প্রবন্ধ
সৎ জীবনে দারিদ্র্য মুমিনের ঐশ্বর্য
এক.
রাহমাতুল্লিল আলামীন হযরত রাসূলে আরাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। তাঁর সামনে উপস্থিত ফেরেশতাকুলের সরদার হযরত জিবরাঈল আ.। এইমাত্র তিনি প্রিয়তম নবীর কাছে আল্লাহ তা'আলার পক্ষ থেকে যুগান্তকারী পয়গাম পেশ করলেন। না, এবার তিনি নবীজীর উম্মতের জন্য পালনীয় কোনো বিধান আনেননি। তাঁর এবারের পয়গামে মক্কার অবাধ্য কুরাইশদের জন্য অনাগত শাস্তির সতর্কবার্তাও নেই। বরং এ সময় রাব্বে কারীমের পক্ষ থেকে তাঁর হাবীবের প্রতি কেবলই সন্তুষ্টি এবং ভালোবাসা প্রকাশের। এ মুহূর্তটি রাব্বে কায়েনাতের প্রিয়বান্দাকে পুরস্কৃত ও সম্মানিত করার সাধ পূরণের। জিবরীলে আমীন আ. কিছুক্ষণ আগে আল্লাহ তা'আলার পক্ষ থেকে একটি অসামান্য প্রতিদানের প্রস্তাব পেশ করে এখন তাঁর সম্মতির অপেক্ষায় আছেন। আল্লাহ তা'আলা নবীজীকে উপঢৌকনস্বরূপ মক্কার সমগ্র উপত্যকা স্বর্ণে পরিণত করে দেয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। মক্কা নগরীর সুবিশাল পর্বতমালাকে 'স্বর্ণপাহাড়ে' রূপান্তর করে দিতে চেয়েছেন তিনি। এটা কোনো অলীক কল্পকথা নয়। এ যে মধ্যাহ্নসূর্যের ন্যায় গনগনে বাস্তবতা। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম মানুষকে ভূপৃষ্ঠের সর্বশ্রেষ্ঠ ধনকুবের বানানোর যুগান্তকারী প্রয়াস। কিন্তু জিবরীলে আমীনের প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে সমগ্র মানবতার চোখের মণি এ মহান মানুষটি যে উত্তর দিলেন তা হীরকখচিত হরফে তুলে রাখার যোগ্য। তিনি অবিচল আস্থার সাথে আরজ করলেন- 'না, আমার রব! আমি বরং একদিন আহার করবো, অপরদিন ক্ষুধার কষ্ট ভোগ করবো। ক্ষুধার যন্ত্রণায় ক্লিষ্ট আমি আপনাকে স্মরণ করে কান্নাকাটি করবো। আবার কখনো তৃপ্তিসহ খাবার খেয়ে আপনার প্রতি কৃতজ্ঞ হবো, শুকরিয়া জানাবো।' (সুনানে তিরমিযী; হা.নং ২৩৪৭)
দুই.
মুসলিমজাহানের প্রথম খলীফা আমীরুল মুমিনীন হযরত আবু বকর রা.। অর্থাভাবে স্ত্রীর সামান্য মিষ্টান্ন খাওয়ার চাহিদাও পূরণ করতে পারেননি। এ অবস্থায় তাঁর স্ত্রী কিছু পয়সা সঞ্চয় করার জন্য তাঁর অনুমতি নিয়ে নিলেন। এরপর বায়তুলমাল থেকে প্রাপ্ত প্রতিদিনের রেশন থেকে নিজের চেষ্টায় অল্প অল্প বাঁচিয়ে মিষ্টান্নের পয়সা সঞ্চয় করলেন। মিষ্টান্নের জন্য সঞ্চিত এই পয়সাগুলো যখন তিনি স্বীয় স্বামী সিদ্দীকে আকবর রা.-এর হাতে দিলেন তখন সিদ্দীকে আকবর রা. পয়সাগুলোকে 'প্রয়োজনের অতিরিক্ত' আখ্যা দিয়ে বললেন, এর মাধ্যমে প্রমাণিত হলো যে, প্রতিদিনের এই পরিমাণ রেশন আমরা বায়তুলমাল থেকে অতিরিক্ত গ্রহণ করছি। এমনকি স্ত্রীর সঞ্চিত পয়সাগুলো বায়তুলমালে ফেরত দিয়ে প্রতিদিনের রেশন থেকে ঐ পরিমাণ বরাদ্দও কমিয়ে দিলেন। ইসলামের এই মহান খলীফা তাঁর খিলাফতকালে বায়তুলমাল থেকে যৎসামান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী গ্রহণ করেছিলেন। মৃত্যুকালে তিনি সেগুলোও মুসলমানদের আমানত মনে করে পরবর্তী খলীফার কাছে হস্তান্তর করার ওসিয়ত করে যান।
তিন.
ইসলামপূর্ব যুগে প্রতাপশালী ব্যবসায়ী ছিলেন হযরত আবুদ্দারদা রা.। তাঁর মুসলিমজীবনের ঘটনা। এক কনকনে শীতের রাতে কিছুলোক তাঁর মেহমান হলো। তারা তাঁর ঘরে রাতের খাবার খেলো। কিন্তু তাদের ঘুমাবার জন্য কোনো লেপের ব্যবস্থা না করায় একজন উঠে তাঁর দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। দেখলো, একসময়ের ধনকুবের আবুদ্দারদা কাত হয়ে শুয়ে আছেন আর তাঁর স্ত্রী পাশে বসে আছেন। তাদের গায়ে পাতলা কাপড় ছাড়া শীত থেকে বাঁচার কোনো অবলম্বনই নেই। লোকটি হযরত আবুদ্দারদা রা.-কে বললো, আপনাদের আসবাবপত্র কোথায়? তিনি উত্তরে বললেন, ঐখানে আমাদের একটি বাড়ি আছে। আমরা এখানে যেসকল আসবাব অর্জন করি তার সবই ওখানে পাঠিয়ে দেই। সেই বাড়িতে পৌঁছার জন্য আমাদের দুর্গম গিরিপথ অতিক্রম করতে হবে। এ গিরিপথে ভারে ন্যুব্জ মানুষের চেয়ে স্বল্পভারী মানুষই বেশি সহজে যেতে পারবে। তাই আমরা স্বল্পভারী হতে চাচ্ছি, যেন সহজে এই পথ অতিক্রম করতে পারি। বলাবাহুল্য, হযরত আবুদ্দারদা রা. যে বাড়ির কথা বলেছেন তা দুনিয়াবী কোনো বাড়ি নয়। বরং তিনি পরকালের বাড়ি তথা জান্নাতের কথা বুঝিয়েছেন।
তাঁরা ছিলেন সোনালীযুগের সোনার মানুষ। আমরা তাঁদের আদর্শের অনুসারী, উত্তরসূরী। অর্থাভাবের এই সুমহান আদর্শের পুঙ্খানুপুঙ্খ অনুসরণ আমাদের মতো দুর্বল দেহ ও মনের মানুষদের জন্য অসম্ভব ও অসমীচীন। কিন্তু তা সত্ত্বেও সাধ্যানুযায়ী তাঁদের অনুসরণের সুতীব্র আগ্রহ ও অভিলাষ থাকা ঈমানের অন্যতম দাবী। এতে দ্বীনের অনুসরণ সহজ হয়, আমলের আগ্রহ বজায় থাকে আখেরাত-মুখিতা বৃদ্ধি পায়।
দারিদ্র্য ও বেকারত্বের মধ্যে পার্থক্য
মানুষের দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় জিনিসের ক্ষেত্রে অল্পে তুষ্ট থাকা, সাদাসিধেভাবে চলা, আড়ম্বরতা পরিহার করা, প্রতিদিন নিজের প্রয়োজন অনুযায়ী হালাল কাজকর্ম করা, নিজেকে কোন বৈধ পেশায় নিয়োজিত রাখা যাতে কোন মতে তার প্রয়োজন পূরণ হয়ে যায় একজন মুমিনের কাছে দুনিয়াবী প্রয়োজনাদির এতটুকুই পূরণ করা কাম্য। আর বাকি সময় আখেরাত আবাদের জন্য আল্লাহর গোলামীতে লেগে থাকা একটি প্রশংসনীয় তরীকা- জীবন পদ্ধতি, যাকে বাহ্যিকভাবে মনে হয় দরিদ্রতা। প্রকৃত অর্থে এটাই হল ধনাঢ্যতা।
কিন্তু এ থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি জিনিস হল বেকারত্ব। শক্তি-সামর্থ্য, সময়-সুযোগ, সুস্থতা থাকার পরও শুধু অলসতা বা উচ্চাকাঙ্ক্ষার কারণে বৈধ কাজকর্মে নিজেকে লাগিয়ে না রাখা একটা মারাত্মক ক্ষতিকর স্বভাব। তাছাড়া এটা নাশুকরী; একটি কবীরা গুনাহ। পৃথিবীতে কাজকর্ম করে দুনিয়ার প্রয়োজন পূর্ণ করা এবং আখিরাত আবাদ করা আল্লাহ তা'আলার ফরমান ও নবীদের সুন্নাত। এ দুনিয়ায় অকর্মন্য বেকার হয়ে চলার অনুমোদন ইসলামে নেই। নিজের মেধা, যোগ্যতা, শক্তি, সামর্থ্য অনুযায়ী হালাল কাজ করে যেতে হবে, তা যতই ছোট বা নিম্ন শ্রেণীর হোক। হালাল পেশায় কোন লজ্জা নেই। এটাই ইসলামের উদার শিক্ষা। এজন্য নবীগণ কর্তৃক বকরীর রাখালী করাতে তাঁদের সম্মানহানী হয়নি। বরং তাঁরাই শতভাগ মর্যাদাবান হয়েছেন। হ্যাঁ, কারো সম্পদের কম প্রয়োজন হলে তিনি উপার্জন করে দুর্বল, অসহায়, ইয়াতীম ও ধর্মীয় কাজে দিয়ে দিবেন। এটাই দুনিয়ার নিযাম বা ব্যবস্থা। এটাই সওয়াবের কাজ।
যুদ্ধ দরিদ্রতার বিরুদ্ধে নয়; বেকারত্বের বিরুদ্ধে
কেননা দয়ার নবী রহমাতুল্লিল আলামীন নিজে সর্বদা দরিদ্র থাকতে দু'আ করেছেন। হাদীসে বর্ণিত হয়েছে,
اللهم أحيني مسكينا وأمتني مسكينا واحشرني في زمرة المساكين.
অর্থ : হে আল্লাহ! আমাকে নিঃস্বতার জীবন দান করুন এবং নিঃস্ব অবস্থায়ই মৃত্যু দিন। হাশরের ময়দানে আমাকে (দুনিয়াবী) নিঃস্বদের কাতারে শামিল করুন। (সুনানে তিরমিযী; হা.নং ২৩৫২)
সুতরাং আমাদের স্লোগান হওয়া উচিত বেকারত্বের বিরুদ্ধে কর্মসংস্থান দিয়ে যুদ্ধ করার, অনৈতিকতার বিরুদ্ধে ন্যায়- নীতির যুদ্ধের, অশিক্ষা-কুশিক্ষার বিরুদ্ধে সুশিক্ষা দিয়ে লড়াই করার, অশ্লীলতা, অন্যায়, অবিচারের বিরুদ্ধে শালীনতা ও ইনসাফের লড়াইয়ের।
এ জাতীয় বিষয়ে লড়াই করা আল্লাহর নির্দেশ, সমস্ত নবীদের তরীকা, সাহাবায়ে কেরামের আদর্শ এবং উম্মতের যিম্মাদারী। তাই সৎভাবে নীতি-নৈতিকতা সহকারে জীবন যাপন করতে এবং সন্নাত তরীকায় চলতে অর্থকষ্ট এবং অভাব অনটন হবেই, বিপদের ঘনঘটা আসবেই। তবে এটা অভিশাপ নয়; বরং রহমত। তাইতো বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেছিলেন, দরিদ্রতা আমার অভিশাপ নয়, দিয়েছে আমাকে আশির্বাদ। কারণ, একজন মুমিনের জন্য অর্থাভাব জনিত দুশ্চিন্তা এবং দৈন্যদশার উপর সবর করার যে সুবিশাল প্রতিদান ও পুরষ্কারের প্রতিশ্রুতি আল্লাহ তা'আলা দিয়ে রেখেছেন তা অর্জন করাই তার জন্য গৌরবের। আর এগুলো থেকে বঞ্চিত হওয়া তার জন্য অভিশাপতুল্য। তাই প্রকৃত মুমিনের জন্য বোঝার বিষয় হল, সৎভাবে জীবন যাপন করাই শ্রেষ্ঠ ইবাদত। হালালভাবে ইবাদত-বন্দেগী ঠিক রেখে নিয়ন্ত্রিত চাকুরী, ব্যবসা, কৃষি ইত্যাদি কাজকর্ম করে যাওয়া এবং এতে যা হয় তা নিয়ে তুষ্ট থাকা এক বিরাট পূণ্যের কাজ। এ অবস্থায় যদি অনেক বেশি সম্পদের মালিকও কেউ হয়ে যায় তাতে দোষণীয় কিছু নেই। কেননা সৎ ব্যক্তির পবিত্র সম্পদ দ্বারা দুনিয়াতে পাক-পবিত্র, আদর্শ ও নীতি- নৈতিকতারই লালন হবে। ধর্মের সহায়তা হবে, মজবুতী হবে।
দরিদ্রতার মাহাত্ম্য ও ধনাঢ্যতার আশঙ্কা
ফকীর বা দরিদ্র ঐ ব্যক্তিকে বলে যার নিকট সামান্য সম্পদ বিদ্যমান থাকে। কিন্তু তা নেসাবের পরিমাণ অর্থাৎ পঞ্চাশ হাজার টাকার চেয়ে কম হয়। ফকীরের কাছাকাছি আরেকটি শব্দ মিসকীন। মিসকীন ঐ ব্যক্তিকে বলে, যার নিকট সম্পদ বলতে কিছুই থাকে না।
এখানে একটি বিষয় লক্ষণীয় যে, কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনকারী সম্পদশালী ব্যক্তি উত্তম, না ধৈর্য্যধারণকারী দরিদ্র ব্যক্তি উত্তম? এ ব্যাপারে সহীহ বুখারীর ব্যাখ্যাকার আল্লামা মুলাহ্হাব রহ. বলেন, আল্লাহ তা'আলার নিকট কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনকারী ধনী ব্যক্তিই উত্তম। কেননা তিনি দরিদ্রদের ন্যায় অন্যান্য ইবাদত বন্দেগী পালন করার পাশাপাশি মালী ইবাদতও অধিক পরিমাণে আদায় করে থাকেন। কিন্তু অধিকাংশ উলামায়ে কেরাম এবং সূফী-সাধক ইমামগণের মতে অল্পে তুষ্ট ধৈর্য্যধারণকারী দরিদ্র ব্যক্তিই আল্লাহর নিকট উত্তম। কারণ সংখ্যায় অতি নগণ্য কয়েকজন নবী ব্যতীত সমস্ত নবী, আউলিয়া, সাহাবায়ে কেরাম, আইম্মায়ে মুজতাহিদীন ফকীর বা দরিদ্র ছিলেন। এছাড়াও রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বদা এভাবে দু'আ করতেন- হে আল্লাহ! আমাকে নিঃস্বতার জীবন দান করুন এবং নিঃস্ব অবস্থায়ই মৃত্যু দিন। হাশরের ময়দানে আমাকে (দুনিয়াবী) নিঃস্বদের কাতারে শামিল করুন। (একথা শুনে) হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রাযি. বললেন, এমনটি কেন চাচ্ছেন ইয়া রাসূলাল্লাহ? তিনি বললেন, কেননা তারা ধনীদের থেকে চল্লিশ বছর পূর্বে জান্নাতে প্রবেশ করবে। হে আয়েশা! কোন মিসকীনকে তোমার দুয়ার হতে (রিক্তহস্তে) ফিরিয়ে দিয়ো না। খেজুরের একটি টুকরা হলেও প্রদান কর। হে আয়েশা! মিসকীনদেরকে ভালোবাসবে এবং তাদেরকে নিজের কাছে স্থান দিবে। তাহলে আল্লাহ তা'আলা কিয়ামতের দিন তোমাকে তাঁর নিকটে স্থান দিবেন। (সুনানে তিরমিযী;হা.নং ২৩৫২)
কুরআনে কারীমে ইরশাদ হচ্ছে, إِنَّمَا أَمْوَالُكُمْ وَأَوْلَادُكُمْ فِتْنَةٌ وَاللَّهُ عِنْدَهُ أَجْرٌ عظِيمٌ অর্থ: নিশ্চয় তোমাদের সম্পদ ও সন্তান পরীক্ষার বস্তু। (সূরা তাগাবুন- ১৫)
হযরত আবূ হুরাইরা রাযি. বলেন, নিশ্চয় আমি সুফ্ফাবাসীদের মধ্য হতে সত্তর জন লোককে দেখেছি, তাদের কারো নিকট একখানা চাদর ছিল না। হয়তা একখানা লুঙ্গি ছিল; অথবা একখানা কম্বল- যা তারা নিজেদের ঘাড়ের সাথে পেঁচিয়ে রাখত। তা কারো অর্ধ গোড়ালী পর্যন্ত, আবার কারো টাখনু পর্যন্ত পৌঁছত। আর তারা তাকে হাত দ্বারা ধরে রাখত এ আশঙ্কায়, যেন সতর প্রকাশ না হয়। (সহীহ বুখারী; হা.নং ৪৪২)
হযরত আলী রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি অল্প রিযিকে পরিতৃপ্ত ও আল্লাহর ফয়সালায় সন্তুষ্ট হবে, আল্লাহ তা'আলাও তার অল্প আমলে সন্তুষ্ট হবেন। (সহীহ মুসলিম; হা.নং ১০৫৪)
হযরত আমর ইবনে আউফ রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আল্লাহর শপথ! আমি তোমাদের জন্য দরিদ্রতার ভয় করি না; বরং আমি তোমাদের ব্যাপারে ভয় করি যে, দুনিয়ার ধন-সম্পদ তোমাদের জন্য প্রশস্ত করে দেয়া হবে, যেভাবে তোমাদের পূর্ববর্তীদের জন্য করে দেয়া হয়েছিল। অতঃপর তোমরা তা অর্জনের প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হবে, যেভাবে তারা প্রতিযোগিতা করেছিল। এবং দুনিয়াবী সম্পদই তোমাদেরকে দীন থেকে বিমুখ করে দিবে যেভাবে তাদেরকে দীন থেকে বিমুখ করেছিল। (সহীহ বুখারী; হা.নং ৪০১৫, সহীহ মুসলিম; হা.নং ২৯৬১) হযরত কা'ব ইবনে ইয়ায রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, প্রত্যেক উম্মতের জন্য একেকটি ফিতনা (পরীক্ষার বস্তু) রয়েছে। আর আমার উম্মতের জন্য ফিতনা হল ধন সম্পদ। (সুনানে তিরমিযী; হা.নং ২৩৩৬)
হযরত উসামা ইবনে যায়েদ রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,(মি'রাজের রাতে বা স্বপ্নযোগে) আমি একবার জান্নাতের দরজায় দাঁড়ালাম। তখন দেখতে পেলাম, যারা জান্নাতে প্রবেশ করছে তাদের অধিকাংশই গরীব-মিসকীন। আর এটাও দেখলাম, সম্পদশালী লোকেরা আটকা পড়ে আছে। কিন্তু কাফের জাহান্নামীদেরকে দোযখের দিকে নিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। অতঃপর আমি জাহান্নামের দরজায় দাঁড়ালাম। তখন দেখলাম, যারা তাতে প্রবেশ করছে তাদের অধিকাংশই নারী সম্প্রদায়। (সহীহ বুখারী; হা.নং ৬৫৪৭, সহীহ মুসলিম; হা.নং ২৭৩৬)
বড়পীর হযরত আব্দুল কাদের জিলানী রহ. বলেন, দরিদ্রতা এত বড় একটি নিয়ামত যার উপর হাজার শুকরিয়া ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করা উচিত। (আনওয়ারুল মিশকাত ৬/৩৬৪)
উল্লিখিত কুরআনের আয়াত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীস ও বুযুর্গানে দীনের বক্তব্য দ্বারা একথা স্পষ্ট যে, আল্লাহ তা'আলার নিকট নেককার ধৈর্য্যশীল গরীবের মর্যাদা নেককার কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনকারী ধনীর চেয়ে অনেক বেশি। শুধু তাই নয়, এ জাতীয় আরো শত শত হাদীস রয়েছে। উক্ত আলোচনায় একথাও বোঝা গেল যে, নেককার ধৈর্য্যশীল দরিদ্র ব্যক্তি তার ইবাদতের দ্বারা যে মর্তবায় পৌঁছতে পারে, নেককার কৃতজ্ঞ ধনী ব্যক্তি মাল দ্বারা সে স্তরে পৌছতে পারে না। (প্রাগুক্ত)
কিন্তু এতদসত্ত্বেও ধনবানদের হতাশার কিছু নেই। তারাও ধন সম্পদের সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার করে অফুরান ফযীলত ও অনন্য মর্যাদার অধিকারী হতে পারেন। দানশীলতা ও উদারতায় হতে পারেন হযরত উসমান গনী রাযি. এর যোগ্য উত্তরসূরী এ প্রসঙ্গে জনৈক বুযুর্গের উক্তি মনে রেখাপাত করার মতো। তিনি বলেছেন যে, দুনিয়ার সম্পদের দৃষ্টান্ত হল বিষধর সাপের ন্যায়। যে ব্যক্তি সাপের মন্ত্র জানে সাপ তাকে দংশন করে না। বরং তার গলায়ও বসে থাকে। আর যে ব্যক্তি সাপের মন্ত্র জানে না, তাকে সাপ দংশন করে। তদ্রূপ যে ব্যক্তি আল্লাহর হুকুম আর নবীর তরীকায় মেহনত করে সাহাবাদের মত দুনিয়া চালানোর মন্ত্র শিখেছে তাকে দুনিয়ার দৌলত কোন দিন গোমরাহ করবে না। বরং তার গলায় কিংবা হাতে থেকে দুনিয়ার শান্তি ও পরকালের মুক্তির পথ সহজ করে দিবে। আর যে ব্যক্তি উক্ত তরীকায় দুনিয়া চালানোর মন্ত্র শিখবে না তাকে এ দুনিয়ার সম্পদ দংশন করে দুনিয়া ও আখিরাত বরবাদ করে দিবে।
ইসলাম সৎ, ধর্মময় ও সাধনার জীবনে উৎসাহ দেয়
ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা। ইসলামী সাম্যনীতিতে রাজা-প্রজা, ধনী-গরীব, মালিক-শ্রমিক, মহাজন, দারোয়ান সকলেরই সমাজে সমানভাবে সুখ-দুঃখ ভোগ করার অধিকার আছে। একজন সুখী হলে অপরজনকেও তার সুখের অংশীদার বানাবে। দুঃখী হলে অপরজনও তার পাশে দাঁড়াবে। এটাই হল মানবতা, মনুষত্ব, বিবেক, ইনসাফ ও ধর্মের আদর্শ।
ইসলাম প্রতিটি মানুষকে কর্মঠ, উজ্জীবিত, সাহসী, কর্মজীবী হওয়ার প্রেরণা যোগায়। এ মর্মে কুরআনে ঘোষণা হচ্ছে,
فَإِذَا قُضِيَتِ الصَّلَاةُ فَانْتَشِرُوا فِي الْأَرْضِ وَابْتَغُوا مِنْ فَضْلِ اللَّهِ وَاذْكُرُوا اللَّهَ كَثِيرًا لَعَلَّكُمْ تُفلحون .
অর্থ: যখন নামায শেষ হয়ে যায়, তখন তোমরা রিযিকের তালাশে যমীনে ছড়িয়ে যাও। (সূরা জুমু'আ- ১০)
হাদীসে পাকে বর্ণিত হয়েছে, হালাল রিযিক উপার্জন করা অন্যান্য ফরযের পর ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ একটি ফরয বিধান। (মিশকাত; পৃষ্ঠা ২৪২,বাইহাকী)
হযরত মিকদাদ ইবনে মা'দীকারাব রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, কোন ব্যক্তি নিজের হাত দ্বারা উপার্জিত খাবার থেকে উত্তম কোন খাবার খেতে পারে না। নিশ্চয় আল্লাহর নবী দাউদ আ. নিজ হাতে উপার্জন করে খেতেন। (সহীহ বুখারী; হা.নং ২০৭২)
হযরত আবূ হুরাইরা রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি সমস্যা-মুসীবত থেকে বাঁচার জন্য, পরিবার-পরিজনের ভরণ-পোষণ করার জন্য ও পাড়া-প্রতিবেশীদের সাথে সহানুভূতি প্রকাশ করার জন্য হালালভাবে দুনিয়ার সম্পদ উপার্জন করবে সে কিয়ামতের দিন পূর্ণিমা রাতের চাঁদের চেহারা নিয়ে আল্লাহর সাথে সাক্ষাত করবে। আর যে ব্যক্তি অধিক সম্পদশালী হওয়ার গর্ব অর্জন করার জন্য এবং মানুষের মাঝে ধনাঢ্যতার প্রদর্শনীর ইচ্ছায় বৈধভাবেও দুনিয়ার সম্পদ কামাই করবে, কিয়ামতের দিন সে আল্লাহর সাথে এমন অবস্থায় সাক্ষাত করবে যে তিনি ভীষণ রাগান্বিত অবস্থায় থাকবেন। (শু'আবুল ঈমান লিল-বাইহাকী; হা.নং ৯৮৯০)
সুতরাং উক্ত আয়াত ও হাদীস দ্বারা ইসলামের নির্দেশ পরিষ্কার যে, নিজে বৈধভাবে উপার্জন করা, অন্যকে সহযোগিতা করা, হালাল উপার্জনে লেগে থাকা এসবই ফরয, যদি ঈমান-আমল দুরস্ত থাকে। অতএব শুধু তাওয়াক্কুলের নামে কাজকর্ম ছেড়ে বসে থাকা গোমরাহী এবং পরিবারে বদগুমানী সৃষ্টির কারণ।
ভিক্ষাবৃত্তি ও মানুষের নিকট হাতপাতা নিষেধ
সমস্ত নবী, সাহাবায়ে কেরাম এবং বুযুর্গানে দীনের সুন্নাত হল, ইচ্ছাকৃতভাবে অল্পে তুষ্ট থেকে দরিদ্রতা অবলম্বন করা। কিন্তু তাঁদের কারো জীবনেই মানুষের নিকট চাওয়ার মানসিকতা ছিল না। এ কাজকে তাঁরা মনেপ্রাণে ঘৃণা করতেন। তবে দীনী প্রয়োজনে অন্যের জন্য দান-সদকায় উদ্বুদ্ধ করা যায়। সেটা চাওয়ার আওতায় পড়ে না। তাই সেটা কোন কোন ক্ষেত্রে প্রশংসনীয়ও বটে। কিন্তু কোন অবস্থায়ই ইসলাম ভিক্ষাবৃত্তির অনুমতি দেয়নি। এজন্যই দয়ার নবী তাঁর দরবারে উপস্থিত ভিক্ষুককে তার কম্বল বিক্রি করা টাকায় কুঠার কিনে কাঠ কেটে কর্মময় জীবন যাপনের পরামর্শ দিয়েছেন। অতঃপর সে এক সময় স্বাবলম্বী হয়ে গেল। হযরত কুবাইসা ইবনে মুখারিক রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, হে কুবাইসা! তিন ব্যক্তি ছাড়া অন্য কোন লোকের পক্ষে চাওয়া হালাল নয়। (এক) ঐ ব্যক্তি, যে অন্যের ঋণ পরিশোধের যিম্মাদার হয়েছে তার জন্য চাওয়া হালাল, যতক্ষণ না সে ঋণ পরিশোধ করে। আর সে নিজেকে তা হতে বিরত রাখবে। (দুই) আরেকজন এমন ব্যক্তি যার উপর এমন বিপদ পৌঁছেছে যা তার সম্পদকে ধ্বংস করে দিয়েছে, তার জন্য চাওয়া হালাল, যতক্ষণ না সে তার প্রয়োজন পূরণ করার মত কিছু অর্জন না করে। (তিন) আরেকজন ঐ ব্যক্তি, যে এতো বেশি অভাবে পতিত হয়েছে যে, তার গোত্রের তিনজন প্রতিবেশী সাক্ষ্য দেয় যে, সত্যিই সে অভাবে পড়েছে। তার জন্য চাওয়া হালাল, যতক্ষণ না সে তার জীবিকা নির্বাহের মত কিছু অর্জন করে। এ তিন অবস্থা ব্যতীত অন্য সকল অবস্থায়ই চাওয়া হারাম। হে কুবাইসা! (এই তিন অবস্থা ব্যতীত) ভিক্ষুকের জন্য ভিক্ষাবৃত্তির উপার্জন ভক্ষণ করা হারাম। (সহীহ মুসলিম; হা.নং ১০৪৪)
হযরত সাওবান রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি আমার কাছে যামিন হতে পারে যে, মানুষের কাছে সে কিছু প্রার্থনা করবে না আমি (মুহাম্মাদ) তার জন্য জান্নাতে পৌঁছে দেয়ার যামিন হতে পারি। তখন হযরত সাওবান রাযি. বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমি হতে পারি। বর্ণনাকারী বলেন, হযরত সাওবান রাযি. এরপর আমৃত্যু কারো নিকট কিছু চাননি। (সুনানে আবু দাউদ; হা.নং ১৬৪৩)
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি সর্বদা মানুষের কাছে চাইতে থাকবে, কিয়ামতের দিন সে এমন অবস্থায় উপস্থিত হবে যে, তার মুখে সামান্য গোশতের প্রলেপও থাকবে না। (সহীহ বুখারী; হা.নং ১৪৭৪, সহীহ মুসলিম; হা.নং ১০৪০)
তাছাড়া সাহাবায়ে কেরামের জীবনীতে দেখা যায় যে, তাঁরা প্রয়োজনের চেয়ে বেশি ধন-সম্পদ বৈধভাবে আসলেও তা গ্রহণ করতেন না। বরং নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতেন। কারণ তাঁরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে এ হাদীস শুনেছেন যে, আল্লাহ তা'আলা যাকে ভালোবাসেন তাকে দুনিয়ার অর্থ-সম্পদ থেকে এমনভাবে বাঁচিয়ে রাখেন যেভাবে জ্বরাক্রান্ত ব্যক্তিকে পানি থেকে বাঁচানো হয়। এজন্যই দেখা যায় হযরত আলী ইবনে আবী তালিব রাযি. নিজে স্বর্ণ- রৌপ্যকে লক্ষ্য করে বলতেন, হে স্বর্ণ-রৌপ্য! আমি ব্যতীত অন্য কাউকে ধোঁকা দাও।
এক সাহাবী একবার বাড়ির পার্শ্বের বাগানে প্রাকৃতিক প্রয়োজন পূরণের জন্য গেলেন। সেখানে একটি ইঁদুর গর্ত থেকে পর্যায়ক্রমে মুখে করে একেকটি দীনার নিয়ে এসে জমা করছিল এটা দেখে তিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট চলে আসলেন। তিনি বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! এই স্বর্ণমুদ্রাগুলো গ্রহণ করা আমার জন্য বৈধ হবে কি? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উত্তরে বললেন, হ্যাঁ, তুমি যে আল্লাহর কাছে রিযিকের দু'আ করে দীনের কাজে লেগে গিয়েছ, এজন্য আল্লাহ তা'আলা খুশি হয়ে ইঁদুরের মাধ্যমে তোমার রিযিক পৌছানোর ব্যবস্থা করে দিয়েছেন (সুবহানাল্লাহ)। (সুনানে আবু দাউদ; হা.নং ৩০৮৭, সুনানে ইবনে মাজাহ; হা.নং ২৫০৮, খুতুবাতে যুলফিকার; পৃষ্ঠা ২৯)
ইমাম গাযালী রহ. এর জীবনে দরিদ্রতা
পৃথিবীর ইতিহাসে জ্ঞানী-বিজ্ঞানী, মহামনিষী, পণ্ডিত, বিদ্বান, আল্লাহওয়ালা, বুযুর্গ, দুনিয়া-আখিরাতের পথপ্রদর্শক বহু সূফী-সাধক এবং দুনিয়ার লাইনের বহু গুনীজন এমন অতিক্রান্ত হয়েছেন যাদের স্বর্ণগাঁথা ত্যাগ-তিতিক্ষার জীবনী পাঠে মনে হয়, এ ধরাপৃষ্ঠে তাদের আগমনে দুনিয়াবাসী ধন্য হয়েছেন। আর তাদের জীবনের দরিদ্রতা তাদের জন্য রহমত হয়েছে। তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন ইমাম গাযালী রহ.। এই নশ্বর দুনিয়ার এমন কোন শিক্ষিত ব্যক্তি নেই যিনি তার নাম জানেন না। অথচ তার জীবনের সূচনা অত্যন্ত বেদনাবিধুর, হৃদয়গ্রাহী। ইমাম গাযালী রহ. ১০৫৮ খ্রিস্টাব্দে ইরাকের খোরাসান প্রদেশে অবস্থিত তাহেরান শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম মুহাম্মাদ। তিনি কোন কারণে অনুতাপ করে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, তার ছেলে দু'টি যেন তার মত অশিক্ষিত না হয়। বরং বিদ্বান হয়। ইমাম গাযালী রহ. এর প্রকৃত নাম মুহাম্মাদ। তার ছোট ভাইয়ের নাম আহমাদ। কিন্তু পিতার সেই স্বপ্ন পিতার জীবদ্দশায় পূরণ হল না। ইমাম গাযালী রহ. এবং তার ভাই আহমাদ যখন অপ্রাপ্ত বয়স্ক; এখনো শিক্ষার বয়স হয়নি, তখন তার পিতা মৃত্যুশয্যায় শায়িত। নিশ্চিত মৃত্যু সন্নিকটে বুঝতে পেরে তার এক সূফী বন্ধুকে ডেকে এনে পুত্রদ্বয়কে তার হাতে তুলে দিয়ে অসীয়ত করলেন, হে প্রিয় ভাই! আমি নিজে লেখাপড়া কিছুই শিখতে পারিনি। তবে মনে আশা ছিল আমার ছেলে দু'টিকে লেখাপড়া শিখিয়ে মনের মত মানুষ করে তুলব। কিন্তু আমি যে রোগে আক্রান্ত হয়েছি, মনে হচ্ছে আর কোন দিন সুস্থতা লাভ করতে পারব না। তাই তোমার নিকট আমার অনুরোধ, বন্ধুত্বের নিদর্শন হিসেবে তুমি আমার এ সন্তান দু'টির শিক্ষা-দীক্ষার দায়িত্বভার গ্রহণ করবে।
পিতার মৃত্যুর পর তারা দু'ভাই উক্ত সূফী সাহেবের তত্ত্বাবধানে প্রাথমিক শিক্ষায় মনোনিবেশ করলেন। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্তির পর পিতার বন্ধু বললেন, তোমাদের শিক্ষা- দীক্ষার জন্য তোমাদের পিতা আমার নিকট যে অর্থ-কড়ি রেখে গিয়েছিলেন তা শেষ হয়ে গেছে। আর বর্তমানে আমার নিজের আর্থিক অবস্থাও তেমন স্বচ্ছল নয় যে, আমি তোমাদের লেখাপড়ার ব্যয়ভার গ্রহণ করব। সুতরাং আমার মতে তোমরা দু'ভাই এমন কোন মাদরাসায় ভর্তি হয়ে লেখাপড়া কর, যেখানে গরীব ছাত্রদের বিনা বেতনে পড়ানো হয়। এমতাবস্থায় ইমাম গাযালী রহ. তার পরামর্শ অনুযায়ী এ ধরনের মাদরাসার তালাশে বের হয়ে পড়লেন। সে যুগে ধর্মীয় শিক্ষার ব্যাপারে প্রায় সবদেশে এমন প্রচলন ছিল যে, বিভিন্ন বিষয়ে অভিজ্ঞ, জ্ঞানের নক্ষত্র বিশিষ্ট আলেমগণ নিজ নিজ গৃহে অথবা মসজিদে মসজিদে ছাত্রদেরকে তা'লীম- তরবিয়ত বা শিক্ষা-দীক্ষা দিতেন। আর এ সকল মুসাফির ছাত্রদের থাকা- খাওয়ার যাবতীয় খরচ স্থানীয় ধর্মপ্রাণ ব্যক্তিবর্গ আঞ্জাম দিতেন। যার ফলে দেশ-বিদেশের ধনী-গরীব যে কোন শ্রেণীর শিক্ষার্থীই উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার সুযোগ পেত। ইমাম গাযালী রহ.-ও এমন একটি সুযোগ পেলেন। যার পরিপ্রেক্ষিতে তিনি ফিকহ শাস্ত্রের প্রাথমিক পর্যায়ের কিতাবসমূহ তাদের শহরের বিখ্যাত আলেম আহমাদ ইবনে মুহাম্মাদ রাযকানী রহ. এর নিকট সমাপ্ত করলেন। অতঃপর উচ্চ শিক্ষার আশায় জুরজান শহরে চলে গেলেন। সেখানে তিনি যুগশ্রেষ্ঠ আলেম ইমাম আবূ নসর ইসমাঈলী রহ. এর নিকট শিক্ষা গ্রহণ করেন। এরপর তিনি আরো উচ্চতর শিক্ষা লাভের উদ্দেশ্যে তৎকালীন দুনিয়ার জ্ঞানের শহর বাগদাদ ও নীশাপুরে গিয়ে পৌঁছেন। সেখানে জগদ্বিখ্যাত আলেম ইমামমুল হারামাইন যিয়াউদ্দীন আব্দুল মালেকের শিষ্যত্ব গ্রহণ করে শিক্ষার কাজ শুরু করে দিলেন।
তৎকালীন সময়ে মুসলিম বিশ্বে ইমামুল হারামাইনের চেয়ে বড় আলেম আর দ্বিতীয় কেউ ছিলেন না। যার ফলে তার সাহচর্যে ইমাম গাযালীও এক সময় গভীর পাণ্ডিত্বে দেশব্যাপী সুনাম অর্জন করে নিলেন। এক সময় তার উস্তাদ ইমামুল হারামাইন মাদরাসায়ে নিযামিয়া- যা মুসলিম বিশ্বের সর্ববৃহৎ ইসলামী বিদ্যাপীঠ ছিল- সেখানকার অধ্যক্ষ ছিলেন। পরবর্তীতে ৪৭৮ হিজরীতে তার উস্তাদের ইন্তিকালের পর বিজ্ঞ মহল ইমাম গাযালীর গুণ-গরিমায় মুগ্ধ হয়ে উক্ত প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ পদে অধিষ্ঠিত করেন। এভাবেই ইমাম গাযালী মুসলিম বিশ্বের সবচেয়ে বড় জ্ঞানী, পণ্ডিত, দার্শনিক ও সূফী-সাধকে পরিণত হন। বলাবাহুল্য, এমন সমুচ্চ মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত হতে তিনি আর্থিক দৈন্যদশাকে বাধা হিসেবে সাব্যস্ত না করে হাসিমুখে বরণ করে নিয়েছিলেন।
এই অগাধ পাণ্ডিত্বের অধিকারী, অসাধারণ প্রতিভাশালী ব্যক্তি ইমাম গাযালী দীর্ঘজীবী হননি। মাত্র পঞ্চাশ বছর বয়সে ৫০৫ হিজরী সনে ইহলোক ত্যাগ করেন তিনি। তার অমূল্য গ্রন্থাবলীর তালিকায় আছে প্রায় আশি খানা কিতাব। এছাড়াও শিরোনামহীন বহু কিতাব রয়েছে। আল্লামা নববী রহ. বুস্তান নামক গ্রন্থে উল্লেখ করেন, ইমাম গাযালী রহ. এর জীবনের সময়ের সাথে তার রচনাবলীর হিসেব করলে গড়ে প্রতিদিন ১৬ পৃষ্ঠা করে পড়ে। যা অত্যন্ত বিরল। কারণ তার সকল রচনাই হল মৌলিক ভিত্তিমূলক। নিজ উদ্ভাবিত রচনা। যাতে অন্যের কোন অনুসরণ নেই। (মুকাশাফাতুল কুলুব ৪/২৬)
ইমাম আবূ ইউসুফ রহ. এর জীবনে দরিদ্রতা
ইমাম আবূ ইউসুফ রহ. এর প্রকৃত নাম ইয়াকুব। তিনি ইমাম আবূ হানীফা রহ. এর একান্ত হাতে গড়া মানুষ এবং হানাফী মাযহাবের গুরুত্বপূর্ণ ইমাম ও মুজতাহিদ। তিনি ১১৩ হিজরীতে জন্মগ্রহণ করেন। পারিবারিকভাবে অসচ্ছল থাকার কারণে তিনি প্রথম জীবনে ধোপার (কাপড় পরিস্কারের) কাজ করতেন। তার ছোটবেলায় একবার ইমাম আবূ হানীফা রহ. একাজ করতে দেখে ডেকে এনে নিজ শিক্ষার আসরে বসালেন এবং জিজ্ঞেস করলেন, তুমি ধোপার কাজে কত টাকা উপার্জন কর? তিনি বললেন, দেড় টাকা। যা দিয়ে আমি ও আমার আম্মার খাবারের ব্যবস্থা হয়। ইমাম আবূ হানীফা রহ. বললেন, তুমি এই ইলমের মজলিসে বসে ইলম শিক্ষা কর। তোমার সংসারের জন্য আমি তোমাকে হাদিয়া স্বরূপ দেড়শ টাকা দিলাম। এভাবেই এ জগতবিখ্যাত ফকীহের পড়াশুনা শুরু হল। এরপর তার এই টাকা ফুরানোর পূর্বেই ইমাম আবূ হানীফা রহ. তাকে টাকা দিয়ে দিতেন, যাতে তার সংসারে কষ্ট না হয়। ইলম থেকে তিনি বঞ্চিত না হন। কিন্তু একদিন তার আম্মা ছেলেকে কাজে না দেখে রাগ করে ইমাম আবূ হানীফা রহ. কে বললেন, আপনি তো আমার ছেলেকে কাজ থেকে বিরত রেখে দিলেন, তাহলে আমাদের খাবারের ব্যবস্থা হবে কি? ইমাম সাহেব ধৈর্য্য সহকারে উত্তরে বললেন, আম্মাজান! একটু সবর করুন, তাকে ইলম শিক্ষার সুযোগ দিন, তাহলে সে একদিন পেস্তা বাদামের তেল দিয়ে পরোটা খাবে। বাস্তবে দেখা গেল তিনি বাদশাহ হারুনুর রশীদের শাসনামলে পুরা আব্বাসীয় সাম্রাজ্যের প্রধান বিচারপতি হয়েছিলেন। আর বাদশাহ তার সম্মানে উক্ত খাবারের আয়োজন করেছিলেন।
মোটকথা, উচ্চশিক্ষা কিংবা উন্নত জীবনযাপনের জন্য বুযুর্গানে-দীনগণ কখনোই দারিদ্র্য ও অভাব-অনটনকে অভিশাপ মনে করেননি। বরং এই অবস্থাকে নবীদের সুন্নাত মনে করে ধনাঢ্যতার ওপর প্রাধান্য দিয়েছেন। তারা বিশ্বাস করতেন, দারিদ্র্যেই প্রাচুর্য এবং অভাবেই ঐশ্বর্য। তারা উপলব্ধি করেছিলেন, দয়ালু রবের রহমত অল্পে তুষ্ট অভাবীদেরই সঙ্গী হয়। ফলে দরিদ্র জীবন যাপনে স্বচ্ছল জীবনের তুলনায় নানা রকমের অস্থিরতা বা দুশ্চিন্তা এবং বিভিন্ন মনোমালিন্য ও তিক্ততা থেকে রেহাই পাওয়া যায়। সাধারণত অভাবী মুমিনের মানসিক প্রশান্তি ও আল্লাহমুখিতা বেশি থাকে। এই সবকিছুই হয় অভাবের সঙ্গে আল্লাহ তা'আলার রহমত ও দয়ার সম্মিলনে। এর বিপরীতে যাদের সামান্য প্রাচুর্যও স্পর্শ করে তাদের সুখ ও প্রশান্তি হ্রাস পেতে থাকে, মাধুর্য এবং ভালোবাসার সম্পর্কগুলোয় নানা কুধারণা ও অবিশ্বাস চিড় ধরাতে শুরু করে। সর্বোপরি দীনের প্রতি উন্নাসিকতা এবং আমলের প্রতি অনাগ্রহ বাড়তে থাকে। আর যদি দুর্বল ঈমানদারের জীবনে ঐশ্বর্যের ছোঁয়া লেগে যায় তাহলে অধঃপতন ও অস্থিরতার প্লাবনে যেন সে হারিয়ে যায়। এমনকি দীনকে তার কাছে মনে হয় আফিমের মতো। আল্লাহ তা'আলার আনুগত্যকে সে পরাধীনতার শেকল মনে করে বসে। এই কঠিন বাস্তবতার চিত্রায়নে মানুষ প্রবাদও তৈরি করে ফেলেছে Money is the root of all evils (অর্থই সকল অনর্থের মূল)।
আল্লাহ তা'আলা আমাদেরকে উভয় জাহানে সুখ ও প্রশান্তির জীবন দান করুন এবং সবধরনের অস্থিরতা ও দুশ্চিন্তা থেকে মুক্ত রাখুন। আমীন।
মন্তব্য (...)
এ সম্পর্কিত আরও প্রবন্ধ
সংঘাতময় পরিস্থিতি: উপেক্ষিত নববী আদর্শ
দিনে দিনে উত্তপ্ত হয়ে উঠছে পৃথিবী। সমতালে এর অধিবাসীরাও 'গরম' হয়ে উঠছে দিনকে দিন। সেই তাপ ও উত্তাপ ব...
حضور اکرم صلی اللہ علیہ وسلم کے عظیم اخلاق
۱:- حدیث شریف میں آیا ہے کہ حضرت ام المومنین عائشہ صدیقہ رضی اللہ عنہا سے لوگوں نے پوچھا تھا کہ رسو...
اُسوہٴ حسنہ کی جامعیت
دُنیا میں جتنے بھی رسول اور بنی تشریف لائے ہیں ہم ان سب کو سچا مانتے اور اُن پر سچے دِل سے ایمان لات...
ঈমান-আমল সুরক্ষিত রাখতে হক্কানী উলামায়ে কেরামের সঙ্গে থাকুন, অন্যদের সঙ্গ ছাড়ুন
[প্রদত্ত বয়ান থেকে সংগৃহীত] হামদ ও সালাতের পর... قال الله تعالى: يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتّ...

মন্তব্য (0)
কোনো মন্তব্য নেই। প্রথম মন্তব্য করুন!
মন্তব্য করতে লগইন করুন