৯১; বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান: ৮৩৮৬)
সালাম দেওয়াটা ঘরে প্রবেশের এক গুরুত্বপূর্ণ আদব। কেবল অনুমতি চাওয়ার রেওয়াজ অন্য ধর্মেও আছে। কিন্তু সালামের দ্বারা অনুমতি চাওয়া ইসলামেরই বৈশিষ্ট্য। এটা সরাসরি আল্লাহ তা'আলার পক্ষ থেকে শিক্ষা। আল্লাহ তা'আলা বলেন- تَحِيةً مِنْ عند الله (কারণ এটা সাক্ষাতের জন্য আল্লাহর পক্ষ হতে প্রদত্ত দু'আ)। تَحِيّة এর প্রকৃত অর্থ দীর্ঘ জীবনের জন্য দু'আ করা। এর মধ্যে ইঙ্গিত রয়েছে, সালাম বিনিময়ের দ্বারা হায়াতে বরকত হয়। বাক্যটির অর্থ এরকম হতে পারে যে, এ সালাম আল্লাহ তা'আলার পক্ষ থেকে প্রদত্ত অভিবাদন। অর্থাৎ এটা কারও মনগড়া নিয়ম নয়; বরং আল্লাহ তা'আলা নিজেই তোমাদের এ নিয়ম শিক্ষা দিয়েছেন। বলাবাহুল্য আল্লাহ তা'আলা বন্দাকে যে নিয়ম শিক্ষা দেন তা প্রভৃত কল্যাণকর হয়ে থাকে। গৃহে প্রবেশকালীন এ নিয়মও তার ব্যতিক্রম নয়। আল্লাহ তা'আলা বলেন-
مُبَارَكَةً طَيِّبَةً (বরকতপূর্ণ ও পবিত্র)। অর্থাৎ সালাম দেওয়ার দ্বারা বান্দা বরকত ও কল্যাণের অধিকারী হয়। এতে অন্তর হিংসা-বিদ্বেষ ও শত্রুতা থেকে মুক্ত ও পবিত্র হয়। যাকে সালাম দেওয়া হয় সে খুশি হয়। এভাবে এর দ্বারা পরস্পরের মধ্যে সম্প্রীতি জন্মায়। হযরত আনাস রাযি. থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে লক্ষ্য করে বলেন-
يَا أَنسُ، إِذَا دَخَلْتَ بَيْتَكَ فَسَلِّمْ عَلَى أَهْلِكَ يَكْثُرْ خَيْرُ بَيْتِكَ
'হে আনাস! যখন ঘরে প্রবেশ করবে, তখন তোমার পরিবারকে সালাম দেবে। এতে তোমার ঘরের কল্যাণ বৃদ্ধি পাবে।'
(বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান : ৮৩৮৬; খারাইতী, মাকারিমুল আখলাক : ৮৪৬)
আয়াতের শব্দাবলির প্রতি লক্ষ করে কেউ কেউ ঘরে প্রবেশকালীন সালামের বাক্য এরূপ বলেছেন-
السَّلَامُ عَلَيْكُمْ تَحِيَّة مِنْ عِنْدِااللهِ مُبَارَكَةً طَيِّبة
আয়াতটির শিক্ষা
ক. নিজের বা অন্যের যে-কারও ঘরে প্রবেশকালে সালাম দেওয়া চাই।
খ. খালিঘরে প্রবেশকালেও সালাম দেবে।
গ. সালামের বিধান আল্লাহপ্রদত্ত, কারও মনগড়া নয়।
ঘ. সালাম দ্বারা ঘরে বরকত ও কল্যাণ হয়।
ঙ. সালাম দেওয়ার দ্বারা হায়াতেও বরকত হয়।
চ. সালাম পারস্পরিক সদ্ভাব ও আন্তরিকতা সৃষ্টিতে সহায়ক।
• তিন নং আয়াত
وَإِذَا حُيِّيْتُمْ بِتَحِيَّةٍ فَحَيُّوا بِأَحْسَنَ مِنْهَا أَوْ رُدُّوهَا
অর্থ: যখন কেউ তোমাদেরকে সালাম করে, তখন তোমরা (তাকে) তদপেক্ষা উত্তমরূপে সালাম দিয়ো কিংবা (অন্ততপক্ষে) সেই শব্দেই তার জবাব দিয়ো।
(সূরা নিসা, আয়াত ৮৬)
ব্যাখ্যা
এ আয়াতে সালামের জবাব দেওয়ার নিয়ম শেখানো হয়েছে। উত্তম হল সালাম অপেক্ষা সালামের জবাব উৎকৃষ্ট হওয়া। অর্থাৎ সালামদাতা সালামে যে পরিমাণ শব্দ ব্যবহার করবে, জবাবদাতা তারচে' বেশি শব্দ ব্যবহার করবে।
যেমন সালামদাতা যদি বলে السَّلَامُ عَلَيْكُمْ , তবে জবাবদাতা বলবে وَعَلَيْكُمُ السَّلَامُ وَرَحْمَةُ اللَّهِ যদি বলে السَّلامُ عَلَيْكُمْ وَرَحْمَةُ الله তবে জবাবে বলবে وَعَلَيْكُمُ السَّلَامُ وَرَحْمَةُ اللهِ وَبَرَكَاتُهُ
এটাই শেষ সীমা। এরপর সালামের আর কোনও শব্দ নেই। কোনও কোনও বর্ণনায় এরপর وَمَغْفرته শব্দেরও উল্লেখ আছে। তবে সে বর্ণনা সহীহ নয়। তা বলা থেকে বিরত থাকাই সঙ্গত। একবার হযরত আব্দুল্লাহ ইবন উমর রাযি.-এর নিকট এক ব্যক্তি এসে وَمَغْفِرَتُهُ -যোগে সালাম দিয়েছিল। হযরত ইবন উমর রাযি. তাকে ধমক দিয়ে বললেন, وَبَرَكَاتُهُ পর্যন্ত বলাটাই তোমার জন্য যথেষ্ট।
(বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান: ৮৪৯০)
হযরত আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাযি. বলেন, সবকিছুর একটা সীমা আছে। সালামের সীমা হল وَبَرَكَاتُهُ।
(বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান: ৮৪৮৯)
একবার হযরত ইবন আব্বাস রাযি.-এর কাছে এসে এক ব্যক্তি وَبَرَكَاتُهُ এর পর আরও কয়েকটি শব্দ। যোগ করে সালাম দিলে হযরত ইবন আব্বাস রাযি. বললেন, এটা কেমন সালাম? রাগে তাঁর চেহারা লাল হয়ে গেল। তিনি বললেন, আল্লাহ তা'আলা সালামের একটা সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছেন। সে সীমা অতিক্রম করতে নিষেধ করেছেন। এই বলে তিনি পাঠ করলেন -
رَحْمَتُ اللهِ وَبَرَكْتُهُ عَلَيْكُمْ أَهْلَ الْبَيْتِ
‘হে গৃহবাসী! তোমাদের প্রতি আল্লাহর রহমত ও তাঁর বরকত’।
( সূরা হুদ, আয়াত ৭৩)(বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান : ৮৪৮৮)
উল্লিখিত সীমার ভেতর যে যত বেশি শব্দ ব্যবহার করবে, সে ততো বেশি ছাওয়াব পাবে। একবার এক ব্যক্তি নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট উপস্থিত হয়ে সালাম দিল السَّلَامُ عَلَيْكُم তিনি তার উত্তর দিলে বললেন- দশ। অর্থাৎ দশ একী হল। সে ব্যক্তি বসে গেল। তারপর আরেক ব্যক্তি এসে সালাম দিল السَّلَامُ عَلَيْكُمُ وَرَحْمَةُ اللَّهِ । তিনি তার জবাব দিয়ে বললেন- বিশ। সেও বসে গেল। তারপর আরেক ব্যক্তি এসে সালাম দিল السَّلامُ عَلَيْكُمْ وَرَحْمَةُ الله وبركاته। তিনি তার জবাব দিয়ে বললেন- ত্রিশ।
(জামে' তিরমিযী: ২৬৮৯; সুনানে আবু দাউদ: ৫১৯৫; সুনানে দারিমী: ২৬৮২; বুখারী, আল আদাবুল মুফরাদ: ৯৮৬; মুসনাদুল বাযযার: ৩৫৮৮; নাসাঈ, আস সুনানুল কুবরা : ১০০৯৭; সহীহ ইবনে হিব্বান : ৪৯৩; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর: ৫৫৬৩; বায়হাকী, শু'আবুলঈমান: ৮৪৮৪)
আয়াতটির শিক্ষা
সালামের জবাব দেওয়া ওয়াজিব। তবে সালাম অপেক্ষা অতিরিক্ত শব্দে জবাব দেওয়া মুস্তাহাব।
• চার নং আয়াত
هَلْ أَتَاكَ حَدِيثُ ضَيْفِ إِبْرَاهِيمَ الْمُكْرَمِينَ (24) إِذْ دَخَلُوا عَلَيْهِ فَقَالُوا سَلَامًا قَالَ سَلَامٌ
অর্থ : (হে রাসূল!) তোমার কাছে কি ইবরাহীমের সম্মানিত অতিথিদের বৃত্তান্ত পৌছেছে? যখন তারা ইবরাহীমের কাছে উপস্থিত হয়ে বলল 'সালাম', তখন ইবরাহীমও বলল 'সালাম'।
(সূরা যারিয়াত, আয়াত ২৪, ২৫)
ব্যাখ্যা
এ আয়াতদু'টি সূরা যারিয়াতের। একবার হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামের কাছে মানুষের আকৃতিতে কয়েকজন ফিরিশতা আগমন করেন। অতিথি হিসেবে ইবরাহীম আলাইহিস সালামের পক্ষ থেকে তাদের সেবাযত্নে মনোযোগী থাকেন। তখন তাদের মধ্যে যা যা ঘটেছিল, এ সূরায় তার একটা অংশ বর্ণিত হয়েছে। তারই খানিকটা রয়েছে এ আয়াতদু'টিতে। প্রথমে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে লক্ষ্য করে বলা হয়েছে-
هَلْ أَثْكَ حَدِيثُ ضَيْفِ إِبْرَاهِيمَ الْمُكْرَمِينَ ‘(হে রাসূল!) সম্মানিত অতিথিদের বৃত্তান্ত পৌঁছেছে'? এ প্রশ্নটি স্বীকৃতিমূলক। বোঝানো হয়েছে, তাদের বৃত্তান্ত তোমার কাছে অবশ্যই এসেছে। তুমি তাদের সম্পর্কে জান। এর দ্বারা দে বৃত্তান্তের গুরুত্ব তুলে ধরা উদ্দেশ্য। এর দ্বারা বোঝা যাচ্ছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লআহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এর আগে আরও ওহী এসেছে।
