রিয়াযুস সালিহীন-ইমাম নববী রহঃ
২. বিবিধ আদব - শিষ্টাচারের অধ্যায়
হাদীস নং: ৬৯১
বিবিধ আদব - শিষ্টাচারের অধ্যায়
কোনও সৎকর্মে অভ্যস্ত হওয়ার পর তার ধারাবাহিকতা রক্ষার আদেশ
কোনও নেক আমল ও নফল ইবাদত-বন্দেগী শুরু করার পর তা অব্যাহত রাখা উচিত। কেননা কেউ যখন কোনও নফল ইবাদত শুরু করে, তখন সে যেন আল্লাহ তা'আলার দরবারে হাজিরা দেয়। আর সে যেন জানান দেয় যে, এখন থেকে সে নিয়মিতই এ দরবারে হাজির থাকবে। পরে সে আমল ছেড়ে দিলে তা অনুপস্থিতির পর্যায়ে পড়ে। মহামহিম আল্লাহর দরবারে উপস্থিত হওয়ার পর তা অব্যাহত না রাখা। এবং নিজেকে অনুপস্থিত লোকদের কাতারে নিয়ে যাওয়া কঠিন বেয়াদবি। দুনিয়ার রাজা-বাদশার ক্ষেত্রেও এটাকে পসন্দ করা হয় না। কাজেই সকল রাজার রাজা ও বাদশার বাদশা আল্লাহ তা'আলার বেলায় এটা কী করে পসন্দনীয় হতে পারে? অতএব কোনও মুমিন ব্যক্তির পক্ষে আল্লাহর দরবারের এ অনুপস্থিতি মোটেই শোভনীয় হতে পারে না।
তাছাড়া বান্দা যে আমল করতে থাকে, তার আমলনামায় সে আমলের ছাওয়াবও লেখা হতে থাকে। আল্লাহ তা'আলা মহিমময় ও মহা দানশীল। তিনি বান্দাকে ছাওয়াব দিতে পসন্দ করেন। তিনি চান বান্দা নেক আমল অব্যাহত রেখে নিজ আমলনামায় ছাওয়াব লেখা জারি রাখুক। এক হাদীছে ইরশাদ হয়েছে-
يَا أَيُّهَا النَّاسُ، خُذُوا مِنَ الْأَعْمَالِ مَا تُطِيْقُوْنَ ، فَإِنَّ اللَّهَ لَا يَمَلُّ حَتَّى تَمَلُّوْا، وَإِنَّ أَحَبَّ الْأَعْمَالِ إِلَى اللَّهِ مَا دَامَ وَإِنْ قَلَّ
'হে মানুষ! তোমরা আমলের সেই পরিমাণ গ্রহণ করো, যা করতে সক্ষম হবে। কেননা আল্লাহ ছাওয়াব দেওয়া বন্ধ করেন না, যাবৎ না তোমরা ক্লান্ত হও (এবং আমল ছেড়ে দাও)। নিশ্চয়ই আল্লাহর কাছে সর্বোত্তম আমল তাই যা স্থায়ী হয়, যাদিও অল্প হয়।(সহীহ বুখারী: ৫৮৬১; সহীহ মুসলিম: ৮৭৫; সুনানে আবূ দাউদ: ১৩৬৮; সুনানে নাসাঈ: ৭৬২; সুনানে ইবন মাজাহ: ৪২৩৭; মুসনাদে ইসহাক ইবন রাহুয়াহ ৬২৭; মুসনাদুল বাযযার ২৯৫; মুসনাদে আবু ইয়া'লা: ৪৭৮৮; সহীহ ইবনে খুযায়মা : ১২৮২; তহাবী, শারহু মুশকিলিল আছার: ৬৫১; সহীহ ইবনে হিব্বান: ২৫৭১; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা : ৫২৩৭)
বোঝা গেল, আল্লাহ চান বান্দা তার আমলনামায় ছাওয়াব লেখানো অব্যাহত রাখুক। কোনও আমল কিছুদিন করার পর ছেড়ে দিলে তা লেখানো বন্ধ হয়ে যায়। তাই তা ছেড়ে দেওয়া কিছুতেই উচিত নয়। এজন্য শুরুতেই যখন কোনও আমল নিয়মিত করার ইচ্ছা হয়, তখন তা এ পরিমাণে গ্রহণ করা উচিত, যা নিয়মিতভাবে করে যাওয়া সম্ভব হবে, যেমনটা এ হাদীছে বলা হয়েছে।
প্রকাশ থাকে যে, এর দ্বারা ওই সমস্ত আমলের কথা বোঝানো হয়েছে, যা শুরুই করা হয় নিয়মিত করার উদ্দেশ্যে। পক্ষান্তরে হঠাৎ করে যে আমল করা হয়, সে ক্ষেত্রে এ কথা বলা হয়নি যে, তা নিয়মিত করে যেতে হবে। কেউ অন্যের দেখাদেখি হঠাৎ এক রাতে তাহাজ্জুদ পড়ল। তারপর সে যদি তাহাজ্জুদ আর না পড়ে, তা দূষণীয় হবে না, যদিও নিয়মিতভাবে তা পড়া উত্তম। হাঁ, যে ব্যক্তি একাধারে তাহাজ্জুদ পড়ছে, তার কর্তব্য তা নিয়মিত পড়ে যাওয়া। সে যদি কিছুদিন পর তা ছেড়ে দেয়, তবে তা অবশ্যই দূষণীয় হবে। এ অধ্যায়ে এটাই বোঝানো উদ্দেশ্য।
যাহোক কোনও আমলের অভ্যাস গড়ে তোলার পর তা নিয়মিত পালন করা চাই। কুরআনে কারীমের বহু আয়াত ও বিভিন্ন হাদীছে এর তাগিদ করা হয়েছে। এ পরিচ্ছেদে সে সম্পর্কিত আয়াত ও হাদীছ উল্লেখ করা হয়েছে। আমরা তার বঙ্গানুবাদ ও সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা পেশ করছি। আল্লাহ তা'আলাই তাওফীকদাতা।
‘কোনও সৎকর্মে অভ্যস্ত হওয়া…’ সম্পর্কিত কিছু আয়াত
এক নং আয়াত
إِنَّ اللَّهَ لَا يُغَيِّرُ مَا بِقَوْمٍ حَتَّى يُغَيِّرُوا مَا بِأَنْفُسِهِمْ
অর্থ: জেনে রেখো, আল্লাহ কোনও জাতির অবস্থা ততক্ষণ পর্যন্ত পরিবর্তন করেন না, যতক্ষণ না তারা নিজেরা নিজেদের অবস্থা পরিবর্তন করে।(সূরা রা'দ (১৩), আয়াত ১১)
ব্যাখ্যা
আল্লাহ তা'আলা ন্যায়পরায়ণ। তিনি কখনও কারও প্রতি জুলুম করেন না। কাজেই তিনি শুধু শুধু মানুষকে বিপদে ফেলেন না। মানুষ যে নি'আমত ও আরাম-আয়েশের মধ্যে থাকে, তা অযথাই কেড়ে নেন না। আল্লাহপ্রদত্ত নি'আমত ও আরাম-আয়েশের দাবি হল মানুষ আল্লাহ তা'আলার শোকর আদায় করবে। সে শোকর হল তাঁর আনুগত্য করা অর্থাৎ সৎকর্ম করে যাওয়া ও অসৎকর্ম হতে বিরত থাকা। মানুষ যদি আল্লাহ তা'আলার নি'আমতের শোকর আদায় করে, তবে আল্লাহ তা'আলা নি'আমত আরও বৃদ্ধি করে দেন। তখন আর নি'আমত বিলুপ্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে না। কিন্তু মানুষ বড় নাশোকর। আল্লাহ তা'আলার পক্ষ থেকে হাজারও নি'আমত পাওয়া সত্ত্বেও তারা তাঁর নাফরমানি করে, নি'আমতের অপব্যবহার করে এবং বিভিন্ন পাপকর্মে লিপ্ত হয়। এর পরিণামে আল্লাহ তা'আলা তাঁর দেওয়া নি'আমত কেড়ে নেন। ফলে নিরাপত্তার স্থানে ভয়-ভীতি, সচ্ছলতার স্থানে অসচ্ছলতা, ফল ও ফসলের প্রাচুর্যের স্থানে খরা ও দুর্ভিক্ষ ইত্যাদি দেখা দেয়। বস্তুত এ পরিণাম মানুষেরই কর্মফল। তার হাতের কামাই। আল্লাহ তা'আলা বলেন-
وَمَا أَصَابَكُمْ مِنْ مُّصِيبَةٍ فَبِمَا كَسَبَتْ أَيْدِيكُمْ وَيَعْفُوا عَنْ كَثِيرٍ
‘তোমাদের যে বিপদ দেখা দেয়, তা তোমাদের নিজ হাতের কৃতকর্মেরই কারণে দেখা দেয়। আর তিনি তোমাদের অনেক কিছুই (অপরাধ) ক্ষমা করে দেন।'(সূরা শূরা (৪২),আয়াত ৩০)
আয়াতটির শিক্ষা
ক. আল্লাহ তা'আলা বিনা কারণে কাউকে বিপদ-আপদে ফেলেন না।
খ. কেউ যদি ভালো অবস্থা হারিয়ে মন্দ অবস্থার শিকার হয়ে যায়, তবে তার বুঝতে হবে তার কোনও মন্দ কৃতকর্মের কারণেই এমন হয়েছে। তাই তার কর্তব্য হবে তাওবা করে নিজেকে সংশোধন করে নেওয়া।
গ. যে-কোনও নি'আমত ও ভালো অবস্থার জন্য আল্লাহ তা'আলার শোকর আদায় করা তথা আল্লাহর আনুগত্য করা ও পাপকর্ম থেকে বেঁচে থাকা উচিত। এটা নি'আমতবৃদ্ধি ও তার স্থায়িত্বের পক্ষে সহায়ক।
দুই নং আয়াত
وَلَا تَكُونُوا كَالَّتِي نَقَضَتْ غَزْلَهَا مِنْ بَعْدِ قُوَّةٍ أَنْكَاثًا
অর্থ: যে নারী তার সুতা মজবুত করে পাকানোর পর পাক খুলে তা রোয়া-রোয়া করে ফেলেছিল, তোমরা তার মতো হয়ো না।(সূরা নাহল (১৬), আয়াত ৯২)
ব্যাখ্যা
বর্ণিত আছে, মক্কা মুকাররমায় খারকা নাম্নী এক উন্মাদিনী ছিল। সে দিনভর পরিশ্রম করে সুতা কাটত আবার সন্ধ্যা হলে তা খুলে খুলে নষ্ট করে ফেলত। কালক্রমে তার এ কাণ্ডটি একটি দৃষ্টান্তে পরিণত হয়। যেমন কেউ যখন কোনও ভালো কাজ সম্পন্ন করার পর নিজেই তা নষ্ট করে ফেলে তখন ওই নারীর সাথে তাকে উপমিত করা হয়। এখানে তার সাথে তুলনা করা হয়েছে সেইসব লোককে, যারা কোনও বিষয়ে জোরদারভাবে কসম করার পর তা ভেঙ্গে ফেলে।
বলা হচ্ছে, তোমরা কোনও বিষয়ে অঙ্গীকার করার পর তা ভঙ্গ করো না। তা ভঙ্গ করাটা ওই উন্মাদিনী নারীর মতো নির্বুদ্ধিতার কাজ হবে। অঙ্গীকার করা হয় আল্লাহর নামে। আল্লাহর নামের মর্যাদা রক্ষা করা চাই। যে বুদ্ধিমানেরা আল্লাহর নামের সম্মান ও মর্যাদা বোঝে, তারা কখনওই অঙ্গীকার ভঙ্গ করতে পারে না। পক্ষান্তরে যারা ন্যায়-নীতি বর্জন করে দুনিয়ার হীন স্বার্থ ও কামনা-বাসনা পূরণের ধান্দায় পড়ে যায়, তারা তাদের সাধারণ কাণ্ডজ্ঞানও হারিয়ে ফেলে। তাদের কাছে শপথ ও অঙ্গীকার করার মূল্য থাকে না। আল্লাহ তা'আলার নামের মর্যাদার প্রতি তারা ভ্রূক্ষেপ করে না। তুচ্ছ তুচ্ছ কারণে তারা অঙ্গীকার ভঙ্গ করে ফেলে। যাদের সঙ্গে অঙ্গীকার করে, তাদেরকে যদি নিজের তুলনায় দুর্বল দেখতে পায়, তখন আর অঙ্গীকারের কোনও তোয়াক্কা করে না। সে ক্ষেত্রে নিজের তুচ্ছ স্বার্থ পূরণ করাই আসল লক্ষ্যবস্তু হয়ে দাঁড়ায়। এ আয়াত জানাচ্ছে, এ শ্রেণির লোক বড়ই নির্বোধ। বরং তারা এক ধরনের উন্মাদ। যারা প্রকৃত মুমিন-মুসলিম, তাদের এরূপ হওয়া সাজে না। তাদের কর্তব্য সর্বাবস্থায় নিজ শপথ ও অঙ্গীকারে অটল থাকা।
কোনও নেক আমল ও নফল ইবাদত-বন্দেগী শুরু করার পর তা অব্যাহত রাখা উচিত। কেননা শুরু করার দ্বারা এক রকম প্রতিশ্রুতি হয়ে যায় যে, তা অব্যাহত রাখা হবে। আমলটি ছেড়ে দেওয়ার দ্বারা সে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করা হয়। আলোচ্য আয়াতটি তার অর্থের ব্যাপকতা দ্বারা আমাদেরকে সতর্ক করছে যে, তোমরা কোনও ইবাদত-বন্দেগী শুরু করার পর কিছুতেই যেন তা ছেড়ে না দাও। বরং তা নিয়মিত করে যাবে এবং আপন প্রতিশ্রুতি রক্ষায় যত্নবান থাকবে।
আয়াতটির শিক্ষা
ক. প্রত্যেক মুমিনের কর্তব্য সর্বাবস্থায় আপন অঙ্গীকার রক্ষা করা।
খ. অঙ্গীকার ভঙ্গ করা নির্বুদ্ধিতা ও পাগলামি। কোনও মুমিনের পক্ষে এটা সাজে না।
গ. কোনও সৎকর্ম শুরু করার পর তা ছেড়ে দেওয়া কিছুতেই সমীচীন নয়। মুমিন ব্যক্তির কর্তব্য হবে সে সৎকর্ম নিয়মিতভাবে সম্পাদন করতে থাকা।
তিন নং আয়াত
وَلَا يَكُونُوا كَالَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَبَ مِنْ قَبْلُ فَطَالَ عَلَيْهِمُ الْأَمَدُ فَقَسَتْ قُلُوبُهُمْ
অর্থ: এবং তারা তাদের মতো হবে না, যাদেরকে পূর্বে কিতাব দেওয়া হয়েছিল অতঃপর যখন তাদের উপর দিয়ে দীর্ঘকাল অতিক্রান্ত হল, তখন তাদের অন্তর শক্ত হয়ে গেল।(সূরা হাদীদ (৫৭), আয়াত ১৬)
ব্যাখ্যা
অতীত কালের আহলে কিতাব সম্প্রদায় প্রথমদিকে তাদের কিতাবের অনুসরণ করলেও আস্তে আস্তে তারা তা থেকে দূরে সরে পড়ে। তারা কিতাবের হিদায়াত ছেড়ে দিয়ে ক্রমান্বয়ে দুনিয়ার দিকে ধাবিত হতে থাকে। এক পর্যায়ে পুরোপুরি মনের খেয়াল-খুশি পূরণ ও ভোগ-উপভোগের মধ্যে নিমজ্জিত হয়ে পড়ে। এতে করে তাদের মন শক্ত হয়ে যায়। তা এমনই শক্ত হয়ে যায় যে, গুনাহ করার কারণে তাদের অন্তরে কোনওরূপ অনুতাপ ও লজ্জাবোধও হচ্ছিল না। তাদের অন্তরের সে কঠোরতা বর্ণনা করতে গিয়ে আল্লাহ তা'আলা বলেন-
ثُمَّ قَسَتْ قُلُوبُكُمْ مِنْ بَعْدِ ذَلِكَ فَهِيَ كَالْحِجَارَةِ أَوْ أَشَدُّ قَسْوَةً وَإِنَّ مِنَ الْحِجَارَةِ لَمَا يَتَفَجَّرُ مِنْهُ الْأَنْهَارُ وَإِنَّ مِنْهَا لَمَا يَشَّقَّقُ فَيَخْرُجُ مِنْهُ الْمَاءُ وَإِنَّ مِنْهَا لَمَا يَهْبِطُ مِنْ خَشْيَةِ اللَّهِ
‘এসব কিছুর পর তোমাদের অন্তর আবার শক্ত হয়ে গেল, এমনকি তা হয়ে গেল পাথরের মতো; বরং তার চেয়েও বেশি শক্ত। (কেননা) পাথরের মধ্যে কিছু তো এমনও আছে, যা থেকে নদী-নালা প্রবাহিত হয়, তার মধ্যে কিছু এমন আছে যা ফেটে যায় এবং তা থেকে পানি নির্গত হয়, আবার তার মধ্যে এমন (পাথর)-ও আছে, যা আল্লাহর ভয়ে ধ্বসে পড়ে।(সূরা বাকারা (২), আয়াত ৭৪)
আল্লাহ তা'আলা এ উম্মতকে বলছেন, তোমাদের অন্তর যেন তাদের মতো শক্ত না হয়। অন্তর শক্ত হয়ে গেলে তোমরা পুরোপুরিভাবে দুনিয়ার প্রতি ঝুঁকে পড়বে। তখন কোনও ওয়াজ-নসীহত তোমাদের অন্তরে রেখাপাত করবে না। ফলে তোমরা ইবাদত-বন্দেগীতে উৎসাহ পাবে না; বরং তা থেকে সম্পূর্ণ বিমুখ হয়ে পাপাচারে লিপ্ত হয়ে পড়বে আর এভাবে তোমরা দুনিয়া ও আখিরাত সবই হারাবে। এ পরিণতিতে যাতে তোমরা না পৌঁছ, সেজন্য তোমাদের কর্তব্য এখনই ইবাদত-বন্দেগী আঁকড়ে ধরা। যা-কিছু ইবাদত-বন্দেগী তোমরা করছ তার কোনওটিই যাতে ছুটে না যায়, সে বিষয়ে সতর্ক থাকবে। দীনের উপর মজবুত থাকার জন্য ইবাদত-বন্দেগী অব্যাহত রাখা জরুরি। কোনওটি ছুটে গেলে তা পুনরায় শুরু করে দেওয়া চাই। অন্যথায় এক এক করে ছুটতেই থাকবে। পরিণামে সম্পূর্ণরূপে ইবাদতবিমুখ হয়ে যাবে আর এভাবে দিল-মন শক্ত হয়ে তোমরা দুনিয়াদারিতে পুরোপুরি ডুবে যাবে।
আয়াতটির শিক্ষা
ক . অন্তর যাতে শক্ত না হয়ে যায়, সে বিষয়ে আমাদের খুব সচেতন থাকতে হবে।
খ. আল্লাহওয়ালাদের সাহচর্য আঁকড়ে ধরলে মন নরম থাকে। তাই বেশিদিন আল্লাহওয়ালাদের সাহচর্য থেকে দূরে থাকতে নেই।
গ. মন নরম রাখার জন্য ইবাদত-বন্দেগীতে মনোযোগী থাকা জরুরি। তাই কোনও ইবাদত শুরু করার পর তা ছেড়ে দেওয়া উচিত নয়। বরং তা অব্যাহত রাখা এবং ইবাদত-বন্দেগীতে আরও বেশি অগ্রগামী হওয়া বাঞ্ছনীয়।
চার নং আয়াত
فَمَا رَعَوْهَا حَقَّ رِعَايَتِهَا
অর্থ: কিন্তু তারা তা যথাযথভাবে পালন করেনি।(সুরা হাদীদ (৫৭), আয়াত ২৭)
ব্যাখ্যা
এ বাক্যটি সূরা হাদীদের ৭৭ নং আয়াতের অংশবিশেষ। আয়াতটিতে রাহবানিয়্যাত (বৈরাগ্যবাদ) সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। রাহবানিয়্যাত অর্থ বৈরাগ্য তথা দুনিয়ার সব আনন্দ ও বিষয়ভোগ পরিহার করা। হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের পরে খ্রিষ্টসম্প্রদায় এমন এক আশ্রমিক ব্যবস্থার প্রবর্তন করেছিল, যাতে কোনও ব্যক্তি আশ্রমে ঢুকে পড়ার পর সংসারজীবন সম্পূর্ণরূপে বর্জন করত। বিয়ে-শাদী করত না এবং পার্থিব কোনওরকমের স্বাদ ও আনন্দে অংশগ্রহণ করত না। তাদের এই আশ্রমিক ব্যবস্থাকেই 'রাহবানিয়্যাত' বলে।
এ ব্যবস্থার সূচনা হয়েছিল এভাবে যে, হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের অনুসারীদের উপর বিভিন্ন রাজা-বাদশা জুলুম-নির্যাতন চালাতে থাকলে তারা নিজেদের দীন রক্ষার তাগিদে শহরের বাইরে গিয়ে বসবাস শুরু করল, যেখানে জীবনযাপনের সাধারণ সুবিধাসমূহ পাওয়া যেত না। কালক্রমে তাদের কাছে জীবনযাপনের এই কঠিন ব্যবস্থাই এক স্বতন্ত্র ইবাদতের রূপ পরিগ্রহ করে। পরবর্তীকালের লোকেরা জীবনযাপনের উপকরণাদি হস্তগত হওয়া সত্ত্বেও এই মনগড়া ইবাদতের জন্য তা পরিহার করতে থাকল।
আল্লাহ তা'আলা বলছেন-
وَرَهْبَانِيَّةً ابْتَدَعُوهَا مَا كَتَبْنَاهَا عَلَيْهِمْ إِلَّا ابْتِغَاءَ رِضْوَانِ اللَّهِ
‘আর রাহবানিয়্যাতের যে বিষয়টা, তা তারা নিজেরাই উদ্ভাবন করেছিল। আমি তাদের উপর তা বাধ্যতামূলক করিনি। বস্তুত তারা (এর মাধ্যমে) আল্লাহর সন্তুষ্টিবিধানই করতে চেয়েছিল।'
অর্থাৎ আমি তাদেরকে এরূপ কঠিন জীবনযাত্রার নির্দেশ দিইনি। তারা নিজেরাই এর প্রবর্তন করেছিল। তারা এর প্রবর্তন তো করেছিল, কিন্তু পরে তারা এ নিয়ম রক্ষা করতে পারেনি। তারা যে এর থেকে বিচ্যুত হয়ে গিয়েছিল, সে সম্পর্কে আল্লাহ বলছেন- فَمَا رَعَوْهَا حَقَّ رِعَايَتِهَا (কিন্তু তারা তা যথাযথভাবে পালন করেনি)। অর্থাৎ বৈরাগ্যবাদের এ প্রথা প্রথম দিকে তো তারা আল্লাহ তা'আলার সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যেই অবলম্বন করেছিল, কিন্তু পরবর্তীকালে তারা নিজেদের জীবনে এ প্রথা পুরোপুরিভাবে রক্ষা করতে পারেনি। তা রক্ষা করতে না পারার দুটো দিক আছে।
(এক) আল্লাহ তা'আলার বিধান ও নির্দেশের অনুসরণ না করা। কেননা আল্লাহ তা'আলা যে জিনিসকে তাদের জন্য বাধ্যতামূলক করেননি, তারা সেটাকে নিজেদের জন্য বাধ্যতামূলক করে নিল। মনে করল, এরূপ না করলে তাদের একটা মহা ইবাদত ছুটে যাবে। অথচ দীনের মধ্যে নিজেদের পক্ষ থেকে কোনও জিনিসকে এমন জরুরি মনে করা যে, তা না করলে অপরাধ হবে, এটা আল্লাহ তা'আলার নির্দেশের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন ও সম্পূর্ণ নাজায়েয।
(দুই) নিজেদের পক্ষ থেকে প্রবর্তিত বিষয়কে যথাযথরূপে পালন না করা। তারা রাহবানিয়্যাতের যে ব্যবস্থা চালু করেছিল, পরবর্তীকালে কার্যত তার যথাযথ অনুসরণ করতে পারেনি। যেহেতু ব্যবস্থাটাই ছিল স্বভাবের পরিপন্থী, তাই স্বাভাবিকভাবেই মানবপ্রকৃতির সাথে তার সংঘাত দেখা দিল এবং ধীরে ধীরে মানবপ্রকৃতির কাছে তা হেরে গেল। বৈরাগ্য হল বিষয়ভোগ থেকে বিরত থাকা। কিন্তু তারা নানা বাহানায় প্রকাশ্যে বা গোপনে বিষয়ভোগ শুরু করে দিল। সে প্রথায় বিবাহেও নিষেধাজ্ঞা ছিল। কিন্তু তারা এ ক্ষেত্রেও সীমালঙ্ঘন করল। বিবাহ করল না বটে, কিন্তু যৌন সম্ভোগের জন্য তারা ব্যভিচারে লিপ্ত হতে লাগল এবং একসময় তাদের আশ্রমগুলিতে তা মহামারি আকার ধারণ করল। সুতরাং যে উদ্দেশ্যে তারা রাহবানিয়্যাতের প্রবর্তন করেছিল তা পুরোপুরি ব্যর্থ হয়ে গেল।
প্রকৃতপক্ষে ইবাদত হিসেবে কেবল এমন আমলই গ্রহণযোগ্য, যা নবী-রাসূলগণ শিক্ষা দিয়েছেন। এর বাইরে নিজেদের পক্ষ থেকে কোনও রীতি-নীতি বা কোনও প্রথা চালু করলে আপাতদৃষ্টিতে তা যতই সুন্দর মনে হোক না কেন, বাস্তবে তা 'ইবাদত' নামে অভিহিত হওয়ার উপযুক্ত কিছুতেই নয়। বরং তা জায়েযই নয়। এ জাতীয় কাজের পারিভাষিক নাম বিদ'আত। এ জাতীয় কাজ দ্বারা কোনও ছাওয়াব পাওয়া যায় না; বরং তাতে অর্থহীন কষ্টভোগ হয় এবং কোনও ক্ষেত্রে হয় অর্থের অপচয়, সেইসঙ্গে গুনাহ তো আছেই। কাজেই এর থেকে বেঁচে থাকা অবশ্যকর্তব্য। আল্লাহ তা'আলার সন্তুষ্টি লাভ ও ছাওয়াব হাসিলের পথ একটাই, আর তা হচ্ছে শরী'আতের অনুসরণ তথা নবী-রাসূলগণের দেখানো পথে চলা। আমাদের জন্য তা হচ্ছে আখেরী নবী হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নত মোতাবেক জীবনযাপন করা।
আয়াতটির শিক্ষা
ক. আল্লাহ তা'আলার সন্তুষ্টিলাভের একটাই পথ- শরী'আতের অনুসরণ।
খ. আল্লাহ তা'আলার সন্তুষ্টিলাভের উদ্দেশ্যে নিজেদের পক্ষ থেকে কোনও প্রথা বানিয়ে নেওয়া জায়েয নয়। তাতে কোনও ছাওয়াব পাওয়া যায় না; বরং গুনাহ হয়।
গ. কোনও নফল ইবাদত নিয়মিত শুরু করলে তার ধারাবাহিকতা রক্ষা করা চাই।
কোনও নেক আমল ও নফল ইবাদত-বন্দেগী শুরু করার পর তা অব্যাহত রাখা উচিত। কেননা কেউ যখন কোনও নফল ইবাদত শুরু করে, তখন সে যেন আল্লাহ তা'আলার দরবারে হাজিরা দেয়। আর সে যেন জানান দেয় যে, এখন থেকে সে নিয়মিতই এ দরবারে হাজির থাকবে। পরে সে আমল ছেড়ে দিলে তা অনুপস্থিতির পর্যায়ে পড়ে। মহামহিম আল্লাহর দরবারে উপস্থিত হওয়ার পর তা অব্যাহত না রাখা। এবং নিজেকে অনুপস্থিত লোকদের কাতারে নিয়ে যাওয়া কঠিন বেয়াদবি। দুনিয়ার রাজা-বাদশার ক্ষেত্রেও এটাকে পসন্দ করা হয় না। কাজেই সকল রাজার রাজা ও বাদশার বাদশা আল্লাহ তা'আলার বেলায় এটা কী করে পসন্দনীয় হতে পারে? অতএব কোনও মুমিন ব্যক্তির পক্ষে আল্লাহর দরবারের এ অনুপস্থিতি মোটেই শোভনীয় হতে পারে না।
তাছাড়া বান্দা যে আমল করতে থাকে, তার আমলনামায় সে আমলের ছাওয়াবও লেখা হতে থাকে। আল্লাহ তা'আলা মহিমময় ও মহা দানশীল। তিনি বান্দাকে ছাওয়াব দিতে পসন্দ করেন। তিনি চান বান্দা নেক আমল অব্যাহত রেখে নিজ আমলনামায় ছাওয়াব লেখা জারি রাখুক। এক হাদীছে ইরশাদ হয়েছে-
يَا أَيُّهَا النَّاسُ، خُذُوا مِنَ الْأَعْمَالِ مَا تُطِيْقُوْنَ ، فَإِنَّ اللَّهَ لَا يَمَلُّ حَتَّى تَمَلُّوْا، وَإِنَّ أَحَبَّ الْأَعْمَالِ إِلَى اللَّهِ مَا دَامَ وَإِنْ قَلَّ
'হে মানুষ! তোমরা আমলের সেই পরিমাণ গ্রহণ করো, যা করতে সক্ষম হবে। কেননা আল্লাহ ছাওয়াব দেওয়া বন্ধ করেন না, যাবৎ না তোমরা ক্লান্ত হও (এবং আমল ছেড়ে দাও)। নিশ্চয়ই আল্লাহর কাছে সর্বোত্তম আমল তাই যা স্থায়ী হয়, যাদিও অল্প হয়।(সহীহ বুখারী: ৫৮৬১; সহীহ মুসলিম: ৮৭৫; সুনানে আবূ দাউদ: ১৩৬৮; সুনানে নাসাঈ: ৭৬২; সুনানে ইবন মাজাহ: ৪২৩৭; মুসনাদে ইসহাক ইবন রাহুয়াহ ৬২৭; মুসনাদুল বাযযার ২৯৫; মুসনাদে আবু ইয়া'লা: ৪৭৮৮; সহীহ ইবনে খুযায়মা : ১২৮২; তহাবী, শারহু মুশকিলিল আছার: ৬৫১; সহীহ ইবনে হিব্বান: ২৫৭১; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা : ৫২৩৭)
বোঝা গেল, আল্লাহ চান বান্দা তার আমলনামায় ছাওয়াব লেখানো অব্যাহত রাখুক। কোনও আমল কিছুদিন করার পর ছেড়ে দিলে তা লেখানো বন্ধ হয়ে যায়। তাই তা ছেড়ে দেওয়া কিছুতেই উচিত নয়। এজন্য শুরুতেই যখন কোনও আমল নিয়মিত করার ইচ্ছা হয়, তখন তা এ পরিমাণে গ্রহণ করা উচিত, যা নিয়মিতভাবে করে যাওয়া সম্ভব হবে, যেমনটা এ হাদীছে বলা হয়েছে।
প্রকাশ থাকে যে, এর দ্বারা ওই সমস্ত আমলের কথা বোঝানো হয়েছে, যা শুরুই করা হয় নিয়মিত করার উদ্দেশ্যে। পক্ষান্তরে হঠাৎ করে যে আমল করা হয়, সে ক্ষেত্রে এ কথা বলা হয়নি যে, তা নিয়মিত করে যেতে হবে। কেউ অন্যের দেখাদেখি হঠাৎ এক রাতে তাহাজ্জুদ পড়ল। তারপর সে যদি তাহাজ্জুদ আর না পড়ে, তা দূষণীয় হবে না, যদিও নিয়মিতভাবে তা পড়া উত্তম। হাঁ, যে ব্যক্তি একাধারে তাহাজ্জুদ পড়ছে, তার কর্তব্য তা নিয়মিত পড়ে যাওয়া। সে যদি কিছুদিন পর তা ছেড়ে দেয়, তবে তা অবশ্যই দূষণীয় হবে। এ অধ্যায়ে এটাই বোঝানো উদ্দেশ্য।
যাহোক কোনও আমলের অভ্যাস গড়ে তোলার পর তা নিয়মিত পালন করা চাই। কুরআনে কারীমের বহু আয়াত ও বিভিন্ন হাদীছে এর তাগিদ করা হয়েছে। এ পরিচ্ছেদে সে সম্পর্কিত আয়াত ও হাদীছ উল্লেখ করা হয়েছে। আমরা তার বঙ্গানুবাদ ও সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা পেশ করছি। আল্লাহ তা'আলাই তাওফীকদাতা।
‘কোনও সৎকর্মে অভ্যস্ত হওয়া…’ সম্পর্কিত কিছু আয়াত
এক নং আয়াত
إِنَّ اللَّهَ لَا يُغَيِّرُ مَا بِقَوْمٍ حَتَّى يُغَيِّرُوا مَا بِأَنْفُسِهِمْ
অর্থ: জেনে রেখো, আল্লাহ কোনও জাতির অবস্থা ততক্ষণ পর্যন্ত পরিবর্তন করেন না, যতক্ষণ না তারা নিজেরা নিজেদের অবস্থা পরিবর্তন করে।(সূরা রা'দ (১৩), আয়াত ১১)
ব্যাখ্যা
আল্লাহ তা'আলা ন্যায়পরায়ণ। তিনি কখনও কারও প্রতি জুলুম করেন না। কাজেই তিনি শুধু শুধু মানুষকে বিপদে ফেলেন না। মানুষ যে নি'আমত ও আরাম-আয়েশের মধ্যে থাকে, তা অযথাই কেড়ে নেন না। আল্লাহপ্রদত্ত নি'আমত ও আরাম-আয়েশের দাবি হল মানুষ আল্লাহ তা'আলার শোকর আদায় করবে। সে শোকর হল তাঁর আনুগত্য করা অর্থাৎ সৎকর্ম করে যাওয়া ও অসৎকর্ম হতে বিরত থাকা। মানুষ যদি আল্লাহ তা'আলার নি'আমতের শোকর আদায় করে, তবে আল্লাহ তা'আলা নি'আমত আরও বৃদ্ধি করে দেন। তখন আর নি'আমত বিলুপ্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে না। কিন্তু মানুষ বড় নাশোকর। আল্লাহ তা'আলার পক্ষ থেকে হাজারও নি'আমত পাওয়া সত্ত্বেও তারা তাঁর নাফরমানি করে, নি'আমতের অপব্যবহার করে এবং বিভিন্ন পাপকর্মে লিপ্ত হয়। এর পরিণামে আল্লাহ তা'আলা তাঁর দেওয়া নি'আমত কেড়ে নেন। ফলে নিরাপত্তার স্থানে ভয়-ভীতি, সচ্ছলতার স্থানে অসচ্ছলতা, ফল ও ফসলের প্রাচুর্যের স্থানে খরা ও দুর্ভিক্ষ ইত্যাদি দেখা দেয়। বস্তুত এ পরিণাম মানুষেরই কর্মফল। তার হাতের কামাই। আল্লাহ তা'আলা বলেন-
وَمَا أَصَابَكُمْ مِنْ مُّصِيبَةٍ فَبِمَا كَسَبَتْ أَيْدِيكُمْ وَيَعْفُوا عَنْ كَثِيرٍ
‘তোমাদের যে বিপদ দেখা দেয়, তা তোমাদের নিজ হাতের কৃতকর্মেরই কারণে দেখা দেয়। আর তিনি তোমাদের অনেক কিছুই (অপরাধ) ক্ষমা করে দেন।'(সূরা শূরা (৪২),আয়াত ৩০)
আয়াতটির শিক্ষা
ক. আল্লাহ তা'আলা বিনা কারণে কাউকে বিপদ-আপদে ফেলেন না।
খ. কেউ যদি ভালো অবস্থা হারিয়ে মন্দ অবস্থার শিকার হয়ে যায়, তবে তার বুঝতে হবে তার কোনও মন্দ কৃতকর্মের কারণেই এমন হয়েছে। তাই তার কর্তব্য হবে তাওবা করে নিজেকে সংশোধন করে নেওয়া।
গ. যে-কোনও নি'আমত ও ভালো অবস্থার জন্য আল্লাহ তা'আলার শোকর আদায় করা তথা আল্লাহর আনুগত্য করা ও পাপকর্ম থেকে বেঁচে থাকা উচিত। এটা নি'আমতবৃদ্ধি ও তার স্থায়িত্বের পক্ষে সহায়ক।
দুই নং আয়াত
وَلَا تَكُونُوا كَالَّتِي نَقَضَتْ غَزْلَهَا مِنْ بَعْدِ قُوَّةٍ أَنْكَاثًا
অর্থ: যে নারী তার সুতা মজবুত করে পাকানোর পর পাক খুলে তা রোয়া-রোয়া করে ফেলেছিল, তোমরা তার মতো হয়ো না।(সূরা নাহল (১৬), আয়াত ৯২)
ব্যাখ্যা
বর্ণিত আছে, মক্কা মুকাররমায় খারকা নাম্নী এক উন্মাদিনী ছিল। সে দিনভর পরিশ্রম করে সুতা কাটত আবার সন্ধ্যা হলে তা খুলে খুলে নষ্ট করে ফেলত। কালক্রমে তার এ কাণ্ডটি একটি দৃষ্টান্তে পরিণত হয়। যেমন কেউ যখন কোনও ভালো কাজ সম্পন্ন করার পর নিজেই তা নষ্ট করে ফেলে তখন ওই নারীর সাথে তাকে উপমিত করা হয়। এখানে তার সাথে তুলনা করা হয়েছে সেইসব লোককে, যারা কোনও বিষয়ে জোরদারভাবে কসম করার পর তা ভেঙ্গে ফেলে।
বলা হচ্ছে, তোমরা কোনও বিষয়ে অঙ্গীকার করার পর তা ভঙ্গ করো না। তা ভঙ্গ করাটা ওই উন্মাদিনী নারীর মতো নির্বুদ্ধিতার কাজ হবে। অঙ্গীকার করা হয় আল্লাহর নামে। আল্লাহর নামের মর্যাদা রক্ষা করা চাই। যে বুদ্ধিমানেরা আল্লাহর নামের সম্মান ও মর্যাদা বোঝে, তারা কখনওই অঙ্গীকার ভঙ্গ করতে পারে না। পক্ষান্তরে যারা ন্যায়-নীতি বর্জন করে দুনিয়ার হীন স্বার্থ ও কামনা-বাসনা পূরণের ধান্দায় পড়ে যায়, তারা তাদের সাধারণ কাণ্ডজ্ঞানও হারিয়ে ফেলে। তাদের কাছে শপথ ও অঙ্গীকার করার মূল্য থাকে না। আল্লাহ তা'আলার নামের মর্যাদার প্রতি তারা ভ্রূক্ষেপ করে না। তুচ্ছ তুচ্ছ কারণে তারা অঙ্গীকার ভঙ্গ করে ফেলে। যাদের সঙ্গে অঙ্গীকার করে, তাদেরকে যদি নিজের তুলনায় দুর্বল দেখতে পায়, তখন আর অঙ্গীকারের কোনও তোয়াক্কা করে না। সে ক্ষেত্রে নিজের তুচ্ছ স্বার্থ পূরণ করাই আসল লক্ষ্যবস্তু হয়ে দাঁড়ায়। এ আয়াত জানাচ্ছে, এ শ্রেণির লোক বড়ই নির্বোধ। বরং তারা এক ধরনের উন্মাদ। যারা প্রকৃত মুমিন-মুসলিম, তাদের এরূপ হওয়া সাজে না। তাদের কর্তব্য সর্বাবস্থায় নিজ শপথ ও অঙ্গীকারে অটল থাকা।
কোনও নেক আমল ও নফল ইবাদত-বন্দেগী শুরু করার পর তা অব্যাহত রাখা উচিত। কেননা শুরু করার দ্বারা এক রকম প্রতিশ্রুতি হয়ে যায় যে, তা অব্যাহত রাখা হবে। আমলটি ছেড়ে দেওয়ার দ্বারা সে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করা হয়। আলোচ্য আয়াতটি তার অর্থের ব্যাপকতা দ্বারা আমাদেরকে সতর্ক করছে যে, তোমরা কোনও ইবাদত-বন্দেগী শুরু করার পর কিছুতেই যেন তা ছেড়ে না দাও। বরং তা নিয়মিত করে যাবে এবং আপন প্রতিশ্রুতি রক্ষায় যত্নবান থাকবে।
আয়াতটির শিক্ষা
ক. প্রত্যেক মুমিনের কর্তব্য সর্বাবস্থায় আপন অঙ্গীকার রক্ষা করা।
খ. অঙ্গীকার ভঙ্গ করা নির্বুদ্ধিতা ও পাগলামি। কোনও মুমিনের পক্ষে এটা সাজে না।
গ. কোনও সৎকর্ম শুরু করার পর তা ছেড়ে দেওয়া কিছুতেই সমীচীন নয়। মুমিন ব্যক্তির কর্তব্য হবে সে সৎকর্ম নিয়মিতভাবে সম্পাদন করতে থাকা।
তিন নং আয়াত
وَلَا يَكُونُوا كَالَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَبَ مِنْ قَبْلُ فَطَالَ عَلَيْهِمُ الْأَمَدُ فَقَسَتْ قُلُوبُهُمْ
অর্থ: এবং তারা তাদের মতো হবে না, যাদেরকে পূর্বে কিতাব দেওয়া হয়েছিল অতঃপর যখন তাদের উপর দিয়ে দীর্ঘকাল অতিক্রান্ত হল, তখন তাদের অন্তর শক্ত হয়ে গেল।(সূরা হাদীদ (৫৭), আয়াত ১৬)
ব্যাখ্যা
অতীত কালের আহলে কিতাব সম্প্রদায় প্রথমদিকে তাদের কিতাবের অনুসরণ করলেও আস্তে আস্তে তারা তা থেকে দূরে সরে পড়ে। তারা কিতাবের হিদায়াত ছেড়ে দিয়ে ক্রমান্বয়ে দুনিয়ার দিকে ধাবিত হতে থাকে। এক পর্যায়ে পুরোপুরি মনের খেয়াল-খুশি পূরণ ও ভোগ-উপভোগের মধ্যে নিমজ্জিত হয়ে পড়ে। এতে করে তাদের মন শক্ত হয়ে যায়। তা এমনই শক্ত হয়ে যায় যে, গুনাহ করার কারণে তাদের অন্তরে কোনওরূপ অনুতাপ ও লজ্জাবোধও হচ্ছিল না। তাদের অন্তরের সে কঠোরতা বর্ণনা করতে গিয়ে আল্লাহ তা'আলা বলেন-
ثُمَّ قَسَتْ قُلُوبُكُمْ مِنْ بَعْدِ ذَلِكَ فَهِيَ كَالْحِجَارَةِ أَوْ أَشَدُّ قَسْوَةً وَإِنَّ مِنَ الْحِجَارَةِ لَمَا يَتَفَجَّرُ مِنْهُ الْأَنْهَارُ وَإِنَّ مِنْهَا لَمَا يَشَّقَّقُ فَيَخْرُجُ مِنْهُ الْمَاءُ وَإِنَّ مِنْهَا لَمَا يَهْبِطُ مِنْ خَشْيَةِ اللَّهِ
‘এসব কিছুর পর তোমাদের অন্তর আবার শক্ত হয়ে গেল, এমনকি তা হয়ে গেল পাথরের মতো; বরং তার চেয়েও বেশি শক্ত। (কেননা) পাথরের মধ্যে কিছু তো এমনও আছে, যা থেকে নদী-নালা প্রবাহিত হয়, তার মধ্যে কিছু এমন আছে যা ফেটে যায় এবং তা থেকে পানি নির্গত হয়, আবার তার মধ্যে এমন (পাথর)-ও আছে, যা আল্লাহর ভয়ে ধ্বসে পড়ে।(সূরা বাকারা (২), আয়াত ৭৪)
আল্লাহ তা'আলা এ উম্মতকে বলছেন, তোমাদের অন্তর যেন তাদের মতো শক্ত না হয়। অন্তর শক্ত হয়ে গেলে তোমরা পুরোপুরিভাবে দুনিয়ার প্রতি ঝুঁকে পড়বে। তখন কোনও ওয়াজ-নসীহত তোমাদের অন্তরে রেখাপাত করবে না। ফলে তোমরা ইবাদত-বন্দেগীতে উৎসাহ পাবে না; বরং তা থেকে সম্পূর্ণ বিমুখ হয়ে পাপাচারে লিপ্ত হয়ে পড়বে আর এভাবে তোমরা দুনিয়া ও আখিরাত সবই হারাবে। এ পরিণতিতে যাতে তোমরা না পৌঁছ, সেজন্য তোমাদের কর্তব্য এখনই ইবাদত-বন্দেগী আঁকড়ে ধরা। যা-কিছু ইবাদত-বন্দেগী তোমরা করছ তার কোনওটিই যাতে ছুটে না যায়, সে বিষয়ে সতর্ক থাকবে। দীনের উপর মজবুত থাকার জন্য ইবাদত-বন্দেগী অব্যাহত রাখা জরুরি। কোনওটি ছুটে গেলে তা পুনরায় শুরু করে দেওয়া চাই। অন্যথায় এক এক করে ছুটতেই থাকবে। পরিণামে সম্পূর্ণরূপে ইবাদতবিমুখ হয়ে যাবে আর এভাবে দিল-মন শক্ত হয়ে তোমরা দুনিয়াদারিতে পুরোপুরি ডুবে যাবে।
আয়াতটির শিক্ষা
ক . অন্তর যাতে শক্ত না হয়ে যায়, সে বিষয়ে আমাদের খুব সচেতন থাকতে হবে।
খ. আল্লাহওয়ালাদের সাহচর্য আঁকড়ে ধরলে মন নরম থাকে। তাই বেশিদিন আল্লাহওয়ালাদের সাহচর্য থেকে দূরে থাকতে নেই।
গ. মন নরম রাখার জন্য ইবাদত-বন্দেগীতে মনোযোগী থাকা জরুরি। তাই কোনও ইবাদত শুরু করার পর তা ছেড়ে দেওয়া উচিত নয়। বরং তা অব্যাহত রাখা এবং ইবাদত-বন্দেগীতে আরও বেশি অগ্রগামী হওয়া বাঞ্ছনীয়।
চার নং আয়াত
فَمَا رَعَوْهَا حَقَّ رِعَايَتِهَا
অর্থ: কিন্তু তারা তা যথাযথভাবে পালন করেনি।(সুরা হাদীদ (৫৭), আয়াত ২৭)
ব্যাখ্যা
এ বাক্যটি সূরা হাদীদের ৭৭ নং আয়াতের অংশবিশেষ। আয়াতটিতে রাহবানিয়্যাত (বৈরাগ্যবাদ) সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। রাহবানিয়্যাত অর্থ বৈরাগ্য তথা দুনিয়ার সব আনন্দ ও বিষয়ভোগ পরিহার করা। হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের পরে খ্রিষ্টসম্প্রদায় এমন এক আশ্রমিক ব্যবস্থার প্রবর্তন করেছিল, যাতে কোনও ব্যক্তি আশ্রমে ঢুকে পড়ার পর সংসারজীবন সম্পূর্ণরূপে বর্জন করত। বিয়ে-শাদী করত না এবং পার্থিব কোনওরকমের স্বাদ ও আনন্দে অংশগ্রহণ করত না। তাদের এই আশ্রমিক ব্যবস্থাকেই 'রাহবানিয়্যাত' বলে।
এ ব্যবস্থার সূচনা হয়েছিল এভাবে যে, হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের অনুসারীদের উপর বিভিন্ন রাজা-বাদশা জুলুম-নির্যাতন চালাতে থাকলে তারা নিজেদের দীন রক্ষার তাগিদে শহরের বাইরে গিয়ে বসবাস শুরু করল, যেখানে জীবনযাপনের সাধারণ সুবিধাসমূহ পাওয়া যেত না। কালক্রমে তাদের কাছে জীবনযাপনের এই কঠিন ব্যবস্থাই এক স্বতন্ত্র ইবাদতের রূপ পরিগ্রহ করে। পরবর্তীকালের লোকেরা জীবনযাপনের উপকরণাদি হস্তগত হওয়া সত্ত্বেও এই মনগড়া ইবাদতের জন্য তা পরিহার করতে থাকল।
আল্লাহ তা'আলা বলছেন-
وَرَهْبَانِيَّةً ابْتَدَعُوهَا مَا كَتَبْنَاهَا عَلَيْهِمْ إِلَّا ابْتِغَاءَ رِضْوَانِ اللَّهِ
‘আর রাহবানিয়্যাতের যে বিষয়টা, তা তারা নিজেরাই উদ্ভাবন করেছিল। আমি তাদের উপর তা বাধ্যতামূলক করিনি। বস্তুত তারা (এর মাধ্যমে) আল্লাহর সন্তুষ্টিবিধানই করতে চেয়েছিল।'
অর্থাৎ আমি তাদেরকে এরূপ কঠিন জীবনযাত্রার নির্দেশ দিইনি। তারা নিজেরাই এর প্রবর্তন করেছিল। তারা এর প্রবর্তন তো করেছিল, কিন্তু পরে তারা এ নিয়ম রক্ষা করতে পারেনি। তারা যে এর থেকে বিচ্যুত হয়ে গিয়েছিল, সে সম্পর্কে আল্লাহ বলছেন- فَمَا رَعَوْهَا حَقَّ رِعَايَتِهَا (কিন্তু তারা তা যথাযথভাবে পালন করেনি)। অর্থাৎ বৈরাগ্যবাদের এ প্রথা প্রথম দিকে তো তারা আল্লাহ তা'আলার সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যেই অবলম্বন করেছিল, কিন্তু পরবর্তীকালে তারা নিজেদের জীবনে এ প্রথা পুরোপুরিভাবে রক্ষা করতে পারেনি। তা রক্ষা করতে না পারার দুটো দিক আছে।
(এক) আল্লাহ তা'আলার বিধান ও নির্দেশের অনুসরণ না করা। কেননা আল্লাহ তা'আলা যে জিনিসকে তাদের জন্য বাধ্যতামূলক করেননি, তারা সেটাকে নিজেদের জন্য বাধ্যতামূলক করে নিল। মনে করল, এরূপ না করলে তাদের একটা মহা ইবাদত ছুটে যাবে। অথচ দীনের মধ্যে নিজেদের পক্ষ থেকে কোনও জিনিসকে এমন জরুরি মনে করা যে, তা না করলে অপরাধ হবে, এটা আল্লাহ তা'আলার নির্দেশের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন ও সম্পূর্ণ নাজায়েয।
(দুই) নিজেদের পক্ষ থেকে প্রবর্তিত বিষয়কে যথাযথরূপে পালন না করা। তারা রাহবানিয়্যাতের যে ব্যবস্থা চালু করেছিল, পরবর্তীকালে কার্যত তার যথাযথ অনুসরণ করতে পারেনি। যেহেতু ব্যবস্থাটাই ছিল স্বভাবের পরিপন্থী, তাই স্বাভাবিকভাবেই মানবপ্রকৃতির সাথে তার সংঘাত দেখা দিল এবং ধীরে ধীরে মানবপ্রকৃতির কাছে তা হেরে গেল। বৈরাগ্য হল বিষয়ভোগ থেকে বিরত থাকা। কিন্তু তারা নানা বাহানায় প্রকাশ্যে বা গোপনে বিষয়ভোগ শুরু করে দিল। সে প্রথায় বিবাহেও নিষেধাজ্ঞা ছিল। কিন্তু তারা এ ক্ষেত্রেও সীমালঙ্ঘন করল। বিবাহ করল না বটে, কিন্তু যৌন সম্ভোগের জন্য তারা ব্যভিচারে লিপ্ত হতে লাগল এবং একসময় তাদের আশ্রমগুলিতে তা মহামারি আকার ধারণ করল। সুতরাং যে উদ্দেশ্যে তারা রাহবানিয়্যাতের প্রবর্তন করেছিল তা পুরোপুরি ব্যর্থ হয়ে গেল।
প্রকৃতপক্ষে ইবাদত হিসেবে কেবল এমন আমলই গ্রহণযোগ্য, যা নবী-রাসূলগণ শিক্ষা দিয়েছেন। এর বাইরে নিজেদের পক্ষ থেকে কোনও রীতি-নীতি বা কোনও প্রথা চালু করলে আপাতদৃষ্টিতে তা যতই সুন্দর মনে হোক না কেন, বাস্তবে তা 'ইবাদত' নামে অভিহিত হওয়ার উপযুক্ত কিছুতেই নয়। বরং তা জায়েযই নয়। এ জাতীয় কাজের পারিভাষিক নাম বিদ'আত। এ জাতীয় কাজ দ্বারা কোনও ছাওয়াব পাওয়া যায় না; বরং তাতে অর্থহীন কষ্টভোগ হয় এবং কোনও ক্ষেত্রে হয় অর্থের অপচয়, সেইসঙ্গে গুনাহ তো আছেই। কাজেই এর থেকে বেঁচে থাকা অবশ্যকর্তব্য। আল্লাহ তা'আলার সন্তুষ্টি লাভ ও ছাওয়াব হাসিলের পথ একটাই, আর তা হচ্ছে শরী'আতের অনুসরণ তথা নবী-রাসূলগণের দেখানো পথে চলা। আমাদের জন্য তা হচ্ছে আখেরী নবী হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নত মোতাবেক জীবনযাপন করা।
আয়াতটির শিক্ষা
ক. আল্লাহ তা'আলার সন্তুষ্টিলাভের একটাই পথ- শরী'আতের অনুসরণ।
খ. আল্লাহ তা'আলার সন্তুষ্টিলাভের উদ্দেশ্যে নিজেদের পক্ষ থেকে কোনও প্রথা বানিয়ে নেওয়া জায়েয নয়। তাতে কোনও ছাওয়াব পাওয়া যায় না; বরং গুনাহ হয়।
গ. কোনও নফল ইবাদত নিয়মিত শুরু করলে তার ধারাবাহিকতা রক্ষা করা চাই।
কোনও নেক আমল শুরু করার পর তা অব্যাহত রাখা
হাদীছ নং: ৬৯১
হযরত আব্দুল্লাহ ইবন আমর ইবনুল আস রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বললেন, হে আব্দুল্লাহ! তুমি অমুকের মতো হয়ো না, যে কিয়ামুল লায়ল করত (অর্থাৎ রাতে জেগে তাহাজ্জুদ পড়ত), পরে কিয়ামুল লায়ল ছেড়ে দিল। -বুখারী ও মুসলিম
(সহীহ বুখারী: ১১৫২; সহীহ মুসলিম: ১১৫৯; সুনানে নাসাঈ ১৭৬৩; সুনানে ইবন মাজাহ: ১৩৩২; মুসনাদে আহমাদ: ৬৫৮৫; মুসনাদুল বাযযার ৩৩৫৮; সহীহ ইবনে হিব্বান ২৬৪১; সহীহ ইবনে খুযায়মা ১১২৯; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা ৪৭১৯; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ: ৯৩৯)
হাদীছ নং: ৬৯১
হযরত আব্দুল্লাহ ইবন আমর ইবনুল আস রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বললেন, হে আব্দুল্লাহ! তুমি অমুকের মতো হয়ো না, যে কিয়ামুল লায়ল করত (অর্থাৎ রাতে জেগে তাহাজ্জুদ পড়ত), পরে কিয়ামুল লায়ল ছেড়ে দিল। -বুখারী ও মুসলিম
(সহীহ বুখারী: ১১৫২; সহীহ মুসলিম: ১১৫৯; সুনানে নাসাঈ ১৭৬৩; সুনানে ইবন মাজাহ: ১৩৩২; মুসনাদে আহমাদ: ৬৫৮৫; মুসনাদুল বাযযার ৩৩৫৮; সহীহ ইবনে হিব্বান ২৬৪১; সহীহ ইবনে খুযায়মা ১১২৯; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা ৪৭১৯; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ: ৯৩৯)
كتاب الأدب
باب المحافظة عَلَى مَا اعتاده من الخير
قَالَ الله تَعَالَى: {إنَّ اللهَ لاَ يُغَيِّرُ مَا بِقَوْمٍ حَتَّى يُغَيِّرُوا مَا بِأنْفُسِهِمْ} [الرعد: 11]، وقال تَعَالَى: {وَلاَ تَكُونُوا كَالَّتِي نقضت غَزْلَهَا مِنْ بَعْدِ قُوَّةٍ أنْكَاثًا} [النحل: 92].
وَ «الأنْكَاثُ»: جَمْعُ نِكْثٍ، وَهُوَ الْغَزْلُ المَنْقُوضُ.
وقال تَعَالَى: {وَلاَ يَكُونُوا كَالَّذِينَ أُوتُوا الكِتَابَ مِنْ قَبْلُ فَطَالَ عَلَيْهِمُ الأَمَدُ فَقَسَتْ قُلُوبُهُمْ} [الحديد: 16]، وقال تَعَالَى: {فَمَا رَعَوْهَا حَقَّ رِعَايَتِهَا} [الحديد: 27].
قَالَ الله تَعَالَى: {إنَّ اللهَ لاَ يُغَيِّرُ مَا بِقَوْمٍ حَتَّى يُغَيِّرُوا مَا بِأنْفُسِهِمْ} [الرعد: 11]، وقال تَعَالَى: {وَلاَ تَكُونُوا كَالَّتِي نقضت غَزْلَهَا مِنْ بَعْدِ قُوَّةٍ أنْكَاثًا} [النحل: 92].
وَ «الأنْكَاثُ»: جَمْعُ نِكْثٍ، وَهُوَ الْغَزْلُ المَنْقُوضُ.
وقال تَعَالَى: {وَلاَ يَكُونُوا كَالَّذِينَ أُوتُوا الكِتَابَ مِنْ قَبْلُ فَطَالَ عَلَيْهِمُ الأَمَدُ فَقَسَتْ قُلُوبُهُمْ} [الحديد: 16]، وقال تَعَالَى: {فَمَا رَعَوْهَا حَقَّ رِعَايَتِهَا} [الحديد: 27].
691 - وعن عبد الله بن عمرو بن العاص رضي الله عنهما، قَالَ: قَالَ لي رسول الله - صلى الله عليه وسلم: «يَا عبْدَ الله، لاَ تَكُنْ مِثْلَ فُلانٍ، كَانَ يَقُومُ اللَّيْلَ فَتَرَكَ قِيَامَ اللَّيْلِ». متفقٌ عَلَيْهِ. (1)
হাদীসের ব্যাখ্যা:
এ হাদীছের মূল বিষয়বস্তু আমলের ধারাবাহিকতা রক্ষায় উৎসাহ দেওয়া। হযরত আব্দুল্লাহ ইবন আমর রাযি. অত্যন্ত ইবাদতগুযার ও যাহেদ প্রকৃতির সাহাবী ছিলেন। রাত জেগে তাহাজ্জুদ পড়া ও কুরআন তিলাওয়াত করা ছিল তাঁর নিয়মিত অভ্যাস। নিঃসন্দেহে এটি অতি বড় মুবারক এক অভ্যাস। তাই নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে এ অভ্যাস ধরে রাখতে উৎসাহ দিচ্ছেন এবং কোনওক্রমেই যাতে ছুটে না যায় তাই সতর্ক করছেন। কেননা কোনও নেক আমল শুরু করার পর তা ছেড়ে দেওয়া পসন্দনীয় নয়। এ অপসন্দনীয় কাজটি কোনও একজনের দ্বারা হয়ে গিয়েছিল। হযরত আব্দুল্লাহ ইবন আমর রাযি. যেন তার মতো কাজ না করে বসেন, তাই তাঁকে সতর্ক করে বলছেন- তুমি অমুকের মতো হয়ো না।
সে অমুক ব্যক্তি কে তা জানা যায় না। সম্ভবত নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার নাম গোপন রাখার উদ্দেশ্যেই এভাবে ইঙ্গিতে কথাটি বলেছেন। এর দ্বারা বোঝা যায়, কারও দ্বারা কোনও ত্রুটিপূর্ণ কাজ হয়ে গেলে লোকসম্মুখে তাকে নিন্দিত করা উচিত নয়। এরূপ লোকের উদাহরণ টেনে যদি কাউকে বোঝানো উদ্দেশ্য হয়, তবে সে ক্ষেত্রে তার নাম উহ্য রেখে কেবল কাজটিই উল্লেখ করতে হবে। কেননা বোঝানোর উদ্দেশ্য তা দ্বারাই হাসিল হয়ে যায়, সেজন্য ব্যক্তির উল্লেখ জরুরি নয়। ব্যক্তির উল্লেখ দ্বারা লোকসম্মুখে তার নিন্দা করা হয়, যা গীবত ও কঠিন গুনাহ। তা থেকে বিরত থাকা অবশ্যকর্তব্য।
যাহোক নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত আব্দুল্লাহ ইবন আমর রাযি -কে তাঁর আমল অব্যাহত রাখতে উৎসাহ দিয়েছেন। কেননা আল্লাহ তা'আলার কাছে ওই আমলই বেশি পসন্দ, যা নিয়মিত করা হয়, যদিও তা পরিমাণে অল্প হয়। এরূপ আমল আল্লাহ তা'আলার কাছে পসন্দ এ কারণে যে, এর দ্বারা আমলকারী ব্যক্তি নিয়মিতভাবে আল্লাহ তা'আলার অভিমুখী থাকে। যেন সে নিয়মিত তাঁর দরবারে হাজিরা দেয়। কিছুদিন সে আমল করার পর যদি ছেড়ে দেওয়া হয়, তবে এর দ্বারা আল্লাহ তা'আলার দরবারে এক রকম অনুপস্থিতি সাব্যস্ত হয়। এটা নিন্দনীয় কাজ। একদম অনুপস্থিত থাকা এক জিনিস। কিন্তু কিছুদিন উপস্থিত থাকার পর আর উপস্থিত না হওয়া সে দরবারের প্রতি অনাগ্রহ ও অনাসক্তি প্রকাশের নামান্তর হয়ে যায়, যা কিছুতেই কাম্য নয়।
তাছাড়া নিয়মিত আমল করার দ্বারা আমলনামায় নিয়মিত ছাওয়াব লেখা হতে থাকে। কিছুদিন করার পর বন্ধ করে দিলে ছাওয়াব লেখাও বন্ধ হয়ে যায়। এটাও কারও কাম্য হওয়া উচিত নয়।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. নফল ইবাদত শুরু করার পর তার ধারাবাহিকতা রক্ষা করা উচিত।
খ. কারও দ্বারা কোনও ত্রুটি না ঘটলেও ভবিষ্যতে যাতে না ঘটে সে ব্যাপারে আগে থেকে তাকে সতর্ক করা যেতে পারে।
গ. কাউকে বোঝানোর জন্য অন্যকে দিয়ে দৃষ্টান্ত দেওয়া যেতে পারে। তবে সে ক্ষেত্রে তার নাম উল্লেখ করা উচিত নয়।
সে অমুক ব্যক্তি কে তা জানা যায় না। সম্ভবত নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার নাম গোপন রাখার উদ্দেশ্যেই এভাবে ইঙ্গিতে কথাটি বলেছেন। এর দ্বারা বোঝা যায়, কারও দ্বারা কোনও ত্রুটিপূর্ণ কাজ হয়ে গেলে লোকসম্মুখে তাকে নিন্দিত করা উচিত নয়। এরূপ লোকের উদাহরণ টেনে যদি কাউকে বোঝানো উদ্দেশ্য হয়, তবে সে ক্ষেত্রে তার নাম উহ্য রেখে কেবল কাজটিই উল্লেখ করতে হবে। কেননা বোঝানোর উদ্দেশ্য তা দ্বারাই হাসিল হয়ে যায়, সেজন্য ব্যক্তির উল্লেখ জরুরি নয়। ব্যক্তির উল্লেখ দ্বারা লোকসম্মুখে তার নিন্দা করা হয়, যা গীবত ও কঠিন গুনাহ। তা থেকে বিরত থাকা অবশ্যকর্তব্য।
যাহোক নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত আব্দুল্লাহ ইবন আমর রাযি -কে তাঁর আমল অব্যাহত রাখতে উৎসাহ দিয়েছেন। কেননা আল্লাহ তা'আলার কাছে ওই আমলই বেশি পসন্দ, যা নিয়মিত করা হয়, যদিও তা পরিমাণে অল্প হয়। এরূপ আমল আল্লাহ তা'আলার কাছে পসন্দ এ কারণে যে, এর দ্বারা আমলকারী ব্যক্তি নিয়মিতভাবে আল্লাহ তা'আলার অভিমুখী থাকে। যেন সে নিয়মিত তাঁর দরবারে হাজিরা দেয়। কিছুদিন সে আমল করার পর যদি ছেড়ে দেওয়া হয়, তবে এর দ্বারা আল্লাহ তা'আলার দরবারে এক রকম অনুপস্থিতি সাব্যস্ত হয়। এটা নিন্দনীয় কাজ। একদম অনুপস্থিত থাকা এক জিনিস। কিন্তু কিছুদিন উপস্থিত থাকার পর আর উপস্থিত না হওয়া সে দরবারের প্রতি অনাগ্রহ ও অনাসক্তি প্রকাশের নামান্তর হয়ে যায়, যা কিছুতেই কাম্য নয়।
তাছাড়া নিয়মিত আমল করার দ্বারা আমলনামায় নিয়মিত ছাওয়াব লেখা হতে থাকে। কিছুদিন করার পর বন্ধ করে দিলে ছাওয়াব লেখাও বন্ধ হয়ে যায়। এটাও কারও কাম্য হওয়া উচিত নয়।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. নফল ইবাদত শুরু করার পর তার ধারাবাহিকতা রক্ষা করা উচিত।
খ. কারও দ্বারা কোনও ত্রুটি না ঘটলেও ভবিষ্যতে যাতে না ঘটে সে ব্যাপারে আগে থেকে তাকে সতর্ক করা যেতে পারে।
গ. কাউকে বোঝানোর জন্য অন্যকে দিয়ে দৃষ্টান্ত দেওয়া যেতে পারে। তবে সে ক্ষেত্রে তার নাম উল্লেখ করা উচিত নয়।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)