আত্-তারগীব ওয়াত্-তারহীব- ইমাম মুনযিরী রহঃ

২৬. অধ্যায়ঃ জান্নাত ও জাহান্নামের বর্ণনা

হাদীস নং: ৫৫৭০
অধ্যায়ঃ জান্নাত ও জাহান্নামের বর্ণনা
জাহান্নাম থেকে ভীতি প্রদর্শন, আল্লাহ্ তা'আলা তাঁর ফযল ও করমে আমাদেরকে তা থেকে রক্ষা করুন।
৫৫৭০. হযরত উমর ইবন খাত্তাব (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, জিব্রীল (আ) নবী (ﷺ)-এর কাছে সাধারণত যে সময় আসতেন, সে সময় ব্যতিরেকে অন্য এক সময় তাঁর কাছে আসলেন। তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-তাঁর কাছে উঠে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, হে জিব্রীল। ব্যাপার কি আপনাকে যে বিবর্ণ দেখছি? তিনি বললেন, আমি আপনার কাছে আসিনি। আল্লাহ তা'আলা আমাকে জাহান্নামের ফুঁকনী তৈরী করতে নির্দেশ দিয়েছেন। রাসূলাল্লাহ (ﷺ) বললেন, হে জিবরীল আমাকে অগ্নির বর্ণনা দিন এবং আমাকে জাহান্নামের বিবরণ দিন। জিবরীল (আ) বললেন, আল্লাহ তা'আলা জাহান্নাম তৈরী করতে হুকুম দিয়েছেন, তখন এক হাজার বছর জাহান্নামের অগ্নি প্রজ্বলিত করা হয়েছে। ফলে অগ্নি শ্রভ্র বর্ণ ধারণ করে। তারপর তিনি আবার তা প্রজ্জলিত করার হুকুম দিলেন। তখন এক হাজার বছর ধরে তা প্রজ্জলিত রাখা হল। ফলে অগ্নি লাল বর্ণ ধারণ করল। তারপর আবার তিনি তা প্রজ্জলিত করতে হুকুম দিলেন, তখন আরও এক হাজার বছর প্রজ্জলিত রাখা হল। ফলে অগ্নি কাল বর্ণ হয়ে গেছে। সুতরাং জাহান্নামের অগ্নি অন্ধকার কালো। তার স্ফুলিঙ্গ আলোকিত হয় না, তার শিখা নিভানো যায় না। সেই সত্তার কসম, যিনি আপনাকে সত্য দ্বীন সহকারে প্রেরণ করেছেন, যদি জাহান্নাম একটি সুইয়ের ছিদ্র পরিমাণও খুলে দেয়া হয়, তবে তার তাপে একেবারে সমস্ত পৃথিবীবাসীর নির্ঘাৎ মৃত্যু হবে। সেই সত্তার কসম, যিনি আপনাকে সত্য দীন সহকারে প্রেরণ করেছেন, যদি জাহান্নামের তত্ত্বাবধানে নিয়োজিত কোন ফিরিশতা দুনিয়াবাসীর কাছে আত্মপ্রকাশ করে, তবে তার কুৎসিত চেহারার কারণে এবং তার দুর্গন্ধে সমস্ত পৃথিবীবাসীর মৃত্যু হবে। সেই সত্তার কসম, যিনি আপনাকে সত্য দ্বীন সহকারে প্রেরণ করেছেন, আল্লাহ্ তা'আলা জাহান্নামীদের যে জিঞ্জিরের বর্ণনা তাঁর গ্রন্থে দিয়েছেন, তার কড়াসমূহ থেকে কোন একটি কড়া যদি পৃথিবীর কোন পর্বতের উপর রাখা হয়, তবে তাকে ছিন্ন ভিন্ন করে দেবে এবং পর্বত স্বস্থানে স্থির থাকতে পারবে না। যে, পর্যন্ত না সে পৃথিবীর সর্বনিম্নস্তরে গিয়ে পৌঁছে। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তখন বললেন, হে জিব্‌রীল। আমার যথেষ্ট হয়েছে, (আর বলবেন না) যাতে আমার কলজে ফেটে না যায়, যার ফলে আমি মৃত্যুমুখে পতিত হই বর্ণনাকারী বলেন, এরপর রাসুলুল্লাহ (ﷺ) জিবরীলের দিকে তাকিয়ে দেখলেন, যে, তিনি কাঁদছেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, হে জিব্রীল। আপনি কাঁদছেন, অথচ আপনি আল্লাহ্ তা'আলার কাছে আপনার বিশেষ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত। তিনি বললেন, আমার কি হয়েছে যে, আমি কাঁদব না? আমার তো বেশি কাঁদা উচিত। কেননা, আমি যে মর্যাদায় রয়েছি, হায় আল্লাহর ইলমের মধ্যে তার ব্যতিক্রম অবস্থায় রয়েছি। আমি জানি না, হয়ত ইবলীসকে যে পরীক্ষা করা হয়েছে, আমাকেও সে পরীক্ষার সম্মুখীন করা হবে। অথচ সে ছিল ফিরিশতাদের অন্তর্ভুক্ত। আমি জানি না, হয়ত হারূত ও মারূতকে যে পরীক্ষা করা হয়েছে, আমাকে সে পরীক্ষার সম্মুখীন করা হবে। রাবী বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) কেঁদে ফেললেন এবং জিব্রীল (আ) ও কাঁদলেন। তাঁরা দু'জন কাঁদতে থাকলেন। তার যে পর্যন্ত না তাঁদেরকে ডেকে বলা হয়, হে জিবরীল ও হে মুহাম্মদ। আল্লাহ্ তা'আলা তোমাদের উভয়কে তাঁর অবাধ্যাচরণ থেকে নিরাপদে রেখেছেন। এরপর জিব্রীল (আ) উঠে গেলেন এবং রাসুলুল্লাহ্ (ﷺ) বের হলেন, এবং কিছু আনসারী সাহাবীর কাছ দিয়ে অতিক্রম করলেন। তাঁরা তখন হাসছিলেন এবং খেলা করছিলেন। তখন তিনি বললেন, তোমরা হাসছ? অথচ তোমাদের পশ্চাতে রয়েছে জাহান্নাম। আমি যা জানি, যদি তোমরা তা জানতে, তবে তোমরা কম হাসতে, বেশি কাঁদতে, খাবার ও পানীয় গলাধঃকরণ করতে পারতে না এবং তোমরা আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করতে করতে রাস্তায় বেরিয়ে পড়তে।
(তাবারানী 'আল আওসাতে' হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। মৃত্যুর আলোচনা অধ্যায়ে অপর এক হাদীস প্রসঙ্গে এ হাদীসের কোন কোন কম ব্যবহৃত শব্দের ব্যাখ্যা পূর্বে বর্ণিত হয়েছে।)
كتاب صفة الجنة والنار
التَّرْهِيب من النَّار أعاذنا الله مِنْهَا بمنه وَكَرمه
5570- وَرُوِيَ عَن عمر بن الْخطاب رَضِي الله عَنهُ قَالَ جَاءَ جِبْرِيل إِلَى النَّبِي صلى الله عَلَيْهِ وَسلم فِي حِين غير حِينه الَّذِي كَانَ يَأْتِيهِ فِيهِ فَقَامَ إِلَيْهِ رَسُول الله صلى الله عَلَيْهِ وَسلم فَقَالَ يَا جِبْرِيل مَا لي أَرَاك متغير اللَّوْن فَقَالَ مَا جئْتُك حَتَّى أَمر الله عز وَجل بمنافخ النَّار فَقَالَ رَسُول الله صلى الله عَلَيْهِ وَسلم يَا جِبْرِيل صف لي النَّار وانعت لي جَهَنَّم فَقَالَ جِبْرِيل إِن الله تبَارك وَتَعَالَى أَمر بجهنم فَأوقد عَلَيْهَا ألف عَام حَتَّى ابْيَضَّتْ ثمَّ أَمر فَأوقد عَلَيْهَا ألف عَام حَتَّى احْمَرَّتْ ثمَّ أَمر فَأوقد عَلَيْهَا ألف عَام حَتَّى اسودت فَهِيَ سَوْدَاء مظْلمَة لَا يضيء شررها وَلَا يطفأ لهبها وَالَّذِي بَعثك بِالْحَقِّ لَو أَن قدر ثقب إبرة فتح من جَهَنَّم لمات من فِي الأَرْض كلهم جَمِيعًا من حره وَالَّذِي بَعثك بِالْحَقِّ لَو أَن خَازِنًا من خَزَنَة جَهَنَّم برز إِلَى أهل الدُّنْيَا لمات من فِي الأَرْض كلهم من قبح وَجهه وَمن نَتن رِيحه وَالَّذِي بَعثك بِالْحَقِّ لَو أَن حَلقَة من حلق سلسلة أهل النَّار الَّتِي نعت الله فِي كِتَابه وضعت على جبال الدُّنْيَا لأرفضت وَمَا تقارت حَتَّى يَنْتَهِي إِلَى الأَرْض السُّفْلى
فَقَالَ رَسُول الله صلى الله عَلَيْهِ وَسلم حسبي يَا جِبْرِيل لَا ينصدع قلبِي فأموت قَالَ فَنظر رَسُول الله صلى الله عَلَيْهِ وَسلم إِلَى جِبْرِيل وَهُوَ يبكي فَقَالَ تبْكي يَا جِبْرِيل وَأَنت من الله بِالْمَكَانِ الَّذِي أَنْت بِهِ فَقَالَ وَمَا لي لَا أبْكِي أَنا أَحَق بالبكاء لعَلي أكون فِي علم الله على غير الْحَال الَّتِي أَنا عَلَيْهَا وَمَا أَدْرِي لعَلي أبتلى بِمَا ابْتُلِيَ بِهِ إِبْلِيس فقد كَانَ من الْمَلَائِكَة وَمَا أَدْرِي لعَلي أبتلى بِمَا ابْتُلِيَ بِهِ هاروت وماروت
قَالَ فَبكى رَسُول الله صلى الله عَلَيْهِ وَسلم وَبكى جِبْرِيل عَلَيْهِ السَّلَام
فَمَا زَالا يَبْكِيَانِ حَتَّى نوديا أَن يَا جِبْرِيل وَيَا مُحَمَّد إِن الله عز وَجل قد أمنكما أَن تعصياه فارتفع جِبْرِيل عَلَيْهِ السَّلَام وَخرج رَسُول الله صلى الله عَلَيْهِ وَسلم فَمر بِقوم من الْأَنْصَار يَضْحَكُونَ ويلعبون فَقَالَ أتضحكون ووراءكم جَهَنَّم فَلَو تعلمُونَ مَا أعلم لضحكتم قَلِيلا ولبكيتم كثيرا وَلما أسغتم الطَّعَام وَالشرَاب ولخرجتم إِلَى الصعدات تجأرون إِلَى الله

رَوَاهُ الطَّبَرَانِيّ فِي الْأَوْسَط وَتقدم شرح بعض غَرِيبه فِي حَدِيث آخر فِي ذكر الْمَوْت

হাদীসের ব্যাখ্যা:

নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বেশি হাসাহাসি পসন্দ করতেন না। বেশি হাসিতে অন্তরে উদাসীনতা জন্ম নেয়। এক হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন لا تكثر الضحك، فإن كثرة الضحك تميت القلب "বেশি হাসবে না। কেননা হাসির আধিক্য অন্তরের মৃত্যু ঘটায়।”

একবার তিনি সাহাবায়ে কেরামের উদ্দেশ্যে এক হৃদয়গ্রাহী ভাষণ দেন। তাতে তিনি এই বলে তাদের উপদেশ দিয়েছিলেন যে (তোমরা যদি জানতে যা আমি জানি, তবে অবশ্যই তোমরা কম হাসতে এবং বেশি কাঁদতে)। অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা পাপীদের জন্য কী কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা রেখেছেন, কী কঠিন কিয়ামতের বিভীষিকা এবং কত কঠিন হাশরের ময়দানের পরিস্থিতি, তা আমি যেমনটা জানি তেমনি তোমরাও যদি জানতে, তবে অবশ্যই কম হাসতে এবং বেশি কাঁদতে। এক বর্ণনায় এরপর আছে
ولما ساغ لكم الطعام ولا الشراب، ولما نمتم على الفرش ولهجرتم النساء، ولخرجتم إلى الصعدات تجأرون
"তোমাদের কাছে পানাহার ভালো লাগত না। তোমরা বিছানায় ঘুমাতে পারতে না। তোমরা নারীদের থেকে দূরে থাকতে। তোমরা চিৎকার করতে করতে রাস্তাঘাটে বের হয়ে পড়তে।

হাদীছটি দ্বারা প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উম্মতকে পার্থিব জীবনযাপন সম্পর্কে এ দিকনির্দেশনা দিয়েছেন যে, দুনিয়া আনন্দে মেতে থাকার জায়গা নয়। তা থাকা উচিতও নয়। তার সামনে আখিরাত আছে। সেখানকার পরিস্থিতি বড় কঠিন। সে কঠিন পরিস্থিতির ব্যাপারে চিন্তিত থাকা উচিত। মনে ভয় রাখা উচিত। উচিত আল্লাহ তাআলার কাছে বেশি বেশি কাঁদা, যাতে তিনি সেখানে নাজাত দান করেন। যেন তিনি নিজ রহমতের ছায়ায় আশ্রয় দান করেন।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. ওয়াজ-নসীহতে হাসানো নয়; বরং কাঁদানোই প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের তরিকা।

খ. অল্প হাসি দোষের নয়, যদি অন্তরে আখিরাতের ভয় থাকে এবং সে ভয়ে ক্রন্দনও করা হয়।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান