মুসনাদে আহমদ- ইমাম আহমদ রহঃ (আল-ফাতহুর রব্বানী)

তাওবা অধ্যায়

হাদীস নং: ৩৪
তাওবা অধ্যায়
অনুচ্ছেদ: এক ব্যক্তি নিরানব্বইজন লোককে হত্যা করে তারপর একজনকে হত্যা করে একশত পূর্ণ করলো
৩৪. আবু সা'ঈদ খুদরী (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট যা শুনেছি, তা অবশ্যই তোমাদের কাছে বর্ণনা করব। আমি তা নিজ কানে শুনেছি এবং আমার অন্তর দিয়ে তা অনুধাবন করেছি। এক ব্যক্তি নিরানব্বই জন মানুষকে হত্যা করে। এরপর তওবা করার চিন্তা আসে তাই সে দুনিয়ার সর্বশ্রেষ্ঠ আলেমের সন্ধান করে। তাকে একজন দরবেশের কথা বলে দেয়া হয়। সে তার নিকট গিয়ে বলে, আমি নিরানব্বই জন লোককে হত্যা করেছি। এখন আমার জন্য তাওবার কোন সুযোগ আছে কি? সে বললো, নিরানব্বই জন লোককে হত্যা করার পর তাওবার সুযোগ? তখন সে তরবারী খুলে তাকে হত্যা করে একশত সংখ্যা পূর্ণ করে। তারপর আবার তাওবার চিন্তা আসে তাই সে দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ 'আলিমের সন্ধান করে। তখন তাকে এক 'আলিমের খোঁজ দেয়া হয়। সে তার নিকট গিয়ে বলে, আমি একশত লোককে হত্যা করেছি, এখন আমার তাওবা করার কোন সুযোগ আছে কি? সে বললো, হাঁ, তাওবার সুযোগ আছে? আর তোমার আর তাওবার মাঝে কে অন্তরায় হতে পারে? তুমি যে খারাপ গ্রামে আছ, সেখান থেকে অমুক ভাল গ্রামে চলে যাও। সেখানে গিয়ে তোমার রবের ইবাদত কর। অতঃপর সে ভাল বা নেককার লোকদের গ্রামের দিকে বের হলে পথেই তার শেষ সময় এসে পড়লো। তখন রহমতের ফেরেশতা ও আযাবের ফেরেশতাদের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দিল। বর্ণনাকারী বলেন ইবলিস বললো, আমি তার অধিক ভাবদার সে কখনও আমার নাফরমানী করেনি।(অর্থাৎ সর্বদা আল্লাহর নাফরমানি করেছে আর আমার আনুগত্য করেছে) তখন রহমতের ফেরেশতারা বলতে লাগলো, এ লোকটি তাওবা করে আল্লাহর দিকে ফিরে এসেছে, আবু রাফে' (রা) বলেন, তখন আল্লাহ্ তা'আলা একজন ফেরেশতা পাঠালে তারা তার বিষয়ে মতবিরোধ তার কাছে পেশ করলো। এরপর তিনি বাকি অংশ কাতাদা (রা) বর্ণিত হাদীসের মতোই বললেন, তোমরা দেখ, দুইটি গ্রামের মধ্যে যেটি তার নিকটবর্তী হয়, তাকে সে গ্রামের জনগণের সাথে সম্পৃক্ত কর। কাতাদা (রা) বলেন, হাসান (র) বলেন, ওই লোক যখন মৃত্যুর ব্যাপারে নিশ্চিত হলো, তখন নিজেকে ভাল লোকদের সাথে মিলিত করার চেষ্টা করল। তাই আল্লাহ তা'আলা সৎ জনবসতিকে তার নিকটবর্তী করে দিলেন, আর অসৎ জনবসতিকে দুরে সরিয়ে দিলেন। ফলে ফেরেশতারা তাকে সৎ জনবসতির অন্তর্ভুক্ত করে নিল।
كتاب التوبة
فصل منه في قصة الرجل الذي قتل تسعة وتسعين نفسا ثم أكمل المائة
حدثنا يزيد (2) أنبأنا همام بن يحيى ثنا قتادة عن أبي الصديق الناجي عن أبي سعيد الخدري رضي الله عنه قال لا أحدثكم الا ما سمعت من رسول الله صلى الله عليه وسلم سمعته أذناي ووعاه قلبي إن عبدا قتل تسعة وتسعين نفسا (3) ثم عرضت له التوبة فسأل عن أعلم أهل الأرض فدل (4) على رجل فأتاه فقال اني قتلت تسعة وتسعين نفسا فهل لي من توبة؟ قال بعد قتل تسعة وتسعين نفسا؟ قال فانتضى سيفه فقتله به فأكمل به مائة ثم عرضت له التوبة فسأل عن أعلم أهل الأرض فدل على رجل (5) فأتاه فقال اني قتلت مائة نفس فهل لي من توبة؟ فقال ومن يحول بينك وبين التوبة أخرج من القرية الخبيثة التي انت فيها الى القرية الصالحة كذا وكذا (6) فاعبد ربك فيها قال فخرج الى القرية الصالحة فعرض له أجله في الطريق قال فاختصمت فيه ملائكة الرحمة وملائكة العذاب قال فقال ابليس فأنا أولى به أنه لم يعصني ساعة قط (1) قال فقالت ملائكة الرحمة إنه خرج تائبا قال همام فحدثني حميد الطويل عن بكر بن عبد الله المزني عن أبي رافع (2) قال فبعث الله عز وجل ملكا فاختصموا اليه (3) ثم رجع الى حديث قتادة قال فقال انظروا أي القريتين كان أقرب اليه فالحقوه بأهلها قال قتادة فحدثنا الحسن قال لما عزف الموت احتفز بنفسه (4) فقرب الله عز وجل منه القرية الصالحة وباعد عنه القرية الخبيثة (5) فألحقوه بأهل القرية الصالحة

হাদীসের ব্যাখ্যা:

তাওবা সম্পর্কে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ হাদীছ। আল্লাহ তা'আলা যে কত উপায়ে বান্দার তাওবা কবুল করেন, এ হাদীছে তা স্পষ্ট করা হয়েছে। এতে জানানো হয়েছে একজন মানুষ যত বড় পাপীই হোক, তার তাওবা করার সুযোগ থাকে এবং সময়মত তাওবা করলে তা আল্লাহ কবূলও করেন। যেমন হাদীছে বর্ণিত লোকটি একজন ঘোরতর পাপী ছিল। একশ'জন লোকের হত্যাকারী। তা সত্ত্বেও আল্লাহ তা'আলা তার তাওবা কবুল করেন এবং তাকে ক্ষমা করে দেন।
ঘটনাটির সারমর্ম এই যে, আমাদের পূর্বের জাতি খুব সম্ভব খৃষ্টান জাতির মধ্যে এক ব্যক্তি এক এক করে ৯৯জন লোককে হত্যা করেছিল। নিশ্চয়ই তার এ পাপ অতি গুরুতর। কাজেই যখন তাওবার উদ্দেশ্যে কোনও রাহিবের কাছে আসল, তখন সে রাহিবও তার তাওবা করার সুযোগ আছে বলে মনে করেনি। তার কাছে মনে হয়েছে এমন ঘোরতর পাপীর আবার কিসের তাওবা!
মূলত এটা ছিল সে রাহিবের অজ্ঞতা। একজন পাপী, যে কিনা তাওবা করতে এসেছে, তাকে আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ করা কোনও জ্ঞানীজনের কাজ হতে পারে না। আল্লাহর রহমত তাঁর ক্রোধের উপর প্রবল। যত বড় পাপীই হোক না কেন সে যদি একবার অনুতপ্ত হৃদয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করে, তবে আল্লাহ তা'আলা অবশ্যই তাকে ক্ষমা করে দেন। তাই এ ব্যক্তিকে নিরাশ করা রাহিবের উচিত হয়নি। এ অনুচিত কাজ করার “যে পরিণাম হওয়ার কথা তাই হয়েছে। এর ফলে তার মনে হতাশা দেখার পাশাপাশি প্রচণ্ড ক্রোধেরও সঞ্চার হয়েছে। হতাশ মনের লোক নির্দ্বিধায় যে-কোনও কাজ করে ফেলতে পারে। ক্রোধোন্মত্ত ব্যক্তিরও কোনও বিবেচনাবোধ থাকে না। ফলে যে-কোনও গর্হিত কাজ সে অনায়াসে করে ফেলে।
হাদীছে বর্ণিত ব্যক্তির মধ্যে সেই ক্রোধ ও হাতাশা- এ দুইই দেখা দিয়েছিল। ফলে তৎক্ষণাৎ সে রাহিবকে হত্যা করে আর এভাবে সে একশ'র কোটা পূর্ণ করে ফেলে। সর্বশেষ এ হত্যার পর তার মধ্যে আবারও অনুশোচনা জাগে। সুতরাং কিভাবে তার মুক্তিলাভ ও তাওবার ব্যবস্থা হতে পারে, তা জানার জন্য বড় কোনও আলেমের সন্ধান করল। তাকে এক আলেমের সন্ধান দেওয়া হল এবং সে তার কাছে চলে গেল।
এবারের ব্যক্তি যথার্থই আলেম ছিলেন। তিনি তাকে হত্যশ করলেন না; বরং এই বলে তার মনে আশার সঞ্চার করলেন যে, কে পাপী ব্যক্তি ও তাওবার মাঝখানে বাধার সৃষ্টি করতে পারে? আল্লাহ অসীম রহমতের মালিক। তাঁর কাছে তাওবার দুয়ার চির উন্মুক্ত। তিনি সকল পাপীকেই ক্ষমা করেন। তোমাকেও ক্ষমা করবেন। তবে হাঁ, পুনরায় যাতে পাপে লিপ্ত না হও, তাই তোমার আত্মসংশোধনের দরকার। সেই সংশোধনের জন্য প্রয়োজন সৎসঙ্গ। তাই নিজ এলাকা ছেড়ে তাকে এমন এক জনপদে যাওয়ার পরামর্শ দিলেন, যেখানে কিছু সংলোক বাস করে এবং আল্লাহর ইবাদত বন্দেগীর ভেতর মশগুল থাকে। তাদের সাহচর্যে কিছুদিন কাটালে তার মধ্যে পরিবর্তন আসবে। আল্লাহর হুকুমমত চলার মানসিকতা তৈরি হবে। নেক কাজের অভ্যাস গড়ে উঠবে। সবরকম বদ অভ্যাস দূর হয়ে যাবে। আর এভাবে ক্রমে সেও একজন সৎলোকে পরিণত হবে।
এই আলেমের পরামর্শ মোতাবেক পাপী লোকটি ওই নেককারদের কাছে যাওয়ার জন্য রওয়ানা হয়ে গেল। যেতে যেতে যখন তার বাড়ি ও নেককারদের এলাকার মাঝ বরাবর পৌঁছল, তখন তার আয়ু ফুরিয়ে গেল। এখন কে তার জান কবজ করবে? রহমতের ফিরিশতা, না আযাবের ফিরিশতা? ফিরিশতাদের দুই দলই উপস্থিত হয়ে গেলেন। আযাবের ফিরিশতাদের কথা- সে একজন ঘোর পাপী। কখনও নেককাজ করেনি। আমরাই তার জান কবজ করব। রহমতের ফিরিশতাদের দাবি তারা জান কাবজ করবেন। কারণ সে পাপী হলেও এখন তো তাওবা করেছে এবং সংশোধনের ইচ্ছায় নেককারদের সাহচর্য নিতে চেয়েছে। উভয়েরই শক্ত যুক্তি। কিন্তু আল্লাহ তাআলা যে পরম দয়ালু। তিনি দয়ার আচরণ করলেন। একজন ফিরিশতার মাধ্যমে ফয়সালা নিলেন উভয়দিকের রাস্তা মেপে দেখা হোক। যেদিকের রাস্তা কম হবে, অর্থাৎ সে যেদিকের বেশি কাছে হবে তাকে সেই দিকেরই গণ্য করা হবে। যদি সে নেককারদের বেশি কাছে হয়, তবে তাকে নেককারদের একজন গণ্য করা হবে আর সে হিসেবে রহমতের ফিরিশতাগণ তার জান কবজ করবেন। অন্যথায় তার জান কবজ করবেন আযাবের ফিরিশতাগণ। সুতরাং পথ মাপা শুরু হল। ওদিকে আল্লাহ তা'আলা যমীনের প্রতি হুকুম জারি করলেন। নেককারদের দিকের ভূমিকে বললেন, সংকুচিত হয়ে যাও। আর ওদিকের ভূমিকে বললেন, প্রসারিত হয়ে যাও। ভূমি হুকুম পালন করল। ফলে মেপে দেখা গেল নেককারদের দিকে দূরত্ব এক বিঘত কম এবং সে তাদেরই বেশি কাছে। সুতরাং ফয়সালা মোতাবেক রহমতের ফিরিশতাগণ তার জান কবজ করলেন।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. কারও দ্বারা যত বড় পাপই হোক না কেন, তাওবা কবুলের ব্যাপারে হতাশ হওয়া উচিত নয়। খাঁটি তাওবা করলে আল্লাহ তা'আলা বড় থেকে বড় পাপও ক্ষমা করেন।

খ. খাঁটি তাওবার একটা অংশ নিজেকে সংশোধনের চেষ্টা করা। নিজেকে সংশোধন করার প্রকৃষ্ট উপায় নেককার লোকদের সাহচর্যগ্রহণ।

গ. নেককার লোকদের কাছে যাওয়ার উদ্দেশ্যে পথ চলাও এক মূল্যবান ইবাদত। এর অছিলায়ও আল্লাহ তা'আলা গুনাহ মাফ করেন।

ঘ. মানুষের ভালো-মন্দরূপে গড়ে উঠার পেছনে পরিবেশের ভূমিকা থাকে। তাই নিজের আমল-আখলাক তৈরি ও হেফাজতকল্পে মন্দ পরিবেশ পরিত্যাগ ও ভালো পরিবেশ অবলম্বন জরুরি।

ঙ. দীনী বিষয়ে সুযোগ্য আলেমের পরামর্শ গ্রহণ করা বাঞ্ছনীয়। এরূপ আলেম কাছে না পাওয়া গেলে শারীরিক চিকিৎসার্থে যেমন দূরে যাওয়া হয়, তেমনি এ ব্যাপারেও দূরের কোনও যোগ্য আলেমের কাছে যেতে হবে।

চ. অযোগ্য ও বেআমল আলেমের সাহচর্য ক্ষতিকর।

ছ. অন্যকে পরামর্শদানে, বিশেষত দীনী বিষয়ে সতর্কতা জরুরি। ভুল পরামর্শে অন্যের অনেক বড় ক্ষতি হয়ে যেতে পারে।

জ. যে বিষয়ে ভালো জানা নেই, সে বিষয়ে মাসআলা বলা ও ফতোয়া দেওয়া থেকে বিরত থাকা অবশ্যকর্তব্য।

ঝ. পাপী ব্যক্তিকে হতাশ না করে তাকে তাওবার প্রতি উৎসাহিত করা ও আল্লাহর রহমত লাভে আশাবাদী করে তোলাই তার প্রকৃত কল্যাণকামিতা।

ঞ. নরহত্যা মহাপাপ। কুরআন মাজীদের ভাষ্যমতে যে-কোনও একজন মানুষকে অন্যায়ভাবে হত্যা করা জগতের সমস্ত মানুষকে হত্যা করার সমতুল্য।

ট. এ হাদীছ দ্বারা ইলমেরও ফযীলত জানা যায়। একজন পরহেযগার আলেম কেবল নিজেই ভ্রান্তপথ থেকে বেঁচে থাকে না। তার মাধ্যমে আল্লাহ তা'আলা অপরাপর মানুষকেও বিভ্রান্তি থেকে রক্ষা করেন ও সুপথে পরিচালিত করেন। এ হাদীছে এ ছাড়া আরও বহু শিক্ষা আছে। সংক্ষেপ করার তাগিদে এখানেই ক্ষান্ত করা হল।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান
মুসনাদে আহমদ- ইমাম আহমদ রহঃ - হাদীস নং ৩৪ | মুসলিম বাংলা