রিয়াযুস সালিহীন-ইমাম নববী রহঃ

৬. সালাম-মুসাফাহার আদব

হাদীস নং: ৮৪৭
সালাম-মুসাফাহার আদব
ষষ্ঠ ভাগ : সালামের বিধান ও আদবসমূহ
পরিচ্ছেদ:১ সালামের ফযীলত ও সালামের রেওয়াজদানের আদেশ
ঈমান, পারস্পরিক ভালোবাসা ও সালামের মধ্যকার সম্পর্ক
হাদীছ নং: ৮৪৭

হযরত আবু হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না, যতক্ষণ না মুমিন হবে। আর তোমরা মুমিন হতে পারবে না. যতক্ষণ না একে অন্যকে ভালোবাস। আমি কি তোমাদেরকে এমন একটা বিষয়ের কথা বলে দেব না, যা করলে তোমরা একে অন্যকে ভালোবাসতে পারবে? তোমরা নিজেদের মধ্যে সালামের প্রসার ঘটাও। -মুসলিম
(সহীহ মুসলিম : ৫৪; সুনানে আবূ দাউদ: ৫১৯৩; জামে তিরমিযী ২৬৮৮: সুনানে ইবনে মাজাহ : ৬৮; মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বাহ: ২৫৭৪১; মুসনাদে আহমাদ: ১৪১২; বায়হাকী, আসসুনানুল কুবরা : ২১০৬৪)
كتاب السلام
كتَاب السَّلاَم
باب فضل السلام والأمر بإفشائه
847 - وعن أَبي هريرة - رضي الله عنه - قَالَ: قَالَ رسول الله - صلى الله عليه وسلم: «لاَ تَدْخُلُوا الجَنَّةَ حَتَّى تُؤمِنُوا، وَلاَ تُؤْمِنُوا حَتَّى تَحَابُّوا، أوَلاَ أدُلُّكُمْ عَلَى شَيْءٍ إِذَا فَعَلْتُمُوهُ تَحَابَبْتُمْ؟ أفْشُوا السَّلاَمَ بَيْنَكُمْ». رواه مسلم. (1)

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এ হাদীছে পর্যায়ক্রমে তিনটি বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। (ক) জান্নাতে যাওয়ার জন্য ঈমান শর্ত। (খ) মুমিন হওয়ার জন্য পারস্পরিক ভালোবাসা জরুরি। (গ) পরস্পরের মধ্যে ভালোবাসা সৃষ্টির উপায় সালামের বহুল ব্যবহার। তিনওটি একই সূত্রে গাঁথা। এর প্রথমটি পূর্ণতা পায় দ্বিতীয়টির দ্বারা। আর তৃতীয়টি হল দ্বিতীয়টি অর্জনের একটি শ্রেষ্ঠ উপায়। বাস্তবে বিষয় তিনটির যে পর্যায়ক্রম, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেই ক্রমানুসারেই বিষয় তিনটি উল্লেখ করেছেন। সুতরাং তিনি প্রথমে ইরশাদ করেন-
لَا تَدْخُلُوا الْجَنَّةَ حَتَّى تُؤْمِنُوا
‘তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না, যতক্ষণ না মুমিন হবে’।
অর্থাৎ জান্নাত লাভ করার জন্য ঈমান শর্ত। ঈমানওয়ালা তথা মুমিন ছাড়া কেউ জান্নাতে যেতে পারবে না। কুরআন মাজীদের বিভিন্ন আয়াতেও এটা স্পষ্ট করা হয়েছে। যেমন ইরশাদ হয়েছে-
إِنَّ اللَّهَ يُدْخِلُ الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ جَنَّاتٍ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ وَالَّذِينَ كَفَرُوا يَتَمَتَّعُونَ وَيَأْكُلُونَ كَمَا تَأْكُلُ الْأَنْعَامُ وَالنَّارُ مَثْوًى لَهُمْ
নিশ্চয়ই যারা ঈমান এনেছে ও সৎকর্ম করেছে, আল্লাহ তাদেরকে দাখিল করবেন এমন উদ্যানে, যার তলদেশে নহর বহমান থাকবে। আর যারা কুফর অবলম্বন করেছে তারা (দুনিয়ায়) মজা লুটছে এবং চতুষ্পদ জন্তু যেভাবে খায় সেভাবে খাচ্ছে। তাদের শেষ ঠিকানা জাহান্নাম। ( সূরা মুহাম্মাদ, আয়াত ১২)

আরও ইরশাদ হয়েছে-
مَنْ كَسَبَ سَيِّئَةً وَأَحَاطَتْ بِهِ خَطِيئَتُهُ فَأُولَئِكَ أَصْحَابُ النَّارِ هُمْ فِيهَا خَالِدُونَ - وَالَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ أُولَئِكَ أَصْحَابُ الْجَنَّةِ هُمْ فِيهَا خَالِدُونَ
'যেসব লোক পাপ কামায় এবং তার পাপ তাকে বেষ্টন করে ফেলে, তারাই জাহান্নামবাসী। তারা সর্বদা সেখানে থাকবে। যেসব লোক ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে, তারা জান্নাতবাসী। তারা সর্বদা সেখানে থাকবে।' (সূরা বাকারা, আয়াত ৮১-৮২)

এক হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-
والذي نفس محمد بيده، لَا يَسْمَعُ بِي أَحَدٌ مِنْ هَذِهِ الْأُمَّةِ يَهُودِيٌّ وَلَا نَصْرَانِيٌّ، ثم يموت ولم يؤمن بالذي أرسلت به إِلَّا كَانَ مِنْ أَصْحَابِ النَّارِ
'মুহাম্মাদের প্রাণ যাঁর হাতে সেই সত্তার কসম! এ উম্মত (আমার আগমনকাল থেকে কিয়ামত পর্যন্ত সমগ্র মানবজাতি)-এর মধ্যে যে-কেউ আমার সম্পর্কে শুনেছে, সে ইহুদি-নাসারা যেই হোক না কেন, যদি আমার নিয়ে আসা দীনের উপর ঈমান আনা ছাড়াই মারা যায়, তবে সে অবশ্যই জাহান্নামবাসী হবে’। (সহীহ মুসলিম: ১৫৩; মুসনাদে আহমাদ: ৮১৮৮; মুসনাদে আবূ দাউদ তয়ালিসী : ৫১১; মুসনাদুল বাযযার: ৩০৫০; সহীহ ইবনে হিব্বান: ৪৮৮০; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ: ৫৬)

ঈমানের বিভিন্ন স্তর আছে। যারা পূর্ণাঙ্গ স্তরের মুমিন, তারা শুরুতেই জান্নাত লাভ করবে। কিন্তু যাদের ঈমান পরিপূর্ণ নয়, অর্থাৎ ঈমানের সব দাবি পুরোপুরি পালন করে না, শরী'আতের যাবতীয় বিধান পরিপূর্ণরূপে মেনে চলে না, বিভিন্ন ত্রুটি-বিচ্যুতি ও পাপকর্ম করে ফেলে, তারা বিনা তাওবায় মারা গেলে ত্রুটি-বিচ্যুতির প্রায়শ্চিত্তস্বরূপ প্রথমে জাহান্নামের শাস্তি ভোগ করতে হবে। তাদের শাস্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার পর ঈমানের বদৌলতে তারা জান্নাতবাসী হবে। জাহান্নামের শাস্তি দুর্বিষহ। তাই প্রয়োজন শুরুতেই জান্নাত লাভ করা। আর সেজন্য দরকার পরিপূর্ণ স্তরের মুমিন হওয়া। পরিপূর্ণ মুমিন কীভাবে হওয়া যাবে, সে বিষয়ে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিভিন্ন নির্দেশনা দান করেছেন। যেমন আলোচ্য হাদীছটিতেই দ্বিতীয় পর্যায়ে নবী কারীম সরাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
وَلَا تُؤْمِنُوا حَتَّى تحابوا (আর তোমরা মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না একে অন্যকে ভালোবাস)। অর্থাৎ একে অন্যকে ভালোবাসার দ্বারা পরিপূর্ণ মুমিন হওয়া যায়। কাজেই প্রত্যেক ঈমানদারের কর্তব্য পরিপূর্ণ মুমিন হওয়ার লক্ষ্যে অন্যান্য মুমিনদের প্রতি অন্তরে ভালোবাসা পোষণ করা। কেননা একে অন্যকে ভালো না বাসলে পারস্পরিক হক নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকে। যার প্রতি ভালোবাসা থাকে না, তার হক আদায়ের প্রতিও বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয় না। ফলে তার প্রতি নানারকম জুলুম-অবিচার হয়ে যায়। হয়তো তার জান, মাল ও ইজ্জতের ক্ষতি করে ফেলে। যার দ্বারা অন্যের কোনওরকম ক্ষতি হয়, সে প্রকৃত মুমিন নয়। তাই অন্য কেউ যাতে কোনওভাবে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সে লক্ষ্যে প্রয়োজন অন্যের প্রতি অন্তরে ভালোবাসা সৃষ্টি করা। অন্যের প্রতি অন্তরে ভালোবাসা সৃষ্টির বিভিন্ন উপায় আছে। তার মধ্যে একটি হল বেশি বেশি সালাম দেওয়া। সুতরাং হাদীছটির তৃতীয় পর্যায়ে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
أَفْشُوا السَّلَامَ بَيْنَكُمْ (তোমরা নিজেদের মধ্যে সালামের প্রসার ঘটাও)। পরস্পরের মধ্যে সুসম্পর্ক সৃষ্টির প্রথম উপায় সালাম দেওয়া। এর দ্বারা প্রথমত অপরিচিতির জড়তা দূর হয়। যাকে সালাম দেওয়া হয় সে সালামদাতার প্রতি আকৃষ্ট হয়। সে তার সঙ্গে কথা বলতে আগ্রহ বোধ করে। এভাবে একজন অন্যজনের সঙ্গে পরিচিত হয়ে ওঠে। যদি তারা পূর্বপরিচিত হয় আর কোনও কারণে একে অন্যের প্রতি বিদ্বিষ্ট হয়ে পড়ে, তবে সালামের দ্বারা বিদ্বেষজনিত দূরত্ব কাটতে শুরু করে। তারপর যত বেশি সালাম বিনিময় হতে থাকে, ততোই উভয়ের মধ্যে সদ্ভাব জন্মাতে থাকে। বাড়তে থাকে ঘনিষ্ঠতা। তারপর একে অন্যের বন্ধুতে পরিণত হয়।

বস্তুত সালাম ইসলামী অভিবাদনের এক বৈশিষ্ট্যময় রীতি। এটা ইসলামের নিদর্শন। যেহেতু এটা ইসলামের নিদর্শন, তাই দরকার এর ব্যাপক প্রচার। সে লক্ষ্যে দরকার বেশি বেশি সালাম দেওয়া। তাতে আত্মিক পরিশুদ্ধিও অর্জিত হয়। কেননা সালাম দেওয়ার দ্বারা অহমিকা দূর হয় এবং অন্তরে বিনয় সৃষ্টি হয়। এর দ্বারা ছোট'র প্রতি স্নেহ-মমতার প্রকাশ ঘটে এবং বড়'র প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন হয়। এতসব কল্যাণ অর্জনের জন্য সালাম শুনিয়ে দেওয়া জরুরি।

সালাম যাকে দেওয়া হয় সে যদি তা শুনতে পায়, তখনই সালামের আছর ও প্রভাব তার অন্তরে পড়া সম্ভব। কাজেই মনে মনে সালাম দিলে চলবে না। এতটুক আওয়াজে দিতে হবে, যাতে সে শুনতে পায়। জবাবের ক্ষেত্রেও একই কথা। অনেকে হাত নেড়ে বা মাথা দুলিয়ে সালাম দেয়। কোনও কোনও পদস্থ লোক অধীনস্তদের সালামের জবাব দেয় মাথার ইশারায়। এটা অহমিকার লক্ষণ। এভাবে সালাম দেওয়া ও সালামের জবাব দেওয়া কিছুতেই উচিত নয়। এটা বিজাতীয় সংস্কৃতিও বটে। তাই এটা সম্পূর্ণ নিষেধ। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
لا تُسَلِّمُوا تَسْلِيمَ الْيَهُودِ وَالنَّصَارَى، فَإِنَّ تَسْلِيمَهُمْ بِالْأكُف وَالرُّؤوسِ وَالْإِشَارَةِ
তোমরা ইহুদি-নাসারার সালামের মতো সালাম দিয়ো না। তাদের সালাম হল হাত, মাথা ও ইশারার দ্বারা। (নাসাঈ, আস সুনানুল কুবরা ১০১০০; বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান: ৮৫২০)

তবে হাঁ, যাকে সালাম দেওয়া হয় সে যদি দূরে থাকে, তবে মুখে উচ্চারণ করার পাশাপাশি হাত দিয়ে ইশারাও করা যেতে পারে। যাতে সে বুঝতে পারে যে, তাকে সালাম দেওয়া হচ্ছে।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. জান্নাত লাভের জন্য মুমিন হওয়া শর্ত। মুমিন ছাড়া কেউ জান্নাতে যেতে পারবে না।

খ. আল্লাহর জন্য একে অন্যকে ভালোবাসলে ঈমানে পরিপূর্ণতা আসে।

গ. পরস্পরের মধ্যে ভালোবাসা সৃষ্টির এক উৎকৃষ্ট উপায় বেশি বেশি সালাম বিনিময়। তাই প্রত্যেক মুসলিমের উচিত সালামের অভ্যাস গড়ে তোলা।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:বিশুদ্ধ (পারিভাষিক সহীহ)