রিয়াযুস সালিহীন-ইমাম নববী রহঃ
رياض الصالحين من كلام سيد المرسلين
২. বিবিধ আদব - শিষ্টাচারের অধ্যায় - এর পরিচ্ছেদসমূহ
মোট হাদীস ২০ টি
হাদীস নং: ৬৮০
 বিবিধ আদব - শিষ্টাচারের অধ্যায়
দ্বিতীয় ভাগ : আদব ও শিষ্টাচার
পরিচ্ছেদ: ১ লজ্জাশীলতা, লজ্জাশীলতার ফযীলত এবং এ গুণে গুণান্বিত হওয়ার প্রতি উৎসাহদান
اَلْأَدب (আদব) অর্থ প্রশংসনীয় কর্মপন্থা। অর্থাৎ বিশ্বাস, কথা ও কাজে যে পদ্ধতি, রীতিনীতি ও ভাবভঙ্গি শরী'আতে প্রশংসনীয়, তাকে আদব বলা হয়। কথাটি এভাবেও বলা যায় যে, আকীদা-বিশ্বাস, কথা ও কাজে মুসলিম ব্যক্তির যে পন্থা অনুসরণ করা উচিত তাকে আদব বলে। এটা ওয়াজিবও হতে পারে, মুস্তাহাবও হতে পারে। করণীয় ক্ষেত্রেও হতে পারে, বর্জনীয় ক্ষেত্রেও হতে পারে।
আদবের সম্পর্ক রয়েছে আল্লাহ তা'আলার সঙ্গে, তাঁর কিতাবের সঙ্গে, তাঁর রাসূলের সঙ্গে, ব্যক্তির নিজের সঙ্গে এবং সমাজের সঙ্গে। এটা অতি ব্যাপক। জীবনের সকল ক্ষেত্র ও সকল কাজেই এটা প্রযোজ্য।
আদব আমাদের দীনী শিক্ষার এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। এর দ্বারা মানবজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে মুসলিম ব্যক্তির স্বাতন্ত্র্য প্রকাশ পায়। কেননা তার খাওয়া, পান করা, পোশাক পরা, অভিভাদন জানানো, অনুমতি চাওয়া, কথাবার্তা, হাসি-তামাশা, অভিনন্দন জানানো, শোক জ্ঞাপন, হাঁচি দেওয়া, হাই তোলা, ওঠাবসা, চলাফেরা, ঘুমানো, স্ত্রীর সঙ্গে আচরণ, আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে মেলামেশা, মজলিসে বসা, মজলিস ত্যাগ করা তথা জীবনসংশ্লিষ্ট প্রতিটি বিষয়ে রয়েছে তাৎপর্যপূর্ণ আদব-কায়দা। সে আদব-কায়দা রক্ষা করা হলে প্রতিটি কাজ হয় সুন্দর ও সুচারু। তা দ্বারা বোঝা যায় সে ব্যক্তি অন্য কোনও ধর্মের নয়; বরং ইসলামেরই অনুসারী।
আদব রক্ষার দ্বারা সমাজে ব্যক্তির নিজের মর্যাদা রক্ষা পায় এবং অন্যদের প্রতিও মর্যাদা প্রদর্শন করা হয়। এর দ্বারা সমাজে শান্তি রক্ষা হয়। সময়ে বরকত হয়। সবকিছুতে অপচয় রোধ হয়। পরস্পরের মধ্যে সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠিত হয়। মানুষের পার্থিব জীবন হয় শান্তিপূর্ণ এবং তার পরকাল হয় সাফল্যমণ্ডিত।
আমাদের ইসলাম আদব-কায়দার প্রতি বিশেষ গুরুত্বারোপ করেছে। আদবের শিক্ষায় কুরআন মাজীদ ও প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীছ ভরপুর। সেদিকে লক্ষ করলে ধারণা হয় যে, এ দীন আদবেরই দীন।
এ গুরুত্বের কারণে লক্ষ করা যায় প্রতিটি হাদীছগ্রন্থে ইসলামী আদব সম্পর্কে রয়েছে স্বতন্ত্র অধ্যায়। এ সম্পর্কে রচিত হয়েছে পৃথক বহু মূল্যবান গ্রন্থ। কিন্তু আফসোস! মুসলিমসমাজ ইসলামী আদবের এ গুরুত্ব প্রায় ভুলে যেতে বসেছে। সর্বত্র এর প্রতি প্রচণ্ড অবহেলা। আমাদের কর্মপন্থা লক্ষ করলে ধারণা জন্মায় ইসলামী শিক্ষায় আদবের বুঝি বিশেষ গুরুত্ব নেই। এটা যেন আমাদের দীনের অংশই নয়। এ কারণেই আজ কাজকর্ম ও আচার-আচরণে মুসলিম ব্যক্তিকে অন্যান্য ধর্মাবলম্বী থেকে পৃথক করে চেনা যায় না। তার অধিকাংশ কাজই সাক্ষ্য দেয় না যে, সে একজন মুসলিম। এটা তার সাংস্কৃতিক অধঃপতন। এ অধঃপতন জাতীয় অস্তিত্বের জন্যই হুমকিস্বরূপ। সুতরাং জাতীয় অস্তিত্বের সুরক্ষার জন্য এ অবস্থার পরিবর্তন দরকার। পরিবর্তন তখনই হবে, যখন আমরা ইসলামী আদব-কায়দার মূল্য বুঝব এবং গুরুত্বের সঙ্গে সকল ক্ষেত্রে তার অনুসরণে যত্নবান হব। রিয়াযুস সালেহীনের এ অধ্যায়টি ইসলামী আদব-কায়দা সম্পর্কেই। এতে মানবজীবনের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি ক্ষেত্র সম্পর্কিত ইসলামী আদব- কায়দা বিষয়ক হাদীছ তুলে ধরা হয়েছে। আমরা এ হাদীছগুলো মনোযোগ দিয়ে পড়ব এবং এ অনুযায়ী আমল করতে সচেষ্ট হব। আল্লাহ তা'আলা আমাদেরকে তাওফীক দান করুন।
লজ্জাশীলতা, লজ্জাশীলতার ফযীলত এবং এ গুণে গুণান্বিত হওয়ার প্রতি উৎসাহদান
الْحَيَاءُ অর্থ লজ্জাশীলতা। ইমাম রাগিব রহ. বলেন, মন্দ বিষয়াবলির কারণে অন্তরে সংকোচন ও জড়ত্ব দেখা দেওয়া এবং সে কারণে তা পরিত্যাগ করাকে الْحَيَاءُ (হায়া) বলে। জুনায়দ রহ. বলেন, একদিকে আল্লাহ তা'আলার নি'আমতরাজি, অপরদিকে নিজ ত্রুটি-বিচ্যুতি- এ উভয়ের প্রতি দৃষ্টিপাত করার দ্বারা অন্তরে যে অবস্থার সৃষ্টি হয়, সেটাই হায়া। এটা এমন এক চরিত্র, যা মানুষকে মন্দকাজ পরিত্যাগে উৎসাহ যোগায় এবং অন্যের হক আদায়ে শিথিলতা করা হতে বিরত রাখে।
বস্তুত হায়া বা লজ্জাশীলতা একটি মহৎ গুণ। মানুষের মনুষ্যত্ব রক্ষার জন্য এ গুণটি অপরিহার্য। এটি না থাকলে মানুষের মনুষ্যত্বের মৃত্যু ঘটে। তাই তো দেখা যায়, হায়াত (الْحَيَاةُ) ও হায়া শব্দদু'টি একই মূলধাতু থেকে উৎপন্ন। অর্থাৎ উভয়টি পরস্পর অবিচ্ছেদ্য। যার হায়াত বা জীবন আছে, তার হায়া বা লজ্জাশীলতাও থাকতে হবে। তা যার নেই, সে জীবিত থেকেও যেন মৃত।
এটি এমনই এক গুরুত্বপূর্ণ গুণ, যা জীবন্ত সত্তা আল্লাহ তা'আলার সঙ্গেও ব্যবহৃত হয়ে থাকে। যেমন এক হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-
إِنَّ رَبَّكُمْ تَبَارَكَ وَتَعَالَى حَييٌّ كَرِيمٌ ، يَسْتَحْيِي مِنْ عَبْدِهِ إِذَا رَفَعَ يَدَيْهِ إِلَيْهِ أَنْ يَرُدَّهُمَا صِفْرًا
‘তোমাদের মহান প্রতিপালক লজ্জাশীল, মহানুভব। বান্দা যখন তাঁর কাছে দু'হাত তোলে, তিনি তা খালি ফিরিয়ে দিতে লজ্জাবোধ করেন।(সুনানে আবু দাউদ: ১৪৮৮; জামে তিরমিযী: ৩৫৫৬; সুনানে ইবন মাজাহ ৩৮৬৫; মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাক ৩২৫০; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর ১৩৫৫৭; হামিক, আল মুস্তাদরাক: ১৮৩১)
অপর একটি হাদীছ দ্বারা এ গুণটির গুরুত্ব উপলব্ধি করা যায়। তাতে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
إِنَّ لِكُلِّ دِيْنِ خُلُقًا، وَخُلُقُ الْإِسْلَامِ الْحَيَاء
‘প্রত্যেক দীনের এক বিশেষ চরিত্র আছে। ইসলামের সে চরিত্র হল লজ্জাশীলতা।(সুনানে ইবন মাজাহ: ৪১৮১; মুআত্তা মালিক: ৩৩৫১; মুসনাদু ইবনিল জা'দ : ২৮৭৭; তাবারানী, আল মু'জামুস সগীর: ১৩; শু'আবুল ঈমান: ৭৩১৪; মুসনাদে আবূ ইয়া'লা : ৩৫৭৩)
উল্লেখ্য, মানুষের লজ্জা দু'প্রকার। এক লজ্জা জন্মগত বা স্বভাবগত। মানুষের স্বভাবগত গুণাবলির মধ্যে এটি শ্রেষ্ঠ। এটি মুসলিম-অমুসলিম যে-কারও মধ্যেই থাকতে পারে। এ গুণ মানুষকে মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখে এবং ভালো কাজে উৎসাহ যোগায়।
আরেক লজ্জা হল সাধনালব্ধ। অর্থাৎ যা চেষ্টা ও সাধনা দ্বারা অর্জন করা হয়। যে ব্যক্তি আল্লাহ তা'আলার শ্রেষ্ঠত্ব, বড়ত্ব ও নৈকট্য সম্পর্কে জানে, তাঁর রহমত ও দয়া, তাঁর অনুগ্রহ ও নি'আমতরাশি সম্পর্কে সচেতন এবং এ বিষয়েও সচেতন যে, তিনি বান্দার যাবতীয় কাজকর্ম ও আচার-আচরণের উপর দৃষ্টি রাখেন, বান্দার চোখের চোরাচাহনি সম্পর্কেও তিনি অবগত এবং তিনি তার মনে কী আছে তাও পরিপূর্ণরূপে জানেন, স্বাভাবিকভাবেই তার আল্লাহর নাফরমানি করতে লজ্জাবোধ হবে। বান্দা যখন নিয়মিতভাবে তাঁর এ গুণের ধ্যান করবে আর এভাবে যথেষ্ট পরিমাণে তাঁর মা'রিফাত হাসিল হয়ে যাবে, তখন তার অন্তরে আল্লাহ তা'আলার প্রতি লজ্জাবোধ এমন বদ্ধমূল হয়ে যাবে যে, সে সহজে তাঁর নাফরমানি করতে প্রস্তুত হবে না; বরং সর্বদা তাঁর আনুগত্যমূলক কাজকর্ম করার প্রতি উৎসাহবোধ করবে। আল্লাহ তা'আলার মা'রিফাত ও তাঁর সম্পর্কে জানার ভিত্তিতে এই যে লজ্জাশীলতা অন্তরে জন্ম নেয়, এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটা ঈমানের এক গুরুত্বপূর্ণ শাখা। ইসলাম এ প্রকারের লজ্জাশীলতা অর্জন ও অবলম্বনের প্রতি বিশেষভাবে উৎসাহ প্রদান করেছে। এ সম্পর্কে বহু হাদীছ আছে। ইমাম নববী রহ. এ পরিচ্ছেদে তা থেকে কয়েকটি হাদীছ উদ্ধৃত করেছেন। আমরা তার বঙ্গানুবাদ ও সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা পেশ করছি। আল্লাহ তা'আলাই তাওফীকদাতা।
পরিচ্ছেদ: ১ লজ্জাশীলতা, লজ্জাশীলতার ফযীলত এবং এ গুণে গুণান্বিত হওয়ার প্রতি উৎসাহদান
اَلْأَدب (আদব) অর্থ প্রশংসনীয় কর্মপন্থা। অর্থাৎ বিশ্বাস, কথা ও কাজে যে পদ্ধতি, রীতিনীতি ও ভাবভঙ্গি শরী'আতে প্রশংসনীয়, তাকে আদব বলা হয়। কথাটি এভাবেও বলা যায় যে, আকীদা-বিশ্বাস, কথা ও কাজে মুসলিম ব্যক্তির যে পন্থা অনুসরণ করা উচিত তাকে আদব বলে। এটা ওয়াজিবও হতে পারে, মুস্তাহাবও হতে পারে। করণীয় ক্ষেত্রেও হতে পারে, বর্জনীয় ক্ষেত্রেও হতে পারে।
আদবের সম্পর্ক রয়েছে আল্লাহ তা'আলার সঙ্গে, তাঁর কিতাবের সঙ্গে, তাঁর রাসূলের সঙ্গে, ব্যক্তির নিজের সঙ্গে এবং সমাজের সঙ্গে। এটা অতি ব্যাপক। জীবনের সকল ক্ষেত্র ও সকল কাজেই এটা প্রযোজ্য।
আদব আমাদের দীনী শিক্ষার এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। এর দ্বারা মানবজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে মুসলিম ব্যক্তির স্বাতন্ত্র্য প্রকাশ পায়। কেননা তার খাওয়া, পান করা, পোশাক পরা, অভিভাদন জানানো, অনুমতি চাওয়া, কথাবার্তা, হাসি-তামাশা, অভিনন্দন জানানো, শোক জ্ঞাপন, হাঁচি দেওয়া, হাই তোলা, ওঠাবসা, চলাফেরা, ঘুমানো, স্ত্রীর সঙ্গে আচরণ, আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে মেলামেশা, মজলিসে বসা, মজলিস ত্যাগ করা তথা জীবনসংশ্লিষ্ট প্রতিটি বিষয়ে রয়েছে তাৎপর্যপূর্ণ আদব-কায়দা। সে আদব-কায়দা রক্ষা করা হলে প্রতিটি কাজ হয় সুন্দর ও সুচারু। তা দ্বারা বোঝা যায় সে ব্যক্তি অন্য কোনও ধর্মের নয়; বরং ইসলামেরই অনুসারী।
আদব রক্ষার দ্বারা সমাজে ব্যক্তির নিজের মর্যাদা রক্ষা পায় এবং অন্যদের প্রতিও মর্যাদা প্রদর্শন করা হয়। এর দ্বারা সমাজে শান্তি রক্ষা হয়। সময়ে বরকত হয়। সবকিছুতে অপচয় রোধ হয়। পরস্পরের মধ্যে সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠিত হয়। মানুষের পার্থিব জীবন হয় শান্তিপূর্ণ এবং তার পরকাল হয় সাফল্যমণ্ডিত।
আমাদের ইসলাম আদব-কায়দার প্রতি বিশেষ গুরুত্বারোপ করেছে। আদবের শিক্ষায় কুরআন মাজীদ ও প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীছ ভরপুর। সেদিকে লক্ষ করলে ধারণা হয় যে, এ দীন আদবেরই দীন।
এ গুরুত্বের কারণে লক্ষ করা যায় প্রতিটি হাদীছগ্রন্থে ইসলামী আদব সম্পর্কে রয়েছে স্বতন্ত্র অধ্যায়। এ সম্পর্কে রচিত হয়েছে পৃথক বহু মূল্যবান গ্রন্থ। কিন্তু আফসোস! মুসলিমসমাজ ইসলামী আদবের এ গুরুত্ব প্রায় ভুলে যেতে বসেছে। সর্বত্র এর প্রতি প্রচণ্ড অবহেলা। আমাদের কর্মপন্থা লক্ষ করলে ধারণা জন্মায় ইসলামী শিক্ষায় আদবের বুঝি বিশেষ গুরুত্ব নেই। এটা যেন আমাদের দীনের অংশই নয়। এ কারণেই আজ কাজকর্ম ও আচার-আচরণে মুসলিম ব্যক্তিকে অন্যান্য ধর্মাবলম্বী থেকে পৃথক করে চেনা যায় না। তার অধিকাংশ কাজই সাক্ষ্য দেয় না যে, সে একজন মুসলিম। এটা তার সাংস্কৃতিক অধঃপতন। এ অধঃপতন জাতীয় অস্তিত্বের জন্যই হুমকিস্বরূপ। সুতরাং জাতীয় অস্তিত্বের সুরক্ষার জন্য এ অবস্থার পরিবর্তন দরকার। পরিবর্তন তখনই হবে, যখন আমরা ইসলামী আদব-কায়দার মূল্য বুঝব এবং গুরুত্বের সঙ্গে সকল ক্ষেত্রে তার অনুসরণে যত্নবান হব। রিয়াযুস সালেহীনের এ অধ্যায়টি ইসলামী আদব-কায়দা সম্পর্কেই। এতে মানবজীবনের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি ক্ষেত্র সম্পর্কিত ইসলামী আদব- কায়দা বিষয়ক হাদীছ তুলে ধরা হয়েছে। আমরা এ হাদীছগুলো মনোযোগ দিয়ে পড়ব এবং এ অনুযায়ী আমল করতে সচেষ্ট হব। আল্লাহ তা'আলা আমাদেরকে তাওফীক দান করুন।
লজ্জাশীলতা, লজ্জাশীলতার ফযীলত এবং এ গুণে গুণান্বিত হওয়ার প্রতি উৎসাহদান
الْحَيَاءُ অর্থ লজ্জাশীলতা। ইমাম রাগিব রহ. বলেন, মন্দ বিষয়াবলির কারণে অন্তরে সংকোচন ও জড়ত্ব দেখা দেওয়া এবং সে কারণে তা পরিত্যাগ করাকে الْحَيَاءُ (হায়া) বলে। জুনায়দ রহ. বলেন, একদিকে আল্লাহ তা'আলার নি'আমতরাজি, অপরদিকে নিজ ত্রুটি-বিচ্যুতি- এ উভয়ের প্রতি দৃষ্টিপাত করার দ্বারা অন্তরে যে অবস্থার সৃষ্টি হয়, সেটাই হায়া। এটা এমন এক চরিত্র, যা মানুষকে মন্দকাজ পরিত্যাগে উৎসাহ যোগায় এবং অন্যের হক আদায়ে শিথিলতা করা হতে বিরত রাখে।
বস্তুত হায়া বা লজ্জাশীলতা একটি মহৎ গুণ। মানুষের মনুষ্যত্ব রক্ষার জন্য এ গুণটি অপরিহার্য। এটি না থাকলে মানুষের মনুষ্যত্বের মৃত্যু ঘটে। তাই তো দেখা যায়, হায়াত (الْحَيَاةُ) ও হায়া শব্দদু'টি একই মূলধাতু থেকে উৎপন্ন। অর্থাৎ উভয়টি পরস্পর অবিচ্ছেদ্য। যার হায়াত বা জীবন আছে, তার হায়া বা লজ্জাশীলতাও থাকতে হবে। তা যার নেই, সে জীবিত থেকেও যেন মৃত।
এটি এমনই এক গুরুত্বপূর্ণ গুণ, যা জীবন্ত সত্তা আল্লাহ তা'আলার সঙ্গেও ব্যবহৃত হয়ে থাকে। যেমন এক হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-
إِنَّ رَبَّكُمْ تَبَارَكَ وَتَعَالَى حَييٌّ كَرِيمٌ ، يَسْتَحْيِي مِنْ عَبْدِهِ إِذَا رَفَعَ يَدَيْهِ إِلَيْهِ أَنْ يَرُدَّهُمَا صِفْرًا
‘তোমাদের মহান প্রতিপালক লজ্জাশীল, মহানুভব। বান্দা যখন তাঁর কাছে দু'হাত তোলে, তিনি তা খালি ফিরিয়ে দিতে লজ্জাবোধ করেন।(সুনানে আবু দাউদ: ১৪৮৮; জামে তিরমিযী: ৩৫৫৬; সুনানে ইবন মাজাহ ৩৮৬৫; মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাক ৩২৫০; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর ১৩৫৫৭; হামিক, আল মুস্তাদরাক: ১৮৩১)
অপর একটি হাদীছ দ্বারা এ গুণটির গুরুত্ব উপলব্ধি করা যায়। তাতে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
إِنَّ لِكُلِّ دِيْنِ خُلُقًا، وَخُلُقُ الْإِسْلَامِ الْحَيَاء
‘প্রত্যেক দীনের এক বিশেষ চরিত্র আছে। ইসলামের সে চরিত্র হল লজ্জাশীলতা।(সুনানে ইবন মাজাহ: ৪১৮১; মুআত্তা মালিক: ৩৩৫১; মুসনাদু ইবনিল জা'দ : ২৮৭৭; তাবারানী, আল মু'জামুস সগীর: ১৩; শু'আবুল ঈমান: ৭৩১৪; মুসনাদে আবূ ইয়া'লা : ৩৫৭৩)
উল্লেখ্য, মানুষের লজ্জা দু'প্রকার। এক লজ্জা জন্মগত বা স্বভাবগত। মানুষের স্বভাবগত গুণাবলির মধ্যে এটি শ্রেষ্ঠ। এটি মুসলিম-অমুসলিম যে-কারও মধ্যেই থাকতে পারে। এ গুণ মানুষকে মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখে এবং ভালো কাজে উৎসাহ যোগায়।
আরেক লজ্জা হল সাধনালব্ধ। অর্থাৎ যা চেষ্টা ও সাধনা দ্বারা অর্জন করা হয়। যে ব্যক্তি আল্লাহ তা'আলার শ্রেষ্ঠত্ব, বড়ত্ব ও নৈকট্য সম্পর্কে জানে, তাঁর রহমত ও দয়া, তাঁর অনুগ্রহ ও নি'আমতরাশি সম্পর্কে সচেতন এবং এ বিষয়েও সচেতন যে, তিনি বান্দার যাবতীয় কাজকর্ম ও আচার-আচরণের উপর দৃষ্টি রাখেন, বান্দার চোখের চোরাচাহনি সম্পর্কেও তিনি অবগত এবং তিনি তার মনে কী আছে তাও পরিপূর্ণরূপে জানেন, স্বাভাবিকভাবেই তার আল্লাহর নাফরমানি করতে লজ্জাবোধ হবে। বান্দা যখন নিয়মিতভাবে তাঁর এ গুণের ধ্যান করবে আর এভাবে যথেষ্ট পরিমাণে তাঁর মা'রিফাত হাসিল হয়ে যাবে, তখন তার অন্তরে আল্লাহ তা'আলার প্রতি লজ্জাবোধ এমন বদ্ধমূল হয়ে যাবে যে, সে সহজে তাঁর নাফরমানি করতে প্রস্তুত হবে না; বরং সর্বদা তাঁর আনুগত্যমূলক কাজকর্ম করার প্রতি উৎসাহবোধ করবে। আল্লাহ তা'আলার মা'রিফাত ও তাঁর সম্পর্কে জানার ভিত্তিতে এই যে লজ্জাশীলতা অন্তরে জন্ম নেয়, এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটা ঈমানের এক গুরুত্বপূর্ণ শাখা। ইসলাম এ প্রকারের লজ্জাশীলতা অর্জন ও অবলম্বনের প্রতি বিশেষভাবে উৎসাহ প্রদান করেছে। এ সম্পর্কে বহু হাদীছ আছে। ইমাম নববী রহ. এ পরিচ্ছেদে তা থেকে কয়েকটি হাদীছ উদ্ধৃত করেছেন। আমরা তার বঙ্গানুবাদ ও সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা পেশ করছি। আল্লাহ তা'আলাই তাওফীকদাতা।
লজ্জাশীলতার প্রতি উৎসাহদান
হাদীছ নং: ৬৮০
হযরত আব্দুল্লাহ ইবন উমর রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জনৈক আনসারী ব্যক্তির নিকট দিয়ে যাচ্ছিলেন। সে তখন তার ভাইকে লজ্জাশীলতার জন্য তিরস্কার করছিল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তাকে ছাড়ো। লজ্জাশীলতা তো ঈমানের অঙ্গ। -বুখারী ও মুসলিম
(সহীহ বুখারী: ২৪; সহীহ মুসলিম: ৩৬; মুসনাদে আহমাদ: ৫১৮২; সুনানে নাসাঈ: ৫০৩৩; সুনানে আবু দাউদ: ৪৭৯৫; তহাবী, শারহু মুশকিলিল আছার: ১৫২৭; খারাইতী, মাকারিমুল আখলাক: ২৯৬; সহীহ ইবনে হিব্বান ৬১০; তাবারানী, আল মু'জামুল আওসাত: ৪৯৩২)
হাদীছ নং: ৬৮০
হযরত আব্দুল্লাহ ইবন উমর রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জনৈক আনসারী ব্যক্তির নিকট দিয়ে যাচ্ছিলেন। সে তখন তার ভাইকে লজ্জাশীলতার জন্য তিরস্কার করছিল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তাকে ছাড়ো। লজ্জাশীলতা তো ঈমানের অঙ্গ। -বুখারী ও মুসলিম
(সহীহ বুখারী: ২৪; সহীহ মুসলিম: ৩৬; মুসনাদে আহমাদ: ৫১৮২; সুনানে নাসাঈ: ৫০৩৩; সুনানে আবু দাউদ: ৪৭৯৫; তহাবী, শারহু মুশকিলিল আছার: ১৫২৭; খারাইতী, মাকারিমুল আখলাক: ২৯৬; সহীহ ইবনে হিব্বান ৬১০; তাবারানী, আল মু'জামুল আওসাত: ৪৯৩২)
كتاب الأدب
كتاب الأدب 
باب الحياء وفضله والحث على التخلق به
باب الحياء وفضله والحث على التخلق به
680 - عن ابن عمر رضي الله عنهما: أنَّ رسول الله - صلى الله عليه وسلم - مَرَّ عَلَى رَجُلٍ مِنَ الأنْصَار وَهُوَ يَعِظُ أخَاهُ في الحَيَاءِ، فَقَالَ رسولُ اللهِ - صلى الله عليه وسلم: «دَعْهُ، فَإنَّ الْحَيَاءَ مِنَ الإيمَانِ». متفقٌ عَلَيْهِ. (1)

তাহকীক:
 হাদীসের ব্যাখ্যা
হাদীসের ব্যাখ্যাহাদীস নং: ৬৮১
 বিবিধ আদব - শিষ্টাচারের অধ্যায়
১ লজ্জাশীলতা, লজ্জাশীলতার ফযীলত এবং এ গুণে গুণান্বিত হওয়ার প্রতি উৎসাহদান
লজ্জাশীলতার কল্যাণকরতা
হাদীছ নং: ৬৮১
হযরত ইমরান ইবন হুসায়ন রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, লজ্জাশীলতা কেবল কল্যাণই বয়ে আনে। -বুখারী ও মুসলিম
মুসলিমের এক বর্ণনায় আছে, লজ্জাশীলতার পুরোটাই কল্যাণ।
(সহীহ বুখারী: ৬১১৭; সহীহ মুসলিম: ৩৭; সুনানে আবু দাউদ: ৪৭৯৬; আবু দাউদ তয়ালিসী: ৮৯৩; আল-আদাবুল মুফরাদ: ১৩১২; তাবারানী আল মু'জামুল কাবীর ৫০৫; বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান: ৭৩০৪; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ: ৩৫৯৭; মুসনাদে আহমাদ: ১৯৮১৭)
হাদীছ নং: ৬৮১
হযরত ইমরান ইবন হুসায়ন রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, লজ্জাশীলতা কেবল কল্যাণই বয়ে আনে। -বুখারী ও মুসলিম
মুসলিমের এক বর্ণনায় আছে, লজ্জাশীলতার পুরোটাই কল্যাণ।
(সহীহ বুখারী: ৬১১৭; সহীহ মুসলিম: ৩৭; সুনানে আবু দাউদ: ৪৭৯৬; আবু দাউদ তয়ালিসী: ৮৯৩; আল-আদাবুল মুফরাদ: ১৩১২; তাবারানী আল মু'জামুল কাবীর ৫০৫; বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান: ৭৩০৪; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ: ৩৫৯৭; মুসনাদে আহমাদ: ১৯৮১৭)
كتاب الأدب
باب الحياء وفضله والحث على التخلق به
681 - وعن عمران بن حصينٍ رضي الله عنهما، قَالَ: قَالَ رسولُ الله - صلى الله عليه وسلم: «الْحَيَاءُ لاَ يَأْتِي إِلاَّ بِخَيْرٍ». متفقٌ عَلَيْهِ. (1)
وفي رواية لمسلمٍ: «الحياءُ خَيْرٌ كُلُّهُ» أَوْ قَالَ: «الْحَيَاءُ كُلُّهُ خَيْرٌ».
وفي رواية لمسلمٍ: «الحياءُ خَيْرٌ كُلُّهُ» أَوْ قَالَ: «الْحَيَاءُ كُلُّهُ خَيْرٌ».

তাহকীক:
 হাদীসের ব্যাখ্যা
হাদীসের ব্যাখ্যাহাদীস নং: ৬৮২
 বিবিধ আদব - শিষ্টাচারের অধ্যায়
১ লজ্জাশীলতা, লজ্জাশীলতার ফযীলত এবং এ গুণে গুণান্বিত হওয়ার প্রতি উৎসাহদান
ঈমানের শাখা হিসেবে লজ্জাশীলতার গুরুত্ব
হাদীছ নং: ৬৮২
হযরত আবূ হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ঈমানের সত্তরটির বেশি অথবা ষাটটির বেশি শাখা আছে। তার মধ্যে সর্বোত্তমটি হল লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু বলা এবং সর্বনিম্নটি হল রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক বস্তু সরিয়ে দেওয়া। আর লজ্জাশীলতা ঈমানের এক গুরুত্বপূর্ণ শাখা। -বুখারী ও মুসলিম
(সহীহ বুখারী: ৯; সহীহ মুসলিম: ৩৫; সুনানে আবু দাউদ: ৪৬৭৬; জামে তিরমিযী: ২৮০১; সুনানে নাসাঈ: ৫০০৪; সুনানে ইবন মাজাহ ৫৭; মুসনাদে আহমাদ: ৮৯২৬; সহীহ ইবনে হিব্বান : ১৬৬; মুসনাদুল বাযযার: ৮৯৭৪; তাবারানী, আল মু'জামুল আওসাত : ৬৯৬২; শু'আবুল ঈমান : ৩)
হাদীছ নং: ৬৮২
হযরত আবূ হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ঈমানের সত্তরটির বেশি অথবা ষাটটির বেশি শাখা আছে। তার মধ্যে সর্বোত্তমটি হল লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু বলা এবং সর্বনিম্নটি হল রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক বস্তু সরিয়ে দেওয়া। আর লজ্জাশীলতা ঈমানের এক গুরুত্বপূর্ণ শাখা। -বুখারী ও মুসলিম
(সহীহ বুখারী: ৯; সহীহ মুসলিম: ৩৫; সুনানে আবু দাউদ: ৪৬৭৬; জামে তিরমিযী: ২৮০১; সুনানে নাসাঈ: ৫০০৪; সুনানে ইবন মাজাহ ৫৭; মুসনাদে আহমাদ: ৮৯২৬; সহীহ ইবনে হিব্বান : ১৬৬; মুসনাদুল বাযযার: ৮৯৭৪; তাবারানী, আল মু'জামুল আওসাত : ৬৯৬২; শু'আবুল ঈমান : ৩)
كتاب الأدب
باب الحياء وفضله والحث على التخلق به
682 - وعن أَبي هريرة - رضي الله عنه: أنَّ رسول الله - صلى الله عليه وسلم - قَالَ: «الإيمَانُ بِضْعٌ وَسَبْعُونَ أَوْ بِضْعٌ وَسِتُّونَ شُعْبَةً: فَأفْضَلُهَا قَوْلُ: لاَ إلهَ إِلاَّ الله، وَأدْنَاهَا إمَاطَةُ الأَذَى عَنِ الطَّرِيقِ، وَالحَيَاءُ شُعْبَةٌ مِنَ الإيمَانِ». متفقٌ عَلَيْهِ. (1)
«البِضْعُ» بكسر الباءِ ويجوز فتحها: وَهُوَ مِنَ الثَّلاَثَةِ إِلَى الْعَشَرَةِ.
وَ «الشُّعْبَةُ»: القِطْعَةُ وَالْخَصْلَةُ. وَ «الإمَاطَةُ»: الإزَالَةُ. وَ «الأَذَى»: مَا يُؤْذِي كَحَجَرٍ وشوك وَطِينٍ ورماد وَقَذَرٍ وَنَحْو ذَلِكَ.
«البِضْعُ» بكسر الباءِ ويجوز فتحها: وَهُوَ مِنَ الثَّلاَثَةِ إِلَى الْعَشَرَةِ.
وَ «الشُّعْبَةُ»: القِطْعَةُ وَالْخَصْلَةُ. وَ «الإمَاطَةُ»: الإزَالَةُ. وَ «الأَذَى»: مَا يُؤْذِي كَحَجَرٍ وشوك وَطِينٍ ورماد وَقَذَرٍ وَنَحْو ذَلِكَ.

তাহকীক:
 হাদীসের ব্যাখ্যা
হাদীসের ব্যাখ্যাহাদীস নং: ৬৮৩
 বিবিধ আদব - শিষ্টাচারের অধ্যায়
১ লজ্জাশীলতা, লজ্জাশীলতার ফযীলত এবং এ গুণে গুণান্বিত হওয়ার প্রতি উৎসাহদান
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের লজ্জাশীলতা
হাদীছ নং: ৬৮৩
হযরত আবূ সা'ঈদ খুদরী রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অন্তঃপুরবাসিনী কুমারী মেয়েদের চেয়েও বেশি লজ্জাশীল ছিলেন। তিনি যখন এমন কোনও বিষয় দেখতেন যা তাঁর পসন্দ হতো না, তখন আমরা তাঁর চেহারা দেখে তা বুঝতে পারতাম।-বুখারী ও মুসলিম
(সহীহ বুখারী : ৩৫৬২; সহীহ মুসলিম: ২৩০২; মুসনাদে আবূ দাউদ তয়ালিসী: ২৩৩৬; মুসান্নাফে ইবন আবী শায়বা ২৫৩৪৬; সহীহ ইবনে হিব্বান ৬৩০৪; মুসনাদুল বাযযার: ৭১২৪; মুসনাদে আবু ইয়া'লা: ৯৯১; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর: ৫০৮; শু'আবুল ঈমান : ৭৩৩৬)
হাদীছ নং: ৬৮৩
হযরত আবূ সা'ঈদ খুদরী রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অন্তঃপুরবাসিনী কুমারী মেয়েদের চেয়েও বেশি লজ্জাশীল ছিলেন। তিনি যখন এমন কোনও বিষয় দেখতেন যা তাঁর পসন্দ হতো না, তখন আমরা তাঁর চেহারা দেখে তা বুঝতে পারতাম।-বুখারী ও মুসলিম
(সহীহ বুখারী : ৩৫৬২; সহীহ মুসলিম: ২৩০২; মুসনাদে আবূ দাউদ তয়ালিসী: ২৩৩৬; মুসান্নাফে ইবন আবী শায়বা ২৫৩৪৬; সহীহ ইবনে হিব্বান ৬৩০৪; মুসনাদুল বাযযার: ৭১২৪; মুসনাদে আবু ইয়া'লা: ৯৯১; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর: ৫০৮; শু'আবুল ঈমান : ৭৩৩৬)
كتاب الأدب
باب الحياء وفضله والحث على التخلق به
683 - وعن أَبي سعيدٍ الخدري - رضي الله عنه - قَالَ: كَانَ رسول الله - صلى الله عليه وسلم - أشَدَّ حَيَاءً مِنَ العَذْرَاءِ في خِدْرِهَا، فَإذَا رَأَى شَيْئًا يَكْرَهُهُ عَرَفْنَاهُ في وَجْهِه. متفقٌ عَلَيْهِ. (1) [ص:220]
قَالَ العلماءُ: حَقِيقَةُ الحَيَاءِ خُلُقٌ يَبْعَثُ عَلَى تَرْكِ القَبِيحِ، وَيَمْنَعُ مِنَ التَّقْصِيرِ في حَقِّ ذِي الحَقِّ. وَرَوَيْنَا عَنْ أَبي القاسم الْجُنَيْدِ رَحِمَهُ اللهُ، قَالَ: الحَيَاءُ: رُؤيَةُ الآلاءِ - أيْ النِّعَمِ - ورُؤْيَةُ التَّقْصِيرِ، فَيَتَوَلَّدُ بَيْنَهُمَا حَالَةٌ تُسَمَّى حَيَاءً (2). وَالله أعلم.
قَالَ العلماءُ: حَقِيقَةُ الحَيَاءِ خُلُقٌ يَبْعَثُ عَلَى تَرْكِ القَبِيحِ، وَيَمْنَعُ مِنَ التَّقْصِيرِ في حَقِّ ذِي الحَقِّ. وَرَوَيْنَا عَنْ أَبي القاسم الْجُنَيْدِ رَحِمَهُ اللهُ، قَالَ: الحَيَاءُ: رُؤيَةُ الآلاءِ - أيْ النِّعَمِ - ورُؤْيَةُ التَّقْصِيرِ، فَيَتَوَلَّدُ بَيْنَهُمَا حَالَةٌ تُسَمَّى حَيَاءً (2). وَالله أعلم.

তাহকীক:
 হাদীসের ব্যাখ্যা
হাদীসের ব্যাখ্যাহাদীস নং: ৬৮৪
 বিবিধ আদব - শিষ্টাচারের অধ্যায়
গোপন বিষয়ের গোপনীয়তা রক্ষা করা
অন্যের গোপনীয় বিষয় আমানতস্বরূপ। তা প্রকাশ করলে আমানতের খেয়ানত হয়। খেয়ানত করা জায়েয নয়। তাই অন্যের গোপনীয় বিষয় প্রকাশ করাও জায়েয নয়। এ ক্ষেত্রে আপন-পর, শত্রু-মিত্রের মধ্যে কোনও ভেদাভেদ নেই। স্বামী-স্ত্রীরও কর্তব্য পরস্পরের গোপন বিষয় গোপন রাখা। এমনিভাবে শত্রুরও কোনও গোপন বিষয় জানতে পারলে তা প্রকাশ করে দেওয়া বৈধ নয়।
অন্যের গোপনীয় বিষয় যেভাবে জানতে পারা যাক, তা গোপন রাখা কর্তব্য। গোপনীয় বিষয়টি যার, সে তাকে সরাসরি তা বলুক বা অন্য কোনও উপায়ে জানতে পারুক। যেমন অন্যের কোনও গোপন বিষয় কারও চোখে পড়ে গেল। বিষয়টি যার, সে কিছুতেই চায় না অন্য কেউ তা জানতে পারুক। জানলে হয়তো তার মান-সম্মান নষ্ট হবে বা অন্য কোনও ক্ষতি হবে। এ অবস্থায় যার চোখে তা পড়ল তার জন্য তা প্রকাশ করা কিছুতেই জায়েয হবে না। তা প্রকাশ করা যেমন আমানতের খেয়ানত, তেমনি এক রকম চোগলখোরিও বটে। চোগলখোরি করাও মহাপাপ। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
لَا يَدْخُلُ الْجَنَّةَ قَتَّاتٌ
‘চোগলখোর জান্নাতে প্রবেশ করবে না।
(সহীহ বুখারী: ৬০৫৬; সহীহ মুসলিম: ১০৫; সুনানে আবু দাউদ: ৪৮৭১; জামে' তিরমিযী: ২০২৬; নাসাঈ, আস সুনানুল কুবরা ১১৫৫০; সহীহ ইবনে হিব্বান ৫৭৬৫; মুসনাদে আবূ দাউদ তয়ালিসী ৪২২; মুসান্নাফে ইবন আবী শায়বা: ২৬৫৮৫; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর: ৩০২১)
মজলিসে যেসব গোপন আলোচনা হয়, তাও সকলের জন্য আমানত। কারও জন্যই তা প্রকাশ করা জায়েয নয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন- إِنَّمَا يُجَالِسُ الْمُتَجَالِسَوْنَ بِأَمَانَةِ اللَّهِ، فَلَا يَحِلُّ لِأَحَدٍ أَنْ يُفْشِيَ عَنْ صَاحِبِهِ مَا يَكْرَهُ 'বৈঠকে অংশগ্রহণকারীগণ আল্লাহ তা'আলার আমানতের সঙ্গেই অংশগ্রহণ করে। সুতরাং তাদের কারও জন্যই অন্যে যা অপসন্দ করে তা প্রকাশ করা বৈধ নয়।(জামে' মা'মার ইবন রাশিদ: ১৯৭৯১)
অবশ্য মজলিসে যদি অন্যের কোনও অধিকার খর্ব করা সম্পর্কে আলোচনা করা হয় এবং সে সম্পর্কে কোনও পরিকল্পনাও নেওয়া হয়, তবে তা প্রকাশ করাই জরুরি। সুতরাং এক হাদীছে ইরশাদ হয়েছে- الْمَجَالِسُ بِالْأَمَانَةِ إِلَّا ثَلَاثَةَ مَجَالِسَ : سَفْكُ دَمٍ حَرَامٍ، أَوْ فَرْجٌ حَرَامٌ، أَوْ اقْتَطَاعُ مَالٍ بِغَيْرِ حَقٌّ
‘বৈঠকের কথাবার্তা আমানতের সঙ্গে সম্পৃক্ত। তবে তিন রকম বৈঠক আলাদা। যে বৈঠকে অন্যায় রক্তপাতের আলোচনা হয়, যে বৈঠকে সতীত্ব হরণের আলোচনা হয় এবং যে মজলিসে অন্যায়ভাবে কারও সম্পদ কেড়ে নেওয়ার আলোচনা হয়।(সুনানে আবূ দাউদ : ৪৮৬৯; খারাইতী, মাকারিমুল আখলাক: ৭০৮; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা: ২১১৬২; শু'আবুল ঈমান: ১০৬৭৯)
অন্যের অধিকার খর্ব হয় না এমন কোনও বৈধ বিষয়ে যদি কথা বলা হয় আর যে ব্যক্তি তা বলে সে এদিক-ওদিক লক্ষ করে, যা দ্বারা অনুমান করা যায় যে সে চায় কথাটি গোপন থাকুক, তবে সে কথাও আমানত হয়ে যায়, যা প্রকাশ করা জায়েয নয়। সুতরাং এক হাদীছে ইরশাদ-
إِذَا حَدَّثَ الرَّجُلُ الْحَدِيثَ ثُمَّ الْتَفَتَ فَهِيَ أَمَانَةٌ
‘যখন ব্যক্তি কোনও কথা বলে, তারপর এদিক-ওদিক তাকায়, তখন তা আমানত হয়ে যায়।(জামে' তিরমিযী: ১৯৫৯; সুনানে আবূ দাউদ: ৪৮৬৮; মুসান্নাফে ইবন আবী শায়বা: ২৫৫৯৮; মুসনাদে আবু ইয়া'লা: ২২১২; তাবারানী, আল মু'জামুল আওসাত: ২৪৫৮; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা: ২১১৬১)
কারও গোপন বিষয় তার মৃত্যুর পর প্রকাশ করা জায়েয কি না? উলামায়ে কেরাম এ ক্ষেত্রে বিষয়টিকে কয়েক ভাগে ভাগ করেছেন। যেমন এক ব্যক্তি বিশেষ কোনও নেক আমল করে, যেমন তাহাজ্জুদ পড়া, গোপনে দান-খয়রাত করা ইত্যাদি। সুনাম ছড়িয়ে পড়ার ভয়ে বা ছাওয়াব কমে যাওয়ার আশঙ্কায় সে তার প্রকাশ পসন্দ করে না। এ ক্ষেত্রে তার মৃত্যুর পর তা প্রকাশ করাতে কোনও দোষ নেই।
আর যে গোপন বিষয় প্রকাশ পেলে মৃত্যুর পরও তার মান-সম্মান নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকে, তা তার জীবদ্দশায় যেমন প্রকাশ করা জায়েয নয়, তেমনি তার মৃত্যুর পরও জায়েয নয়।
তার কাছে যদি অন্যের কোনও পাওনা থাকে কিংবা অন্যের কাছে তার কোনও পাওনা থাকে, তবে যার তা জানা আছে তার উচিত তার মৃত্যুর পর অবশ্যই তা প্রকাশ করা। এটা জরুরি এ কারণে যে, তা প্রকাশ না করা হলে তার উপর দেনার দায় থেকে যাবে, যে জন্য আখিরাতে সে আটকা পড়ে যাবে। যদি সে নিজেই পাওনাদার হয়, সে ক্ষেত্রে তা প্রকাশ করা না হলে তার ওয়ারিছগণ বঞ্চিত হবে। উভয় ক্ষেত্রে প্রকাশ করা হলে তার দেনা পরিশোধ করা বা পাওনা উসুল করার ব্যবস্থা করা যাবে।
মোটকথা, সাধারণভাবে অন্যের গোপনীয় বিষয় গোপন রাখা শরী'আতের এক গুরুত্বপূর্ণ বিধান। শরী'আতসম্মত কারণ ছাড়া তা প্রকাশ করা কিছুতেই সমীচীন নয়। কুরআন ও হাদীছে এ সম্পর্কে সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। আলোচ্য পরিচ্ছেদটি সে সম্পর্কেই।
‘গোপন বিষয়ের গোপনীয়তা রক্ষা করা’ সম্পর্কিত একটি আয়াত
وَأَوْفُوا بِالْعَهْدِ إِنَّ الْعَهْدَ كَانَ مَسْئُولًا
অর্থ: আর অঙ্গীকার পূরণ করো। নিশ্চয়ই অঙ্গীকার সম্পর্কে (তোমাদের) জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।(সূরা বনী ইসরাঈল (১৭), আয়াত ৩৪)
ব্যাখ্যা
এ আয়াতে অঙ্গীকার রক্ষা করার আদেশ করা হয়েছে। অঙ্গীকার দু'রকম। এক হল আল্লাহ তা'আলার সঙ্গে কৃত অঙ্গীকার, যা কালেমা তায়্যিবার মাধ্যমে আমরা করে থাকি। আমরা যখন সাক্ষ্য দিয়েছি আল্লাহ ছাড়া কোনও মা'বুদ নেই, তখন এর দ্বারা প্রকারান্তরে এই অঙ্গীকারও করে ফেলেছি যে, আমরা তাঁর সকল আদেশ-নিষেধ পরিপূর্ণরূপে মেনে চলব। এ আয়াতে আল্লাহ তা'আলা সে অঙ্গীকার রক্ষার হুকুম দিয়েছেন। এছাড়া মানবসৃষ্টির সূচনায় রূহানী জগতেও আমাদের থেকে তাঁকে প্রতিপালকরূপে মেনে চলার অঙ্গীকার নেওয়া হয়েছে। সে অঙ্গীকার রক্ষার বিষয়টিও এ আয়াতের আদেশের অন্তর্ভুক্ত।
আরেক অঙ্গীকার হল মানুষের পারস্পরিক অঙ্গীকার। শরী'আতসম্মতভাবে একজন অন্যজনের সঙ্গে যে অঙ্গীকারে আবদ্ধ হয়, তা রক্ষা করাও জরুরি। তাও এ আয়াতের হুকুমের মধ্যে এসে গেছে। কাজেই শরী'আতসম্মত কারণ ছাড়া সে অঙ্গীকার ভঙ্গ করা জায়েয নয়। আখিরাতে উভয় প্রকার অঙ্গীকার সম্পর্কে আল্লাহ তা'আলা জিজ্ঞেস করবেন। যেমন এ আয়াতের শেষ বাক্যে বলা হয়েছে- إِنَّ الْعَهْدَ كَانَ مَسْئُولًا 'নিশ্চয়ই অঙ্গীকার সম্পর্কে (তোমাদের) জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে'। অর্থাৎ জিজ্ঞেস করা হবে, তোমরা আল্লাহর সঙ্গে কৃত অঙ্গীকার কতটুকু রক্ষা করেছ? এমনিভাবে তোমরা একে অন্যের সঙ্গে যে অঙ্গীকার করেছিলে, তা যথাযথভাবে রক্ষা করেছিলে তো? সুতরাং বিবাহের মাধ্যমে স্বামী-স্ত্রীর পরস্পর হক আদায়ের যে অঙ্গীকারে উভয়ে আবদ্ধ হয়ে থাকে, সে সম্পর্কেও আখিরাতে জিজ্ঞেস করা হবে। এমনিভাবে নির্বাচনকালে প্রার্থীগণ যে অঙ্গীকার করে থাকে, নির্বাচিত হওয়ার পর আনুষ্ঠানিকভাবে মন্ত্রী, এমপি, বিচারপতি প্রভৃতি পদধারীদের থেকে যে শপথ নেওয়া হয় তা কতটুকু রক্ষা করা হয়েছে, সে সম্পর্কেও আখিরাতে জবাব দিতে হবে। সরকারি ও বেসরকারি চাকরিতে যে শর্তে নিয়োগদান ও গ্রহণ করা হয়, তাও অঙ্গীকারের মধ্যে পড়ে। চাকরিদাতা ও চাকরিগ্রহীতা উভয়ের সে শর্ত রক্ষা করা জরুরি। বেচাকেনা, ইজারা, বন্ধক, আমানত প্রভৃতি চুক্তির শর্তসমূহও এর অন্তর্ভুক্ত। দুই রাষ্ট্রের মধ্যে যেসকল চুক্তি হয়, তা যদি মুসলিম ও অমুসলিম রাষ্ট্রের মধ্যেও হয়, তাও অঙ্গীকারের মর্যাদা রাখে। গ্রহণযোগ্য কারণ ছাড়া তা ভঙ্গ করা জায়েয নয়। খাস মজলিসে যেসব কথাবার্তা হয় এবং যা গোপন রাখার ব্যাপারে সকলে দায়বদ্ধ থাকে, এমনিভাবে একজন অন্যজনের সঙ্গে যে গোপন কথাবার্তা বলে, তাও গোপন রাখা জরুরি। এটাও অঙ্গীকার রক্ষার অন্তর্ভুক্ত, যে সম্পর্কে আখিরাতে জবাবদিহিতা রয়েছে।
মোটকথা, অঙ্গীকার ও প্রতিশ্রুতির বিষয়টি অনেক ব্যাপক। স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক বিষয়াদি থেকে শুরু করে দ্বিপাক্ষিক যত ক্ষেত্র আছে এবং অন্যের সঙ্গে দায়বদ্ধতার যত বিষয় আছে সবই এর অন্তর্ভুক্ত। সেইসঙ্গে শরী'আতের বিধানাবলি মেনে চলার অঙ্গীকার তো রয়েছেই। এর কোনওটিকেই হালকা করে দেখার সুযোগ নেই। আখিরাতে যেহেতু আল্লাহর সামনে জবাব দিতে হবে বলে এ আয়াতে জানানো হয়েছে, সেহেতু সকল ক্ষেত্রের সকল অঙ্গীকার রক্ষার ব্যাপারে আমাদেরকে সচেতন থাকতে হবে।
আয়াতটির শিক্ষা
কোনও অঙ্গীকার ও গোপন কথাকে তুচ্ছ মনে করতে নেই। অন্তরে আখিরাতে জবাবদিহিতার ভয় রেখে ছোট-বড় এবং প্রকাশ্য ও গুপ্ত সকল অঙ্গীকার রক্ষার ব্যাপারে আমাদেরকে যত্নবান থাকতে হবে।
অন্যের গোপনীয় বিষয় আমানতস্বরূপ। তা প্রকাশ করলে আমানতের খেয়ানত হয়। খেয়ানত করা জায়েয নয়। তাই অন্যের গোপনীয় বিষয় প্রকাশ করাও জায়েয নয়। এ ক্ষেত্রে আপন-পর, শত্রু-মিত্রের মধ্যে কোনও ভেদাভেদ নেই। স্বামী-স্ত্রীরও কর্তব্য পরস্পরের গোপন বিষয় গোপন রাখা। এমনিভাবে শত্রুরও কোনও গোপন বিষয় জানতে পারলে তা প্রকাশ করে দেওয়া বৈধ নয়।
অন্যের গোপনীয় বিষয় যেভাবে জানতে পারা যাক, তা গোপন রাখা কর্তব্য। গোপনীয় বিষয়টি যার, সে তাকে সরাসরি তা বলুক বা অন্য কোনও উপায়ে জানতে পারুক। যেমন অন্যের কোনও গোপন বিষয় কারও চোখে পড়ে গেল। বিষয়টি যার, সে কিছুতেই চায় না অন্য কেউ তা জানতে পারুক। জানলে হয়তো তার মান-সম্মান নষ্ট হবে বা অন্য কোনও ক্ষতি হবে। এ অবস্থায় যার চোখে তা পড়ল তার জন্য তা প্রকাশ করা কিছুতেই জায়েয হবে না। তা প্রকাশ করা যেমন আমানতের খেয়ানত, তেমনি এক রকম চোগলখোরিও বটে। চোগলখোরি করাও মহাপাপ। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
لَا يَدْخُلُ الْجَنَّةَ قَتَّاتٌ
‘চোগলখোর জান্নাতে প্রবেশ করবে না।
(সহীহ বুখারী: ৬০৫৬; সহীহ মুসলিম: ১০৫; সুনানে আবু দাউদ: ৪৮৭১; জামে' তিরমিযী: ২০২৬; নাসাঈ, আস সুনানুল কুবরা ১১৫৫০; সহীহ ইবনে হিব্বান ৫৭৬৫; মুসনাদে আবূ দাউদ তয়ালিসী ৪২২; মুসান্নাফে ইবন আবী শায়বা: ২৬৫৮৫; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর: ৩০২১)
মজলিসে যেসব গোপন আলোচনা হয়, তাও সকলের জন্য আমানত। কারও জন্যই তা প্রকাশ করা জায়েয নয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন- إِنَّمَا يُجَالِسُ الْمُتَجَالِسَوْنَ بِأَمَانَةِ اللَّهِ، فَلَا يَحِلُّ لِأَحَدٍ أَنْ يُفْشِيَ عَنْ صَاحِبِهِ مَا يَكْرَهُ 'বৈঠকে অংশগ্রহণকারীগণ আল্লাহ তা'আলার আমানতের সঙ্গেই অংশগ্রহণ করে। সুতরাং তাদের কারও জন্যই অন্যে যা অপসন্দ করে তা প্রকাশ করা বৈধ নয়।(জামে' মা'মার ইবন রাশিদ: ১৯৭৯১)
অবশ্য মজলিসে যদি অন্যের কোনও অধিকার খর্ব করা সম্পর্কে আলোচনা করা হয় এবং সে সম্পর্কে কোনও পরিকল্পনাও নেওয়া হয়, তবে তা প্রকাশ করাই জরুরি। সুতরাং এক হাদীছে ইরশাদ হয়েছে- الْمَجَالِسُ بِالْأَمَانَةِ إِلَّا ثَلَاثَةَ مَجَالِسَ : سَفْكُ دَمٍ حَرَامٍ، أَوْ فَرْجٌ حَرَامٌ، أَوْ اقْتَطَاعُ مَالٍ بِغَيْرِ حَقٌّ
‘বৈঠকের কথাবার্তা আমানতের সঙ্গে সম্পৃক্ত। তবে তিন রকম বৈঠক আলাদা। যে বৈঠকে অন্যায় রক্তপাতের আলোচনা হয়, যে বৈঠকে সতীত্ব হরণের আলোচনা হয় এবং যে মজলিসে অন্যায়ভাবে কারও সম্পদ কেড়ে নেওয়ার আলোচনা হয়।(সুনানে আবূ দাউদ : ৪৮৬৯; খারাইতী, মাকারিমুল আখলাক: ৭০৮; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা: ২১১৬২; শু'আবুল ঈমান: ১০৬৭৯)
অন্যের অধিকার খর্ব হয় না এমন কোনও বৈধ বিষয়ে যদি কথা বলা হয় আর যে ব্যক্তি তা বলে সে এদিক-ওদিক লক্ষ করে, যা দ্বারা অনুমান করা যায় যে সে চায় কথাটি গোপন থাকুক, তবে সে কথাও আমানত হয়ে যায়, যা প্রকাশ করা জায়েয নয়। সুতরাং এক হাদীছে ইরশাদ-
إِذَا حَدَّثَ الرَّجُلُ الْحَدِيثَ ثُمَّ الْتَفَتَ فَهِيَ أَمَانَةٌ
‘যখন ব্যক্তি কোনও কথা বলে, তারপর এদিক-ওদিক তাকায়, তখন তা আমানত হয়ে যায়।(জামে' তিরমিযী: ১৯৫৯; সুনানে আবূ দাউদ: ৪৮৬৮; মুসান্নাফে ইবন আবী শায়বা: ২৫৫৯৮; মুসনাদে আবু ইয়া'লা: ২২১২; তাবারানী, আল মু'জামুল আওসাত: ২৪৫৮; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা: ২১১৬১)
কারও গোপন বিষয় তার মৃত্যুর পর প্রকাশ করা জায়েয কি না? উলামায়ে কেরাম এ ক্ষেত্রে বিষয়টিকে কয়েক ভাগে ভাগ করেছেন। যেমন এক ব্যক্তি বিশেষ কোনও নেক আমল করে, যেমন তাহাজ্জুদ পড়া, গোপনে দান-খয়রাত করা ইত্যাদি। সুনাম ছড়িয়ে পড়ার ভয়ে বা ছাওয়াব কমে যাওয়ার আশঙ্কায় সে তার প্রকাশ পসন্দ করে না। এ ক্ষেত্রে তার মৃত্যুর পর তা প্রকাশ করাতে কোনও দোষ নেই।
আর যে গোপন বিষয় প্রকাশ পেলে মৃত্যুর পরও তার মান-সম্মান নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকে, তা তার জীবদ্দশায় যেমন প্রকাশ করা জায়েয নয়, তেমনি তার মৃত্যুর পরও জায়েয নয়।
তার কাছে যদি অন্যের কোনও পাওনা থাকে কিংবা অন্যের কাছে তার কোনও পাওনা থাকে, তবে যার তা জানা আছে তার উচিত তার মৃত্যুর পর অবশ্যই তা প্রকাশ করা। এটা জরুরি এ কারণে যে, তা প্রকাশ না করা হলে তার উপর দেনার দায় থেকে যাবে, যে জন্য আখিরাতে সে আটকা পড়ে যাবে। যদি সে নিজেই পাওনাদার হয়, সে ক্ষেত্রে তা প্রকাশ করা না হলে তার ওয়ারিছগণ বঞ্চিত হবে। উভয় ক্ষেত্রে প্রকাশ করা হলে তার দেনা পরিশোধ করা বা পাওনা উসুল করার ব্যবস্থা করা যাবে।
মোটকথা, সাধারণভাবে অন্যের গোপনীয় বিষয় গোপন রাখা শরী'আতের এক গুরুত্বপূর্ণ বিধান। শরী'আতসম্মত কারণ ছাড়া তা প্রকাশ করা কিছুতেই সমীচীন নয়। কুরআন ও হাদীছে এ সম্পর্কে সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। আলোচ্য পরিচ্ছেদটি সে সম্পর্কেই।
‘গোপন বিষয়ের গোপনীয়তা রক্ষা করা’ সম্পর্কিত একটি আয়াত
وَأَوْفُوا بِالْعَهْدِ إِنَّ الْعَهْدَ كَانَ مَسْئُولًا
অর্থ: আর অঙ্গীকার পূরণ করো। নিশ্চয়ই অঙ্গীকার সম্পর্কে (তোমাদের) জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।(সূরা বনী ইসরাঈল (১৭), আয়াত ৩৪)
ব্যাখ্যা
এ আয়াতে অঙ্গীকার রক্ষা করার আদেশ করা হয়েছে। অঙ্গীকার দু'রকম। এক হল আল্লাহ তা'আলার সঙ্গে কৃত অঙ্গীকার, যা কালেমা তায়্যিবার মাধ্যমে আমরা করে থাকি। আমরা যখন সাক্ষ্য দিয়েছি আল্লাহ ছাড়া কোনও মা'বুদ নেই, তখন এর দ্বারা প্রকারান্তরে এই অঙ্গীকারও করে ফেলেছি যে, আমরা তাঁর সকল আদেশ-নিষেধ পরিপূর্ণরূপে মেনে চলব। এ আয়াতে আল্লাহ তা'আলা সে অঙ্গীকার রক্ষার হুকুম দিয়েছেন। এছাড়া মানবসৃষ্টির সূচনায় রূহানী জগতেও আমাদের থেকে তাঁকে প্রতিপালকরূপে মেনে চলার অঙ্গীকার নেওয়া হয়েছে। সে অঙ্গীকার রক্ষার বিষয়টিও এ আয়াতের আদেশের অন্তর্ভুক্ত।
আরেক অঙ্গীকার হল মানুষের পারস্পরিক অঙ্গীকার। শরী'আতসম্মতভাবে একজন অন্যজনের সঙ্গে যে অঙ্গীকারে আবদ্ধ হয়, তা রক্ষা করাও জরুরি। তাও এ আয়াতের হুকুমের মধ্যে এসে গেছে। কাজেই শরী'আতসম্মত কারণ ছাড়া সে অঙ্গীকার ভঙ্গ করা জায়েয নয়। আখিরাতে উভয় প্রকার অঙ্গীকার সম্পর্কে আল্লাহ তা'আলা জিজ্ঞেস করবেন। যেমন এ আয়াতের শেষ বাক্যে বলা হয়েছে- إِنَّ الْعَهْدَ كَانَ مَسْئُولًا 'নিশ্চয়ই অঙ্গীকার সম্পর্কে (তোমাদের) জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে'। অর্থাৎ জিজ্ঞেস করা হবে, তোমরা আল্লাহর সঙ্গে কৃত অঙ্গীকার কতটুকু রক্ষা করেছ? এমনিভাবে তোমরা একে অন্যের সঙ্গে যে অঙ্গীকার করেছিলে, তা যথাযথভাবে রক্ষা করেছিলে তো? সুতরাং বিবাহের মাধ্যমে স্বামী-স্ত্রীর পরস্পর হক আদায়ের যে অঙ্গীকারে উভয়ে আবদ্ধ হয়ে থাকে, সে সম্পর্কেও আখিরাতে জিজ্ঞেস করা হবে। এমনিভাবে নির্বাচনকালে প্রার্থীগণ যে অঙ্গীকার করে থাকে, নির্বাচিত হওয়ার পর আনুষ্ঠানিকভাবে মন্ত্রী, এমপি, বিচারপতি প্রভৃতি পদধারীদের থেকে যে শপথ নেওয়া হয় তা কতটুকু রক্ষা করা হয়েছে, সে সম্পর্কেও আখিরাতে জবাব দিতে হবে। সরকারি ও বেসরকারি চাকরিতে যে শর্তে নিয়োগদান ও গ্রহণ করা হয়, তাও অঙ্গীকারের মধ্যে পড়ে। চাকরিদাতা ও চাকরিগ্রহীতা উভয়ের সে শর্ত রক্ষা করা জরুরি। বেচাকেনা, ইজারা, বন্ধক, আমানত প্রভৃতি চুক্তির শর্তসমূহও এর অন্তর্ভুক্ত। দুই রাষ্ট্রের মধ্যে যেসকল চুক্তি হয়, তা যদি মুসলিম ও অমুসলিম রাষ্ট্রের মধ্যেও হয়, তাও অঙ্গীকারের মর্যাদা রাখে। গ্রহণযোগ্য কারণ ছাড়া তা ভঙ্গ করা জায়েয নয়। খাস মজলিসে যেসব কথাবার্তা হয় এবং যা গোপন রাখার ব্যাপারে সকলে দায়বদ্ধ থাকে, এমনিভাবে একজন অন্যজনের সঙ্গে যে গোপন কথাবার্তা বলে, তাও গোপন রাখা জরুরি। এটাও অঙ্গীকার রক্ষার অন্তর্ভুক্ত, যে সম্পর্কে আখিরাতে জবাবদিহিতা রয়েছে।
মোটকথা, অঙ্গীকার ও প্রতিশ্রুতির বিষয়টি অনেক ব্যাপক। স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক বিষয়াদি থেকে শুরু করে দ্বিপাক্ষিক যত ক্ষেত্র আছে এবং অন্যের সঙ্গে দায়বদ্ধতার যত বিষয় আছে সবই এর অন্তর্ভুক্ত। সেইসঙ্গে শরী'আতের বিধানাবলি মেনে চলার অঙ্গীকার তো রয়েছেই। এর কোনওটিকেই হালকা করে দেখার সুযোগ নেই। আখিরাতে যেহেতু আল্লাহর সামনে জবাব দিতে হবে বলে এ আয়াতে জানানো হয়েছে, সেহেতু সকল ক্ষেত্রের সকল অঙ্গীকার রক্ষার ব্যাপারে আমাদেরকে সচেতন থাকতে হবে।
আয়াতটির শিক্ষা
কোনও অঙ্গীকার ও গোপন কথাকে তুচ্ছ মনে করতে নেই। অন্তরে আখিরাতে জবাবদিহিতার ভয় রেখে ছোট-বড় এবং প্রকাশ্য ও গুপ্ত সকল অঙ্গীকার রক্ষার ব্যাপারে আমাদেরকে যত্নবান থাকতে হবে।
স্বামী-স্ত্রীর মধ্যকার গোপনীয় বিষয়সমূহ প্রকাশ না করা
হাদীছ নং: ৬৮৪
হযরত আবু সা'ঈদ খুদরী রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, কিয়ামতের দিন আল্লাহর কাছে মর্যাদায় সর্বাপেক্ষা নিকৃষ্ট লোকদের একজন সেই ব্যক্তি, যে তার স্ত্রীর সঙ্গে মিলিত হয় এবং সেও তার সঙ্গে মিলিত হয়, তারপর সে লোকটি তার গোপনীয় বিষয় মানুষের কাছে প্রকাশ করে।-মুসলিম
(সহীহ মুসলিম: ১৪৩৭; সুনানে আবু দাউদ: ৪৮৭০; মুসান্নাফে ইবন আবী শায়বা: ১৭৫৫৯; ইবনুস সুন্নী, আমালুল ইয়াওম ওয়াল লায়লা ৬১৪)
হাদীছ নং: ৬৮৪
হযরত আবু সা'ঈদ খুদরী রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, কিয়ামতের দিন আল্লাহর কাছে মর্যাদায় সর্বাপেক্ষা নিকৃষ্ট লোকদের একজন সেই ব্যক্তি, যে তার স্ত্রীর সঙ্গে মিলিত হয় এবং সেও তার সঙ্গে মিলিত হয়, তারপর সে লোকটি তার গোপনীয় বিষয় মানুষের কাছে প্রকাশ করে।-মুসলিম
(সহীহ মুসলিম: ১৪৩৭; সুনানে আবু দাউদ: ৪৮৭০; মুসান্নাফে ইবন আবী শায়বা: ১৭৫৫৯; ইবনুস সুন্নী, আমালুল ইয়াওম ওয়াল লায়লা ৬১৪)
كتاب الأدب
بابُ حفظ السِّر
قَالَ الله تَعَالَى: {وَأَوْفُوا بِالْعَهْدِ إنَّ الْعَهْدَ كَانَ مَسْؤُولًا} [الإسراء: 34].
قَالَ الله تَعَالَى: {وَأَوْفُوا بِالْعَهْدِ إنَّ الْعَهْدَ كَانَ مَسْؤُولًا} [الإسراء: 34].
684 - وعن أَبي سعيد الخدري - رضي الله عنه - قَالَ: قَالَ رسول الله - صلى الله عليه وسلم: «إنَّ مِنْ أَشَرِّ النَّاسِ عِنْدَ اللهِ مَنْزِلَةً يَوْمَ القِيَامَةِ الرَّجُلَ يُفْضِي إِلَى الْمَرْأةِ وتُفْضِي إِلَيْهِ، ثُمَّ يَنْشُرُ سِرَّهَا». رواه مسلم. (1)

তাহকীক:
 হাদীসের ব্যাখ্যা
হাদীসের ব্যাখ্যাহাদীস নং: ৬৮৫
 বিবিধ আদব - শিষ্টাচারের অধ্যায়
২ গোপন বিষয়ের গোপনীয়তা রক্ষা করা
রাসূলুল্লাহ ﷺ -এর সঙ্গে হযরত হাফসা রাযি.-এর বিবাহ এবং এ প্রসঙ্গে হযরত আবু বকর রাযি. কর্তৃক তাঁর গোপন কথা প্রকাশ না করা
হাদীছ নং: ৬৮৫
হযরত আব্দুল্লাহ ইবন উমর রাযি. থেকে বর্ণিত, উমর রাযি.-এর কন্যা হাফসা রাযি. বিধবা হলে তিনি বলেন, আমি উছমান ইবন আফফানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করলাম এবং তার সামনে হাফসাকে তুলে ধরলাম। বললাম, আপনি চাইলে হাফসা বিনত উমরকে আপনার সঙ্গে বিবাহ দিই! তিনি বললেন, আমি এ বিষয়ে ভেবে দেখব। আমি কয়েকদিন অপেক্ষা করলাম। তারপর তিনি আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বললেন, বর্তমানে আমার কাছে আমার বিবাহ না করাটাই সঙ্গত মনে হয়েছে। তারপর আমি আবু বকর সিদ্দীকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করলাম এবং তাকে বললাম, আপনি চাইলে হাফসা বিনত উমরকে আপনার সঙ্গে বিবাহ দিই! আবু বকর নীরব থাকলেন। তিনি আমার কথার কোনও উত্তর দিলেন না। এতে আমি উছমানের প্রতি যে কষ্ট পেয়েছিলাম তার চেয়েও বেশি কষ্ট তাঁর প্রতি পেলাম। এভাবে আমার কয়েকদিন কাটল। অতঃপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাফসাকে বিবাহ করার প্রস্তাব দিলেন। আমি তাঁর সঙ্গেই হাফসাকে বিবাহ দিলাম। তারপর আবূ বকর আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন। তিনি বললেন, আপনি যখন হাফসাকে বিবাহ করার জন্য আমার কাছে প্রস্তাব রেখেছিলেন আর আমি আপনাকে তার কোনও উত্তর দিইনি, তখন হয়তো আপনি আমার প্রতি কষ্ট পেয়েছিলেন। আমি বললাম, হাঁ। তিনি বললেন, আমি যে আপনাকে তার কোনও জবাব দিইনি, তার একমাত্র কারণ ছিল এই যে, আমি জানতে পেরেছিলাম নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার কথা আলোচনা করেছেন। আর আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কোনও গোপন কথা প্রকাশ করতে চাচ্ছিলাম না। হাঁ, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যদি তাকে বিবাহ করার ইচ্ছা না করতেন, তবে আমি তাকে অবশ্যই গ্রহণ করতাম। -বুখারী
(সহীহ বুখারী: ৪০০৫; সুনানে নাসাঈ ৩২৪৮; মুসনাদে আহমাদ: ৭৪; মুসনাদুল বাযযার: ১১৬; মুসনাদে আবূ ইয়া'লা: ৭; সহীহ ইবনে হিব্বান: ৪০৩৯; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা: ১৩৭৪৯)
হাদীছ নং: ৬৮৫
হযরত আব্দুল্লাহ ইবন উমর রাযি. থেকে বর্ণিত, উমর রাযি.-এর কন্যা হাফসা রাযি. বিধবা হলে তিনি বলেন, আমি উছমান ইবন আফফানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করলাম এবং তার সামনে হাফসাকে তুলে ধরলাম। বললাম, আপনি চাইলে হাফসা বিনত উমরকে আপনার সঙ্গে বিবাহ দিই! তিনি বললেন, আমি এ বিষয়ে ভেবে দেখব। আমি কয়েকদিন অপেক্ষা করলাম। তারপর তিনি আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বললেন, বর্তমানে আমার কাছে আমার বিবাহ না করাটাই সঙ্গত মনে হয়েছে। তারপর আমি আবু বকর সিদ্দীকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করলাম এবং তাকে বললাম, আপনি চাইলে হাফসা বিনত উমরকে আপনার সঙ্গে বিবাহ দিই! আবু বকর নীরব থাকলেন। তিনি আমার কথার কোনও উত্তর দিলেন না। এতে আমি উছমানের প্রতি যে কষ্ট পেয়েছিলাম তার চেয়েও বেশি কষ্ট তাঁর প্রতি পেলাম। এভাবে আমার কয়েকদিন কাটল। অতঃপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাফসাকে বিবাহ করার প্রস্তাব দিলেন। আমি তাঁর সঙ্গেই হাফসাকে বিবাহ দিলাম। তারপর আবূ বকর আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন। তিনি বললেন, আপনি যখন হাফসাকে বিবাহ করার জন্য আমার কাছে প্রস্তাব রেখেছিলেন আর আমি আপনাকে তার কোনও উত্তর দিইনি, তখন হয়তো আপনি আমার প্রতি কষ্ট পেয়েছিলেন। আমি বললাম, হাঁ। তিনি বললেন, আমি যে আপনাকে তার কোনও জবাব দিইনি, তার একমাত্র কারণ ছিল এই যে, আমি জানতে পেরেছিলাম নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার কথা আলোচনা করেছেন। আর আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কোনও গোপন কথা প্রকাশ করতে চাচ্ছিলাম না। হাঁ, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যদি তাকে বিবাহ করার ইচ্ছা না করতেন, তবে আমি তাকে অবশ্যই গ্রহণ করতাম। -বুখারী
(সহীহ বুখারী: ৪০০৫; সুনানে নাসাঈ ৩২৪৮; মুসনাদে আহমাদ: ৭৪; মুসনাদুল বাযযার: ১১৬; মুসনাদে আবূ ইয়া'লা: ৭; সহীহ ইবনে হিব্বান: ৪০৩৯; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা: ১৩৭৪৯)
كتاب الأدب
بابُ حفظ السِّر
685 - وعن عبدِ الله بن عمر رضي الله عنهما: أنَّ عمرَ - رضي الله عنه - حِيْنَ تأيَّمَتْ بِنْتُهُ حَفْصَةُ، قَالَ: لَقِيتُ عُثْمَانَ بْنَ عَفّانَ - رضي الله عنه - فَعَرَضْتُ عَلَيْهِ حَفْصَةَ، فَقُلْتُ: إنْ شِئْتَ أَنْكَحْتُكَ حَفْصَةَ بِنْتَ عُمَرَ؟ قَالَ: سأَنْظُرُ فِي أمْرِي. فَلَبِثْتُ لَيَالِيَ ثُمَّ لَقِيَنِي، فَقَالَ: قَدْ بَدَا لِي أَنْ لاَ أتَزَوَّجَ يَوْمِي هَذَا. فَلَقِيتُ أَبَا بَكْرٍ - رضي الله عنه - فقلتُ: إنْ شِئْتَ أَنْكَحْتُكَ حَفْصَةَ بنْتَ عُمَرَ، فَصَمتَ أَبُو بَكْرٍ - رضي الله عنه - فَلَمْ يَرْجِعْ إلَيَّ شَيْئًا! فَكُنْتُ عَلَيْهِ أَوْجَدَ مِنِّي عَلَى عُثْمَانَ، فَلَبِثَ لَيَالِيَ ثُمَّ خَطَبَهَا النَّبيُّ - صلى الله عليه وسلم - فَأنْكَحْتُهَا إيَّاهُ. فَلَقِيَنِي أَبُو بَكْرٍ، فَقَالَ: لَعَلَّكَ وَجَدْتَ عَلَيَّ حِيْنَ عَرَضْتَ عَلَيَّ حَفْصَةَ فَلَمْ أرْجِعْ إِلَيْكَ شَيْئًا؟ فقلتُ: نَعَمْ، قَالَ: فَإنَّهُ لَمْ يَمْنَعْنِي أَنْ أرْجِعَ إِلَيْك فِيمَا عَرَضْتَ عَلَيَّ إِلاَّ أنِّي كُنْتُ عَلِمْتُ أنَّ النبيَّ - صلى الله عليه وسلم - ذَكَرَهَا، فَلَمْ أكُنْ لأُفْشِيَ سِرَّ رسول الله - صلى الله عليه وسلم - وَلَوْ تَرَكَهَا النَّبيُّ - صلى الله عليه وسلم - لَقَبِلْتُهَا. رواه البخاري. (1)
«تَأَيَّمَتْ» أيْ: صَارَتْ بِلاَ زَوْجٍ، وَكَانَ زَوْجُهَا تُوُفِّيَ - رضي الله عنه. «وَجَدْتَ»: غَضِبْتَ.
«تَأَيَّمَتْ» أيْ: صَارَتْ بِلاَ زَوْجٍ، وَكَانَ زَوْجُهَا تُوُفِّيَ - رضي الله عنه. «وَجَدْتَ»: غَضِبْتَ.

তাহকীক:
 হাদীসের ব্যাখ্যা
হাদীসের ব্যাখ্যাহাদীস নং: ৬৮৬
 বিবিধ আদব - শিষ্টাচারের অধ্যায়
২ গোপন বিষয়ের গোপনীয়তা রক্ষা করা
হযরত ফাতিমা রাযি.-এর মর্যাদা
হাদীছ নং: ৬৮৬
হযরত আয়েশা রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্ত্রীগণ তাঁর নিকট উপস্থিত ছিলেন। এমন সময় ফাতিমা হেঁটে হেঁটে এগিয়ে আসলেন। তার চলনভঙ্গি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চলনভঙ্গি থেকে একটুও আলাদা ছিল না। তিনি যখন তাকে দেখলেন, তাকে স্বাগত জানালেন এবং বললেন, আমার কন্যাকে স্বাগতম। তারপর তিনি তাকে নিজের ডানে বা বামে বসালেন। তারপর চুপিসারে কিছু বললেন। তাতে ফাতিমা প্রচণ্ডভাবে কেঁদে উঠলেন। তিনি যখন তাঁর অস্থিরতা লক্ষ করলেন, পুনরায় চুপিসারে কিছু বললেন। তাতে ফাতিমা হেসে দিলেন। আমি তাকে বললাম, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর স্ত্রীদের মাঝখানে বিশেষভাবে তোমাকে চুপিসারে কিছু বললেন। তাও তুমি কাঁদলে! তারপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উঠে গেলে আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তোমাকে কী বলেছিলেন? তিনি বললেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের গোপন কথা প্রকাশ করতে পারব না। তারপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওফাত হয়ে গেলে আমি ফাতিমাকে বললাম, তোমার উপর আমার যে হক আছে তার দোহাই দিয়ে বলছি, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তোমাকে কী বলেছিলেন তা অবশ্যই আমাকে বলো। তিনি বললেন, হাঁ, এখন তা বলা যায়। প্রথমবার যে তিনি চুপিসারে আমাকে কিছু বলেছিলেন তখন আমাকে জানিয়েছিলেন যে, জিবরীল প্রতি বছর তাঁর কাছে সম্পূর্ণ কুরআন এক-দু'বার পেশ করতেন। কিন্তু এ সময় (এক রমযানেই) তাঁর সামনে তা দু'বার পেশ করেছেন। তাই আমার মনে হচ্ছে আমার মৃত্যু কাছে এসে গেছে। সুতরাং তুমি আল্লাহকে ভয় করো এবং ধৈর্য ধরো। কেননা আমি তোমার জন্য উত্তম অগ্রবর্তী। এ কথায় আমি কেঁদে দিলাম, যে কান্না আপনি দেখেছেন। তিনি যখন আমার অস্থিরতা লক্ষ করলেন, পুনরায় চুপিসারে আমার সঙ্গে কথা বললেন। তিনি বললেন, হে ফাতিমা! তুমি কি এতে সন্তুষ্ট নও যে, তুমি মুমিন নারীদের, কিংবা তিনি বলেছিলেন, তুমি এ উম্মতের নারীদের নেত্রী হবে? এ কথায় আমি হেসে দিলাম, যে হাসি আপনি দেখেছেন। -বুখারী ও মুসলিম। এটা মুসলিমের ভাষা।
(সহীহ বুখারী: ৬২৮৫; সহীহ মুসলিম: ২৪৫০; মুসনাদে আবু দাউদ তয়ালিসী: ১৪৭০; মুসনাদে ইসহাক ইবন রাহুয়াহ ২১০২; নাসাঈ, আস সুনানুল কুবরা: ৮৪৬৩; মুসনাদে আবু ইয়া'লা: ৬৭৪৫; তহাবী, শারহু মুশকিলিল আছার: ১৪৪; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর : ১০৩৩)
হাদীছ নং: ৬৮৬
হযরত আয়েশা রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্ত্রীগণ তাঁর নিকট উপস্থিত ছিলেন। এমন সময় ফাতিমা হেঁটে হেঁটে এগিয়ে আসলেন। তার চলনভঙ্গি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চলনভঙ্গি থেকে একটুও আলাদা ছিল না। তিনি যখন তাকে দেখলেন, তাকে স্বাগত জানালেন এবং বললেন, আমার কন্যাকে স্বাগতম। তারপর তিনি তাকে নিজের ডানে বা বামে বসালেন। তারপর চুপিসারে কিছু বললেন। তাতে ফাতিমা প্রচণ্ডভাবে কেঁদে উঠলেন। তিনি যখন তাঁর অস্থিরতা লক্ষ করলেন, পুনরায় চুপিসারে কিছু বললেন। তাতে ফাতিমা হেসে দিলেন। আমি তাকে বললাম, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর স্ত্রীদের মাঝখানে বিশেষভাবে তোমাকে চুপিসারে কিছু বললেন। তাও তুমি কাঁদলে! তারপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উঠে গেলে আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তোমাকে কী বলেছিলেন? তিনি বললেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের গোপন কথা প্রকাশ করতে পারব না। তারপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওফাত হয়ে গেলে আমি ফাতিমাকে বললাম, তোমার উপর আমার যে হক আছে তার দোহাই দিয়ে বলছি, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তোমাকে কী বলেছিলেন তা অবশ্যই আমাকে বলো। তিনি বললেন, হাঁ, এখন তা বলা যায়। প্রথমবার যে তিনি চুপিসারে আমাকে কিছু বলেছিলেন তখন আমাকে জানিয়েছিলেন যে, জিবরীল প্রতি বছর তাঁর কাছে সম্পূর্ণ কুরআন এক-দু'বার পেশ করতেন। কিন্তু এ সময় (এক রমযানেই) তাঁর সামনে তা দু'বার পেশ করেছেন। তাই আমার মনে হচ্ছে আমার মৃত্যু কাছে এসে গেছে। সুতরাং তুমি আল্লাহকে ভয় করো এবং ধৈর্য ধরো। কেননা আমি তোমার জন্য উত্তম অগ্রবর্তী। এ কথায় আমি কেঁদে দিলাম, যে কান্না আপনি দেখেছেন। তিনি যখন আমার অস্থিরতা লক্ষ করলেন, পুনরায় চুপিসারে আমার সঙ্গে কথা বললেন। তিনি বললেন, হে ফাতিমা! তুমি কি এতে সন্তুষ্ট নও যে, তুমি মুমিন নারীদের, কিংবা তিনি বলেছিলেন, তুমি এ উম্মতের নারীদের নেত্রী হবে? এ কথায় আমি হেসে দিলাম, যে হাসি আপনি দেখেছেন। -বুখারী ও মুসলিম। এটা মুসলিমের ভাষা।
(সহীহ বুখারী: ৬২৮৫; সহীহ মুসলিম: ২৪৫০; মুসনাদে আবু দাউদ তয়ালিসী: ১৪৭০; মুসনাদে ইসহাক ইবন রাহুয়াহ ২১০২; নাসাঈ, আস সুনানুল কুবরা: ৮৪৬৩; মুসনাদে আবু ইয়া'লা: ৬৭৪৫; তহাবী, শারহু মুশকিলিল আছার: ১৪৪; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর : ১০৩৩)
كتاب الأدب
بابُ حفظ السِّر
686 - وعن عائشة رضي الله عنها، قالت: كُنَّ أزْوَاجُ النَّبيِّ - صلى الله عليه وسلم - عِنْدَهُ، فَأقْبَلَتْ فَاطِمَةُ رضي الله عنها تَمْشِي، مَا تُخْطِئُ مِشيتُها مِنْ مشْيَةِ رسول الله - صلى الله عليه وسلم - شَيْئًا، فَلَمَّا رَآهَا رَحَّبَ بِهَا، وقال: [ص:221] «مَرْحَبًا بِابْنَتِي»، ثُمَّ أجْلَسَهَا عَنْ يَمِينِهِ أَوْ عَنْ شِمَالِهِ، ثُمَّ سَارَّهَا فَبَكتْ بُكَاءً شَديدًا، فَلَمَّا رَأى جَزَعَهَا، سَارَّهَا الثَّانِيَةَ فَضَحِكَتْ، فقلتُ لَهَا: خَصَّكِ رسولُ الله - صلى الله عليه وسلم - مِنْ بَيْنِ نِسَائِهِ بالسِّرَارِ، ثُمَّ أنْتِ تَبْكِينَ! فَلَمَّا قَامَ رسولُ الله - صلى الله عليه وسلم - سَألْتُهَا: مَا قَالَ لَكِ رسولُ الله - صلى الله عليه وسلم -؟ قالت: مَا كُنْتُ لأُفْشِي عَلَى رسول الله - صلى الله عليه وسلم - سِرَّهُ، فَلَمَّا تُوُفِّيَ رسول الله - صلى الله عليه وسلم - قُلْتُ: عَزَمْتُ عَلَيْكِ بِمَا لِي عَلَيْكِ مِنَ الحَقِّ، لَمَا حَدَّثْتِنِي مَا قَالَ لَكِ رسول الله - صلى الله عليه وسلم؟ فقالَتْ: أمَّا الآن فَنَعَمْ، أمَّا حِيْنَ سَارَّنِي في المَرَّةِ الأُولَى فأخْبَرَنِي أنّ جِبْريلَ كَانَ يُعَارِضُهُ القُرآنَ في كُلِّ سَنَةٍ مَرَّةً أَوْ مَرَّتَيْنِ، وَأنَّهُ عَارَضَهُ الآنَ مَرَّتَيْنِ، وَإنِّي لا أُرَى الأجَلَ إِلاَّ قَدِ اقْتَرَبَ، فَاتَّقِي اللهَ وَاصْبِرِي، فَإنَّهُ نِعْمَ السَّلَفُ أنَا لَكِ، فَبَكَيْتُ بُكَائِي الَّذِي رَأيْتِ، فَلَمَّا رَأى جَزَعِي سَارَّنِي الثَّانِيَةَ، فَقَالَ: «يَا فَاطِمَةُ، أمَا تَرْضَيْنَ أَنْ تَكُونِي سَيِّدَةَ نِسَاءِ المُؤُمِنِينَ، أَوْ سَيَّدَةَ نِساءِ هذِهِ الأُمَّةِ؟» فَضَحِكتُ ضَحِكِي الَّذِي رَأيْتِ. متفقٌ عَلَيْهِ، وهذا لفظ مسلم. (1)

তাহকীক:
 হাদীসের ব্যাখ্যা
হাদীসের ব্যাখ্যাহাদীস নং: ৬৮৭
 বিবিধ আদব - শিষ্টাচারের অধ্যায়
২ গোপন বিষয়ের গোপনীয়তা রক্ষা করা
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি হযরত আনাস রাযি.-এর বিশ্বস্ততা
হাদীছ নং: ৬৮৭
ছাবিত থেকে বর্ণিত, হযরত আনাস রাযি. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার কাছে আসলেন। আমি তখন বালকদের সঙ্গে খেলছিলাম। তিনি আমাদের সালাম দিলেন। তারপর তিনি আমাকে এক প্রয়োজনে পাঠালেন। ফলে আমার মায়ের কাছে ফিরতে দেরি হয়ে গেল। তারপর যখন আসলাম, তিনি বললেন, তোমাকে কিসে আটকে রেখেছিল? আমি বললাম, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে তাঁর এক প্রয়োজনে পাঠিয়েছিলেন। তিনি বললেন, তাঁর সে প্রয়োজনটি কী ছিল? বললাম, এটা তো গোপন কথা। তিনি বললেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের গোপন কথা কাউকে বলে দিয়ো না। হযরত আনাস রাযি. বলেন, আল্লাহর কসম! আমি যদি সে কথা কাউকে বলতাম, তবে হে ছাবিত! তোমাকে অবশ্যই বলতাম। -মুসলিম। ইমাম বুখারী এর অংশবিশেষ সংক্ষেপে বর্ণনা করেছেন।
(সহীহ বুখারী: ৬২৮৯; সহীহ মুসলিম: ২৪৮২; মুসান্নাফে ইবন আবী শায়বা: ২৫৫৩০; আল আদাবুল মুফরাদ: ১১৫৪; মুসনাদুল বাযযার ৬৫৮৭; মুসনাদে আবু ইয়া'লা: ৩২৯৯; শারহুস সুন্নাহ : ৩৩০৭; মুসনাদে আবু দাউদ তয়ালিসী: ২১৪৪; তহাবী, শারহু মুশকিলিল আছার: ৩৩৮২)
হাদীছ নং: ৬৮৭
ছাবিত থেকে বর্ণিত, হযরত আনাস রাযি. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার কাছে আসলেন। আমি তখন বালকদের সঙ্গে খেলছিলাম। তিনি আমাদের সালাম দিলেন। তারপর তিনি আমাকে এক প্রয়োজনে পাঠালেন। ফলে আমার মায়ের কাছে ফিরতে দেরি হয়ে গেল। তারপর যখন আসলাম, তিনি বললেন, তোমাকে কিসে আটকে রেখেছিল? আমি বললাম, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে তাঁর এক প্রয়োজনে পাঠিয়েছিলেন। তিনি বললেন, তাঁর সে প্রয়োজনটি কী ছিল? বললাম, এটা তো গোপন কথা। তিনি বললেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের গোপন কথা কাউকে বলে দিয়ো না। হযরত আনাস রাযি. বলেন, আল্লাহর কসম! আমি যদি সে কথা কাউকে বলতাম, তবে হে ছাবিত! তোমাকে অবশ্যই বলতাম। -মুসলিম। ইমাম বুখারী এর অংশবিশেষ সংক্ষেপে বর্ণনা করেছেন।
(সহীহ বুখারী: ৬২৮৯; সহীহ মুসলিম: ২৪৮২; মুসান্নাফে ইবন আবী শায়বা: ২৫৫৩০; আল আদাবুল মুফরাদ: ১১৫৪; মুসনাদুল বাযযার ৬৫৮৭; মুসনাদে আবু ইয়া'লা: ৩২৯৯; শারহুস সুন্নাহ : ৩৩০৭; মুসনাদে আবু দাউদ তয়ালিসী: ২১৪৪; তহাবী, শারহু মুশকিলিল আছার: ৩৩৮২)
كتاب الأدب
بابُ حفظ السِّر
687 - وعن ثَابِتٍ، عن أنس - رضي الله عنه - قَالَ: أتَى عَلَيَّ رسول الله - صلى الله عليه وسلم - وَأنَا ألْعَبُ مَعَ الغِلْمَانِ، فَسَلمَ عَلَيْنَا، فَبَعَثَني إِلَى حاجَةٍ، فَأبْطَأتُ عَلَى أُمِّي. فَلَمَّا جِئْتُ، قالت: مَا حَبَسَكَ؟ فقلتُ: بَعَثَني رسولُ الله - صلى الله عليه وسلم - لِحَاجَةٍ، قالت: مَا حَاجَتُهُ؟ قُلْتُ: إنَّهاَ سرٌّ. قالت: لا تُخْبِرَنَّ بِسرِّ رسول الله - صلى الله عليه وسلم - أحَدًا، قَالَ أنَسٌ: وَاللهِ لَوْ حَدَّثْتُ بِهِ أحَدًا لَحَدَّثْتُكَ بِهِ يَا ثَابِتُ. رواه مسلم وروى البخاري بعضه مختصرًا. (1)

তাহকীক:
 হাদীসের ব্যাখ্যা
হাদীসের ব্যাখ্যাহাদীস নং: ৬৮৮
 বিবিধ আদব - শিষ্টাচারের অধ্যায়
প্রতিশ্রুতি পূরণ করা ও ওয়াদা রক্ষা করা
العَهْدُ অর্থ অঙ্গীকার, প্রতিশ্রুতি। পরিভাষায় শর্তযুক্ত ওয়াদাকে العَهْدُ বলে। যেমন তুমি পরীক্ষায় ১ম বিভাগে উত্তীর্ণ হলে তোমাকে এই কিতাবটি পুরস্কার দেব, তুমি আমার বাড়ি বেড়াতে আসলে আমিও তোমার বাড়ি বেড়াতে যাব, তুমি তার দেনা পরিশোধ করলে আমি তোমাকে সে পরিমাণ অর্থ দিয়ে দেব ইত্যাদি। অঙ্গীকার পূরণ করা ওয়াজিব ও অবশ্যকর্তব্য। তা পূরণ না করা কঠিন পাপ। আখিরাতে এ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে।
الْوَعْدُ অর্থ ওয়াদা। এটা শর্তবিহীন হয়ে থাকে। যেমন বলল, আমি তোমাকে এই কিতাবখানি দেব, আমি তোমাকে এত টাকা ঋণ দেব, আমি তোমার বাড়ি বেড়াতে যাব, আমি অমুক রোগীকে দেখতে যাব, আমি তার চিকিৎসার খরচ দেব ইত্যাদি। এটা এক রকম হাদিয়া ও উপহার, যা পূরণ করা ওয়াজিব নয়। কাজেই তা পূরণ না করলে কোনও গুনাহও হবে না। অবশ্য ওয়াদা করার সময় যদি মনে মনে তা পূরণ না করার নিয়ত থাকে, তবে অবশ্যই গুনাহ হবে। কেননা সে ক্ষেত্রে ওয়াদাটি মিথ্যা কথার অন্তর্ভুক্ত হবে। মিথ্যা বলা কঠিন গুনাহ। যদি পূরণ করার নিয়ত থাকে আর পরে মন ঘুরে যায় এবং সে কারণে ওয়াদা পূরণ না করে, তবে কোনও গুনাহ হবে না। হাঁ, মানুষের মুখের কথার মূল্য আছে। তাই ওয়াদা যখন করা হয়েছে, তখন পূরণ করাই বাঞ্ছনীয়। বলা হয়ে থাকে- اَلْكَرِيمُ إِذَا وَعَدَ وَفَى (ভদ্র লোক যখন কোনও বিষয়ে ওয়াদা করে, তা পূরণ করে)। হযরত ইসমা'ঈল আলাইহিস সালাম ওয়াদাপূরণে খুব বেশি যত্নবান ছিলেন। তাই কুরআন মাজীদে তাঁর প্রশংসা করে বলা হয়েছে-
إِنَّهُ كَانَ صَادِقَ الْوَعْدِ وَكَانَ رَسُولًا نَبِيًّا
‘নিশ্চয়ই সে ছিল ওয়াদার ক্ষেত্রে সত্যবাদী এবং রাসূল ও নবী।(সূরা মারয়াম (১৯), আয়াত ৫৪)
    
প্রকাশ থাকে যে, শরী'আতবিরোধী কোনও কাজের ওয়াদা করলে তা রক্ষা করা নয়। বরং সে ওয়াদা ভঙ্গ করাই জরুরি। যেমন বলল, তোমরা এখানে কনসার্টের আয়োজন করো, খরচ আমি দেব। এ ওয়াদাটি সম্পূর্ণ শরী'আতবিরোধী। তাই এটা পূরণ করা জরুরি তো নয়ই, জায়েযও নয়।
আমাদের দীনে অন্যান্য বিষয়ের মতো আখলাক-চরিত্রেরও পূর্ণাঙ্গ শিক্ষাদান করা হয়েছে। সে শিক্ষার এক গুরুত্বপূর্ণ দিক হল প্রতিশ্রুতি ও ওয়াদা রক্ষা। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে প্রতিশ্রুতি রক্ষা ও ওয়াদা পূরণে অত্যন্ত সচেতন ছিলেন। তিনি সাহাবায়ে কেরামকেও এ বিষয়ে সচেতন করে তুলেছিলেন। তাই তাঁরা কখনও প্রতিশ্রুতি ও ওয়াদার বরখেলাপ করতেন না। তাঁদের অনুসরণে প্রত্যেক মুসলিমেরই এ বিষয়ে সচেতন থাকা উচিত। সে লক্ষ্যেই বর্তমান পরিচ্ছেদে এ বিষয় সম্পর্কিত কয়েকটি আয়াত ও হাদীছ উল্লেখ করা হয়েছে। আমরা তার বঙ্গানুবাদ ও সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা পেশ করছি। আল্লাহ তা'আলাই তাওফীকদাতা।
‘প্রতিশ্রুতি পূরণ করা ও ওয়াদা রক্ষা করা’ সম্পর্কিত কিছু আয়াত
এক নং আয়াত
وَأَوْفُوا بِالْعَهْدِ إِنَّ الْعَهْدَ كَانَ مَسْئُولًا
অর্থ: আর অঙ্গীকার পূরণ করো। নিশ্চয়ই অঙ্গীকার সম্পর্কে (তোমাদের) জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।(সূরা বনী ইসরাঈল (১৭), আয়াত ৩৪)
ব্যাখ্যা
এ আয়াতটি ৮৫ নং অধ্যায়ে গত হয়েছে। সেখানে এর ব্যাখ্যা দ্রষ্টব্য।
দুই নং আয়াত
وَأَوْفُوا بِعَهْدِ اللَّهِ إِذَا عَاهَدْتُمْ
অর্থ: তোমরা যখন কোনও অঙ্গীকার কর, তখন আল্লাহর সঙ্গে কৃত অঙ্গীকার পূর্ণ করো।(সূরা নাহল (১৬), আয়াত ৯১)
ব্যাখ্যা
আল্লাহর সঙ্গে কৃত অঙ্গীকার বলতে শরী'আতের বিধানাবলি বোঝানো হয়েছে। বান্দা যখন ঈমান এনেছে অর্থাৎ স্বীকার করে নিয়েছে যে, আল্লাহ ছাড়া কোনও মা'বৃদ নেই এবং হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর বান্দা ও রাসূল, তখন এর মাধ্যমে সে যেন এ অঙ্গীকারে আবদ্ধ হয়ে গেছে যে, আল্লাহ তা'আলা তাঁর রাসূলের মাধ্যমে যে দীন ও শরী'আত দান করেছেন সে তা পুরোপুরি মেনে চলবে। আয়াতে একেই 'আল্লাহর সঙ্গে কৃত অঙ্গীকার' শব্দে ব্যক্ত করা হয়েছে। তাছাড়া মানুষ একে অন্যের সঙ্গে যে অঙ্গীকার বা চুক্তি করে, তাও এর অন্তর্ভুক্ত। কেননা আল্লাহ তা'আলার পক্ষ থেকে তা রক্ষা করারও নির্দেশ রয়েছে।
আয়াতটির শিক্ষা
অঙ্গীকার রক্ষা ইসলামের এক গুরুত্বপূর্ণ হুকুম। সুতরাং তা অবশ্যই রক্ষা করতে হবে।
তিন নং আয়াত
يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَوْفُوا بِالْعُقُودِ
অর্থ: হে মুমিনগণ! তোমরা অঙ্গীকার পূরণ করো।(সূরা মায়িদা (৫), আয়াত ১)
ব্যাখ্যা
عُقُودٌ শব্দটি عَقْدٌ এর বহুবচন। এর অর্থ অঙ্গীকার, ওয়াদা ও চুক্তি। আয়াতে ব্যাপকভাবে সর্বপ্রকার অঙ্গীকার ও চুক্তি পূরণের হুকুম দেওয়া হয়েছে। সুতরাং শরী'আতের বিধানাবলি, বেচাকেনা, আমানত, ইজারা, ঋণ, বন্ধক, বিবাহ এবং দুই দেশ বা দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্পাদিত যে-কোনও চুক্তি এর অন্তর্ভুক্ত। সুতরাং এ আয়াতের হুকুম মোতাবেক দুই পক্ষের মধ্যে সম্পাদিত যে-কোনও অঙ্গীকার বা চুক্তি রক্ষা করা অবশ্যকর্তব্য।
আল্লাহ তা'আলা ঈমানদারদেরকে ডাক দিয়ে অঙ্গীকার পূরণের হুকুম দিয়েছেন। এর মধ্যে ইঙ্গিত রয়েছে অঙ্গীকার পূরণ করা ঈমানেরই দাবি। সুতরাং এক হাদীছে ইরশাদ হয়েছে-
لَا إِيْمَانَ لِمَنْ لَا أَمَانَةَ لَهُ ، وَلَا دِيْنَ لِمَنْ لَا عَهْدَ لَهُ
‘ওই ব্যক্তির ঈমান নেই, যার আমানতদারি নেই এবং ওই ব্যক্তির দীন নেই, যে অঙ্গীকার রক্ষা করে না।(সহীহ ইবনে হিব্বান: ১৯৪; মুসান্নাফে ইবন আবী শায়বা: ৩০৪০১; মুসনাদুল বাযযার: ৭১৯৬ মুসনাদে আবু ইয়া'লা: ২৪৫৮; তহাবী, শারহু মুশকিলিল আছার ৪৬৯৩; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর: ১০৫৫৩; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা: ১২৬৯০; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ ৩৯)
ঈমানদারদের লক্ষ্য করে অঙ্গীকার ও চুক্তি রক্ষার হুকুম দেওয়ার দ্বারা এদিকেও ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, কেবল ওইসকল অঙ্গীকার রক্ষা করাই জরুরি, যা ঈমানের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। সুতরাং কেউ যদি কারও সঙ্গে শরী'আতবিরোধী কোনও ওয়াদা বা চুক্তি করে, তবে তা রক্ষা করা জরুরি নয়। বরং সে চুক্তি ভঙ্গ করাই জরুরি। যেমন সুদ-ঘুষের চুক্তি।
আয়াতটির শিক্ষা
ক. ওয়াদা বা চুক্তি রক্ষা করা ঈমানের দাবি। সুতরাং প্রত্যেক মুমিনকে চুক্তি রক্ষায় যত্নবান থাকতে হবে।
খ. যেসব ওয়াদা ও চুক্তি শরী'আতসম্মত নয়, তা রক্ষা করাও জরুরি নয়।
চার নং আয়াত
يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لِمَ تَقُولُونَ مَا لَا تَفْعَلُونَ (2) كَبُرَ مَقْتًا عِنْدَ اللَّهِ أَنْ تَقُولُوا مَا لَا تَفْعَلُونَ (3)
অর্থ: হে মুমিনগণ! তোমরা এমন কথা কেন বল, যা কর না? আল্লাহর কাছে এ বিষয়টা অতি ঘৃণ্য যে, তোমরা এমন কথা বলবে, যা তোমরা কর না।(সূরা সাফ্ফ (৬১), আয়াত ২-৩)
ব্যাখ্যা
আয়াতটির সম্পর্ক তিন শ্রেণির লোকের সঙ্গে। ক. যারা ভালো ভালো কাজ করবে বলে ওয়াদা করে, কিন্তু পরে সে ওয়াদা রক্ষা করে না। খ. যারা ভালো ভালো কাজ করেছে বলে প্রকাশ করে, কিন্তু বাস্তবে তা করেনি। গ. যারা ভালো ভালো কাজের উপদেশ ও নসীহত করে, কিন্তু নিজেরা সে অনুযায়ী আমল করে না।
এক শ্রেণির লোক আছে, যারা বিশেষ বিশেষ পরিস্থিতিতে বড় গলায় বলে ওঠে যে, সময় আসলে দেখিয়ে দেব আমি কী করতে পারি। পরে যখন সময় আসে, তখন তাদেরকে ধারেকাছেও পাওয়া যায় না। এমনকি বদর যুদ্ধের পরও কতক সাহাবীর বেলায় এমনটা ঘটেছিল। তারা বলেছিলেন, বদর যুদ্ধ হঠাৎ করেই হয়ে যাওয়ায় আমরা তাতে শরীক হতে পারিনি। ভবিষ্যতে যদি কখনও এমন যুদ্ধের অবকাশ আসে, তখন আমরা দেখিয়ে দেব কেমন জানপ্রাণ দিয়ে লড়াই করি।
কোনও কোনও লোক বলেছিল, আমরা যদি জানতে পারতাম কোন আমল আল্লাহর কাছে বেশি প্রিয়, তবে আমরা তা করতাম। আল্লাহ তা'আলা জানিয়ে দেন যে, আল্লাহ তা'আলার কাছে জিহাদই সবচে' প্রিয় আমল। কিন্তু তাদের কাছে এটা খুব কঠিন মনে হল। ফলে যখনই জিহাদের ডাক আসল, তারা তা থেকে পিছিয়ে থাকল।
মুনাফিকদের তো এটা সব সময়কার অভ্যাস। তারা ভালো কাজের ওয়াদা করে, কিন্তু বাস্তবে তা করে না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যমানায়ও এরকম ছিল। তারা মুমিনদের বলত, তোমরা যখন যুদ্ধে যাবে, তখন আমরাও তোমাদের সঙ্গে যাব এবং তোমাদের সাহায্য করব। কিন্তু তারা এক তো যুদ্ধে যেতই না, আবার গেলেও তারা সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করত না। সর্বদাই তারা অসহযোগিতা করত। এটা সুস্পষ্টই ওয়াদা খেলাফি ও নীতিভ্রষ্টতা। এদেরকে তিরস্কার করে আল্লাহ তা'আলা বলেন- لِمَ تَقُوْلُوْنَ مَا لَا تَفْعَلُوْنَ (তোমরা এমন কথা কেন বল, যা কর না)। অর্থাৎ এমন ওয়াদা কেন কর বা এমন প্রতিশ্রুতি কেন দাও, যা তোমরা পূরণ কর না?
কিছু লোক এমনও আছে, যারা মুখে বলে বেড়ায় আমরা তাহাজ্জুদ পড়ি, আল্লাহর পথে দান-খয়রাত করি, অমুক মসজিদটি আমাদের করা, অমুক সেতুটি আমরাই করে দিয়েছি, আমরা এই করেছি সেই করেছি। বাস্তবে কিছুই করেনি। অনেকেই বলে থাকে আমি অনেক ধৈর্য ধরেছি, আর নয়। বাস্তবে মোটেই ধৈর্য ধরেনি। বলে থাকে, আমি তাকে অনেক বুঝিয়েছি, অনেক দরদের সঙ্গে উপদেশ দিয়েছি। প্রকৃতপক্ষে সে এর কিছুই করেনি। অনেক সময় তারা হাবভাব দ্বারাও এ জাতীয় কাজ করে থাকে বলে বোঝানোর চেষ্টা করে। প্রকৃতপক্ষে তারা আদৌ তা করে না। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যমানায় মুনাফিকরা এরকমই ছিল। কিছুই না করেও 'করেছি' বলে প্রচার করত। আল্লাহ তা'আলা বলছেন- لِمَ تَقُوْلُوْنَ مَا لَا تَفْعَلُونَ (তোমরা এমন কথা কেন বল, যা কর না)। অর্থাৎ বাস্তবে যা করনি, তা করেছ বলে প্রচার করছ কেন?
এমনিভাবে বেআমল ওয়ায়েজদের জন্যও আয়াতটি প্রযোজ্য। অনেক ওয়াজ- নসীহতকারী মানুষকে ভালো ভালো কাজের উপদেশ দেয়। বিভিন্ন নেক আমলের ফযীলত বলে মানুষকে তা করার প্রতি উৎসাহ যোগায়। কিন্তু নিজেদের আমল নেই। নিজেরা সেসব আমল থেকে অনেক দূরে। আল্লাহ তা'আলা বলছেন- لِمَ تَقُوْلُوْنَ مَا لَا تَفْعَلُوْنَ (তোমরা এমন কথা কেন বল, যা কর না)। অর্থাৎ যেসব নেক আমল নিজেরা কর না, মানুষকে তার উপদেশ দাও কেন? যেমন অপর এক আয়াতে আছে-
أَتَأْمُرُونَ النَّاسَ بِالْبِرِّ وَتَنْسَوْنَ أَنْفُسَكُمْ
‘তোমরা কি অন্য লোকদেরকে পুণ্যের আদেশ কর আর নিজেদেরকে ভুলে যাও?'(সূরা বাকারা (২), আয়াত ৪৪)
এর দ্বারা এ কথা বোঝানো উদ্দেশ্য নয় যে, আমল নেই বলে ওয়াজ করা যাবে না। বরং উদ্দেশ্য হল মানুষকে যখন ভালো কাজের উপদেশ দিচ্ছ, তখন তোমাদের নিজেদেরও সে অনুযায়ী আমল করা উচিত।
মোটকথা ভালো কাজের প্রতিশ্রুতি দিয়ে সে প্রতিশ্রুতি রক্ষা না করা, ভালো কাজ না করেও 'করেছি' বলে প্রচার করা এবং নিজে নেক আমলে উদাসীন থেকে অন্যদের ওয়াজ-নসীহত করা নিন্দনীয় কাজ। আল্লাহ তা'আলা এ আয়াতে এদের সকলকেই তিরস্কার করেছেন। কাজেই এর থেকে সকলেরই বিরত থাকা উচিত। কেননা যারা এরূপ করে, আল্লাহ তা'আলা তাদের প্রতি নারাজ হন। আয়াতে আল্লাহ তা'আলা বলেন-
كَبُرَ مَقْتًا عِنْدَ اللَّهِ أَنْ تَقُوْلُوْا مَا لَا تَفْعَلُونَ (আল্লাহর কাছে এ বিষয়টা অতি ঘৃণ্য যে, তোমরা এমন কথা বলবে, যা তোমরা কর না)। বলাবাহুল্য, যে কাজ আল্লাহ তা'আলার কাছে ঘৃণ্য তা যে করবে, সে তাঁর ঘৃণার পাত্রে পরিণত হবে। আল্লাহ তা'আলা আমাদেরকে তা থেকে রক্ষা করুন।
আয়াতটির শিক্ষা
ক. কোনও সৎকর্মের অঙ্গীকার করলে তা অবশ্যই পূরণ করা উচিত।
খ. যেসব নেক আমল নিজে করা হয় না, তা 'করি' বলে প্রকাশ করতে নেই। কারণ তা সুস্পষ্ট মিথ্যাচার।
গ. অন্যকে সৎকর্মের উপদেশ দিয়ে নিজে তা থেকে গাফেল থাকা উচিত নয়। বরং উপদেশ দেওয়ার পাশাপাশি নিজেরও সে অনুযায়ী আমলে যত্নবান থাকা চাই।
العَهْدُ অর্থ অঙ্গীকার, প্রতিশ্রুতি। পরিভাষায় শর্তযুক্ত ওয়াদাকে العَهْدُ বলে। যেমন তুমি পরীক্ষায় ১ম বিভাগে উত্তীর্ণ হলে তোমাকে এই কিতাবটি পুরস্কার দেব, তুমি আমার বাড়ি বেড়াতে আসলে আমিও তোমার বাড়ি বেড়াতে যাব, তুমি তার দেনা পরিশোধ করলে আমি তোমাকে সে পরিমাণ অর্থ দিয়ে দেব ইত্যাদি। অঙ্গীকার পূরণ করা ওয়াজিব ও অবশ্যকর্তব্য। তা পূরণ না করা কঠিন পাপ। আখিরাতে এ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে।
الْوَعْدُ অর্থ ওয়াদা। এটা শর্তবিহীন হয়ে থাকে। যেমন বলল, আমি তোমাকে এই কিতাবখানি দেব, আমি তোমাকে এত টাকা ঋণ দেব, আমি তোমার বাড়ি বেড়াতে যাব, আমি অমুক রোগীকে দেখতে যাব, আমি তার চিকিৎসার খরচ দেব ইত্যাদি। এটা এক রকম হাদিয়া ও উপহার, যা পূরণ করা ওয়াজিব নয়। কাজেই তা পূরণ না করলে কোনও গুনাহও হবে না। অবশ্য ওয়াদা করার সময় যদি মনে মনে তা পূরণ না করার নিয়ত থাকে, তবে অবশ্যই গুনাহ হবে। কেননা সে ক্ষেত্রে ওয়াদাটি মিথ্যা কথার অন্তর্ভুক্ত হবে। মিথ্যা বলা কঠিন গুনাহ। যদি পূরণ করার নিয়ত থাকে আর পরে মন ঘুরে যায় এবং সে কারণে ওয়াদা পূরণ না করে, তবে কোনও গুনাহ হবে না। হাঁ, মানুষের মুখের কথার মূল্য আছে। তাই ওয়াদা যখন করা হয়েছে, তখন পূরণ করাই বাঞ্ছনীয়। বলা হয়ে থাকে- اَلْكَرِيمُ إِذَا وَعَدَ وَفَى (ভদ্র লোক যখন কোনও বিষয়ে ওয়াদা করে, তা পূরণ করে)। হযরত ইসমা'ঈল আলাইহিস সালাম ওয়াদাপূরণে খুব বেশি যত্নবান ছিলেন। তাই কুরআন মাজীদে তাঁর প্রশংসা করে বলা হয়েছে-
إِنَّهُ كَانَ صَادِقَ الْوَعْدِ وَكَانَ رَسُولًا نَبِيًّا
‘নিশ্চয়ই সে ছিল ওয়াদার ক্ষেত্রে সত্যবাদী এবং রাসূল ও নবী।(সূরা মারয়াম (১৯), আয়াত ৫৪)
প্রকাশ থাকে যে, শরী'আতবিরোধী কোনও কাজের ওয়াদা করলে তা রক্ষা করা নয়। বরং সে ওয়াদা ভঙ্গ করাই জরুরি। যেমন বলল, তোমরা এখানে কনসার্টের আয়োজন করো, খরচ আমি দেব। এ ওয়াদাটি সম্পূর্ণ শরী'আতবিরোধী। তাই এটা পূরণ করা জরুরি তো নয়ই, জায়েযও নয়।
আমাদের দীনে অন্যান্য বিষয়ের মতো আখলাক-চরিত্রেরও পূর্ণাঙ্গ শিক্ষাদান করা হয়েছে। সে শিক্ষার এক গুরুত্বপূর্ণ দিক হল প্রতিশ্রুতি ও ওয়াদা রক্ষা। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে প্রতিশ্রুতি রক্ষা ও ওয়াদা পূরণে অত্যন্ত সচেতন ছিলেন। তিনি সাহাবায়ে কেরামকেও এ বিষয়ে সচেতন করে তুলেছিলেন। তাই তাঁরা কখনও প্রতিশ্রুতি ও ওয়াদার বরখেলাপ করতেন না। তাঁদের অনুসরণে প্রত্যেক মুসলিমেরই এ বিষয়ে সচেতন থাকা উচিত। সে লক্ষ্যেই বর্তমান পরিচ্ছেদে এ বিষয় সম্পর্কিত কয়েকটি আয়াত ও হাদীছ উল্লেখ করা হয়েছে। আমরা তার বঙ্গানুবাদ ও সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা পেশ করছি। আল্লাহ তা'আলাই তাওফীকদাতা।
‘প্রতিশ্রুতি পূরণ করা ও ওয়াদা রক্ষা করা’ সম্পর্কিত কিছু আয়াত
এক নং আয়াত
وَأَوْفُوا بِالْعَهْدِ إِنَّ الْعَهْدَ كَانَ مَسْئُولًا
অর্থ: আর অঙ্গীকার পূরণ করো। নিশ্চয়ই অঙ্গীকার সম্পর্কে (তোমাদের) জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।(সূরা বনী ইসরাঈল (১৭), আয়াত ৩৪)
ব্যাখ্যা
এ আয়াতটি ৮৫ নং অধ্যায়ে গত হয়েছে। সেখানে এর ব্যাখ্যা দ্রষ্টব্য।
দুই নং আয়াত
وَأَوْفُوا بِعَهْدِ اللَّهِ إِذَا عَاهَدْتُمْ
অর্থ: তোমরা যখন কোনও অঙ্গীকার কর, তখন আল্লাহর সঙ্গে কৃত অঙ্গীকার পূর্ণ করো।(সূরা নাহল (১৬), আয়াত ৯১)
ব্যাখ্যা
আল্লাহর সঙ্গে কৃত অঙ্গীকার বলতে শরী'আতের বিধানাবলি বোঝানো হয়েছে। বান্দা যখন ঈমান এনেছে অর্থাৎ স্বীকার করে নিয়েছে যে, আল্লাহ ছাড়া কোনও মা'বৃদ নেই এবং হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর বান্দা ও রাসূল, তখন এর মাধ্যমে সে যেন এ অঙ্গীকারে আবদ্ধ হয়ে গেছে যে, আল্লাহ তা'আলা তাঁর রাসূলের মাধ্যমে যে দীন ও শরী'আত দান করেছেন সে তা পুরোপুরি মেনে চলবে। আয়াতে একেই 'আল্লাহর সঙ্গে কৃত অঙ্গীকার' শব্দে ব্যক্ত করা হয়েছে। তাছাড়া মানুষ একে অন্যের সঙ্গে যে অঙ্গীকার বা চুক্তি করে, তাও এর অন্তর্ভুক্ত। কেননা আল্লাহ তা'আলার পক্ষ থেকে তা রক্ষা করারও নির্দেশ রয়েছে।
আয়াতটির শিক্ষা
অঙ্গীকার রক্ষা ইসলামের এক গুরুত্বপূর্ণ হুকুম। সুতরাং তা অবশ্যই রক্ষা করতে হবে।
তিন নং আয়াত
يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَوْفُوا بِالْعُقُودِ
অর্থ: হে মুমিনগণ! তোমরা অঙ্গীকার পূরণ করো।(সূরা মায়িদা (৫), আয়াত ১)
ব্যাখ্যা
عُقُودٌ শব্দটি عَقْدٌ এর বহুবচন। এর অর্থ অঙ্গীকার, ওয়াদা ও চুক্তি। আয়াতে ব্যাপকভাবে সর্বপ্রকার অঙ্গীকার ও চুক্তি পূরণের হুকুম দেওয়া হয়েছে। সুতরাং শরী'আতের বিধানাবলি, বেচাকেনা, আমানত, ইজারা, ঋণ, বন্ধক, বিবাহ এবং দুই দেশ বা দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্পাদিত যে-কোনও চুক্তি এর অন্তর্ভুক্ত। সুতরাং এ আয়াতের হুকুম মোতাবেক দুই পক্ষের মধ্যে সম্পাদিত যে-কোনও অঙ্গীকার বা চুক্তি রক্ষা করা অবশ্যকর্তব্য।
আল্লাহ তা'আলা ঈমানদারদেরকে ডাক দিয়ে অঙ্গীকার পূরণের হুকুম দিয়েছেন। এর মধ্যে ইঙ্গিত রয়েছে অঙ্গীকার পূরণ করা ঈমানেরই দাবি। সুতরাং এক হাদীছে ইরশাদ হয়েছে-
لَا إِيْمَانَ لِمَنْ لَا أَمَانَةَ لَهُ ، وَلَا دِيْنَ لِمَنْ لَا عَهْدَ لَهُ
‘ওই ব্যক্তির ঈমান নেই, যার আমানতদারি নেই এবং ওই ব্যক্তির দীন নেই, যে অঙ্গীকার রক্ষা করে না।(সহীহ ইবনে হিব্বান: ১৯৪; মুসান্নাফে ইবন আবী শায়বা: ৩০৪০১; মুসনাদুল বাযযার: ৭১৯৬ মুসনাদে আবু ইয়া'লা: ২৪৫৮; তহাবী, শারহু মুশকিলিল আছার ৪৬৯৩; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর: ১০৫৫৩; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা: ১২৬৯০; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ ৩৯)
ঈমানদারদের লক্ষ্য করে অঙ্গীকার ও চুক্তি রক্ষার হুকুম দেওয়ার দ্বারা এদিকেও ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, কেবল ওইসকল অঙ্গীকার রক্ষা করাই জরুরি, যা ঈমানের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। সুতরাং কেউ যদি কারও সঙ্গে শরী'আতবিরোধী কোনও ওয়াদা বা চুক্তি করে, তবে তা রক্ষা করা জরুরি নয়। বরং সে চুক্তি ভঙ্গ করাই জরুরি। যেমন সুদ-ঘুষের চুক্তি।
আয়াতটির শিক্ষা
ক. ওয়াদা বা চুক্তি রক্ষা করা ঈমানের দাবি। সুতরাং প্রত্যেক মুমিনকে চুক্তি রক্ষায় যত্নবান থাকতে হবে।
খ. যেসব ওয়াদা ও চুক্তি শরী'আতসম্মত নয়, তা রক্ষা করাও জরুরি নয়।
চার নং আয়াত
يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لِمَ تَقُولُونَ مَا لَا تَفْعَلُونَ (2) كَبُرَ مَقْتًا عِنْدَ اللَّهِ أَنْ تَقُولُوا مَا لَا تَفْعَلُونَ (3)
অর্থ: হে মুমিনগণ! তোমরা এমন কথা কেন বল, যা কর না? আল্লাহর কাছে এ বিষয়টা অতি ঘৃণ্য যে, তোমরা এমন কথা বলবে, যা তোমরা কর না।(সূরা সাফ্ফ (৬১), আয়াত ২-৩)
ব্যাখ্যা
আয়াতটির সম্পর্ক তিন শ্রেণির লোকের সঙ্গে। ক. যারা ভালো ভালো কাজ করবে বলে ওয়াদা করে, কিন্তু পরে সে ওয়াদা রক্ষা করে না। খ. যারা ভালো ভালো কাজ করেছে বলে প্রকাশ করে, কিন্তু বাস্তবে তা করেনি। গ. যারা ভালো ভালো কাজের উপদেশ ও নসীহত করে, কিন্তু নিজেরা সে অনুযায়ী আমল করে না।
এক শ্রেণির লোক আছে, যারা বিশেষ বিশেষ পরিস্থিতিতে বড় গলায় বলে ওঠে যে, সময় আসলে দেখিয়ে দেব আমি কী করতে পারি। পরে যখন সময় আসে, তখন তাদেরকে ধারেকাছেও পাওয়া যায় না। এমনকি বদর যুদ্ধের পরও কতক সাহাবীর বেলায় এমনটা ঘটেছিল। তারা বলেছিলেন, বদর যুদ্ধ হঠাৎ করেই হয়ে যাওয়ায় আমরা তাতে শরীক হতে পারিনি। ভবিষ্যতে যদি কখনও এমন যুদ্ধের অবকাশ আসে, তখন আমরা দেখিয়ে দেব কেমন জানপ্রাণ দিয়ে লড়াই করি।
কোনও কোনও লোক বলেছিল, আমরা যদি জানতে পারতাম কোন আমল আল্লাহর কাছে বেশি প্রিয়, তবে আমরা তা করতাম। আল্লাহ তা'আলা জানিয়ে দেন যে, আল্লাহ তা'আলার কাছে জিহাদই সবচে' প্রিয় আমল। কিন্তু তাদের কাছে এটা খুব কঠিন মনে হল। ফলে যখনই জিহাদের ডাক আসল, তারা তা থেকে পিছিয়ে থাকল।
মুনাফিকদের তো এটা সব সময়কার অভ্যাস। তারা ভালো কাজের ওয়াদা করে, কিন্তু বাস্তবে তা করে না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যমানায়ও এরকম ছিল। তারা মুমিনদের বলত, তোমরা যখন যুদ্ধে যাবে, তখন আমরাও তোমাদের সঙ্গে যাব এবং তোমাদের সাহায্য করব। কিন্তু তারা এক তো যুদ্ধে যেতই না, আবার গেলেও তারা সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করত না। সর্বদাই তারা অসহযোগিতা করত। এটা সুস্পষ্টই ওয়াদা খেলাফি ও নীতিভ্রষ্টতা। এদেরকে তিরস্কার করে আল্লাহ তা'আলা বলেন- لِمَ تَقُوْلُوْنَ مَا لَا تَفْعَلُوْنَ (তোমরা এমন কথা কেন বল, যা কর না)। অর্থাৎ এমন ওয়াদা কেন কর বা এমন প্রতিশ্রুতি কেন দাও, যা তোমরা পূরণ কর না?
কিছু লোক এমনও আছে, যারা মুখে বলে বেড়ায় আমরা তাহাজ্জুদ পড়ি, আল্লাহর পথে দান-খয়রাত করি, অমুক মসজিদটি আমাদের করা, অমুক সেতুটি আমরাই করে দিয়েছি, আমরা এই করেছি সেই করেছি। বাস্তবে কিছুই করেনি। অনেকেই বলে থাকে আমি অনেক ধৈর্য ধরেছি, আর নয়। বাস্তবে মোটেই ধৈর্য ধরেনি। বলে থাকে, আমি তাকে অনেক বুঝিয়েছি, অনেক দরদের সঙ্গে উপদেশ দিয়েছি। প্রকৃতপক্ষে সে এর কিছুই করেনি। অনেক সময় তারা হাবভাব দ্বারাও এ জাতীয় কাজ করে থাকে বলে বোঝানোর চেষ্টা করে। প্রকৃতপক্ষে তারা আদৌ তা করে না। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যমানায় মুনাফিকরা এরকমই ছিল। কিছুই না করেও 'করেছি' বলে প্রচার করত। আল্লাহ তা'আলা বলছেন- لِمَ تَقُوْلُوْنَ مَا لَا تَفْعَلُونَ (তোমরা এমন কথা কেন বল, যা কর না)। অর্থাৎ বাস্তবে যা করনি, তা করেছ বলে প্রচার করছ কেন?
এমনিভাবে বেআমল ওয়ায়েজদের জন্যও আয়াতটি প্রযোজ্য। অনেক ওয়াজ- নসীহতকারী মানুষকে ভালো ভালো কাজের উপদেশ দেয়। বিভিন্ন নেক আমলের ফযীলত বলে মানুষকে তা করার প্রতি উৎসাহ যোগায়। কিন্তু নিজেদের আমল নেই। নিজেরা সেসব আমল থেকে অনেক দূরে। আল্লাহ তা'আলা বলছেন- لِمَ تَقُوْلُوْنَ مَا لَا تَفْعَلُوْنَ (তোমরা এমন কথা কেন বল, যা কর না)। অর্থাৎ যেসব নেক আমল নিজেরা কর না, মানুষকে তার উপদেশ দাও কেন? যেমন অপর এক আয়াতে আছে-
أَتَأْمُرُونَ النَّاسَ بِالْبِرِّ وَتَنْسَوْنَ أَنْفُسَكُمْ
‘তোমরা কি অন্য লোকদেরকে পুণ্যের আদেশ কর আর নিজেদেরকে ভুলে যাও?'(সূরা বাকারা (২), আয়াত ৪৪)
এর দ্বারা এ কথা বোঝানো উদ্দেশ্য নয় যে, আমল নেই বলে ওয়াজ করা যাবে না। বরং উদ্দেশ্য হল মানুষকে যখন ভালো কাজের উপদেশ দিচ্ছ, তখন তোমাদের নিজেদেরও সে অনুযায়ী আমল করা উচিত।
মোটকথা ভালো কাজের প্রতিশ্রুতি দিয়ে সে প্রতিশ্রুতি রক্ষা না করা, ভালো কাজ না করেও 'করেছি' বলে প্রচার করা এবং নিজে নেক আমলে উদাসীন থেকে অন্যদের ওয়াজ-নসীহত করা নিন্দনীয় কাজ। আল্লাহ তা'আলা এ আয়াতে এদের সকলকেই তিরস্কার করেছেন। কাজেই এর থেকে সকলেরই বিরত থাকা উচিত। কেননা যারা এরূপ করে, আল্লাহ তা'আলা তাদের প্রতি নারাজ হন। আয়াতে আল্লাহ তা'আলা বলেন-
كَبُرَ مَقْتًا عِنْدَ اللَّهِ أَنْ تَقُوْلُوْا مَا لَا تَفْعَلُونَ (আল্লাহর কাছে এ বিষয়টা অতি ঘৃণ্য যে, তোমরা এমন কথা বলবে, যা তোমরা কর না)। বলাবাহুল্য, যে কাজ আল্লাহ তা'আলার কাছে ঘৃণ্য তা যে করবে, সে তাঁর ঘৃণার পাত্রে পরিণত হবে। আল্লাহ তা'আলা আমাদেরকে তা থেকে রক্ষা করুন।
আয়াতটির শিক্ষা
ক. কোনও সৎকর্মের অঙ্গীকার করলে তা অবশ্যই পূরণ করা উচিত।
খ. যেসব নেক আমল নিজে করা হয় না, তা 'করি' বলে প্রকাশ করতে নেই। কারণ তা সুস্পষ্ট মিথ্যাচার।
গ. অন্যকে সৎকর্মের উপদেশ দিয়ে নিজে তা থেকে গাফেল থাকা উচিত নয়। বরং উপদেশ দেওয়ার পাশাপাশি নিজেরও সে অনুযায়ী আমলে যত্নবান থাকা চাই।
মুনাফিকের তিন আলামত
হাদীছ নং: ৬৮৮
হযরত আবূ হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, মুনাফিকের আলামত তিনটি- যখন কথা বলে মিথ্যা বলে। যখন ওয়াদা করে তা ভঙ্গ করে এবং যখন তাদের কাছে আমানত রাখা হয় তাতে খেয়ানত করে। -বুখারী ও মুসলিম
(সহীহ বুখারী: ৩৩; সহীহ মুসলিম: ৫৯; জামে' তিরমিযী: ২৬৩১; সুনানে নাসাঈ: ৫০২১ মুসনাদে আহমাদ: ৮৬৭০; বাগাবী, শারহুস্ সুন্নাহ: ৩৫; মুসনাদুল বাযযার: ৮৩১৫; মুসনাদে আবু ইয়া'লা : ৬৫৩৩; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা: ১১৪৫৮; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ: ৩৫)
মুসলিমের এক বর্ণনায় অতিরিক্ত আছে, যদিও সে রোযা রাখে ও নামায পড়ে এবং মনে করে সে একজন মুসলিম।
হাদীছ নং: ৬৮৮
হযরত আবূ হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, মুনাফিকের আলামত তিনটি- যখন কথা বলে মিথ্যা বলে। যখন ওয়াদা করে তা ভঙ্গ করে এবং যখন তাদের কাছে আমানত রাখা হয় তাতে খেয়ানত করে। -বুখারী ও মুসলিম
(সহীহ বুখারী: ৩৩; সহীহ মুসলিম: ৫৯; জামে' তিরমিযী: ২৬৩১; সুনানে নাসাঈ: ৫০২১ মুসনাদে আহমাদ: ৮৬৭০; বাগাবী, শারহুস্ সুন্নাহ: ৩৫; মুসনাদুল বাযযার: ৮৩১৫; মুসনাদে আবু ইয়া'লা : ৬৫৩৩; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা: ১১৪৫৮; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ: ৩৫)
মুসলিমের এক বর্ণনায় অতিরিক্ত আছে, যদিও সে রোযা রাখে ও নামায পড়ে এবং মনে করে সে একজন মুসলিম।
كتاب الأدب
باب الوفاء بالعهد وَإنجاز الوَعد
قَالَ الله تَعَالَى: {وَأوْفُوا بِالعَهْدِ إنَّ العَهْدَ كَانَ مَسْئُولًا} [الإسراء: 34]، وقال تَعَالَى: {وَأوْفُوا بِعَهْدِ اللهِ إِذَا عَاهَدْتُمْ} [النحل: 91]، وقال تَعَالَى: {يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أوْفُوا بِالْعُقُودِ} [المائدة: 1]، وقال تَعَالَى: {يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لِمَ تَقُولُونَ مَا لاَ تَفْعَلُونَ كَبُرَ مَقْتًا عِنْدَ اللهِ أَنْ تَقُولُوا مَا لاَ تَفْعَلُونَ} [الصف: 2 - 3].
قَالَ الله تَعَالَى: {وَأوْفُوا بِالعَهْدِ إنَّ العَهْدَ كَانَ مَسْئُولًا} [الإسراء: 34]، وقال تَعَالَى: {وَأوْفُوا بِعَهْدِ اللهِ إِذَا عَاهَدْتُمْ} [النحل: 91]، وقال تَعَالَى: {يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أوْفُوا بِالْعُقُودِ} [المائدة: 1]، وقال تَعَالَى: {يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لِمَ تَقُولُونَ مَا لاَ تَفْعَلُونَ كَبُرَ مَقْتًا عِنْدَ اللهِ أَنْ تَقُولُوا مَا لاَ تَفْعَلُونَ} [الصف: 2 - 3].
688 - وعن أَبي هريرة - رضي الله عنه: أنَّ رسول الله - صلى الله عليه وسلم - قَالَ: «آيَةُ المُنَافِقِ ثَلاَثٌ: إِذَا حَدَّثَ كَذَبَ، وَإِذَا وَعَدَ أَخْلَفَ، وَإِذَا اؤْتُمِنَ خَانَ». متفقٌ عَلَيْهِ. (1)
زَادَ في روايةٍ لمسلم: «وإنْ صَامَ وَصَلَّى وَزَعَمَ أنَّهُ مُسْلِمٌ».
زَادَ في روايةٍ لمسلم: «وإنْ صَامَ وَصَلَّى وَزَعَمَ أنَّهُ مُسْلِمٌ».

তাহকীক:
 হাদীসের ব্যাখ্যা
হাদীসের ব্যাখ্যাহাদীস নং: ৬৮৯
 বিবিধ আদব - শিষ্টাচারের অধ্যায়
৩ প্রতিশ্রুতি পূরণ করা ও ওয়াদা রক্ষা করা
মুনাফিকের আরও কিছু আলামত
হাদীছ নং: ৬৮৯
হযরত আব্দুল্লাহ ইবন আমর ইবনুল আস রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, চারটি বিষয় যে ব্যক্তির মধ্যে থাকবে সে একজন খাঁটি মুনাফিক সাব্যস্ত হবে। যার মধ্যে তা থেকে একটি থাকবে তার মধ্যে মুনাফিকীরই একটা খাসলত থাকবে, যাবৎ না সে তা ছেড়ে দেয়। তা হচ্ছে- তার কাছে যখন আমানত রাখা হয় খেয়ানত করে, যখন কথা বলে মিথ্যা বলে, যখন প্রতিশ্রুতি দেয় তা ভঙ্গ করে আর যখন কলহ-বিবাদ করে তখন সীমালঙ্ঘন করে।বুখারী-মুসলিম।
(সহীহ বুখারী: ৩৪; সহীহ মুসলিম: ৫৮; সুনানে আবু দাউদ: ৪৬৮৮; জামে তিরমিযী: ২৬৩২ সহীহ ইবনে হিব্বান: ২৫৪; মুসান্নাফে ইবন আবী শায়বা: ২৫৬১০; মুসনাদে আহমাদ: ৬৮৬৪; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা : ১৮৮৪৫; শু'আবুল ঈমান: ৪০৪৩; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ: ৩৮)
হাদীছ নং: ৬৮৯
হযরত আব্দুল্লাহ ইবন আমর ইবনুল আস রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, চারটি বিষয় যে ব্যক্তির মধ্যে থাকবে সে একজন খাঁটি মুনাফিক সাব্যস্ত হবে। যার মধ্যে তা থেকে একটি থাকবে তার মধ্যে মুনাফিকীরই একটা খাসলত থাকবে, যাবৎ না সে তা ছেড়ে দেয়। তা হচ্ছে- তার কাছে যখন আমানত রাখা হয় খেয়ানত করে, যখন কথা বলে মিথ্যা বলে, যখন প্রতিশ্রুতি দেয় তা ভঙ্গ করে আর যখন কলহ-বিবাদ করে তখন সীমালঙ্ঘন করে।বুখারী-মুসলিম।
(সহীহ বুখারী: ৩৪; সহীহ মুসলিম: ৫৮; সুনানে আবু দাউদ: ৪৬৮৮; জামে তিরমিযী: ২৬৩২ সহীহ ইবনে হিব্বান: ২৫৪; মুসান্নাফে ইবন আবী শায়বা: ২৫৬১০; মুসনাদে আহমাদ: ৬৮৬৪; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা : ১৮৮৪৫; শু'আবুল ঈমান: ৪০৪৩; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ: ৩৮)
كتاب الأدب
باب الوفاء بالعهد وَإنجاز الوَعد
689 - وعن عبد الله بن عمرو بن العاص رضي الله عنهما: أنَّ رسول الله - صلى الله عليه وسلم - قَالَ: «أرْبَعٌ مَنْ كُنَّ فِيهِ كَانَ مُنَافِقًا خَالِصًا، وَمَنْ كَانَتْ فِيهِ خَصْلَةٌ مِنْهُنَّ كَانَتْ فِيهِ خَصْلَةٌ مِنَ النِّفَاقِ حَتَّى يَدَعَهَا: إِذَا اؤْتُمِنَ خَانَ، وَإِذَا حَدَّثَ كَذَبَ، وَإِذَا عَاهَدَ غَدَرَ، وَإِذَا خَاصَمَ فَجَرَ». متفقٌ عَلَيْهِ. (1)

তাহকীক:
 হাদীসের ব্যাখ্যা
হাদীসের ব্যাখ্যাহাদীস নং: ৬৯০
 বিবিধ আদব - শিষ্টাচারের অধ্যায়
৩ প্রতিশ্রুতি পূরণ করা ও ওয়াদা রক্ষা করা
ওয়াদা পূরণের আগে কারও মৃত্যু হয়ে গেলে তার ওয়ারিছ ও স্থলাভিষিক্তের করণীয়
হাদীছ নং: ৬৯০
হযরত জাবির রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বললেন, যদি বাহরাইনের মাল আসত, তবে আমি তোমাকে এ পরিমাণ, এ পরিমাণ ও এ পরিমাণ দিতাম। কিন্তু বাহরাইনের মাল আসল না। পরিশেষে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওফাত হয়ে গেল। তারপর যখন বাহরাইনের মাল আসল, হযরত আবূ বকর রাযি.-এর আদেশে ঘোষক ঘোষণা করল, যার অনুকূলে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কোনও ওয়াদা আছে অথবা তাঁর কাছে যার কোনও পাওনা আছে, সে যেন আমাদের কাছে আসে। সুতরাং আমি তাঁর কাছে আসলাম এবং তাঁকে বললাম, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে এরূপ এরূপ বলেছিলেন। তখন তিনি আমাকে এক আঁজলা ভরে দিলেন। আমি তা গুনে দেখলাম পাঁচশ দিরহাম। তিনি আমাকে বললেন, এর দ্বিগুণ নিয়ে নাও। -বুখারী ও মুসলিম
(সহীহ বুখারী: ২২৯৬; সহীহ মুসলিম: ২৩১৪; মুসনাদুল হুমায়দী: ১২৬৮; মুসান্নাফে ইবন আবী শায়বা: ২৬৬১০; মুসনাদুল বাযযার ৯৮; মুসনাদে আবূ ইয়া'লা : ২০১৯; তহাবী, শারহু মা'আনিল আছার: ৫৪৩৪ আল-আজুররী, আশ-শারী'আ ১২৭৪; খারাইতী, মাকারিমুল আখলাক: ৬০৯)
হাদীছ নং: ৬৯০
হযরত জাবির রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বললেন, যদি বাহরাইনের মাল আসত, তবে আমি তোমাকে এ পরিমাণ, এ পরিমাণ ও এ পরিমাণ দিতাম। কিন্তু বাহরাইনের মাল আসল না। পরিশেষে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওফাত হয়ে গেল। তারপর যখন বাহরাইনের মাল আসল, হযরত আবূ বকর রাযি.-এর আদেশে ঘোষক ঘোষণা করল, যার অনুকূলে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কোনও ওয়াদা আছে অথবা তাঁর কাছে যার কোনও পাওনা আছে, সে যেন আমাদের কাছে আসে। সুতরাং আমি তাঁর কাছে আসলাম এবং তাঁকে বললাম, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে এরূপ এরূপ বলেছিলেন। তখন তিনি আমাকে এক আঁজলা ভরে দিলেন। আমি তা গুনে দেখলাম পাঁচশ দিরহাম। তিনি আমাকে বললেন, এর দ্বিগুণ নিয়ে নাও। -বুখারী ও মুসলিম
(সহীহ বুখারী: ২২৯৬; সহীহ মুসলিম: ২৩১৪; মুসনাদুল হুমায়দী: ১২৬৮; মুসান্নাফে ইবন আবী শায়বা: ২৬৬১০; মুসনাদুল বাযযার ৯৮; মুসনাদে আবূ ইয়া'লা : ২০১৯; তহাবী, শারহু মা'আনিল আছার: ৫৪৩৪ আল-আজুররী, আশ-শারী'আ ১২৭৪; খারাইতী, মাকারিমুল আখলাক: ৬০৯)
كتاب الأدب
باب الوفاء بالعهد وَإنجاز الوَعد
690 - وعن جابر - رضي الله عنه - قَالَ: قَالَ لي النبيُّ - صلى الله عليه وسلم: «لَوْ قَدْ جَاءَ مَالُ الْبَحْرَيْنِ أعْطَيْتُكَ هكَذَا وَهَكَذَا وَهكَذَا» فَلَمْ يَجِئْ مَالُ الْبَحْرَينِ حَتَّى قُبِضَ النَّبيُّ - صلى الله عليه وسلم - فَلَمَّا جَاءَ مَالُ الْبَحْرَيْنِ أمَرَ أَبُو بَكْرٍ - رضي الله عنه - فَنَادَى: مَنْ كَانَ لَهُ عِنْدَ رسول الله - صلى الله عليه وسلم - عِدَةٌ أَوْ دَيْنٌ فَلْيَأتِنَا، فَأتَيْتُهُ وَقُلْتُ لَهُ: إنَّ النَّبيَّ - صلى الله عليه وسلم - قَالَ لي كَذَا وَكَذَا، فَحَثَى لي حَثْيَةً فَعَدَدْتُهَا، فَإذَا هِيَ خَمْسُمِئَةٍ، فَقَالَ لِي: خُذْ مِثْلَيْهَا. متفقٌ عَلَيْهِ. (1)

তাহকীক:
 হাদীসের ব্যাখ্যা
হাদীসের ব্যাখ্যাহাদীস নং: ৬৯১
 বিবিধ আদব - শিষ্টাচারের অধ্যায়
কোনও সৎকর্মে অভ্যস্ত হওয়ার পর তার ধারাবাহিকতা রক্ষার আদেশ
কোনও নেক আমল ও নফল ইবাদত-বন্দেগী শুরু করার পর তা অব্যাহত রাখা উচিত। কেননা কেউ যখন কোনও নফল ইবাদত শুরু করে, তখন সে যেন আল্লাহ তা'আলার দরবারে হাজিরা দেয়। আর সে যেন জানান দেয় যে, এখন থেকে সে নিয়মিতই এ দরবারে হাজির থাকবে। পরে সে আমল ছেড়ে দিলে তা অনুপস্থিতির পর্যায়ে পড়ে। মহামহিম আল্লাহর দরবারে উপস্থিত হওয়ার পর তা অব্যাহত না রাখা। এবং নিজেকে অনুপস্থিত লোকদের কাতারে নিয়ে যাওয়া কঠিন বেয়াদবি। দুনিয়ার রাজা-বাদশার ক্ষেত্রেও এটাকে পসন্দ করা হয় না। কাজেই সকল রাজার রাজা ও বাদশার বাদশা আল্লাহ তা'আলার বেলায় এটা কী করে পসন্দনীয় হতে পারে? অতএব কোনও মুমিন ব্যক্তির পক্ষে আল্লাহর দরবারের এ অনুপস্থিতি মোটেই শোভনীয় হতে পারে না।
তাছাড়া বান্দা যে আমল করতে থাকে, তার আমলনামায় সে আমলের ছাওয়াবও লেখা হতে থাকে। আল্লাহ তা'আলা মহিমময় ও মহা দানশীল। তিনি বান্দাকে ছাওয়াব দিতে পসন্দ করেন। তিনি চান বান্দা নেক আমল অব্যাহত রেখে নিজ আমলনামায় ছাওয়াব লেখা জারি রাখুক। এক হাদীছে ইরশাদ হয়েছে-
يَا أَيُّهَا النَّاسُ، خُذُوا مِنَ الْأَعْمَالِ مَا تُطِيْقُوْنَ ، فَإِنَّ اللَّهَ لَا يَمَلُّ حَتَّى تَمَلُّوْا، وَإِنَّ أَحَبَّ الْأَعْمَالِ إِلَى اللَّهِ مَا دَامَ وَإِنْ قَلَّ
'হে মানুষ! তোমরা আমলের সেই পরিমাণ গ্রহণ করো, যা করতে সক্ষম হবে। কেননা আল্লাহ ছাওয়াব দেওয়া বন্ধ করেন না, যাবৎ না তোমরা ক্লান্ত হও (এবং আমল ছেড়ে দাও)। নিশ্চয়ই আল্লাহর কাছে সর্বোত্তম আমল তাই যা স্থায়ী হয়, যাদিও অল্প হয়।(সহীহ বুখারী: ৫৮৬১; সহীহ মুসলিম: ৮৭৫; সুনানে আবূ দাউদ: ১৩৬৮; সুনানে নাসাঈ: ৭৬২; সুনানে ইবন মাজাহ: ৪২৩৭; মুসনাদে ইসহাক ইবন রাহুয়াহ ৬২৭; মুসনাদুল বাযযার ২৯৫; মুসনাদে আবু ইয়া'লা: ৪৭৮৮; সহীহ ইবনে খুযায়মা : ১২৮২; তহাবী, শারহু মুশকিলিল আছার: ৬৫১; সহীহ ইবনে হিব্বান: ২৫৭১; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা : ৫২৩৭)
বোঝা গেল, আল্লাহ চান বান্দা তার আমলনামায় ছাওয়াব লেখানো অব্যাহত রাখুক। কোনও আমল কিছুদিন করার পর ছেড়ে দিলে তা লেখানো বন্ধ হয়ে যায়। তাই তা ছেড়ে দেওয়া কিছুতেই উচিত নয়। এজন্য শুরুতেই যখন কোনও আমল নিয়মিত করার ইচ্ছা হয়, তখন তা এ পরিমাণে গ্রহণ করা উচিত, যা নিয়মিতভাবে করে যাওয়া সম্ভব হবে, যেমনটা এ হাদীছে বলা হয়েছে।
প্রকাশ থাকে যে, এর দ্বারা ওই সমস্ত আমলের কথা বোঝানো হয়েছে, যা শুরুই করা হয় নিয়মিত করার উদ্দেশ্যে। পক্ষান্তরে হঠাৎ করে যে আমল করা হয়, সে ক্ষেত্রে এ কথা বলা হয়নি যে, তা নিয়মিত করে যেতে হবে। কেউ অন্যের দেখাদেখি হঠাৎ এক রাতে তাহাজ্জুদ পড়ল। তারপর সে যদি তাহাজ্জুদ আর না পড়ে, তা দূষণীয় হবে না, যদিও নিয়মিতভাবে তা পড়া উত্তম। হাঁ, যে ব্যক্তি একাধারে তাহাজ্জুদ পড়ছে, তার কর্তব্য তা নিয়মিত পড়ে যাওয়া। সে যদি কিছুদিন পর তা ছেড়ে দেয়, তবে তা অবশ্যই দূষণীয় হবে। এ অধ্যায়ে এটাই বোঝানো উদ্দেশ্য।
যাহোক কোনও আমলের অভ্যাস গড়ে তোলার পর তা নিয়মিত পালন করা চাই। কুরআনে কারীমের বহু আয়াত ও বিভিন্ন হাদীছে এর তাগিদ করা হয়েছে। এ পরিচ্ছেদে সে সম্পর্কিত আয়াত ও হাদীছ উল্লেখ করা হয়েছে। আমরা তার বঙ্গানুবাদ ও সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা পেশ করছি। আল্লাহ তা'আলাই তাওফীকদাতা।
‘কোনও সৎকর্মে অভ্যস্ত হওয়া…’ সম্পর্কিত কিছু আয়াত
এক নং আয়াত
إِنَّ اللَّهَ لَا يُغَيِّرُ مَا بِقَوْمٍ حَتَّى يُغَيِّرُوا مَا بِأَنْفُسِهِمْ
অর্থ: জেনে রেখো, আল্লাহ কোনও জাতির অবস্থা ততক্ষণ পর্যন্ত পরিবর্তন করেন না, যতক্ষণ না তারা নিজেরা নিজেদের অবস্থা পরিবর্তন করে।(সূরা রা'দ (১৩), আয়াত ১১)
ব্যাখ্যা
আল্লাহ তা'আলা ন্যায়পরায়ণ। তিনি কখনও কারও প্রতি জুলুম করেন না। কাজেই তিনি শুধু শুধু মানুষকে বিপদে ফেলেন না। মানুষ যে নি'আমত ও আরাম-আয়েশের মধ্যে থাকে, তা অযথাই কেড়ে নেন না। আল্লাহপ্রদত্ত নি'আমত ও আরাম-আয়েশের দাবি হল মানুষ আল্লাহ তা'আলার শোকর আদায় করবে। সে শোকর হল তাঁর আনুগত্য করা অর্থাৎ সৎকর্ম করে যাওয়া ও অসৎকর্ম হতে বিরত থাকা। মানুষ যদি আল্লাহ তা'আলার নি'আমতের শোকর আদায় করে, তবে আল্লাহ তা'আলা নি'আমত আরও বৃদ্ধি করে দেন। তখন আর নি'আমত বিলুপ্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে না। কিন্তু মানুষ বড় নাশোকর। আল্লাহ তা'আলার পক্ষ থেকে হাজারও নি'আমত পাওয়া সত্ত্বেও তারা তাঁর নাফরমানি করে, নি'আমতের অপব্যবহার করে এবং বিভিন্ন পাপকর্মে লিপ্ত হয়। এর পরিণামে আল্লাহ তা'আলা তাঁর দেওয়া নি'আমত কেড়ে নেন। ফলে নিরাপত্তার স্থানে ভয়-ভীতি, সচ্ছলতার স্থানে অসচ্ছলতা, ফল ও ফসলের প্রাচুর্যের স্থানে খরা ও দুর্ভিক্ষ ইত্যাদি দেখা দেয়। বস্তুত এ পরিণাম মানুষেরই কর্মফল। তার হাতের কামাই। আল্লাহ তা'আলা বলেন-
وَمَا أَصَابَكُمْ مِنْ مُّصِيبَةٍ فَبِمَا كَسَبَتْ أَيْدِيكُمْ وَيَعْفُوا عَنْ كَثِيرٍ
‘তোমাদের যে বিপদ দেখা দেয়, তা তোমাদের নিজ হাতের কৃতকর্মেরই কারণে দেখা দেয়। আর তিনি তোমাদের অনেক কিছুই (অপরাধ) ক্ষমা করে দেন।'(সূরা শূরা (৪২),আয়াত ৩০)
আয়াতটির শিক্ষা
ক. আল্লাহ তা'আলা বিনা কারণে কাউকে বিপদ-আপদে ফেলেন না।
খ. কেউ যদি ভালো অবস্থা হারিয়ে মন্দ অবস্থার শিকার হয়ে যায়, তবে তার বুঝতে হবে তার কোনও মন্দ কৃতকর্মের কারণেই এমন হয়েছে। তাই তার কর্তব্য হবে তাওবা করে নিজেকে সংশোধন করে নেওয়া।
গ. যে-কোনও নি'আমত ও ভালো অবস্থার জন্য আল্লাহ তা'আলার শোকর আদায় করা তথা আল্লাহর আনুগত্য করা ও পাপকর্ম থেকে বেঁচে থাকা উচিত। এটা নি'আমতবৃদ্ধি ও তার স্থায়িত্বের পক্ষে সহায়ক।
দুই নং আয়াত
وَلَا تَكُونُوا كَالَّتِي نَقَضَتْ غَزْلَهَا مِنْ بَعْدِ قُوَّةٍ أَنْكَاثًا
অর্থ: যে নারী তার সুতা মজবুত করে পাকানোর পর পাক খুলে তা রোয়া-রোয়া করে ফেলেছিল, তোমরা তার মতো হয়ো না।(সূরা নাহল (১৬), আয়াত ৯২)
ব্যাখ্যা
বর্ণিত আছে, মক্কা মুকাররমায় খারকা নাম্নী এক উন্মাদিনী ছিল। সে দিনভর পরিশ্রম করে সুতা কাটত আবার সন্ধ্যা হলে তা খুলে খুলে নষ্ট করে ফেলত। কালক্রমে তার এ কাণ্ডটি একটি দৃষ্টান্তে পরিণত হয়। যেমন কেউ যখন কোনও ভালো কাজ সম্পন্ন করার পর নিজেই তা নষ্ট করে ফেলে তখন ওই নারীর সাথে তাকে উপমিত করা হয়। এখানে তার সাথে তুলনা করা হয়েছে সেইসব লোককে, যারা কোনও বিষয়ে জোরদারভাবে কসম করার পর তা ভেঙ্গে ফেলে।
বলা হচ্ছে, তোমরা কোনও বিষয়ে অঙ্গীকার করার পর তা ভঙ্গ করো না। তা ভঙ্গ করাটা ওই উন্মাদিনী নারীর মতো নির্বুদ্ধিতার কাজ হবে। অঙ্গীকার করা হয় আল্লাহর নামে। আল্লাহর নামের মর্যাদা রক্ষা করা চাই। যে বুদ্ধিমানেরা আল্লাহর নামের সম্মান ও মর্যাদা বোঝে, তারা কখনওই অঙ্গীকার ভঙ্গ করতে পারে না। পক্ষান্তরে যারা ন্যায়-নীতি বর্জন করে দুনিয়ার হীন স্বার্থ ও কামনা-বাসনা পূরণের ধান্দায় পড়ে যায়, তারা তাদের সাধারণ কাণ্ডজ্ঞানও হারিয়ে ফেলে। তাদের কাছে শপথ ও অঙ্গীকার করার মূল্য থাকে না। আল্লাহ তা'আলার নামের মর্যাদার প্রতি তারা ভ্রূক্ষেপ করে না। তুচ্ছ তুচ্ছ কারণে তারা অঙ্গীকার ভঙ্গ করে ফেলে। যাদের সঙ্গে অঙ্গীকার করে, তাদেরকে যদি নিজের তুলনায় দুর্বল দেখতে পায়, তখন আর অঙ্গীকারের কোনও তোয়াক্কা করে না। সে ক্ষেত্রে নিজের তুচ্ছ স্বার্থ পূরণ করাই আসল লক্ষ্যবস্তু হয়ে দাঁড়ায়। এ আয়াত জানাচ্ছে, এ শ্রেণির লোক বড়ই নির্বোধ। বরং তারা এক ধরনের উন্মাদ। যারা প্রকৃত মুমিন-মুসলিম, তাদের এরূপ হওয়া সাজে না। তাদের কর্তব্য সর্বাবস্থায় নিজ শপথ ও অঙ্গীকারে অটল থাকা।
কোনও নেক আমল ও নফল ইবাদত-বন্দেগী শুরু করার পর তা অব্যাহত রাখা উচিত। কেননা শুরু করার দ্বারা এক রকম প্রতিশ্রুতি হয়ে যায় যে, তা অব্যাহত রাখা হবে। আমলটি ছেড়ে দেওয়ার দ্বারা সে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করা হয়। আলোচ্য আয়াতটি তার অর্থের ব্যাপকতা দ্বারা আমাদেরকে সতর্ক করছে যে, তোমরা কোনও ইবাদত-বন্দেগী শুরু করার পর কিছুতেই যেন তা ছেড়ে না দাও। বরং তা নিয়মিত করে যাবে এবং আপন প্রতিশ্রুতি রক্ষায় যত্নবান থাকবে।
আয়াতটির শিক্ষা
ক. প্রত্যেক মুমিনের কর্তব্য সর্বাবস্থায় আপন অঙ্গীকার রক্ষা করা।
খ. অঙ্গীকার ভঙ্গ করা নির্বুদ্ধিতা ও পাগলামি। কোনও মুমিনের পক্ষে এটা সাজে না।
গ. কোনও সৎকর্ম শুরু করার পর তা ছেড়ে দেওয়া কিছুতেই সমীচীন নয়। মুমিন ব্যক্তির কর্তব্য হবে সে সৎকর্ম নিয়মিতভাবে সম্পাদন করতে থাকা।
তিন নং আয়াত
وَلَا يَكُونُوا كَالَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَبَ مِنْ قَبْلُ فَطَالَ عَلَيْهِمُ الْأَمَدُ فَقَسَتْ قُلُوبُهُمْ
অর্থ: এবং তারা তাদের মতো হবে না, যাদেরকে পূর্বে কিতাব দেওয়া হয়েছিল অতঃপর যখন তাদের উপর দিয়ে দীর্ঘকাল অতিক্রান্ত হল, তখন তাদের অন্তর শক্ত হয়ে গেল।(সূরা হাদীদ (৫৭), আয়াত ১৬)
ব্যাখ্যা
অতীত কালের আহলে কিতাব সম্প্রদায় প্রথমদিকে তাদের কিতাবের অনুসরণ করলেও আস্তে আস্তে তারা তা থেকে দূরে সরে পড়ে। তারা কিতাবের হিদায়াত ছেড়ে দিয়ে ক্রমান্বয়ে দুনিয়ার দিকে ধাবিত হতে থাকে। এক পর্যায়ে পুরোপুরি মনের খেয়াল-খুশি পূরণ ও ভোগ-উপভোগের মধ্যে নিমজ্জিত হয়ে পড়ে। এতে করে তাদের মন শক্ত হয়ে যায়। তা এমনই শক্ত হয়ে যায় যে, গুনাহ করার কারণে তাদের অন্তরে কোনওরূপ অনুতাপ ও লজ্জাবোধও হচ্ছিল না। তাদের অন্তরের সে কঠোরতা বর্ণনা করতে গিয়ে আল্লাহ তা'আলা বলেন-
ثُمَّ قَسَتْ قُلُوبُكُمْ مِنْ بَعْدِ ذَلِكَ فَهِيَ كَالْحِجَارَةِ أَوْ أَشَدُّ قَسْوَةً وَإِنَّ مِنَ الْحِجَارَةِ لَمَا يَتَفَجَّرُ مِنْهُ الْأَنْهَارُ وَإِنَّ مِنْهَا لَمَا يَشَّقَّقُ فَيَخْرُجُ مِنْهُ الْمَاءُ وَإِنَّ مِنْهَا لَمَا يَهْبِطُ مِنْ خَشْيَةِ اللَّهِ
‘এসব কিছুর পর তোমাদের অন্তর আবার শক্ত হয়ে গেল, এমনকি তা হয়ে গেল পাথরের মতো; বরং তার চেয়েও বেশি শক্ত। (কেননা) পাথরের মধ্যে কিছু তো এমনও আছে, যা থেকে নদী-নালা প্রবাহিত হয়, তার মধ্যে কিছু এমন আছে যা ফেটে যায় এবং তা থেকে পানি নির্গত হয়, আবার তার মধ্যে এমন (পাথর)-ও আছে, যা আল্লাহর ভয়ে ধ্বসে পড়ে।(সূরা বাকারা (২), আয়াত ৭৪)
আল্লাহ তা'আলা এ উম্মতকে বলছেন, তোমাদের অন্তর যেন তাদের মতো শক্ত না হয়। অন্তর শক্ত হয়ে গেলে তোমরা পুরোপুরিভাবে দুনিয়ার প্রতি ঝুঁকে পড়বে। তখন কোনও ওয়াজ-নসীহত তোমাদের অন্তরে রেখাপাত করবে না। ফলে তোমরা ইবাদত-বন্দেগীতে উৎসাহ পাবে না; বরং তা থেকে সম্পূর্ণ বিমুখ হয়ে পাপাচারে লিপ্ত হয়ে পড়বে আর এভাবে তোমরা দুনিয়া ও আখিরাত সবই হারাবে। এ পরিণতিতে যাতে তোমরা না পৌঁছ, সেজন্য তোমাদের কর্তব্য এখনই ইবাদত-বন্দেগী আঁকড়ে ধরা। যা-কিছু ইবাদত-বন্দেগী তোমরা করছ তার কোনওটিই যাতে ছুটে না যায়, সে বিষয়ে সতর্ক থাকবে। দীনের উপর মজবুত থাকার জন্য ইবাদত-বন্দেগী অব্যাহত রাখা জরুরি। কোনওটি ছুটে গেলে তা পুনরায় শুরু করে দেওয়া চাই। অন্যথায় এক এক করে ছুটতেই থাকবে। পরিণামে সম্পূর্ণরূপে ইবাদতবিমুখ হয়ে যাবে আর এভাবে দিল-মন শক্ত হয়ে তোমরা দুনিয়াদারিতে পুরোপুরি ডুবে যাবে।
আয়াতটির শিক্ষা
ক . অন্তর যাতে শক্ত না হয়ে যায়, সে বিষয়ে আমাদের খুব সচেতন থাকতে হবে।
খ. আল্লাহওয়ালাদের সাহচর্য আঁকড়ে ধরলে মন নরম থাকে। তাই বেশিদিন আল্লাহওয়ালাদের সাহচর্য থেকে দূরে থাকতে নেই।
গ. মন নরম রাখার জন্য ইবাদত-বন্দেগীতে মনোযোগী থাকা জরুরি। তাই কোনও ইবাদত শুরু করার পর তা ছেড়ে দেওয়া উচিত নয়। বরং তা অব্যাহত রাখা এবং ইবাদত-বন্দেগীতে আরও বেশি অগ্রগামী হওয়া বাঞ্ছনীয়।
চার নং আয়াত
فَمَا رَعَوْهَا حَقَّ رِعَايَتِهَا
অর্থ: কিন্তু তারা তা যথাযথভাবে পালন করেনি।(সুরা হাদীদ (৫৭), আয়াত ২৭)
ব্যাখ্যা
এ বাক্যটি সূরা হাদীদের ৭৭ নং আয়াতের অংশবিশেষ। আয়াতটিতে রাহবানিয়্যাত (বৈরাগ্যবাদ) সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। রাহবানিয়্যাত অর্থ বৈরাগ্য তথা দুনিয়ার সব আনন্দ ও বিষয়ভোগ পরিহার করা। হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের পরে খ্রিষ্টসম্প্রদায় এমন এক আশ্রমিক ব্যবস্থার প্রবর্তন করেছিল, যাতে কোনও ব্যক্তি আশ্রমে ঢুকে পড়ার পর সংসারজীবন সম্পূর্ণরূপে বর্জন করত। বিয়ে-শাদী করত না এবং পার্থিব কোনওরকমের স্বাদ ও আনন্দে অংশগ্রহণ করত না। তাদের এই আশ্রমিক ব্যবস্থাকেই 'রাহবানিয়্যাত' বলে।
এ ব্যবস্থার সূচনা হয়েছিল এভাবে যে, হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের অনুসারীদের উপর বিভিন্ন রাজা-বাদশা জুলুম-নির্যাতন চালাতে থাকলে তারা নিজেদের দীন রক্ষার তাগিদে শহরের বাইরে গিয়ে বসবাস শুরু করল, যেখানে জীবনযাপনের সাধারণ সুবিধাসমূহ পাওয়া যেত না। কালক্রমে তাদের কাছে জীবনযাপনের এই কঠিন ব্যবস্থাই এক স্বতন্ত্র ইবাদতের রূপ পরিগ্রহ করে। পরবর্তীকালের লোকেরা জীবনযাপনের উপকরণাদি হস্তগত হওয়া সত্ত্বেও এই মনগড়া ইবাদতের জন্য তা পরিহার করতে থাকল।
আল্লাহ তা'আলা বলছেন-
وَرَهْبَانِيَّةً ابْتَدَعُوهَا مَا كَتَبْنَاهَا عَلَيْهِمْ إِلَّا ابْتِغَاءَ رِضْوَانِ اللَّهِ
‘আর রাহবানিয়্যাতের যে বিষয়টা, তা তারা নিজেরাই উদ্ভাবন করেছিল। আমি তাদের উপর তা বাধ্যতামূলক করিনি। বস্তুত তারা (এর মাধ্যমে) আল্লাহর সন্তুষ্টিবিধানই করতে চেয়েছিল।'
অর্থাৎ আমি তাদেরকে এরূপ কঠিন জীবনযাত্রার নির্দেশ দিইনি। তারা নিজেরাই এর প্রবর্তন করেছিল। তারা এর প্রবর্তন তো করেছিল, কিন্তু পরে তারা এ নিয়ম রক্ষা করতে পারেনি। তারা যে এর থেকে বিচ্যুত হয়ে গিয়েছিল, সে সম্পর্কে আল্লাহ বলছেন- فَمَا رَعَوْهَا حَقَّ رِعَايَتِهَا (কিন্তু তারা তা যথাযথভাবে পালন করেনি)। অর্থাৎ বৈরাগ্যবাদের এ প্রথা প্রথম দিকে তো তারা আল্লাহ তা'আলার সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যেই অবলম্বন করেছিল, কিন্তু পরবর্তীকালে তারা নিজেদের জীবনে এ প্রথা পুরোপুরিভাবে রক্ষা করতে পারেনি। তা রক্ষা করতে না পারার দুটো দিক আছে।
(এক) আল্লাহ তা'আলার বিধান ও নির্দেশের অনুসরণ না করা। কেননা আল্লাহ তা'আলা যে জিনিসকে তাদের জন্য বাধ্যতামূলক করেননি, তারা সেটাকে নিজেদের জন্য বাধ্যতামূলক করে নিল। মনে করল, এরূপ না করলে তাদের একটা মহা ইবাদত ছুটে যাবে। অথচ দীনের মধ্যে নিজেদের পক্ষ থেকে কোনও জিনিসকে এমন জরুরি মনে করা যে, তা না করলে অপরাধ হবে, এটা আল্লাহ তা'আলার নির্দেশের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন ও সম্পূর্ণ নাজায়েয।
(দুই) নিজেদের পক্ষ থেকে প্রবর্তিত বিষয়কে যথাযথরূপে পালন না করা। তারা রাহবানিয়্যাতের যে ব্যবস্থা চালু করেছিল, পরবর্তীকালে কার্যত তার যথাযথ অনুসরণ করতে পারেনি। যেহেতু ব্যবস্থাটাই ছিল স্বভাবের পরিপন্থী, তাই স্বাভাবিকভাবেই মানবপ্রকৃতির সাথে তার সংঘাত দেখা দিল এবং ধীরে ধীরে মানবপ্রকৃতির কাছে তা হেরে গেল। বৈরাগ্য হল বিষয়ভোগ থেকে বিরত থাকা। কিন্তু তারা নানা বাহানায় প্রকাশ্যে বা গোপনে বিষয়ভোগ শুরু করে দিল। সে প্রথায় বিবাহেও নিষেধাজ্ঞা ছিল। কিন্তু তারা এ ক্ষেত্রেও সীমালঙ্ঘন করল। বিবাহ করল না বটে, কিন্তু যৌন সম্ভোগের জন্য তারা ব্যভিচারে লিপ্ত হতে লাগল এবং একসময় তাদের আশ্রমগুলিতে তা মহামারি আকার ধারণ করল। সুতরাং যে উদ্দেশ্যে তারা রাহবানিয়্যাতের প্রবর্তন করেছিল তা পুরোপুরি ব্যর্থ হয়ে গেল।
প্রকৃতপক্ষে ইবাদত হিসেবে কেবল এমন আমলই গ্রহণযোগ্য, যা নবী-রাসূলগণ শিক্ষা দিয়েছেন। এর বাইরে নিজেদের পক্ষ থেকে কোনও রীতি-নীতি বা কোনও প্রথা চালু করলে আপাতদৃষ্টিতে তা যতই সুন্দর মনে হোক না কেন, বাস্তবে তা 'ইবাদত' নামে অভিহিত হওয়ার উপযুক্ত কিছুতেই নয়। বরং তা জায়েযই নয়। এ জাতীয় কাজের পারিভাষিক নাম বিদ'আত। এ জাতীয় কাজ দ্বারা কোনও ছাওয়াব পাওয়া যায় না; বরং তাতে অর্থহীন কষ্টভোগ হয় এবং কোনও ক্ষেত্রে হয় অর্থের অপচয়, সেইসঙ্গে গুনাহ তো আছেই। কাজেই এর থেকে বেঁচে থাকা অবশ্যকর্তব্য। আল্লাহ তা'আলার সন্তুষ্টি লাভ ও ছাওয়াব হাসিলের পথ একটাই, আর তা হচ্ছে শরী'আতের অনুসরণ তথা নবী-রাসূলগণের দেখানো পথে চলা। আমাদের জন্য তা হচ্ছে আখেরী নবী হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নত মোতাবেক জীবনযাপন করা।
আয়াতটির শিক্ষা
ক. আল্লাহ তা'আলার সন্তুষ্টিলাভের একটাই পথ- শরী'আতের অনুসরণ।
খ. আল্লাহ তা'আলার সন্তুষ্টিলাভের উদ্দেশ্যে নিজেদের পক্ষ থেকে কোনও প্রথা বানিয়ে নেওয়া জায়েয নয়। তাতে কোনও ছাওয়াব পাওয়া যায় না; বরং গুনাহ হয়।
গ. কোনও নফল ইবাদত নিয়মিত শুরু করলে তার ধারাবাহিকতা রক্ষা করা চাই।
কোনও নেক আমল ও নফল ইবাদত-বন্দেগী শুরু করার পর তা অব্যাহত রাখা উচিত। কেননা কেউ যখন কোনও নফল ইবাদত শুরু করে, তখন সে যেন আল্লাহ তা'আলার দরবারে হাজিরা দেয়। আর সে যেন জানান দেয় যে, এখন থেকে সে নিয়মিতই এ দরবারে হাজির থাকবে। পরে সে আমল ছেড়ে দিলে তা অনুপস্থিতির পর্যায়ে পড়ে। মহামহিম আল্লাহর দরবারে উপস্থিত হওয়ার পর তা অব্যাহত না রাখা। এবং নিজেকে অনুপস্থিত লোকদের কাতারে নিয়ে যাওয়া কঠিন বেয়াদবি। দুনিয়ার রাজা-বাদশার ক্ষেত্রেও এটাকে পসন্দ করা হয় না। কাজেই সকল রাজার রাজা ও বাদশার বাদশা আল্লাহ তা'আলার বেলায় এটা কী করে পসন্দনীয় হতে পারে? অতএব কোনও মুমিন ব্যক্তির পক্ষে আল্লাহর দরবারের এ অনুপস্থিতি মোটেই শোভনীয় হতে পারে না।
তাছাড়া বান্দা যে আমল করতে থাকে, তার আমলনামায় সে আমলের ছাওয়াবও লেখা হতে থাকে। আল্লাহ তা'আলা মহিমময় ও মহা দানশীল। তিনি বান্দাকে ছাওয়াব দিতে পসন্দ করেন। তিনি চান বান্দা নেক আমল অব্যাহত রেখে নিজ আমলনামায় ছাওয়াব লেখা জারি রাখুক। এক হাদীছে ইরশাদ হয়েছে-
يَا أَيُّهَا النَّاسُ، خُذُوا مِنَ الْأَعْمَالِ مَا تُطِيْقُوْنَ ، فَإِنَّ اللَّهَ لَا يَمَلُّ حَتَّى تَمَلُّوْا، وَإِنَّ أَحَبَّ الْأَعْمَالِ إِلَى اللَّهِ مَا دَامَ وَإِنْ قَلَّ
'হে মানুষ! তোমরা আমলের সেই পরিমাণ গ্রহণ করো, যা করতে সক্ষম হবে। কেননা আল্লাহ ছাওয়াব দেওয়া বন্ধ করেন না, যাবৎ না তোমরা ক্লান্ত হও (এবং আমল ছেড়ে দাও)। নিশ্চয়ই আল্লাহর কাছে সর্বোত্তম আমল তাই যা স্থায়ী হয়, যাদিও অল্প হয়।(সহীহ বুখারী: ৫৮৬১; সহীহ মুসলিম: ৮৭৫; সুনানে আবূ দাউদ: ১৩৬৮; সুনানে নাসাঈ: ৭৬২; সুনানে ইবন মাজাহ: ৪২৩৭; মুসনাদে ইসহাক ইবন রাহুয়াহ ৬২৭; মুসনাদুল বাযযার ২৯৫; মুসনাদে আবু ইয়া'লা: ৪৭৮৮; সহীহ ইবনে খুযায়মা : ১২৮২; তহাবী, শারহু মুশকিলিল আছার: ৬৫১; সহীহ ইবনে হিব্বান: ২৫৭১; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা : ৫২৩৭)
বোঝা গেল, আল্লাহ চান বান্দা তার আমলনামায় ছাওয়াব লেখানো অব্যাহত রাখুক। কোনও আমল কিছুদিন করার পর ছেড়ে দিলে তা লেখানো বন্ধ হয়ে যায়। তাই তা ছেড়ে দেওয়া কিছুতেই উচিত নয়। এজন্য শুরুতেই যখন কোনও আমল নিয়মিত করার ইচ্ছা হয়, তখন তা এ পরিমাণে গ্রহণ করা উচিত, যা নিয়মিতভাবে করে যাওয়া সম্ভব হবে, যেমনটা এ হাদীছে বলা হয়েছে।
প্রকাশ থাকে যে, এর দ্বারা ওই সমস্ত আমলের কথা বোঝানো হয়েছে, যা শুরুই করা হয় নিয়মিত করার উদ্দেশ্যে। পক্ষান্তরে হঠাৎ করে যে আমল করা হয়, সে ক্ষেত্রে এ কথা বলা হয়নি যে, তা নিয়মিত করে যেতে হবে। কেউ অন্যের দেখাদেখি হঠাৎ এক রাতে তাহাজ্জুদ পড়ল। তারপর সে যদি তাহাজ্জুদ আর না পড়ে, তা দূষণীয় হবে না, যদিও নিয়মিতভাবে তা পড়া উত্তম। হাঁ, যে ব্যক্তি একাধারে তাহাজ্জুদ পড়ছে, তার কর্তব্য তা নিয়মিত পড়ে যাওয়া। সে যদি কিছুদিন পর তা ছেড়ে দেয়, তবে তা অবশ্যই দূষণীয় হবে। এ অধ্যায়ে এটাই বোঝানো উদ্দেশ্য।
যাহোক কোনও আমলের অভ্যাস গড়ে তোলার পর তা নিয়মিত পালন করা চাই। কুরআনে কারীমের বহু আয়াত ও বিভিন্ন হাদীছে এর তাগিদ করা হয়েছে। এ পরিচ্ছেদে সে সম্পর্কিত আয়াত ও হাদীছ উল্লেখ করা হয়েছে। আমরা তার বঙ্গানুবাদ ও সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা পেশ করছি। আল্লাহ তা'আলাই তাওফীকদাতা।
‘কোনও সৎকর্মে অভ্যস্ত হওয়া…’ সম্পর্কিত কিছু আয়াত
এক নং আয়াত
إِنَّ اللَّهَ لَا يُغَيِّرُ مَا بِقَوْمٍ حَتَّى يُغَيِّرُوا مَا بِأَنْفُسِهِمْ
অর্থ: জেনে রেখো, আল্লাহ কোনও জাতির অবস্থা ততক্ষণ পর্যন্ত পরিবর্তন করেন না, যতক্ষণ না তারা নিজেরা নিজেদের অবস্থা পরিবর্তন করে।(সূরা রা'দ (১৩), আয়াত ১১)
ব্যাখ্যা
আল্লাহ তা'আলা ন্যায়পরায়ণ। তিনি কখনও কারও প্রতি জুলুম করেন না। কাজেই তিনি শুধু শুধু মানুষকে বিপদে ফেলেন না। মানুষ যে নি'আমত ও আরাম-আয়েশের মধ্যে থাকে, তা অযথাই কেড়ে নেন না। আল্লাহপ্রদত্ত নি'আমত ও আরাম-আয়েশের দাবি হল মানুষ আল্লাহ তা'আলার শোকর আদায় করবে। সে শোকর হল তাঁর আনুগত্য করা অর্থাৎ সৎকর্ম করে যাওয়া ও অসৎকর্ম হতে বিরত থাকা। মানুষ যদি আল্লাহ তা'আলার নি'আমতের শোকর আদায় করে, তবে আল্লাহ তা'আলা নি'আমত আরও বৃদ্ধি করে দেন। তখন আর নি'আমত বিলুপ্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে না। কিন্তু মানুষ বড় নাশোকর। আল্লাহ তা'আলার পক্ষ থেকে হাজারও নি'আমত পাওয়া সত্ত্বেও তারা তাঁর নাফরমানি করে, নি'আমতের অপব্যবহার করে এবং বিভিন্ন পাপকর্মে লিপ্ত হয়। এর পরিণামে আল্লাহ তা'আলা তাঁর দেওয়া নি'আমত কেড়ে নেন। ফলে নিরাপত্তার স্থানে ভয়-ভীতি, সচ্ছলতার স্থানে অসচ্ছলতা, ফল ও ফসলের প্রাচুর্যের স্থানে খরা ও দুর্ভিক্ষ ইত্যাদি দেখা দেয়। বস্তুত এ পরিণাম মানুষেরই কর্মফল। তার হাতের কামাই। আল্লাহ তা'আলা বলেন-
وَمَا أَصَابَكُمْ مِنْ مُّصِيبَةٍ فَبِمَا كَسَبَتْ أَيْدِيكُمْ وَيَعْفُوا عَنْ كَثِيرٍ
‘তোমাদের যে বিপদ দেখা দেয়, তা তোমাদের নিজ হাতের কৃতকর্মেরই কারণে দেখা দেয়। আর তিনি তোমাদের অনেক কিছুই (অপরাধ) ক্ষমা করে দেন।'(সূরা শূরা (৪২),আয়াত ৩০)
আয়াতটির শিক্ষা
ক. আল্লাহ তা'আলা বিনা কারণে কাউকে বিপদ-আপদে ফেলেন না।
খ. কেউ যদি ভালো অবস্থা হারিয়ে মন্দ অবস্থার শিকার হয়ে যায়, তবে তার বুঝতে হবে তার কোনও মন্দ কৃতকর্মের কারণেই এমন হয়েছে। তাই তার কর্তব্য হবে তাওবা করে নিজেকে সংশোধন করে নেওয়া।
গ. যে-কোনও নি'আমত ও ভালো অবস্থার জন্য আল্লাহ তা'আলার শোকর আদায় করা তথা আল্লাহর আনুগত্য করা ও পাপকর্ম থেকে বেঁচে থাকা উচিত। এটা নি'আমতবৃদ্ধি ও তার স্থায়িত্বের পক্ষে সহায়ক।
দুই নং আয়াত
وَلَا تَكُونُوا كَالَّتِي نَقَضَتْ غَزْلَهَا مِنْ بَعْدِ قُوَّةٍ أَنْكَاثًا
অর্থ: যে নারী তার সুতা মজবুত করে পাকানোর পর পাক খুলে তা রোয়া-রোয়া করে ফেলেছিল, তোমরা তার মতো হয়ো না।(সূরা নাহল (১৬), আয়াত ৯২)
ব্যাখ্যা
বর্ণিত আছে, মক্কা মুকাররমায় খারকা নাম্নী এক উন্মাদিনী ছিল। সে দিনভর পরিশ্রম করে সুতা কাটত আবার সন্ধ্যা হলে তা খুলে খুলে নষ্ট করে ফেলত। কালক্রমে তার এ কাণ্ডটি একটি দৃষ্টান্তে পরিণত হয়। যেমন কেউ যখন কোনও ভালো কাজ সম্পন্ন করার পর নিজেই তা নষ্ট করে ফেলে তখন ওই নারীর সাথে তাকে উপমিত করা হয়। এখানে তার সাথে তুলনা করা হয়েছে সেইসব লোককে, যারা কোনও বিষয়ে জোরদারভাবে কসম করার পর তা ভেঙ্গে ফেলে।
বলা হচ্ছে, তোমরা কোনও বিষয়ে অঙ্গীকার করার পর তা ভঙ্গ করো না। তা ভঙ্গ করাটা ওই উন্মাদিনী নারীর মতো নির্বুদ্ধিতার কাজ হবে। অঙ্গীকার করা হয় আল্লাহর নামে। আল্লাহর নামের মর্যাদা রক্ষা করা চাই। যে বুদ্ধিমানেরা আল্লাহর নামের সম্মান ও মর্যাদা বোঝে, তারা কখনওই অঙ্গীকার ভঙ্গ করতে পারে না। পক্ষান্তরে যারা ন্যায়-নীতি বর্জন করে দুনিয়ার হীন স্বার্থ ও কামনা-বাসনা পূরণের ধান্দায় পড়ে যায়, তারা তাদের সাধারণ কাণ্ডজ্ঞানও হারিয়ে ফেলে। তাদের কাছে শপথ ও অঙ্গীকার করার মূল্য থাকে না। আল্লাহ তা'আলার নামের মর্যাদার প্রতি তারা ভ্রূক্ষেপ করে না। তুচ্ছ তুচ্ছ কারণে তারা অঙ্গীকার ভঙ্গ করে ফেলে। যাদের সঙ্গে অঙ্গীকার করে, তাদেরকে যদি নিজের তুলনায় দুর্বল দেখতে পায়, তখন আর অঙ্গীকারের কোনও তোয়াক্কা করে না। সে ক্ষেত্রে নিজের তুচ্ছ স্বার্থ পূরণ করাই আসল লক্ষ্যবস্তু হয়ে দাঁড়ায়। এ আয়াত জানাচ্ছে, এ শ্রেণির লোক বড়ই নির্বোধ। বরং তারা এক ধরনের উন্মাদ। যারা প্রকৃত মুমিন-মুসলিম, তাদের এরূপ হওয়া সাজে না। তাদের কর্তব্য সর্বাবস্থায় নিজ শপথ ও অঙ্গীকারে অটল থাকা।
কোনও নেক আমল ও নফল ইবাদত-বন্দেগী শুরু করার পর তা অব্যাহত রাখা উচিত। কেননা শুরু করার দ্বারা এক রকম প্রতিশ্রুতি হয়ে যায় যে, তা অব্যাহত রাখা হবে। আমলটি ছেড়ে দেওয়ার দ্বারা সে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করা হয়। আলোচ্য আয়াতটি তার অর্থের ব্যাপকতা দ্বারা আমাদেরকে সতর্ক করছে যে, তোমরা কোনও ইবাদত-বন্দেগী শুরু করার পর কিছুতেই যেন তা ছেড়ে না দাও। বরং তা নিয়মিত করে যাবে এবং আপন প্রতিশ্রুতি রক্ষায় যত্নবান থাকবে।
আয়াতটির শিক্ষা
ক. প্রত্যেক মুমিনের কর্তব্য সর্বাবস্থায় আপন অঙ্গীকার রক্ষা করা।
খ. অঙ্গীকার ভঙ্গ করা নির্বুদ্ধিতা ও পাগলামি। কোনও মুমিনের পক্ষে এটা সাজে না।
গ. কোনও সৎকর্ম শুরু করার পর তা ছেড়ে দেওয়া কিছুতেই সমীচীন নয়। মুমিন ব্যক্তির কর্তব্য হবে সে সৎকর্ম নিয়মিতভাবে সম্পাদন করতে থাকা।
তিন নং আয়াত
وَلَا يَكُونُوا كَالَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَبَ مِنْ قَبْلُ فَطَالَ عَلَيْهِمُ الْأَمَدُ فَقَسَتْ قُلُوبُهُمْ
অর্থ: এবং তারা তাদের মতো হবে না, যাদেরকে পূর্বে কিতাব দেওয়া হয়েছিল অতঃপর যখন তাদের উপর দিয়ে দীর্ঘকাল অতিক্রান্ত হল, তখন তাদের অন্তর শক্ত হয়ে গেল।(সূরা হাদীদ (৫৭), আয়াত ১৬)
ব্যাখ্যা
অতীত কালের আহলে কিতাব সম্প্রদায় প্রথমদিকে তাদের কিতাবের অনুসরণ করলেও আস্তে আস্তে তারা তা থেকে দূরে সরে পড়ে। তারা কিতাবের হিদায়াত ছেড়ে দিয়ে ক্রমান্বয়ে দুনিয়ার দিকে ধাবিত হতে থাকে। এক পর্যায়ে পুরোপুরি মনের খেয়াল-খুশি পূরণ ও ভোগ-উপভোগের মধ্যে নিমজ্জিত হয়ে পড়ে। এতে করে তাদের মন শক্ত হয়ে যায়। তা এমনই শক্ত হয়ে যায় যে, গুনাহ করার কারণে তাদের অন্তরে কোনওরূপ অনুতাপ ও লজ্জাবোধও হচ্ছিল না। তাদের অন্তরের সে কঠোরতা বর্ণনা করতে গিয়ে আল্লাহ তা'আলা বলেন-
ثُمَّ قَسَتْ قُلُوبُكُمْ مِنْ بَعْدِ ذَلِكَ فَهِيَ كَالْحِجَارَةِ أَوْ أَشَدُّ قَسْوَةً وَإِنَّ مِنَ الْحِجَارَةِ لَمَا يَتَفَجَّرُ مِنْهُ الْأَنْهَارُ وَإِنَّ مِنْهَا لَمَا يَشَّقَّقُ فَيَخْرُجُ مِنْهُ الْمَاءُ وَإِنَّ مِنْهَا لَمَا يَهْبِطُ مِنْ خَشْيَةِ اللَّهِ
‘এসব কিছুর পর তোমাদের অন্তর আবার শক্ত হয়ে গেল, এমনকি তা হয়ে গেল পাথরের মতো; বরং তার চেয়েও বেশি শক্ত। (কেননা) পাথরের মধ্যে কিছু তো এমনও আছে, যা থেকে নদী-নালা প্রবাহিত হয়, তার মধ্যে কিছু এমন আছে যা ফেটে যায় এবং তা থেকে পানি নির্গত হয়, আবার তার মধ্যে এমন (পাথর)-ও আছে, যা আল্লাহর ভয়ে ধ্বসে পড়ে।(সূরা বাকারা (২), আয়াত ৭৪)
আল্লাহ তা'আলা এ উম্মতকে বলছেন, তোমাদের অন্তর যেন তাদের মতো শক্ত না হয়। অন্তর শক্ত হয়ে গেলে তোমরা পুরোপুরিভাবে দুনিয়ার প্রতি ঝুঁকে পড়বে। তখন কোনও ওয়াজ-নসীহত তোমাদের অন্তরে রেখাপাত করবে না। ফলে তোমরা ইবাদত-বন্দেগীতে উৎসাহ পাবে না; বরং তা থেকে সম্পূর্ণ বিমুখ হয়ে পাপাচারে লিপ্ত হয়ে পড়বে আর এভাবে তোমরা দুনিয়া ও আখিরাত সবই হারাবে। এ পরিণতিতে যাতে তোমরা না পৌঁছ, সেজন্য তোমাদের কর্তব্য এখনই ইবাদত-বন্দেগী আঁকড়ে ধরা। যা-কিছু ইবাদত-বন্দেগী তোমরা করছ তার কোনওটিই যাতে ছুটে না যায়, সে বিষয়ে সতর্ক থাকবে। দীনের উপর মজবুত থাকার জন্য ইবাদত-বন্দেগী অব্যাহত রাখা জরুরি। কোনওটি ছুটে গেলে তা পুনরায় শুরু করে দেওয়া চাই। অন্যথায় এক এক করে ছুটতেই থাকবে। পরিণামে সম্পূর্ণরূপে ইবাদতবিমুখ হয়ে যাবে আর এভাবে দিল-মন শক্ত হয়ে তোমরা দুনিয়াদারিতে পুরোপুরি ডুবে যাবে।
আয়াতটির শিক্ষা
ক . অন্তর যাতে শক্ত না হয়ে যায়, সে বিষয়ে আমাদের খুব সচেতন থাকতে হবে।
খ. আল্লাহওয়ালাদের সাহচর্য আঁকড়ে ধরলে মন নরম থাকে। তাই বেশিদিন আল্লাহওয়ালাদের সাহচর্য থেকে দূরে থাকতে নেই।
গ. মন নরম রাখার জন্য ইবাদত-বন্দেগীতে মনোযোগী থাকা জরুরি। তাই কোনও ইবাদত শুরু করার পর তা ছেড়ে দেওয়া উচিত নয়। বরং তা অব্যাহত রাখা এবং ইবাদত-বন্দেগীতে আরও বেশি অগ্রগামী হওয়া বাঞ্ছনীয়।
চার নং আয়াত
فَمَا رَعَوْهَا حَقَّ رِعَايَتِهَا
অর্থ: কিন্তু তারা তা যথাযথভাবে পালন করেনি।(সুরা হাদীদ (৫৭), আয়াত ২৭)
ব্যাখ্যা
এ বাক্যটি সূরা হাদীদের ৭৭ নং আয়াতের অংশবিশেষ। আয়াতটিতে রাহবানিয়্যাত (বৈরাগ্যবাদ) সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। রাহবানিয়্যাত অর্থ বৈরাগ্য তথা দুনিয়ার সব আনন্দ ও বিষয়ভোগ পরিহার করা। হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের পরে খ্রিষ্টসম্প্রদায় এমন এক আশ্রমিক ব্যবস্থার প্রবর্তন করেছিল, যাতে কোনও ব্যক্তি আশ্রমে ঢুকে পড়ার পর সংসারজীবন সম্পূর্ণরূপে বর্জন করত। বিয়ে-শাদী করত না এবং পার্থিব কোনওরকমের স্বাদ ও আনন্দে অংশগ্রহণ করত না। তাদের এই আশ্রমিক ব্যবস্থাকেই 'রাহবানিয়্যাত' বলে।
এ ব্যবস্থার সূচনা হয়েছিল এভাবে যে, হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের অনুসারীদের উপর বিভিন্ন রাজা-বাদশা জুলুম-নির্যাতন চালাতে থাকলে তারা নিজেদের দীন রক্ষার তাগিদে শহরের বাইরে গিয়ে বসবাস শুরু করল, যেখানে জীবনযাপনের সাধারণ সুবিধাসমূহ পাওয়া যেত না। কালক্রমে তাদের কাছে জীবনযাপনের এই কঠিন ব্যবস্থাই এক স্বতন্ত্র ইবাদতের রূপ পরিগ্রহ করে। পরবর্তীকালের লোকেরা জীবনযাপনের উপকরণাদি হস্তগত হওয়া সত্ত্বেও এই মনগড়া ইবাদতের জন্য তা পরিহার করতে থাকল।
আল্লাহ তা'আলা বলছেন-
وَرَهْبَانِيَّةً ابْتَدَعُوهَا مَا كَتَبْنَاهَا عَلَيْهِمْ إِلَّا ابْتِغَاءَ رِضْوَانِ اللَّهِ
‘আর রাহবানিয়্যাতের যে বিষয়টা, তা তারা নিজেরাই উদ্ভাবন করেছিল। আমি তাদের উপর তা বাধ্যতামূলক করিনি। বস্তুত তারা (এর মাধ্যমে) আল্লাহর সন্তুষ্টিবিধানই করতে চেয়েছিল।'
অর্থাৎ আমি তাদেরকে এরূপ কঠিন জীবনযাত্রার নির্দেশ দিইনি। তারা নিজেরাই এর প্রবর্তন করেছিল। তারা এর প্রবর্তন তো করেছিল, কিন্তু পরে তারা এ নিয়ম রক্ষা করতে পারেনি। তারা যে এর থেকে বিচ্যুত হয়ে গিয়েছিল, সে সম্পর্কে আল্লাহ বলছেন- فَمَا رَعَوْهَا حَقَّ رِعَايَتِهَا (কিন্তু তারা তা যথাযথভাবে পালন করেনি)। অর্থাৎ বৈরাগ্যবাদের এ প্রথা প্রথম দিকে তো তারা আল্লাহ তা'আলার সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যেই অবলম্বন করেছিল, কিন্তু পরবর্তীকালে তারা নিজেদের জীবনে এ প্রথা পুরোপুরিভাবে রক্ষা করতে পারেনি। তা রক্ষা করতে না পারার দুটো দিক আছে।
(এক) আল্লাহ তা'আলার বিধান ও নির্দেশের অনুসরণ না করা। কেননা আল্লাহ তা'আলা যে জিনিসকে তাদের জন্য বাধ্যতামূলক করেননি, তারা সেটাকে নিজেদের জন্য বাধ্যতামূলক করে নিল। মনে করল, এরূপ না করলে তাদের একটা মহা ইবাদত ছুটে যাবে। অথচ দীনের মধ্যে নিজেদের পক্ষ থেকে কোনও জিনিসকে এমন জরুরি মনে করা যে, তা না করলে অপরাধ হবে, এটা আল্লাহ তা'আলার নির্দেশের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন ও সম্পূর্ণ নাজায়েয।
(দুই) নিজেদের পক্ষ থেকে প্রবর্তিত বিষয়কে যথাযথরূপে পালন না করা। তারা রাহবানিয়্যাতের যে ব্যবস্থা চালু করেছিল, পরবর্তীকালে কার্যত তার যথাযথ অনুসরণ করতে পারেনি। যেহেতু ব্যবস্থাটাই ছিল স্বভাবের পরিপন্থী, তাই স্বাভাবিকভাবেই মানবপ্রকৃতির সাথে তার সংঘাত দেখা দিল এবং ধীরে ধীরে মানবপ্রকৃতির কাছে তা হেরে গেল। বৈরাগ্য হল বিষয়ভোগ থেকে বিরত থাকা। কিন্তু তারা নানা বাহানায় প্রকাশ্যে বা গোপনে বিষয়ভোগ শুরু করে দিল। সে প্রথায় বিবাহেও নিষেধাজ্ঞা ছিল। কিন্তু তারা এ ক্ষেত্রেও সীমালঙ্ঘন করল। বিবাহ করল না বটে, কিন্তু যৌন সম্ভোগের জন্য তারা ব্যভিচারে লিপ্ত হতে লাগল এবং একসময় তাদের আশ্রমগুলিতে তা মহামারি আকার ধারণ করল। সুতরাং যে উদ্দেশ্যে তারা রাহবানিয়্যাতের প্রবর্তন করেছিল তা পুরোপুরি ব্যর্থ হয়ে গেল।
প্রকৃতপক্ষে ইবাদত হিসেবে কেবল এমন আমলই গ্রহণযোগ্য, যা নবী-রাসূলগণ শিক্ষা দিয়েছেন। এর বাইরে নিজেদের পক্ষ থেকে কোনও রীতি-নীতি বা কোনও প্রথা চালু করলে আপাতদৃষ্টিতে তা যতই সুন্দর মনে হোক না কেন, বাস্তবে তা 'ইবাদত' নামে অভিহিত হওয়ার উপযুক্ত কিছুতেই নয়। বরং তা জায়েযই নয়। এ জাতীয় কাজের পারিভাষিক নাম বিদ'আত। এ জাতীয় কাজ দ্বারা কোনও ছাওয়াব পাওয়া যায় না; বরং তাতে অর্থহীন কষ্টভোগ হয় এবং কোনও ক্ষেত্রে হয় অর্থের অপচয়, সেইসঙ্গে গুনাহ তো আছেই। কাজেই এর থেকে বেঁচে থাকা অবশ্যকর্তব্য। আল্লাহ তা'আলার সন্তুষ্টি লাভ ও ছাওয়াব হাসিলের পথ একটাই, আর তা হচ্ছে শরী'আতের অনুসরণ তথা নবী-রাসূলগণের দেখানো পথে চলা। আমাদের জন্য তা হচ্ছে আখেরী নবী হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নত মোতাবেক জীবনযাপন করা।
আয়াতটির শিক্ষা
ক. আল্লাহ তা'আলার সন্তুষ্টিলাভের একটাই পথ- শরী'আতের অনুসরণ।
খ. আল্লাহ তা'আলার সন্তুষ্টিলাভের উদ্দেশ্যে নিজেদের পক্ষ থেকে কোনও প্রথা বানিয়ে নেওয়া জায়েয নয়। তাতে কোনও ছাওয়াব পাওয়া যায় না; বরং গুনাহ হয়।
গ. কোনও নফল ইবাদত নিয়মিত শুরু করলে তার ধারাবাহিকতা রক্ষা করা চাই।
কোনও নেক আমল শুরু করার পর তা অব্যাহত রাখা
হাদীছ নং: ৬৯১
হযরত আব্দুল্লাহ ইবন আমর ইবনুল আস রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বললেন, হে আব্দুল্লাহ! তুমি অমুকের মতো হয়ো না, যে কিয়ামুল লায়ল করত (অর্থাৎ রাতে জেগে তাহাজ্জুদ পড়ত), পরে কিয়ামুল লায়ল ছেড়ে দিল। -বুখারী ও মুসলিম
(সহীহ বুখারী: ১১৫২; সহীহ মুসলিম: ১১৫৯; সুনানে নাসাঈ ১৭৬৩; সুনানে ইবন মাজাহ: ১৩৩২; মুসনাদে আহমাদ: ৬৫৮৫; মুসনাদুল বাযযার ৩৩৫৮; সহীহ ইবনে হিব্বান ২৬৪১; সহীহ ইবনে খুযায়মা ১১২৯; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা ৪৭১৯; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ: ৯৩৯)
হাদীছ নং: ৬৯১
হযরত আব্দুল্লাহ ইবন আমর ইবনুল আস রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বললেন, হে আব্দুল্লাহ! তুমি অমুকের মতো হয়ো না, যে কিয়ামুল লায়ল করত (অর্থাৎ রাতে জেগে তাহাজ্জুদ পড়ত), পরে কিয়ামুল লায়ল ছেড়ে দিল। -বুখারী ও মুসলিম
(সহীহ বুখারী: ১১৫২; সহীহ মুসলিম: ১১৫৯; সুনানে নাসাঈ ১৭৬৩; সুনানে ইবন মাজাহ: ১৩৩২; মুসনাদে আহমাদ: ৬৫৮৫; মুসনাদুল বাযযার ৩৩৫৮; সহীহ ইবনে হিব্বান ২৬৪১; সহীহ ইবনে খুযায়মা ১১২৯; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা ৪৭১৯; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ: ৯৩৯)
كتاب الأدب
باب المحافظة عَلَى مَا اعتاده من الخير
قَالَ الله تَعَالَى: {إنَّ اللهَ لاَ يُغَيِّرُ مَا بِقَوْمٍ حَتَّى يُغَيِّرُوا مَا بِأنْفُسِهِمْ} [الرعد: 11]، وقال تَعَالَى: {وَلاَ تَكُونُوا كَالَّتِي نقضت غَزْلَهَا مِنْ بَعْدِ قُوَّةٍ أنْكَاثًا} [النحل: 92].
وَ «الأنْكَاثُ»: جَمْعُ نِكْثٍ، وَهُوَ الْغَزْلُ المَنْقُوضُ.
وقال تَعَالَى: {وَلاَ يَكُونُوا كَالَّذِينَ أُوتُوا الكِتَابَ مِنْ قَبْلُ فَطَالَ عَلَيْهِمُ الأَمَدُ فَقَسَتْ قُلُوبُهُمْ} [الحديد: 16]، وقال تَعَالَى: {فَمَا رَعَوْهَا حَقَّ رِعَايَتِهَا} [الحديد: 27].
قَالَ الله تَعَالَى: {إنَّ اللهَ لاَ يُغَيِّرُ مَا بِقَوْمٍ حَتَّى يُغَيِّرُوا مَا بِأنْفُسِهِمْ} [الرعد: 11]، وقال تَعَالَى: {وَلاَ تَكُونُوا كَالَّتِي نقضت غَزْلَهَا مِنْ بَعْدِ قُوَّةٍ أنْكَاثًا} [النحل: 92].
وَ «الأنْكَاثُ»: جَمْعُ نِكْثٍ، وَهُوَ الْغَزْلُ المَنْقُوضُ.
وقال تَعَالَى: {وَلاَ يَكُونُوا كَالَّذِينَ أُوتُوا الكِتَابَ مِنْ قَبْلُ فَطَالَ عَلَيْهِمُ الأَمَدُ فَقَسَتْ قُلُوبُهُمْ} [الحديد: 16]، وقال تَعَالَى: {فَمَا رَعَوْهَا حَقَّ رِعَايَتِهَا} [الحديد: 27].
691 - وعن عبد الله بن عمرو بن العاص رضي الله عنهما، قَالَ: قَالَ لي رسول الله - صلى الله عليه وسلم: «يَا عبْدَ الله، لاَ تَكُنْ مِثْلَ فُلانٍ، كَانَ يَقُومُ اللَّيْلَ فَتَرَكَ قِيَامَ اللَّيْلِ». متفقٌ عَلَيْهِ. (1)

তাহকীক:
 হাদীসের ব্যাখ্যা
হাদীসের ব্যাখ্যাহাদীস নং: ৬৯২
 বিবিধ আদব - শিষ্টাচারের অধ্যায়
সাক্ষাৎকালে উত্তম কথা বলা ও হাসিমুখে থাকা
মানুষ সামাজিক জীব হওয়ায় একের সঙ্গে অন্যের নানাবিধ প্রয়োজন থাকেই। অন্যের সাহায্য-সহযোগিতা নেওয়া ছাড়া কেউ চলতে পারে না। তাই নানা প্রয়োজনে একের সঙ্গে অন্যের দেখা-সাক্ষাতের প্রয়োজন পড়ে। পরস্পরে দেখা-সাক্ষাৎ করার দ্বারা প্রয়োজন পূরণ অনেক সহজ হয়।
মানুষের প্রয়োজন দুই রকম। পার্থিব প্রয়োজন ও দীনী প্রয়োজন। দেখা-সাক্ষাৎ করা দরকার হয় উভয় প্রয়োজন পূরণের জন্যই।
কেউ যখন তার দীনী বা দুনিয়াবী প্রয়োজনে কারও সঙ্গে সাক্ষাৎ করে, তখন তার উচিত সাক্ষাৎকারীকে আন্তরিকতার সঙ্গে গ্রহণ করা। উত্তম কথা বলা ও মুখে হাসি ফুটিয়ে তোলা আন্তরিকতার প্রকাশ। এর দ্বারা সাক্ষাৎপ্রার্থী বুঝতে পারে তার আগমনে সে বিরক্ত হয়নি; বরং খুশি হয়েছে। এতে করে সে যে উদ্দেশ্যে এসেছে তা পূরণ হবে বলে তার মনে আশা জন্মাবে। তাই ইসলাম মানুষকে উত্তম কথা বলার হুকুম করেছে।
কুরআন মাজীদে ইরশাদ-
وَقُولُوا لِلنَّاسِ حُسْنًا
‘মানুষের সাথে ভালো কথা বলবে।(সূরা বাকারা (২), আয়াত ৮৩)
অন্যত্র ইরশাদ-
وَقُلْ لِعِبَادِي يَقُولُوا الَّتِي هِيَ أَحْسَنُ
‘আমার (মুমিন) বান্দাদের বলে দাও, তারা যেন এমন কথাই বলে, যা উত্তম।'(সূরা বনী ইসরাঈল (১৭) আয়াত ৫৩)
মুমিন বান্দা হিসেবে উত্তম কথা আমাদের বলতেই হবে। কেননা আখেরে এর দ্বারা নিজেরই লাভ। এই যে অন্যের প্রয়োজন সমাধার কথা বলা হল, এটা তো এক মানবিক কাজ, যা দ্বারা আল্লাহ তা'আলা খুশি হন এবং এর অনেক ছাওয়াব। কাজেই অন্যের প্রয়োজন পূরণের সঙ্গে নিজ স্বার্থ জড়িত রয়েছে। পরকালীন স্বার্থ। তাই খুশিমনেই তা পূরণের চেষ্টা করা উচিত। বরং যে ব্যক্তি সাহায্য গ্রহণের জন্য এসেছে, তার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করাই বাঞ্ছনীয়। কারণ সে উপকার নিতে এসে প্রকৃতপক্ষে তারই উপকার করছে। কাজেই তার আগমনে সে যে খুশি, কথাবার্তা ও মুখের ভাব দ্বারা তা প্রকাশ করা উচিত।
উত্তম কথা ও মুখের হাসি দ্বারা আগন্তুককে খুশিও করা যায়। মানুষকে খুশি করা স্বতন্ত্র এক ছাওয়াবের কাজ। তাছাড়া খুশির সঙ্গে কারও প্রয়োজন সমাধা করলে তার পক্ষে তা গ্রহণ করা সহজ হয়। এতে মনে চাপ পড়ে না। উপকারকারীর কাছে নিজেকে ছোট মনে হয় না। সে ক্ষেত্রে তার দ্বারা কৃতজ্ঞতা প্রকাশও সহজ হয়।
যে ব্যক্তি মুখ ভার করে অন্যের উপকার করে, তার প্রতি উপকারগ্রহীতা স্বচ্ছন্দ হতে পারে না। উপকারগ্রহণটা তার মাথার উপর এক কঠিন বোঝা হয়ে থাকে। ফলে সে মনেপ্রাণে উপকারকারীর প্রতি কৃতজ্ঞ থাকতে পারে না। এ অবস্থায় অনেক সময় তার আচরণ উপকারকারীর কাছে অপ্রীতিকর বোধ হয়। তখন সে মনে মনে তাকে অকৃতজ্ঞ ঠাওরায়। কখনও মুখেও তা প্রকাশ করে। বহুলাংশেই এ অকৃতজ্ঞতার জন্য সে নিজেই দায়ী। সে উপকার করেছে বটে, কিন্তু আচরণটা সুন্দর করেনি। খুশিমনে করেনি।
সাক্ষাৎ যে কেবল প্রয়োজনের দায়েই হতে হবে, এমন কোনও কথা নেই। ইসলামী ভ্রাতৃত্ববোধের তাগিদেও এক মুসলিমের অপর মুসলিমের সঙ্গে সাক্ষাৎ করা উচিত। এতে আল্লাহ তা'আলা খুশি হন। এর অনেক ছাওয়াব। সুতরাং বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া কেবল সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে সাক্ষাৎ করাও একটি দীনী কাজ। সুতরাং কেউ যদি এ কারণেও সাক্ষাৎ করতে আসে, তখন তার সে আসাটাকে ভালোভাবে গ্রহণ করা উচিত। কেননা এ আসাটা একটি মহৎ কাজ। একে ভালোভাবে গ্রহণ করলে নিজেরও অনেক ছাওয়াব হবে। উভয়ের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব ও সম্প্রীতি দৃঢ় তো হবেই, যা কিনা আমাদের দীনের এক গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা।
মোটকথা সর্ববিচারেই কেউ সাক্ষাৎ করতে আসলে তাকে হাসিমুখে গ্রহণ করা উচিত এবং তার সঙ্গে ভালো ভালো কথা বলা উচিত। এ বিষয়ে কুরআন মাজীদ ও হাদীছের সুস্পষ্ট শিক্ষা রয়েছে। সে শিক্ষা সম্পর্কেই এ পরিচ্ছেদটির অবতারণা। আল্লাহ তা'আলা আমাদেরকে এর উপর আমল করার তাওফীক দান করুন।
‘সাক্ষাৎকালে উত্তম কথা বলা ও হাসিমুখে থাকা’ সম্পর্কিত দুটি আয়াত
এক নং আয়াত
وَاخْفِضْ جَنَاحَكَ لِلْمُؤْمِنِينَ
অর্থ: আর যারা ঈমান এনেছে তাদের জন্য তোমার (বাৎসল্যের) ডানা নামিলে দাও।(সূরা হিজর (১৫), আয়াত ৮৮)
ব্যাখ্যা
وَاخْفِضْ جَنَاحَكَ এর মূল অর্থ- তোমার ডানা নামিয়ে দাও। ‘ডানা নামানো’ দ্বারা মমত্বপূর্ণ আচরণ বোঝানো হয়। ‘মুমিনদের প্রতি ডানা নামিয়ে দাও’-এর অর্থ হবে- যারা তোমার প্রতি ঈমান এনেছে, তুমি তাদের প্রতি মমত্বের আচরণ করো, যাতে তারা তোমার কাছে কাছে থাকে, দূরে সরে না যায়।
সরাসরি এ আদেশটি করা হয়েছে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে, যাতে তিনি মুমিন-মুসলিমদের প্রতি নম্রকোমল আচরণ বজায় রাখেন। প্রকৃতপক্ষে তিনি সকলের প্রতি এরকম আচরণই করতেন। তারপরও তাঁকে এ আদেশ করার দ্বারা বিষয়টির গুরুত্ব তুলে ধরা হয়েছে, যাতে তাঁর উম্মতের প্রত্যেকেও সকলের সঙ্গে স্নেহ-মমতা ও ভালোবাসার আচরণ করে। সে আচরণের একটা দিক এইও যে, যখন যার সঙ্গে সাক্ষাৎ হবে, তাকে আন্তরিকতার সঙ্গে গ্রহণ করবে। চেহারায় আনন্দের ভাব ফুটিয়ে তুলবে এবং কথা বলবে হাসি দিয়ে। যদি রাশভারি চেহারায় সাক্ষাৎ করে, মুখে হাসি না থাকে, তবে আগুন্তুক ব্যক্তি অস্বস্তি বোধ করবে। সে ভাববে আমার আগমনে ইনি খুশি নন। ফলে সে পরে আর কখনও তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চাইবে না। এভাবে সে তার থেকে দূরে সরে যাবে। ফলে পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ব ও ভালোবাসার সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যাবে, যা কিছুতেই কাম্য নয়। ইসলাম তার অনুসারীদের পারস্পরিক সম্প্রীতি ও ভালোবাসার বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে থাকে। এটা ঈমানেরও অঙ্গ। তাই এদিকে বিশেষভাবে লক্ষ রাখা প্রয়োজন। প্রত্যেক মুমিনের কর্তব্য অপরাপর মুমিনদের উপর মমত্বের ডানা বিছিয়ে দেওয়া এবং সকলকে খুশিমনে ও উৎফুল্ল চেহারায় গ্রহণ করে নেওয়া।
উল্লেখ্য, এ আয়াতটি ৭ম খণ্ডের ৭১ নং অধ্যায়ের ১নং আয়াতরূপে গত হয়েছে। সেখানে এর বিস্তারিত ব্যাখ্যা দ্রষ্টব্য।
আয়াতটির শিক্ষা
ক. প্রত্যেক মুমিনের কর্তব্য আত্মীয়-অনাত্মীয় নির্বিশেষে যে-কোনও মুমিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ হবে, তার প্রতি ভালোবাসা ও আন্তরিকতা প্রদর্শন করবে এবং হাসিমুখে তাকে গ্রহণ করবে।
খ. আয়াতটির শব্দসমূহের প্রতি লক্ষ করলে জানা যায় যে, কুরআন মাজীদের কোনও কোনও শব্দ তার প্রকৃত অর্থে নয়; বরং রূপক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। কাজেই আয়াতের অর্থ ও ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে সেদিকেও লক্ষ রাখা জরুরি।
দুই নং আয়াত
وَلَوْ كُنْتَ فَظًّا غَلِيظَ الْقَلْبِ لَانْفَضُّوا مِنْ حَوْلِكَ
অর্থ: তুমি যদি রূঢ় প্রকৃতির ও কঠোর হৃদয় হতে, তবে তারা তোমার আশপাশ থেকে সরে বিক্ষিপ্ত হয়ে যেত।(সূরা আলে ইমরান (৩), আয়াত ১৫৯)
ব্যাখ্যা
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অত্যন্ত কোমল চরিত্রের ছিলেন। তিনি সাহাবায়ে কেরামের প্রতি পিতার মতো আচরণ করতেন। সাক্ষাৎকালে চেহারায় আনন্দ প্রকাশ করতেন ও হাসিমুখে কথা বলতেন। এতে তারা তাঁর সঙ্গে সহজ হয়ে যেতেন। ফলে যে-কোনও কথা তাঁর সঙ্গে সচ্ছন্দে বলতে পারতেন। যে-কোনও প্রয়োজন অসংকোচে তাঁর সামনে পেশ করতে পারতেন। তাঁর প্রফুল্ল চেহারার সাক্ষাৎ ও হাসিমুখের কথা তাদের অন্তরে ভালোবাসার বীজ বুনে দিত। তারা যে তাঁর জন্য অকাতরে নিজেদের জান-মাল বিলিয়ে দিতেন, তা তাঁর সেই মধুর আচরণ ও প্রাণজুড়ানো হাসির ফল বৈ কি।
অনেক সময় তাদের দ্বারা ভুল-ত্রুটিও হয়ে যেত, কিন্তু তিনি তা ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখতেন এবং পরম মমত্বের সঙ্গে তাদের বোঝাতেন ও সংশোধন করে দিতেন। তাঁর ক্ষমাপরায়ণতা ও মমত্বসুলভ আচরণের ঘটনাবলি দ্বারা হাদীছ ও সীরাত গ্রন্থসমূহ ভরপুর। তা দ্বারা প্রমাণ হয় তিনি ব্যক্তিগত বিষয়ে কখনও কারও থেকে প্রতিশোধ নেননি। জীবনভর কেবল ক্ষমাই করে গেছেন। এটা তাঁর নবুওয়াতী গুণের এক দিক। তাঁর নবুওয়াতী গুণেরই আরেক দিক হল তিনি দীনী অন্যায়-অপরাধের ক্ষেত্রে খুবই কঠোর ছিলেন। সে কঠোরতা ছিল আল্লাহরই জন্য। আল্লাহ তা'আলাই নম্রতা প্রদর্শনের ক্ষেত্রে সীমারেখা নির্ধারণ করে দিয়েছেন। কারও দ্বারা যদি শরী'আতের অবমাননা হয়, সে ক্ষেত্রে কঠোরতাই কাম্য। বিভিন্ন ঘটনা দ্বারা তাঁর চরিত্রের এ দিকটিও সুস্পষ্ট হয়ে আছে।
উহুদের যুদ্ধে কতক সাহাবীর দ্বারা একটা ভুল হয়ে গিয়েছিল। সে ভুলের কারণে এ যুদ্ধে মুসলিমদের ব্যাপক হতাহতের শিকার হতে হয় এবং পরাজয়ও বরণ করতে হয়। এ অপূরণীয় ক্ষতির কারণে খুবই স্বাভাবিক ছিল যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অত্যন্ত মর্মাহত হবেন এবং যারা ভুল করেছিল তাদের প্রতি নারাজ হয়ে কঠোরতা প্রদর্শন করবেন। কিন্তু তা করতে গেলে ক্ষতিরও আশঙ্কা ছিল। এ আয়াতে সে ক্ষতির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে তাদের সঙ্গে নম্র-কোমল আচরণ করতে বলা হয়েছে। আল্লাহ তা'আলা বলেন-
وَلَوْ كُنْتَ فَظًّا غَلِيظَ الْقَلْبِ لَانْفَضُّوا مِنْ حَوْلِكَ (তুমি যদি রূঢ় প্রকৃতির ও কঠোর হৃদয় হতে, তবে তারা তোমার আশপাশ থেকে সরে বিক্ষিপ্ত হয়ে যেত)। অর্থাৎ নরম স্বভাবের হওয়ার কারণে আপনি সর্বদা সাহাবীদের প্রতি কোমল আচরণ করে এসেছেন। তাদের ভুল-ত্রুটি হলেও তা ক্ষমা করে দিয়েছেন। ক্ষমা না করে যদি কঠোর ও রুক্ষ আচরণ করতেন, তবে তারা এখন যেমন আপনার কাছে ভিড়ছে এবং আপনার জন্য জান-মাল সব উৎসর্গ করে দিচ্ছে, সেরকম করতে পারত না। তারা ভীত ও কুণ্ঠিত হয়ে থাকত। এক পর্যায়ে উৎসাহ-উদ্দীপনা হারিয়ে দূরেই সরে পড়ত। সে ক্ষেত্রে তাদের অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে যেত। আপনার সাহচর্যে লেগে থাকায় তারা দীন শিখতে পারছে, চারিত্রিক উন্নতি ঘটাতে পারছে এবং আল্লাহ তা'আলার রহমত ও করুণাধারায় সদা সিক্ত হয়ে থাকছে। তারা তাদের এ সৌভাগ্য এ কারণেই লাভ করতে পারছে যে, আপনি সর্বদাই তাদের প্রতি নম্র-কোমল আচরণ করে যাচ্ছেন। এ বাক্যের আগে আল্লাহ তা'আলা বলেছেন-
فَبِمَا رَحْمَةٍ مِنَ اللَّهِ لِنْتَ لَهُمْ (আল্লাহর রহমতেই তুমি তাদের প্রতি কোমল হৃদয় হয়েছ)। সুতরাং উহুদ যুদ্ধের এ ভুলের ক্ষেত্রেও আপনার হৃদয়ের সে কোমলতার দাবি আপনি তাদের ক্ষমা করে দেবেন। সুতরাং এর পরেই আল্লাহ তা'আলা বলছেন-
فَاعْفُ عَنْهُمْ وَاسْتَغْفِرْ لَهُمْ ‘তুমি তাদের ক্ষমা করে দাও এবং (আল্লাহর কাছেও) তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করো'। অর্থাৎ তাদের যে ভুলের সম্পর্ক ব্যক্তিগতভাবে আপনার সঙ্গে, তা আপনি ক্ষমা করে দিন। আর সে ভুলের যে সম্পর্ক আল্লাহ তা'আলার সঙ্গে, সেজন্য আপনি আল্লাহ তা'আলার কাছেও তাদের অনুকূলে ক্ষমা প্রার্থনা করুন, যাতে আল্লাহ তা'আলাও তাদের ক্ষমা করে দেন।
আয়াতটির শিক্ষা
ক. ব্যক্তিগত বিষয়ে মানুষের প্রতি ক্ষমাপরায়ণ থাকা ও নম্র-কোমল আচরণ করাই ছিল নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চরিত্র। আমাদেরও এ গুণ রপ্ত করতে হবে।
খ. দীনের অনুসরণীয় ব্যক্তি ও নেতৃবর্গের উচিত তাদের অনুসারী ও সাথী-সঙ্গীদের প্রতি মমত্বপূর্ণ আচরণ করা। এটা তাদের শিক্ষাদান ও তরবিয়াতের পক্ষে খুব বেশি সহায়ক।
গ. যখন যার সঙ্গেই সাক্ষাৎ হবে, তখন মুমিন ব্যক্তির কর্তব্য হবে তার প্রতি আন্তরিকতা প্রকাশ করা এবং তার সঙ্গে হাসিমুখে কথা বলা।
ঘ. অনুসারী ও অনুচরদের প্রতি কঠোর আচরণ অবাঞ্ছনীয়। এতে করে তারা ক্রমে দূরে সরে যায় এবং পরিণামে দীনী ও দুনিয়াবী দিক থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
মানুষ সামাজিক জীব হওয়ায় একের সঙ্গে অন্যের নানাবিধ প্রয়োজন থাকেই। অন্যের সাহায্য-সহযোগিতা নেওয়া ছাড়া কেউ চলতে পারে না। তাই নানা প্রয়োজনে একের সঙ্গে অন্যের দেখা-সাক্ষাতের প্রয়োজন পড়ে। পরস্পরে দেখা-সাক্ষাৎ করার দ্বারা প্রয়োজন পূরণ অনেক সহজ হয়।
মানুষের প্রয়োজন দুই রকম। পার্থিব প্রয়োজন ও দীনী প্রয়োজন। দেখা-সাক্ষাৎ করা দরকার হয় উভয় প্রয়োজন পূরণের জন্যই।
কেউ যখন তার দীনী বা দুনিয়াবী প্রয়োজনে কারও সঙ্গে সাক্ষাৎ করে, তখন তার উচিত সাক্ষাৎকারীকে আন্তরিকতার সঙ্গে গ্রহণ করা। উত্তম কথা বলা ও মুখে হাসি ফুটিয়ে তোলা আন্তরিকতার প্রকাশ। এর দ্বারা সাক্ষাৎপ্রার্থী বুঝতে পারে তার আগমনে সে বিরক্ত হয়নি; বরং খুশি হয়েছে। এতে করে সে যে উদ্দেশ্যে এসেছে তা পূরণ হবে বলে তার মনে আশা জন্মাবে। তাই ইসলাম মানুষকে উত্তম কথা বলার হুকুম করেছে।
কুরআন মাজীদে ইরশাদ-
وَقُولُوا لِلنَّاسِ حُسْنًا
‘মানুষের সাথে ভালো কথা বলবে।(সূরা বাকারা (২), আয়াত ৮৩)
অন্যত্র ইরশাদ-
وَقُلْ لِعِبَادِي يَقُولُوا الَّتِي هِيَ أَحْسَنُ
‘আমার (মুমিন) বান্দাদের বলে দাও, তারা যেন এমন কথাই বলে, যা উত্তম।'(সূরা বনী ইসরাঈল (১৭) আয়াত ৫৩)
মুমিন বান্দা হিসেবে উত্তম কথা আমাদের বলতেই হবে। কেননা আখেরে এর দ্বারা নিজেরই লাভ। এই যে অন্যের প্রয়োজন সমাধার কথা বলা হল, এটা তো এক মানবিক কাজ, যা দ্বারা আল্লাহ তা'আলা খুশি হন এবং এর অনেক ছাওয়াব। কাজেই অন্যের প্রয়োজন পূরণের সঙ্গে নিজ স্বার্থ জড়িত রয়েছে। পরকালীন স্বার্থ। তাই খুশিমনেই তা পূরণের চেষ্টা করা উচিত। বরং যে ব্যক্তি সাহায্য গ্রহণের জন্য এসেছে, তার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করাই বাঞ্ছনীয়। কারণ সে উপকার নিতে এসে প্রকৃতপক্ষে তারই উপকার করছে। কাজেই তার আগমনে সে যে খুশি, কথাবার্তা ও মুখের ভাব দ্বারা তা প্রকাশ করা উচিত।
উত্তম কথা ও মুখের হাসি দ্বারা আগন্তুককে খুশিও করা যায়। মানুষকে খুশি করা স্বতন্ত্র এক ছাওয়াবের কাজ। তাছাড়া খুশির সঙ্গে কারও প্রয়োজন সমাধা করলে তার পক্ষে তা গ্রহণ করা সহজ হয়। এতে মনে চাপ পড়ে না। উপকারকারীর কাছে নিজেকে ছোট মনে হয় না। সে ক্ষেত্রে তার দ্বারা কৃতজ্ঞতা প্রকাশও সহজ হয়।
যে ব্যক্তি মুখ ভার করে অন্যের উপকার করে, তার প্রতি উপকারগ্রহীতা স্বচ্ছন্দ হতে পারে না। উপকারগ্রহণটা তার মাথার উপর এক কঠিন বোঝা হয়ে থাকে। ফলে সে মনেপ্রাণে উপকারকারীর প্রতি কৃতজ্ঞ থাকতে পারে না। এ অবস্থায় অনেক সময় তার আচরণ উপকারকারীর কাছে অপ্রীতিকর বোধ হয়। তখন সে মনে মনে তাকে অকৃতজ্ঞ ঠাওরায়। কখনও মুখেও তা প্রকাশ করে। বহুলাংশেই এ অকৃতজ্ঞতার জন্য সে নিজেই দায়ী। সে উপকার করেছে বটে, কিন্তু আচরণটা সুন্দর করেনি। খুশিমনে করেনি।
সাক্ষাৎ যে কেবল প্রয়োজনের দায়েই হতে হবে, এমন কোনও কথা নেই। ইসলামী ভ্রাতৃত্ববোধের তাগিদেও এক মুসলিমের অপর মুসলিমের সঙ্গে সাক্ষাৎ করা উচিত। এতে আল্লাহ তা'আলা খুশি হন। এর অনেক ছাওয়াব। সুতরাং বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া কেবল সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে সাক্ষাৎ করাও একটি দীনী কাজ। সুতরাং কেউ যদি এ কারণেও সাক্ষাৎ করতে আসে, তখন তার সে আসাটাকে ভালোভাবে গ্রহণ করা উচিত। কেননা এ আসাটা একটি মহৎ কাজ। একে ভালোভাবে গ্রহণ করলে নিজেরও অনেক ছাওয়াব হবে। উভয়ের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব ও সম্প্রীতি দৃঢ় তো হবেই, যা কিনা আমাদের দীনের এক গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা।
মোটকথা সর্ববিচারেই কেউ সাক্ষাৎ করতে আসলে তাকে হাসিমুখে গ্রহণ করা উচিত এবং তার সঙ্গে ভালো ভালো কথা বলা উচিত। এ বিষয়ে কুরআন মাজীদ ও হাদীছের সুস্পষ্ট শিক্ষা রয়েছে। সে শিক্ষা সম্পর্কেই এ পরিচ্ছেদটির অবতারণা। আল্লাহ তা'আলা আমাদেরকে এর উপর আমল করার তাওফীক দান করুন।
‘সাক্ষাৎকালে উত্তম কথা বলা ও হাসিমুখে থাকা’ সম্পর্কিত দুটি আয়াত
এক নং আয়াত
وَاخْفِضْ جَنَاحَكَ لِلْمُؤْمِنِينَ
অর্থ: আর যারা ঈমান এনেছে তাদের জন্য তোমার (বাৎসল্যের) ডানা নামিলে দাও।(সূরা হিজর (১৫), আয়াত ৮৮)
ব্যাখ্যা
وَاخْفِضْ جَنَاحَكَ এর মূল অর্থ- তোমার ডানা নামিয়ে দাও। ‘ডানা নামানো’ দ্বারা মমত্বপূর্ণ আচরণ বোঝানো হয়। ‘মুমিনদের প্রতি ডানা নামিয়ে দাও’-এর অর্থ হবে- যারা তোমার প্রতি ঈমান এনেছে, তুমি তাদের প্রতি মমত্বের আচরণ করো, যাতে তারা তোমার কাছে কাছে থাকে, দূরে সরে না যায়।
সরাসরি এ আদেশটি করা হয়েছে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে, যাতে তিনি মুমিন-মুসলিমদের প্রতি নম্রকোমল আচরণ বজায় রাখেন। প্রকৃতপক্ষে তিনি সকলের প্রতি এরকম আচরণই করতেন। তারপরও তাঁকে এ আদেশ করার দ্বারা বিষয়টির গুরুত্ব তুলে ধরা হয়েছে, যাতে তাঁর উম্মতের প্রত্যেকেও সকলের সঙ্গে স্নেহ-মমতা ও ভালোবাসার আচরণ করে। সে আচরণের একটা দিক এইও যে, যখন যার সঙ্গে সাক্ষাৎ হবে, তাকে আন্তরিকতার সঙ্গে গ্রহণ করবে। চেহারায় আনন্দের ভাব ফুটিয়ে তুলবে এবং কথা বলবে হাসি দিয়ে। যদি রাশভারি চেহারায় সাক্ষাৎ করে, মুখে হাসি না থাকে, তবে আগুন্তুক ব্যক্তি অস্বস্তি বোধ করবে। সে ভাববে আমার আগমনে ইনি খুশি নন। ফলে সে পরে আর কখনও তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চাইবে না। এভাবে সে তার থেকে দূরে সরে যাবে। ফলে পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ব ও ভালোবাসার সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যাবে, যা কিছুতেই কাম্য নয়। ইসলাম তার অনুসারীদের পারস্পরিক সম্প্রীতি ও ভালোবাসার বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে থাকে। এটা ঈমানেরও অঙ্গ। তাই এদিকে বিশেষভাবে লক্ষ রাখা প্রয়োজন। প্রত্যেক মুমিনের কর্তব্য অপরাপর মুমিনদের উপর মমত্বের ডানা বিছিয়ে দেওয়া এবং সকলকে খুশিমনে ও উৎফুল্ল চেহারায় গ্রহণ করে নেওয়া।
উল্লেখ্য, এ আয়াতটি ৭ম খণ্ডের ৭১ নং অধ্যায়ের ১নং আয়াতরূপে গত হয়েছে। সেখানে এর বিস্তারিত ব্যাখ্যা দ্রষ্টব্য।
আয়াতটির শিক্ষা
ক. প্রত্যেক মুমিনের কর্তব্য আত্মীয়-অনাত্মীয় নির্বিশেষে যে-কোনও মুমিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ হবে, তার প্রতি ভালোবাসা ও আন্তরিকতা প্রদর্শন করবে এবং হাসিমুখে তাকে গ্রহণ করবে।
খ. আয়াতটির শব্দসমূহের প্রতি লক্ষ করলে জানা যায় যে, কুরআন মাজীদের কোনও কোনও শব্দ তার প্রকৃত অর্থে নয়; বরং রূপক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। কাজেই আয়াতের অর্থ ও ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে সেদিকেও লক্ষ রাখা জরুরি।
দুই নং আয়াত
وَلَوْ كُنْتَ فَظًّا غَلِيظَ الْقَلْبِ لَانْفَضُّوا مِنْ حَوْلِكَ
অর্থ: তুমি যদি রূঢ় প্রকৃতির ও কঠোর হৃদয় হতে, তবে তারা তোমার আশপাশ থেকে সরে বিক্ষিপ্ত হয়ে যেত।(সূরা আলে ইমরান (৩), আয়াত ১৫৯)
ব্যাখ্যা
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অত্যন্ত কোমল চরিত্রের ছিলেন। তিনি সাহাবায়ে কেরামের প্রতি পিতার মতো আচরণ করতেন। সাক্ষাৎকালে চেহারায় আনন্দ প্রকাশ করতেন ও হাসিমুখে কথা বলতেন। এতে তারা তাঁর সঙ্গে সহজ হয়ে যেতেন। ফলে যে-কোনও কথা তাঁর সঙ্গে সচ্ছন্দে বলতে পারতেন। যে-কোনও প্রয়োজন অসংকোচে তাঁর সামনে পেশ করতে পারতেন। তাঁর প্রফুল্ল চেহারার সাক্ষাৎ ও হাসিমুখের কথা তাদের অন্তরে ভালোবাসার বীজ বুনে দিত। তারা যে তাঁর জন্য অকাতরে নিজেদের জান-মাল বিলিয়ে দিতেন, তা তাঁর সেই মধুর আচরণ ও প্রাণজুড়ানো হাসির ফল বৈ কি।
অনেক সময় তাদের দ্বারা ভুল-ত্রুটিও হয়ে যেত, কিন্তু তিনি তা ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখতেন এবং পরম মমত্বের সঙ্গে তাদের বোঝাতেন ও সংশোধন করে দিতেন। তাঁর ক্ষমাপরায়ণতা ও মমত্বসুলভ আচরণের ঘটনাবলি দ্বারা হাদীছ ও সীরাত গ্রন্থসমূহ ভরপুর। তা দ্বারা প্রমাণ হয় তিনি ব্যক্তিগত বিষয়ে কখনও কারও থেকে প্রতিশোধ নেননি। জীবনভর কেবল ক্ষমাই করে গেছেন। এটা তাঁর নবুওয়াতী গুণের এক দিক। তাঁর নবুওয়াতী গুণেরই আরেক দিক হল তিনি দীনী অন্যায়-অপরাধের ক্ষেত্রে খুবই কঠোর ছিলেন। সে কঠোরতা ছিল আল্লাহরই জন্য। আল্লাহ তা'আলাই নম্রতা প্রদর্শনের ক্ষেত্রে সীমারেখা নির্ধারণ করে দিয়েছেন। কারও দ্বারা যদি শরী'আতের অবমাননা হয়, সে ক্ষেত্রে কঠোরতাই কাম্য। বিভিন্ন ঘটনা দ্বারা তাঁর চরিত্রের এ দিকটিও সুস্পষ্ট হয়ে আছে।
উহুদের যুদ্ধে কতক সাহাবীর দ্বারা একটা ভুল হয়ে গিয়েছিল। সে ভুলের কারণে এ যুদ্ধে মুসলিমদের ব্যাপক হতাহতের শিকার হতে হয় এবং পরাজয়ও বরণ করতে হয়। এ অপূরণীয় ক্ষতির কারণে খুবই স্বাভাবিক ছিল যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অত্যন্ত মর্মাহত হবেন এবং যারা ভুল করেছিল তাদের প্রতি নারাজ হয়ে কঠোরতা প্রদর্শন করবেন। কিন্তু তা করতে গেলে ক্ষতিরও আশঙ্কা ছিল। এ আয়াতে সে ক্ষতির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে তাদের সঙ্গে নম্র-কোমল আচরণ করতে বলা হয়েছে। আল্লাহ তা'আলা বলেন-
وَلَوْ كُنْتَ فَظًّا غَلِيظَ الْقَلْبِ لَانْفَضُّوا مِنْ حَوْلِكَ (তুমি যদি রূঢ় প্রকৃতির ও কঠোর হৃদয় হতে, তবে তারা তোমার আশপাশ থেকে সরে বিক্ষিপ্ত হয়ে যেত)। অর্থাৎ নরম স্বভাবের হওয়ার কারণে আপনি সর্বদা সাহাবীদের প্রতি কোমল আচরণ করে এসেছেন। তাদের ভুল-ত্রুটি হলেও তা ক্ষমা করে দিয়েছেন। ক্ষমা না করে যদি কঠোর ও রুক্ষ আচরণ করতেন, তবে তারা এখন যেমন আপনার কাছে ভিড়ছে এবং আপনার জন্য জান-মাল সব উৎসর্গ করে দিচ্ছে, সেরকম করতে পারত না। তারা ভীত ও কুণ্ঠিত হয়ে থাকত। এক পর্যায়ে উৎসাহ-উদ্দীপনা হারিয়ে দূরেই সরে পড়ত। সে ক্ষেত্রে তাদের অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে যেত। আপনার সাহচর্যে লেগে থাকায় তারা দীন শিখতে পারছে, চারিত্রিক উন্নতি ঘটাতে পারছে এবং আল্লাহ তা'আলার রহমত ও করুণাধারায় সদা সিক্ত হয়ে থাকছে। তারা তাদের এ সৌভাগ্য এ কারণেই লাভ করতে পারছে যে, আপনি সর্বদাই তাদের প্রতি নম্র-কোমল আচরণ করে যাচ্ছেন। এ বাক্যের আগে আল্লাহ তা'আলা বলেছেন-
فَبِمَا رَحْمَةٍ مِنَ اللَّهِ لِنْتَ لَهُمْ (আল্লাহর রহমতেই তুমি তাদের প্রতি কোমল হৃদয় হয়েছ)। সুতরাং উহুদ যুদ্ধের এ ভুলের ক্ষেত্রেও আপনার হৃদয়ের সে কোমলতার দাবি আপনি তাদের ক্ষমা করে দেবেন। সুতরাং এর পরেই আল্লাহ তা'আলা বলছেন-
فَاعْفُ عَنْهُمْ وَاسْتَغْفِرْ لَهُمْ ‘তুমি তাদের ক্ষমা করে দাও এবং (আল্লাহর কাছেও) তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করো'। অর্থাৎ তাদের যে ভুলের সম্পর্ক ব্যক্তিগতভাবে আপনার সঙ্গে, তা আপনি ক্ষমা করে দিন। আর সে ভুলের যে সম্পর্ক আল্লাহ তা'আলার সঙ্গে, সেজন্য আপনি আল্লাহ তা'আলার কাছেও তাদের অনুকূলে ক্ষমা প্রার্থনা করুন, যাতে আল্লাহ তা'আলাও তাদের ক্ষমা করে দেন।
আয়াতটির শিক্ষা
ক. ব্যক্তিগত বিষয়ে মানুষের প্রতি ক্ষমাপরায়ণ থাকা ও নম্র-কোমল আচরণ করাই ছিল নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চরিত্র। আমাদেরও এ গুণ রপ্ত করতে হবে।
খ. দীনের অনুসরণীয় ব্যক্তি ও নেতৃবর্গের উচিত তাদের অনুসারী ও সাথী-সঙ্গীদের প্রতি মমত্বপূর্ণ আচরণ করা। এটা তাদের শিক্ষাদান ও তরবিয়াতের পক্ষে খুব বেশি সহায়ক।
গ. যখন যার সঙ্গেই সাক্ষাৎ হবে, তখন মুমিন ব্যক্তির কর্তব্য হবে তার প্রতি আন্তরিকতা প্রকাশ করা এবং তার সঙ্গে হাসিমুখে কথা বলা।
ঘ. অনুসারী ও অনুচরদের প্রতি কঠোর আচরণ অবাঞ্ছনীয়। এতে করে তারা ক্রমে দূরে সরে যায় এবং পরিণামে দীনী ও দুনিয়াবী দিক থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
জাহান্নাম থেকে বাঁচার উপায়
হাদীছ নং: ৬৯২
হযরত আদী ইবন হাতিম রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, তোমরা (জাহান্নামের) আগুন থেকে বাঁচো, যদিও খেজুরের একটা টুকরার বিনিময়ে হয়। আর যে ব্যক্তি তাও পায় না, সে উত্তম কথার বিনিময়ে। -বুখারী ও মুসলিম
(সহীহ বুখারী: ১৪১৭; সহীহ মুসলিম: ১০১৬; সুনানে নাসাঈ ২৫৫২; বায়হাকী : ১০১৩১; মুসনাদে আহমাদ: ৩৬৭৯; তাবারানী, আল-মু'জামুল কাবীর : ৮০১৭)
হাদীছ নং: ৬৯২
হযরত আদী ইবন হাতিম রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, তোমরা (জাহান্নামের) আগুন থেকে বাঁচো, যদিও খেজুরের একটা টুকরার বিনিময়ে হয়। আর যে ব্যক্তি তাও পায় না, সে উত্তম কথার বিনিময়ে। -বুখারী ও মুসলিম
(সহীহ বুখারী: ১৪১৭; সহীহ মুসলিম: ১০১৬; সুনানে নাসাঈ ২৫৫২; বায়হাকী : ১০১৩১; মুসনাদে আহমাদ: ৩৬৭৯; তাবারানী, আল-মু'জামুল কাবীর : ৮০১৭)
كتاب الأدب
باب استحباب طيب الكلام وطلاقة الوَجه عند اللقاء
قَالَ الله تَعَالَى: {وَاخْفِضْ جَنَاحَكَ لِلْمُؤْمِنينَ} [الحجر: 88]، وقال تَعَالَى: {وَلَوْ كُنْتَ فَظًّا غَلِيظَ القَلْبِ لاَنْفَضُّوا مِنْ حَوْلِكَ} [آل عمران: 159].
قَالَ الله تَعَالَى: {وَاخْفِضْ جَنَاحَكَ لِلْمُؤْمِنينَ} [الحجر: 88]، وقال تَعَالَى: {وَلَوْ كُنْتَ فَظًّا غَلِيظَ القَلْبِ لاَنْفَضُّوا مِنْ حَوْلِكَ} [آل عمران: 159].
692 - وعن عدي بن حاتمٍ - رضي الله عنه - قَالَ: قَالَ رسول الله - صلى الله عليه وسلم: «اتَّقُوا النَّارَ وَلَوْ بِشِقِّ تَمْرَةٍ، فَمَنْ لَمْ يَجِدْ فَبِكَلِمَةٍ طَيِّبَةٍ». متفقٌ عَلَيْهِ. (1)

তাহকীক:
 হাদীসের ব্যাখ্যা
হাদীসের ব্যাখ্যাহাদীস নং: ৬৯৩
 বিবিধ আদব - শিষ্টাচারের অধ্যায়
৫ সাক্ষাৎকালে উত্তম কথা বলা ও হাসিমুখে থাকা
উত্তম কথার ছাওয়াব
হাদীছ নং: ৬৯৩
হযরত আবূ হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, উত্তম কথা এক সদাকা। -বুখারী ও মুসলিম
(সহীহ বুখারী : ২৭০৭; সহীহ মুসলিম: ১০০৯; মুসনাদে আহমাদ: ৮১৮৩; বায়হাকী : ৭৮২০; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ: ১৬৪৫)
হাদীছ নং: ৬৯৩
হযরত আবূ হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, উত্তম কথা এক সদাকা। -বুখারী ও মুসলিম
(সহীহ বুখারী : ২৭০৭; সহীহ মুসলিম: ১০০৯; মুসনাদে আহমাদ: ৮১৮৩; বায়হাকী : ৭৮২০; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ: ১৬৪৫)
كتاب الأدب
باب استحباب طيب الكلام وطلاقة الوَجه عند اللقاء
693 - وعن أَبي هريرة - رضي الله عنه: أنَّ النبيَّ - صلى الله عليه وسلم - قَالَ: «وَالكَلِمَةُ الطَّيِّبَةُ صَدَقَةٌ». متفقٌ عَلَيْهِ، (1) وَهُوَ بعض حديث تقدم بطولِه.

তাহকীক:
 হাদীসের ব্যাখ্যা
হাদীসের ব্যাখ্যাহাদীস নং: ৬৯৪
 বিবিধ আদব - শিষ্টাচারের অধ্যায়
৫ সাক্ষাৎকালে উত্তম কথা বলা ও হাসিমুখে থাকা
উৎফুল্ল চেহারায় সাক্ষাৎ করাও নেকীর কাজ
হাদীছ নং: ৬৯৪
হযরত আবূ যার্র রাযি. বলেন, একবার নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে লক্ষ্য করে বলেন, তুমি কিছুতেই কোনও নেক কাজকে তুচ্ছ মনে করো না, যদি তা তোমার ভাইয়ের সাথে হাসিমুখে সাক্ষাৎ করাও হয়। -মুসলিম
(সহীহ মুসলিম: ২৬২৬; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ: ১৬৮৯; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর: ৬৩৮৫; মুসনাদে আহমাদ: ১৪৭১)
হাদীছ নং: ৬৯৪
হযরত আবূ যার্র রাযি. বলেন, একবার নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে লক্ষ্য করে বলেন, তুমি কিছুতেই কোনও নেক কাজকে তুচ্ছ মনে করো না, যদি তা তোমার ভাইয়ের সাথে হাসিমুখে সাক্ষাৎ করাও হয়। -মুসলিম
(সহীহ মুসলিম: ২৬২৬; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ: ১৬৮৯; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর: ৬৩৮৫; মুসনাদে আহমাদ: ১৪৭১)
كتاب الأدب
88 - باب استحباب طيب الكلام وطلاقة الوَجه عند اللقاء
694 - وعن أَبي ذَرٍّ - رضي الله عنه - قَالَ: قَالَ لي رسول الله - صلى الله عليه وسلم: «لاَ تَحْقِرَنَّ مِنَ الْمَعْرُوفِ شَيْئًا، وَلَوْ أَنْ تَلْقَى أخَاكَ بوَجْهٍ طَلْقٍ». رواه مسلم (1).

তাহকীক:
 হাদীসের ব্যাখ্যা
হাদীসের ব্যাখ্যাহাদীস নং: ৬৯৫
 বিবিধ আদব - শিষ্টাচারের অধ্যায়
শ্রোতার সামনে কথা সুস্পষ্টভাবে বলা, যাতে সে বুঝতে পারে এবং প্রয়োজনে তার পুনরাবৃত্তি করা
মানুষের জন্য বাকশক্তি আল্লাহ তা'আলার এক বিরাট নি'আমত। এ কথা স্বরণ করিয়ে দিয়ে আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেন-
خَلَقَ الْإِنْسَانَ عَلَّمَهُ الْبَيَانَ
‘তিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। তাকে ভাব প্রকাশ করতে শিখিয়েছেন।’(সূরা আর-রাহমান (৫৫), আয়াত ৩-৪)
ভাষা ও বাকশক্তি মূলত ভাবপ্রকাশের জন্যই। কাজেই যে বক্তব্য দ্বারা মনের ভাব যথাযথভাবে প্রকাশ পায় না, সে কথা বলার বিশেষ সার্থকতা থাকে না। তাই বিজ্ঞজনেরা সর্বদা আপন বক্তব্য সুস্পষ্ট ভাষায় প্রদান করেছেন। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বিজ্ঞ মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর প্রতিটি বক্তব্য সুস্পষ্ট ভাষায় দিয়েছেন। তিনি সর্বদা লক্ষ রেখেছেন যাতে শ্রোতা তাঁর কথা ভালোভাবে বুঝতে পারে। শ্রোতাকে বোঝানোর উদ্দেশ্যে তিনি অনেক সময়ই একই কথা তিনবার পর্যন্ত বলেছেন। কুরআন মাজীদও এমনই এক গ্রন্থ। এ গ্রন্থের বাণীসমূহ অতি স্পষ্ট। কুরআন মাজীদ তার নিজের সম্পর্কে বলছে-
وَكُلَّ شَيْءٍ فَصَّلْنَاهُ تَفْصِيلًا
‘আমি সবকিছু পৃথক-পৃথকভাবে স্পষ্ট করে দিয়েছি।’(সূরা বনী ইসরাঈল (১৭), আয়াত ১২)
অন্যত্র ইরশাদ
قَدْ فَصَّلْنَا الْآيَاتِ لِقَوْمٍ يَعْلَمُونَ
‘আমি আয়াতসমূহ স্পষ্ট করে দিয়েছি সেইসকল লোকের জন্য, যারা জ্ঞানকে কাজে লাগায়।’(সূরা আন'আম (৬), আয়াত ৯৭)
এর দ্বারা আমরা কথাবার্তা সুস্পষ্টভাবে বলার শিক্ষা পাই। কথা স্পষ্টভাবে না বললে বিভ্রান্তি সৃষ্টির আশঙ্কা থাকে। অনেক সময় তা সৃষ্টি হয়েও যায়। এর ফলে অপ্রীতিকর অনেক ঘটনাও ঘটে যায়। বক্তা বলে এক কথা, কিন্তু শ্রোতা তা ভালোভাবে বুঝতে না পারার কারণে বোঝে অন্য কিছু। তাতে পারিবারিক ও সামাজিক নানা অনর্থ দেখা দেয়। অনেক সময়ই তা প্রতিকার করারও কোনও সুযোগ থাকে না। সে কথা যদি শরী'আত সম্পর্কিত হয়, তবে তো তার ক্ষতি ভয়াবহ। বক্তার কথা ভালোভাবে বুঝতে না পারার কারণে শ্রোতা হয়তো হালালকে হারাম, হারামকে হালাল, জায়েযকে নাজায়েয বা নাজায়েযকে জায়েয বুঝে বসবে। এমনকি ঈমান-আকীদা বিষয়েও সে ভুল কিছু বুঝে বসবে। আর এভাবে তার ঈমান-আকীদা ক্ষতিগ্রস্ত হবে কিংবা ভুল আমল করে ছাওয়াবের স্থানে গুনাহগার হবে।
কথার দ্বারা কাউকে বিভ্রান্তিতে ফেলা কিছুতেই সমীচীন নয়। এটা কথা বলার উদ্দেশ্যের পরিপন্থী। কথা তো বলাই হয় উদ্দিষ্ট বিষয়কে শ্রোতার কাছে পরিষ্কার করে দেওয়ার জন্য, যাতে সে বিষয়টি ভালোভাবে বুঝতে পারে এবং সে অনুযায়ী নিজ কর্তব্য স্থির করতে পারে। কাজেই কাউকে কোনও সংবাদ দেওয়া, কোনও ঘটনা সম্পর্কে অবহিত করা, কোনও বিষয়ে আদেশ বা নিষেধ করা ইত্যাদি যে-কোনও বিষয়ক কথা সুস্পষ্টভাবেই বলা উচিত। প্রয়োজনে সে কথার পুনরাবৃত্তিও করা যেতে পারে। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাই করতেন। সুতরাং এ বিষয়েও আমাদেরকে তাঁর অনুসরণ করতে হবে। সে লক্ষ্যেই ইমাম নববী রহ. এ পরিচ্ছেদটির অবতারণা করেছেন এবং এ বিষয়ক হাদীছ এতে উদ্ধৃত করেছেন।
মানুষের জন্য বাকশক্তি আল্লাহ তা'আলার এক বিরাট নি'আমত। এ কথা স্বরণ করিয়ে দিয়ে আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেন-
خَلَقَ الْإِنْسَانَ عَلَّمَهُ الْبَيَانَ
‘তিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। তাকে ভাব প্রকাশ করতে শিখিয়েছেন।’(সূরা আর-রাহমান (৫৫), আয়াত ৩-৪)
ভাষা ও বাকশক্তি মূলত ভাবপ্রকাশের জন্যই। কাজেই যে বক্তব্য দ্বারা মনের ভাব যথাযথভাবে প্রকাশ পায় না, সে কথা বলার বিশেষ সার্থকতা থাকে না। তাই বিজ্ঞজনেরা সর্বদা আপন বক্তব্য সুস্পষ্ট ভাষায় প্রদান করেছেন। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বিজ্ঞ মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর প্রতিটি বক্তব্য সুস্পষ্ট ভাষায় দিয়েছেন। তিনি সর্বদা লক্ষ রেখেছেন যাতে শ্রোতা তাঁর কথা ভালোভাবে বুঝতে পারে। শ্রোতাকে বোঝানোর উদ্দেশ্যে তিনি অনেক সময়ই একই কথা তিনবার পর্যন্ত বলেছেন। কুরআন মাজীদও এমনই এক গ্রন্থ। এ গ্রন্থের বাণীসমূহ অতি স্পষ্ট। কুরআন মাজীদ তার নিজের সম্পর্কে বলছে-
وَكُلَّ شَيْءٍ فَصَّلْنَاهُ تَفْصِيلًا
‘আমি সবকিছু পৃথক-পৃথকভাবে স্পষ্ট করে দিয়েছি।’(সূরা বনী ইসরাঈল (১৭), আয়াত ১২)
অন্যত্র ইরশাদ
قَدْ فَصَّلْنَا الْآيَاتِ لِقَوْمٍ يَعْلَمُونَ
‘আমি আয়াতসমূহ স্পষ্ট করে দিয়েছি সেইসকল লোকের জন্য, যারা জ্ঞানকে কাজে লাগায়।’(সূরা আন'আম (৬), আয়াত ৯৭)
এর দ্বারা আমরা কথাবার্তা সুস্পষ্টভাবে বলার শিক্ষা পাই। কথা স্পষ্টভাবে না বললে বিভ্রান্তি সৃষ্টির আশঙ্কা থাকে। অনেক সময় তা সৃষ্টি হয়েও যায়। এর ফলে অপ্রীতিকর অনেক ঘটনাও ঘটে যায়। বক্তা বলে এক কথা, কিন্তু শ্রোতা তা ভালোভাবে বুঝতে না পারার কারণে বোঝে অন্য কিছু। তাতে পারিবারিক ও সামাজিক নানা অনর্থ দেখা দেয়। অনেক সময়ই তা প্রতিকার করারও কোনও সুযোগ থাকে না। সে কথা যদি শরী'আত সম্পর্কিত হয়, তবে তো তার ক্ষতি ভয়াবহ। বক্তার কথা ভালোভাবে বুঝতে না পারার কারণে শ্রোতা হয়তো হালালকে হারাম, হারামকে হালাল, জায়েযকে নাজায়েয বা নাজায়েযকে জায়েয বুঝে বসবে। এমনকি ঈমান-আকীদা বিষয়েও সে ভুল কিছু বুঝে বসবে। আর এভাবে তার ঈমান-আকীদা ক্ষতিগ্রস্ত হবে কিংবা ভুল আমল করে ছাওয়াবের স্থানে গুনাহগার হবে।
কথার দ্বারা কাউকে বিভ্রান্তিতে ফেলা কিছুতেই সমীচীন নয়। এটা কথা বলার উদ্দেশ্যের পরিপন্থী। কথা তো বলাই হয় উদ্দিষ্ট বিষয়কে শ্রোতার কাছে পরিষ্কার করে দেওয়ার জন্য, যাতে সে বিষয়টি ভালোভাবে বুঝতে পারে এবং সে অনুযায়ী নিজ কর্তব্য স্থির করতে পারে। কাজেই কাউকে কোনও সংবাদ দেওয়া, কোনও ঘটনা সম্পর্কে অবহিত করা, কোনও বিষয়ে আদেশ বা নিষেধ করা ইত্যাদি যে-কোনও বিষয়ক কথা সুস্পষ্টভাবেই বলা উচিত। প্রয়োজনে সে কথার পুনরাবৃত্তিও করা যেতে পারে। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাই করতেন। সুতরাং এ বিষয়েও আমাদেরকে তাঁর অনুসরণ করতে হবে। সে লক্ষ্যেই ইমাম নববী রহ. এ পরিচ্ছেদটির অবতারণা করেছেন এবং এ বিষয়ক হাদীছ এতে উদ্ধৃত করেছেন।
বক্তব্য ও সালামের পুনরাবৃত্তি করা 
হাদীছ নং: ৬৯৫
হযরত আনাস রাযি. থেকে বর্ণিত যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন কোনও কথা বলতেন, তিনবার তার পুনরাবৃত্তি করতেন, যাতে তাঁর কাছ থেকে তা বুঝে নেওয়া হয়। তিনি যখন কোনও লোকসমষ্টির কাছে আসতেন এবং তাদেরকে সালাম বলতেন, তখন তাদেরকে সালাম বলতেন তিনবার। -বুখারী
(সহীহ বুখারী: ৯৫; জামে তিরমিযী: ২৭২৩; মুসনাদুল বাযযার: ৯৪১৮; হাকিম, আল মুস্তাদরাক: ৭৭১৬; বাগাবী, শারহুস সন্নাহ: ১৪১)
হাদীছ নং: ৬৯৫
হযরত আনাস রাযি. থেকে বর্ণিত যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন কোনও কথা বলতেন, তিনবার তার পুনরাবৃত্তি করতেন, যাতে তাঁর কাছ থেকে তা বুঝে নেওয়া হয়। তিনি যখন কোনও লোকসমষ্টির কাছে আসতেন এবং তাদেরকে সালাম বলতেন, তখন তাদেরকে সালাম বলতেন তিনবার। -বুখারী
(সহীহ বুখারী: ৯৫; জামে তিরমিযী: ২৭২৩; মুসনাদুল বাযযার: ৯৪১৮; হাকিম, আল মুস্তাদরাক: ৭৭১৬; বাগাবী, শারহুস সন্নাহ: ১৪১)
كتاب الأدب
باب استحباب بيان الكلام وإيضاحه للمخاطب وتكريره ليفهم إذا لَمْ يفهم إِلا بذلك
695 - عن أنسٍ - رضي الله عنه: أنَّ النَّبيَّ - صلى الله عليه وسلم - كَانَ إِذَا تَكَلَّمَ بِكَلِمَةً أعَادَهَا ثَلاَثًا حَتَّى تُفْهَمَ عَنْهُ، وَإِذَا أتَى عَلَى قَوْمٍ فَسَلَّمَ عَلَيْهِمْ سَلَّمَ عَلَيْهِمْ ثَلاثًا. رواه البخاري. (1)

তাহকীক:
 হাদীসের ব্যাখ্যা
হাদীসের ব্যাখ্যাহাদীস নং: ৬৯৬
 বিবিধ আদব - শিষ্টাচারের অধ্যায়
৬ শ্রোতার সামনে কথা সুস্পষ্টভাবে বলা, যাতে সে বুঝতে পারে এবং প্রয়োজনে তার পুনরাবৃত্তি করা
বক্তব্য যেন হয় সুস্পষ্ট
হাদীছ নং: ৬৯৬
হযরত আয়েশা রাযি. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কথা ছিল সুস্পষ্ট। যে-কেউ তা শুনত, ভালোভাবে বুঝতে পারত। -আবু দাউদ
(সুনানে আবু দাউদ: ৪৮৩৯; মুসান্নাফে ইবন আবী শায়বা ২৬২৯৬; নাসাঈ, আস সুনানুল কুবরা: ১০১৭৩; মুসনাদে আহমাদ: ২৫০৭৭; মুসনাদে ইসহাক ইবন রাহুয়াহ: ১৭০৪)
হাদীছ নং: ৬৯৬
হযরত আয়েশা রাযি. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কথা ছিল সুস্পষ্ট। যে-কেউ তা শুনত, ভালোভাবে বুঝতে পারত। -আবু দাউদ
(সুনানে আবু দাউদ: ৪৮৩৯; মুসান্নাফে ইবন আবী শায়বা ২৬২৯৬; নাসাঈ, আস সুনানুল কুবরা: ১০১৭৩; মুসনাদে আহমাদ: ২৫০৭৭; মুসনাদে ইসহাক ইবন রাহুয়াহ: ১৭০৪)
كتاب الأدب
باب استحباب بيان الكلام وإيضاحه للمخاطب وتكريره ليفهم إذا لَمْ يفهم إِلا بذلك
696 - وعن عائشة رضي الله عنها، قالت: كَانَ كَلاَمُ رسول الله - صلى الله عليه وسلم - كَلامًا فَصْلًا يَفْهَمُهُ كُلُّ مَنْ يَسْمَعُهُ. رواه أَبُو داود. (1)

তাহকীক:
 হাদীসের ব্যাখ্যা
হাদীসের ব্যাখ্যাহাদীস নং: ৬৯৭
 বিবিধ আদব - শিষ্টাচারের অধ্যায়
৭ সঙ্গীর যে কথা হারাম নয় অপর সঙ্গীর তা মনোযোগ দিয়ে শ্রবণ করা এবং আলেম ও ওয়ায়েজ কর্তৃক হাযিরীনে মজলিসকে নীরব হতে বলা
হাদীছ নং: ৬৯৭
হযরত জারীর ইবন আব্দুল্লাহ রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, বিদায় হজ্জে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বললেন, লোকদেরকে নীরব হতে বলো। অতঃপর তিনি বলেন, তোমরা যেন আমার পর কুফরীতে লিপ্ত হয়ে না পড় যে, তোমাদের একে অন্যের গর্দান উড়াতে থাকবে। -বুখারী ও মুসলিম
(সহীহ বুখারী: ১২১; সহীহ মুসলিম: ৬৫; সুনানে নাসাঈ ৪১৩১; সুনানে ইবন মাজাহ: ৩৯৪২; মুসনাদে আবু দাউদ তয়ালিসী: ৬৯৯; মুসনাদে আহমাদ: ১৯২৫৯; সুনানে দারিমী: ১৯৬২; নাসাঈ, আস সুনানুল কুবরা ৫৮৫১; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর: ২২৭৭; সহীহ ইবনে হিব্বান: ৫৯৪০)
হযরত জারীর ইবন আব্দুল্লাহ রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, বিদায় হজ্জে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বললেন, লোকদেরকে নীরব হতে বলো। অতঃপর তিনি বলেন, তোমরা যেন আমার পর কুফরীতে লিপ্ত হয়ে না পড় যে, তোমাদের একে অন্যের গর্দান উড়াতে থাকবে। -বুখারী ও মুসলিম
(সহীহ বুখারী: ১২১; সহীহ মুসলিম: ৬৫; সুনানে নাসাঈ ৪১৩১; সুনানে ইবন মাজাহ: ৩৯৪২; মুসনাদে আবু দাউদ তয়ালিসী: ৬৯৯; মুসনাদে আহমাদ: ১৯২৫৯; সুনানে দারিমী: ১৯৬২; নাসাঈ, আস সুনানুল কুবরা ৫৮৫১; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর: ২২৭৭; সহীহ ইবনে হিব্বান: ৫৯৪০)
كتاب الأدب
باب إصغاء الجليس لحديث جليسه الذي ليس بحرام واستنصات العالم والواعظ حاضري مجلسه
697 - عن جرير بن عبدِ اللهِ - رضي الله عنه - قَالَ: قَالَ لي رسول الله - صلى الله عليه وسلم - في حَجَّةِ الْوَدَاعِ: «اسْتَنْصِتِ النَّاسَ» ثُمَّ قَالَ: «لاَ تَرْجِعُوا بَعْدِي كُفّارًا يَضْرِبُ بَعْضُكُمْ رِقَابَ بَعْضٍ». متفقٌ عَلَيْهِ. (1)

তাহকীক:
 হাদীসের ব্যাখ্যা
হাদীসের ব্যাখ্যাহাদীস নং: ৬৯৮
 বিবিধ আদব - শিষ্টাচারের অধ্যায়
ওয়াজ-নসীহত করা ও তাতে মধ্যপন্থা রক্ষা
ওয়াজ ও নসীহত করা একটি মহান কাজ। মৌলিকভাবে এটা ছিল নবী-রাসূলগণের দায়িত্ব। পরবর্তীতে তাঁদের প্রতিনিধি হিসেবে উলামায়ে কেরাম এ দায়িত্ব পালন করে থাকেন। এ কাজের উদ্দেশ্য অনেক মহৎ। এর দ্বারা মানুষকে আল্লাহর দিকে ডাকা হয়। আল্লাহর বান্দাকে আল্লাহর সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। সুতরাং এটি অনেক বড় দায়িত্বশীল কাজ। দায়িত্বশীলতার সঙ্গেই এটা আঞ্জাম দেওয়া উচিত। কীভাবে এ দায়িত্ব পালন করতে হবে, তার নির্দেশনা পাওয়া যায় নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওয়াজ-নসীহতের ভেতর। তাঁর ওয়াজ-নসীহতের মধ্যে দৃষ্টিপাত করলে এর বিভিন্ন আদব-কায়দা ও রীতি-নীতি খুঁজে পাওয়া যায়। তার মধ্যে একটা হল মধ্যপন্থা। মধ্যপন্থারও বিভিন্ন দিক আছে। এ পরিচ্ছেদে বিশেষভাবে পরিমাণগত মধ্যপন্থা সম্পর্কে আলোচনা করা উদ্দেশ্য। অর্থাৎ ওয়াজ যেন অতি সংক্ষেপও না হয় এবং খুব বেশি লম্বাও না হয়। বরং মাঝামাঝি পরিমাণে হয়। অতি সংক্ষেপ হলে বিষয়বস্তু পরিষ্কার হয় না। শ্রোতা ভালোভাবে বুঝতে পারে না বক্তা তার উদ্দেশ্যে কী বলেছে। ফলে ওয়াজের উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়। আবার বেশি লম্বা হলেও শ্রোতা বিরক্ত হয়ে যায়। বিরক্তির সঙ্গে যে বয়ান শোনা হয়, তা অন্তরে রেখাপাত করে না। ফলে শ্রোতা সে ওয়াজ দ্বারা আমলে উজ্জীবিত হয় না। তাছাড়া বেশি লম্বা-চওড়া হওয়ার কারণে সব কথা মনেও থাকে না। এটাও ওয়াজের উদ্দেশ্যকে নস্যাৎ করে। সুতরাং মধ্যপন্থাই শ্রেয়। হাদীছেও এর প্রতি উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেও যে ওয়াজ-নসীহত করতেন, তা মাঝামাঝি পরিমাণই হত। হযরত জাবির ইবন সামুরা রাযি. বলেন-
كُنتُ أصَلِّي مَعَ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ، فَكَانَتْ صَلَاتُهُ قَصْدًا، وَخُطْبَتُهُ قَصْدًا
‘আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পেছনে নামায পড়তাম। তাঁর নামায হতো মধ্যম পরিমাণে এবং তাঁর ভাষণও হতো মধ্যম পরিমাণে।’(সহীহ মুসলিম : ৮৬৬; জামে' তিরমিযী: ৫০৭; সুনানে আবূ দাউদ: ১১০১; সুনানে নাসাঈ : ১৫৮২; মুসনাদুল বাযযার: ৪২৫৩; সহীহ ইবনে হিব্বান: ২৮০২; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা : ৫৭৬১; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর: ১৯৮৪; মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাক : ৫২৫৬; মুসান্নাফে ইবন আবী শায়বা: ৪৬৫৫; সুনানে দারিমী: ১৫৯৮; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ: ১০৭৪)
অপর এক হাদীছে আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-
أُمِرْتُ ، أَنْ أَتَجَوَّزَ فِي الْقَوْلِ، فَإِنَّ الْجَوَازَ هُوَ خَيْرٌ
আমাকে আদেশ করা হয়েছে যেন কথায় মধ্যপন্থা অবলম্বন করি। মধ্যপন্থাই শ্রেষ্ঠ।(সুনানে আবু দাউদ: ৫০০৮; বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান: ৪৬২১)
রিয়াযুস সালিহীনের বর্তমান এ পরিচ্ছেদটি সে সম্পর্কেই। এতে যে আয়াত ও হাদীছ উল্লেখ করা হয়েছে, তা ওয়াজ-নসীহতে মধ্যমপন্থা অবলম্বনের নির্দেশনা দেয়। আমরা সেসব আয়াত ও হাদীছের বঙ্গানুবাদ ও ব্যাখ্যা পেশ করছি। আল্লাহ তা'আলাই তাওফীকদাতা।
‘ওয়াজ-নসীহত করা ও তাতে মধ্যপন্থা রক্ষা’ সম্পর্কিত একটি আয়াত
ادْعُ إِلَى سَبِيلِ رَبِّكَ بِالْحِكْمَةِ وَالْمَوْعِظَةِ الْحَسَنَةِ
অর্থ: তুমি নিজ প্রতিপালকের পথে মানুষকে ডাকবে হিকমত ও সদুপদেশের মাধ্যমে।(সূরা নাহল (১৬), আয়াত ১২৫)
ব্যাখ্যা
এ আয়াতে দাওয়াত ও তাবলীগের অতি গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতি বর্ণিত হয়েছে। এ বাক্যটি আয়াতটির অংশবিশেষ। এর পরে আছে-
وَجَادِلْهُمْ بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ إِنَّ رَبَّكَ هُوَ أَعْلَمُ بِمَنْ ضَلَّ عَنْ سَبِيلِهِ وَهُوَ أَعْلَمُ بِالْمُهْتَدِينَ
‘আর (যদি কখনও বিতর্কের দরকার পড়ে, তবে) তাদের সাথে বিতর্ক করবে উৎকৃষ্ট পন্থায়। নিশ্চয়ই তোমার প্রতিপালক যারা তার পথ থেকে বিচ্যুত হয়েছে তাদের সম্পর্কে ভালোভাবেই জানেন এবং তিনি তাদের সম্পর্কেও পরিপূর্ণ জ্ঞাত, যারা সৎপথে প্রতিষ্ঠিত।’
দাওয়াতের তিনটি মূলনীতি
এ আয়াতে দাওয়াত ও তাবলীগের তিনটি মূলনীতি শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। তা হল- (ক) হিকমত (খ) সদুপদেশ ও (গ) উৎকৃষ্ট পন্থায় বিতর্ক।
হিকমতের মর্ম হল- সত্য-সঠিক বিষয়বস্তু অকাট্য দলীল-প্রমাণের মাধ্যমে স্থান- কাল-পাত্র বিবেচনায় রেখে উপস্থাপন করা। বিখ্যাত তাফসীরগ্রন্থ ‘আল-বাহরুল মুহীত’ -এ বলা হয়েছে-
إِنَّهَا الْكَلَامُ الصَّوَابُ الْوَاقِعُ مِنَ النَّفْسِ أَجْمَلَ مَوْقِع
‘হিকমত বলা হয় এমন সঠিক কথাকে, যা মানুষের অন্তরে চমৎকার রেখাপাত করে।'
এ ব্যাখ্যাটি অতি সুন্দর ও ব্যাপক অর্থবোধক। এর সারকথা হচ্ছে, আল্লাহর পথে ডাকতে হবে কুরআন মাজীদ, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীছ এবং অকাট্য দলীল-প্রমাণ দ্বারা। সেইসঙ্গে স্থান-কাল-পাত্রও বিবেচ্য। যাকে ডাকা হবে তার মর্যাদার দিকে লক্ষ রাখতে হবে। যেখানে শক্ত কথা বলার প্রয়োজন সেখানে শক্ত কথা বলা এবং যেখানে নরম কথা বলা দরকার সেখানে নরম কথা বলাও দাওয়াত ফলপ্রসূ হওয়ার পক্ষে সহায়ক। তাছাড়া যেখানে আড়ালে দাওয়াত দেওয়া প্রয়োজন সেখানে আড়ালে দেওয়া এবং যেখানে প্রকাশ্যে দেওয়া প্রয়োজন সেখানে প্রকাশ্যে দেওয়াও হিকমতের অন্তর্ভুক্ত।
এমনিভাবে এদিকেও লক্ষ রাখা জরুরি যাতে দাওয়াতের বক্তব্য পরিমিত হয়। যতটুকু কথা বলা দরকার তার বেশিও না হয় কমও না হয়। কম হলে শ্রোতা দাওয়াতের বিষয়বস্তু ভালোভাবে বুঝতে পারবে না। ফলে তার পক্ষে তা বিবেচনা করাও সম্ভব হবে না। এ অবস্থায় সে যে তা গ্রহণ করবে এমন আশা কীভাবে করা যায়? অন্যদিকে বক্তব্য প্রয়োজনের অতিরিক্ত লম্বা হলে তা শ্রোতার অন্তরে বিরক্তি সৃষ্টি করে। এরূপ ক্ষেত্রে শ্রোতা দাওয়াতদাতাকে আপন করে নেওয়ার বদলে তার কাছ থেকে মুক্তি পাওয়ার চেষ্টা করে। ফলে দাওয়াতের সবটা চেষ্টা পণ্ডশ্রমে পরিণত হয়। কাজেই হিকমতের দাবি হল দাওয়াতদাতা মাত্রাজ্ঞানের পরিচয় দেবে এবং তার দাওয়াতী বক্তব্য যাতে পরিমাণমতো হয় সেদিকে লক্ষ রাখবে।
সদুপদেশের অর্থ- যাকে দাওয়াত দেওয়া হবে তার কল্যাণ কামনার্থে হৃদয়গ্রাহী ভাষায় তাকে বোঝানোর চেষ্টা করা, যাতে তার মনে নম্রতা আসে এবং দাওয়াত গ্রহণের জন্য সে প্রস্তুত হয়ে যায়। এ ক্ষেত্রে তার মান-সম্মানের প্রতি লক্ষ রাখাও জরুরি। এমন কথা বলা কিছুতেই সমীচীন নয়, যা দ্বারা তার মান-সম্মানে আঘাত লাগতে পারে বা অন্য কোনওভাবে সে আহত হতে পারে। কেননা ‘মাওইযা’ (الْموْعِظَة) শব্দটির মূল অর্থের মধ্যে কল্যাণকামিতার একটি দিকও আছে। কাজেই উপদেশ এমনভাবে দেওয়া চাই, যাতে ব্যক্তি মনে করে উপদেশদাতা আমার একজন হিতাকাঙ্ক্ষী; আমার শত্রু নয়। তার উপদেশ আমার গ্রহণ করা উচিত। সুতরাং দাওয়াত দিতে গিয়ে যদি তার পক্ষে অসম্মানজনক বা অপ্রীতিকর কোনও শব্দ ব্যবহার করা হয় বা সেরকম কোনও ভাবভঙ্গি অবলম্বন করা হয়, তবে তাতে নসীহত কেবল ব্যর্থই হয় না; বরং উল্টো ফল ফলে। যাদেরকে দাওয়াত দেওয়া হয় তারা সম্পূর্ণ বিগড়ে যায়। পরবর্তীতে অন্য কারও উপদেশেও তারা কর্ণপাত করতে চায় না। এজন্যই মাওইযার সাথে ‘হাসানা’ বিশেষণটি ব্যবহার করা হয়েছে। বোঝানো উদ্দেশ্য, নসীহত যেন অবশ্যই উত্তম পন্থায় হয় এবং যা-কিছু নসীহত গ্রহণের পক্ষে বাধা তা এড়িয়ে চলা হয়।
আর উৎকৃষ্ট পন্থায় বিতর্ক করার অর্থ সত্য প্রতিষ্ঠা করা ও প্রতিপক্ষকে তা বোঝানোর নিয়তে সত্যনিষ্ঠার সাথে ভদ্রোচিত ভাষায় যথোপযুক্ত যুক্তি-তর্ক ও দলীল-প্রমাণ পেশ করা, প্রতিপক্ষের মনে আঘাত লাগতে পারে বা জেদ সৃষ্টি হতে পারে এ জাতীয় আচরণ পরিহার করা এবং সর্বাবস্থায় মাত্রাবোধ ও ন্যায়-ইনসাফের পরিচয় দেওয়া।
উদ্দেশ্য যখন মানুষের সামনে সত্য প্রতিষ্ঠিত করা এবং তাদেরকে সত্যগ্রহণে উৎসাহিত করা, তখন বিতর্কের পন্থা অবশ্যই ন্যায়নিষ্ঠ হওয়া উচিত এবং হওয়া উচিত হৃদয়গ্রাহী। আল্লাহ তা'আলা তো হযরত মূসা আলাইহিস-সালামের মতো জালীলুল-কদর নবীকে ফির‘আউনের মতো মহাপাপিষ্ঠ ব্যক্তির সামনে নম্র পন্থায় দাওয়াত পেশের হুকুম দিয়েছেন। ইরশাদ হয়েছে-
فَقُولَا لَهُ قَوْلًا لَيِّنًا لَعَلَّهُ يَتَذَكَّرُ أَوْ يَخْشَى (44)
‘তোমরা গিয়ে তার সাথে নম্র কথা বলবে। হয়তো সে উপদেশ গ্রহণ করবে অথবা (আল্লাহকে) ভয় করবে।’(সূরা তোয়াহা (২০), আয়াত ৪৪)
এমনিভাবে আহলে কিতাবের সঙ্গে বিতর্ক করা সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে-
وَلَا تُجَادِلُوا أَهْلَ الْكِتَابِ إِلَّا بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ
‘(হে মুসলিমগণ!) কিতাবীদের সাথে বিতর্ক করবে না উত্তম পন্থা ছাড়া।’(সূরা আনকাবূত (২৯), আয়াত ৪৬)
দীন ও শরী'আত সম্পর্কিত কোনও বিষয়ে বিতর্কের উদ্দেশ্য কেবলই দীন ও শরী'আতের সত্যতা ও শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করা, নিজ যোগ্যতা ও শ্রেষ্ঠত্ব জাহির করা নয়। তা জাহিরের চেষ্টা অহমিকার লক্ষণ ও সম্পূর্ণ নাজায়েয।
মোটকথা, আল্লাহর পথে ডাকার জন্য দা'ঈকে কুরআন মাজীদে বর্ণিত এ তিনটি মূলনীতি অবশ্যই অনুসরণ করতে হবে। দাওয়াত দেওয়া একটি উচ্চস্তরের দীনী কাজ। যে-কোনও দীনী কাজ কুরআন-হাদীছে বর্ণিত পন্থায় করাই বাঞ্ছনীয়। সেভাবে করলেই কৃতকার্যতা লাভের আশা থাকে। অন্যথায় সব মেহনত বৃথা যায়। আল্লাহ তা'আলা আমাদের সকলকে দা'ঈ হিসেবে কবুল করুন এবং তাঁর দেখানো পন্থায় দাওয়াতী মেহনতের তাওফীক দিন।
আয়াতটির শিক্ষা
ক. আপন আপন সামর্থ্য অনুযায়ী দীনী দাওয়াতের কাজ করে যাওয়া প্রত্যেক মুমিনের কর্তব্য।
খ. দাওয়াতদাতার অন্তরে ইখলাস থাকা জরুরি, যাতে তার দাওয়াত সত্যিই আল্লাহর দিকে হয়; নিজ যোগ্যতা ও দক্ষতার দিকে মানুষকে আকর্ষণ করা উদ্দেশ্য না হয়।
গ. দাওয়াতের কাজে হিকমত ও যথাযথ কৌশল অবলম্বন করা জরুরি। মধ্যপন্থা রক্ষা ও পরিমিতিবোধের পরিচয় দেওয়াও সে হিকমতের অংশ।
ঘ. দাওয়াত যেন অবশ্যই সদুপদেশের সঙ্গে হয়, কিছুতেই যেন কারও মনে আঘাত করা না হয় এবং অন্যকে ছোট করে নিজ বড়ত্ব জাহির করা না হয়, সেদিকে লক্ষ রাখা একান্ত জরুরি।
ওয়াজ ও নসীহত করা একটি মহান কাজ। মৌলিকভাবে এটা ছিল নবী-রাসূলগণের দায়িত্ব। পরবর্তীতে তাঁদের প্রতিনিধি হিসেবে উলামায়ে কেরাম এ দায়িত্ব পালন করে থাকেন। এ কাজের উদ্দেশ্য অনেক মহৎ। এর দ্বারা মানুষকে আল্লাহর দিকে ডাকা হয়। আল্লাহর বান্দাকে আল্লাহর সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। সুতরাং এটি অনেক বড় দায়িত্বশীল কাজ। দায়িত্বশীলতার সঙ্গেই এটা আঞ্জাম দেওয়া উচিত। কীভাবে এ দায়িত্ব পালন করতে হবে, তার নির্দেশনা পাওয়া যায় নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওয়াজ-নসীহতের ভেতর। তাঁর ওয়াজ-নসীহতের মধ্যে দৃষ্টিপাত করলে এর বিভিন্ন আদব-কায়দা ও রীতি-নীতি খুঁজে পাওয়া যায়। তার মধ্যে একটা হল মধ্যপন্থা। মধ্যপন্থারও বিভিন্ন দিক আছে। এ পরিচ্ছেদে বিশেষভাবে পরিমাণগত মধ্যপন্থা সম্পর্কে আলোচনা করা উদ্দেশ্য। অর্থাৎ ওয়াজ যেন অতি সংক্ষেপও না হয় এবং খুব বেশি লম্বাও না হয়। বরং মাঝামাঝি পরিমাণে হয়। অতি সংক্ষেপ হলে বিষয়বস্তু পরিষ্কার হয় না। শ্রোতা ভালোভাবে বুঝতে পারে না বক্তা তার উদ্দেশ্যে কী বলেছে। ফলে ওয়াজের উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়। আবার বেশি লম্বা হলেও শ্রোতা বিরক্ত হয়ে যায়। বিরক্তির সঙ্গে যে বয়ান শোনা হয়, তা অন্তরে রেখাপাত করে না। ফলে শ্রোতা সে ওয়াজ দ্বারা আমলে উজ্জীবিত হয় না। তাছাড়া বেশি লম্বা-চওড়া হওয়ার কারণে সব কথা মনেও থাকে না। এটাও ওয়াজের উদ্দেশ্যকে নস্যাৎ করে। সুতরাং মধ্যপন্থাই শ্রেয়। হাদীছেও এর প্রতি উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেও যে ওয়াজ-নসীহত করতেন, তা মাঝামাঝি পরিমাণই হত। হযরত জাবির ইবন সামুরা রাযি. বলেন-
كُنتُ أصَلِّي مَعَ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ، فَكَانَتْ صَلَاتُهُ قَصْدًا، وَخُطْبَتُهُ قَصْدًا
‘আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পেছনে নামায পড়তাম। তাঁর নামায হতো মধ্যম পরিমাণে এবং তাঁর ভাষণও হতো মধ্যম পরিমাণে।’(সহীহ মুসলিম : ৮৬৬; জামে' তিরমিযী: ৫০৭; সুনানে আবূ দাউদ: ১১০১; সুনানে নাসাঈ : ১৫৮২; মুসনাদুল বাযযার: ৪২৫৩; সহীহ ইবনে হিব্বান: ২৮০২; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা : ৫৭৬১; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর: ১৯৮৪; মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাক : ৫২৫৬; মুসান্নাফে ইবন আবী শায়বা: ৪৬৫৫; সুনানে দারিমী: ১৫৯৮; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ: ১০৭৪)
অপর এক হাদীছে আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-
أُمِرْتُ ، أَنْ أَتَجَوَّزَ فِي الْقَوْلِ، فَإِنَّ الْجَوَازَ هُوَ خَيْرٌ
আমাকে আদেশ করা হয়েছে যেন কথায় মধ্যপন্থা অবলম্বন করি। মধ্যপন্থাই শ্রেষ্ঠ।(সুনানে আবু দাউদ: ৫০০৮; বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান: ৪৬২১)
রিয়াযুস সালিহীনের বর্তমান এ পরিচ্ছেদটি সে সম্পর্কেই। এতে যে আয়াত ও হাদীছ উল্লেখ করা হয়েছে, তা ওয়াজ-নসীহতে মধ্যমপন্থা অবলম্বনের নির্দেশনা দেয়। আমরা সেসব আয়াত ও হাদীছের বঙ্গানুবাদ ও ব্যাখ্যা পেশ করছি। আল্লাহ তা'আলাই তাওফীকদাতা।
‘ওয়াজ-নসীহত করা ও তাতে মধ্যপন্থা রক্ষা’ সম্পর্কিত একটি আয়াত
ادْعُ إِلَى سَبِيلِ رَبِّكَ بِالْحِكْمَةِ وَالْمَوْعِظَةِ الْحَسَنَةِ
অর্থ: তুমি নিজ প্রতিপালকের পথে মানুষকে ডাকবে হিকমত ও সদুপদেশের মাধ্যমে।(সূরা নাহল (১৬), আয়াত ১২৫)
ব্যাখ্যা
এ আয়াতে দাওয়াত ও তাবলীগের অতি গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতি বর্ণিত হয়েছে। এ বাক্যটি আয়াতটির অংশবিশেষ। এর পরে আছে-
وَجَادِلْهُمْ بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ إِنَّ رَبَّكَ هُوَ أَعْلَمُ بِمَنْ ضَلَّ عَنْ سَبِيلِهِ وَهُوَ أَعْلَمُ بِالْمُهْتَدِينَ
‘আর (যদি কখনও বিতর্কের দরকার পড়ে, তবে) তাদের সাথে বিতর্ক করবে উৎকৃষ্ট পন্থায়। নিশ্চয়ই তোমার প্রতিপালক যারা তার পথ থেকে বিচ্যুত হয়েছে তাদের সম্পর্কে ভালোভাবেই জানেন এবং তিনি তাদের সম্পর্কেও পরিপূর্ণ জ্ঞাত, যারা সৎপথে প্রতিষ্ঠিত।’
দাওয়াতের তিনটি মূলনীতি
এ আয়াতে দাওয়াত ও তাবলীগের তিনটি মূলনীতি শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। তা হল- (ক) হিকমত (খ) সদুপদেশ ও (গ) উৎকৃষ্ট পন্থায় বিতর্ক।
হিকমতের মর্ম হল- সত্য-সঠিক বিষয়বস্তু অকাট্য দলীল-প্রমাণের মাধ্যমে স্থান- কাল-পাত্র বিবেচনায় রেখে উপস্থাপন করা। বিখ্যাত তাফসীরগ্রন্থ ‘আল-বাহরুল মুহীত’ -এ বলা হয়েছে-
إِنَّهَا الْكَلَامُ الصَّوَابُ الْوَاقِعُ مِنَ النَّفْسِ أَجْمَلَ مَوْقِع
‘হিকমত বলা হয় এমন সঠিক কথাকে, যা মানুষের অন্তরে চমৎকার রেখাপাত করে।'
এ ব্যাখ্যাটি অতি সুন্দর ও ব্যাপক অর্থবোধক। এর সারকথা হচ্ছে, আল্লাহর পথে ডাকতে হবে কুরআন মাজীদ, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীছ এবং অকাট্য দলীল-প্রমাণ দ্বারা। সেইসঙ্গে স্থান-কাল-পাত্রও বিবেচ্য। যাকে ডাকা হবে তার মর্যাদার দিকে লক্ষ রাখতে হবে। যেখানে শক্ত কথা বলার প্রয়োজন সেখানে শক্ত কথা বলা এবং যেখানে নরম কথা বলা দরকার সেখানে নরম কথা বলাও দাওয়াত ফলপ্রসূ হওয়ার পক্ষে সহায়ক। তাছাড়া যেখানে আড়ালে দাওয়াত দেওয়া প্রয়োজন সেখানে আড়ালে দেওয়া এবং যেখানে প্রকাশ্যে দেওয়া প্রয়োজন সেখানে প্রকাশ্যে দেওয়াও হিকমতের অন্তর্ভুক্ত।
এমনিভাবে এদিকেও লক্ষ রাখা জরুরি যাতে দাওয়াতের বক্তব্য পরিমিত হয়। যতটুকু কথা বলা দরকার তার বেশিও না হয় কমও না হয়। কম হলে শ্রোতা দাওয়াতের বিষয়বস্তু ভালোভাবে বুঝতে পারবে না। ফলে তার পক্ষে তা বিবেচনা করাও সম্ভব হবে না। এ অবস্থায় সে যে তা গ্রহণ করবে এমন আশা কীভাবে করা যায়? অন্যদিকে বক্তব্য প্রয়োজনের অতিরিক্ত লম্বা হলে তা শ্রোতার অন্তরে বিরক্তি সৃষ্টি করে। এরূপ ক্ষেত্রে শ্রোতা দাওয়াতদাতাকে আপন করে নেওয়ার বদলে তার কাছ থেকে মুক্তি পাওয়ার চেষ্টা করে। ফলে দাওয়াতের সবটা চেষ্টা পণ্ডশ্রমে পরিণত হয়। কাজেই হিকমতের দাবি হল দাওয়াতদাতা মাত্রাজ্ঞানের পরিচয় দেবে এবং তার দাওয়াতী বক্তব্য যাতে পরিমাণমতো হয় সেদিকে লক্ষ রাখবে।
সদুপদেশের অর্থ- যাকে দাওয়াত দেওয়া হবে তার কল্যাণ কামনার্থে হৃদয়গ্রাহী ভাষায় তাকে বোঝানোর চেষ্টা করা, যাতে তার মনে নম্রতা আসে এবং দাওয়াত গ্রহণের জন্য সে প্রস্তুত হয়ে যায়। এ ক্ষেত্রে তার মান-সম্মানের প্রতি লক্ষ রাখাও জরুরি। এমন কথা বলা কিছুতেই সমীচীন নয়, যা দ্বারা তার মান-সম্মানে আঘাত লাগতে পারে বা অন্য কোনওভাবে সে আহত হতে পারে। কেননা ‘মাওইযা’ (الْموْعِظَة) শব্দটির মূল অর্থের মধ্যে কল্যাণকামিতার একটি দিকও আছে। কাজেই উপদেশ এমনভাবে দেওয়া চাই, যাতে ব্যক্তি মনে করে উপদেশদাতা আমার একজন হিতাকাঙ্ক্ষী; আমার শত্রু নয়। তার উপদেশ আমার গ্রহণ করা উচিত। সুতরাং দাওয়াত দিতে গিয়ে যদি তার পক্ষে অসম্মানজনক বা অপ্রীতিকর কোনও শব্দ ব্যবহার করা হয় বা সেরকম কোনও ভাবভঙ্গি অবলম্বন করা হয়, তবে তাতে নসীহত কেবল ব্যর্থই হয় না; বরং উল্টো ফল ফলে। যাদেরকে দাওয়াত দেওয়া হয় তারা সম্পূর্ণ বিগড়ে যায়। পরবর্তীতে অন্য কারও উপদেশেও তারা কর্ণপাত করতে চায় না। এজন্যই মাওইযার সাথে ‘হাসানা’ বিশেষণটি ব্যবহার করা হয়েছে। বোঝানো উদ্দেশ্য, নসীহত যেন অবশ্যই উত্তম পন্থায় হয় এবং যা-কিছু নসীহত গ্রহণের পক্ষে বাধা তা এড়িয়ে চলা হয়।
আর উৎকৃষ্ট পন্থায় বিতর্ক করার অর্থ সত্য প্রতিষ্ঠা করা ও প্রতিপক্ষকে তা বোঝানোর নিয়তে সত্যনিষ্ঠার সাথে ভদ্রোচিত ভাষায় যথোপযুক্ত যুক্তি-তর্ক ও দলীল-প্রমাণ পেশ করা, প্রতিপক্ষের মনে আঘাত লাগতে পারে বা জেদ সৃষ্টি হতে পারে এ জাতীয় আচরণ পরিহার করা এবং সর্বাবস্থায় মাত্রাবোধ ও ন্যায়-ইনসাফের পরিচয় দেওয়া।
উদ্দেশ্য যখন মানুষের সামনে সত্য প্রতিষ্ঠিত করা এবং তাদেরকে সত্যগ্রহণে উৎসাহিত করা, তখন বিতর্কের পন্থা অবশ্যই ন্যায়নিষ্ঠ হওয়া উচিত এবং হওয়া উচিত হৃদয়গ্রাহী। আল্লাহ তা'আলা তো হযরত মূসা আলাইহিস-সালামের মতো জালীলুল-কদর নবীকে ফির‘আউনের মতো মহাপাপিষ্ঠ ব্যক্তির সামনে নম্র পন্থায় দাওয়াত পেশের হুকুম দিয়েছেন। ইরশাদ হয়েছে-
فَقُولَا لَهُ قَوْلًا لَيِّنًا لَعَلَّهُ يَتَذَكَّرُ أَوْ يَخْشَى (44)
‘তোমরা গিয়ে তার সাথে নম্র কথা বলবে। হয়তো সে উপদেশ গ্রহণ করবে অথবা (আল্লাহকে) ভয় করবে।’(সূরা তোয়াহা (২০), আয়াত ৪৪)
এমনিভাবে আহলে কিতাবের সঙ্গে বিতর্ক করা সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে-
وَلَا تُجَادِلُوا أَهْلَ الْكِتَابِ إِلَّا بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ
‘(হে মুসলিমগণ!) কিতাবীদের সাথে বিতর্ক করবে না উত্তম পন্থা ছাড়া।’(সূরা আনকাবূত (২৯), আয়াত ৪৬)
দীন ও শরী'আত সম্পর্কিত কোনও বিষয়ে বিতর্কের উদ্দেশ্য কেবলই দীন ও শরী'আতের সত্যতা ও শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করা, নিজ যোগ্যতা ও শ্রেষ্ঠত্ব জাহির করা নয়। তা জাহিরের চেষ্টা অহমিকার লক্ষণ ও সম্পূর্ণ নাজায়েয।
মোটকথা, আল্লাহর পথে ডাকার জন্য দা'ঈকে কুরআন মাজীদে বর্ণিত এ তিনটি মূলনীতি অবশ্যই অনুসরণ করতে হবে। দাওয়াত দেওয়া একটি উচ্চস্তরের দীনী কাজ। যে-কোনও দীনী কাজ কুরআন-হাদীছে বর্ণিত পন্থায় করাই বাঞ্ছনীয়। সেভাবে করলেই কৃতকার্যতা লাভের আশা থাকে। অন্যথায় সব মেহনত বৃথা যায়। আল্লাহ তা'আলা আমাদের সকলকে দা'ঈ হিসেবে কবুল করুন এবং তাঁর দেখানো পন্থায় দাওয়াতী মেহনতের তাওফীক দিন।
আয়াতটির শিক্ষা
ক. আপন আপন সামর্থ্য অনুযায়ী দীনী দাওয়াতের কাজ করে যাওয়া প্রত্যেক মুমিনের কর্তব্য।
খ. দাওয়াতদাতার অন্তরে ইখলাস থাকা জরুরি, যাতে তার দাওয়াত সত্যিই আল্লাহর দিকে হয়; নিজ যোগ্যতা ও দক্ষতার দিকে মানুষকে আকর্ষণ করা উদ্দেশ্য না হয়।
গ. দাওয়াতের কাজে হিকমত ও যথাযথ কৌশল অবলম্বন করা জরুরি। মধ্যপন্থা রক্ষা ও পরিমিতিবোধের পরিচয় দেওয়াও সে হিকমতের অংশ।
ঘ. দাওয়াত যেন অবশ্যই সদুপদেশের সঙ্গে হয়, কিছুতেই যেন কারও মনে আঘাত করা না হয় এবং অন্যকে ছোট করে নিজ বড়ত্ব জাহির করা না হয়, সেদিকে লক্ষ রাখা একান্ত জরুরি।
শিক্ষাদান ও ওয়াজ-নসীহতে মাঝে মাঝে বিরতি দেওয়া
হাদীছ নং: ৬৯৮
আবু ওয়াইল শাকীক ইবন সালামা রহ. বলেন, ইবন মাস‘উদ রাযি. প্রতি বৃহস্পতিবার আমাদেরকে নসীহত করতেন। (একদিন) এক ব্যক্তি বলল, হে আবূ আব্দুর রহমান! আমার বড় কামনা আপনি প্রতিদিন আমাদের নসীহত করুন। তিনি বললেন, শোনো হে! তাতে আমার বাধা এটাই যে, আমি তোমাদেরকে বিরক্ত করতে অপসন্দ করি। আমি তোমাদেরকে নসীহত করার জন্য উপযুক্ত সময়ের সন্ধান করি, যেমন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে নসীহত করার জন্য উপযুক্ত সময়ের সন্ধান করতেন- আমাদের বিরক্ত হয়ে পড়ার আশঙ্কায়। -বুখারী ও মুসলিম
(সহীহ বুখারী: ৭০; সহীহ মুসলিম: ২৮২১; জামে' তিরমিযী: ২৮৫৫; মুসনাদে আহমাদ: ৩৫৮২; মুসনাদে আবু দাউদ তয়ালিসী ২৫৩; মুসনাদুল হুমায়দী: ১০৭; মুসান্নাফে ইবন আবী শায়বা : ২৬৫১৫; মুসনাদুল বাযযার: ১৬৭০; নাসাঈ, আস সুনানুল কুবরা : ৫৮৫৮; মুসনাদে আবূ ইয়া'লা: ৫০৩২)
হাদীছ নং: ৬৯৮
আবু ওয়াইল শাকীক ইবন সালামা রহ. বলেন, ইবন মাস‘উদ রাযি. প্রতি বৃহস্পতিবার আমাদেরকে নসীহত করতেন। (একদিন) এক ব্যক্তি বলল, হে আবূ আব্দুর রহমান! আমার বড় কামনা আপনি প্রতিদিন আমাদের নসীহত করুন। তিনি বললেন, শোনো হে! তাতে আমার বাধা এটাই যে, আমি তোমাদেরকে বিরক্ত করতে অপসন্দ করি। আমি তোমাদেরকে নসীহত করার জন্য উপযুক্ত সময়ের সন্ধান করি, যেমন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে নসীহত করার জন্য উপযুক্ত সময়ের সন্ধান করতেন- আমাদের বিরক্ত হয়ে পড়ার আশঙ্কায়। -বুখারী ও মুসলিম
(সহীহ বুখারী: ৭০; সহীহ মুসলিম: ২৮২১; জামে' তিরমিযী: ২৮৫৫; মুসনাদে আহমাদ: ৩৫৮২; মুসনাদে আবু দাউদ তয়ালিসী ২৫৩; মুসনাদুল হুমায়দী: ১০৭; মুসান্নাফে ইবন আবী শায়বা : ২৬৫১৫; মুসনাদুল বাযযার: ১৬৭০; নাসাঈ, আস সুনানুল কুবরা : ৫৮৫৮; মুসনাদে আবূ ইয়া'লা: ৫০৩২)
كتاب الأدب
بابُ الوَعظ والاقتصاد فِيهِ
قَالَ الله تَعَالَى: {ادْعُ إِلَى سَبيلِ رَبِّكَ بالحِكْمَةِ وَالْمَوْعِظَةِ الْحَسَنَةِ} [النحل: 125].
قَالَ الله تَعَالَى: {ادْعُ إِلَى سَبيلِ رَبِّكَ بالحِكْمَةِ وَالْمَوْعِظَةِ الْحَسَنَةِ} [النحل: 125].
698 - وعن أَبي وائلٍ شقيقِ بن سَلَمَةَ، قَالَ: كَانَ ابنُ مَسْعُودٍ - رضي الله عنه - يُذَكِّرُنَا في كُلِّ خَمِيسٍ، فَقَالَ لَهُ رَجُلٌ: يَا أَبَا عَبْدِ الرَّحْمنِ، لَوَدِدْتُ أنَّكَ ذَكَّرْتَنَا كُلَّ يَوْمٍ، فَقَالَ: أمَا إنَّهُ يَمْنَعُنِي مِنْ ذَلِكَ أنَّي أكْرَهُ أَنْ أُمِلَّكُمْ، وَإنِّي أتَخَوَّلُكُمْ بِالْمَوْعِظَةِ، كَمَا كَانَ رسول الله - صلى الله عليه وسلم - يَتَخَوَّلُنَا بِهَا مَخَافَةَ السَّآمَةِ عَلَيْنَا. متفقٌ عَلَيْهِ. (1)
«يَتَخَوَّلُنَا»: يَتَعَهَّدُنَا.
«يَتَخَوَّلُنَا»: يَتَعَهَّدُنَا.

তাহকীক:
 হাদীসের ব্যাখ্যা
হাদীসের ব্যাখ্যাহাদীস নং: ৬৯৯
 বিবিধ আদব - শিষ্টাচারের অধ্যায়
৮ ওয়াজ-নসীহত করা ও তাতে মধ্যপন্থা রক্ষা
জুমু‘আর খুতবা বেশি লম্বা না করা
হাদীছ নং: ৬৯৯
হযরত আবুল ইয়াকযান আম্মার ইবন ইয়াসির রাযি. বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, কোনও ব্যক্তির সালাত দীর্ঘ করা ও বক্তৃতা ছোট করা তার ফকীহ (দীনের বুঝসম্পন্ন) হওয়ার আলামত। সুতরাং তোমরা নামায দীর্ঘ করো এবং বক্তৃতা সংক্ষেপ করো। -মুসলিম
(সহীহ মুসলিম: ৮৬৯; সুনানে দারিমী: ১৫৯৭; মুসনাদে আবু ইয়া'লা: ১৬৪২; সহীহ ইবনে খুযায়মা : ১৭৮২; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা: ৫৭৬৩; মুসনাদুল বাযযার: ১৩৯৮)
হাদীছ নং: ৬৯৯
হযরত আবুল ইয়াকযান আম্মার ইবন ইয়াসির রাযি. বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, কোনও ব্যক্তির সালাত দীর্ঘ করা ও বক্তৃতা ছোট করা তার ফকীহ (দীনের বুঝসম্পন্ন) হওয়ার আলামত। সুতরাং তোমরা নামায দীর্ঘ করো এবং বক্তৃতা সংক্ষেপ করো। -মুসলিম
(সহীহ মুসলিম: ৮৬৯; সুনানে দারিমী: ১৫৯৭; মুসনাদে আবু ইয়া'লা: ১৬৪২; সহীহ ইবনে খুযায়মা : ১৭৮২; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা: ৫৭৬৩; মুসনাদুল বাযযার: ১৩৯৮)
كتاب الأدب
بابُ الوَعظ والاقتصاد فِيهِ
699 - وعن أَبي اليقظان عمار بن ياسر رضي الله عنهما، قَالَ: سَمِعْتُ رسول الله - صلى الله عليه وسلم - يقول: «إنَّ طُولَ صَلاَةِ الرَّجُلِ، وَقِصَرَ خُطْبَتِهِ، مَئِنَّةٌ مِنْ فِقههِ، فأطِيلُوا الصَّلاَةَ وَأقْصِرُوا الْخُطْبَةَ». رواه مسلم. (1)
«مَئِنَّةٌ» بميم مفتوحة ثُمَّ همزة مكسورة ثُمَّ نون مشددة، أيْ: عَلاَمَةٌ دَالَّةٌ عَلَى فِقْهِهِ.
«مَئِنَّةٌ» بميم مفتوحة ثُمَّ همزة مكسورة ثُمَّ نون مشددة، أيْ: عَلاَمَةٌ دَالَّةٌ عَلَى فِقْهِهِ.

তাহকীক:
 হাদীসের ব্যাখ্যা
হাদীসের ব্যাখ্যা