আত্-তারগীব ওয়াত্-তারহীব- ইমাম মুনযিরী রহঃ

২. কুরআন-সুন্নাহর অনুসরণ

হাদীস নং: ৭৮
কুরআন-সুন্নাহর অনুসরণ
সুন্নত বর্জন, বিদআত অবলম্বন এবং প্রবৃত্তি পূজার প্রতি ভীতি প্রদর্শন
৭৮. হযরত জাবির (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা) যখন ভাষণ দিতেন তখন তাঁর চক্ষুদ্বয় হয়ে উঠতো রক্তিম বর্ণ, কণ্ঠস্বর হতো উচ্চ এবং তাঁর গোস্বা কঠিনরূপ ধারণ করত। মনে হতো তিনি যেন কোন সেনাদলকে সাবধান করছেন। তিনি বলতেন, তোমাদের উপর সকালে ও সন্ধ্যায় দুশমন হামলা করবে। তিনি কখনো কখনো হাতের তর্জনি ও মধ্যমা অঙ্গুলী একত্র করে বলতেনঃ আমাকে এমন এক সময়ে প্রেরণ করা হয়েছে যখন আমার এবং কিয়ামতের ব্যবধান এই দুই অংগুলি তুল্য। এরপর তিনি হামদ ও সানা শেষে বলতেন: কুরআনের বাণী সর্বোত্তম বাণী এবং মুহাম্মদ (সা) এর হিদায়াত সর্বোত্তম হিদায়ত। সর্ব নিকৃষ্ট কাজ হল দ্বীনের মধ্যে বিদআত সৃষ্টি করা, প্রত্যেক বিদআতই গুমরাহী। তিনি আরো বলতেনঃ আমি সকল মুমিনের জন্য তাদের নিজেদের চাইতেও ঘনিষ্টতর। যে ব্যক্তি ধন-সম্পদ রেখে মৃত্যুবরণ করে, তা তার পরিবারবর্গের জন্য, আর যে ব্যক্তি কোন ঋণ অথবা অসহায় সন্তান রেখে মারা যায়, তার ঋণ পরিশোধ করা এবং তার সন্তানের প্রতিপালনের দায়িত্ব আমার।
(ইমাম মুসলিম, ইব্ন মাজাহ প্রমুখ হাদীসটি রিওয়ায়াত করেছেন।)
كتاب السنة
التَّرْهِيب من ترك السّنة وارتكاب الْبدع والأهواء
78 - وَعَن جَابر رَضِي الله عَنهُ قَالَ كَانَ رَسُول الله صلى الله عَلَيْهِ وَسلم إِذا خطب احْمَرَّتْ عَيناهُ وَعلا صَوته وَاشْتَدَّ غَضَبه كَأَنَّهُ مُنْذر جَيش يَقُول صبحكم ومساكم وَيَقُول بعثت أَنا والساعة كهاتين ويقرن بَين أصبعيه السبابَة وَالْوُسْطَى
وَيَقُول أما بعد فَإِن خير الحَدِيث كتاب الله وَخير الْهَدْي هدي مُحَمَّد وَشر الْأُمُور محدثاتها وكل بِدعَة ضَلَالَة
ثمَّ يَقُول أَنا أولى بِكُل مُؤمن من نَفسه من ترك مَالا فلاهله وَمن ترك دينا أَو ضيَاعًا فَإِلَيَّ وَعلي
رَوَاهُ مُسلم وَابْن مَاجَه وَغَيرهمَا

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এ হাদীছ দ্বারা উম্মতের প্রতি নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের দরদ ও মমত্ববোধ, কিয়ামতের নৈকট্য, আল্লাহর কিতাব ও নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের তরিকার মাহাত্ম্য ও বিদ'আতের নিকৃষ্টতা উপলব্ধি করা যায়।

কেমন হত নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের ভাষণ
এ হাদীছটির বর্ণনায় হযরত জাবির রাযি. প্রথমে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন ভাষণ দিতেন তখন তাঁর চেহারার ভাব-ভঙ্গি কেমন হত তা তুলে ধরেছেন। তিনি বলেন, ভাষণ দেওয়ার সময় তাঁর চোখ লাল হয়ে যেত, আওয়াজ চড়া হয়ে যেত ও রাগ বেড়ে যেত। এটা সাধারণ বক্তা ও ভাষণদাতার বিপরীত। সাধারণ ভাষণদাতাদের ভাষণে থাকে শৈল্পিক ভাব-ভঙ্গি। তাতে ভাষণটাই হয় মুখ্য। কিন্তু নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিলেন উম্মতের দরদী বন্ধু। তাদের মুক্তি ও কল্যাণই ছিল তাঁর লক্ষ্যবস্তু। তিনি যখন নিজ উম্মতের অবস্থা লক্ষ করতেন এবং তাতে তাঁর শিক্ষা অনুসরণে কোনও ত্রুটি দেখতে পেতেন, তখন বেজায় দুঃখ পেতেন এবং সে ত্রুটির অশুভ পরিণাম চিন্তা করে উৎকণ্ঠিত হয়ে উঠতেন। তাঁর ভাষণে সে গভীর উৎকণ্ঠারই বহিঃপ্রকাশ ঘটত বলে চোখ লাল হয়ে যেত ও কথা বলতেন রাগতঃস্বরে। সুতরাং এটা—না'ঊযুবিল্লাহ —তাঁর স্বভাবের কঠোরতা নয়; বরং রহমদিলেরই পরিচায়ক ছিল।

তাঁর ভাষণকে ওই সতর্ককারীর ভাষণের সাথে তুলনা করা হয়েছে, যে তার জাতিকে কোনও হানাদার বাহিনীর ব্যাপারে সতর্ক করে আর বলে, তোমরা আত্মরক্ষার চেষ্টা কর। ভোরবেলায়ই ওরা তোমাদের ওপর হামলা চালাবে বা সন্ধ্যাবেলায়ই তোমাদের ওপর হামলা চালাবে। তোমাদের হাতে সময় নেই। আত্মরক্ষার জন্য এখনই ব্যবস্থা নাও। অবহেলা করবে তো ধ্বংস হয়ে যাবে। তো নিজ কওমকে বাঁচানোর জন্য ওই ব্যক্তির মনে যে প্রচণ্ড আবেগ-উৎকণ্ঠা থাকে, নিজ উম্মতকে দুনিয়া ও আখিরাতের অনিষ্টতা থেকে বাঁচানোর জন্য নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের মনের তাড়না ছিল তারচে' অনেক অনেক তীব্র। আর সে কারণেই ভাষণ দেওয়ার সময় তাঁর এরকম অবস্থা হত।

অতঃপর হযরত জাবির রাযি. নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের একটি ভাষণের অংশবিশেষ বর্ণনা করেছেন। এতে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিশেষভাবে কয়েকটি বিষয়ের প্রতি উম্মতের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। সর্বপ্রথম ইরশাদ করেন-
بعثت أنا والسَّاعَةُ كَهَائين، ويقرن بين أصبعيه السبابة والوسطى
“তিনি বলতেন, আমি এবং কিয়ামত এভাবে প্রেরিত হয়েছি। এই বলে তিনি তাঁর তর্জনী ও মধ্যমা আঙ্গুলদু'টি মিলিয়ে দেখাতেন।”

কিয়ামতের নৈকট্য বোঝানোর জন্য নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজ তর্জনী ও মধ্যমা আঙ্গুল দ্বারা ইশারা করে বলেছেন যে, আমি ও কিয়ামত এভাবে প্রেরিত হয়েছি। এর দ্বারা এক তো বোঝা যাচ্ছে কিয়ামত খুব কাছে। তর্জনীর পরপরই যেমন মধ্যমা আঙ্গুল, ঠিক তেমনি নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের আবির্ভাবের পরপরই কিয়ামত। দ্বিতীয়ত বোঝা যাচ্ছে তিনিই সর্বশেষ নবী। তাঁর ও কিয়ামতের মাঝখানে আর কোনও নবী নেই, যেমন তর্জনী ও মধ্যমার মাঝখানে আর কোনও আঙ্গুল নেই।

কুরআন মাজীদ কেমন কিতাব
এরপর মূল বক্তব্য শুরু হয়েছে। তাতে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রথমে কুরআন মাজীদের শ্রেষ্ঠত্ব ও মাহাত্ম্য উল্লেখ করতে গিয়ে বলেন-
فإن خَيْرَ الْحَدِيثِ كِتَابُ اللهِ
'সর্বোত্তম কথা আল্লাহর কিতাব।'

আল্লাহর কিতাব যে সর্বোত্তম কথা ও শ্রেষ্ঠতম বাণী– এতে সন্দেহের কোনও অবকাশ নেই। বলা হয়ে থাকে, রাজার কথা সকল কথার রাজা। আল্লাহ তা'আলা তো সকল রাজাদেরও রাজা। মহাবিশ্বের একমাত্র অধিপতি। সুতরাং তাঁর কথা সকল রাজা-বাদশা ও কুলমাখলুকাতের কথা অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ হবে—এটাই তো স্বাভাবিক। তাঁর বাণী আল-কুরআনের ভাষা অলৌকিক ও হৃদয়গ্রাহী। আগাগোড়া সামঞ্জস্যপূর্ণ। এতে আছে প্রয়োজনীয় সব বিধান- সার্বজনীন জীবনবিধান, আছে উপদেশমালা, আছে সতর্কবাণী ও সুসংবাদ, আছে অতীত ঘটনাবলী ও অনেক ভবিষ্যদ্বাণী, আছে দৃশ্যমান জগৎ সম্পর্কে আলোচনা, আছে অদৃশ্য ও গায়েবী জগতের বর্ণনা। এর প্রতিটি কথা সত্য-সঠিক। সর্বোতভাবে পূর্ণাঙ্গ এক কিতাব। মানুষের অন্তর প্রভাবিত করে। তাতে নম্রতা ও কোমলতা সৃষ্টি করে। তা জীবন বদলের প্রেরণা যোগায়। মানুষকে প্রকৃত মানুষ ও আল্লাহর খাঁটি বান্দা হয়ে উঠার পথ দেখায়। আল্লাহ তা'আলা নিজেই তাঁর এ কিতাবের পরিচয় দিতে গিয়ে বলেন-
اللَّهُ نَزَّلَ أَحْسَنَ الْحَدِيثِ كِتَابًا مُتَشَابِهًا مَثَانِيَ تَقْشَعِرُّ مِنْهُ جُلُودُ الَّذِينَ يَخْشَوْنَ رَبَّهُمْ ثُمَّ تَلِينُ جُلُودُهُمْ وَقُلُوبُهُمْ إِلَى ذِكْرِ اللَّهِ ذَلِكَ هُدَى اللَّهِ يَهْدِي بِهِ مَنْ يَشَاءُ
আল্লাহ নাযিল করেছেন সর্বোত্তম বাণী—এমন এক কিতাব, যার বিষয়বস্তুসমূহ পরস্পর সুসামঞ্জস্যপূর্ণ, (যার বক্তব্যসমূহ) পুনরাবৃত্তিকৃত, যারা তাদের প্রতিপালককে ভয় করে, এর দ্বারা তাদের শরীর রোমাঞ্চিত হয়। তারপর তাদের দেহ-মন বিগলিত হয়ে আল্লাহর স্মরণে ঝুঁকে পড়ে। এটা আল্লাহর হিদায়াত, যার মাধ্যমে তিনি যাকে চান সঠিক পথে নিয়ে আসেন। (সূরা যুমার (৩৯), আয়াত ২৩)

নববী তরিকার শ্রেষ্ঠত্ব
তারপর নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
وَخَيْرَ الْهَدْي هَدْيُ مُحَمَّدٍ
সর্বোত্তম তরিকা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের তরিকা।
তাঁর তরিকা বলতে তাঁর জীবনাদর্শ বোঝানো হয়েছে। তাঁর বিশ্বাস ও কর্ম, ইবাদত-বন্দেগী, আখলাক-চরিত্র, আচার-আচরণ ইত্যাদি সবই এর অন্তর্ভুক্ত। তিনি ছিলেন কুরআনের বাস্তব নমুনা। কাজেই তাঁর তরিকা ও জীবনাদর্শ সর্বোত্তম হতে বাধ্য। এ কথাটি দ্বারা মূলত উদ্দেশ্য হচ্ছে আমাদেরকে তাঁর তরিকামত চলতে উৎসাহ দেওয়া। আমরা যদি আমাদের জীবনকে উত্তম জীবন বানাতে চাই এবং জীবনের যাবতীয় কাজকর্ম সুন্দর ও সুচারুরূপে আঞ্জাম দিতে চাই, তবে এর জন্য দরকার উৎকৃষ্টতম কোনও তরিকা ও জীবনাদর্শের অনুসরণ। বলাবাহুল্য, এ ক্ষেত্রে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের তরিকার কোনও বিকল্প নেই। আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেন-
لَقَدْ كَانَ لَكُمْ فِي رَسُولِ اللَّهِ أَسْوَةٌ حَسَنَةٌ لِمَنْ كَانَ يَرْجُوا اللهَ وَالْيَوْمَ الْآخِرَ وَذَكَرَ اللَّهَ كَثِيرا
বস্তুত আল্লাহর রাসূলের মধ্যে তোমাদের জন্য রয়েছে উত্তম আদর্শ—এমন ব্যক্তির জন্য, যে আল্লাহ ও আখিরাত দিবসের আশা রাখে এবং আল্লাহকে অধিক পরিমাণে স্মরণ করে। (সূরা আহযাব (৩৩), আয়াত ২১)

বিদ'আতের কদর্যতা
তারপর নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিদ'আত ও নব-উদ্ভাবিত বিষয়ের ব্যাপারে সতর্ক করে বলেন-
وشَرَّ الْأُمُورِ مُحْدَثَاتُهَا، وَكُلَّ مُحْدَثَةٍ ضَلَالَةٌ
'সর্বাপেক্ষা নিকৃষ্ট বিষয় নব-উদ্ভাবিত বিষয়সমূহ আর প্রত্যেকটি বিদ'আত গোমরাহী।'
কুরআন ও হাদীছে বিদ'আত ও নতুন উদ্ভাবিত জিনিসের যেহেতু কোনও ভিত্তি নেই; বরং তা মানুষের মনগড়া, মানুষ নিজেদের খেয়াল-খুশিমত তা তৈরি করে নেয়, সেহেতু তার নিকৃষ্ট হওয়াটা অনিবার্য। কুরআন ও হাদীছের বাইরে মনগড়া কিছু তৈরি করাই হয় খাহেশাত পূরণের তাড়নায়। কুরআন ও হাদীছ যে সত্য ও ন্যায়ের পথ দেখায় তা দ্বারা মানুষের খাহেশাত ও কু-চাহিদা পূরণ করা যায় না। তা পূরণের জন্যই মানুষ নতুন নতুন পন্থা তৈরি করে নেয়। কুরআন-হাদীছ পরিপন্থী সেসব পন্থা হয় অসত্য ও অন্যায়। যা-কিছু অসত্য ও অন্যায় তা নিকৃষ্টই বটে এবং তা পথভ্রষ্টতাও বটে। তা দ্বারা মানুষ সত্য-ন্যায়ের পথ ছেড়ে ভ্রান্ত পথের অনুগামী হয়। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ হাদীছে দ্ব্যর্থহীনভাবেই বলে দিয়েছেন যে, বিদ'আত তথা নতুন উদ্ভাবিত বিষয় হচ্ছে পথভ্রষ্টতা।

নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের সঙ্গে মুমিনের ঘনিষ্ঠতা
তারপর নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম উম্মতের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন-
أَنَا أَوْلَى بِكُلِّ مُؤْمِنٍ مِنْ نَفْسِهِ
“আমি প্রত্যেক মুমিনের ওপর তার নিজের চেয়েও বেশি হকদার।”
এ কথাটি এক পরম সত্য। আল্লাহ তা'আলা প্রত্যেক মু'মিনকে ঈমানের মহাসম্পদ দান করেছেন নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের অসিলায়। এ সম্পদ যার নেই সে এক নিকৃষ্ট জীব। কুরআন মাজীদে তাকে সর্বাপেক্ষা নিকৃষ্ট জীবরূপেই নির্ণিত করা হয়েছে। তো যে ঈমানের বদৌলতে একজন মানুষ নিকৃষ্টতার নিম্নতর স্তর থেকে মুক্তি পেয়ে সৃষ্টির সেরা জীবের স্তরে উন্নীত হয়, তা যখন নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের অসিলায় পাওয়া তখন এটাই তো স্বাভাবিক যে, সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতাও তাঁর সঙ্গেই সবচে' বেশি হবে এবং তার ওপর তাঁর হকও হবে সবার উপরে, এমনকি পিতামাতারও উপরে। কেননা পিতামাতার মাধ্যমে তার দৈহিক অস্তিত্ব লাভ হয়েছে, আর নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের মাধ্যমে লাভ হয়েছে ঈমানী ও রূহানী অস্তিত্ব, যা না হলে দৈহিক অস্তিত্ব সম্পূর্ণ মূল্যহীন। দৈহিক অস্তিত্ব অতি ক্ষণস্থায়ী, আর রূহানী অস্তিত্ব স্থায়ী ও অবিনশ্বর। এ মহা নি'আমত যার মাধ্যমে লাভ হয়েছে তার হক সবচে' বেশি না হয়ে পারে কি? সুতরাং কুরআন মাজীদেও ইরশাদ হয়েছে-
النَّبِيُّ أَوْلَى بِالْمُؤْمِنِينَ مِنْ أَنْفُسِهِمْ وَأَزْوَاجُهُ أُمَّهَاتُهُمْ
'মুমিনদের পক্ষে নবী তাদের নিজেদের প্রাণ অপেক্ষাও বেশি ঘনিষ্ঠ। আর তাঁর স্ত্রীগণ তাদের মা। (সূরা আহযাব (৩৩), আয়াত ৬)

এ ঘনিষ্ঠতার সুবাদে উম্মতের ওপর তাঁর রয়েছে বহুবিধ হক। একটি প্রধান হক হচ্ছে মহব্বত ও ভালোবাসা। একজন মু'মিন হিসেবে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ভালোবাসতে হবে সর্বাপেক্ষা বেশি। এক হাদীছে ইরশাদ হয়েছে-
«لاَ يُؤْمِنُ أَحَدُكُمْ، حَتَّى أَكُونَ أَحَبَّ إِلَيْهِ مِنْ وَالِدِهِ وَوَلَدِهِ وَالنَّاسِ أَجْمَعِينَ»
'তোমাদের কেউ মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না সে আমাকে তার পিতা, তার সন্তান ও সমস্ত মানুষ অপেক্ষা বেশি ভালোবাসবে। (সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ১৫; সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ৪৪; সুনানে নাসাঈ, হাদীছ নং ৫০১৩ সুনানে ইবন মাজাহ, হাদীছ নং ৬৭; মুসতাদরাক হাকিম, হাদীছ নং ৩৮০৫) আর এ ভালোবাসার দাবি এবং তাঁর অন্যতম একটি প্রধান হক হচ্ছে তাঁর সুন্নতের অনুসরণ করা ও সর্বপ্রকার বিদ'আত থেকে বেঁচে থাকা। এ হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের সর্বশেষ কথা হচ্ছে-
مَنْ تَرَكَ مَالًا فَلِأَهْلِهِ، وَمَنْ تَرَكَ دَيْنًا، أَوْ ضِيَاعًا فَإِلَيَّ وَعَلَيَّ
'কেউ যদি সম্পদ রেখে যায় তবে তা তার পরিবারবর্গের। আর যদি ঋণ বা অসহায় সন্তান রেখে যায়, তবে তার (সন্তানের) অভিভাবকত্ব আমারই এবং আমারই ওপর তার (ঋণ পরিশোধের) দায়িত্ব।
অর্থাৎ যদিও ঈমান ও রূহানী দিক থেকে প্রত্যেক মু'মিনের জন্য নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম সর্বাপেক্ষা বেশি ঘনিষ্ঠ ও সবচে' বেশি কাছের, কিন্তু তাই বলে এর সাথে মীরাছের কোনও সম্পর্ক নেই। মীরাছ ও উত্তরাধিকার প্রাপ্য হয় নিকটাত্মীয়তার ভিত্তিতে, রূহানী সম্পর্কে ভিত্তিতে নয়। তাই নবী, উস্তায বা শায়খ হিসেবে কেউ কোনও ব্যক্তির মীরাছ লাভ করে না। তা লাভ করে কেবলই মৃত ব্যক্তির জীবিত ওয়ারিশগণ, যেমন এ হাদীছে বলা হয়েছে।

অপরদিকে কেউ যদি দেনা রেখে মারা যায় এবং তা পরিশোধের কোনও ব্যবস্থা না থাকে, সে সম্পর্কে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, তা পরিশোধের দায়িত্ব আমার। তাঁর অবর্তমানে এ দায়িত্ব সরকারের ওপর বর্তায়।

এমনিভাবে কেউ যদি তার সন্তান বা পরিবারভুক্ত কাউকে রেখে মারা যায় আর তাদের দেখাশোনা করার মত কোনও অভিভাবক না থাকে, তখন তার অভিভাবকত্ব কে পালন করবে? নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, সে ক্ষেত্রে আমিই হব তাদের অভিভাবক। তাদের দেখাশোনা ও ভরণপোষণের যিম্মাদারী থাকবে আমার ওপর। তিনি দুনিয়া থেকে চলে যাওয়ার পর এ যিম্মাদারী সরকারের।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. যারা ওয়াজ ও নসীহতের দায়িত্ব পালন করে, তাদের জন্য এ হাদীছের মধ্যে এ শিক্ষা রয়েছে যে, তারা তা পালন করবে অত্যন্ত দরদ ও মমত্ববোধের সাথে। সে মমত্ববোধের প্রকাশ যেন তার কন্ঠস্বর ও চেহারায়ও প্রকাশ পায়।

খ. কিয়ামত অবশ্য ঘটবে। তা অতি বিভীষিকাময় এবং দূর অতীত হিসেবে অতি কাছেও বটে। তার বিভীষিকা জীবিত ও মৃত সকলকেই স্পর্শ করবে। তাই অন্তরে তার ভয় রাখা চাই।

গ. নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম সর্বশেষ নবী। তাঁর ও কিয়ামতের মাঝখানে আর কোনও নবী নেই। সুতরাং কেউ নিজেকে নবী বলে দাবি করলে সে ঘোর মিথ্যুক। গোলাম আহমাদ কাদিয়ানীও একজন ঘোর মিথ্যুক।

ঘ. আল্লাহর কিতাব সর্বোত্তম বাণী। গভীর শ্রদ্ধা ও ভক্তির সাথে তার তিলাওয়াত ও অনুসরণে রত থাকা চাই।

ঙ. নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের তরিকার চেয়ে ভালো কোনও তরিকা নেই। দুনিয়ার সকল মানুষের কর্তব্য- দোজাহানের মুক্তির লক্ষ্যে তাঁর তরিকা আঁকড়ে ধরা।

চ. বিদ'আত যেহেতু সর্বাপেক্ষা নিকৃষ্ট কাজ, তাই সর্বাবস্থায় তা থেকে বেঁচে থাকতে হবে।

ছ. একজন মু'মিন হিসেবে নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের হক সবার উপরে। তাই সর্বাপেক্ষা তাঁকেই বেশি ভালোবাসতে হবে এবং তাঁর সুন্নতের অনুসরণ করে চলতে হবে।

জ. নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের একজন উম্মত হিসেবে আমাদের প্রত্যেকের কর্তব্য- তাঁর সকল উম্মতের প্রতি মমতাশীল থাকা। সেই হিসেবে উচিত মৃত ব্যক্তির দেনা পরিশোধে সাহায্য করা এবং তার এতিম সন্তানদের খোঁজখবর রাখা।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান