আত্-তারগীব ওয়াত্-তারহীব- ইমাম মুনযিরী রহঃ

১০. অধ্যায়ঃ ঈদ ও কুরবানী

হাদীস নং: ১৬৭৬
অধ্যায়ঃ ঈদ ও কুরবানী
কোন জন্তুর নাক-কান কর্তনের ব্যাপারে সতর্কবাণী, যারা খাওয়া ছাড়া অন্য কোন উদ্দেশ্যে জীব-জন্তুকে হত্যা করে, তাদের প্রসঙ্গ এবং উত্তমভাবে প্রাণ হরণ ও যবেহের নির্দেশ প্রসঙ্গ
১৬৭৬. হযরত শাদ্দাদ ইব্‌ন আওস (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ বলেছেন: আল্লাহ প্রতিটি বিষয়কে সুন্দরভাবে সম্পাদন করা বিধিবদ্ধ করে দিয়েছেন। অতএব তোমরা যখন প্রাণ হরণ করবে, তখন তাও সুন্দরভাবে করবে। আর যখন যবেহ করবে, তখন সুন্দরভাবে যবেহ করবে। তোমাদের যে কেউ যেন তার ছুরিটি ধার করে নেয় এবং যবেহের প্রাণীটিকে সহজে যবেহ করে ফেলে।
(হাদীসটি মুসলিম, আবু দাউদ, নাসাঈ ও ইবন মাজাহ বর্ণনা করেছেন।)
كتاب الْعِيدَيْنِ
الترهيب من المثلة بالحيوان ومن قتله لغير الأكل وما جاء في الأمر بتحسين القتلة والذبحة
1676- عَن شَدَّاد بن أَوْس رَضِي الله عَنهُ قَالَ قَالَ رَسُول الله صلى الله عَلَيْهِ وَسلم إِن الله كتب الْإِحْسَان على كل شَيْء فَإِذا قتلتم فَأحْسنُوا القتلة وَإِذا ذبحتم فَأحْسنُوا الذبْحَة وليحد أحدكُم شفرته وليرح ذَبِيحَته

رَوَاهُ مُسلم وَأَبُو دَاوُد وَالنَّسَائِيّ وَابْن مَاجَه

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এ হাদীছটিতে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোমলতা অবলম্বন ও সদয় আচরণের প্রতি উৎসাহ দান করেছেন। তিনি এর গুরুত্ব তুলে ধরতে গিয়ে ইরশাদ করেন-
إِنَّ اللَّهَ كَتَبَ الْإِحْسَانَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ (আল্লাহ তা'আলা প্রতিটি জিনিসের উপর সদয় আচরণের বিধান দিয়েছেন)। كَتَبَ এর আক্ষরিক অর্থ 'লিখেছেন'। শব্দটি এ আক্ষরিক অর্থে যেমন ব্যবহৃত হয়, তেমনি এর দ্বারা আবশ্যিক করা, অবধারিত করা, বিধান দেওয়া ইত্যাদি অর্থও বোঝানো হয়ে থাকে।

اَلْإِحْسَان এর অর্থ দয়া করা, ভালো ব্যবহার করা। হাদীছটিতে বলা হয়েছে, আল্লাহ প্রতিটি জিনিসে ইহসান বা সদয় আচরণের বিধান দিয়েছেন। অর্থাৎ বান্দার কর্তব্য প্রতিটি কাজ আন্তরিকতার সঙ্গে করা এবং উত্তমভাবে আঞ্জাম দেওয়া। উদাহরণ হিসেবে কতল করা ও পশু জবাই করার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। সুতরাং ইরশাদ হয়েছে-
فَإِذَا قَتَلْتُمْ فَأَحْسِنُوا الْقِتْلَةَ (সুতরাং তোমরা যখন হত্যা করবে, তখন হত্যাকর্ম উত্তমভাবে করবে)। অর্থাৎ যদি কখনও কোনও ক্ষতিকর প্রাণী হত্যার অবকাশ আসে, তখন সে হত্যাকর্মেও যেন যথাসম্ভব দয়ার প্রকাশ ঘটে। অহেতুক নির্মমতা দেখাবে না। কোনও পশু খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মারবে না। পানিতে চুবিয়ে বা আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করবে না। ধারালো অস্ত্র দিয়ে যত সহজে ও যত তাড়াতাড়ি সম্ভব হয় হত্যা করতে চেষ্টা করবে। লক্ষ রাখবে যাতে অল্প সময়ের মধ্যেই তার প্রাণবায়ু বের হয়ে যায়।

এমনিভাবে যদি কিসাস বা হুদূদ আইনে কাউকে হত্যা করার অবকাশ আসে, তবে তাকেও যত কম কষ্ট দিয়ে সম্ভব হয় হত্যা করবে। যেভাবে হত্যা করলে অল্প সময়ের ভেতর মৃত্যু ঘটে, ধুঁকে ধুঁকে মারা না যায়, সেভাবে হত্যা করবে। এমনিভাবে হত্যা করাই যেহেতু তার চরম শাস্তি, তাই এর সঙ্গে হাত-পা কেটে বা অন্য কোনও অঙ্গ ছেদন করে তাকে বাড়তি কষ্ট দেবে না। তারপর জবাই করা সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে-
وَإِذَا ذَبَحْتُمْ فَأَحْسِنُوا الذِّبْحَةَ (আর যখন জবাই করবে, উত্তমভাবে জবাই করবে)। উত্তমভাবে জবাই করার বিভিন্ন দিক আছে। একটা দিক তো হল ছুরি ধারালো হওয়া। ধারালো ছুরি দ্বারা জবাই করলে তাড়াতাড়ি জবাই হয়। ফলে তাড়াতাড়ি প্রাণ বের হয়। এ কারণেই হাদীছে হুকুম করা হয়েছে-
وَلْيُحِدَّ أَحَدُكُمْ شَفْرَتَهُ (তোমরা প্রত্যেকে তার ছুরি ধার দিয়ে নেবে)। কাজেই ভোতা ছুরি দিয়ে জবাই করা কিছুতেই উচিত নয়। কেননা তাতে জবাই করতে বেশি সময় লাগে। ফলে প্রাণী বেশি কষ্ট পায়। উত্তমভাবে জবাই করার আরেকটি দিক হল পশুরে অহেতুক কষ্ট দেওয়া হতে বিরত থাকা। সুতরাং জবাইকালে এদিকেও লক্ষ রাখা জরুরি, যাতে জবাইয়ের কষ্ট ছাড়া অন্য কোনওভাবে পশুকে কষ্ট দেওয়া না হয়। একবার এক ব্যক্তি ছাগলের কান ধরে টেনে নিচ্ছিল। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দেখে বললেন, কান ছেড়ে দাও এবং গর্দানের সম্মুখদিকে ধরো। আরেকবার এক ব্যক্তি ছাগলের ঘাড় পা দিয়ে চেপে ধরে ছুরি ধার দিচ্ছিল আর ছাগলটি সেদিকে তাকিয়ে রয়েছিল। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেখান দিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি এ অবস্থা দেখে বললেন, তুমি এ কাজ আগে করলে না কেন? তুমি কি এটা দু'বার মারতে চাও? একবার এক কসাই ছাগলের পা ধরে টেনে-হেঁচড়ে জবাইয়ের স্থানে নিয়ে যাচ্ছিল। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন, তুমি এটিকে মৃত্যুর স্থানে কোমলভাবে নিয়ে যাও।

ছাগল জবাইয়ের কাজ সহৃদয়ভাবে করলে আল্লাহ তা'আলার রহমত পাওয়া যায়। এ সম্পর্কে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জনৈক ব্যক্তিকে লক্ষ্য করে বলেন-
وَالشَّاةُ فَإِنْ تَرْحَمْهَا يَرْحَمْكَ اللَّهُ
'ছাগল জবাইয়ের কাজ যদি দয়ার সঙ্গে কর, তবে আল্লাহ তোমাকে দয়া করবেন। (শু'আবুল ঈমান: ১১০৬৭; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর: ৪৪; মুসনাদুল বাযযার: ১২২১)

একবার হযরত উমর ফারুক রাযি. দেখলেন এক ব্যক্তি একটি ছাগলের পা ধরে জবাই করতে নিয়ে যাচ্ছে। তিনি তাকে ধমক দিয়ে বললেন, এটিকে এর মৃত্যুর স্থানে সুন্দরভাবে নিয়ে যাও।

ইমাম আহমাদ ইবন হাম্বল রহ. বলেন, জবাইয়ের স্থানে পশুকে সদয়ভাবে টেনে নেবে। ছুরি লুকিয়ে রাখবে। সেটি বের করবে কেবল তখন, যখন জবাই শুরু করবে।

وَلَيُرِحْ ذَبِيحَتَهُ 'এবং নিজ জবাইয়ের পশুকে (যথাসম্ভব) আরাম দেবে'। অর্থাৎ অহেতুক কষ্ট দেবে না। ধারালো ছুরি খুব দ্রুত চালিয়ে দেবে। পুরোপুরি শান্ত না হওয়া পর্যন্ত চামড়া ছাড়াবে না। জবাই করবে সম্মুখদিক থেকে, ঘাড়ের পেছন থেকে নয়। জবাইয়ের স্থানে টেনে-হেঁচড়ে নেবে না। লক্ষ রাখবে যাতে রগগুলো ভালোভাবে কাটা হয় ইত্যাদি।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. প্রতিটি কাজ সহৃদয়তার সঙ্গে করতে হবে, সে কাজের সম্পর্ক নিজের সঙ্গে হোক বা অন্যের সঙ্গে।

খ. মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার ক্ষেত্রেও অপরাধীকে বাড়তি কষ্ট দেওয়া ও নিষ্ঠুরতা প্রদর্শন করা কিছুতেই উচিত নয়।

গ. পশু জবাইয়ের কাজও সদয়ভাবে করা উচিত।

ঘ. খুব লক্ষ রাখা উচিত যাতে জবাইয়ের কষ্ট ছাড়া বাড়তি কোনও কষ্ট পশু না পায়।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান