মুসনাদে আহমদ- ইমাম আহমদ রহঃ (আল-ফাতহুর রব্বানী)

১. একত্ববাদ ও দীনের মূল ভিত্তিসমূহের আলোচনা

হাদীস নং: ১৩
আন্তর্জাতিক নং: ২১৫১৬
একত্ববাদ ও দীনের মূল ভিত্তিসমূহের আলোচনা
(২) পরিচ্ছেদঃ আল্লাহ মাহাত্ম্য, পরম শক্তি ও তাঁর প্রতি সৃষ্টির নির্ভরশীলতা প্রসঙ্গে
(১৩) আবূ যর (রা) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন, আমি এমন কিছু দেখতে পাই যা তোমরা দেখতে পাও না, এবং এমন কিছু শুনতে পাই, যা তোমরা শুনতে পাও না।(আমি দেখতে ও শ্রবণ করতে পাই যে,) আকাশ ফিরিশতাদের পদচারণায় ভারাক্রান্ত।তার ভারাক্রান্ত হওয়াই উচিত।সেখানে চার আঙ্গুল পরিমাণ এমন কোন স্থান নেই, যেখানে একজন করে সিজদারত ফিরিশতা নেই।আমি যা জানি, তা যদি তোমরা জানতে, তবে তোমরা হাসতে কম কাঁদতে বেশী, আর বিছানার উপরে (আরাম করে) নারী সম্ভোগে সময় কাটাতে না; এবং অবশ্যই গ্রহ থেকে বের হয়ে সুউচ্চ রাস্তায় (কিংবা বন-বাগড়ে) ঘুরে বেড়াতে-আল্লাহর সান্নিধ্য ও করুণা প্রাপ্তির অন্বেষায়।’ হযরত আবূ যর (রা) বলেন, আল্লাহর শপথ, আমি মনে-প্রাণে কামনা করছিলাম আমি যদি একটি বৃহ্ম হতে পারতাম যাকে কর্তন করা হবে। [ইবন্ মাজাহ্ ও তিরমিযী তিনি বলেন হাদীসটি হাসান ও গরীব]
كتاب التوحيد
(2) باب في عظمة الله تعالى وكبريائه وكمال قدرته وافتقار الخلق إليه
(13) وعن ابي ذر رضي الله عنه قال قال رسول الله صلي الله عليه ويلم إني أري ما لا ترون واسمع ما لا تسمعون أطت (3) السماء وحن لها ان تئط ما فيها يوضع أربع أصابع إلا عليه ملك ساجد، لو علمتم ما أعلم لضحكتم قليلاً ولبكيتم كثيراً ولا تلذذتم بالنساء علي الفرشات ولخرجتم على أعلى
الصعدات (1) تجأرون 'الي الله تعالي قال أبو ذر والله لوددت أني شجره تعضد

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এ হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আসমানে ফিরিশতাদের সংখ্যা ও তাদের ইবাদত-বন্দেগীর আধিক্য বোঝাতে গিয়ে ইরশাদ করেছেন-

أَطَّتِ السَّمَاءُ وَحَقَّ لَهَا أَنْ تَئِطَّ (আকাশ কড়কড় শব্দ করছে। আর তার জন্য কড়কড় আওয়াজ করা যথার্থই)। أَطَّتِ ক্রিয়াপদটির উৎপত্তি اطيط থেকে। উটের হাওদা, গাধার পালান ইত্যাদিতে আরোহী চড়লে তার ভারে যে শব্দ সৃষ্টি হয়, তাকে اطيط বলে। হাদীছটিতে রূপকালঙ্কার হয়েছে। এতে আসমানকে হাওদা, পালান ইত্যাদির সঙ্গে উপমিত করে তার শব্দকে আসমানের জন্য কল্পনা করা হয়েছে। বোঝানো উদ্দেশ্য, আসমানের যদি শব্দ করার অবকাশ থাকত, তবে ফিরিশতাদের সংখ্যাধিক্য ও ইবাদত- বন্দেগীতে তাদের অবিরাম লিপ্ততার ভারে হাওদার মত তারও অবশ্যই কড়কড় আওয়াজ শোনা যেত। ইবনুল আছীর রহ. বলেন, এটি একটি উপমা। এর দ্বারা ফিরিশতাদের সংখ্যাধিক্য বোঝানো হয়েছে, যদিও আকাশের কোনও আওয়াজ নেই। মূলত এ উপমা দ্বারা আল্লাহ তাআলার গৌরব-মহিমা তুলে ধরাই উদ্দেশ্য। কারও কারও মতে এর দ্বারা প্রকৃত শব্দই বোঝানো হয়েছে। তা অসম্ভব নয়।

পরবর্তী বাক্যে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আসমানের শব্দ করার কারণ বর্ণনা করেন যে-

مَا فِيهَا مَوْضِعُ أَرْبَعِ أَصَابِعَ إِلاَّ وَمَلَكٌ وَاضِعٌ جَبْهَتَهُ سَاجِدًا لِلَّهِ

(তাতে এমন চার আঙ্গুল পরিমাণ জায়গাও নেই, যেখানে কোনও না কোনও ফিরিশতা আল্লাহ তাআলার জন্য সিজদারত অবস্থায় কপাল ঠেকানো নেই)। সুবিশাল আসমানের প্রতি চার আঙ্গুল পরিমাণ স্থানে একেকজন ফিরিশতা যদি সিজদারত থাকে, তাহলে সহজেই অনুমেয় আসমানে ফিরিশতাদের সংখ্যা কত বিপুল। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে—

وَمَا يَعْلَمُ جُنُودَ رَبِّكَ إِلَّا هُوَ

‘তোমার প্রতিপালকের বাহিনী সম্পর্কে তিনি ছাড়া কেউ জানে না।৩৭৪

ফিরিশতাদের এ আমল দ্বারা জানা গেল যে, আল্লাহ তাআলার অন্যান্য আদেশ পালনের পাশাপাশি সরাসরি ইবাদত-বন্দেগী করাও তাদের একটি কাজ। তারাও সিজদা করে, আল্লাহ তাআলার তাসবীহ পাঠ করে এবং আল্লাহর কাছে দুআ করে। যেমন ইরশাদ হয়েছে-

الَّذِينَ يَحْمِلُونَ الْعَرْشَ وَمَنْ حَوْلَهُ يُسَبِّحُونَ بِحَمْدِ رَبِّهِمْ وَيُؤْمِنُونَ بِهِ وَيَسْتَغْفِرُونَ لِلَّذِينَ آمَنُوا


‘যারা (অর্থাৎ যে ফিরিশতাগণ) আরশ ধারণ করে আছে এবং যারা তার চারপাশে আছে, তারা তাদের প্রতিপালকের প্রশংসার সাথে তাঁর তাসবীহ পাঠ করে ঈমান রাখে এবং যারা ঈমান এনেছে তাদের জন্য মাগফিরাতের দুআ করে।৩৭৫

এর দ্বারা আসমানের পবিত্রতাও উপলব্ধি করা যায়। পৃথিবীতে পাপ-পুণ্য উভয়রকম কাজই হয়ে থাকে। তুলনা করলে পুণ্যের চেয়ে পাপই বেশি হয়। পুণ্যবানের তুলনায় পাপীর সংখ্যাই বেশি। আসমানে কোনও পাপ নেই। নেই পাপীও। আছে কেবল পুণ্যবান ফিরিশতা, যারা সর্বদা আল্লাহ তাআলার ইবাদত-আনুগত্যে লিপ্ত।

আসমানের এ পবিত্রতা, ফিরিশতাদের সংখ্যার বিপুলতা এবং সেখানে মহাজাগতিক ব্যবস্থাপনায় আল্লাহ তাআলার হুকুম পালনে ফিরিশতাদের ব্যতিব্যস্ততা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বিভিন্ন সময় দেখিয়ে দেওয়া হয়েছিল। মি'রাজের সফরে তো তিনি সরাসরি সেখানে গিয়েই সেসব দেখতে পেয়েছিলেন। বিভিন্ন হাদীছে তিনি সে বৃত্তান্ত বর্ণনাও করেছেন। সেদিকে ইঙ্গিত করে তিনি এ হাদীছে বলেন-

وَاللهِ لَوْ تَعْلَمُونَ مَا أَعْلَمُ, لَضَحِكْتُمْ قَلِيلاً، وَلَبَكَيْتُمْ كَثِيرًا

(আল্লাহর কসম! তোমরা যদি জানতে যা আমি জানি, তবে তোমরা অবশ্যই অল্প হাসতে এবং বেশি কাঁদতে)। অর্থাৎ আল্লাহ তাআলার গৌরব-মহিমা ও তাঁর শাস্তির কঠোরতা আমি যেমন জানি, এমনকি মি'রাজের পরিভ্রমণে নিজ চোখে যেমন তা দেখেছি, তেমনি তোমাদের জানা থাকলে আল্লাহ তাআলার শাস্তির ভয়ে তোমরা অল্প হাসতে এবং বেশি কাঁদতে।

অল্প হাসা ও বেশি কান্নার কথা বলে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, হাসির তুলনায় কান্না বেশি হতে হবে বটে, কিন্তু এমন নয় যে, কখনও কোনও অবস্থায় বিলকুল হাসা যাবে না, সর্বক্ষণ শুধু কাঁদতেই হবে। কেননা কিছুটা আনন্দ-ফুর্তিও মানবজীবনে দরকার আছে। আখেরাতের ভয়-ভীতি সীমা ছাড়িয়ে যাওয়া উচিত নয়। তাতে হতাশা আসে। ভয়-ভীতির উদ্দেশ্য নেক আমলে মনোযোগী হওয়া। হতাশা মানুষকে আমলবিমুখ করে তোলে। এ কারণেই কুরআন ও হাদীছে আল্লাহ তাআলার রহমত ও মাগফিরাতের কথা বলে মানুষের অন্তরে আশারও সঞ্চার করা হয়েছে। সেদিকে লক্ষ করে যেমন অন্তরে প্রফুল্লতা সৃষ্টি করা এবং মুক্তির আশাবাদী হয়ে আমলের উৎসাহ-উদ্দীপনা সঞ্চার করা দরকার, তেমনি আযাব ও গযবের ভয়ে ভীত হয়ে দরকার অন্যায় ও অনুচিত কাজ থেকে বিরত থাকা এবং অতীত ভুলত্রুটির জন্য কান্নাকাটিও করা। আশা ও ভয় এ দুয়ের সমষ্টিই ঈমান। হাঁ, সাধারণ অবস্থায় আশা অপেক্ষা ভয়ের দিক ভারী রাখা কাম্য। আর মৃত্যুকালে ভালো আশায় উজ্জীবিত থাকা।

ভয়-ভীতি যাতে মাত্রা না হারায়, সম্ভবত সে কারণেই আখেরাতের বিভীষিকা সাধারণভাবে দেখিয়ে দেওয়া হয়নি; বরং কুরআন ও হাদীছ দ্বারা সে সম্পর্কে সংবাদ দেওয়া হয়েছে। দেখিয়ে দেওয়া হলে মানুষ দুনিয়ার সব কাজকর্ম ছেড়ে দিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়ত, যেমন এ হাদীছের পরবর্তী বাক্যে বলা হয়েছে-

وَمَا تَلَذَّذْتُمْ بِالنِّسَاءِ عَلَى الْفُرُشَاتِ، وَلَخَرَجْتُمْ إِلَى الصُّعُدَاتِ، تَجْأَرُونَ إِلَى اللهِ

(আর তোমরা বিছানায় স্ত্রীদের সঙ্গে আনন্দ-উপভোগও করতে না। বরং তোমরা আল্লাহ তাআলার আশ্রয় চাইতে চাইতে রাস্তাঘাটে বের হয়ে পড়তে)। কিন্তু এটা কাম্য নয়। আল্লাহ তাআলাকে ভয় করার উদ্দেশ্য নাফরমানি হতে বাঁচা ও শরীআতসম্মত জীবনযাপন করা। পার্থিব জীবন থেকে সম্পূর্ণ বিমুখ হয়ে ঘর-সংসার ছেড়ে দেওয়া নয়। তাই আল্লাহভীতির মাত্রা রক্ষা করা জরুরি। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুআ শিক্ষা দিয়েছেন-
اللَّهُمَّ اقْسِمْ لَنَا مِنْ خَشْيَتِكَ مَا يَحُولُ بَيْنَنَا وَبَيْنَ مَعَاصِيْكَ
‘হে আল্লাহ! আমাদেরকে এই পরিমাণ আপনার ভয় দান করুন, যা আমাদের ও আপনার নাফরমানির মধ্যে অন্তরায় সৃষ্টি করবে।৩৭৬

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. ফিরিশতাদের সংখ্যা এত বেশি যে, আল্লাহ তাআলা ছাড়া আর কেউ তাদের সংখ্যা জানে না।

খ. ফিরিশতাগণও আল্লাহ তাআলার ইবাদত করে থাকে।

গ. আখেরাতের হিসাব-নিকাশ অত্যন্ত কঠিন। সে ভয়ে ভীত থেকে আল্লাহ তাআলার আদেশ-নিষেধ পালনে রত থাকা চাই। কিছুতেই তাঁর নাফরমানি করা উচিত নয়।

ঘ. নিজ ত্রুটি-বিচ্যুতির জন্য আল্লাহ তাআলার কাছে কান্নাকাটি করা উচিত, যাতে সেজন্য তাঁর শাস্তিতে নিপতিত হতে না হয়। কিছুতেই আনন্দ-ফুর্তিতে মাতোয়ারা হয়ে থাকা উচিত নয়।

ঙ. আখেরাতের ভয়ও পরিমিত পরিমাণেই রাখা উচিত। যে ভয় নৈরাশ্য আনে এবং ঘর-সংসার থেকে বিমুখ করে দেয় তা বাঞ্ছনীয় নয়।

চ. আল্লাহর ভয়ে বেশি বেশি ক্রন্দন করার পাশাপাশি শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য মাঝেমাঝে হাসি-আনন্দেরও প্রয়োজন আছে।

৩৭৪. সূরা মুদ্দাছছির (৭৪), আয়াত ৩১

৩৭৫. সূরা গাফির (৪০), আয়াত ৭

৩৭৬. জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ৩৫০২; নাসাঈ, আস্ সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ১০১৬১; শারহুস্ সুন্নাহ, হাদীছ নং ১৩৭৪
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান