মোহর ও খুতবা ছাড়া বিবাহ
প্রশ্নঃ ১১৫৬৩. আসসালামুআলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ, পাত্র ও পাত্রী উভয় অভিভাবক এর সম্মতিতে ২ জন সাক্ষীর সামনে কবুল বললো ।কিন্তু বিয়ের খুতবা ও পড়া হয় নি। এবং তাদের দেনমোহর ঠিক হলো না।পাত্রী পরে দেনমোহর চেয়ে নেবে এই কথা বললো। এই ক্ষেত্রে বিয়ে হবে কি ?? পাত্রীর সম্মতিতে তারা দুজন কি মিশতে পারবে?
উত্তর
و علَيْــــــــــــــــــــكُم السلام ورحمة الله وبركاته
بسم الله الرحمن الرحيم
বিবাহের সুন্নতসম্মত তরিকা হলো, দুই জন সাক্ষীর উপস্থিতি একজন (বর-কনে কিংবা তাদের নিযুক্ত অভিভাবক) অপর জনকে ইজাব (প্রস্তাব) করবে তারপর অপরজন কবুল বলবে। ইজাব ছাড়া কবুল বললে কিংবা পরস্পরকে স্বামী-স্ত্রী হিসেবে মেনে নিলেই বিবাহ সহিহ হবে না।
বিবাহে খুতবা পাঠ করা সুন্নত। বিনা ওজরে বিবাহের ন্যায় এমন একটি গুরুত্বপূর্ন কাজে এই সুন্নত পরিহার করা উচিত নয়।
ইজাব-কবুলের পূর্বে মোহর নির্ধারণ করে নেওয়া উত্তম। মোহর নির্ধারণ করা ছাড়া বিবাহ হলে সেক্ষেত্রে মহরে মিছাল দিতে হবে। তবে কখন আদায় করবে সেই ব্যাপারে তারা আলোচনা করে নিতে পারে।
বিবাহ সহিহ না হলে তাদের পরস্পরের দেখা সাক্ষাত করা জায়েজ নাই।
সুন্নতসম্মত বিবাহ সম্পর্কে আরো বিস্তারিত জানতে নিচের রেফারেন্স উত্তরগুলো দেখতে পারেন।
والله اعلم بالصواب
উত্তর দাতা:
বাইতুল কুরআন মাদারাসা , মোহাম্মাদপুর
রেফারেন্স উত্তর :
প্রশ্নঃ ৫১৯৬. আসসালামুআলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ, নবীর সুন্নত তরিকায় বিয়ে করার নিয়ম কি?
উত্তর
و علَيْــــــــــــــــــــكُم السلام ورحمة الله وبركاته
بسم الله الرحمن الرحيم
বিবাহের সুন্নাত সমূহ
১. মাসনূন বিবাহ সাদাসিধে ও অনাড়ম্বর হবে, যা অপচয়, অপব্যয়, বেপর্দা ও বিজাতীয় সংস্কৃতি, গান-বাদ্য, ভিডিও-অডিও মুক্ত হবে এবং তাতে যৌতুকের শর্ত বা সামর্থ্যের অধিক মহরানার শর্ত থাকবে না। (তাবরানী আউসাত, হাদীস নং- ৩৬১২)
২. সৎ ও খোদাভীরু পাত্র-পাত্রীর সন্ধান করে বিবাহের পয়গাম পাঠানো। কোন বাহানা বা সুযোগে পাত্রী দেখা সম্ভব হলে, দেখে নেয়া মুস্তাহাব। কিন্তু আনুষ্ঠানিকভাবে ঘটা করে পাত্রী দেখানোর যে প্রথা আমাদের সমাজে প্রচলিত, তা সুন্নাতের পরিপন্থী ও পরিত্যাজ্য। (ইমদাদুল ফাতাওয়া, ৪ : ২০০/ বুখারী হাদীস নং- ৫০৯০)
৩. শাওয়াল মাসে এবং জুমু‘আর দিনে মসজিদে বিবাহ সম্পাদন করা। উল্লেখ্য, সকল মাসের যে কোন দিন বিবাহ করা জায়েয আছে। (মুসলিম, হাদীস নং- ১৪২৩/ বাইহাকী, হাদীস নং- ১৪৬৯৯)
৪. বিবাহের খবর ব্যাপকভাবে প্রচার করে বিবাহ করা এবং বিবাহের পরে আকদ অনুষ্ঠানে উপস্থিত লোকদের মাঝে খেজুর বণ্টন করা। (বুখারী শরীফ, হাদীস নং- ৫১৪৭)
৫. সামর্থ্যানুযায়ী মহর ধার্য করা।(আবু দাউদ: হাদীস নং- ২১০৬)
৬. বাসর রাতে স্ত্রীর কপালের উপরের চুল হাতে নিয়ে এই দু‘আ পড়াঃ
اَللّهُمَّ إنِّيْ أسْألُكَ مِنْ خَيْرِهَا وَخَيْرِ مَا جَبَلْتَ عَلَيْهِ . وأعُوْذُ بِكَ مِنْ شَرِّهَا وَشَرِّ مَا جَبَلْتَ عَلَيْهِ.
(আবু দাউদ, হাদীস নং- ২১৬০)
৭. স্ত্রীর সঙ্গে প্রথমে অন্তরঙ্গতা সৃষ্টি করবে, তারপর যখনই সহবাস-এর ইচ্ছা হয়, তখন প্রথমে নিম্নোক্ত দু‘আ পড়ে নেবেঃ
بِسْمِ اللّهِ اَللَّهُمَّ جَنِّبْنَا الشَّيْطَانَ وَجَنِّبِ الشَّيْطانَ مَا رَزَقْتَنَا.
(মুসলিম, হাদীস নং- ১৪৩৪)
বি.দ্র. উপরোক্ত দু‘আ না পড়লে শয়তানের তাছীরে বাচ্চার উপর কু-প্রভাব পড়ে। অতঃপর সন্তান বড় হলে, তার মধ্যে ধীরে ধীরে তা প্রকাশ পেতে থাকে এবং বাচ্চা নাফরমান ও অবাধ্য হয়। সুতরাং পিতা-মাতাকে খুবই সতর্ক থাকা জরুরী।
৮. বাসর রাতের পর দু’হাতে আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, শুভাকাঙ্ক্ষী এবং গরীব-মিসকিনদের তাওফীক অনুযায়ী ওলীমা খাওয়ানোর আয়োজন করা। (মুসলিম, হাদীস নং- ১৪২৭)
বি.দ্র. (ক) কোন পক্ষ যেওরের শর্ত করা নিষেধ এবং ছেলের পক্ষ থেকে যৌতুক চাওয়া হারাম। (আহসানুল ফাতাওয়া, ৫ : ১৩)
(খ) কনের ইযন-এর জন্য সাক্ষীর কোন প্রয়োজন নাই। সুতরাং ছেলের পক্ষের লোক ইযন শুনতে যাওয়া অনর্থক এবং বেপর্দা। সুতরাং তা নিষেধ। মেয়ের কোন মাহরাম বিবাহের উকিল হওয়ার অনুমতি নিবে। (মুসলিম, হাদীস নং- ১৪২১)
(গ) শর্ত আরোপ করে বরযাত্রীর নামে বরের সাথে অধিক সংখ্যক লোকজন নিয়ে যাওয়া এবং কনের বাড়ীতে মেহমান হয়ে কনের পিতার উপর বোঝা সৃষ্টি করা আজকের সমাজের একটি জঘন্য কু-প্রথা, যা সম্পূর্ণরূপে পরিত্যাগ করা আবশ্যক। (মুসনাদে আহমদ, হাদীস নং- ২০৭২২/ বুখারী হাদীস নং- ২৬৯৭)
(ঘ) ওলীমায় অতিরিক্ত ব্যয় করা কিংবা খুব উঁচু মানের খানার ব্যবস্থা করা জরুরী নয়। বরং সামর্থ্যানুযায়ী খরচ করাই সুন্নাত আদায়ের জন্য যথেষ্ট। যে ওলীমায় শুধু ধনী ও দুনিয়াদার লোকদের দাওয়াত করা হয়, দীনদার ও গরীব-মিসকিনদের দাওয়াত করা হয় না, সে ওলীমাকে হাদীসে নিকৃষ্টতম ওলীমা বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। সুতরাং এ ধরনের নিকৃষ্ট ওলীমার আয়োজন থেকে বিরত থাকা উচিত।(আবু দাউদ, হাদীস নং- ৩৭৫৪)
(ঙ) ওলীমার মজলিসে হাদিয়া লেন-দেন ঠিক নয়। কেউ হাদিয়া দিতে চাইলে নিজের সুযোগ মত পাঠিয়ে দিবে, প্রচার করবে না। গোপনে দিবে, এটাই হাদিয়ার সুন্নাত।
والله اعلم بالصواب
উত্তর দাতা:
প্রশ্নঃ ১০৪৬০. আসসালামুআলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ, ইসলামীক বিয়ের নিয়মটা জানাবেন কী? যেটাতে খরচ অনেক কম ও বরকত অনেক বেশি !
উত্তর
و علَيْــــــــــــــــــــكُم السلام ورحمة الله وبركاته
بسم الله الرحمن الرحيم
সুন্নত তরিকায় বিবাহ সম্পাদন বরকতময় হয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন: নিশ্চয় সে বিয়ে বেশি বরকতপূর্ণ হয়, যে বিয়েতে খরচ কম হয়। (মুসনাদে আহমাদ ও মুস্তাদরাকে হাকিম)। এ ছাড়া বিয়ে সংশ্লিষ্ট আরও কিছু সুন্নত রয়েছে, যেমন: বিবাহ সাদাসিধে ও অনাড়ম্বর হওয়া, অপচয়, অপব্যয় ও বিজাতীয় অপসংস্কৃতিমুক্ত হওয়া এবং সামর্থ্যের অধিক দেনমোহর ধার্য বা শর্ত না করা। (তাবারানি আওসাত, হাদিস নং-৩৬১২)। (আবু দাউদ: ২১০৬)
এমনিভাবে কনেপক্ষ থেকে অলংকারের শর্ত করা বা ছেলেপক্ষ থেকে যৌতুক চাওয়া উভয়টিই নিষিদ্ধ। (আহসানুল ফাতাওয়া, খণ্ড: ৫, পৃষ্ঠা: ১৩)।
সৎ ও খোদাভীরু পাত্র-পাত্রীর সন্ধান করা এবং কোনো সুযোগে পাত্রী দেখা সম্ভব হলে দেখে নেওয়া। বিয়ের পর ছেলের পক্ষ তার আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, শুভাকাঙ্ক্ষী ও গরিব-মিসকিনদের তৌফিক অনুযায়ী আপ্যায়ন করাকে ‘ওয়ালিমা’ বলে। বাংলায় ওয়ালিমাকে বউভাতও বলা হয়ে থাকে। বিয়ের পরদিন বা পরবর্তী সময়ে সুবিধামতো নিকটতম সময়ের মধ্যে ওয়ালিমা করা বিধেয়। তবে তিন দিনের মধ্যে করা উত্তম। যেকোনো প্রকার খাদ্যদ্রব্য দিয়ে ওয়ালিমা করা যায়। ওয়ালিমা একটি ইবাদত। একদিন ওয়ালিমা করা সুন্নত, দুইদিন ওয়ালিমা করা মুস্তাহাব, তিনদিন ওয়ালিমা করা জায়েজ। (মুসলিম: ১৪২৭)।
ওয়ালিমা করা এক গুরুত্বপূর্ণ সুন্নত। রাসুলুল্লাহ (সা.) নিজে ওয়ালিমা করেছেন এবং সাহাবিদের করতে বলেছেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) জয়নব বিনতে জাহাশ (রা.)-কে বিয়ে করার পরদিন ওয়ালিমা করেছিলেন। (বুখারি, হাদিস নম্বর-৫১৭০)। এমনিভাবে ছাফিয়াহ (রা.)-কে বিয়ের পর তিনদিন যাবৎ ওয়ালিমা খাইয়েছিলেন। (মুসনাদে আবু ইয়ালা, হাদিস নম্বর-৩৮৩৪)।
হজরত আনাস (রা.) বলেন, নবী (সা.) আবদুর রহমান ইবনে আওফের গায়ে হলুদ রঙের চিহ্ন দেখে জিজ্ঞেস করলেন, এটা কী? তিনি বললেন, আমি এক খেজুর আঁটির ওজন স্বর্ণ দিয়ে একজন মহিলাকে বিবাহ করেছি। রাসুল (সা.) বললেন, ‘আল্লাহ তোমার বিবাহে বরকত দান করুক। একটি ছাগল দ্বারা হলেও তুমি ওয়ালিমা করো।’ (বুখারি: ৫১৫৫; মুসলিম ও মিশকাত, হাদিস নম্বর-৩২১০)।
উপরোক্ত হাদিসের মাধ্যমে প্রনিধানযোগ্য বিষয় এই যে, আব্দুর রহমান ইবনে আউফ (রাদিআল্লাহু তা'আলা আনহু) এর মত সাহাবী যিনি বিপুল সম্পদের মালিক ছিলেন, অপরদিকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যিনি সাহাবীদের চোখের মনি এবং পৃথিবীর সবচেয়ে প্রিয় ব্যক্তিত্ব এমনকি তাদের নিজেদের জীবনের চেয়েও প্রিয় ছিলেন। সেই সাহাবায়েকরামদের মধ্য থেকে যখন কেউ একজন বিয়ে করলেন, তখন ওই বিয়ে এত অনারম্বর এবং সাদাসিধে ছিল যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও জানেন নি। কতই না সহজ-সরল ছিল তাহাদের বিবাহ-সাদী। যার কারনে ওই সময়ে গুনাহ এবং ব্যভিচারের সংখ্যা ছিল খুবই কম। অথচ বর্তমানে জাঁকজমক- বিলাসিতা, অপচয় এবং সামাজিক রীতিনীতির প্যাঁচের মাধ্যমে বিবাহকে আমরা খুবই কঠিন করে ফেলেছি , অপরদিকে বিবাহবহির্ভূত অবৈধ প্রেম ভালোবাসা রাস্তা খুলে দিয়েছি। যার কারণে সমাজের ছড়িয়ে পড়ছে বেহায়াপনা ও বিশৃঙ্খলা।
সুতরাং বিবাহ হওয়া চাই সাদা-সিধে, অনারম্বর, অপচয় মুক্ত, সুন্নতানুসারে এবং ওয়ালিমায় অতিরিক্ত ব্যয় করা কিংবা খুব উঁচু মানের খানার ব্যবস্থা করাও জরুরি নয়। বরং সামর্থ্য অনুযায়ী খরচ করাই সুন্নত আদায়ের জন্য যথেষ্ট। যে ওয়ালিমায় শুধু ধনী ও দুনিয়াদার লোকদের দাওয়াত দেওয়া হয়, দ্বীনদার ও গরিব-মিসকিনদের দাওয়াত দেওয়া হয় না, সেই ওয়ালিমাকে হাদিসে নিকৃষ্টতম ওয়ালিমা বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। (আবু দাউদ:)
এমনিভাবে মেয়ের বাড়িতেও যে ভোজের আয়োজন করা হয়, তা শরিয়তসম্মত নয়। বিয়েতে মেয়েপক্ষের কোনোরূপ খরচ করার কথা নয়। আপ্যায়নের উদ্দেশ্যে অনারম্বর ভাবে সামান্য কিছু আয়োজন করা যেতে পারে। (বুখারি, হাদিস নম্বর-৬০১৮)।
তবে আপ্যায়নের নামে মেয়েদের উপর সামাজিক প্রচলন ও রুসমতের উপর ভিত্তি করে মেয়ে পক্ষের ওপর আপ্যায়নের যে চাপ সৃষ্টি করা হয়, তা সম্পূর্ণ হারাম। সর্বোপরি শর্ত আরোপ করে বরযাত্রীর নামে বরের সঙ্গে অধিকসংখ্যক লোক নিয়ে যাওয়া এবং কনের বাড়িতে মেহমান হয়ে কনের পিতার ওপর বোঝা সৃষ্টি করা বর্তমান সমাজের একটি জঘন্য কুপ্রথা, যা সম্পূর্ণরূপে পরিত্যাগ করা আবশ্যক। (মুসনাদে আহমাদ: ২০৭২২, বুখারি: ২৬৯৭)।
والله اعلم بالصواب
উত্তর দাতা:
শাইখ আবু সাঈদ ইসলামিক রিসার্চ সেন্টার, মোহাম্মাদপুর।
মন্তব্য (0)
কোনো মন্তব্য নেই। প্রথম মন্তব্য করুন!
মন্তব্য করতে লগইন করুন