আল জামিউস সহীহ- ইমাম বুখারী রহঃ

৭৯- আহকাম (রাষ্ট্রনীতি) অধ্যায়

হাদীস নং: ৬৬৬৮
আন্তর্জাতিক নং: ৭১৫৩
- আহকাম (রাষ্ট্রনীতি) অধ্যায়
৩০১৪. রাস্তায় দাঁড়িয়ে বিচার করা কিংবা ফাতওয়া দেওয়া।
ইয়াহয়া ইবনে ইয়া'মার (রাহঃ) রাস্তায় বিচারকার্য করেছেন। শাবী (রাহঃ) তাঁর ঘরের দরজায় বিচারকার্য করেছেন।
৬৬৬৮। উসমান ইবনে আবি শাঈবা (রাহঃ) ......... আনাস ইবনে মালিক (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একবার আমি ও নবী (ﷺ) উভয়ে মসজিদ থেকে বের হচ্ছিলাম। এমন সময় একজন লোক মসজিদের আঙ্গিনায় আমাদের সাথে সাক্ষাত করে বলল, ইয়া রাসুলাল্লাহ! কিয়ামত কখন হবে? নবী (ﷺ) বললেনঃ তুমি তার জন্য কী প্রস্তুতি গ্রহণ করেছ? এতে লোকটি যেন কিছুটা লজ্জিত হল। তারপর বলল, ইয়া রাসুলাল্লাহ! রোযা, নামায, সাদ্‌কা খুব একটা তার জন্য করতে পারিনি। তবে আমি আল্লাহ ও তার রাসুলকে ভালবাসি। তিনি বললেনঃ তুমি যাকে ভালবাস, (কিয়ামতে) তার সাথেই থাকবে।
كتاب الأحكام
باب الْقَضَاءِ وَالْفُتْيَا فِي الطَّرِيقِ وَقَضَى يَحْيَى بْنُ يَعْمَرَ فِي الطَّرِيقِ. وَقَضَى الشَّعْبِيُّ عَلَى بَابُ دَارِهِ
7153 - حَدَّثَنَا عُثْمَانُ بْنُ أَبِي شَيْبَةَ، حَدَّثَنَا جَرِيرٌ، عَنْ مَنْصُورٍ، عَنْ سَالِمِ بْنِ أَبِي الجَعْدِ، حَدَّثَنَا أَنَسُ بْنُ مَالِكٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ، قَالَ: بَيْنَمَا أَنَا وَالنَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ خَارِجَانِ مِنَ المَسْجِدِ، فَلَقِيَنَا رَجُلٌ عِنْدَ سُدَّةِ المَسْجِدِ، فَقَالَ: يَا رَسُولَ اللَّهِ، مَتَى السَّاعَةُ؟ قَالَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «مَا أَعْدَدْتَ لَهَا؟» ، فَكَأَنَّ الرَّجُلَ اسْتَكَانَ، ثُمَّ قَالَ: يَا رَسُولَ اللَّهِ [ص:65]، مَا أَعْدَدْتُ لَهَا كَبِيرَ صِيَامٍ، وَلاَ صَلاَةٍ، وَلاَ صَدَقَةٍ، وَلَكِنِّي أُحِبُّ اللَّهَ وَرَسُولَهُ، قَالَ: «أَنْتَ مَعَ مَنْ أَحْبَبْتَ»

হাদীসের ব্যাখ্যা:

কিয়ামত সম্পর্কে প্রশ্নকারী ব্যক্তি ছিলেন একজন বেদুঈন সাহাবী। তাঁর নাম যুল-খুওয়ায়সিরা। এক বর্ণনা দ্বারা জানা যায়, তিনি যখন প্রশ্ন করেছিলেন তখন নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খুতবা দিচ্ছিলেন। ফলে তখন তিনি এর কোনও উত্তর দেননি। নামায শেষে যখন মসজিদ থেকে বের হন, তখন তিনি তাকে দেখতে পেয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি যেন কী প্রশ্ন করেছিলে? তিনি প্রশ্নটির পুনরাবৃত্তি করলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন ما اعددت لها (তার জন্য তুমি কী প্রস্তুতি গ্রহণ করেছ?)। অর্থাৎ কিয়ামত কবে হবে তা জানা কোনও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। তাই আল্লাহ তাআলা তা আমাদেরকে জানানওনি। কিয়ামত কবে হবে তা কেবল আল্লাহ তাআলাই জানেন। কুরআন মাজীদে আছে إِنَّ اللَّهَ عِنْدَهُ عِلْمُ السَّاعَةِ “নিশ্চয়ই কিয়ামত (-এর ক্ষণ) সম্পর্কিত জ্ঞান কেবল আল্লাহরই কাছে আছে।২৫৬

আল্লাহ তাআলা যে বিষয়ে জানাননি, তার পেছনে পড়ার কোনও জরুরত নেই। কিয়ামত কবে হবে তা জানার কোনও ফায়দাও নেই। প্রয়োজন হচ্ছে কিয়ামতের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করা। কেননা কিয়ামতের পর সকলকে আল্লাহর সামনে দাঁড়াতে হবে। সেদিন প্রত্যেককে তার কর্মের প্রতিদান দেওয়া হবে। কর্ম ভালো হলে ভালো প্রতিদান পাওয়া যাবে, মন্দ হলে মন্দ প্রতিদান। তাই কর্ম ভালো করা ও বেশি বেশি নেক আমলে যত্নবান থাকাই আসল কাজ। সেটাই উপকারে আসবে। তা সে কাজ তুমি কতখানি করেছ?

এ প্রশ্নে সেই সাহাবী দমে গেলেন। কিয়ামতের প্রস্তুতি হিসেবে তিনি নিজ আমলকে খুব নগণ্য মনে করলেন। হাঁ, একটা সম্পদ তিনি তাঁর অন্তরে লালন করতেন- আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের মহব্বত। তাঁর দৃষ্টিতে এর বিশেষ মূল্য ছিল। তাই কিয়ামতের প্রস্তুতিস্বরূপ তিনি সে সম্পদের কথাই প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সামনে তুলে ধরলেন। তিনি বললেন-

ما أعددت لها من كثير صوم، ولا صلاة، ولا صدقة، ولكني أحب الله ورسوله

(আমি সেজন্য রোযা নামায ও দান-সদাকার প্রস্তুতি বেশি গ্রহণ করতে পারিনি। তবে আমি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে ভালোবাসি)। অর্থাৎ প্রস্তুতি হিসেবে সৎকর্মের কথা যদি বলেন, তবে সেরকম প্রস্তুতি আমার বিশেষ কিছু নেই। যতটুকু করা হয়েছে, কিয়ামতের ভয়াবহতার বিপরীতে তা উল্লেখযোগ্য কিছু নয়। তবে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের মহব্বত আমার অন্তরে আছে। কিয়ামতের প্রস্তুতি হিসেবে এর কথা আমি উল্লেখ করতে পারি।

সত্য বটে। প্রত্যেক সাহাবীর অন্তরে আল্লাহপ্রেম ছিল ভরপুর। তাদের নবীপ্রেম ছিল অতুলনীয়। নিজ প্রাণের চেয়েও তারা তাঁকে বেশি ভালোবাসতেন। তাঁর জন্য তারা অকাতরে প্রাণ দিয়ে দিতে পারতেন। দিয়েও দিয়েছিলেন। তাদের সে মহব্বত ও প্রেম-ভালোবাসা ছিল নিখুঁত। তাই কিয়ামতের প্রস্তুতি হিসেবে তা পেশ করা মতই ছিল । সুতরাং নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার কদর করলেন এবং আশ্বাসবাণী শোনালেন أنت مع من أحببت (তুমি যাকে ভালোবাস তার সঙ্গেই থাকবে)। অর্থাৎ এ ভালোবাসার কারণে আল্লাহ তাআলার সাহায্য তোমার সঙ্গে থাকবে। তোমার প্রতি থাকবে তাঁর রহমতের দৃষ্টি। ফলে প্রয়োজনীয় সব মুহূর্তে তুমি তাঁর সাহায্য পাবে। ইবাদত বন্দেগীতে তাঁর তাওফীক লাভ হবে। মৃত্যুকালে, কবরে, হাশরে সর্বত্র তুমি তাঁর সাহায্য ও রহমতের অধিকারী হবে। আমাকেও তোমার সঙ্গে পাবে। আমার শাফা'আত তোমার নসীব হবে। আমার হাতে হাউজে কাউসারের পানি পান করার সৌভাগ্য লাভ করবে। জান্নাতেও আমার দেখা পাবে।

এসকল ভাব ও মর্ম নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সংক্ষিপ্ত বাক্যটির মধ্যে নিহিত আছে। তিনি সরাসরি এ কথা বলেননি যে, তুমি যখন আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে ভালোবাস, তখন তাঁদের সঙ্গেই থাকবে। বরং বলেছেন, যাকে ভালোবাস তার সঙ্গে থাকবে। এভাবে সাধারণভাবে বলার দ্বারা কথাটি সকলের জন্যই সমান প্রযোজ্য হয়। কেননা এর বার্তা হলো, ভালোমন্দ যাকেই ভালোবাস না কেন, আখেরাতে কিন্তু তোমাকে তার সঙ্গেই থাকতে হবে। আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে এবং নেককারদের ভালোবাসলে তাদের সঙ্গে থাকতে পারবে, আর যদি আল্লাহর দুশমন এবং বদকারদের ভালোবাস, তবে তাদের সঙ্গেই তোমার হাশর হবে। এবার চিন্তা করে দেখ তুমি ভালো কাকে বাসবে?

এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, যে ব্যক্তি আল্লাহ তাআলা ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ভালোবাসবে, সে নেক আমলেও বেশি যত্নবান থাকবে। বেশি বেশি নেক আমলে লেগে থাকাটাই সে ভালোবাসার সত্যতার প্রমাণ। যার এ ভালোবাসা যতবেশি খাঁটি, সে নিজের আমলকে ততবেশি নগণ্য ও ত্রুটিপূর্ণ মনে করে। বাস্তবিকপক্ষে এ স্তরের মানুষের আমলই মান ও পরিমাণে অন্যদের তুলনায় শ্রেষ্ঠ হয়ে থাকে।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. নিজ ঈমান ও আমলের পক্ষে যা উপকারী নয় সে সম্পর্কে প্রশ্ন করা ও জানতে চাওয়া সমীচীন নয়।

খ. আল্লাহ তাআলার ইশক ও নবীপ্রেমই দুনিয়া ও আখেরাতের নাজাত ও সফলতা লাভের প্রধান অবলম্বন।

গ. এ ইশক ও মহব্বতের দাবিতে সাধ্য অনুযায়ী নেক আমল করে যাওয়া চাই।

২৫৬. সূরা লুকমান (৩১), আয়াত ৩৪
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:বিশুদ্ধ (পারিভাষিক সহীহ)