মুসনাদে আহমদ- ইমাম আহমদ রহঃ (আল-ফাতহুর রব্বানী)

নেক আমল অর্জনে উৎসাহিত করা অধ্যায়

হাদীস নং: ১৫
নেক আমল অর্জনে উৎসাহিত করা অধ্যায়
পরিচ্ছেদ: সাধারণভাবে আনুগত্য ও নেক আমল করার জন্য উৎসাহ প্রদান
১৫. আবু যর (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, আল্লাহ তা'আলা বলেন, যে ব্যক্তি একটি নেক আমল করে, তার পরিবর্তে সে দশটি নেক আমলের ছাওয়াব পাবে অথবা তারও অধিক দেব। আর যে ব্যক্তি একটি খারাপ কাজ করে, তার পরিবর্তে সে একটি প্রতিদান পাবে অথবা তাকে ক্ষমা করা করে দেব। যে ব্যক্তি যমীন ভরে যায় এ পরিমাণ অপরাধের করেছে এবার সে আমার যাবে এ অবস্থায় সাক্ষাৎ করেছে যে, সে কোন প্রকার শিরক করেনি, তাবেগিয়ে যাই। আবে। আর যে যায়ে এমার দিকে আধ হাত এগিয়ে আসে, আমি তার দিকে এক হাত এগিয়ে যাই। আর যে আমার দিকে এক হাত এগিয়ে আসে, আমি তার দিকে দুই হাত এগিয়ে যাই, আর যখন সে আমার কাছে হেঁটে হেঁটে আসে, তখন আমি তার দিকে দৌড়িয়ে যাই।
كتاب الترغيب في صالح الأعمال
باب في الترغيب في أعمال البر والطاعة مطلقا
عن أبي ذر قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم يقول الله عز وجل من عمل حسنة فله عشر أمثاله أو أزيد ومن عمل سيئة فجزاؤه مثلها أو أغفر ومن عمل قراب (11) الأرض خطيئة ثم لقيني لا يشرك بي شيئا جعلت له مثلها مغفرة ومن اقترب إلي شبرا اقتربت إليه ذراعا ومن اقترب إلى ذراعا اقتربت إليه باعا ومن أتاني يمشي أتيته هرولة

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এ হাদীছে বর্ণিত বাক্যসমূহ দীর্ঘ একটি হাদীছের অংশ। পূর্ণ হাদীছটি এরকম-

قَالَ: قَالَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: " يَقُولُ اللَّهُ تَعَالَى: أَنَا عِنْدَ ظَنِّ عَبْدِي بِي، وَأَنَا مَعَهُ إِذَا ذَكَرَنِي، فَإِنْ ذَكَرَنِي فِي نَفْسِهِ ذَكَرْتُهُ فِي نَفْسِي، وَإِنْ ذَكَرَنِي فِي مَلَإٍ ذَكَرْتُهُ فِي مَلَإٍ خَيْرٍ مِنْهُمْ، وَإِنْ تَقَرَّبَ إِلَيَّ بِشِبْرٍ تَقَرَّبْتُ إِلَيْهِ ذِرَاعًا، وَإِنْ تَقَرَّبَ إِلَيَّ ذِرَاعًا تَقَرَّبْتُ إِلَيْهِ بَاعًا، وَإِنْ أَتَانِي يَمْشِي أَتَيْتُهُ هَرْوَلَةً "

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন যে, আল্লাহ তা'আলা বলেন, আমি বান্দার সঙ্গে আমার প্রতি তার ধারণার অনুরূপ আচরণ করি। এবং সে যখন আমাকে স্মরণ করে, তখন আমি তার সঙ্গে থাকি। সে যদি আমাকে মনে মনে স্মরণ করে, আমিও তাকে মনে মনে স্মরণ করি। সে যদি আমাকে সমাবেশে স্মরণ করে, তবে আমি তাকে এমন সমাবেশে স্মরণ করি, যা তার সমাবেশ অপেক্ষা উত্তম। আর বান্দা যখন আমার দিকে এক বিঘত এগিয়ে আসে, তখন আমি তার দিকে এক হাত এগিয়ে যাই। সে যখন আমার দিকে এক হাত এগিয়ে আসে, আমি তার দিকে দুই হাতের বিস্তার পরিমাণ এগিয়ে যাই। আর বান্দা যখন আমার দিকে হেঁটে আসে, আমি তার দিকে দৌঁড়ে যাই।সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৭৪০৫: সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ২৬৭৫: জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ২৩৮৮; সুনানে ইবন মাজাহ, হাদীছ নং ৩৮২৩; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ৯৩৫০
এ হাদীছ বান্দাকে আল্লাহর সম্পর্কে সুধারণা রাখতে উৎসাহ যোগায়। অর্থাৎ বান্দা যে নেক কাজই করে, বিশুদ্ধভাবে আদায়ে সচেষ্ট থাকার পাশাপাশি সে আশা রাখবে যে, আল্লাহ তা'আলা নিজ দয়ায় তা কবুল করে নেবেন। কোনও গুনাহ হয়ে গেলে খাঁটি মনে তাওবা করবে এবং আশা রাখবে যে, আল্লাহ তা'আলা নিজ রহমতে তার তাওবা কবুল করবেন। এরূপ সুধারণা রাখলে আল্লাহ তা'আলাও তার সঙ্গে অনুরূপ আচরণই করবেন। এটা একটা মূলনীতিস্বরূপ। হাদীছের পরবর্তী বাক্যসমূহ দ্বারা এর ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। তাতে দেখানো হয়েছে যে, বান্দা 'ইবাদত-বন্দেগীর মাধ্যমে তাঁর দিকে এগিয়ে গেলে আল্লাহ তা'আলা তার দিকে আরও দ্রুতগতিতে এগিয়ে আসেন। সুতরাং হে বান্দা! তুমি যত বড় পাপই কর না কেন, নিরাশ হয়ো না। আল্লাহর দিকে রুজু হও। তাঁর কাছে ক্ষমার আশা রাখ। অতীতে যত অলসতাই করো না কেন, এখন তৎপর হও। আর সময় নষ্ট না করে ইবাদতে মন দাও। তিনি তোমাকে ক্ষমা করবেন এবং কাছে টেনে নেবেন। নিচে হাদীছটির এস্থলে বর্ণিত অংশের ব্যাখ্যা দেওয়া যাচ্ছে।
تَقَرَّبَ -এর আক্ষরিক অর্থ নিকটবর্তী হওয়া। সাধারণত এর দ্বারা স্থানগতভাবে নিকটবর্তী হওয়া বোঝানো হয়। এ হাদীছে বলা হয়েছে, বান্দা আল্লাহর দিকে আধা হাত বা এক হাত এগিয়ে গেলে আল্লাহ বান্দার দিকে তার দ্বিগুণ পরিমাণ এগিয়ে আসেন। এমনিভাবে বান্দা আল্লাহর দিকে হেঁটে গেলে আল্লাহ বান্দার দিকে দৌড়ে আসেন। এর দ্বারা বাহ্যত স্থানগতভাবে এগিয়ে যাওয়াই বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু মুহাক্কিক “উলামায়ে কিরাম এ ব্যাপারে একমত যে, আল্লাহর সঙ্গে এরূপ স্থানগত নৈকট্য হতে পারে না। কেননা আল্লাহ এমন কোনও শারীরিক সত্তা নন, যিনি কোনও এক স্থানে অবস্থান করছেন, যেখান থেকে তিনি কারও দিকে এক-আধ হাত এগিয়ে আসবেন বা তার দিকে কেউ এক-আধ হাত এগিয়ে যাবে। কাজেই এ হাদীছে যে এগিয়ে যাওয়া ও নিকটবর্তী হওয়ার কথা বলা হয়েছে, তা দ্বারা স্থানগতভাবে এগিয়ে যাওয়া ও নিকটবর্তী হওয়া বোঝানো উদ্দেশ্য নয়; বরং এস্থলে تَقَرَّبَ শব্দটি রূপক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।
সুতরাং বান্দার পক্ষ থেকে আল্লাহর দিকে এগিয়ে যাওয়া মানে ‘ইবাদত-বন্দেগীর মাধ্যমে তাঁর সন্তুষ্টি, ভালোবাসা ও রহমতপ্রাপ্তির দিকে এগিয়ে যাওয়া, যাকে রূহানী ও আত্মিক নৈকট্য বলা হয়ে থাকে। এরূপ ক্ষেত্রে ‘নৈকট্য’ শব্দের ব্যবহার বাংলা ভাষায়ও আছে, যেমন বলা হয় অমুক আমার কাছের মানুষ। তার মানে সে তার স্নেহ-ভালোবাসার পাত্র এবং মনের দিক থেকে কাছের।
মানুষ তার কাছের ব্যক্তির প্রতি তার সাধ্যমত অনুগ্রহ প্রদর্শন করে থাকে। তারে নানাভাবে পুরস্কৃত করে ও উপহার-উপঢৌকন দেয়। অনুরূপ যে বান্দা আল্লাহর ইবাদত-আনুগত্যে লিপ্ত থাকে এবং নিজ অন্তকরণকে অজ্ঞতা, লোভলালসা, হিংসা- বিদ্বেষ প্রভৃতি নিন্দনীয় চরিত্র থেকে মুক্ত করতে সচেষ্ট থাকে, আল্লাহ তা'আলাও তার প্রতি তাঁর অসীম রহমতের ভাণ্ডার থেকে করুণাধারা বর্ষণ করে থাকেন এবং নিজ হিকমত, ‘ইলম, সহিষ্ণুতা, দয়া প্রভৃতি গুণাবলির একটা অংশ তাকে দান করে থাকেন। এভাবে বান্দা আপন যোগ্যতা মোতাবেক আল্লাহর গুণে গুণান্বিত হয়ে আধ্যাত্মিকভাবে তাঁর নৈকট্য অর্জন করে নেয়। সম্ভবত 'আধা হাত', 'এক হাত' প্রভৃতি পরিমাপ দ্বারা এরূপ নৈকট্যের বিভিন্ন স্তর বোঝানো হয়েছে।
আর আল্লাহর পক্ষ থেকে বান্দার দিকে এগিয়ে আসার মানে বান্দার প্রতি তাঁর সন্তুষ্ট হওয়া, তার প্রতি রহমত করা ও তার আমলের ছাওয়াব দেওয়া এবং উল্লিখিত আধ্যাত্মিক নৈকট্যের স্তরসমূহে তাকে উন্নীত করা। বান্দা যতবেশি আমল করে, সে ততবেশি আল্লাহর ভালোবাসা পায় এবং ততবেশি তাঁর সন্তুষ্টি ও রহমতের অধিকারী হয়ে নৈকট্যের উচ্চ থেকে উচ্চতর স্তরে উন্নতি লাভ করতে থাকে। বরং বান্দা যে আমল করে, সে তুলনায় আল্লাহর দান অনেক বেশি। তিনি বান্দার আমল অপেক্ষা ছাওয়াব ও পুরস্কার দেন অনেক বেশি। অন্ততপক্ষে দশগুণ।
এ হাদীছে যে বলা হয়েছে আল্লাহ বান্দার দিকে দৌড়ে আসেন, তার মানে অতিদ্রুত রহমত ও ছাওয়াব দান করেন। বান্দার পক্ষে হয়তো অলসতা হয়, আমল করতে দেরি করে, কিন্তু আল্লাহ ছাওয়াব লেখাতে কোনও দেরি করেন না।
এর দ্বারা তাওবা কবুল হওয়ার কথাও বোঝানো হতে পারে। বান্দার দ্বারা কোনও পাপ হয়ে যাওয়ার পর যদি সে লজ্জিত ও অনুতপ্ত হয় এবং খাঁটি মনে তাওবা করে, তবে খুব শীঘ্র তিনি তা কবুল করে নেন। বান্দার তাওবা করতে দেরি হলেও আল্লাহ ক্ষমা করতে দেরি করেন না।
আল্লাহ তা'আলা কতই না মেহেরবান! বান্দার সামান্য চেষ্টাকেও তিনি অনেক বেশি মূল্য দিয়ে থাকেন। তাঁর এ মেহেরবানীর দাবি, আমলের প্রতি আমাদের আরও বেশি যত্নবান হওয়া এবং অধিকতর সাধনা ও মুজাহাদার সাথে ‘ইবাদত-বন্দেগীতে সচেষ্ট থাকা। আল্লাহ তা'আলা আমাদের তাওফীক দান করুন- আমীন।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. এ হাদীছ দ্বারা বান্দার প্রতি আল্লাহ তা'আলা যে কতটা সদয়, সে সম্পর্কে ধারণা
পাওয়া যায়।

খ. বান্দার কর্তব্য আল্লাহর নৈকট্যলাভের জন্য তৎপর থাকা। বান্দা যত বেশি তৎপরতা দেখাতে পারবে, আল্লাহর পক্ষ থেকে ততোধিক তৎপরতায় সাড়া দেওয়া হবে।

গ. এ হাদীছ দ্বারা বোঝা যায়, আল্লাহ চান বান্দা তাঁর নৈকট্য অর্জনে সচেষ্ট থাকুক। সুতরাং সব অলসতা ঝেড়ে ফেলে এখনই আমাদের সে চেষ্টায় লেগে পড়া উচিত।

ঘ. এ হাদীছে পাপী ও পুণ্যবানের মধ্যে কোনও পার্থক্য করা হয়নি। যে-কেউ আল্লাহর পথে অগ্রসর হতে শুরু করে, আল্লাহ তাকেই কাছে টেনে নেন। সুতরাং পাপী ব্যক্তির জন্য এর মধ্যে অনেক বড় আশার বাণী আছে। সে খালেস মনে তাওবা করে পথ চলতে শুরু করলে অবশ্যই আল্লাহর নৈকট্য লাভ করতে সক্ষম হবে।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান