আত্-তারগীব ওয়াত্-তারহীব- ইমাম মুনযিরী রহঃ

৩. অধ্যায়ঃ ইলেম

হাদীস নং: ২৩৩
অধ্যায়ঃ ইলেম
কলহ্ ও অনর্থক বাদানুবাদ, পারস্পরিক অনর্থক যুক্তি প্রদান, ক্ষুব্ধ হওয়া এবং বিজয়ী হওয়ার প্রবণতার প্রতি ভীতি প্রদর্শন এবং সত্য প্রতিষ্ঠা ও মিথ্যা তিরোহিত করার প্রতি অনুপ্রেরণা
২৩৩. হযরত আবু উমামা (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ যে ব্যক্তি বাতিলের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকা অবস্থায় তা বর্জন করে, তার জন্য জান্নাতের কিনারায় একটি ঘর তৈরি করা হবে। আর যে ব্যক্তি হকের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকা সত্ত্বেও তা পরিহার করবে, তার জন্য জান্নাতের মধ্যভাগে একটি ঘর তৈরি করা হবে এবং যে ব্যক্তি উত্তম চরিত্রের অধিকারী, তার জন্য জান্নাতের উর্ধ্বদেশে ঘর তৈরি করা হবে।
(ইমাম আবু দাউদ এবং তিরমিযী নিজ শব্দযোগে হাদীসটি বর্ণনা করেন এবং ইবন মাজাহ ও বায়হাকী হাদীসটি রিওয়ায়াত করেন। তিরমিযী (র) বলেন, হাদীসটি হাসান। তাবারানীর 'আওসাত' গ্রন্থে হযরত ইবন উমর (রা) সূত্রে বর্ণিত, "রাসুলুল্লাহ্ (সা) বলেছেন, যে ব্যক্তি হকের উপর থাকা সত্ত্বেও বাদানুবাদ থেকে বিরত থাকে, আমি তার জন্য জান্নাতের কিনারায় একটি ঘরের যিম্মাদার, আর যে ব্যক্তি বিদ্রুপচ্ছলেও মিথ্যা পরিহার করে, আমি জান্নাতের মধ্যখানে তার ঘরের যামিনদার। আর যে ব্যক্তি উত্তম চরিত্রের অধিকারী, জান্নাতের সর্বোচ্চ স্থানে তার ঘরের জন্য আমি যিম্মাদার।")
كتاب الْعلم
التَّرْهِيب من المراء والجدال والمخاصمة والمحاججة والقهر وَالْغَلَبَة وَالتَّرْغِيب فِي تَركه للمحق والمبطل
233 - عَن أبي أُمَامَة رَضِي الله عَنهُ قَالَ قَالَ رَسُول الله صلى الله عَلَيْهِ وَسلم من ترك المراء وَهُوَ مُبْطل بني لَهُ بَيت فِي ربض الْجنَّة وَمن تَركه وَهُوَ محق بني لَهُ فِي وَسطهَا وَمن حسن خلقه بني لَهُ فِي أَعْلَاهَا
رَوَاهُ أَبُو دَاوُد وَالتِّرْمِذِيّ وَاللَّفْظ لَهُ وَابْن مَاجَه وَالْبَيْهَقِيّ وَقَالَ التِّرْمِذِيّ حَدِيث حسن وَرَوَاهُ الطَّبَرَانِيّ فِي الْأَوْسَط من حَدِيث ابْن عمر وَلَفظه قَالَ رَسُول الله صلى الله عَلَيْهِ وَسلم أَنا زعيم بِبَيْت فِي ربض الْجنَّة لمن ترك المراء وَهُوَ محق وببيت فِي وسط الْجنَّة لمن ترك الْكَذِب وَهُوَ مازح وببيت فِي أَعلَى الْجنَّة لمن حسنت سَرِيرَته

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এ হাদীছে বিশেষ তিনটি আমলের গুরুত্ব ও ফযীলত বর্ণিত হয়েছে। আমল তিনটি হল- ঝগড়া-বিবাদ পরিত্যাগ করা, মিথ্যা কথা না বলা এবং নিজ চরিত্র ভালো করা। ঝগড়া-বিবাদ পরিহার করা সম্পর্কে বলা হয়েছে-
أَنا زَعِيمٌ ببَيتٍ في ربَضِ الجنَّةِ لِمَنْ تَرَكَ المِرَاءَ وَإِنْ كَانَ مُحِقًّا (আমি ওই ব্যক্তির জন্য জান্নাতের কিনারার দিকে এক ঘরের যিম্মাদার, যে ব্যক্তি বিবাদ-বিতর্ক পরিত্যাগ করে, যদিও সে ন্যায়ের উপর থাকে)। বিবাদ-বিতর্ক অতি মন্দ কাজ। এর দ্বারা পরস্পর সুসম্পর্ক নষ্ট হয় ও শত্রুতা সৃষ্টি হয়, যা কিনা হাজারও অন্যায়-অপরাধের মূল।

তাই আল্লাহ তা'আলা তর্ক-বিতর্ক ও কলহ-বিবাদ করাকে খুবই অপসন্দ করেন। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
إِنَّ أَبْغَضَ الرِّجَالِ إِلَى اللَّهِ الْأَلَدُّ الْخَصِم
‘নিশ্চয়ই আল্লাহর কাছে সবচে ঘৃণ্য ওই ব্যক্তি, যে তর্কপ্রিয় ও ঝগড়াটে।(সহীহ বুখারী: ২৪৫৭; সহীহ মুসলিম: ২৬৬৮; জামে তিরমিযী: ২৯৭৬; সুনানে নাসাঈ: ৫৪২৩; সহীহ ইবন হিব্বান: ৫৬৯৭; মুসনাদুল হুমায়দী: ২৭৫; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা: ২০২৯৭)

এহেন মন্দ কাজ সর্বাবস্থায় পরিত্যাজ্য। এমনকি ন্যায়ের উপর থেকেও। অর্থাৎ নিজ দাবি যদি ন্যায়সঙ্গত হয় আর প্রতিপক্ষ তা মানতে রাজি না হয়, তবে সে ক্ষেত্রেও তর্ক-বিতর্ক ও ঝগড়া-বিবাদ পরিহার করা উচিত। কেননা ঝগড়া-বিবাদে লিপ্ত হলে নিজের ন্যায়সঙ্গত দাবি পূরণ হবে তার কোনও নিশ্চয়তা নেই। আর যদি পূরণ হয়ও, তবে তা দ্বারা ঝগড়া-বিবাদের ক্ষতির প্রতিকার হয় না। কেননা ঝগড়া-বিবাদ করতে গেলে বন্ধু শত্রুতে পরিণত হয়, যা কিছুতেই কাম্য নয়। তাছাড়া নানারকম গুনাহও হয়ে যায়। যেমন গীবত করা, গালি দেওয়া, কটু কথা বলা, ক্ষেত্রবিশেষে মিথ্যা বলা, ঘুষ দেওয়া, আরও কত কি। এ কারণেই দাবি ন্যায্য হলেও বিবাদ এড়ানোই ভালো। এতে করে পার্থিব কিছুটা ক্ষতি হলেও আখিরাতে রয়েছে অভাবনীয় পুরস্কার। এ হাদীছে সুসংবাদ দেওয়া হয়েছে, এরূপ ব্যক্তির জন্য জান্নাতের কিনারার দিকে বাড়ি বানানো হয়। দুনিয়াবী ক্ষয়-ক্ষতির প্রতিকার হিসেবে এ প্রাপ্তি অনেক অনেক বড়, সে ক্ষতি যত বেশিই হোক না কেন।

তারপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মিথ্যা কথা পরিত্যাগ করার গুরুত্ব ও ফযীলত সম্পর্কে ইরশাদ করেন- وَبِبَيْتٍ فِي وَسَطِ الْجَنَّةِ لِمَنْ تَرَكَ الْكَذِبَ، وَإِنْ كَانَ مَازِحًا (এবং ওই ব্যক্তির জন্য জান্নাতের মধ্যস্থলে এক ঘরের যিম্মাদার, যে মিথ্যা কথা পরিহার করে, যদিও তা ঠাট্টাচ্ছলে হয়)। মিথ্যা বলা মহাপাপ। একজন মুমিনের জন্য সর্বাপেক্ষা অশোভন কাজ। এটা জায়েয হয় কেবল সেই ক্ষেত্রে, যখন উদ্দেশ্য হয় বিবদমান দুই পক্ষের মধ্যে মীমাংসা করে দেওয়া। এমনিভাবে সত্য বললে যদি কোনও নির্দোষ ব্যক্তির জান-মালের ক্ষতি হওয়ার প্রবল আশঙ্কা থাকে, সে ক্ষেত্রেও মিথ্যা বলার অবকাশ আছে। এরূপ শরী'আতসম্মত ওজর ছাড়া কোনও অবস্থায়ই মিথ্যা বলা জায়েয নয়। এটা জায়েয নয় ঠাট্টাস্বরূপও। সুতরাং যে ব্যক্তি ঠাট্টাচ্ছলেও মিথ্যা বলা হতে বিরত থাকে, তার অনুকূলে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দায়িত্ব নিয়েছেন যে, জান্নাতের মধ্যস্থলে সে একটি বাড়ি পাবে। এটা কত বড়ই না পুরস্কার! পার্থিব এহেন স্বার্থ ও তুচ্ছ প্রাপ্তি পরিহার করার বিনিময়ে এত বড় পুরস্কার যে আল্লাহ তা'আলা দান করবেন, তিনি কত বড়ই না দয়ার মালিক!

হাদীছটিতে তৃতীয় পর্যায়ে ইরশাদ হয়েছে- وَبِبَيْتٍ فِي أَعْلَى الْجَنَّةِ لِمَنْ حَسَّنَ خُلُقَهُ (আর ওই ব্যক্তির জন্য জান্নাতের শীর্ষস্থানে এক ঘরের যিম্মাদার, যে তার চরিত্র সৌন্দর্যমণ্ডিত করে)। حَسَّن ক্রিয়াপদটি تَحْسِينٌ ক্রিয়ামূল থেকে উৎপন্ন। এর অর্থ নিয়মিত যত্ন ও প্রচেষ্টা দ্বারা সুন্দর ও উন্নত করতে থাকা। আখলাক-চরিত্র এমনই এক জিনিস, যা হঠাৎ করেই সংশোধন হয়ে যায় না। এর জন্য নিয়মিত চেষ্টা-সাধনা দরকার। উত্তম চরিত্র যেহেতু আল্লাহ তা'আলার কাছে অনেক পসন্দনীয়, তাই চরিত্র উন্নত করার চেষ্টাও একটি উত্তম কাজ এবং আল্লাহ তা'আলার কাছে পসন্দনীয় মেহনত বলে গণ্য হবে বৈ কি। এ কারণেই যে ব্যক্তি চরিত্র ভালো করার জন্য পর্যায়ক্রমিক মেহনত চালায়, তার সম্পর্কে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দায়িত্ব নিয়েছেন যে, জান্নাতের সর্বোচ্চ স্থানে সে একটি বাড়ি পাবে।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. কোনও অন্যায় দাবির উপর তর্ক-বিতর্ক করা নিতান্তই গর্হিত কাজ।

খ. দাবি ন্যায় হলেও তার পক্ষে তর্ক-বিতর্কে না জড়ানো উচিত। তাতে জান্নাতের মহা পুরস্কারলাভের আশা আছে।

গ. শরী'আতসম্মত কারণ ছাড়া মিথ্যা বলা মহাপাপ।

ঘ. হাস্যরস করেও মিথ্যা কথা বলতে নেই।

ঙ. সর্বাবস্থায় মিথ্যা পরিত্যাগ করলে জান্নাতের মধ্যস্থলে বাড়ি পাওয়ার আশা আছে।

চ. আমরা অবশ্যই চরিত্র সংশোধনের চেষ্টা অব্যাহত রাখব, যাতে জান্নাতের সর্বোচ্চ ধাপে স্থান লাভ করতে পারি।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান