রিয়াযুস সালিহীন-ইমাম নববী রহঃ

৬. সালাম-মুসাফাহার আদব

হাদীস নং: ৮৪৫
সালাম-মুসাফাহার আদব
ষষ্ঠ ভাগ : সালামের বিধান ও আদবসমূহ
পরিচ্ছেদ:১ সালামের ফযীলত ও সালামের রেওয়াজদানের আদেশ
সালামের সূচনা কখন
হাদীছ নং: ৮৪৫

হযরত আবু হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, আল্লাহ তা'আলা আদম আলাইহিস সালামকে সৃষ্টি করার পর বললেন, যাও, ওদেরকে- ইঙ্গিত উপবিষ্ট একদল ফিরিশতার প্রতি- সালাম দাও আর লক্ষ করে শোনো তারা তোমাকে কী জবাব দেয়। এটাই তোমার ও তোমার বংশধরদের অভিবাদন। তিনি বললেন- السَّلَامُ عَلَيْكُمْ । তারা বললেন-السلام عَلَيْكَ وَرَحْمَةُ اللهِ তারা তাঁকে وَرَحْمَةُ اللَّهِ বেশি বললেন। -বুখারী ও মুসলিম
(সহীহ বুখারী: ৩৩২৬; সহীহ মুসলিম: ২৮৪১; জামে' মা'মার ইবন রাশিদ: ১৯৪৩৫; সহীহ ইবনে হিব্বান : ৬১৬২; বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান: ৮৪৭৯; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ: ৩২৯৮ )
كتاب السلام
كتَاب السَّلاَم
باب فضل السلام والأمر بإفشائه
845 - وعن أَبي هريرة - رضي الله عنه - عن النبيِّ - صلى الله عليه وسلم - قَالَ: «لَمَّا خَلَقَ اللهُ آدَمَ - صلى الله عليه وسلم - قَالَ: اذْهَبْ فَسَلِّمْ عَلَى أُولئِكَ - نَفَرٍ مِنَ المَلاَئِكَةِ جُلُوس - فَاسْتَمِعْ مَا يُحَيُّونَكَ؛ فَإنَّهَا تَحِيَّتُكَ وَتَحِيَّةُ ذُرِّيتِكَ. فَقَالَ: السَّلاَمُ عَلَيْكُمْ، فقالوا: السَّلاَمُ عَلَيْكَ وَرَحْمَةُ اللهِ، فَزَادُوهُ: وَرَحْمَةُ اللهِ». متفقٌ عَلَيْهِ. (1)

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এ হাদীছটিতে সালামের সূচনা কীভাবে হল তা জানানো হয়েছে। জানানো হয়েছে যে, এর সূচনা প্রথম মানুষ হযরত আদম আলাইহিস সালাম থেকেই। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন- لَمَّا خَلَقَ اللهُ آدَمَ (আল্লাহ তা'আলা যখন আদম আলাইহিস সালামকে সৃষ্টি করলেন)। হযরত আদম আলাইহিস সালাম প্রথম মানুষ। তিনি আমাদের আদি পিতা। আল্লাহ তা'আলা কোনও পিতা-মাতা ছাড়া তাঁকে সরাসরি সৃষ্টি করেছেন। তাঁকে সৃষ্টি করেছেন মাটি দ্বারা। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে-
وَإِذْ قَالَ رَبُّكَ لِلْمَلَائِكَةِ إِنِّي خَالِقٌ بَشَرًا مِنْ صَلْصَالٍ مِنْ حَمَإٍ مَسْنُونٍ
'সেই সময়কে স্মরণ করো, যখন তোমার প্রতিপালক ফিরিশতাদেরকে বলেছিলেন, আমি শুকনো কাদার ঠনঠনে মাটি দ্বারা এক মানব সৃষ্টি করতে চাই’। (সূরা হিজর, আয়াত ২৮)

আরও ইরশাদ হয়েছে-
إِنَّ مَثَلَ عِيسَى عِنْدَ اللَّهِ كَمَثَلِ آدَمَ خَلَقَهُ مِنْ تُرَابٍ ثُمَّ قَالَ لَهُ كُنْ فَيَكُونُ
'আল্লাহর নিকট ঈসার দৃষ্টান্ত আদমের মতো। আল্লাহ তাঁকে মাটি দ্বারা সৃষ্টি করেন। তাকে বলেন 'হয়ে যাও', অমনি সে হয়ে যায়’। ( সূরা আলে ইমরান, আয়াত ৫৯)

হযরত আদম আলাইহিস সালামকে সৃষ্টি করার পর আল্লাহ তা'আলা তাঁকে একদল ফিরিশতাকে দেখিয়ে হুকুম দিলেন- اذْهَب فَسلم عَلَى أولئك (যাও, তাদেরকে সালাম দাও)। খানিকটা দূরে একদল ফিরিশতা বসা ছিলেন। তাদের কাছে গিয়ে সালাম দেওয়ার হুকুম দ্বারা তাঁকে সালামের বাস্তব প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছিল। যখন কেউ কারও কাছে যায় বা কারও সাথে সাক্ষাৎ হয়, তখনই অভিবাদন বা সালামের প্রয়োজন হয়। এখানে সেভাবেই সালাম শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। সম্ভবত কী বাক্যে ফিরিশতাদেরকে সালাম দিতে হবে তাও আল্লাহ তা'আলা তাঁকে শিখিয়ে দিয়েছিলেন কিংবা তাঁর অন্তরে সে বাক্য সঞ্চার করে দিয়েছিলেন। সেমতে তিনি তাদের কাছে গেলেন এবং বললেন- - اَلسَّلَامُ عَلَيْكُمْ (আপনাদের প্রতি সালাম)। উত্তরে ফিরিশতাগণ। বললেন-
اَلسَّلَامُ عَلَيْكَ وَرَحْمَةُ اللَّهِ (আপনার প্রতি সালাম ও আল্লাহর রহমত)। ফিরিশতাগণ وَرَحْمَةُ اللَّهِ কথাটি অতিরিক্ত যোগ করলেন। শেখানো হল যে, সালামের চেয়ে সালামের জবাব উত্তম হতে হয়। অতিরিক্ত শব্দ যোগ করার দ্বারা জবাব উত্তম হয়।

ফিরিশতাগণ কয়েকজন থাকায় হযরত আদম আলাইহিস সালাম বহুবচনে বলেছেন- اَلسَّلَامُ عَلَيْكُمْ (আপনাদের প্রতি সালাম)। অপরদিকে হযরত আদম আলাইহিস সালাম একা হওয়ায় ফিরিশতাগণ একবচনে জবাব দিয়েছেন- السَّلَامُ عَلَيْك (আপনার প্রতি সালাম)। এখানে ফিরিশতাদের জবাবে السَّلَامُ শব্দ আগে বলা হয়েছে। এটাও জায়েয। তবে উত্তম হল এটা পরে ব্যবহার করা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে সেরকমই শিক্ষা দিয়েছেন। হযরত আদম আলাইহিস সালাম একা হওয়ায় ফিরিশতাগণ একবচনের শব্দ عَلَيْك ব্যবহার করেছেন। এটাও জায়েয। তবে উত্তম একজনের বেলায়ও বহুবচনে عَلَيْكُمْ বলা। কারণ মানুষ সে একা হলেও তার সঙ্গে সবসময় দু'জন ফিরিশতা থাকে। তাই সালামে তাদেরকেও শামিল রাখা চাই।

যাহোক সালাম ও সালামের উত্তরের প্রশিক্ষণ হয়ে গেল। এই সালাম ও উত্তর সম্পর্কে আল্লাহ তা'আলা হযরত আদম আলাইহিস সালামকে লক্ষ করে বলেছেন- فَإِنَّهَا تَحِيَّتُكَ وَتحِيَّةُ ذُرِّيتكَ (এটাই তোমার ও তোমার বংশধরদের অভিবাদন)। অর্থাৎ আমার দেওয়া বিধানরূপে এ সালামই হবে পারস্পরিক সাক্ষাৎকালে তোমার বংশধরদের অভিবাদন। বোঝা গেল অভিবাদনের ইসলামী রীতি হল সালামের আদান-প্রদান। সব যুগেই ইসলামই ছিল আল্লাহপ্রদত্ত একমাত্র দীন। প্রত্যেক নবীর প্রকৃত অনুসারীগণ ছিল মুসলিম। সব মুসলিমের জন্যই অভিবাদনরূপে সালামই ছিল বিধিসম্মত। কিন্তু অতীত জাতিসমূহ তাদের দীন বিকৃত করে ফেলেছে। কোনও সম্প্রদায় তাদের নবীর রেখে যাওয়া দীন সংরক্ষণ করেনি। তারা প্রতিনিয়ত তার মধ্যে সত্যদীন তথা ইসলাম থেকে সম্পূর্ণ বিচ্যুত হয়েছে। হারিয়ে ফেলেছে নবীর প্রকৃত শিক্ষা। সে ধারায় তাদের থেকে সালামের রেওয়াজও বিলুপ্ত হয়ে গেছে। ব্যতিক্রম কেবল আখেরী নবী হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উম্মত। তারা তাঁর রেখে যাওয়া দীনের পরিপূর্ণ হেফাজত করেছে। ফলে অন্যান্য বিধানের মতো সালামের বিধানটিও আজও পর্যন্ত এ উম্মতের মধ্যে চালু আছে। আজ এটা কেবলই সত্যদীন ইসলামের নিদর্শনরূপে প্রচলিত। এমনকি যারা ইসলামের অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিধানে গাফলাতি করে, পারস্পরিক সাক্ষাৎকালে তাদেরও প্রথম কাজ হয় সালাম বিনিময়। পাশ্চাত্য সভ্যতার আগ্রাসনে এ উম্মত তাদের অনেক বিশেষত্ব হারিয়ে ফেলেছে। কিন্তু সালাম বিনিময়ের মাধুর্যপূর্ণ অভিবাদন আজও স্বমহিমায় সমুজ্জ্বল। আদি পিতা হযরত আদম আলাইহিস সালামের আদর্শিক এ মীরাছ কেবল তাঁর আখেরী বংশধরগণই যত্নের সঙ্গে লালন করে চলেছে। উম্মত যদি এভাবে শেষনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যাবতীয় শিক্ষার অনুসরণে যত্নবান হয়, তবে এর ভেতর দিয়ে আদি পিতা হযরত আদম আলাইহিস সালামসহ পূর্ববর্তী অন্যসকল নবীর মৌলিক শিক্ষাসমূহও পুনর্জীবন লাভ করবে, যেমনটা একবার তা পুনর্জীবিত হয়েছিল এ উম্মতের শুরুর যমানায়।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. হযরত আদম আলাইহিস সালাম সর্বপ্রথম মানুষ। আল্লাহ তা'আলা সরাসরি তাঁকে পূর্ণ মানুষরূপে সৃষ্টি করেছেন। তিনি প্রাণীর অন্য কোনও রূপ থেকে বিবর্তিত নন।

খ. সালাম বিনিময়ের সূচনা হয়েছে হযরত আদম আলাইহিস সালাম থেকে।

গ. সালাম অপেক্ষা সালামের জবাবে অতিরিক্ত শব্দ ব্যবহার করা উত্তম।

ঘ . আদব হল আগন্তুক ব্যক্তি অবস্থানকারীদেরকে সালাম দেবে।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:বিশুদ্ধ (পারিভাষিক সহীহ)