আয়াতে হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামের অতিথিদেরকে المكرمين বিশেষণে বিশেষিত করা হয়েছে। এর অর্থ সম্মানিত। ফিরিশতাগণ সম্মানিত এ কারণে যে, তারা কোনও গুনাহ করেন না। তারা আল্লাহ তা'আলার হুকুম পালন করেন এবং তাঁর মহিমা ও গৌরব বর্ণনায় রত থাকেন। আবার হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম কর্তৃকও তারা সম্মানিত হয়েছিলেন। তিনি জানতেন না তারা ফিরিশতা। তথাপি অতিথি হিসেবে তিনি তাদেরকে সম্মান করেছিলেন। তিনি নিজে ও তাঁর স্ত্রী তাদের সেবাযত্ন করেছিলেন।
ফিরিশতাগণ তাঁর ঘরে প্রবেশকালে বললেন- سَلَامًا (সালাম)। বোঝা গেল কারও ঘরে প্রবেশকালে সালাম দিতে হয়। এখানে আরবী শব্দটি হল سَلَامًا । এটি ক্রিয়াপ্রধান বাক্য। এর মূল রূপ হল نُسَلِّمُكَ سَلَامًا (আমরা আপনাকে সালাম দিচ্ছি)। এর উত্তরে হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম বললেন-
سَلَام (সালাম)। তিনি উত্তরে ব্যবহার করলেন বিশেষ্যপ্রধান বাক্য। কেননা سَلَام এর প্রকৃত রূপ হল سَلَامٌ عَلَيْكُمْ (আপনাদের প্রতিও সালাম)। ক্রিয়াপ্রধান বাক্য ক্ষণস্থায়িত্বের। অর্থ দেয় আর বিশেষপ্রধান বাক্য স্থায়িত্বের অর্থ দেয়। এ হিসেবে ফিরিশতাদের সালাম অপেক্ষা হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামের উত্তর উৎকৃষ্ট হয়েছে। জবাব দেওয়ার ক্ষেত্রে এদিকে লক্ষ রাখা ভালো। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে-
وَإِذَا حُيِّيْتُمْ بِتَحِيَّةٍ فَحَيُّوا بِأَحْسَنَ مِنْهَا أَوْ رُدُّوهَا
'যখন কেউ তোমাদেরকে সালাম করে, তখন তোমরা (তাকে) তদপেক্ষাও উত্তমরূপে সালাম দিয়ো কিংবা (অন্ততপক্ষে) সেই শব্দেই তার জবাব দিয়ো’। (সূরা নিসা, আয়াত ৮৬)
আয়াতের শিক্ষা
ক. মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উম্মী হওয়া সত্ত্বেও কুরআনের মাধ্যমে প্রাচীনকালের নবী হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামের বৃত্তান্ত আমাদেরকে অবহিত করেছেন। এটা প্রমাণ করে কুরআন আল্লাহর বাণী এবং তিনি আল্লাহর নবী।
খ. অতিথি সম্মানযোগ্য। তার প্রতি সম্মানজনক আচরণ করা কর্তব্য।
গ . ফিরিশতাগণ আল্লাহ তা'আলার সম্মানিত সৃষ্টি। তারা আকৃতি বদল করতে পারেন।
ঘ. অন্যের গৃহে প্রবেশকালে সালাম দেওয়া অবশ্যকর্তব্য।
ঙ. সালাম অপেক্ষা সালামের জবাব উত্তম হওয়া কাম্য।
শ্রেষ্ঠ দু'টি কাজ : খাবার খাওয়ানো ও সালাম দেওয়া
হাদীছ নং: ৮৪৪
হযরত আব্দুল্লাহ ইবন আমর ইবনুল আস রাযি. থেকে বর্ণিত, জনৈক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করল, কোন ইসলাম উত্তম? তিনি বললেন, তুমি খাবার খাওয়াবে এবং পরিচিত ও অপরিচিত সকলকে সালাম দেবে।-বুখারী ও মুসলিম
(সহীহ বুখারী: ১২; সহীহ মুসলিম: ৩৯; সুনানে আবূ দাউদ: ৫১৯৪; সুনানে নাসাঈ ৫০০০; সুনানে ইবন মাজাহ ৩২৫৩; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর ১৪৯; সহীহ ইবনে হিব্বান: ৫০৫)
হাদীছ নং: ৮৪৪
হযরত আব্দুল্লাহ ইবন আমর ইবনুল আস রাযি. থেকে বর্ণিত, জনৈক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করল, কোন ইসলাম উত্তম? তিনি বললেন, তুমি খাবার খাওয়াবে এবং পরিচিত ও অপরিচিত সকলকে সালাম দেবে।-বুখারী ও মুসলিম
(সহীহ বুখারী: ১২; সহীহ মুসলিম: ৩৯; সুনানে আবূ দাউদ: ৫১৯৪; সুনানে নাসাঈ ৫০০০; সুনানে ইবন মাজাহ ৩২৫৩; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর ১৪৯; সহীহ ইবনে হিব্বান: ৫০৫)
كتاب السلام
كتَاب السَّلاَم
باب فضل السلام والأمر بإفشائه
قَالَ الله تَعَالَى: {يَا أيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لاَ تَدْخُلُوا بُيُوتًا غَيْرَ بُيُوتِكُمْ حَتَّى تَسْتَأْنِسُوا وَتُسَلِّمُوا عَلَى أهْلِهَا} [النور: 27]، وقال تَعَالَى: {فَإذَا دَخَلْتُمْ بُيُوتًا فَسَلِّمُوا عَلَى أنْفُسِكُمْ تَحِيَّةً مِنْ عِنْدِ اللهِ مُبَارَكَةً طَيِّبَةً} [النور: 61]، وقال تَعَالَى: {وَإِذَا حُيِّيتُمْ بِتَحِيَّةٍ فَحَيُّوا بِأَحْسَنَ مِنْهَا أَوْ رُدُّوهَا} [النساء: 86]، وقال تَعَالَى: {هَلْ أَتَاكَ حَدِيثُ ضَيْفِ إبْرَاهِيمَ الْمُكرَمِينَ إِذْ دَخَلُوا عَلَيْهِ فَقَالُوا سَلاَمًا قَالَ سَلاَمٌ} [الذاريات: 24 - 25].
باب فضل السلام والأمر بإفشائه
قَالَ الله تَعَالَى: {يَا أيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لاَ تَدْخُلُوا بُيُوتًا غَيْرَ بُيُوتِكُمْ حَتَّى تَسْتَأْنِسُوا وَتُسَلِّمُوا عَلَى أهْلِهَا} [النور: 27]، وقال تَعَالَى: {فَإذَا دَخَلْتُمْ بُيُوتًا فَسَلِّمُوا عَلَى أنْفُسِكُمْ تَحِيَّةً مِنْ عِنْدِ اللهِ مُبَارَكَةً طَيِّبَةً} [النور: 61]، وقال تَعَالَى: {وَإِذَا حُيِّيتُمْ بِتَحِيَّةٍ فَحَيُّوا بِأَحْسَنَ مِنْهَا أَوْ رُدُّوهَا} [النساء: 86]، وقال تَعَالَى: {هَلْ أَتَاكَ حَدِيثُ ضَيْفِ إبْرَاهِيمَ الْمُكرَمِينَ إِذْ دَخَلُوا عَلَيْهِ فَقَالُوا سَلاَمًا قَالَ سَلاَمٌ} [الذاريات: 24 - 25].
844 - وعن عبد الله بن عمرو بن العاص رضي الله عنهما: أنَّ رجلًا سأل رسول الله - صلى الله عليه وسلم: أيُّ الإسْلاَمِ خَيْرٌ؟ قَالَ: «تُطْعِمُ الطَّعَامَ، وَتَقْرَأُ السَّلاَمَ عَلَى مَنْ عَرَفْتَ وَمَنْ لَمْ تَعْرِفْ». متفقٌ عَلَيْهِ. (1)
হাদীসের ব্যাখ্যা:
হাদীছটির বর্ণনা বলা হয়েছে, জনৈক সাহাবী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে ইসলামের শ্রেষ্ঠতম আমল কী তা জানতে চেয়েছিলেন। সে সাহাবী কে, তার উল্লেখ এ বর্ণনায় নেই। তবে অন্যান্য বর্ণনা দ্বারা জানা যায়, এ জিজ্ঞাসাকারী হাদীছটির বর্ণনাকারী হযরত আব্দুল্লাহ ইবন আমর ইবনুল আস রাযি. নিজেই।
এ জাতীয় প্রশ্ন অন্যান্য সাহাবীদের থেকেও পাওয়া যায়। বস্তুত সৎকর্মের প্রতি সাহাবায়ে কেরামের আগ্রহ-উদ্দীপনা ছিল বিপুল। তবে একই ব্যক্তির পক্ষে যাবতীয় সৎকর্ম করা দুরূহ। যেগুলো ফরয বা ওয়াজিব পর্যায়ের, তা তো সকলের পক্ষেই পালন করা সম্ভব ও সহজ। কিন্তু যাবতীয় নফল কাজ প্রত্যেকের পক্ষে করা সম্ভব হয় না। এ ক্ষেত্রে যেসব আমল নিজের পক্ষে করা সম্ভব এবং তাতে ছাওয়াবও বেশি, সেগুলো বাছাই করে নেওয়াই বুদ্ধিমত্তার পরিচায়ক, যাতে তা নিয়মিত পালন করা যায় এবং বেশির থেকে বেশি ছাওয়াব অর্জন করা যায়। তাই হাদীছ গ্রন্থসমূহে আমরা বিভিন্ন সাহাবীর পক্ষ থেকে এ জাতীয় প্রশ্নের উল্লেখ পাই।
যাহোক জিজ্ঞাসাকারী সাহাবী জানতে চাইলেন- أَيُّ الْإِسْلَامِ خَيْرٌ؟ (কোন ইসলাম উত্তম)? অর্থাৎ ইসলামের কোন কোন বিষয় উত্তম? প্রশ্নটিতে الْإِسْلَام শব্দের আগে خصال (বিষয়সমূহ, কর্মসমূহ) শব্দ উহ্য আছে। অর্থাৎ ইসলাম যেসকল বিষয়ের শিক্ষা দেয় এবং যেসব আমল করতে বলে, তার মধ্যে কোন কোনটিতে ছাওয়াব বেশি? উত্তরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ২টি বিষয় উল্লেখ করলেন। প্রথমে বললেন-
تُطْعِمُ الطَّعَامَ (তুমি খাবার খাওয়াবে)। বাহ্যত এর দ্বারা দান-খয়রাত, হাদিয়া, আতিথেয়তা ইত্যাদিরূপে খানা খাওয়ানোর কথা বোঝানো হয়েছে।
وَتَقْرَأُ السَّلَامَ عَلَى مَنْ عَرَفْتَ وَمَنْ لَمْ تَعْرِفْ (এবং পরিচিত ও অপরিচিত সকলকে সালাম দেবে)। অর্থাৎ সালাম দেওয়াকে বিশেষ বিশেষ ব্যক্তির জন্য নির্দিষ্ট করে ফেলবে না। বরং এটা যেহেতু ইসলামের এক গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন, তাই এ ক্ষেত্রে ইসলামী ভ্রাতৃত্বের দিকে দৃষ্টি রাখবে। সুতরাং যে ব্যক্তিই মুসলিম, সে পরিচিত হোক বা অপরিচিত, তাকেই সালাম দেবে।
প্রশ্ন হতে পারে, ‘পরিচিত-অপরিচিত’ শব্দের ব্যাপকতার মধ্যে তো কাফের, ফাসেক ও মুনাফিক সকলেই পড়ে যায়, তাহলে তাদেরকেও কি সালাম দেওয়া হবে?
এর উত্তর হল, হাদীছটি দ্বারা এতটা ব্যাপকতা বোঝানো উদ্দেশ্য নয়। শুধু মুসলিমদের মধ্যে ‘পরিচিত-অপরিচিত’-এর ব্যাপকতা বোঝানো হয়েছে। এটা অন্যান্য দলীল দ্বারা বোঝা যায়। সারকথা এ হাদীছ দ্বারা মুসলিম-সমাজে সালামের ব্যাপক প্রচলন ঘটাতে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে।
বিশেষভাবে খাবার খাওয়ানো ও সালাম দেওয়াকে উত্তম বলা হয়েছে এ কারণে যে, খাদ্য হচ্ছে মানুষের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক চাহিদা। এ চাহিদা পূরণ করার দ্বারা মানুষের উপকার বেশি হয়। তাই এতে ছাওয়াবও বেশি। সালাম দেওয়ার দ্বারা বিনয় প্রকাশ পায়। তাছাড়া এটা নিজের পক্ষ থেকে নিরাপত্তা দানের ঘোষণাস্বরূপ। যাকে সালাম দেওয়া হয় তাকে যেন বোঝানো হয়, তুমি নিশ্চিত থাকো, আমার পক্ষ থেকে তোমার কোনওভাবে কোনও ক্ষতি করা হবে না। সে দৃষ্টিতে সালামের উপকার অনেক ব্যাপক। তাই এর ছাওয়াবও অনেক বেশি।
তাছাড়া সালাম দেওয়া ও খানা খাওয়ানো- এ উভয় কাজটি দ্বারা পারস্পরিক মহব্বত ও ভালোবাসা সৃষ্টি হয়। পারস্পরিক ভালোবাসা ঈমানের পরিপূর্ণতার জন্য শর্ত। এ গুরুত্বের কারণে তুলনামূলকভাবে এ আমলদু'টিতে ছাওয়াবও বেশি।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. যেসকল কাজে ছাওয়াব বেশি, আমল করার ক্ষেত্রে সেগুলোকে বেশি প্রাধান্য দেওয়া চাই।
খ. অন্যকে খাবার খাওয়ানো অতি বড় পুণ্যের কাজ। এ কাজে কিছুতেই কৃপণতা করতে নেই।
গ. পরিচিত-অপরিচিত যে-কোনও মুসলিমকে আগে আগে সালাম দেওয়ার অভ্যাস গড়ে তোলা চাই।
এ জাতীয় প্রশ্ন অন্যান্য সাহাবীদের থেকেও পাওয়া যায়। বস্তুত সৎকর্মের প্রতি সাহাবায়ে কেরামের আগ্রহ-উদ্দীপনা ছিল বিপুল। তবে একই ব্যক্তির পক্ষে যাবতীয় সৎকর্ম করা দুরূহ। যেগুলো ফরয বা ওয়াজিব পর্যায়ের, তা তো সকলের পক্ষেই পালন করা সম্ভব ও সহজ। কিন্তু যাবতীয় নফল কাজ প্রত্যেকের পক্ষে করা সম্ভব হয় না। এ ক্ষেত্রে যেসব আমল নিজের পক্ষে করা সম্ভব এবং তাতে ছাওয়াবও বেশি, সেগুলো বাছাই করে নেওয়াই বুদ্ধিমত্তার পরিচায়ক, যাতে তা নিয়মিত পালন করা যায় এবং বেশির থেকে বেশি ছাওয়াব অর্জন করা যায়। তাই হাদীছ গ্রন্থসমূহে আমরা বিভিন্ন সাহাবীর পক্ষ থেকে এ জাতীয় প্রশ্নের উল্লেখ পাই।
যাহোক জিজ্ঞাসাকারী সাহাবী জানতে চাইলেন- أَيُّ الْإِسْلَامِ خَيْرٌ؟ (কোন ইসলাম উত্তম)? অর্থাৎ ইসলামের কোন কোন বিষয় উত্তম? প্রশ্নটিতে الْإِسْلَام শব্দের আগে خصال (বিষয়সমূহ, কর্মসমূহ) শব্দ উহ্য আছে। অর্থাৎ ইসলাম যেসকল বিষয়ের শিক্ষা দেয় এবং যেসব আমল করতে বলে, তার মধ্যে কোন কোনটিতে ছাওয়াব বেশি? উত্তরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ২টি বিষয় উল্লেখ করলেন। প্রথমে বললেন-
تُطْعِمُ الطَّعَامَ (তুমি খাবার খাওয়াবে)। বাহ্যত এর দ্বারা দান-খয়রাত, হাদিয়া, আতিথেয়তা ইত্যাদিরূপে খানা খাওয়ানোর কথা বোঝানো হয়েছে।
وَتَقْرَأُ السَّلَامَ عَلَى مَنْ عَرَفْتَ وَمَنْ لَمْ تَعْرِفْ (এবং পরিচিত ও অপরিচিত সকলকে সালাম দেবে)। অর্থাৎ সালাম দেওয়াকে বিশেষ বিশেষ ব্যক্তির জন্য নির্দিষ্ট করে ফেলবে না। বরং এটা যেহেতু ইসলামের এক গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন, তাই এ ক্ষেত্রে ইসলামী ভ্রাতৃত্বের দিকে দৃষ্টি রাখবে। সুতরাং যে ব্যক্তিই মুসলিম, সে পরিচিত হোক বা অপরিচিত, তাকেই সালাম দেবে।
প্রশ্ন হতে পারে, ‘পরিচিত-অপরিচিত’ শব্দের ব্যাপকতার মধ্যে তো কাফের, ফাসেক ও মুনাফিক সকলেই পড়ে যায়, তাহলে তাদেরকেও কি সালাম দেওয়া হবে?
এর উত্তর হল, হাদীছটি দ্বারা এতটা ব্যাপকতা বোঝানো উদ্দেশ্য নয়। শুধু মুসলিমদের মধ্যে ‘পরিচিত-অপরিচিত’-এর ব্যাপকতা বোঝানো হয়েছে। এটা অন্যান্য দলীল দ্বারা বোঝা যায়। সারকথা এ হাদীছ দ্বারা মুসলিম-সমাজে সালামের ব্যাপক প্রচলন ঘটাতে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে।
বিশেষভাবে খাবার খাওয়ানো ও সালাম দেওয়াকে উত্তম বলা হয়েছে এ কারণে যে, খাদ্য হচ্ছে মানুষের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক চাহিদা। এ চাহিদা পূরণ করার দ্বারা মানুষের উপকার বেশি হয়। তাই এতে ছাওয়াবও বেশি। সালাম দেওয়ার দ্বারা বিনয় প্রকাশ পায়। তাছাড়া এটা নিজের পক্ষ থেকে নিরাপত্তা দানের ঘোষণাস্বরূপ। যাকে সালাম দেওয়া হয় তাকে যেন বোঝানো হয়, তুমি নিশ্চিত থাকো, আমার পক্ষ থেকে তোমার কোনওভাবে কোনও ক্ষতি করা হবে না। সে দৃষ্টিতে সালামের উপকার অনেক ব্যাপক। তাই এর ছাওয়াবও অনেক বেশি।
তাছাড়া সালাম দেওয়া ও খানা খাওয়ানো- এ উভয় কাজটি দ্বারা পারস্পরিক মহব্বত ও ভালোবাসা সৃষ্টি হয়। পারস্পরিক ভালোবাসা ঈমানের পরিপূর্ণতার জন্য শর্ত। এ গুরুত্বের কারণে তুলনামূলকভাবে এ আমলদু'টিতে ছাওয়াবও বেশি।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. যেসকল কাজে ছাওয়াব বেশি, আমল করার ক্ষেত্রে সেগুলোকে বেশি প্রাধান্য দেওয়া চাই।
খ. অন্যকে খাবার খাওয়ানো অতি বড় পুণ্যের কাজ। এ কাজে কিছুতেই কৃপণতা করতে নেই।
গ. পরিচিত-অপরিচিত যে-কোনও মুসলিমকে আগে আগে সালাম দেওয়ার অভ্যাস গড়ে তোলা চাই।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)