রিয়াযুস সালিহীন-ইমাম নববী রহঃ

২. বিবিধ আদব - শিষ্টাচারের অধ্যায়

হাদীস নং: ৬৯৮
বিবিধ আদব - শিষ্টাচারের অধ্যায়
ওয়াজ-নসীহত করা ও তাতে মধ্যপন্থা রক্ষা

ওয়াজ ও নসীহত করা একটি মহান কাজ। মৌলিকভাবে এটা ছিল নবী-রাসূলগণের দায়িত্ব। পরবর্তীতে তাঁদের প্রতিনিধি হিসেবে উলামায়ে কেরাম এ দায়িত্ব পালন করে থাকেন। এ কাজের উদ্দেশ্য অনেক মহৎ। এর দ্বারা মানুষকে আল্লাহর দিকে ডাকা হয়। আল্লাহর বান্দাকে আল্লাহর সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। সুতরাং এটি অনেক বড় দায়িত্বশীল কাজ। দায়িত্বশীলতার সঙ্গেই এটা আঞ্জাম দেওয়া উচিত। কীভাবে এ দায়িত্ব পালন করতে হবে, তার নির্দেশনা পাওয়া যায় নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওয়াজ-নসীহতের ভেতর। তাঁর ওয়াজ-নসীহতের মধ্যে দৃষ্টিপাত করলে এর বিভিন্ন আদব-কায়দা ও রীতি-নীতি খুঁজে পাওয়া যায়। তার মধ্যে একটা হল মধ্যপন্থা। মধ্যপন্থারও বিভিন্ন দিক আছে। এ পরিচ্ছেদে বিশেষভাবে পরিমাণগত মধ্যপন্থা সম্পর্কে আলোচনা করা উদ্দেশ্য। অর্থাৎ ওয়াজ যেন অতি সংক্ষেপও না হয় এবং খুব বেশি লম্বাও না হয়। বরং মাঝামাঝি পরিমাণে হয়। অতি সংক্ষেপ হলে বিষয়বস্তু পরিষ্কার হয় না। শ্রোতা ভালোভাবে বুঝতে পারে না বক্তা তার উদ্দেশ্যে কী বলেছে। ফলে ওয়াজের উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়। আবার বেশি লম্বা হলেও শ্রোতা বিরক্ত হয়ে যায়। বিরক্তির সঙ্গে যে বয়ান শোনা হয়, তা অন্তরে রেখাপাত করে না। ফলে শ্রোতা সে ওয়াজ দ্বারা আমলে উজ্জীবিত হয় না। তাছাড়া বেশি লম্বা-চওড়া হওয়ার কারণে সব কথা মনেও থাকে না। এটাও ওয়াজের উদ্দেশ্যকে নস্যাৎ করে। সুতরাং মধ্যপন্থাই শ্রেয়। হাদীছেও এর প্রতি উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেও যে ওয়াজ-নসীহত করতেন, তা মাঝামাঝি পরিমাণই হত। হযরত জাবির ইবন সামুরা রাযি. বলেন-
كُنتُ أصَلِّي مَعَ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ، فَكَانَتْ صَلَاتُهُ قَصْدًا، وَخُطْبَتُهُ قَصْدًا
‘আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পেছনে নামায পড়তাম। তাঁর নামায হতো মধ্যম পরিমাণে এবং তাঁর ভাষণও হতো মধ্যম পরিমাণে।’(সহীহ মুসলিম : ৮৬৬; জামে' তিরমিযী: ৫০৭; সুনানে আবূ দাউদ: ১১০১; সুনানে নাসাঈ : ১৫৮২; মুসনাদুল বাযযার: ৪২৫৩; সহীহ ইবনে হিব্বান: ২৮০২; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা : ৫৭৬১; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর: ১৯৮৪; মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাক : ৫২৫৬; মুসান্নাফে ইবন আবী শায়বা: ৪৬৫৫; সুনানে দারিমী: ১৫৯৮; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ: ১০৭৪)

অপর এক হাদীছে আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-
أُمِرْتُ ، أَنْ أَتَجَوَّزَ فِي الْقَوْلِ، فَإِنَّ الْجَوَازَ هُوَ خَيْرٌ
আমাকে আদেশ করা হয়েছে যেন কথায় মধ্যপন্থা অবলম্বন করি। মধ্যপন্থাই শ্রেষ্ঠ।(সুনানে আবু দাউদ: ৫০০৮; বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান: ৪৬২১)
রিয়াযুস সালিহীনের বর্তমান এ পরিচ্ছেদটি সে সম্পর্কেই। এতে যে আয়াত ও হাদীছ উল্লেখ করা হয়েছে, তা ওয়াজ-নসীহতে মধ্যমপন্থা অবলম্বনের নির্দেশনা দেয়। আমরা সেসব আয়াত ও হাদীছের বঙ্গানুবাদ ও ব্যাখ্যা পেশ করছি। আল্লাহ তা'আলাই তাওফীকদাতা।


‘ওয়াজ-নসীহত করা ও তাতে মধ্যপন্থা রক্ষা’ সম্পর্কিত একটি আয়াত

ادْعُ إِلَى سَبِيلِ رَبِّكَ بِالْحِكْمَةِ وَالْمَوْعِظَةِ الْحَسَنَةِ
অর্থ: তুমি নিজ প্রতিপালকের পথে মানুষকে ডাকবে হিকমত ও সদুপদেশের মাধ্যমে।(সূরা নাহল (১৬), আয়াত ১২৫)

ব্যাখ্যা
এ আয়াতে দাওয়াত ও তাবলীগের অতি গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতি বর্ণিত হয়েছে। এ বাক্যটি আয়াতটির অংশবিশেষ। এর পরে আছে-
وَجَادِلْهُمْ بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ إِنَّ رَبَّكَ هُوَ أَعْلَمُ بِمَنْ ضَلَّ عَنْ سَبِيلِهِ وَهُوَ أَعْلَمُ بِالْمُهْتَدِينَ
‘আর (যদি কখনও বিতর্কের দরকার পড়ে, তবে) তাদের সাথে বিতর্ক করবে উৎকৃষ্ট পন্থায়। নিশ্চয়ই তোমার প্রতিপালক যারা তার পথ থেকে বিচ্যুত হয়েছে তাদের সম্পর্কে ভালোভাবেই জানেন এবং তিনি তাদের সম্পর্কেও পরিপূর্ণ জ্ঞাত, যারা সৎপথে প্রতিষ্ঠিত।’

দাওয়াতের তিনটি মূলনীতি
এ আয়াতে দাওয়াত ও তাবলীগের তিনটি মূলনীতি শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। তা হল- (ক) হিকমত (খ) সদুপদেশ ও (গ) উৎকৃষ্ট পন্থায় বিতর্ক।
হিকমতের মর্ম হল- সত্য-সঠিক বিষয়বস্তু অকাট্য দলীল-প্রমাণের মাধ্যমে স্থান- কাল-পাত্র বিবেচনায় রেখে উপস্থাপন করা। বিখ্যাত তাফসীরগ্রন্থ ‘আল-বাহরুল মুহীত’ -এ বলা হয়েছে-
إِنَّهَا الْكَلَامُ الصَّوَابُ الْوَاقِعُ مِنَ النَّفْسِ أَجْمَلَ مَوْقِع
‘হিকমত বলা হয় এমন সঠিক কথাকে, যা মানুষের অন্তরে চমৎকার রেখাপাত করে।'
এ ব্যাখ্যাটি অতি সুন্দর ও ব্যাপক অর্থবোধক। এর সারকথা হচ্ছে, আল্লাহর পথে ডাকতে হবে কুরআন মাজীদ, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীছ এবং অকাট্য দলীল-প্রমাণ দ্বারা। সেইসঙ্গে স্থান-কাল-পাত্রও বিবেচ্য। যাকে ডাকা হবে তার মর্যাদার দিকে লক্ষ রাখতে হবে। যেখানে শক্ত কথা বলার প্রয়োজন সেখানে শক্ত কথা বলা এবং যেখানে নরম কথা বলা দরকার সেখানে নরম কথা বলাও দাওয়াত ফলপ্রসূ হওয়ার পক্ষে সহায়ক। তাছাড়া যেখানে আড়ালে দাওয়াত দেওয়া প্রয়োজন সেখানে আড়ালে দেওয়া এবং যেখানে প্রকাশ্যে দেওয়া প্রয়োজন সেখানে প্রকাশ্যে দেওয়াও হিকমতের অন্তর্ভুক্ত।
এমনিভাবে এদিকেও লক্ষ রাখা জরুরি যাতে দাওয়াতের বক্তব্য পরিমিত হয়। যতটুকু কথা বলা দরকার তার বেশিও না হয় কমও না হয়। কম হলে শ্রোতা দাওয়াতের বিষয়বস্তু ভালোভাবে বুঝতে পারবে না। ফলে তার পক্ষে তা বিবেচনা করাও সম্ভব হবে না। এ অবস্থায় সে যে তা গ্রহণ করবে এমন আশা কীভাবে করা যায়? অন্যদিকে বক্তব্য প্রয়োজনের অতিরিক্ত লম্বা হলে তা শ্রোতার অন্তরে বিরক্তি সৃষ্টি করে। এরূপ ক্ষেত্রে শ্রোতা দাওয়াতদাতাকে আপন করে নেওয়ার বদলে তার কাছ থেকে মুক্তি পাওয়ার চেষ্টা করে। ফলে দাওয়াতের সবটা চেষ্টা পণ্ডশ্রমে পরিণত হয়। কাজেই হিকমতের দাবি হল দাওয়াতদাতা মাত্রাজ্ঞানের পরিচয় দেবে এবং তার দাওয়াতী বক্তব্য যাতে পরিমাণমতো হয় সেদিকে লক্ষ রাখবে।
সদুপদেশের অর্থ- যাকে দাওয়াত দেওয়া হবে তার কল্যাণ কামনার্থে হৃদয়গ্রাহী ভাষায় তাকে বোঝানোর চেষ্টা করা, যাতে তার মনে নম্রতা আসে এবং দাওয়াত গ্রহণের জন্য সে প্রস্তুত হয়ে যায়। এ ক্ষেত্রে তার মান-সম্মানের প্রতি লক্ষ রাখাও জরুরি। এমন কথা বলা কিছুতেই সমীচীন নয়, যা দ্বারা তার মান-সম্মানে আঘাত লাগতে পারে বা অন্য কোনওভাবে সে আহত হতে পারে। কেননা ‘মাওইযা’ (الْموْعِظَة) শব্দটির মূল অর্থের মধ্যে কল্যাণকামিতার একটি দিকও আছে। কাজেই উপদেশ এমনভাবে দেওয়া চাই, যাতে ব্যক্তি মনে করে উপদেশদাতা আমার একজন হিতাকাঙ্ক্ষী; আমার শত্রু নয়। তার উপদেশ আমার গ্রহণ করা উচিত। সুতরাং দাওয়াত দিতে গিয়ে যদি তার পক্ষে অসম্মানজনক বা অপ্রীতিকর কোনও শব্দ ব্যবহার করা হয় বা সেরকম কোনও ভাবভঙ্গি অবলম্বন করা হয়, তবে তাতে নসীহত কেবল ব্যর্থই হয় না; বরং উল্টো ফল ফলে। যাদেরকে দাওয়াত দেওয়া হয় তারা সম্পূর্ণ বিগড়ে যায়। পরবর্তীতে অন্য কারও উপদেশেও তারা কর্ণপাত করতে চায় না। এজন্যই মাওইযার সাথে ‘হাসানা’ বিশেষণটি ব্যবহার করা হয়েছে। বোঝানো উদ্দেশ্য, নসীহত যেন অবশ্যই উত্তম পন্থায় হয় এবং যা-কিছু নসীহত গ্রহণের পক্ষে বাধা তা এড়িয়ে চলা হয়।
আর উৎকৃষ্ট পন্থায় বিতর্ক করার অর্থ সত্য প্রতিষ্ঠা করা ও প্রতিপক্ষকে তা বোঝানোর নিয়তে সত্যনিষ্ঠার সাথে ভদ্রোচিত ভাষায় যথোপযুক্ত যুক্তি-তর্ক ও দলীল-প্রমাণ পেশ করা, প্রতিপক্ষের মনে আঘাত লাগতে পারে বা জেদ সৃষ্টি হতে পারে এ জাতীয় আচরণ পরিহার করা এবং সর্বাবস্থায় মাত্রাবোধ ও ন্যায়-ইনসাফের পরিচয় দেওয়া।
উদ্দেশ্য যখন মানুষের সামনে সত্য প্রতিষ্ঠিত করা এবং তাদেরকে সত্যগ্রহণে উৎসাহিত করা, তখন বিতর্কের পন্থা অবশ্যই ন্যায়নিষ্ঠ হওয়া উচিত এবং হওয়া উচিত হৃদয়গ্রাহী। আল্লাহ তা'আলা তো হযরত মূসা আলাইহিস-সালামের মতো জালীলুল-কদর নবীকে ফির‘আউনের মতো মহাপাপিষ্ঠ ব্যক্তির সামনে নম্র পন্থায় দাওয়াত পেশের হুকুম দিয়েছেন। ইরশাদ হয়েছে-
فَقُولَا لَهُ قَوْلًا لَيِّنًا لَعَلَّهُ يَتَذَكَّرُ أَوْ يَخْشَى (44)
‘তোমরা গিয়ে তার সাথে নম্র কথা বলবে। হয়তো সে উপদেশ গ্রহণ করবে অথবা (আল্লাহকে) ভয় করবে।’(সূরা তোয়াহা (২০), আয়াত ৪৪)
এমনিভাবে আহলে কিতাবের সঙ্গে বিতর্ক করা সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে-
وَلَا تُجَادِلُوا أَهْلَ الْكِتَابِ إِلَّا بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ
‘(হে মুসলিমগণ!) কিতাবীদের সাথে বিতর্ক করবে না উত্তম পন্থা ছাড়া।’(সূরা আনকাবূত (২৯), আয়াত ৪৬)
দীন ও শরী'আত সম্পর্কিত কোনও বিষয়ে বিতর্কের উদ্দেশ্য কেবলই দীন ও শরী'আতের সত্যতা ও শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করা, নিজ যোগ্যতা ও শ্রেষ্ঠত্ব জাহির করা নয়। তা জাহিরের চেষ্টা অহমিকার লক্ষণ ও সম্পূর্ণ নাজায়েয।
মোটকথা, আল্লাহর পথে ডাকার জন্য দা'ঈকে কুরআন মাজীদে বর্ণিত এ তিনটি মূলনীতি অবশ্যই অনুসরণ করতে হবে। দাওয়াত দেওয়া একটি উচ্চস্তরের দীনী কাজ। যে-কোনও দীনী কাজ কুরআন-হাদীছে বর্ণিত পন্থায় করাই বাঞ্ছনীয়। সেভাবে করলেই কৃতকার্যতা লাভের আশা থাকে। অন্যথায় সব মেহনত বৃথা যায়। আল্লাহ তা'আলা আমাদের সকলকে দা'ঈ হিসেবে কবুল করুন এবং তাঁর দেখানো পন্থায় দাওয়াতী মেহনতের তাওফীক দিন।

আয়াতটির শিক্ষা
ক. আপন আপন সামর্থ্য অনুযায়ী দীনী দাওয়াতের কাজ করে যাওয়া প্রত্যেক মুমিনের কর্তব্য।
খ. দাওয়াতদাতার অন্তরে ইখলাস থাকা জরুরি, যাতে তার দাওয়াত সত্যিই আল্লাহর দিকে হয়; নিজ যোগ্যতা ও দক্ষতার দিকে মানুষকে আকর্ষণ করা উদ্দেশ্য না হয়।
গ. দাওয়াতের কাজে হিকমত ও যথাযথ কৌশল অবলম্বন করা জরুরি। মধ্যপন্থা রক্ষা ও পরিমিতিবোধের পরিচয় দেওয়াও সে হিকমতের অংশ।
ঘ. দাওয়াত যেন অবশ্যই সদুপদেশের সঙ্গে হয়, কিছুতেই যেন কারও মনে আঘাত করা না হয় এবং অন্যকে ছোট করে নিজ বড়ত্ব জাহির করা না হয়, সেদিকে লক্ষ রাখা একান্ত জরুরি।
শিক্ষাদান ও ওয়াজ-নসীহতে মাঝে মাঝে বিরতি দেওয়া
হাদীছ নং: ৬৯৮

আবু ওয়াইল শাকীক ইবন সালামা রহ. বলেন, ইবন মাস‘উদ রাযি. প্রতি বৃহস্পতিবার আমাদেরকে নসীহত করতেন। (একদিন) এক ব্যক্তি বলল, হে আবূ আব্দুর রহমান! আমার বড় কামনা আপনি প্রতিদিন আমাদের নসীহত করুন। তিনি বললেন, শোনো হে! তাতে আমার বাধা এটাই যে, আমি তোমাদেরকে বিরক্ত করতে অপসন্দ করি। আমি তোমাদেরকে নসীহত করার জন্য উপযুক্ত সময়ের সন্ধান করি, যেমন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে নসীহত করার জন্য উপযুক্ত সময়ের সন্ধান করতেন- আমাদের বিরক্ত হয়ে পড়ার আশঙ্কায়। -বুখারী ও মুসলিম
(সহীহ বুখারী: ৭০; সহীহ মুসলিম: ২৮২১; জামে' তিরমিযী: ২৮৫৫; মুসনাদে আহমাদ: ৩৫৮২; মুসনাদে আবু দাউদ তয়ালিসী ২৫৩; মুসনাদুল হুমায়দী: ১০৭; মুসান্নাফে ইবন আবী শায়বা : ২৬৫১৫; মুসনাদুল বাযযার: ১৬৭০; নাসাঈ, আস সুনানুল কুবরা : ৫৮৫৮; মুসনাদে আবূ ইয়া'লা: ৫০৩২)
كتاب الأدب
بابُ الوَعظ والاقتصاد فِيهِ
قَالَ الله تَعَالَى: {ادْعُ إِلَى سَبيلِ رَبِّكَ بالحِكْمَةِ وَالْمَوْعِظَةِ الْحَسَنَةِ} [النحل: 125].
698 - وعن أَبي وائلٍ شقيقِ بن سَلَمَةَ، قَالَ: كَانَ ابنُ مَسْعُودٍ - رضي الله عنه - يُذَكِّرُنَا في كُلِّ خَمِيسٍ، فَقَالَ لَهُ رَجُلٌ: يَا أَبَا عَبْدِ الرَّحْمنِ، لَوَدِدْتُ أنَّكَ ذَكَّرْتَنَا كُلَّ يَوْمٍ، فَقَالَ: أمَا إنَّهُ يَمْنَعُنِي مِنْ ذَلِكَ أنَّي أكْرَهُ أَنْ أُمِلَّكُمْ، وَإنِّي أتَخَوَّلُكُمْ بِالْمَوْعِظَةِ، كَمَا كَانَ رسول الله - صلى الله عليه وسلم - يَتَخَوَّلُنَا بِهَا مَخَافَةَ السَّآمَةِ عَلَيْنَا. متفقٌ عَلَيْهِ. (1)
«يَتَخَوَّلُنَا»: يَتَعَهَّدُنَا.

হাদীসের ব্যাখ্যা:

হযরত আব্দুল্লাহ ইবন মাস‘উদ রাযি. একজন শীর্ষস্থানীয় সাহাবী এবং তাঁদের মধ্যে যারা বিশিষ্ট আলেম ও ফকীহ ছিলেন তাদের একজন। তিনি নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ছিলেন। ছিলেন তাঁর খাস খাদেম। জীবনভর তাঁর কাছ থেকে দীনের শিক্ষা গ্রহণ করেছেন। তাঁর ওফাতের পর তিনি অকৃপণভাবে সে শিক্ষার বিতরণে মশগুল থেকেছেন। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মতো তিনিও ছিলেন একজন মহান শিক্ষক। গভীর আন্তরিকতা ও যত্নের সঙ্গে শিষ্যবর্গকে শিক্ষাদান করতেন। তিনি শিক্ষাদানের ক্ষেত্রেও নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদর্শ ও নীতি অনুসরণ করতেন। তার একটা পরিচয় এ হাদীছ দ্বারাও পাওয়া যায়। তাঁর খুব কাছের ছাত্রদের একজন হলেন আবু ওয়াইল শাকীক ইবন সালামা। তিনি জানাচ্ছেন, হযরত ইবনে মাসউদ রাযি. তাদেরকে সপ্তাহে একদিন নসীহত করতেন। প্রতি বৃহস্পতিবার।

প্রকাশ থাকে যে, হযরত ইবনে মাস‘উদ রাযি.-এর সে নসীহত প্রচলিত অর্থের বয়ান-বক্তব্য হতো না। বরং তা ছিল যথারীতি কুরআন-হাদীছের শিক্ষাদান। তিনি ছিলেন শিক্ষক এবং শ্রোতাবর্গ শিক্ষার্থী। শিক্ষার্থীগণ তাঁর গভীর পাণ্ডিত্য ও আন্তরিকতার কারণে প্রতিদিনই তাঁর কাছে শিক্ষাগ্রহণ করতে চাইতেন। একদিন তারা তাঁর কাছে নিজেদের মনের সে আগ্রহের কথা প্রকাশই করে ফেললেন। এর উত্তরে তিনি বললেন-
أما إنَّه يَمْنَعُنِي مِن ذلكَ أنِّي أكْرَهُ أنْ أُمِلَّكُمْ (শোনো হে! তাতে আমার বাধা এটাই যে, আমি তোমাদেরকে বিরক্ত করতে অপসন্দ করি)। অর্থাৎ আমি চাই না প্রতিদিন এ শিক্ষা মজলিসে হাজির হতে হতে তোমরা ক্লান্ত হয়ে পড় আর এক পর্যায়ে বিরক্ত হয়ে আসা ছেড়েই দাও। দীনের শিক্ষা আল্লাহ তা'আলার অনেক বড় নি'আমত। এ নি'আমতের গ্রহণ অব্যাহত রাখাই কাম্য। কোনও অবস্থায়ই ছেড়ে দেওয়া উচিত নয়। আর এ নি'আমত গ্রহণও করা উচিত আগ্রহের সঙ্গে। বিরক্তির সঙ্গে নয়। বিরক্ত হওয়াটা এ শিক্ষার সঙ্গে এক রকম বেয়াদবি। তাই শিক্ষকেরই লক্ষ রাখা উচিত যাতে তার শিক্ষার্থী শিক্ষাগ্রহণের প্রতি কোনওক্রমেই বিরক্ত ও নিরুৎসাহ না হয়ে পড়ে।

হযরত আব্দুল্লাহ ইবন মাস'উদ রাযি. পরিষ্কার করে দিয়েছেন যে, শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে মাঝে মাঝে বিরতি দেওয়ার এই যে নিয়ম তিনি অবলম্বন করেন, এটা তাঁর মনগড়া নয়। বরং এটা তিনি নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছ থেকেই পেয়েছেন এবং তিনি এ ক্ষেত্রে তাঁরই অনুসরণ করছেন। সুতরাং তিনি বলেন-
وَإِنِّي أَتَخَوَّلُكُمْ بِالْمَوْعِظَةِ، كَمَا كَانَ رَسُوْلُ اللهِ ﷺ يَتَخَوَّلُنَا بِهَا مَخَافَةَ السَّامَةِ عَلَيْنَا
(আমি তোমাদেরকে নসীহত করার জন্য উপযুক্ত সময়ের সন্ধান করি, যেমন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে নসীহত করার জন্য উপযুক্ত সময়ের সন্ধান করতেন- আমাদের বিরক্ত হয়ে পড়ার আশঙ্কায়)। يَتَخَوَّلُنَا শব্দটিকে তিনভাবে পড়া হয়েছে। এক তো خ এর সঙ্গে, এখানে যেমনটা আছে। দ্বিতীয় হল خ এর পরিবর্তে ح এর সঙ্গে يَتَحَوَّلُنَا । আর তৃতীয় হল خ এর সঙ্গেই, তবে শেষে ل এর স্থানে ن অর্থাৎ ا يَتَخَوَّنُنَا

يَتَحَوَّلُ এর মাসদার হল التَّحَوُّلُ। এর অর্থ تَفَقّدُ الْأَحْوَالِ । অর্থাৎ তিনি তাদের অবস্থা খতিয়ে দেখতেন। যখন তাদের মধ্যে উপদেশ শোনার আগ্রহ-উদ্দীপনা থাকত, তখন উপদেশ দিতেন। তবে তারা যাতে বিরক্ত হয়ে না পড়ে, সেজন্য খুব লম্বা-চওড়া নসীহত করতেন না।

يَتَخَوَّنُ এর মাসদার হল اَلتَّخَوُّنُ। এর অর্থও اَلتَّعَهدُ। ইমাম আসমা‘ঈ রহ, শব্দটিকে এভাবেই পড়তেন। মাজমা'উল গারাইব গ্রন্থে আছে, ইমাম আসমা'ঈ রহ. বলেন, আমার ধারণা শব্দটি হবে يَتَخَوَّلُ) يَتَخَوَّنُ নয়)। একবার ইমাম আ‘মাশ রহ. এ হাদীছটি يَتَخَوَّلُ এর সঙ্গে বর্ণনা করলে আবূ আমর ইবনুল ‘আলা রহ. আপত্তি করেন এবং বলেন, শব্দটি হবে يَتَخَوَّنُ। কিন্তু হাদীছটি তিনি তাঁর উস্তাযবর্গের নিকট যেহেতু এভাবেই শুনেছেন, তাই তিনি সে আপত্তি গ্রহণ করেননি। প্রকৃতপক্ষে উভয় শব্দই সহীহ। তবে সাধারণভাবে এটি يَتَخَوَّلُ রূপেই বেশি বর্ণিত।

يَتَخَوَّلُ এর মাসদার (ক্রিয়ামূল) হল اَلتَّخَوُّلُ। এর অর্থ اَلتَّعَهدُ (লক্ষ রাখা, যত্ন নেওয়া, পরিচর্যা করা, তদারকি করা, পরিচালনা করা, সম্পাদন করা)। বলা হয়, خَالَ المَالَ 'সে তার সম্পদের পরিচর্যা করল এবং তার উত্তম বন্দোবস্ত করল'। সুতরাং শব্দটি দ্বারা এ হাদীছে বোঝানো হচ্ছে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবায়ে কেরামের প্রতি লক্ষ রাখতেন। তাদের দীনী জীবন গঠনের প্রতি বিশেষ যত্ন নিতেন। তিনি তাদের উত্তম পরিচালনা করতেন। সে হিসেবে শিক্ষাদান ও উপদেশ দেওয়ার ক্ষেত্রেও তিনি লক্ষ রাখতেন যাতে তা দ্বারা তাদেরকে উত্তমরূপে গঠন করা যায়। আর সে লক্ষ্যে তিনি প্রতিদিন শিক্ষাদান করতেন না এবং উপর্যুপরি উপদেশও দিতেন না। বরং সময়-সুযোগ ও পরিবেশ-পরিস্থিতির প্রতি লক্ষ রাখতেন এবং যখন যা শিক্ষা দেওয়ার বা যখন যে উপদেশ দেওয়ার তা দিতেন।

এটা প্রতিদিন করলে এ আশঙ্কা ছিল যে, তারা বিরক্ত হয়ে পড়বেন। ফলে আগ্রহের সঙ্গে তা গ্রহণ করবেন না। আর এতে করে তাদেরকে উত্তমরূপে গড়ে তোলার যে উদ্দেশ্য ছিল তাও সফল হবে না। উল্টো শুধু শুধুই তাদেরকে কষ্ট দেওয়া হবে। একজন মহান শিক্ষকরূপে তিনি তা পসন্দ করতেন না। কুরআন মাজীদে তাঁর চরিত্র সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে-
عَزِيزٌ عَلَيْهِ مَا عَنِتُّمْ حَرِيصٌ عَلَيْكُمْ بِالْمُؤْمِنِينَ رَءُوفٌ رَحِيمٌ
‘তোমাদের যে-কোনও কষ্ট তার জন্য অতি পীড়াদায়ক। সে সতত তোমাদের কল্যাণকামী, মুমিনদের প্রতি অত্যন্ত সদয়, পরম দয়ালু।’ (সূরা তাওবা (৯), আয়াত ১২৮)

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. শিক্ষার্থী যাতে শিক্ষাগ্রহণে উৎসাহ না হারায়, সেদিকে লক্ষ রাখাও একজন শিক্ষকের দায়িত্ব। সুতরাং যে আচরণ ও কর্মপন্থা তাদের উৎসাহ ক্ষুণ্ণ করতে পারে, শিক্ষককে অবশ্যই তা থেকে বিরত থাকতে হবে।

খ. শ্রোতা যতটুকু বুঝতে ও মনে রাখতে সক্ষম হবে, সেদিকে লক্ষ রেখেই ওয়াজ-নসীহত করা উচিত।

গ. শিক্ষক ও ওয়াজ-নসীহতকারীর বিচক্ষণতা ও দুরদর্শীতারও পরিচয় দেওয়া উচিত। কাজেই আপাতদৃষ্টিতে ভালো মনে হয় বলেই শিক্ষার্থীর যে-কোনও আবেদন গ্রহণ করে নেওয়া ঠিক নয়। কেননা আখেরে তা ক্ষতিকরও হতে পারে।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:বিশুদ্ধ (পারিভাষিক সহীহ)