রিয়াযুস সালিহীন-ইমাম নববী রহঃ

ভূমিকা অধ্যায়

হাদীস নং: ৫১৪
ভূমিকা অধ্যায়
অধ্যায়ঃ ৫৬ অনাহারে থাকা, কৃচ্ছতাপূর্ণ জীবনযাপন করা, অল্প পানাহার, অল্প পোশাক ও অল্প ভোগে পরিতুষ্ট থাকা এবং চাহিদা ত্যাগের ফযীলত।
আসহাবুস সুফ্ফার খাদ্যাভাব ও তাদের ফযীলত
হাদীছ নং: ৫১৪

হযরত ফাযালা ইবনে উবায়দ রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন সাহাবীদের নিয়ে নামায পড়তেন, তখন নামাযে দাঁড়ানো ব্যক্তিবর্গের মধ্যে কতক লোক তীব্র ক্ষুধার করণে অচেতন হয়ে পড়ত। তারা হল আসহাবে সুফ্ফা। বেদুঈনরা বলত, এরা পাগল। রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নামায শেষে তাদের দিকে ফিরে বলতেন, আল্লাহর কাছে তোমাদের জন্য কী সংরক্ষিত আছে তা যদি জানতে, তবে তোমরা অবশ্যই আরও বেশি ক্ষুধা ও অভাবগ্রস্ততা কামনা করতে- তিরমিযী।
مقدمة الامام النووي
56 - باب فضل الجوع وخشونة العيش والاقتصار على القليل من المأكول والمشروب والملبوس وغيرها من حظوظ النفس وترك الشهوات
514 - وعن فُضَالَةَ بن عبيدٍ - رضي الله عنه: أنَّ رسول الله - صلى الله عليه وسلم - كَانَ إِذَا صَلَّى بِالنَّاسِ، يَخِرُّ رِجَالٌ مِنْ قَامَتِهِمْ في الصَّلاةِ مِنَ الخَصَاصَةِ - وَهُمْ أصْحَابُ الصُّفَّةِ - حَتَّى يَقُولَ الأعْرَابُ: هؤُلاء مَجَانِينٌ. فَإذَا صلَّى رسول الله - صلى الله عليه وسلم - انْصَرَفَ إلَيْهِمْ، فَقَالَ: «لَوْ تَعْلَمُونَ مَا لَكُمْ عِنْدَ اللهِ تَعَالَى، لأَحْبَبْتُمْ أَنْ تَزْدَادُوا فَاقَةً وَحَاجَةً». رواه الترمذي، (1) وقال: «حديث صحيح».
«الخَصَاصَةُ»: الفَاقَةُ وَالجُوعُ الشَّدِيدُ.

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এ হাদীছে সুফফাবাসী সাহাবীদের হতদরিদ্রতার পাশাপাশি ইবাদত-বন্দেগীতে একনিষ্ঠতার কথা বর্ণিত হয়েছে। ক্ষুধায় কাতর থাকা সত্ত্বেও নামায আদায়ে তাদের কোনও আলস্য ছিল না। বিপুল আগ্রহের সঙ্গেই তারা নামাযে দাঁড়াতেন। কিন্তু ক্ষুধার কষ্ট সইতে না পেরে একপর্যায়ে দাঁড়িয়ে থাকা আর সম্ভব হতো না। অচেতন হয়ে পড়ে যেতেন। বেদুঈনরা ভাবত, সে পড়ে যাওয়ার কারণ ছিল তাদের উন্মাদগ্রস্ততা। কারণ- যে ক্ষুধার কষ্ট, তা তারা বুঝতে পারত না। তাই বলে উঠত এরা পাগল।

বেদুঈনরা আসত বাহির থেকে। তাই তাদের পক্ষে সহজে বোঝা সম্ভব ছিল না। সুফ্ফার সাহাবীগণ কতটা ক্ষুধার কষ্ট সহ্য করেন। শত কষ্টেও তারা তো কারও কাছে হাত পাততেন না বা কারও কাছে কিছু চাইতেন না।

ক্ষুধার কষ্ট সহ্য করে যাওয়া এবং এ অবস্থায় কারও কাছে কিছু না চাওয়া অত্যন্ত ফযীলতের কাজ। আল্লাহ তা'আলার কাছে এর অনেক মর্যাদা। তাই তো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সালাম ফেরানোর পর তাদের লক্ষ্য করে বলেন-
لو تعلمون ما لكم عند الله تعالى، لأحببتم أن تزدادوا فاقة وحاج (আল্লাহর কাছে তোমাদের জন্য কী সংরক্ষিত আছে তা যদি জানতে, তবে তোমরা অবশ্যই আরও বেশি ক্ষুধা ও অভাবগ্রস্ততা কামনা করতে)। অর্থাৎ এত দারিদ্র্য ও অনাহার সত্ত্বেও তোমরা যে ঈমানে অবিচল আছ এবং আল্লাহ তা'আলার হুকুম পালন করে যাচ্ছ, সেজন্য আখিরাতে আল্লাহ তা'আলা তোমাদের জন্য যে পুরস্কারের ব্যবস্থা রেখেছেন তা তোমরা জান না। কুরআন মাজীদে ইরশাদ-
فَلَا تَعْلَمُ نَفْسٌ مَّا أُخْفِيَ لَهُمْ مِنْ قُرَّةٍ أَعْيُنٍ جَزَاءٌ بِمَا كَانُوا يَعْمَلُونَ
"সুতরাং কোনও ব্যক্তি জানে না এরূপ লোকদের জন্য তাদের কর্মফলস্বৰূপ চোখ জুড়ানোর কত কী উপকরণ লুকিয়ে রাখা হয়েছে।"

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহ তাআলার এ বাণী ইরশাদ করেন-
أعْدَدْتُ لِعِبَادِي الصَّالِحِينَ ما لا عين رأت ولا أذن سَمِعَتْ، وَلا خطر على
আমি আমার নেককার বান্দাদের জন্য যা প্রস্তুত রেখেছি, কোনও চোখ তা দেখেনি, কোনও কান তা শোনেনি এবং কোনও মানুষের অন্তর তা কল্পনা করেনি।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলছেন, তোমরা যদি তা জানতে, তবে তোমরা অবশ্যই আরও বেশি ক্ষুধা ও অভাবগ্রস্ততা কামনা করতে। অর্থাৎ জান্নাতে যে পুরস্কারের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে তা জানতে পারলে তা পাওয়ার জন্য তোমরা আরও বেশি উদগ্রীব হতে। ফলে ইবাদত-বন্দেগীতে তোমরা আরও বেশি মজা পেতে এবং অভাব-অনটন ও ক্ষুধার কষ্টের ভেতরও এক রকম রূহানী আস্বাদ অনুভূত হতো। আর এ কারণে ইবাদতের মাত্রা আরও বাড়িয়ে দিতে। আরও বেশি ক্ষুধা ও অভাব-অনটন প্রত্যাশা করতে।

পরম প্রিয় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পবিত্র মুখের এ আশ্বাসবাণী না জানি ক্ষুধার্ত সে সাহাবীদের অন্তরে কতটা মধুর লেগেছিল। কষ্ট ক্লেশের প্রতিটি জায়গায় তিনি তাদের অন্তরে এভাবে সান্ত্বনা যোগাতেন। তাই তো তাদের পক্ষে সকল দুঃখ-কষ্ট হাসিমুখে বরণ করে নেওয়া সম্ভব হয়েছিল। অনুসারীদের চরম কষ্ট-ক্লেশের ভেতরও তাদের প্রাণে শান্তির পরশ বোলানো আর এভাবে তাদেরকে দীন ও ঈমানের উপর প্রাণভরা উদ্যম-উদ্দীপনায় সজীব করে রাখা ছিল মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দাওয়াতী কার্যক্রমের এক বিশেষত্ব।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. সুফ্ফার সাহাবীগণ কী চরম অভাব-অনটনের ভেতর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহচর্যে পড়ে থেকেছিলেন, এ হাদীছ দ্বারা সে সম্পর্কে কিছুটা ধারণা পাওয়া যায়।

ঘ. এত কষ্টের ভেতর তারা ইলমে দীন শিখেছেন, তা সংরক্ষণ করেছেন ও আমাদের পর্যন্ত পৌঁছিয়েছেন। তাই তাদের প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞ থাকা ঈমানের দাবি।

গ. উস্তাযের সাহচর্যে থাকা ও কষ্ট-ক্লেশ সহ্য করা ইলমে দীন হাসিলের জন্য অপরিহার্য শর্ত।

খ. যারা দীন ও ঈমানের চূড়ান্ত ধাপে পৌঁছাতে সক্ষম হয়, অজ্ঞজনেরা তাদেরকে পাগল ঠাওরিয়ে থাকে।

ঙ. যে যতো বেশি কষ্ট-ক্লেশের ভেতর ঈমান-আমলে যত্নবান থাকবে, আখিরাতে সে ততো বেশি উচ্চমর্যাদা লাভ করবে, ততো বেশি পুরস্কারে ভূষিত হবে।

চ. দীনের দাওয়াতদাতা ও অনুসরণীয় ব্যক্তির কর্তব্য ভক্ত-অনুরক্তদের দুঃখ-কষ্টে সমবেদনা জানানো ও সান্ত্বনামূলক কথা বলে তাদের অন্তরে প্রশান্তি যোগানো।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান