মুসনাদে আহমদ- ইমাম আহমদ রহঃ (আল-ফাতহুর রব্বানী)

কবীরা ও অন্যান্য গুনাহের বর্ণনা অধ্যায়

হাদীস নং: ২০
কবীরা ও অন্যান্য গুনাহের বর্ণনা অধ্যায়
পরিচ্ছেদ: কবিরা গুনাহ সংক্রান্ত স্বভাব থেকে ভীতি প্রদর্শন এবং গুনাহকারীদের শাস্তি সম্পর্কে যা এসেছে
২০. 'আবদুল্লাহ ইবন 'আমর ইবন 'আস (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কে বলতে শুনেছি, তিনি বলেছেন, জুলুম কিয়ামতের দিন অন্ধকারাচ্ছন্ন ধোয়ায় পরিণত হবে, অশ্লীলতা থেকে তোমরা সাবধান থাক, কারণ আল্লাহ্ তা'আলা অশ্লীলতা পছন্দ করেন না, সুতরাং তোমরা অশ্লীল কথা বলো না। তোমরা কৃপণতা থেকে সাবধান থাকবে, কারণ কৃপণতার কারণে তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদেরকে ধ্বংস করা হয়েছে, তাদেরকে পাপ কাজ না করতে নির্দেশ দেওয়া হয়, কিন্তু তারা পাপাচারে লিপ্ত হয়। তাদেরকে কৃপণতা না করতে নির্দেশ দেওয়া হয়, অথচ তারা কৃপণতা করে; তাদেরকে অশ্লীল কাজ না করতে নির্দেশ দেওয়া হয়, অথচ তারা অশ্লীল কাজ করে। বর্ণনাকারী বলেন, তখন এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে বললো, হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! ইসলামে কোন জিনিস সবচেয়ে উত্তম? তিনি বললেন, তোমার হাত ও মুখের অনিষ্ঠ থেকে যেন অন্য মুসলমান নিরাপদ থাকে।
كتاب الكبائر وأنواع اخرى من المعاصي
باب ما جاء في الترهيب من خصال من كبريات المعاصي مجتمعة ووعيد فاعلها
عن عبد الله بن عمرو بن العاص (7) قال سمعت رسول الله صلى الله عليه وسلم يقول الظلم ظلمات يوم القيامة واياكم والفحش فإن الله لا يحب الفحش ولا التفحش واياكم والشح فإن الشح أهلك من كان قبلكم أمرهم بالقطيعة فقطعوا وأمرهم بالبخل فبخلوا وأمرهم بالفجور ففجروا قال فقام رجل فقال يا رسول أي الإسلام أفضل؟ قال إن يسلم المسلمون من لسانك ويدك الحديث

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এখানে হাদীসটি সংক্ষিপ্ত আকারে আনা হয়েছে। অন্যান্য বর্ণনার আলোকে নিম্নে পূর্ণাঙ্গ হাদীস ও তার ব্যাখ্যা পেশ করা হলো।

হযরত জাবির রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, তোমরা জুলুম করা হতে বিরত থাক, কেননা জুলুম কিয়ামতের দিন ঘোর অন্ধকারে পরিণত হবে। এবং তোমরা লোভ–লালসা হতে বিরত থাক, কেননা লোভ–লালসা তোমাদের পূর্বের লোকদেরকে ধ্বংস করেছে। তা তাদেরকে তাদের রক্তপাত করতে প্ররোচিত করেছিল এবং তারা তাদের জন্য নিষিদ্ধ বিষয়সমূহকে হালাল করে নিয়েছিল। (সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ২৫৭৮)

এ হাদীছে দু'টি বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা এবং বিষয়দুটির অশুভ পরিণাম বর্ণিত হয়েছে। তার একটি হচ্ছে জুলুম, অপরটি লোভ।

‘জুলুম'–এর শাব্দিক অর্থ কোনও বস্তু এমন স্থানে রাখা, যা তার প্রকৃত স্থান নয়। শরী'আতের পরিভাষায় জুলুম বলা হয় অন্যের অধিকারে হস্তক্ষেপ করা বা অন্যের হক নষ্ট করা ও অনধিকার চর্চাকে। শরী'আত যে বস্তুর যে সীমা স্থির করে দিয়েছে, তা লঙ্ঘন করাকেও জুলুম বলা হয়। সুতরাং অন্যের জমি দখল করা, অন্যের টাকা–পয়সা কেড়ে নেওয়া, সম্মানী ব্যক্তিকে সম্মান না করা, অন্যায়ভাবে কাউকে তার পথ থেকে সরিয়ে দেওয়া ইত্যাদি সবই জুলুমের মধ্যে পড়ে।

জুলুম প্রথমত দুই প্রকার। এক জুলুম হচ্ছে হাক্কুল্লাহর ক্ষেত্রে, আরেক জুলুম হাক্কুল ইবাদের ক্ষেত্রে। আল্লাহর হক বলতে – তাঁকে এক জানা ও তাঁর সঙ্গে কাউকে শরীক না করা–সহ–তাঁর সম্পর্কিত যাবতীয় আকীদা–বিশ্বাস অন্তরে লালন করা এবং তাঁর দেওয়া শরী'আত মেনে চলাকে বোঝায়। সুতরাং ঈমান ও আকীদায় যে–কোনও ত্রুটি এবং আল্লাহর যে–কোনও আদেশ–নিষেধ অমান্য করা জুলুমের অন্তর্ভুক্ত। হযরত আদম আলাইহিস সালাম তো তাঁর ইজতিহাদভিত্তিক ভুলকেও 'জুলুম' নামে অভিহিত করেছেন, যা কিনা গুনাহর মধ্যেই পড়ে না। সুতরাং তিনি ও তাঁর স্ত্রী হযরত হাওয়া আলাইহিমাস সালাম সে ভুলের পর এই বলে আল্লাহ তা'আলার কাছে দু'আ করেছিলেন যে–

قَالَا رَبَّنَا ظَلَمْنَا أَنْفُسَنَا وَإِنْ لَمْ تَغْفِرْ لَنَا وَتَرْحَمْنَا لَنَكُونَنَّ مِنَ الْخَاسِرِينَ

“হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা নিজ সত্তার ওপর জুলুম করে ফেলেছি। আপনি যদি আমাদেরকে ক্ষমা না করেন ও আমাদের প্রতি রহম না করেন, তবে আমরা অবশ্যই অকৃতকার্যদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাব। (সূরা আ'রাফ (৭), আয়াত ২৩)

হাক্কুল ইবাদের ক্ষেত্রে জুলুমকে মৌলিকভাবে তিন ভাগে ভাগ করা যায়–
ক. অন্যের জানের প্রতি জুলুম;
খ. অন্যের মালের ওপর জুলুম এবং
গ. অন্যের ইজ্জতের ওপর জুলুম।
তা এভাবে যে, মানুষের মূল সম্পদ হচ্ছে তিনটি তার জান, তার মাল ও তার ইজ্জত। সুতরাং এ তিন বস্তুর নিরাপত্তা লাভ প্রত্যেকের মৌলিক অধিকার। অন্যায়ভাবে এর কোনওটিতে আঘাত করা জায়েয নয়। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিদায় হজ্জের দিন ঘোষণা করেনঃ–

فإن دماءكم وأموالكم وأعراضكم بينكم حرام كحرمة يومكم هذا في شهركم هذا في بلدكم هذا

তোমাদের এই (মক্কা) নগরে এই (হজ্জের) মাসে আজকের এই দিনটির যেমন মর্যাদা, তোমাদের পরস্পরের মধ্যে তোমাদের রক্ত, তোমাদের সম্পদ ও তোমাদের ইজ্জতের মর্যাদা তেমনই। (সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৬৭; সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ১৬৭৯; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ২১৫৯; সুনানে ইবন মাজাহ, হাদীছ নং ৩০৫৫; সুনানে আবূ দাউদ, হাদীছ নং ৩৩৩৪; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ১৫৫০৭; সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ৫৯৪১) অর্থাৎ প্রত্যেকের কর্তব্য অন্যের এ তিনটি বিষয়ের নিরাপত্তা ও মর্যাদা রক্ষা করা।এমন কোনও কাজ করা জায়েয নয়, যা দ্বারা অন্যের জান, মাল ও ইজ্জতের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়। যদি তা করা হয়, তবে সে কাজটি জুলুমরূপে গণ্য হবে।
সুতরাং কাউকে অন্যায়ভাবে হত্যা করা, অঙ্গহানি করা, মারধর করা এবং যে কোনওভাবে শারীরিক কষ্ট দেওয়া হচ্ছে তার জানের ওপর জুলুম।

কারও বাড়িঘর ও জমি–জায়েদাদ দখল করা, ব্যবসা–বাণিজ্যের ক্ষতি করা, টাকা পয়সা কেড়ে নেওয়া এবং যে–কোনও রকম বৈষয়িক ক্ষতি করা তার মালের ওপর জুলুম বলে বিবেচিত হবে।
কারও নামে অপবাদ দেওয়া, তার গীবত করা, তাকে গালাগাল করা এবং তার প্রতি মানহানিকর যে–কোনও আচরণ করা ইজ্জতের ওপর জুলুম করার অন্তর্ভুক্ত। ইসলাম এর প্রত্যেকটিকেই কঠিনভাবে নিষিদ্ধ করেছে এবং যে–কোনও প্রকার জুলুমকে কঠিন পাপ ঘোষণা করেছে।

চিন্তা করলে বোঝা যায় 'হাক্কুল ইবাদ' জাতীয় জুলুম হাক্কুল্লাহ'র ক্ষেত্রে জুলুম অপেক্ষাও কঠিন। কেননা হাক্কুল ইবাদ আদায় করাও আল্লাহ তা'আলার হুকুম। কাজেই এটা লঙ্ঘন করলে যেমন বান্দার হক নষ্ট করার জুলুম হয়, তেমনি আল্লাহর হক নষ্ট করারও জুলুম হয়ে যায়। তাই প্রত্যেকের কর্তব্য এর থেকে সম্পূর্ণরূপে বিরত থাকা। অন্যথায় আখিরাতে এর জন্য কঠিন শাস্তির সম্মুখীন তো হতেই হবে, দুনিয়ায়ও এর অশুভ পরিণাম ভোগ করার আশঙ্কা আছে।

ইতোমধ্যে কারও দ্বারা যদি কোনও প্রকার জুলুম হয়ে থাকে, তবে তার কর্তব্য এখনই সে ব্যাপারে পরিষ্কার হয়ে যাওয়া। পরিষ্কার হওয়ার উপায় হচ্ছে, হাক্কুল্লাহর ক্ষেত্রে আল্লাহ তা'আলার কাছে তাওবা করা এবং হাক্কুল ইবাদের ক্ষেত্রে তাওবার পাশাপাশি সে যার ওপর জুলুম করেছে তার থেকে দায়মুক্তি লাভ করা। অর্থাৎ যদি তার জানের ওপর আঘাত করে থাকে বা কোনওভাবে তার মানহানি করে থাকে, তবে তার কাছে সরাসরি ক্ষমা চাওয়া এবং আন্তরিকভাবে তার কাছ থেকে ক্ষমা লাভ করে নেওয়া। যদি তার মৃত্যু হয়ে থাকে, তবে তার ওয়ারিশদের প্রতি সদাচরণ করা, তাদেরকে খুশি করার চেষ্টা করা এবং সেই মৃত ব্যক্তির জন্য মাগফিরাতের দু'আ করতে থাকা। এতে আশা করা যায় আল্লাহ তা'আলা তার পক্ষ থেকে ক্ষমার ব্যবস্থা করে দেবেন।

আর যদি অর্থ–সম্পদ সংক্রান্ত জুলুম হয়ে থাকে, তবে সে যদি জীবিত থাকে এবং তাকে পাওয়া সম্ভব হয়, তাহলে তার যে পরিমাণ অর্থ সে আত্মসাৎ করেছে তা তাকে ফেরত দেবে। যদি সে মারা গিয়ে থাকে, তবে তার ওয়ারিশদের কাছে ফেরত দেবে। যদি তাকে বা তার ওয়ারিশদের কাউকেই না পাওয়া যায়, তবে তার নামে তা দান সদাকা করে দেবে। অর্থাৎ এই নিয়ত রাখবে যে, এর ছাওয়াব যেন সে ব্যক্তি পায়। এর বিস্তারিত মাসাইল বিজ্ঞ আলেমদের কাছ থেকে জেনে নেওয়া চাই।

উল্লেখ্য, প্রত্যেক ব্যক্তির নিজের ওপরও নিজের হক আছে। যেমন এক হাদীছে বলা হয়েছেঃ–

وإن لنفسك عليك حقا

নিশ্চয়ই তোমার ওপর তোমার নিজেরও হক আছে। (জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ২৪১৩; মুস্তাদরাক হাকিম, হাদীছ নং ৬৯০০; সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ৩৬৩৮; সুনানে আবূ দাউদ, হাদীছ নং ১৩৬৯; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ২৬৩০৮; তাবারানী, আল–মু'জামুল কাবীর, হাদীছ নং ৮৩১৯)
সুতরাং বান্দার হকের মধ্যে নিজের হকও শামিল। এ ক্ষেত্রে অবহেলাও জুলুমের অন্তর্ভুক্ত। এমন কোনও কাজ করা জায়েয হবে না, যা দ্বারা নিজ জান, মাল ও ইজ্জত ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আর সর্বপ্রকার জুলুমই শেষটায় নিজ সত্তার ওপরই জুলুম। কেননা তাতে যে পাপ হয় তার খেসারত তো নিজেকেই দিতে হয়। তাই অন্ততপক্ষে নিজের ক্ষতি চিন্তা করেও সবরকম জুলুম থেকে বিরত থাকা উচিত।

তারপর যুলুম করার পরিণাম সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, কিয়ামতের দিন তা ঘোর অন্ধকারে পরিণত হবে। দুনিয়ায় যে ব্যক্তি জুলুম করেছে, সে কিয়ামতের দিন আলো পাবে না। অথচ সেদিন জাহান্নাম থেকে মুক্তিলাভ করে জান্নাতে পৌঁছার জন্য আলোর প্রয়োজন হবে। যেমন মু'মিনদের সম্পর্কে কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে-

نُورُهُمْ يَسْعَى بَيْنَ أَيْدِيهِمْ

তাদের আলো তাদের সামনে ও তাদের ডান পাশে ধাবিত হবে। সূরা তাহরীম (৬৬), আয়াত ৯
সেদিন যাদের আলো থাকবে না, তারা জান্নাতে পৌঁছতে পারবে না। তাই প্রত্যেকের উচিত কত বেশি আলো সংগ্রহ করা যায় সে চেষ্টা করা। এমন কোনও কিছুতে লিপ্ত হওয়া উচিত নয়, যা আলো তো নয়ই: উল্টো অন্ধকারের কারণ হয়ে দাঁড়াবে। এ হাদীছ বলছে, জুলুম সেরকমই এক কাজ, যা জুলুমকারীর জন্য অন্ধকারে পরিণত হবে। এ অবস্থায় নাজাতের আশা কিভাবে করা যেতে পারে?

কারও মনে জানার আগ্রহ দেখা দিতে পারে যে, জুলুমের পরিণাম কেন অন্ধকাররূপে দেখা দেবে? এর উত্তর এই যে, আরবীতে অন্ধকারকে ظلمة وظلام (জুলমাত ও জলাম) বলা হয়। উভয়টি একই মূলধাতু থেকে নির্গত। ধাতুগতভাবে যেমন উভয়ের মধ্যে মিল আছে, তেমনি মিল আছে তাত্ত্বিকভাবেও। কেননা জুলুমের কাজটি এমন ব্যক্তিই করতে পারে, যার অন্তর অন্ধকারাচ্ছন্ন।

সাধারণত জুলুম করা হয় নিজের চেয়ে যে দুর্বল তার প্রতি। মনুষ্যত্বের তো দাবি দুর্বলের প্রতি মমতা ও করুণা দেখানো। সেখানে যদি জুলুম ও অবিচার করা হয়, তবে তা মনুষ্যত্ব লোপ পেয়ে যাওয়ারই প্রমাণ বহন করে। অর্থাৎ তার অন্তর থেকে মনুষ্যত্বের আলো ঘুচে গিয়ে পাশবিকতার অন্ধকারে ছেয়ে গেছে। সেখানে দয়া-মায়ার পরিবর্তে স্থান করে নিয়েছে নিষ্ঠুরতা। এভাবে দুনিয়ায় যেহেতু দুর্বলের প্রতি জালেম ব্যক্তির আচরণ হয় তার অন্ধকারাচ্ছন্ন মন থেকে, সেহেতু আখিরাতে তার শাস্তিও অনুরূপই হবে। অর্থাৎ তার অন্তরের অন্ধকারপ্রসূত আচরণকে আখিরাতে বাস্তবিক অন্ধকারের রূপ দিয়ে দেওয়া হবে। যেমন কর্ম তেমন ফল।

হযরত মু'আবিয়া রাযি. বলতেন, ওই ব্যক্তির প্রতি জুলুম করতে আমার লজ্জাবোধ হয়, যার আল্লাহ ছাড়া এমন কোনও সাহায্যকারী নেই, যে আমার বিরুদ্ধে তার পক্ষে দাঁড়াতে পারে।
বিলাল ইবন মাস'উদ রহ. বলেন, তুমি ওই ব্যক্তিকে ভয় কর, যার আল্লাহ ছাড়া কোনও সাহায্যকারী নেই।

ইয়াযীদ ইবন হাতিম রহ. বলতেন, যে ব্যক্তি সম্পর্কে আমার জানা আছে যে, আল্লাহ ছাড়া তার কোনও সাহায্যকারী নেই, এমন দুর্বলের প্রতি জুলুম করতে আমার যতটা ভয় হয়, অতটা ভয় আমার অন্য কোনওকিছুতেই হয় না।
এ হাদীছে দ্বিতীয়ত নিষেধ করা হয়েছে লোভ-লালসা করতে। বলা হয়েছে-

اتقوا الشح

(তোমরা লোভ-লালসা হতে বিরত থাক)। তারপর নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কারণ সম্পর্কে বলেন যে, আগের জাতিসমূহ লোভ-লালসার কারণেই ধ্বংস হয়েছে। তারা লোভ-লালসায় পড়ে একে অন্যের রক্তপাত করেছে এবং নিষিদ্ধ বিষয় হালাল করে নিয়েছে।

কেউ যখন অর্থ-সম্পদ, ক্ষমতা বা অন্য কিছুর লোভে পড়ে যায়, তখন তা অর্জনের জন্য বৈধ-অবৈধ নির্বিচারে সবরকম পন্থা অবলম্বন করে থাকে। এমনকি এর জন্য খুন-খারাবি করতেও দ্বিধাবোধ করে না। মানুষের মধ্যে সর্বপ্রথম হত্যার ঘটনা তো এভাবেই ঘটেছিল। কাবীল হাবীলকে হত্যা করেছিল নারীর লোভে পড়ে। বনী ইসরাঈলে যে এক ভাতিজা তার চাচাকে হত্যা করেছিল, তা তার সম্পদের লোভে পড়ে। সে ঘটনা সংক্ষেপে সূরা বাকারায় বর্ণিত হয়েছে। বর্তমানেও আমরা দেখছি কিভাবে মানুষ ক্ষমতার জন্য খুনাখুনিতে লিপ্ত হয়। অন্যের সম্পদ গ্রাস করার জন্যও একে অন্যকে খুন করছে। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন-

اسْتَحَلوا مَحارمهم

তারা তাদের জন্য নিষিদ্ধ বিষয়সমূহকে হালাল করে নিয়েছিল। এখানে محارم (মাহারিম) শব্দটি محرم (মাহরাম)-এর বহুবচন। এর অর্থ নিষিদ্ধ বিষয় ও নিষিদ্ধ বস্তু। যে সকল নর-নারীর মধ্যে বিবাহ হারাম, তাদেরকেও একে অপরের মাহরাম বলা হয়ে থাকে। পূর্বের জাতিসমূহ লোভ-লালসার বশবর্তী হয়ে সর্বপ্রকার হারাম ও নিষিদ্ধ কাজকে হালাল করে ফেলেছিল। তাদের অনেকে মাহরামকে বিবাহ করত, অনেকে ছলচাতুরী করে হারাম বস্তু হালাল বানিয়ে নিত। এর পরিণামে তাদেরকে ধ্বংস করে দেওয়া হয়।

তাদেরকে ধ্বংস করার দুই অর্থ হতে পারে। ক. আযাব ও গযব দ্বারা দুনিয়া থেকে নির্মূল করে ফেলা। আল্লাহ তা'আলা বহু জাতিকে এমনভাবে ধ্বংস করে দিয়েছেন যে, দুনিয়ায় তাদের কোনও চিহ্নমাত্রও অবশিষ্ট নেই।

খ. দ্বিতীয় অর্থ হতে পারে আদর্শগত বিলুপ্তি। অর্থাৎ রক্তপাত ও হালালকে হারাম করতে থাকার পরিণামে তাদের দীন-ধর্ম এমনভাবে বিকৃত হয়ে গিয়েছিল যে, শুরুতে তারা যে ধর্মের ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল, একপর্যায়ে সেই ধর্মের সাথে তাদের বিশ্বাস ও জীবনাচারের কোনও সম্পর্ক ও মিল থাকেনি। তারা যেন সম্পূর্ণ এক ভিন্ন জাতিতে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। বর্তমানে মুসলিম জাতি ছাড়া অন্য যারা নিজেদেরকে আসমানী ধর্মের অনুসারী বলে দাবি করে, তাদের অবস্থা তো এরকমই।

কেউ কেউ তাদের ধ্বংস হয়ে যাওয়ার ব্যাখ্যা এভাবে করেছেন যে, লোভ-লালসার কারণে খুন-খারাবিতে লিপ্ত হওয়া ছিল তাদের দৈহিক ধ্বংস আর হারাম বস্তুকে হালাল বানিয়ে ভোগ করা ছিল নৈতিক ধ্বংস। লোভ-লালসা এমনই এক খাসলাত, যার পরিণামে মানুষ এ উভয়বিধ ধ্বংসের শিকার হয়ে যায়।

কেউ কেউ الشح -এর অর্থ করেছেন কৃপণতা। সে হিসেবে এ হাদীছে কৃপণতা করতে নিষেধ করা হয়েছে এবং এ খাসলাতকে পূর্ববর্তী জাতিসমূহের ধ্বংসের কারণ সাব্যস্ত করা হয়েছে। বস্তুত কৃপণতার কারণেও মানুষ রক্তপাত ও হারামকে হালাল করার কাজে লিপ্ত হয়ে পড়ে। কৃপণ ব্যক্তি অন্যের হক আদায় করতে তো চায়ই না, সেইসঙ্গে অর্থ-সম্পদ কুক্ষিগত করার জন্য সে অন্যায়ভাবে অন্যের সম্পন হরণেরও চেষ্টা করে। পরিণামে পরস্পরে মারামারি-হানাহানির সৃষ্টি হয়ে যায়।

এমনিভাবে কৃপণ ব্যক্তি সম্পদের লোভেও পড়ে যায়। বরং বলা যায় কৃপণ ব্যক্তির অন্তরে সম্পদের লোভ থাকেই। আর সেই লোভের কারণে সে যাকাত আদায় করতে গড়িমসি করে। হয়তো তা আদায় করেই না। এমনিভাবে অর্থ-সম্পদ সংক্রান্ত অন্যান্য হক আদায় থেকেও বিরত থাকে। সেইসঙ্গে কোন্ ছলে হারাম মাল ভোগ করা যায় সেই ফাঁক-ফোকরও খোঁজে। এভাবে সে একের পর এক হারাম ভোগের সিলসিলায় লিপ্ত হয়ে পড়ে। এক কৃপণতার খাসলাতের কারণে সে লোভ, হিংসা, পরশ্রীকাতরতা, স্বার্থপরতাসহ নানা মন্দ খাসলাতের শিকার হয়ে যায় এবং নৈতিক অধঃপতনের চূড়ান্ত পর্যায়ে নেমে যায়। এ কারণেই নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম কৃপণতা থেকে বেঁচে থাকার তাগিদ করেছেন।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. জুলুম একটি কঠিন পাপ। সুতরাং আমরা সর্বপ্রকার জুলুম থেকে বিরত থাকার চেষ্টা করব।

খ. লোভ-লালসা ও কৃপণতা এমনিতেও কঠিন পাপ। সেইসঙ্গে তা অন্যান্য নৈতিক অবক্ষয়েরও কারণ। সুতরাং এর থেকে বেঁচে থাকা প্রত্যেকের অবশ্যকর্তব্য।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান