রিয়াযুস সালিহীন-ইমাম নববী রহঃ

২. বিবিধ আদব - শিষ্টাচারের অধ্যায়

হাদীস নং: ৬৯৭
বিবিধ আদব - শিষ্টাচারের অধ্যায়
৭ সঙ্গীর যে কথা হারাম নয় অপর সঙ্গীর তা মনোযোগ দিয়ে শ্রবণ করা এবং আলেম ও ওয়ায়েজ কর্তৃক হাযিরীনে মজলিসকে নীরব হতে বলা
হাদীছ নং: ৬৯৭

হযরত জারীর ইবন আব্দুল্লাহ রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, বিদায় হজ্জে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বললেন, লোকদেরকে নীরব হতে বলো। অতঃপর তিনি বলেন, তোমরা যেন আমার পর কুফরীতে লিপ্ত হয়ে না পড় যে, তোমাদের একে অন্যের গর্দান উড়াতে থাকবে। -বুখারী ও মুসলিম
(সহীহ বুখারী: ১২১; সহীহ মুসলিম: ৬৫; সুনানে নাসাঈ ৪১৩১; সুনানে ইবন মাজাহ: ৩৯৪২; মুসনাদে আবু দাউদ তয়ালিসী: ৬৯৯; মুসনাদে আহমাদ: ১৯২৫৯; সুনানে দারিমী: ১৯৬২; নাসাঈ, আস সুনানুল কুবরা ৫৮৫১; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর: ২২৭৭; সহীহ ইবনে হিব্বান: ৫৯৪০)
كتاب الأدب
باب إصغاء الجليس لحديث جليسه الذي ليس بحرام واستنصات العالم والواعظ حاضري مجلسه
697 - عن جرير بن عبدِ اللهِ - رضي الله عنه - قَالَ: قَالَ لي رسول الله - صلى الله عليه وسلم - في حَجَّةِ الْوَدَاعِ: «اسْتَنْصِتِ النَّاسَ» ثُمَّ قَالَ: «لاَ تَرْجِعُوا بَعْدِي كُفّارًا يَضْرِبُ بَعْضُكُمْ رِقَابَ بَعْضٍ». متفقٌ عَلَيْهِ. (1)

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এ হাদীছে বলা হয়েছে, বিদায় হজ্জের দিন নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত জারীর ইবন আব্দুল্লাহ রাযি.-কে আদেশ করেছিলেন- استنْصِتِ النَّاسَ (লোকদেরকে নীরব হতে বলো)। নীরব হতে বলার কারণ তিনি তাদের সামনে গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দেবেন। সে ভাষণে তাদের ব্যক্তিগত, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা থাকবে। তা মনোযোগের সঙ্গে শোনা তাদের জন্য অতীব জরুরি। যাতে পরবর্তীকালে তারা সেই নির্দেশনা অনুযায়ী চলতে পারে।

নবী যখন কোনও নির্দেশনা দেন, তখন তা মনোযোগ সহকারে শ্রবণ করা জরুরি এক তো এ কারণে যে, সে নির্দেশনা দীনের অংশ। তা না শুনলে দীনের একটা অঙ্গই অজানা থেকে যাবে। অথচ প্রত্যেক মুসলিমের জন্য পরিপূর্ণ দীনের অনুসরণ করা জরুরি। দ্বিতীয় কারণ হল নবীর কথা মনোযোগ দিয়ে না শোনা কঠিন বেয়াদবি। যে- কোনও গুরুজনের কথায় অমনোযোগী থাকাকেই বেয়াদবি গণ্য করা হয়। এ অবস্থায় নবীর কথায় অমনোযোগিতা প্রদর্শন কী গুরুতর বেয়াদবি হতে পারে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এ কারণেই তো কুরআন মাজীদে হুকুম করা হয়েছে-
لَا تَرْفَعُوا أَصْوَاتَكُمْ فَوْقَ صَوْتِ النَّبِيِّ
‘নিজের আওয়াজকে নবীর আওয়াজ থেকে উঁচু করো না।' (সূরা হুজুরাত (৪৯), আয়াত ২) অর্থাৎ নীরব থাকো এবং তিনি যা বলেন মনোযোগ দিয়ে শোনো।

সাহাবায়ে কেরাম এরকমই ছিলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন কথা বলতেন, তখন তারা সম্পূর্ণ নীরব হয়ে যেতেন। নিজেদের মধ্যে কোনও কথাবার্তা তো বলতেনই না, এমনকি কোনওরূপ নড়াচড়াও করতেন না। ঠিক স্থাণুর মতো। যেন কোনও পাখি মাথার উপর বসতে চাইলে বসতে পারবে।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এখন নেই। কিন্তু কুরআন ও সুন্নাহ আছে। আছে তাঁর ওয়ারিছ উলামায়ে কেরামও। উলামায়ে কেরাম কুরআনের শিক্ষা প্রচার করেন। তারা সুন্নত জিন্দা করেন। তারা শরী'আতের প্রচার-প্রতিষ্ঠায় ব্যস্ত থাকেন। কাজেই তাদের সম্মান করা ও তাদের প্রতি আদব বজায় রাখা একান্ত জরুরি। তারা যখন কুরআন ও হাদীছ থেকে বয়ান করেন, তখন উপস্থিত শ্রোতাদের নীরবে মনোযোগের সঙ্গে তা শোনা কর্তব্য। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে-
وَإِذَا قُرِئَ الْقُرْآنُ فَاسْتَمِعُوا لَهُ وَأَنْصِتُوا لَعَلَّكُمْ تُرْحَمُونَ (204)
যখন কুরআন পড়া হয় তখন তা মনোযোগ দিয়ে শোনো এবং চুপ থাকো, যাতে তোমাদের প্রতি রহমত হয়। (সূরা আ'রাফ (৭), আয়াত ২০৪)

নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্দেশে উপস্থিত লোকজন নীরব হয়ে গেল। তিনি তাদের সামনে এক গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দেন। দীর্ঘ সে ভাষণের একটি অংশ এ হাদীছে বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেন-
لَا تَرْجَعُوْا بَعْدِي كُفَّارًا يَضْرِبُ بَعْضُكُمْ رِقَابَ بَعْضٍ (তোমরা যেন আমার পর কুফরীতে লিপ্ত হয়ে না পড় যে, তোমাদের একে অন্যের গর্দান উড়াতে থাকবে)। এর দুটি অর্থ হতে পারে।

ক. তোমরা আমার পরে মুরতাদ হয়ে যেয়ো না। অর্থাৎ বাস্তবিকই ইসলাম পরিত্যাগ করে কুফরী ধর্মের দিকে ফিরে যেয়ো না, যার পরিণামে জাহিলী যুগের মতো পরস্পরে মারামারি ও খুনোখুনিতে লিপ্ত হবে এবং অন্যায়ভাবে একে অন্যের গর্দান উড়িয়ে দেবে।

খ. অথবা এর অর্থ- তোমরা কাফেরদের মতো হয়ে যেয়ো না, যাদের কাছে মানুষের জান-মালের কোনও মূল্য নেই। ফলে তোমরা অন্যায়ভাবে একে অন্যকে হত্যা করবে এবং তুচ্ছ তুচ্ছ কারণে পরস্পরে খুনোখুনিতে লিপ্ত হবে। বাস্তবিকপক্ষে অন্যায় রক্তপাত কাফেরদেরই কাজ। এটা মু'মিনদের কাজ হতে পারে না। মু'মিনদের কাজ তো অন্যের জান-মালের নিরাপত্তা বিধান করা। সুতরাং তোমরা যদি আমার পর আত্মকলহে লিপ্ত হও এবং অন্যায়ভাবে একে অন্যকে হত্যা কর, তবে তা কাফেরদের মতো কাজই হবে। এরকম কাজ তোমরা ইসলাম গ্রহণের আগে জাহিলী যুগে করতে। সাবধান! আমার পরে তোমরা ওইরকম কাজের দিকে ফিরে যেয়ো না। তোমরা যেহেতু মুমিন, আর ঈমানের দাবি হল অন্যের জান, মাল ও ইজ্জতের নিরাপত্তা রক্ষা করা, তাই তোমরা সেদিকেই মনোযোগী থাকবে। মনে فَإِنَّ دِمَاءَكُمْ وَأَمْوَالَكُمْ وَأَعْرَاضَكُمْ عَلَيْكُمْ حَرَامٌ তোমাদের রক্ত, তোমাদের ধন-সম্পদ এবং তোমাদের মান-সম্মানও তোমাদের জন্য মর্যাদাপূর্ণ (যা ক্ষুণ্ণ করা হারাম)'। কাজেই এর বিপরীত কাজ কিছুতেই করবে না। তোমরা ঈমানের উপর মজবুত থাকবে এবং নিজেদের সম্প্রীতি ও ভ্রাতৃত্ব অটুট রাখবে।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি ভক্তি-ভালোবাসার দাবিতে তাঁর ওয়ারিছদের প্রতিও ভক্তি-ভালোবাসা বজায় রাখা উচিত। সুতরাং তারা যখন কুরআন-হাদীছ থেকে আলোচনা করেন, তখন নীরবে মনোযোগ সহকারে তা শুনতে হবে।

খ. মুমিনদের পরস্পরে ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখা ঈমানের দাবি। একের সঙ্গে অন্যের মারামারি ও হানাহানিতে লিপ্ত হওয়া সম্পূর্ণ নাজায়েয ও ঈমানের দাবির পরিপন্থী কাজ।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:বিশুদ্ধ (পারিভাষিক সহীহ)