আত্-তারগীব ওয়াত্-তারহীব- ইমাম মুনযিরী রহঃ

১৭. অধ্যায়ঃ পোশাক-পরিচ্ছদ

হাদীস নং: ৩১১০
অধ্যায়ঃ পোশাক-পরিচ্ছদ
জামা পরিধান করার প্রতি অনুপ্রেরণা এবং জামা ও অন্যান্য পোশাক, যা পরিধেয়, তা শরী'আত পরিপন্থী লম্বা করা, অহংকার করে পোশাক টেনে চলা এবং সালাত ও অন্যান্য সময়ে (পায়ের নিচে) ঝুলিয়ে দেয়ার প্রতি ভীতি প্রদর্শন
৩১১০. হযরত ইবনে উমার (রা) থেকে বর্ণিত। রাসুলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন: যে ব্যক্তি অহংকারবশত কাপড় টাখনুর গিরার নিচে ঝুলিয়ে পরিধান করে, আল্লাহ্ কিয়ামতের দিন তার দিকে তাকাবেন না। (একথা শুনে) আবু বকর সিদ্দীক (রা) বললেনঃ ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমার পরিধেয় বস্ত্র ঝুলে পড়ে, তবে যাতে না পড়ে সে দিকে আমি খেয়াল রাখি। তখন রাসুলুল্লাহ (ﷺ) তাকে বলেনঃ যে ব্যক্তি অহংকারবশত তা করে (তাদের ক্ষেত্রে এ বিধান প্রযোজ্য, আর) তুমি তাদের অন্তর্ভুক্ত নও।
(বুখারী, মুসলিম, আবু দাউদ ও নাসাঈ বর্ণিত।
মুসলিমের অন্য বর্ণনা আছে, তিনি বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ (ﷺ)-কে আমার এই দুই কানে বলতে শুনেছি, "যে ব্যক্তি অহংকারবশত পরিধেয় বস্ত্র টাখনুর গিরার নিচে ঝুলিয়ে পরিধান করবে, কিয়ামতের দিন আল্লাহ্ তার প্রতি তাকাবে না।"
والخيلاء - অহংকার প্রকাশ করা ও নিজের পসন্দসই হওয়া।
والمخيلة - অহংকার করা এবং মানুষকে তুচ্ছ জ্ঞান করার অর্থে ব্যবহৃত হয়।)
كتاب اللباس
التَّرْغِيب فِي الْقَمِيص والترهيب من طوله وَطول غَيره مِمَّا يلبس وجره خُيَلَاء وإسباله فِي الصَّلَاة وَغَيرهَا
3110- وَعَن ابْن عمر رَضِي الله عَنْهُمَا أَن رَسُول الله صلى الله عَلَيْهِ وَسلم قَالَ من جر ثَوْبه خُيَلَاء لم ينظر الله إِلَيْهِ يَوْم الْقِيَامَة فَقَالَ أَبُو بكر الصّديق رَضِي الله عَنهُ يَا رَسُول الله إِن إزَارِي
يسترخي إِلَّا أَن أتعاهده فَقَالَ لَهُ رَسُول الله صلى الله عَلَيْهِ وَسلم إِنَّك لست مِمَّن يَفْعَله خُيَلَاء

رَوَاهُ البُخَارِيّ وَمُسلم وَأَبُو دَاوُد وَالنَّسَائِيّ
وَلَفظ مُسلم قَالَ سَمِعت رَسُول الله صلى الله عَلَيْهِ وَسلم بأذني هَاتين يَقُول من جر إزَاره لَا يُرِيد بذلك إِلَّا المخيلة فَإِن الله عز وَجل لَا ينظر إِلَيْهِ يَوْم الْقِيَامَة
الْخُيَلَاء بِضَم الْخَاء الْمُعْجَمَة وَكسرهَا أَيْضا وبفتح الْيَاء الْمُثَنَّاة تَحت ممدودا هُوَ الْكبر وَالْعجب
والمخيلة بِفَتْح الْمِيم وَكسر الْخَاء الْمُعْجَمَة من الاختيال وَهُوَ الْكبر واستحقار النَّاس

হাদীসের ব্যাখ্যা:

হাদীছটিতে টাখনুর নিচে লুঙ্গি পরিধানকারী সম্পর্কে সতর্ক করা হয়েছে যে, কিয়ামতের দিন আল্লাহ তা'আলা তার দিকে তাকাবেন না। অর্থাৎ রহমতের দৃষ্টিতে তাকাবেন না। বড়ই ভয়ানক কথা। তিনি রহমতের দৃষ্টিতে না তাকানোর অর্থ তিনি তার প্রতি অসন্তুষ্ট থাকবেন। কিয়ামতের দিন যার প্রতি আল্লাহ তা'আলা অসন্তুষ্ট থাকবেন, তার পরিণাম নিশ্চিত জাহান্নাম। আল্লাহ তা'আলা সে পরিণাম থেকে আমাদের রক্ষা করুন। অপর এক হাদীছে ইরশাদ হয়েছে-
مَا أَسْفَلَ مِنَ الْكَعْبَيْنِ مِنَ الْإِزَارِ فَفِي النَّارِ
'টাখনুর নিচে যতটুকু অংশ লুঙ্গি স্পর্শ করে, তা জাহান্নামে যাবে।’( সহীহ বুখারী: ৫৭৮৭; সুনানে ইবন মাজাহ: ২৫৭৪; মুআত্তা মালিক: ১২ মুসান্নাফে ইবন আবী শায়বা: ২৪৮২৪; মুসনাদুল হুমায়দী: ৭৫৪; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা ৩৩১৮)

উল্লেখ্য, এ সতর্কবাণী কেবল লুঙ্গির জন্যই নির্ধারিত নয়; বরং জামা ও পায়জামার জন্যও প্রযোজ্য। অর্থাৎ শরীরে পরিধেয় যে-কোনও বস্ত্র নিচের দিকে সর্বোচ্চ টাখনু পর্যন্ত নামানো যাবে, এর নিচে নয়।এজন্যই সহীহ বুখারী ও মুসলিমের এক বর্ণনায় এভাবে এসেছে-
مَنْ جَرَّ ثَوْبَهُ مِنَ الْخُيَلَاءِ لَمْ يَنْظُرِ اللَّهُ إِلَيْهِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ
‘যে ব্যক্তি তার পরিধেয় বস্ত্র হেঁচড়াবে, কেয়ামত দিবসে আল্লাহ তার দিকে তাকাবেন না।' -বুখারী: ৫৭৮৪; মুসলিম: ২০৮৫) পুরুষের সতর যেহেতু হাঁটু পর্যন্ত, তাই হাঁটুর নিচে নামাতে হবে অবশ্যই। তার মানে পরিধেয় বস্তু হাঁটু ও টাখনুর মাঝামাঝি যে- কোনও স্থান পর্যন্ত নামানো যাবে। লুঙ্গি বা পায়জামা নলার মাঝ বরাবর হলে ভালো। হযরত আবূ সা'ঈদ খুদরী রাযি. থেকে বর্ণিত এক হাদীছে আছে-
إِزْرَةُ الْمُؤْمِنِ إِلَى أَنْصَافِ سَاقَيْهِ ، لَا جُنَاحَ عَلَيْهِ مَا بَيْنَهُ وَبَيْنَ الْكَعْبَيْنِ، وَمَا أَسْفَلَ مِنَ الْكَعْبَيْنِ فِي النَّارِ». يَقُوْلُ ثَلَاثًا: «لَا يَنْظُرُ اللَّهُ إِلَى مَنْ جَرَّ إِزَارَهُ بَطَرًا».
‘মুমিনের লুঙ্গি পরিধান হবে তার নলার মধ্যখান পর্যন্ত। এর নিচে টাখনু ও মধ্যনলার মাঝে যে-কোনও স্থান পর্যন্ত হলে কোনও দোষ নেই। কিন্তু টাখনুর নিচে যতটুকু পর্যন্ত নামবে, তা জাহান্নামে যাবে। তিনি তিনবার বলেছেন, যে ব্যক্তি অহংকারবশত লুঙ্গি হেঁচড়িয়ে চলে, আল্লাহ তার দিকে তাকাবেন না ‘( সুনানে ইবন মাজাহ : ৩৫৭৩; মুসনাদুল হুমায়দী: ৭৫৪; মুআত্তা মালিক: ১২; মুসনাদে আবু ইয়া'লা: ৯৮০; সহীহ ইবন হিব্বান: ৫৪৪৭; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর: ১৩২৯২)

হযরত হুযায়ফা রাযি. বলেন-
أَخَذَ رَسُولُ اللَّهِ ﷺ بِأَسْفَلِ عَضَلَةِ سَاقِي - أَوْ سَاقِهِ - فَقَالَ: هَذَا مَوْضِعُ الْإِزارِ، فَإِنْ أَبَيْتَ فَأَسْفَلَ، فَإِنْ أَبَيْتَ فَأَسْفَلَ، فَإِنْ أَبَيْتَ فَلَا حَقَّ لِلْإِزَارِ فِي الْكَعْبَيْنِ
‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার পায়ের নলার মাংসল স্থানের নিচে ধরলেন। তারপর বললেন, এটা হল লুঙ্গির স্থান। তুমি যদি এটা না মান, তবে আরেকটি নিচে। তাও না মানলে আরেকটু নিচে। যদি তাও না মান, তবে মনে রাখবে, টাখনুর নিচে লুঙ্গি পরার কোনও অধিকার নেই।(সুনানে ইবন মাজাহ ৩৫৭২; জামে তিরমিযী: ১৭৮৩; সুনানে নাসাঈ ৫৩২৯; সহীহ ইবন হিব্বান: ৫৪৪৮; তাবারানী, আল মু'জামুল আওসাত: ১৭৭৯; মুসান্নাফে ইবন আবী শায়বা: ২৪৮১৮)

হাদীছে যে অহমিকাবশত পরার কথা বলা হয়েছে, সেদিকে লক্ষ করে কেউ যদি বলে আমার টাখনুর নিচে পরাটা অহংকারের কারণে নয়, তবে তার সে কথা গ্রহণযোগ্য নয়। কেননা এমন কে আছে, যে নিজেকে অহংকারী মনে করে? প্রকৃতপক্ষে কার মনে অহংকার আছে আর কার মনে তা নেই, তা আল্লাহ তা'আলাই ভালো জানেন। সাধারণত টাখনুর নিচে পরাই হয় অহংকারবশে। যাদের এরকম পরার অভ্যাস, তারা টাখনুর উপরে উঠাতে পারে না। তাতে লজ্জাবোধ করে। এটা অহংকারেরই লক্ষণ। সুতরাং সাধারণ এ অবস্থার প্রতি লক্ষ করেই হাদীছটিতে অহংকারের কথা বলা হয়েছে। না হয় কোনও কোনও হাদীছে অহংকারের উল্লেখ ছাড়াই এ নিষেধাজ্ঞা প্রদান করা হয়েছে, যেমন উপরে হযরত হুযায়ফা রাযি. বর্ণিত হাদীছটিতে লক্ষ করা যাচ্ছে।

প্রকাশ থাকে যে, টাখনুর নিচে নামানোর নিষেধাজ্ঞা কেবল পুরুষদের জন্যই প্রযোজ্য, নারীদের জন্য নয়। তাদের জন্য টাখনুর নিচে নামানোই জরুরি। কেননা তাদের পা'ও সতরের অন্তর্ভুক্ত।

উল্লেখ্য, মোজা দ্বারা পা ঢাকাতে কোনও অসুবিধা নেই। নিষিদ্ধ হচ্ছে পরিধেয় কাপড় টাখনুর নিচে নামানো। মোজা তার মধ্যে পড়ে না। পায়ে মোজা পরিহিত অবস্থায়ও পরিধেয় বস্ত্র টাখনুর নিচে নামানো নিষেধ।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. কিয়ামতে আল্লাহ তা'আলার রহমতের দৃষ্টি আমাদের কাম্য। সুতরাং যা-কিছু সে দৃষ্টিলাভের পক্ষে বাধা, তা অবশ্যই পরিত্যাজ্য।

খ. পরিধেয় বস্ত্র, তা লুঙ্গি ও প্যান্ট-পায়জামা হোক কিংবা জামা, সর্বাবস্থায় টাখনুর উপরে পরতে হবে।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান